পরমাণুর কেন্দ্র-পিণ্ডটিকে যতক্ষণ-না কোনো লোকসান ঘটে ততক্ষণ দুটো-চারটে ইলেকট্রন যদি ছিনিয়ে নেওয়া যায় তা হলে তার বৈদ্যুতের বাঁধা বরাদ্দে কিছু কমতি পড়তে পারে কিন্তু অপঘাতটা সাংঘাতিক হয় না। যদি ঐ কেন্দ্রবস্তুটার খাস তহবিলে লুটপাট সম্ভব হয় তা হলেই পরমাণুর জাত বদল হয়ে যায়।
পরমাণুর নিজের একান্ত ঐক্য নেই এ-খবরটা পেয়েই বিজ্ঞানীরা প্রথমটা আশা করেছিলেন যে, তাঁরা তেজ-ছুঁড়ে মারা গোলন্দাজ রেডিয়মকে লাগাবেন পরমাণুর মধ্যে ভেদ ঘটিয়ে তার কেন্দ্রসম্বলভাঙা লুটপাটের কাজে। কিন্তু লক্ষ্যটি অতিসূক্ষ্ম, নিশানা করা সহজ নয়, তেজের ঢেলা বিস্তর মারতে মারতে দৈবাৎ একটা লেগে যায়। তাই এরকম অনিশ্চিত লড়াই-প্রণালীর বদলে আজকাল প্রকাণ্ড যন্ত্র তৈরির আয়োজন হচ্ছে যাতে অতি প্রচণ্ড শক্তিমান বৈদ্যুত উৎপন্ন হয়ে পরমাণুর কেন্দ্রকেল্লার পাহারা ভেদ করতে পারে। সেখানে আছে প্রবল পালোয়ান-শক্তির পাহারা। আজ ঠিক যে-সময়টাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারবার জন্যে সহস্রঘ্নী যন্ত্রের উদ্ভাবন হচ্ছে ঠিক সেই সময়টাতেই বিশ্বের সূক্ষ্মতম পদার্থের অলক্ষ্যতম মর্ম বিদীর্ণ করবার জন্যে বিরাট বৈদ্যুতবর্ষণীর কারখানা বসল।
পূর্বেই বলেছি আল্ফাকণা স্বরূপ হারিয়ে হয়ে যায় হীলিয়ম গ্যাস। এটা কাজে লেগেছে পৃথিবীর বয়স প্রমাণ করতে। কোনো পাহাড়ের একখানা পাথরের মধ্যে যদি বিশেষ পরিমাণ হীলিয়ম গ্যাস দেখা যায়, তা হলে এই গ্যাসের পরিণতির নির্দিষ্ট সময় হিসাব করে ঐ পাহাড়ের জন্মকুষ্ঠি তৈরি করা যায়। এই প্রণালীর ভিতর দিয়ে পৃথিবীর বয়স বিচার করা হয়েছে।
ওজনের গুরুত্বে হাইড্রজেন গ্যাসের ঠিক উপরের কোঠাতেই পড়ে যে-গ্যাস তারই নাম দেওয়া হয়েছে হীলিয়ম। এই গ্যাস বিজ্ঞানীমহলে নূতন-জানা। এই গ্যাস প্রথম ধরা পড়েছিল সূর্যগ্রহণের সময়ে। সূর্য আপন চক্রসীমাটুকু ছাড়িয়ে বহুলক্ষ ক্রোশ দূর পর্যন্ত জলদ্বাষ্পের অতি সূক্ষ্ম উত্তরীয় উড়িয়ে থাকে, ঝরনা যেমন জলকণার কুয়াশা ছড়ায় আপনার চারি দিকে। গ্রহণের সময় সেই তার চার দিকের আগ্নেয় গ্যাসের বিস্তার দেখতে পাওয়া যায় দুরবীনে। এই দূরবিক্ষিপ্ত গ্যাসের দীপ্তিকে য়ুরোপীয় ভাষায় বলে করোনা, বাংলায় একে বলা যেতে পারে কিরীটিকা।
কিছুকাল আগে ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দের সূর্যগ্রহণের সুযোগে এই কিরীটিকা পরীক্ষা করবার সময় বর্ণলিপির নীলসীমানার দিকে দেখা গেল তিনটি অজানা সাদা রেখা। পণ্ডিতেরা ভাবলেন হয়তো কোনো একটি আগের জানা পদার্থ অধিক দহনে নূতন দশা পেয়েছে, এটা তারই চিহ্ন। কিংবা হয়তো একটা নতুন পদার্থই বা জানান দিল। এখনো তার ঠিকানা হল না।
১৮৬৮ খৃষ্টাব্দের গ্রহণের সময় বিজ্ঞানীদের এইরকমই একটা চমক লাগিয়েছিল। সূর্যের গ্যাসীয় বেড়ার ভিতর থেকে একটা লিপি এল তখনকার কোনো অচেনা পদার্থের। এই নূতন খবর-পাওয়া মৌলিক পদার্থের নাম দেওয়া হল হীলিয়ম, অর্থাৎ সৌরক। কেননা তখন মনে হয়েছিল এটা একান্ত সূর্যেরই অন্তর্গত গ্যাস। অবশেষে ত্রিশ বছর কেটে গেলে পরে বিখ্যাত রসায়নী র্যামজে এই গ্যাসের আমেজ পেলেন পৃথিবীর হাওয়ায় অতি সামান্য পরিমাণে। তখন স্থির হল পৃথিবীতে এ গ্যাস দুর্লভ। তার পরে দেখা গেল উত্তর-আমেরিকায় কোনো মেটে তেলের গহ্বরে যে-গ্যাস পাওয়া যায় তাতে যথেষ্ট পরিমাণে হীলিয়ম আছে। তখন একে কাজে লাগাবার সুবিধে হল। অত্যন্ত হালকা ব’লে এতদিন হাইড্রেজেন গ্যাস দিয়ে আকাশযানগুলোর উড়ন-শক্তির জোগান দেওয়া হত। কিন্তু হাইড্রেজেন গ্যাস ওড়াবার পক্ষে যেমন কেজো, জ্বালাবার পক্ষে তার চেয়ে কম না। এই গ্যাস অনেক মস্ত মস্ত উড়োজাহাজকে জ্বালিয়ে মেরেছে। হীলিয়ম গ্যাসের মধ্যে প্রচ্ছন্ন দুরন্ত জ্বলনচণ্ডী নেই, অথচ হাইড্রেজেন ছাড়া সকল গ্যাসের চেয়ে এ হালকা। তাই জাহাজ-ওড়ানোকে নিরাপদ করবার জন্যে তারই ব্যবহার চলতি হয়েছে। চিকিৎসাতেও কোনো কোনো রোগে এর প্রয়োগ শুরু হল।
পূর্বেই বলা হয়েছে পজিটিভ চার্জওয়ালা পদার্থ ও নেগেটিভ চার্জওয়ালা পদার্থ পরস্পরকে কাছে টানে কিন্তু একই জাতীয় চার্জওয়ালারা পরস্পরকে ঠেলে ফেলতে চায়। যতই তাদের কাছাকাছি করা যায় ততই উগ্র হয়ে ওঠে তাদের ঠেলার জোর। তেমনি বিপরীত চার্জওয়ালারা যতই পরস্পরের কাছে আসে তাদের টানের জোর ততই বেড়ে ওঠে। এইজন্যে যে-সব ইলেকট্রন কেন্দ্রবস্তুর কাছাকাছি থাকে তারা টানের জোর এড়াবার জন্যে দূরবর্তীদের চেয়ে দৌড়য় বেশি জোরে। সৌরমণ্ডলে যে-সব গ্রহ সূর্যের যত কাছে তাদের দৌড়ের বেগ ততই বেশি; দূরের গ্রহদের বিপদ কম, তারা অনেকটা ধীরেসুস্থে চলে।
এই ইলেকট্রন প্রোটনের ব্যাস সমস্ত পরমাণুর পঞ্চাশ হাজার ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ পরমাণুর মধ্যে শূণ্যতাই বেশি। একটা মানুষের দেহের সমস্ত পরমাণু যদি ঠেসে দেওয়া হয়, তা হলে তার থেকে একটা অদশ্যৃপ্রায় বস্তুবিন্দু তৈরি হবে।
দুই প্রোটনের পরস্পরের প্রতি বিমুখতার জোর যে কত, রসায়নী ফ্রেডরিক সডি তার হিসাব করে বলেছেন, এক গ্র৻াম পরিমাণ প্রোটন যদি ভূতলের এক মেরুতে রাখা যায় আর তার বিপরীত মেরুতে থাকে আর এক গ্র৻াম প্রোটন তা হলে এই সুদূর পথ পেরিয়ে তাদের উভয়েরই ঠেলা মারার জোর হবে প্রায় ছ শো মণের চাপে। এই যদি বিধি হয় তা হলে বোঝা শক্ত হয় পরমাণুকেন্দ্রের অতি সংকীর্ণ মণ্ডলীর মধ্যে একটির বেশি প্রোটন কেমন করে ঘেঁষাঘেঁষি মিলে থাকতে পারে। এই নিয়ম অনুসারে হাইড্রজেন যার পরমাণুকেন্দ্রে একেশ্বর প্রোটনের অধিকার, সে ছাড়া বিশ্বে আর কোনো পদার্থ তো টিঁকতেই পারে না; তা হলে তো বিশ্বজগৎ হয়ে ওঠে হাইড্রজেনময়।