আমরা বলি “ওষুধপত্র’। “ওষুধ’ বলতে কী বোঝায় তা জানা আছে, কিন্তু “পত্রটা’ যে কী তার সংজ্ঞা নির্ণয় করা অসম্ভব। ওটুকু অব্যক্তই রেখে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং ওতে অনেক কিছুই বোঝাতে পারে। হয়তো ফীবার্মিক্শ্চারের সঙ্গে মকরধ্বজ, ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপ্শন, থর্মমীটার, কুইনীনের বড়ি, হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের বাক্স। হয়তো তাও নয়। হয়তো কেবলমাত্র দু বোতল ডি-গুপ্ত। এমনি “মালপত্র’ “দলিলপত্র’ বিছানাপত্র’ প্রভৃতি শব্দে ব্যক্ত অব্যক্তের যুগলমিলন।
আর-একরকম জোড়মেলানো শব্দ আছে যেখানে দুই ভাগেরই এক মানে, কিংবা প্রায় সমান মানে; যেমন “লোকলস্কর’। এই “লস্কর’ শব্দে সব জায়গাতেই যে ফৌজ বোঝাতেই তা নয়; প্রায় ওতে “লোক’ শব্দের অর্থের সঙ্গে অনির্দিষ্ট লোকসঙ্ঘের ব্যাপকতা বোঝায়। অন্যরকম করে বলতে গেলে হয়ত বলতুম, হাজার হাজার লোক চলেছে; অথচ গুণে দেখলে হয়ত আড়াইশো’র বেশি লোক পাওয়া যেত না।
খুব “চড়চাপড়’ লাগালে : ওর মধ্যে চড়টা সুনিশ্চিত, চাপড়টা অনিশ্চিত। ওটা কি তবে একবার গালে চড়, একবার পিঠে চাপড়। খুব সম্ভব তা নয়। তবে কি অনেকগুলো চড়। হতেও পারে।
মারাধরা মারধোর : বর্ণিত ঘটনায় শুধু হয়তো মারাই হয়েছিল কিন্তু ধরা হয়নি। কিন্তু “মারধোর’ শব্দের দ্বারা মারটাকে সুনির্দিষ্ট সীমার বাইরে ব্যাপ্ত করা হল। যে উৎপাতটা ঘটেছিল তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলো এই শব্দে ইঙ্গিতের মধ্যে সেরে দেওয়া হয়েছে।
“কালিকিষ্টি’ এটা একটা ভঙ্গীওয়ালা কথা। শুধু “কালো’ বলে যখন মনে তৃপ্তি হয় না তখন তার সঙ্গে “কিষ্টি’ যোগ করে কালিমাকে আরও অবজ্ঞায় ঘনিয়ে তোলা হয়।
ভাবনাচিন্তা আপদবিপদ কাটাছাঁটা হাঁকডাক শব্দে অর্থের বিস্তার করে। শুধু “চিন্তা’ দুঃখজনক, কিন্তু “ভাবনাচিন্তা’ বিচিত্র এবং দীর্ঘায়িত।
স্বতন্ত্র শব্দে “আপদ’ কিংবা “বিপদ’ বলতে যে বিশেষ ঘটনা বোঝায়, যুক্ত শব্দে ঠিক তা বোঝায় না। “আপদবিপদ’ সমষ্টিগত, ওর মধ্যে অনির্দিষ্টভাবে নানাপ্রকার দুর্যোগের সম্ভাবনার সংকেত আছে।
“ধারধোর’ শব্দে ধার কথার উপরেও আর কিছু অস্পষ্টভাবে উদ্বৃত্ত থাকে। হয়তো, কাউকে ধ’রে পড়া। রূপক অর্থে শুধু “ছাই’ শব্দে তুচ্ছতা বোঝায় যথেষ্ট, এই অর্থে “ছাই’ শব্দের ব্যবহার হয়ে থাকে, যেমন : কী ছাই বকছ। কিন্তু “ছাইভস্ম কী যে বকছ’, এতে প্রলাপের বহর যেন বড়ো করে দেখানো হয়।
“হাঁড়িকুঁড়ি’ শব্দ সংক্ষেপে পাকশালার বহুবিধ আয়োজনের ছবি এনে দেয়। এরকম স্থলে তন্নতন্ন বর্ণনার চেয়ে অস্পষ্ট বর্ণনার প্রভাব বেশি। “মামলা-মকদ্দমা’ শব্দটা ব্রিটিশ আদালদের দীর্ঘপ্রলম্বিত বিপত্তির দ্বিপদী প্রতীক। এইজাতীয় শব্দের কতকগুলি নমুনা দেওয়া গেল : মাথামুণ্ডু মালমসলা গোনাগুন্তি চালচলন বাঁধাছাঁদা হাসিতামাশা বিয়েথাওয়া দেওয়াথোওয়া বেঁটেখাটো পাকাপোক্ত মায়াদয়া ছুটোছুটি কুটোকাটা কাঁটাখোঁচা ঘোরাফেরা নাচাকোঁদা জাঁকজমক গড়াপেটা জানাশোনা চাষাভুষো দাবিদাওয়া অদলবদল ছেলেপুলে নাতিপুতি।
বাংলাভাষা পরিচয় – ২২
২২
চলতি বাংলার আর-একটি বিশেষত্ব জানিয়ে দিয়ে এ বই শেষ করি। যাঁরা সাধু ভাষায় গদ্যসাহিত্যকে রূপ দিয়েছিলেন স্বভাবতই তাঁদের হাতে বাক্যবিন্যাসের একটা ধারা বাঁধা হয়েছিল।
তার প্রয়োজন নিয়ে তর্ক নেই। আমার বক্তব্য এই যে, এ বাঁধাবাঁধি বাংলা চলতি ভাষায় নয়।
কোথায় গেলেন তোমার দাদা, তোমার দাদা কোথায় গেলেন, গেলেন কেথায় তোমার দাদা, দাদা তোমার গেলেন কোথায়, কোথায় গেলেন দাদা তোমার : প্রথম পাঁচটি বাক্যে “গেলেন’ ক্রিয়াপদের উপর এবং শেষের বাক্যটিতে “কোথায়’ শব্দের উপর ঝোঁক দিয়ে এই সবকটা প্রয়োগই চলে। আশ্চর্য তোমার সাহস, কিংবা, রেখে দাও তোমার চালাকি, একেবারে ভাসিয়ে দিলে কেঁদে : সাধু ভাষার ছাঁদের চেয়ে এতে আরও বেশি জোর পৌঁছয়। যা থাকে অদৃষ্টে, যা করেন ভগবান, সে প’ড়ে আছে পিছনে : এ আমরা কেবল-যে বলি তা নয়, এইটেই বলি সহজে।
বাংলা ভাষার একটা বিপদ তার ক্রিয়াপদ নিয়ে; “ইল’ “তেছে’ “ছিল’-যোগে বিশেষ বিশেষ কালবাচক ক্রিয়ার সমাপ্তি। ক্রিয়াপদের এই একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি এড়াবার জন্যে লেখকদের সতর্ক থাকতে হয়। বাংলা বাক্যবিন্যাসে যদি স্বাধীনতা না থাকত তা হলে উপায় থাকত না। এই স্বাধীনতা আছে বটে, কিন্তু তাই বলে স্বৈরাচার নেই। “ভাসিয়ে একেবারে দিলে কেঁদে’ কিংবা “ভাসিয়ে দিলে একেবারে কেঁদে’ বলি নে। “সে প’ড়ে সবার আছে পিছনে’ কিংবা “রেখে চালাকি দাও তোমার’ হবার জো নেই। তার কারণ জোড়া ক্রিয়ার জোড় ভাঙা অবৈধ।
চলতি গদ্যের একটা নমুনা দেওয়া যাক। এতে সাধু গদ্যভাষার বাক্যপদ্ধতি অনেকটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে–
কুঞ্জবাবু চললেন মথুরায়। তাঁর ভাই মুকুন্দ যাবে স্টেশন পর্যন্ত। বৈজু দারোয়ান চলেছে মাঠাকরুনের পাল্কির পাশে পাশে, লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে, ছিটের মের্জাই গায়ে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ঘর সামলাবার জন্যে রয়ে গেছে ভরু সর্দার। টেমি কুকরটা ঘুমোচ্ছিল সিমেন্টের বস্তার উপর ল্যাজে মাথা গুঁজে, গোলমাল শুনে ছুটে এল এক লাফে। যত ওরা বারণ করে ততই কেঁই কেঁই ঘেউ-ঘেউ রবে মিনতি জানায়, ঘন ঘন নাড়ে বোঁচা ল্যাজটা। রেল লাইন থেকে শোনা যাচ্ছে মালগাড়ি আসার শব্দ। ডাকগাড়ি আসতে বাকি আছে বিশ মিনিট মাত্র। বিষম ব্যস্ত হয়ে পড়ল মুকুন্দ; সে যাবে কলকাতার দিকে, আজ সেখানে মোহনবাগানের ম্যাচ। ঐ বুঝি দেখা গেল সিগ্ন্যাল-ডাউন। এ দিকে নামল ঝমাঝম্ বৃষ্টি, তার সঙ্গে জোর হাওয়া। বেহারাগুলো পাল্কি নামালো অশথতলায়। হঠাৎ একটি ভিখিরি মেয়ে ছুটে এসে বললে, “দরজা খোলো মা, একবার মুখখানি দেখে নিই।’ দরজা খুলে চমকে উঠলেন গিন্নিঠাকরুন, “ওমা, ও কে গো! আমাদের বিনোদিনী যে! কে করলে ওর এ দশা!” কুকুরটা ওকে দেখেই লাফিয়ে উঠল, ওর বুকে দুই পা তুলে কাঁই-কাঁই করতে লাগল আনন্দে। বিনোদিনী একবার তার গলা জড়িয়ে ধরল দুই হাতে, তার পরেই ওকে সরিয়ে দিল, জোরে ঠেলা দিয়ে। গোলেমালে কোথায় মেয়েটি পালালো ঝড়ের আড়ালে, দেখা গেল না। চারি দিকে সন্ধানে ছুটল লোকজন। বড়োবাবু স্বয়ং হাঁকতে থাকলেন “বিনু বিনু’, মিলল না কোনো সাড়া। মুকুন্দ রইল তার সেকেণ্ড ক্লাসের গাড়িতে, রুমালে মুখ লুকিয়ে একেবারে চুপ। মেলগাড়ি কখন্ গেল বেরিয়ে। বৃষ্টির বিরাম নেই।
বাংলাভাষা পরিচয় – ২৩
২৩