- বইয়ের নামঃ বাংলা শব্দতত্ত্ব
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অনুবাদ-চর্চা
শান্তিনিকেতন পত্রের পাঠকদের নিকট হইতে একটি ইংরেজি অনুবাদের বাংলা তরজমা চাহিয়াছিলাম। কতকগুলির উত্তর পাইয়াছিলাম। সকল উত্তরের সমালোচনা করি এমন স্থান আমাদের নাই। ইহার মধ্যে যেটা হাতে ঠেকিল সেইটেরই বিচার করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। প্রথম বাক্যটি এই : At every stage of their growth our forest and orchard trees are subject to the attacks of hordes of insect enemies, which, if unchecked, would soon utterly destroy them। একজন তরজমা পাঠাইয়াছেন : “বৃদ্ধির প্রথম সোপানেই আমাদের আরণ্য ও উদ্দানস্থ ফল বৃক্ষ সমূহ কীটশত্রু সম্প্রদায় কর্তৃক আক্রমণের বিষয়ীভূত হয়, যাহারা প্রশমিত না হইলে অচিরেই তাহাদের সর্বতোভাবে বিনাশসাধন করিত।”
ইংরেজি বাক্য বাংলায় তরজমা করিবার সময় অনেকেই সংস্কৃত শব্দের ঘটা করিয়া থাকেন। বাংলা ভাষাকে ফাঁকি দিবার এই একটা উপায়। কারণ, এই শব্দগুলির পর্দার আড়ালে বাংলা ভাষারীতির বিরুদ্ধাচারণ অনেকটা ঢাকা পড়ে। বাংলা ভাষায় “যাহারা’ সর্বনামটি গণেশের মতো বাক্যের সর্বপ্রথম পূজা পাইয়া থাকে। “দস্যুদল পুলিসের হাতে ধরা পড়িল যাহারা গ্রাম লুটিয়াছিল’ বাংলায় এরূপ বলি না, আমরা বলি, “যাহারা গ্রাম লুটিয়াছিল সেই দস্যুদল পুলিসের হাতে ধরা পড়িল।’ The pilgrims took shelter in the temple, most of whom were starving–ইংরেজিতে এই “whom’ অসংগত নহে। কিন্তু বাংলায় ঐ বাক্যটি তরজমা করিবার বেলা যদি লিখি, “যাত্রীরা মন্দিরে আশ্রয় লইল যাহাদের অধিকাংশ উপবাস করিতেছিল’ তবে তাহা ঠিক শোনায় না। এরূপ স্থলে আমরা “যাহারা’ সর্বনামের বদলে “তাহারা’-সর্বনাম ব্যবহার করি। আমরা বলি “যাত্রীরা মন্দিরে আশ্রয় লইল, তাহারা অনেকেই উপবাসী ছিল’। অতএব আমাদের আলোচ্য ইংরেজি প্যারাগ্রাফে যেখানে “which’ আছে সেখানে “যাহারা’ না হইয়া “তাহারা’ হইবে।
“যে’ সর্বনাম সম্বন্ধে যে নিয়মের আলোচনা করিলাম তাহার ব্যতিক্রম আছে এখানে তাহার উল্লেখ থাকা আবশ্যক। “এমন’ সর্বনাম শব্দানুগত বাক্যাংশ বিকল্পে “যে’ সর্বনামের পূর্বে বসে। যথা ঃ “এমন গরিব আছে যাহার ঘরে হাঁড়ি চড়ে না।’ ইহাকে উল্টাইয়া বলা চলে “যাহার ঘরে হাঁড়ি চড়ে না এমন গরিবও আছে।’ “এমন জলচর জীব আছে যাহারা স্তন্যপায়ী এবং ভাসিয়া উঠিয়া যাহাদিগকে শ্বাস গ্রহণ করিতে হয়।’ এই “এমন’ শব্দ না থাকিলে বাক্যের শেষভাগে “যাহাদিগকে’ শব্দ ব্যবহার করা যায় না। যেমন, “তিমি জাতীয় স্তন্যপায়ী জলে বাস করে, ভাসিয়া উঠিয়া যাহাদিগকে শ্বাস গ্রহণ করিতে হয়’– ইহা ইংরেজি রীতি; বাংলা রীতিতে “যাহাদিগকে’ না বলিয়া “তাহাদিগকে’ বলিতে হইবে।
ইংরেজিতে subject শব্দের অনেকগুলি অর্থ আছে তাহার মধ্যে একটি অর্থ, আলোচ্য প্রসঙ্গ। ইহাকে আমরা বিষয় বলি। Subject of conversation, subject of discussion ইত্যাদির বাংলা– আলাপের বিষয়, তর্কের বিষয়। কিন্তু subject to cold “সর্দির বিষয়’ নহে। এরূপ স্থলে সংস্কৃত ভাষায় আস্পদ, পাত্র, ভাজন, অধীন, বশীভূত প্রভৃতি প্রয়োগ চলে। রোগাস্পদ, আক্রমণের পাত্র, মৃত্যুর বশীভূত ইত্যাদি প্রয়োগ চলিতে পারে।
আমাদের অনেক পত্রলেখকই subject কথাটাকে এড়াইয়া চলিয়াছেন। তাঁহারা লিখিয়াছেন কীটশত্রু “গাছগুলিকে আক্রমণ করে’। ইহাতে আক্রমণ ব্যাপারকে নিত্য ঘটনা বলিয়া স্বীকার করা হয়। কিন্তু subject to attack বলিলে বুঝায় এখনো আক্রমণ না হইলেও গাছগুলি আক্রমণের লক্ষ্য বটে।
ইংরেজি বাক্যটিকে আমি এইরূপ তরজমা করিয়াছি: “আমাদের বনের এবং ফলবাগানের গাছগুলি আপন বৃদ্ধিকালের প্রত্যেক পর্বে দলে দলে শত্রুকীটের আক্রমণ-ভাজন হইয়া থাকে; ইহারা বাধা না পাইলে শীঘ্রই গাছগুলিকে সম্পূর্ণ নষ্ট করিত।’
পত্রলেখকের তরজমা “বন্য ও ছায়াপাদপের ক্ষতি বলিতে কতটা ক্ষতি আমাদের বোধগম্য হয় তাহা বর্ণনা করা অপেক্ষা আমাদের অধিক উপলব্ধির বিষয়।’
“বর্ণনা করা অপেক্ষা অধিক উপলব্ধির বিষয়’ এরূপ প্রয়োগ চলে না। একটা কিছু “করার’ সঙ্গে আর-একটা কিছু “করার’ তুলনা চাই। “বর্ণনা করা অপেক্ষা উপলব্ধি করা সহজ’ বলিলে ভাষায় বাধিত না বটে কিন্তু উপলব্ধি করা এবং ভলতফভশন করা এক নহে।
আমাদের তরজমা: “আমাদের বন-বৃক্ষ এবং ছায়াতরুগুলির বিনাশ বলিতে যে কতটা বুঝায় তাহা বর্ণনা করা অপেক্ষা কল্পনা করা সহজ।’
‘Wood enters into so many products, that it is difficult to think of civilised man without it, while the fruits of the orchards are of the greatest importance.’
পত্রলেখকের তরজমা : “কাষ্ঠ হইতে এত দ্রব্য উৎপন্ন হয় যে, সভ্য মানবের পক্ষে উহাকে পরিহার করিবার চিন্তা অত্যন্ত কঠিন, এদিকে আমাদের উদ্যানজাত ফলসমূহও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়।’
কাষ্ঠ হইতে দ্রব্য নির্মিত হয়, উৎপন্ন হয় না। এখানে “উহাকে’ শব্দের “কে’ বিভক্তিচিহ্ন চলিতে পারে না। “ফল সমূহ সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়’ বলিলে অত্যুক্তি করা হয়। ইংরেজিতে “are of the greatest importance’ বলিতে এই বুঝায় যে পৃথিবীতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়তা যে-সকল জিনিসের আছে, ফলও তাহার মধ্যে একটি। “সভ্য মানুষের পক্ষে উহাকে পরিহার করিবার চিন্তা অত্যন্ত কঠিন’ ইহা মূলের অনুগত হয় নাই।
আমাদের তরজমা: “কাঠ আমাদের এতপ্রকার সামগ্রীতে লাগে যে ইহাকে বাদ দিয়া সভ্য মানুষের অবস্থা চিন্তা করা কঠিন; এদিকে ফলবাগানের ফলও আমাদের যার-পর-নাই প্রয়োজনীয়।’
বলা বাহুল্য “যার-পর-নাই’ কথাটা শুনিতে যত একান্ত বড়ো, ব্যবহারে ইহার অর্থ তত বড়ো নহে।
‘Fortunately, the insect foes of trees are not without their own persistent enemies, and among them are many species of brids, whose equipment and habits specially fit them to deal with insects and whose entire lives are spent in pursuit of them.’
পত্রলেখকের তরজমা : “সৌভাগ্যক্রমে বৃক্ষের কীট-অরিগণও নিজেরা তাহাদের স্থায়ী শত্রুহস্ত হইতে মুক্ত নয়, এবং তাহাদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে, যাহাদিগকে তাহাদের অভ্যাস ও দৈহিক উপকরণগুলি বিশেষভাবে কীটদিগের সহিত সংগ্রামে উপযোগী করিয়াছে এবং যাহাদিগের সমস্ত জীবন তাহাদিগকে অনুধাবন করিতে ব্যয়িত হয়।’
“যে’ সর্বনাম শব্দের প্রয়োগ সম্বন্ধে পূর্বেই আমাদের বক্তব্য জানাইয়াছি।
আমাদের তরজমা : “ভাগ্যক্রমে বৃক্ষের শত্রু-কীট-সকলেরও নিজেদের নিত্যশত্রুর অভাব নাই; এই শত্রুদের মধ্যে এমন অনেক জাতীয় পাখি আছে যাহাদের যুদ্ধোপকরণ এবং অভ্যাস সকল কীট-আক্রমণের পক্ষে বিশেষ উপযোগী এবং যাহারা কীট শিকারেই সমস্ত জীবন যাপন করে।’
ইংরেজিতে persistent কথাটি নিতান্ত সহজ। কথ্য বাংলায় আমরা বলি নাছোড়বান্দা। কিন্তু লেখায় সব জায়গায় ইহা চলে না। আমাদের একজন পত্রলেখক “দৃঢ়াগ্রহ’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। কিন্তু “আগ্রহ’ শব্দে, অন্তত বাংলায়, প্রধানত একটি মনোধর্ম বুঝায়। নিষ্ঠা শব্দেও সেইরূপ। Persistent শব্দের অর্থ, যাহা নিরন্তর লাগিয়াই আছে। “নির্বন্ধ’ শব্দটিতে সেই লাগিয়া থাকা অর্থ আছে; “দৃঢ়নির্বন্ধ’ কথাটা বড়ো বেশি অপরিচিত। এখানে কেবল মাত্র “নিত্য’ বিশেষণ যোগে ইংরেজি শব্দের ভাব স্পষ্ট হইতে পারে।
আমাদের আলোচ্য ইংরেজি প্যারাগ্রাফে একটি বাক্য আছে “among them are many species of birds’; আমাদের একজন ছাত্র এই speciesশব্দকে “উপজাতি’ প্রতিশব্দ দ্বারা তরজমা করিয়াছে। গতবারে “প্রতিশব্দ’ প্রবন্ধে আমরাই species-এর বাংলা “উপজাতি’ স্থির করিয়াছিলাম অথচ আমরাই এবারে কেন many ‘species of birds’-কে “নানাজাতীয় পক্ষী’ বলিলাম তাহার কৈফিয়ত আবশ্যক। মনে রাখিতে হইবে এখানে ইংরেজিতে species পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয় নাই। এখানে কোনো বিশেষ একটি মহাজাতীয় পক্ষীরই উপজাতিকে লক্ষ্য করিয়া species কথা বলা হয় নাই। বস্তুত কীটের যে-সব শত্রু আছে তাহারা নানা জাতিরই পক্ষী– কাকও হইতে পারে শালিকও হইতে পারে, শুধু কেবল কাক এবং দাঁড়কাক শালিক এবং গাঙশালিক নহে। বস্তুত সাধারণ ব্যবহারে অনেক শব্দ আপন মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া চলে, কেহ তাহাতে আপত্তি করে না, কিন্তু পারিভাষিক ব্যবহারে কঠোরভাবে নিয়ম মানিয়া চলিতে হয়। যেমন বন্ধুর নিমন্ত্রণক্ষেত্রে মানুষ নিয়মের দিকে দৃষ্টি রাখে না, সামাজিক নিমন্ত্রণে তাহাকে নিয়ম বাঁচাইয়া চলিতে হয়– এও সেইরূপ।
আমাদের তরজমায় আমরা অর্থ স্পষ্ট করিবার খাতিরে দুই-একটা বাড়তি শব্দ বসাইয়াছি। যেমন শেষ বাক্যে মূলে যেখানে আছে, “and among them are many species of birds’, আমরা লিখিয়াছি “এই শত্রুদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে’– অবিকল অনুবাদ করিলে লিখিতে হইত “এবং তাহাদের মধ্যে ইত্যাদি’। ইংরেজিতে একটি সাধারণ নিয়ম এই যে, সর্বনাম শব্দ তাহার পূর্ববর্তী নিকটতম বিশেষ্য শব্দের সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট। এ স্থলে them সর্বনামের অনতিপূর্বেই আছে enemies, এইজন্য এখানে “তাহাদের’ বলিলেই শত্রুদের বুঝাইবে। বাংলায় এ নিয়ম পাকা নহে, এইজন্য, “তাহাদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে’ বলিলে যদি কেহ হঠাৎ বুঝিয়া বসেন, “গাছেদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে, অর্থাৎ পক্ষী বাসা বাঁধিয়া থাকে’ তবে তাঁহাকে খুব দোষী করা যাইবে না।
ইংরেজিতে “and’, আর বাংলায় “এবং’ শব্দের প্রয়োগ-ভেদ আছে। সেটা এখানে বলিয়া লই। “তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তাহারা খবরের কাগজে তাঁহার নিন্দা করে’ এই বাক্যটা ইংরেজি ছাঁচের হইল। এ স্থলে আমরা “এবং’ ব্যবহার করি না। “তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তাহারা সরকারের বেতনভোগী’। এখানেও “এবং’ বাংলায় চলে না। “তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তিনি তাহাদিগকে গ্রাহ্য করেন না’ এরূপ স্থলে হয় “এবং’ বাদ দিই অথবা “কিন্তু’ বসাই। তাহার কারণ, “আছে’র সঙ্গে “আছে’, “করে’র সঙ্গে ক’রে, “হয়’-এর সঙ্গে “হয়’ মেলে, “আছে’র সঙ্গে “করে’, “করে’র সঙ্গে “হয়’ মেলে না। “তাঁহার শত্রু আছে এবং তাঁহার তিনটে মোটর গাড়ি আছে’– এই দুটি অসংশ্লিষ্ট সংবাদের মাঝখানেও “এবং’ চলে কিন্তু তাঁহার শত্রু আছে এবং তিনি শৌখিন লোক’ এরূপ স্থলে “এবং’ চলে না, কেননা “তাঁর আছে’ এবং “তিনি হন’ এ দুটো বাক্যের মধ্যে ভাষার গতি দুই দিকে। এগুলো যেন ভাষার অসবর্ণ বিবাহ, ইংরেজিতে চলে বাংলায় চলে না। ইংরেজির সঙ্গে বাংলার এই সূক্ষ্ম প্রভেদগুলি অনেক সময় অসতর্ক হইয়া আমরা ভুলিয়া যাই।
শব্দযুক্ত ইংরেজি বাক্যে তরজমা করিতে গিয়া বার বার দেখিয়াছি তাহার অনেক স্থলেই বাংলায় “এবং’ শব্দ খাটে না। তখন আমার এই মনে হইয়াছে “এবং’ শব্দটা লিখিত বাংলায় পণ্ডিতদের কর্তৃক নূতন আমদানি, ইহার মানে “এইরূপ’। “আর’ শব্দ “অপর’ শব্দ হইতে উৎপন্ন, তাহার মানে “অন্যরূপ’। “তাঁহার ধন আছে এবং মান আছে’ বলিলে বুঝায় তাঁহার যেমন ধন আছে সেইরূপ মানও আছে। “তিনি প’ড়ে গেলেন, আর, একটা গাড়ি তাঁর পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল’– এখানে পড়িয়া যাওয়া একটা ঘটনা, অন্য ঘটনাটা অপর প্রকারের, সেইজন্য “আর’ শব্দটা খাটে। “তিনি পড়িয়া গেলেন এবং আঘাত পাইলেন’ এখানে দুইটি ঘটনার প্রকৃত যোগ আছে। “তিনি পড়িয়া গেলেন এবং তাঁহার পায়ের উপর দিয়া গাড়ি চলিয়া গেল’, এখানে “এবং’ শব্দটা বেখাপ। এরূপ বেখাপ প্রয়োগ কেহ করেন না বা আমি করি না এমন কথা বলি না কিন্তু ইহা যে বেখাপ তাহার উদাহরণ গতবারের শান্তিনিকেতন পত্রে কিছু কিছু দিয়াছি। He has enemies and they are paid by the Government ইহার বাংলা, “তাঁর শত্রু আছে; তারা সরকারের বেতন খায়’। এখানে “এবং’ কথাটা অচল। তাহার কারণ, এখানে দুই ঘটনা দুইরূপ। “তাঁহার পুত্র আছে এবং কন্যা আছে।’ “তাঁহার গাড়ি আছে এবং ঘোড়া আছে।’ এ-সব জায়গায় “এবং’ জোরে আপন আসন দখল করে।
আশ্বিন-কার্তিকের সংখ্যার শান্তিনিকেতনে বলিয়াছিলাম যে “এবং’ শব্দ দিয়া যোজিত দুই বাক্যাংশের মধ্যে ক্রিয়াপদের রূপের মিল থাকা চাই। যেমন “সে দরিদ্র এবং সে মূর্খ’ “সে চরকা কাটে এবং ধান ভানে’– প্রথম বাক্যটির দুই অংশই অস্তিত্ববাচক, শেষের বাক্যটির দুই অংশই কর্তৃত্ববাচক। “সে দরিদ্র এবং সে ধান ভানিয়া খায়’ আমার মতে এটা খাঁটি নহে। আমরা এরূপ স্থলে “এবং’ ব্যবহারই করি না, বলি, “সে দরিদ্র, ধান ভানিয়া খায়’। অথচ ইংরেজিতে অনায়াসে বলা চলে, She is poor and lives on husking rice।
“রাম ধনী এবং তার বাড়ি তিনতলা’ এরূপ প্রয়োগ আমরা সহজে করি না। আমরা বলি, “রাম ধনী, তার বাড়ি তিন তলা।’
“যার জমি আছে এবং সেই জমি যে চাষ করে এমন গৃহস্থ এই গ্রামে নেই’– এরূপ বাক্য বাংলায় চলে। বস্তুত এখানে “এবং’ উহ্য রাখিলে চলেই না। পূর্বোক্ত বাক্যে “এমন’ শব্দটি তৎপূর্ববর্তী সমস্ত শব্দগুলিকে জমাট করিয়া দিয়াছে। এমন, কেমন? না, “যার-জমি-আছে-এবং-সেই-জমি-যে-নিজে-চাষ-করে’ সমস্তটাই গৃহস্থ শব্দের এক বিশেষণ পদ। কিন্তু “তিনি স্কুল মাস্টার এবং তাঁর একটি খোঁড়া কুকুর আছে’ বাংলায় এখানে “এবং’ খাটে না, তার কারণ এখানে দুই বাক্যাংশ পৃথক, তাহাদের মধ্যে রূপের ও ভাবের ঘনিষ্ঠতা নাই। আমরা বলি, “তিনি স্কুল মাস্টার, তাঁর একটি খোঁড়া কুকুর আছে।’ কিন্তু ইংরেজিতে বলা চলে, He is a school master and he has a lame dog।
সংস্কৃত ভাষায় যে-সব জায়গায় দ্বন্দ্ব সমাস খাটে, চলিত বাংলায় আমরা সেখানে যোজক শব্দ ব্যবহার করি না। আমরা বলি, “হাতি ঘোড়া লোক লশকর নিয়ে রাজা চলেছেন,’ “চৌকি টেবিল আলনা আলমারিতে ঘরটি ভরা।’ ইংরেজিতে উভয় স্থলেই একটা তশধ না বসাইয়া চলে না। যথা “The king marches with his elephants, horses and soldiers’, “The room is full of chairs, tables, clothes, racks and almirahs।’
বাংলায় আর-একটি নূতন আমদানি যোজক শব্দ “ও’। লিখিত বাংলায় পণ্ডিতেরা ইহাকে “and’ শব্দের প্রতিশব্দরূপে গায়ের জোরে চালাইয়া দিয়াছেন। কিন্তু মুখের ভাষায় কখনোই এরূপ ব্যবহার খাটে না। আমরা বলি “রাজা চলেছেন, তাঁর সৈন্যও চলেছে’। “রাজা চলিয়াছেন ও তাঁহার সৈন্যদল চলিয়াছে’ ইহা ফোর্ট উইলিয়মের গোরাদের আদেশে পণ্ডিতদের বানানো বাংলা। এখন “ও’ শব্দের এইরূপ বিকৃত ব্যবহার বাংলা লিখিত ভাষায় এমনি শিকড় গাড়িয়াছে যে তাহাকে উৎপাটিত করা আর চলিবে না। মাঝে হইতে খাঁটি বাংলা যোজক “আর’ শব্দকে পণ্ডিতেরা বিনা অপরাধে লিখিত বাংলা হইতে নির্বাসিত করিয়াছেন। আমরা মুখে বলিবার বেলা বলি “সে চলেছে, আর কুকুরটি পিছন পিছন চলেছে’ অথবা “সে চলেছে, তার কুকুরটিও পিছন পিছন চলেছে’ কিন্তু লিখিবার বেলা লিখি “সে চলিয়াছে ও (কিংবা এবং) তাহার কুকুরটি তাহার অনুসরণ করিতেছে।’ “আর’ শব্দটিকে কি আর-একবার তার স্বস্থানে ফিরাইয়া আনিবার সময় হয় নাই? একটা সুখের কথা এই যে, পণ্ডিতদের আশীর্বাদ সত্ত্বেও “এবং’ শব্দটা বাংলা কবিতার মধ্যে প্রবেশ করিবার পথ পায় নাই।
১৩২৬
অন্যান্য রচনা ও চিঠিপত্র হইতে সংকলিত
অকুশল–awkward॥ পাণ্ডুলিপি সংখ্যা ২৭১, রবীন্দ্রভবন-সংগ্রহ
অগ্রসরতা= progress॥ যাত্রী
অতিকৃতি–exaggeration॥ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত:
৬ এপ্রিল ১৯৪১। চিঠিপত্র ১২
অদ্বয়বিবাহ=monogamy॥ ছন্দ
অতিশয়পন্থা– extremism॥ কালান্তর
অন্যোন্যস্তুতি=mutual admiration॥ সে
অবচয়ন–selection॥ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে লিখিত : ১ আষাঢ় ১৩৩২
অবচ্ছিন্ন=abstract॥ শান্তিনিকেতন
অবন্ধ্য=productive॥ ইতিহাস
অবয়বহীন–amorphous॥ সাহানাদেবীকে লিখিত : ১৬ বৈশাখ ১৩৪৫;
সংগীতচিন্তা
অভিশোচন–condolence॥ প্রশান্তচন্ত্র মহলানবিশকে লিখিত :
৪ আষাঢ় ১৩৩২
অযথা– inaccurate॥ নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখিত :
২৭ কার্তিক ১৩৩৫
আরামবাগ=park=রাশিয়ার চিঠি
আরোগ্যালয়–sanatorium॥ রাশিয়ার চিঠি
ইঙ্গিত, সঙ্কেত–suggestion॥ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত :
১৯ মার্চ ১৯৩৭। চিঠিপত্র ১২
উঁচ্-কপালেগিরি–High browism॥ সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে লিখিত :
“পত্রিকা”, পরিচয়, কার্তিক ১৩৩৮
*একক সংগীত–solo
কালবিরোধদোষ=anachronism॥ সাহিত্য
কিরীটিকা= Corona॥ বিশ্বপরিচয়
কৌতুকনাট্য=burlesque॥ জীবনস্মৃতি
ক্ষুব্ধস্তর–troposphere॥ বিশ্বপরিচয়
গণজাতি–Race॥ সুর ও সঙ্গতি
গার্হস্থ্যবিভাগ–household commission॥ রাশিয়ার চিঠি
গৃহদীপ সহায়িকা– girlguide॥ শ্রীশান্তিদেব ঘোষ, রবীন্দ্রসংগীত
গোত্রবন্ধন, জাতিবন্ধন–clan system॥ সমাজ
গোধিকা= Lacerta॥ বিশ্বপরিচয়
গ্রহিকা= asteroids॥ বিশ্বপরিচয়
ঘুমন্ত শরিক=sleeping partner॥ চিঠিপত্র ৯
চিরজীবনরস–Elixir of Life॥ স্বদেশ
ছদ্মবেশী নাচ– fency ball॥ য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র
ছাঁদ, রীতি=style॥ আধুনিক সাহিত্য
জগতত্ত্ব–cosmology=সাধনা, ভাদ্র ১৩০১
*জাত=caste
দূরধ্বনিবহ– Telephone= মৈত্রেয়ী দেবীকে লিখিত : বিজয়া দশমী ১৩৩৮
দৈশিকতা= Patriotism॥ বিশ্বভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৬২ :
অরবিন্দমোহন বসুকে লিখিত : অগ্রহায়ণ ১৩১৫
দ্বয়ীশিক্ষা= co-education॥ দ্র| জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, বাঙ্গালা ভাষার অভিধান
দ্বৈধব্য=bigamy॥ স্বদেশ
দ্বৈরাজ্য=diarchy॥ গল্পগুচ্ছ
ধ্রুবপদ্ধতি=classicaর
নাট্যখেলা= charade॥ হাস্যকৌতুক
নিরনেক বিবাহ=monogamy॥ বিশ্বভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৭০
নির্বস্তুক=abstract॥ বাংলাভাষা পরিচয়
নির্মিতি=construction॥ বিশ্বভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৭০
নেহাত সত্য–truism॥ সুর ও সঙ্গতি
নৈরাশ্যগ্রস্ত–pessimist॥ বিদ্যাসাগর চরিত
নৌবাহ্য–navigable॥ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত :
২০ জানুয়ারি ১৯৩৭। চিঠিপত্র ১২
পরকালতত্ত্ব=eschatology॥ সাধনা, ভাদ্র ১৩০১
*পরশ্রমজীবী বা পরশ্রমভোগী–Bourgeois॥ রাশিয়ার চিঠি
*পরার্থশ্রমী–proletariat॥ রাশিয়ার চিঠি
পরাশিত=parasite॥ সমবায়নীতি
পাঠগৃহ–reading room॥ রাশিয়ার চিঠি
পাত্রশিল্প॥ Pottery॥ চিঠিপত্র ৯
পারলৌকিক বৈষয়িকতা= other worldliness॥ আধুনিক সাহিত্য
পীত সংকট=yellow peril॥ কালান্তর
পুরাগত বনেদ–tradition॥ সে
পুরোযায়ী–pioneer॥ রাশিয়ার চিঠি
প্রতিবৃত্তিক্রিয়া– reflex action॥ সমূহ
প্রতিরূপক–symbol॥ সমাজ
প্রবহমানতা– enjambenment ॥ ছন্দ
প্রিয়চারী–amiable॥ সমূহ
প্রৈতি–energy॥ শান্তিনিকেতন
বন্ধ্য–unproductive॥ ইতিহাস
বর্ণকল্পনা– colour scheme॥ রাশিয়ার চিঠি
বহুগ্রন্থিল কলেবর–Complex Structure॥ সংগীতচিন্তা
বিকলন–Analysis॥ বিশ্বভারতী পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ ১৩৬২ :
রাধারানী দেবীকে লিখিত : ১৪ ভাদ্র ১৩৩৫
বিদ্যাভবন–Home of education॥ রাশিয়ার চিঠি
বিধি এবং ব্যবস্থা= law and order॥ সভ্যতার সংকট
বিশ্রান্তিনিকেতন–The Home of Rest॥ রাশিয়ার চিঠি
বিশ্বমানবিকতা– cultural fellowship with foreign countries॥
দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লিখিত : ১১ জানুয়ারি ১৯৩৫
বিশ্বমুসলমানী–Pan Islamism॥ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত :
বিশ্বম্বহ–Omnibnus॥ পথের সঞ্চয়
বিশ্বসাহিত্য–Comparative Literature॥ সাহিত্য
বীরধর্ম–Chivalry॥ রাশিয়ার চিঠি
বেগ্নি পারের আলো, বেগনি পারের রশ্মি, বেগ্নি পেরোনো আলো–
ultra violet ray॥ বিশ্বপরিচয়
বৈদ্যুত=Electricity॥ বিশ্বপরিচয়
বৈভীষিক রাষ্ট্রউদ্যম–terroristic political movement॥
শ্রীঅমিয় চক্রবর্তীকে লিখিত, চিঠিপত্র ১১
বৈয়ক্তিক চৌম্বকশক্তি–Personal magnetism॥ চিঠিপত্র ৬
ব্যক্তিসাতন্ত্র্য=individualism॥ ধর্ম
ব্যঙ্গীকরণ=caricature॥ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, “রবীন্দ্রস্মৃতি’
ব্যঞ্জনা= gesture॥ চার অধ্যায়
ব্যূহবদ্ধতা– Organisation॥ সমূহ
ভাববাতিকতা= sentimentalism॥ রাজাপ্রজা
ভাবানুষঙ্গ=association॥ সাহিত্যের পথে
ভারাবর্তন, মহাকর্ষ=Gravitation॥ বিশ্বপরিচয়
মঠাশ্রয়ী ব্যবস্থা= manasticism॥ সঞ্চয়
মহাজাগতিক রশ্মি=cosmic ray=বিশ্বপরিচয়
মূর্ধন্য হাসি–wit॥ সে
*যুগ্মক সংগীত–Duet
রাষ্ট্রিকতা– Politics॥ সংহতি, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩০; প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩৩০
*রীতি ও পদ্ধতি–cult and dogma
রূপকল্প–Pattern॥ ছন্দ
রূপদক্ষ–artist॥ সাহিত্যের পথে
লাল-উজানি আলো– Infra-red light॥ বিশ্বপরিচয়
লোকবাক্য–popular belief॥ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত :
[শব্দগত] স্পর্শদোষ–contamination of words॥ দ্র| বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, “শব্দগত স্পর্শদোষ”, প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩৪২
শারীরশ্রমের সম্মান–dignity of labour॥ পথে ও পথের প্রান্তে
শাস্ত্রমত=dogma॥ কালান্তর
শিশুরক্ষণী–Creche॥ রাশিয়ার চিঠি
সূচিপত্র–Correction slip॥ মোহিতচন্দ্র সেনকে লিখিত : ২৯ শ্রাবণ ১৩১০
সংকলন, সংগ্রথন–Collection॥ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে লিখিত :
১ আষাঢ় ১৩৩২
সংস্কৃতায়িত=Sanskritized॥ বঙ্গদর্শন, চৈত্র ১৩১১
সংস্থান পত্র–prospectus॥ কালিদাস নাগকে লিখিত : ১৪ নভেম্বর ১৯২২
সখ্যবিবাহ–Compassionate marriage॥ মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখিত।
দ্র| হিরণকুমার সান্যাল, “মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়”, সংবদধ্বম্ Vol। 8, No। 1
সঙ্কল–Simple॥ সংগীতচিন্তা
সঞ্চয়িকা– Anthology॥ অমিয় চক্রবর্তীকে লিখিত : ১ জানুয়ারি ১৯৩৫, চিঠিপত্র ১১
সপ্তাহপ্রান্ত– Week-end॥ দিলীপকুমার রায়কে লিখিত : ২২ শ্রাবণ ১৩৪৪
সভাপত্য– Presidentship॥ কালিদাস নাগকে লিখিত : পত্র ৮, প্রবাসী, চৈত্র ১৩৩৯
সম্মিতি, সংসাম্য=symmetry॥ ছন্দ
*সম্মেলক সংগীত–Chorus
সহজ প্রবৃত্তি=instinct॥ পঞ্চভূত, সমাজ
সহায়িকা– girl guide॥ শান্তিনিকেতন পত্র, আশ্বিন ১৩৩০
সেবক=Steward॥ য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র
স্তব্ধস্তর–Stratosphere॥ বিশ্বপরিচয়
স্থানিক তথ্যসন্ধান–region studies॥ রাশিয়ার চিঠি
স্নিগ্ধ–Affectionate॥ মৈত্রেয়ী দেবীকে লিখিত : ৪ অক্টোবর ১৯৩৩
স্বতন্ত্রশাসিত–Autonomous॥ রাশিয়ার চিঠি
হাঁ-ধর্মী–positive॥ বিশ্বপরিচয়
তালিকা-ধৃত *-চিহ্নিত শব্দগুলি বাংলা শব্দতত্ত্ব দ্বিতীয় সংস্করণের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যে স্থলে ইংরেজি ও বাংলা শব্দ একই সঙ্গে ব্যবহার করিয়াছেন সে স্থলে ইংরেজি শব্দের পূর্বে = চিহ্ন দেওয়া হইল।
অভিভাষণ
একদিন ছিল যখন পাণ্ডিত্যের সঙ্গে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের বিরোধ ছিল। এর প্রতি কিছু অবজ্ঞাও তখন করা হয়েছে। প্রাচীন সংস্কৃতের আলয় থেকে বাংলা তখন যথোচিত সম্মান পায় নি তার কারণও হয়তো ছিল। তখন বাংলা ছিল অপরিণত, সাহিত্যের অনুপযোগী। এর দৈন্যকে উপেক্ষা করা সহজ ছিল। কিন্তু যে শক্তি তখন এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল, সে শক্তি এ কোথা থেকে পেয়েছে? সংস্কৃত ভাষারই অমৃত উৎস থেকে। সেই কারণেই তার পরিণতিও চলেছে, কোথাও বাধা পায় নি। বাইরে থেকে যে-সকল বিদ্যা আমরা লাভ করেছি, তা আমাদের ভাষায় রক্ষা করা সম্ভব হল, কারণ বাংলার দৈন্য ও অভাব আজ আর বেশি নেই। পারিভাষিকের কিছু দারিদ্র্য আছে বটে, কিন্তু সে দারিদ্র্য পূর্ণ করবার উপায় আছে সংস্কৃতের মধ্যে।
একদিন ছিল ভারতবর্ষে ভাষা-বোধের একটা প্রতিভা। ভারতবর্ষ পাণিনির জন্মভূমি। তখনকার দিনে প্রাকৃতকে যাঁরা বিধিবদ্ধ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন পরম পণ্ডিত। অথচ প্রাকৃতের প্রতি তাঁদের অবজ্ঞা ছিল না। সংস্কৃত ব্যাকরণের চাপে তাঁরা প্রাকৃতকে লুপ্তপ্রায় করেন নি। তার কারণ ভাষা সম্বন্ধে তাঁদের ছিল সহজ বোধশক্তি। আমরা আজকাল সংস্কৃত শিখে ভুলে যাই যে, বাংলার একটি স্বকীয়তা আছে। অবশ্য সংস্কৃত থেকেই সে শব্দ-সম্পদ পাবে, কিন্তু তার নিজের দৈহিক প্রকৃতি সংস্কৃত দ্বারা আচ্ছন্ন করবার চেষ্টা অসংগত। আমাদের প্রাচীন পণ্ডিতেরা কখনো সে চেষ্টা করেন নি। আমি সেকালের পণ্ডিতদের বাংলায় লেখা অনেক পুরানো পুঁথি দেখেছি। তার বানান তাঁরা বাংলা ভাষাকে প্রাকৃত জেনেই করেছিলেন। তাঁদের ষত্ব ণত্ব জ্ঞান ছিল না, এ কথা বলা চলে না। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আমলেও এখনকার নব পণ্ডিতদের মতো ষত্ব ণত্ব নিয়ে মাতামাতি করা হয় নি। তা করলে “শ্রবণ” থেকে উদ্ভূত “শোনা” কখনোই মূর্ধন্য ণ-এর অত্যাচার ঠেকাতে পারত না। যাঁরা মনে করেছেন বাইরে থেকে বাংলাকে সংস্কৃতের অনুগামী করে শুদ্ধিদান করবেন, তাঁরা সেই দোষ করছেন যা ভারতে ছিল না। এ দোষ পশ্চিমের। ইংরেজিতে শব্দ ধ্বনির অনুযায়ী নয়। ল্যাটিন ও গ্রীক থেকে উদ্ভূত শব্দে বানানের সঙ্গে ধ্বনির বিরোধ হলেও তাঁরা মূল বানান রক্ষা করেন। এই প্রণালীতে তাঁরা ইতিহাসের স্মৃতি বেঁধে রাখতে চান। কিন্তু ইতিহাসকে রক্ষা করা যদি অবশ্যকর্তব্য হয় তবে ডারউইন-কথিত আমাদের পূর্বপুরুষদের যে অঙ্গটি খসে গেছে সেটিকে আবার সংযোজিত করা উচিত হবে। প্রসঙ্গক্রমে আধুনিক পণ্ডিতদের একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি, তাঁদের মতে “বানান’ শব্দে কোন্ ন লাগবে?
বাংলাকে বাংলা বলে স্বীকার করেও এ কথা মানতে হবে যে সংস্কৃতের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। সংস্কৃত ভাষায় ভারতীয় চিত্তের যে আভিজাত্য, যে তপস্যা আছে বাংলা ভাষায় তাকে যদি গ্রহণ না করি তবে আমাদের সাহিত্য ক্ষীণপ্রাণ ও ঐশ্বর্যভ্রষ্ট হবে।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে য়ুরোপীয় বিদ্যার যোগে নতুন বাংলা সাহিত্য, এমন-কি, কিয়ৎ পরিমাণে ভাষাও তৈরি হয়ে উঠেছে, বর্তমান কালের ভাব ও মনন-ধারা বহন করে এই যোগ যেমন আমাদের উদ্বোধনের সহায় হয়েছে, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের নিরন্তর সম্বন্ধও আমাদের তেমনি সহায়। য়ুরোপীয় চিত্তের সঙ্গে আমাদের সাহিত্যের যদি বিচ্ছেদ ঘটে, তবে তাতে করে আমাদের যে দৈন্য ঘটবে সে আমাদের পক্ষে শোচনীয়, তেমনি সংস্কৃতের ভিতর দিয়ে প্রাচীন ভারতীয় চিত্তের যোগপ্রবাহ যদি ক্ষীণ বা অবরুদ্ধ হয়, তবে তাতেও বাংলা ভাষার স্রোতস্বিনী বিশুদ্ধতা ও গভীরতা হারাবে। ভাবের দিকের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, শব্দের দিক থেকে বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কাছে নিরন্তর আনুকূল্যের অপেক্ষা না করে থাকতে পারে না।
বাংলায় লিখতে গিয়ে আমাকে প্রতি পদে নতুন কথা উদ্ভাবন করতে হয়েছে। তার কারণ বাংলা ভাষা একদিন শুদ্ধমাত্র ঘরের ভাষা ছিল। সেজন্য এর দৈন্য বা অভাব যথেষ্ট রয়ে গেছে। সে দৈন্য পূরণের সুযোগ আমাদের দেশেই আছে। জাপানি ভাষার মধ্যে অনুরূপ একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। জাপানি ভাষায় তত্ত্বঘটিত শব্দরচনা সহজ নয়। জাপানির সঙ্গে সেজন্যে চীনে ভাষার যোগ রয়ে গেছে। যুদ্ধের দ্বারা সেদিনও জাপান চীনকে অসম্মান করেছে, অপমান করেছে। কিন্তু ভাষার মধ্যে সে চীনকে সম্মান করতে বাধ্য। তাই জাপানি অক্ষরের মধ্যে চৈনিক অক্ষরও অপরিহার্য। ঘরের কথা জাপানি ভাষায় চলে হয়তো, কিন্তু চীনে ভাষা সঙ্গে না থাকলে বড়ো কোনো জ্ঞান বা উপলব্ধির প্রকাশ অসম্ভব হয়। অনুরূপ কারণেই বাংলাকে সংস্কৃত ভাষার দানসত্র ও অন্নসত্র থেকে দূরে নিয়ে এলে তাতে গুরুতর ক্ষতি ঘটবে।
আমাকে যে উপাধিতে আপনারা ভূষিত করলেন, তার জন্যে আবার আপনাদের প্রতি আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। কিন্তু এও বলি যে, অযোগ্য পাত্রে যদি সম্মান অর্পিত হয়ে থাকে সে দায়িত্ব আপনাদের। আমার কিছুই গোপন নেই। সংস্কৃত ভাষায় আমার অধিকার সংকীর্ণ। তথাপি যখন আপনারা আমাকে এই পুরস্কার দিলেন এর জন্যে কাউকে যদি নিন্দাভাগী হতে হয় তো সে আপনাদের।
কার্তিক, ১৩৩৮
উত্তর-প্রত্যুত্তর
উত্তর। বিগত শ্রাবণের ভারতীতে লিখিত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ বিষয়ক প্রস্তাব পাঠ করিলাম। পাঠান্তে মনোমধ্যে হর্ষ ও বিষাদ উভয়ই উদয় হইল। হর্ষের কারণ প্রস্তাব-লেখক মহাশয় বিশেষ পরিশ্রম করিয়া বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার-কর্তৃক সম্পাদিত, বিদ্যাপতির পদাবলী পাঠ করিয়াছেন। এবং টীকাতে যে সমুদায় ভুল আছে তাহা সংশোধন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। গুরুতর পরিশ্রম করিয়া তিনি দুরূহ পদসমূহেরও ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আমাদের বিবেচনায় তাঁহার কৃত ব্যাখ্যা অনেক স্থলে বিশদ হইয়াছে। যে জাতির যে কাব্যের যত প্রকার ব্যাখ্যা হয় সেই জাতির সেই কাব্যের তত গৌরবের কথা। এক-একখানি সংস্কৃত কাব্যের এক-একটি পদের নানা প্রকার অর্থ করা যাইতে পারে– ইহা সংস্কৃত ভাষায় গৌরবের কথা সন্দেহ নাই। মিল্টনের প্যারেডাইস লস্টের অসংখ্য ব্যাখ্যা আছে– প্যারেডাইস লস্ট ইংরেজি ভাষার অমূল্য রত্ন। বিদ্যাপতির এক-একটি পদের নানা প্রকার অর্থ হওয়া আনন্দের কথা। কিন্তু তাঁহার কৃত পদাবলী পাঠ করিয়া ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের অর্থ করেন, এরূপ পাঠক বা লেখক-সংখ্যা বঙ্গদেশে অল্প– সাধারণত বঙ্গবাসী এ প্রকার কষ্টকর কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে অগ্রসর হয় না। সেইজন্য ভারতীয় প্রাচীন কাব্য সম্বন্ধীয় প্রস্তাব পাঠ করিয়া আমাদের এত হর্ষ হইয়াছে। আমাদিগের বিষাদের কারণ এই, যে, প্রস্তাব-লেখক মহাশয় নিরপেক্ষভাবে প্রাচীন কাব্য সংগ্রহের সমালোচনা করেন নাই। তিনি অনেক স্থানে সম্পাদকের অযথা নিন্দা করিয়াছেন। এসম্বন্ধে আমাদের কিছু বক্তব্য আছে।
কোনো ব্যক্তি কোনো পুস্তকের টীকা করিবার পূর্বে এরূপ প্রতিজ্ঞা করিতে পারেন না, যে, তিনি যাহা লিখিবেন তাহাই নির্ভুল হইবে। আমরা যত দূর কাব্য-সংগ্রহ পাঠ করিয়াছি তাহার কোনো স্থানেই সম্পাদক শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার এ প্রকার প্রতিজ্ঞা করেন নাই, সুতরাং চুক্তিভঙ্গের নালিশ তাঁহার উপর চলে না। কবিদিগের প্রতি অবিচার করার দাবিও করা যাইতে পারে না। কারণ কবিদিগের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভক্তি না থাকিলে সম্পাদক এ কার্যে হস্তক্ষেপ করিতেন কি না সন্দেহ। আমাদের বোধ হয় সাধারণ পাঠকবর্গ সম্পাদক যাহা-কিছু লিখিয়াছেন, তাহাই ভুল-শূন্য এ প্রত্যাশা করিয়া প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ পাঠ করিতে আরম্ভ করেন না; সুতরাং তাঁহারা উক্ত পুস্তকমধ্যে স্থানে স্থানে ভুল ব্যাখ্যা দেখিলে বোধ হয়, বিস্মিত হয়েন না।
শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার অকাতরে পরিশ্রম করিয়া, মহাজন পদাবলী সংগ্রহ করিয়াছেন। দুরূহ শব্দের অর্থ করিয়াছেন; এমন-কি, লুপ্তপ্রায় পদাবলী সমূহকে মনোহর বেশভূষায় ভূষিত করিয়া, সাহিত্যজগতে আনয়নপূর্বক সাহিত্যপ্রিয় ব্যক্তিমাত্রেরই কৃতজ্ঞতার পাত্র হইয়াছেন। প্রবন্ধে লেখক-মহাশয় লিখিয়াছেন, যে, তিনি তজ্জন্য সম্পাদককে উৎসাহ দিলেন। কিন্তু কিরূপে যে তিনি উৎসাহ দিলেন, তাহা আমাদিগের বোধগম্য হইল না। বরং তিনি প্রকারান্তরে সম্পাদককে অলস অমনোযোগী প্রভৃতি বলিয়াছেন। তাঁহার লেখার ভাবে বোধ হইল, যে, সম্পাদকের নিন্দা করিবার অভিপ্রায়েই তিনি লেখনী ধারণ করিয়াছিলেন।
তৎকর্তৃক-সম্পাদিত পদাবলীর গুণাগুণ ব্যাখ্যা করা তাঁহার অভিপ্রায় ছিল না। নতুবা সম্পাদককে লজ্জিত করিবার জন্য এত চেষ্টা কেন? তাঁহার প্রতি এত তীব্র বিদ্রূপ নিক্ষেপ কেন? আমরা বলিয়াছি প্রবন্ধ-লেখক অনেক স্থানে সম্পাদকের অযথা নিন্দা করিয়াছেন, যাহা স্পষ্ট ভুল নহে তাহাকে ভুল প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, এক্ষণে দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইব যে আমাদের কথা সত্য। তিনি লিখিয়াছেন–
“অলখিতে মোহে হেরি বিহসিতে থোরি।
জনু বয়ান বিরাজে চাঁদ উজোরি।
কুটিল কটাক্ষ ছটা পড়ি গেল।
মধুকর ডম্বর অম্বর ভেল॥’
এই শ্লোকের শেষ ছত্রে সম্পাদক “যেন’ শব্দ কোথা হইতে পাইলেন এবং “আচ্ছন্ন’ শব্দই বা কোথা হইতে জুটিল? কোনো পদের অনুবাদ করা এক কথা, আর ব্যাখ্যা করা আর-এক কথা। অনুবাদ করিতে হইলে নিজ হইতে শব্দ দেওয়ার সকল সময়ে প্রয়োজন না হইতে পারে, কিন্তু ব্যাখ্যা করিতে হইলে অনেক সময়ে নূতন শব্দ প্রয়োগ করিতে হয়; অন্যথা সকল স্থানে ব্যাখ্যা সরল হয় না। পাঠকেরাও উত্তম রূপ বুঝিতে পারেন না। উপরে ঊদ্ধৃত পদটিতে একট উৎপ্রেক্ষা অলংকার আছে সুতরাং “যেন’ শব্দ প্রয়োগ করিয়া সম্পাদক কোনো দোষ করেন নাই। অনেক কৃতবিদ্য সুপণ্ডিত ব্যক্তি সংস্কৃত শ্লোকের ব্যাখ্যাকালে নিজ হইতে অনেক শব্দ যোগ করিয়া দিয়াছেন। উদাহরণ–
“বশিষ্ঠ ধেনোরনুযায়িনন্তং
আবর্তমানং বনিতা বনান্তাৎ।
পপৌ নিমেষালস পক্ষ্ণ পঙ্ক্তি
রুপোষিতাভ্যামিব লোচনাভ্যাম্।’
রঘুবংশ। দ্বিতীয়ঃ সর্গঃ, ১৯ শ্লোক
পণ্ডিত নবীনচন্দ্র ইহার এইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন– “রাজ্ঞী সুদক্ষিণা বন হইতে প্রত্যাগত বশিষ্ঠ ধেনুর অনুযায়ী রাজাকে নির্নিমেষ লোচনে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন, তাঁহার স্থির নিশ্চল দৃষ্টি দেখিয়া বোধ হইল যেন, তাঁহার লোচন যুগল বহুকাল উপোষিত থাকিয়া অতি তৃষ্ণার সহিত রাজার সৌন্দর্য পান করিতেছিল।’ এক্ষণে জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে “অতি তৃষ্ণার সহিত রাজার সৌন্দর্য পান’ কোথা হইতে আসিল? আর একজন পণ্ডিত ইহার টীকা করিয়াছেন, “পতি বশিষ্ঠ ধেনুর অনুচর হইয়া বন হইতে প্রত্যাগমন করিতেছেন দেখিয়া রাজ্ঞী অনিমিষ নয়নে তাঁহাকে দেখিতে লাগিলেন। বোধ হইল যেন, তাঁহার নয়ন যুগল এতক্ষণ উপবাসী ছিল এখন তদীয় সৌন্দর্য সুধা পান করিতেছে।’ “সৌন্দর্য সুধা’ কোথা হইতে আসিল? বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার টীকা করিতে যাইয়া দুই-একটি নিজের শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন বলিয়া আমাদের প্রবন্ধ লেখক তাঁহাকে বিদ্রূপ করিয়াছেন, কিন্তু এ-সকল টীকা পাঠ করিয়া তিনি কি বলিবেন বলিতে পারি না।
শ্রীযোগেন্দ্রনারায়ণ রায়
প্রত্যুত্তর– অর্থ ব্যাখ্যা করা এক, আর অর্থ তৈরি করা এক। অর্থ সহজ করিবার জন্য তাহাতে নূতন কথা যোগ করা কিছু মন্দ কাজ নহে, কিন্তু মূলে যে কথা নাই সেই কথা যোগ করিয়া অর্থ গড়িয়া তোলা দোষের নহে তো কী? লেখক আবার পাছে ভুল বুঝেন এই নিমিত্ত স্পষ্ট করিয়া উদাহরণ দিয়া বলিতে হইল। মনে করুন, “সময় বসন্ত, কান্ত রহুঁ দূরদেশ’ এই ছত্রটির অর্থ বুঝাইতে গিয়া আমি যদি বলি, “বসন্তের ন্যায় এমন সুখের সময়ে, প্রাণের অপেক্ষা যাহাকে ভালোবাসি, সে কান্ত দূরদেশে রহিয়াছেন’, তাহাতে দোষ পড়ে না; যদিও কথা বাড়াইলাম তথাপি কবির ভাবের অনুসরণ করিয়া চলিয়াছি। কিন্তু আমি যদি বলি “বসন্ত অতিক্রম করিয়া গ্রীষ্ম আসিয়া পড়িল, তথাপি আমার কান্ত দূরদেশে রহিয়াছেন’ তাহা হইলে অতিরিক্ত কথা ব্যবহারের জন্য আমি দোষী।
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রস্তাব-লেখক
উত্তর– “লীলা-কমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি
চমকি চললু ধনি চকিত নেহারি।’
লেখক লিখিয়াছেন “লীলা-কমলের দ্বারা ভ্রমরকে নিবারণ’ ইত্যাদি। আমাদের বিবেচনায় সম্পাদকের অর্থই বিশদ হইয়াছে। রাধিকার হস্তে লীলা-কমল কোথা হইতে আসিল? তিনি কি ভ্রমর তাড়াইবার জন্য লীলা-কমল হস্তে করিয়া বেড়াইতেন? সম্পাদক “ন্যায়’ “সহিত’ প্রভৃতি শব্দ ঘর হইতে দেওয়ায় যে মহাপাতক সঞ্চয় করেন নাই তাহা উপরে বলিয়াছি।
শ্রীযোঃ নাঃ রাঃ
প্রত্যুত্তর– “লীলা-কমল’ কোথা হইতে আসিল? তাহা ঠিক বলিতে পারি না, তবে এই পর্যন্ত বলিতে পারি যে তাহা আনাইতে কবির এক ফোঁটার অধিক কালি খরচ হইয়াছিল কি না সন্দেহ। চণ্ডীদাসের এক স্থানে আছে– “চলে নীল শাড়ি নিঙ্গাড়ি নিঙ্গাড়ি, পরাণ সহিতে মোর।’ লেখক তো জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, “নীল শাড়ি কোথা হইতে আসিল? ঢাকা হইতে না বারাণসী হইতে?’ চণ্ডীদাসের সেটা লেখা উচিত ছিল, সন্দেহ নাই, কিন্তু সে বিষয়ে চণ্ডীদাসের হইয়া একটা কথা বলা যায়। এ পর্যন্ত অনেক কবি নীল শাড়ি ও লীলাকমলের অপেক্ষাও অনেক দামী দুষ্প্রাপ্য জিনিস কাব্যে আনিয়াছেন, কিন্তু কোন্ দোকান হইতে আনাইয়াছেন, পাঠকদের উপকারার্থ তাহা লিখিয়া দেন নাই। সংস্কৃত কাব্যে সহস্র স্থানে লীলা-কমলের দ্বারা ভ্রমর তাড়াইবার উল্লেখ আছে।
শ্রীরঃ
উত্তর–
“যব গোধূলি সময় বেলি
ধনি মন্দির বাহির ভেলি,
নব জলধরে বিজুরী-রেখা
দ্বন্দ্ব পসারিয়া গেলি।’
এ পদের সম্পাদকীয় টীকাই আমাদের মতে পরিষ্কার ও ভাব-ব্যঞ্জক হইয়াছে। প্রবন্ধ-লেখক যে অর্থ করিয়াছেন তাহা পরিষ্কার হয় নাই। তিনি লিখিয়াছেন, “রাধা গোধূলির ঈষৎ অন্ধকারে মন্দিরের বাহির হইলেন। যেন নব জলধরে বিদ্যুৎ রেখা দ্বন্দ্ব বিস্তার করিয়া গেল।’ “দ্বন্দ্ব’ শব্দের এখানে অর্থ কী? কাহার সহিত দ্বন্দ্ব করিয়া গেল? সম্পাদক এই স্থানে “পুন’ শব্দ পরিত্যাগ করার ও “যেন’ শব্দ নিজ গৃহ হইতে দেওয়ায় প্রবন্ধ-লেখক তাঁহার নিকট কৈফিয়ৎ চাহিয়াছেন। কিন্তু তিনি এক্ষণে “যেন’ ঘর হইতে দিয়াছেন এবং দ্বন্দ্ব কথাটির যথোচিত সম্মান রক্ষা করেন নাই! অন্যকে যে জন্য নিন্দা করিলাম নিজে সেই কার্যটি করিলে গভীর বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া হয় না।
শ্রীযোঃ
প্রত্যুত্তর– সম্পাদকীয় টীকা উদ্ধৃত করি– “বিদ্যুৎ-রেখার সহিত দ্বন্দ্ব বিস্তার করিয়া গেল। অর্থাৎ তাহার সমান বা অধিক লাবণ্যময়ী হইল।’ এখানে “সহিত’ শব্দ যোজনা করা যে নিতান্ত জোর-জবর্দস্তির কাজ হইয়াছে, তাহা কেহ অস্বীকার করিতে পারেন না। আমার অর্থ এই যে– অন্ধকারের কৃষ্ণবর্ণ ও রাধিকার গৌরবর্ণ মিলিয়া কেমন হইল, যেমন নবজলধরের সহিত বিদ্যুৎ-রেখার বিবাদ বিস্তৃত হইল। যদি বলি “ঈশ্বরে আমি প্রীতি স্থাপন করিলাম’ তাহা হইলে বুঝায়, ঈশ্বরের সহিত আমি প্রীতি করিলাম; তেমনি “জলধরে বিদ্যুৎ বিবাদ বিস্তার করিল’ অর্থে বুঝায়, জলধরের সহিত বিদ্যুৎ বিবাদ করিল।
শ্রীরঃ
উত্তর–
“এ সখি কি পেখনু এক অপরূপ।
শুনাইতে মানবি স্বপন স্বরূপ॥
শাখা-শিখর সুধাকর পাঁতি।
তাহে নব পল্লবে অরুণক ভাতি॥
…
তা পর চঞ্চল খঞ্জন যোড়।
তা পর সাপিনী ঝাঁপল মোড়॥’
২০-সংখ্যক গীত
প্রবন্ধ-লেখক ইহার মধ্যস্থ দুই চরণের এই অর্থ দিয়াছেন। “সে তমাল তরুর শাখা শিখর অর্থাৎ মুখ, সুধাকর। লাবণ্যই বোধ করি অরুণ ভাতির পল্লবে।’ পাঁতি শব্দটি কোথায় গেল? “লাবণ্যই বোধ করি–‘ ইত্যাদি এই ছত্রের অর্থ আমরা বুঝিতে পারিলাম না।
শ্রীযোঃ
প্রত্যুত্তর– “বোধ করি’ শব্দ ব্যবহার করিবার তাৎপর্য এই যে, যেখানে অর্থ বোধে মনে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকে সেখানে আমি অসংকুচিত ও অসন্দিগ্ধ ভাব দেখাইতে পারি না। এ অপরাধের যদি কোনো শাস্তি থাকে, তবে তাহা বহন করিতে রাজি আছি।
শ্রীরঃ
উত্তর– আর “হাস্য স্থির বাস করে’ কিরূপ বাংলা? শ্রীকৃষ্ণের কুন্তল সাপিনীর ন্যায়ই বা কি প্রকারে হইল? শ্রীকৃষ্ণের চূড়ার কথাই শুনিয়াছি। আমরা যে ব্যক্তির নিকট এই গীতটির ব্যাখ্যা শুনিয়াছি তিনি ইহার আদিরস-ঘটিত ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। সম্ভবত সেইজন্যই ইহার অর্থ করেন নাই।
শ্রীযোঃ
প্রত্যুত্তর– শ্রীকৃষ্ণের শরীর বর্ণনা করা ভিন্ন অন্য কোনো প্রকার গূঢ় আদিরস ঘটিত অর্থ বুঝানো কবির অভিপ্রেত ছিল, তাহা আমি কোনো মতেই বিশ্বাস করিতে পারি না। “চঞ্চল খঞ্জন’ “যুগল বিম্বফল’ প্রভৃতি শব্দ প্রয়োগ দেখিয়া রূপ-বর্ণনা বলিয়াই স্পষ্ট অনুমান হইতেছে।
শ্রীরঃ
উত্তর–
“গগন সঘন, মহী পঙ্কা
বিঘিনি বিথারিত ইত্যাদি।’
এই পদে দুই-একটি ছাপার ভুল আছে। “ভুললি’ স্থানে “ভুলালি’ ও “মানবি’ স্থানে “মানব’ হইবে। তাহা হইলেই সম্পাদকের অর্থ থাকিয়া যাইবে। আশ্চর্যের বিষয়, যে, প্রবন্ধ-লেখক একটু চিন্তা করিয়া দেখেন নাই, সম্পাদক এ অর্থ দিলেন কেন। একেবারে সম্পাদকের অর্থকে ভুল বলিয়াছেন; ইহাতে তাঁহার কতদূর বিজ্ঞতার পরিচয় প্রদান করা হইয়াছে, তাহা তিনিই বিবেচনা করুন।
শ্রীযোঃ
প্রত্যুত্তর– আশ্চর্যের বিষয় যে প্রবন্ধ-লেখক একটু চিন্তা করিয়া দেখেন নাই, যে, মূলে ও টীকায় উভয় স্থলেই অবিকল একই-রূপ ছাপার ভুল থাকা সম্ভব কি না? টীকার বন্ধনী-চিহ্নের মধ্যে যে কথাগুলি উদ্ধৃত আছে সেগুলির প্রতি লেখক একবার যেন দৃষ্টিপাত করেন।
শ্রীরঃ
উত্তর– পিণ্ডন শব্দের টীকা না করিয়া প্রবন্ধ-লেখক যে টিপ্পনী করিয়াছেন, আমাদের চক্ষে তাহা ভালো লাগিল না। সম্পাদক-কৃত অর্থ ভালো না হওয়ায় প্রবন্ধ-লেখক যেন আনন্দিত হইয়াছেন। তিনি যেন সম্পাদককে বিদ্রূপ করিবার সুযোগ খুঁজিতেছিলেন এবং সেই সুযোগ পাইয়াই দুইটা কথা শুনাইয়া দিয়াছেন। এপ্রকার লেখায় সাধারণ পাঠকবর্গের বা প্রাচীন-কাব্য সংগ্রহের– বিদ্যাপতি বা চণ্ডীদাসের কোনো লাভ হয় নাই– হইয়াছে, কেবল নিন্দা করিয়া লেখকের মনে সন্তোষ লাভ, আর যদি সম্পাদকের কেহ শত্রু থাকেন, তাহা হইলে তাঁহার মনে শান্তি লাভ।
শ্রীযোঃ
প্রত্যুত্তর– অসম্ভব ও অসংগত উক্তি শুনিলে আমাদের স্বভাবতই হাসি আসে। একজনকে একটা অদ্ভুত কার্য করিতে দেখিয়া বা অদ্ভুত কথা কহিতে শুনিয়া আমরা যদি হাসিয়া উঠি, সে কি বলিতে পারে যে, তাহার প্রতি শত্রুতা-বশত আমরা বহুদিন হইতে অবসর খুঁজিতেছিলাম, কখন সে অদ্ভুত কথা বলিবে ও আমরা হাসিয়া উঠিব? হাসি সামলাইতে পারি নাই, হাসিয়াছিলাম। মধ্যে মধ্যে এরূপ বেয়াদবি করিবার অধিকার সকল দেশের সাহিত্য-সমালাচকদেরই আছে।
শ্রীরঃ
উত্তর– জানয়বি শব্দে “য়’ ভুল নহে। আমাদের বোধ হয় “ন’তে আকার দিতে ছাপার ভুল হইয়া থাকিবে। হিন্দীতে যখন “দেখায়ব’ “লিখায়ব’ প্রভৃতি আছে, তখন জানায়ব বা জানায়বি না হইবে কেন? ছাপার ভুলের জন্য সম্পাদককে দায়ী করা যায় না। বিশেষত বঙ্গদেশে এমন পুস্তক খুব কম যাহাতে ছাপার ভুল নাই। আমাদের আলোচ্য প্রবন্ধেই ছাপার ভুল আছে; ছাপার ভুলের জন্য কোনো গ্রন্থকারকে কেহ দোষী করেন না। তবে নিন্দা করিবার অভিপ্রায় থাকিলে সে স্বতন্ত্র কথা।
শ্রীযোঃ
প্রত্যুত্তর– একে সহজেই দুর্বোধ্য ভাষা, তাহার উপরে ছাপার ভুল হইলে না কি বিশেষ হানি হইবার সম্ভাবনা এই নিমিত্তই আমরা বলি এ-সকল বই ছাপাইতে নিতান্তই পরিশ্রম করা আবশ্যক। সচরাচর প্রকাশিত বাংলা পুস্তকে ভুল থাকিলে তেমন হানি হয় না। প্রাচীন কবিতায়, কোন্টা ছাপার ভুল কোন্টা নহে তাহা নির্ণয় করা নিতান্তই দুঃসাধ্য। “জানায়বি’ এবং “জানাওবি’ উভয়ই হইতে পারে, অতএব “য়’ এবং “ও’ লইয়া আমার বিবাদ নহে– আমার কথা এই যে আকারটি না থাকাতে ছত্রটির অর্থ পাওয়া যায় না।
শ্রীরঃ
উত্তর–
“হিম হিমকর তাপে তাপায়লু
ভৈগেল কাল বসন্ত।
কান্ত কাক মুখে নাহি সম্বাদই
কিয়ে করু মদন দুরন্ত।’
কান্ত কাকের মুখে সংবাদ পাঠাইলেন না পাঠ করিয়া প্রবন্ধ-লেখক অজ্ঞান হইয়াছেন। কাকের মুখে সংবাদ বড়ো আশ্চর্য কথা! লেখক নিশ্চয়ই কলিকাতাবাসী হইবেন, কাকের মুখে সংবাদ দেওয়ার কথা যে বঙ্গদেশের প্রায় সমুদয় স্থানেই (কলিকাতায় আছে কিনা জানি না) প্রচলিত আছে, তাহা তিনি অবগত নহেন। কাকই যে প্রেমের দূত এরূপ নহে; কোকিলও সময়ে সময়ে প্রেমের দৌত্য কার্য করিয়া থাকে। আমরা একটি গীতে শুনিয়াছি– “যা রে কোকিল আমার বঁধু আছে যে দেশে’ ইত্যাদি। হিন্দুস্থানী ভাষায় ষষ্ঠীতে “ক’ বিভক্তি হইতে কোথাও দেখি নাই; “কা’, “কি’, “কে’, “কিস্কা’ “কিস্কী’ “কিস্কে’ পড়িয়াছি। হিন্দী ব্যাকরণ ভাষা-চন্দ্রোদয়ে এই তিনটি বৈ ষষ্ঠীর বিভক্তি নাই। তবে “তাক’ হইতে তাহার “কাক’ হইতে কাহার টানিয়া বুনিয়া অর্থ করা যায়, কিন্তু তাহার সহিত ব্যাকরণের কোনো সংস্রব নাই।
শ্রীযোঃ
প্রত্যুত্তর– অমঙ্গল-সূচক কাক যে সংবাদ বহন করিতে পারে না এমন আমাদের কথা নহে। কিন্তু কোনো কবি এ পর্যন্ত কাককে প্রেমের ডাক-হরকরার কাজ দেন নাই। এ-সকল কাজ হংস, কোকিল, মেঘ, মাঝে মাঝে করিয়াছে। কাকের না চেহারা ভালো, না গলা ভালো, না স্বভাব ভালো; এই নিমিত্ত কবিরা কাককে প্রেমের কোমল কাজে নিযুক্ত করেন না। ব্যাকরণ-কারেরা যে ভাষার সৃষ্টি করে না, তাহা সকলেই জানেন। বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস প্রভৃতি কবিদের পদাবলীতে যদি শত শত স্থানে ষষ্ঠীতে “ক’ বিভক্তি ব্যবহার হইয়া থাকে, তবে আমার ব্যাকরণ খুলিবার কোনো আবশ্যক দেখিতেছি না। “কি কহব, রে, সখি, কানুক রূপ।’ “সুজনক প্রেম হেম সমতুল।’ “প্রেমক রীত অব বুঝহ বিচারি।’ “যাক দরশ বিনা ঝরয়ে পরাণ, অব নাহি হেরসি তাক বয়ান।’ এমন সহস্র উদাহরণ দেওয়া যায়।
শ্রীরঃ
উত্তর–
“দক্ষি পবন বহে কৈছে যুবতী সহে
তাহে দুখ দেই অনঙ্গ।
গেলহুঁ পরাণ আশা দেই রাখই
দশ নখে লিখই ভুজঙ্গ।
প্রবন্ধ-লেখক কৃত এই পদের অর্থ আমাদের বিশেষরূপে হৃদয়ঙ্গম হইল না। অনঙ্গ মহাদেবকেই ভয় করিতে পারে, বড়ো জোর না হয় নন্দীকে ভয় করিবে, কিন্তু সর্পকেও ভয় করিতে হইবে কেন বুঝা গেল না। সম্ভবত ইহার অন্য কোনো অর্থ আছে।
শ্রীযোঃ
প্রত্যুত্তর– আমি যে টীকা করিয়াছিলাম, তাহা উদ্ধৃত করি। “শিবের ভূষণ ভুজঙ্গকে মদন ভয় করেন, এইজন্য বিরহিনী নখে ভুজঙ্গ আঁকিয়া তাহাকে ভয় দেখাইয় প্রাণকে আশা দিয়া রাখিতেছেন।’ এই পদটির আরম্ভেই আছে,
“হিমকর পেখি আনত করু আনন
…
নয়ন কাজর দেই লিখই বিধুন্তুদ’–
ইত্যাদি।
চন্দ্রকে ভয় দেখাইবার জন্য রাধা রাহু আঁকিয়াছেন,তবে মদনকে ভয় দেখাইবার অভিপ্রায়ে সাপ আঁকা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব নহে। এত দ্রব্য থাকিতে রাধা সাপ আঁকিতে গেলেন কেন? তাহার প্রধান কারণ, তিনি কখনো Art-School-এ পড়েন নাই, এই নিমিত্ত তাঁহার পক্ষে নন্দীর ছবি আঁকা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার, কিন্তু মাটির উপরে অঙ্গুলি বুলাইয়া গেলেই অতি সহজে সাপ আঁকা যায়। তাহা ছাড়া, মহাদেবের সাপকে যে ভয় করিতে নাই এমন নহে।
শ্রীরঃ
পুস্তক-মধ্যে ছোটো ছোট অসাবধানতা সম্বন্ধে লেখক যে-সকল কথা বলিয়াছেন, তাহার কতকগুলির উত্তর দেওয়ার উপযুক্ত পাত্র সম্পাদক স্বয়ং। আমরা কেবল এ সম্বন্ধে দুই-চারিটি কথা বলিব। “কিয়ে’ শব্দের অর্থ কি অপেক্ষা কিবা ভালো হয়। “কিয়ে’ শব্দের স্থানে কি হয় কিনা, আমাদের সন্দেহ আছে। “কিয়া’ শব্দেই হিন্দীতে কি। কিয়ে শব্দে উর্দুতে করিয়াছিল অর্থ হয়। এরূপ অবস্থায় কিয়ে শব্দের অর্থে কিবা ব্যবহার করিয়া সম্পাদক দুষ্কর্ম করেন নাই। আর হাস্যজনক কথা কোথাও দেখিলাম না।
শ্রীযোঃ
প্রত্যুত্তর– “কিয়ে’ শব্দের অর্থে জিজ্ঞাসাসূচক “কি’ হয় কি না, এ বিষয়ে লেখকের সন্দেহ আছে। কিন্তু কেবলমাত্র ব্যাকরণ না পড়িয়া প্রাচীন কবিতা ভালো করিয়া পড়িলে এ সন্দেহ সহজেই যাইবে। উদাহরণ দেওয়া যাক।
“হাম যদি জানিয়ে পিরীতি দুরন্ত,
তব্ কিয়ে যায়ব পাপক অন্ত?’
“হাম যদি জানিতুঁ কানুক রীত
তব্ কিয়ে তা সঙে বাঁধিয়ে চিত?’
শ্রীরঃ
যাহা হউক এই প্রস্তাব লইয়া বিবাদ করা আমাদিগের অভিলাষ নহে। আমরা সম্পাদকের পক্ষে বা প্রবন্ধ-লেখকের বিপক্ষে নহি। প্রবন্ধ-লেখক মহাশয় স্থানে স্থানে যে-সকল ভুল বাহির করিয়াছেন তাহার মধ্যে কতকগুলি আমাদের ভুল বলিয়া বিশ্বাস হইয়াছে। তবে প্রবন্ধ-লেখক মহাশয় সম্পাদকের উপর যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাব প্রকাশ করিয়াছেন; তাঁহার গুরুতর পরিশ্রমের কথা বিস্মৃত হইয়া প্রকারান্তরে তাঁহাকে অলস ও এ কার্যে অক্ষম বলিয়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে এই কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে অনুরোধ করিয়াছেন– ইহা আমাদের ভালো লাগে নাই। আমরা পূর্বেও বলিয়াছি, এখনো বলিতেছি, যে, লেখার ভাব দেখিয়া আমাদের বোধ হইয়াছে যে, লেখক যেন, দোষ দেখাইয়া আনন্দ লাভ করিবার জন্যই কলম ধারণ করিয়াছিলেন। যেন তিনি কোনো কারণ প্রযুক্ত ইতিপূর্বে সম্পাদকের উপর চটিয়া ছিলেন, এক্ষণে সুযোগ পাইয়া এই প্রস্তাবে গাত্রের জ্বালা নিবারণ করিয়াছেন। এপ্রকার লেখার প্রশ্রয় আমরা দিতে পারি না।
আর সম্পাদকের নিকট আমাদের প্রার্থনা যে, তিনি যেন তাঁহার কাব্য-সংগ্রহের দ্বিতীয় সংস্করণে ইহার ভুলগুলি সংশোধন করিয়া দেন। তিনি গুরু পরিশ্রম করিয়া কাব্য সংগ্রহ করিয়াছেন তজ্জন্য বঙ্গবাসী তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ আছে। আর একটু পরিশ্রম করিয়া সামান্য সামান্য ভুলগুলি সংশোধন করিয়া দিলে আমরা তাঁহার নিকট অধিকতর কৃতজ্ঞ হইব।
শ্রীযোগেন্দ্রনারায়ণ রায়
প্রত্যুত্তর– যৎসামান্য শ্রম-স্বীকার পূর্বক ব্যাকরণ ও অভিধান না খুলিয়া সম্পাদক মহাশয় অসংকোচে টীকা করিয়া যাওয়াতে যে-সকল ভ্রমে পড়িয়াছেন, তাহা যদি সমস্ত উদ্ধৃত করিয়া দিই তাহা হইলে সহজেই প্রমাণ হইবে যে, আমি তাঁহাকে যে নিন্দা করিয়াছি তাহা অযথা হয় নাই। আমার প্রতি অন্যায় ও রুচি-বিগর্হিত দোষারোপ দূর করিবার নিমিত্ত ভবিষ্যতে সেইগুলি বিবৃত করিবার মানস রহিল। আমি সাহিত্যের সেবক। সাহিত্য লইয়াই অক্ষয়বাবুর সহিত বিবাদ করিয়াছি, তাহা আমার কর্তব্য কর্ম। সাহিত্য-বহির্ভূত ব্যক্তিগত কোনো কথার উল্লেখ করিয়া তাঁহার প্রতি আমার আক্রোশ প্রকাশ করি নাই; এমন স্থলে যদি কেহ বলেন যে, “লেখক কোনো কারণ প্রযুক্ত ইতিপূর্বে সম্পাদকের উপর চটিয়াছিলেন, এক্ষণে সুযোগ পাইয়া এই প্রস্তাবে গাত্রের জ্বালা নিবারণ করিয়াছেন’ তবে তাঁহার শিক্ষার অসম্পূর্ণতা ও রুচির বিকার প্রকাশ পায়। লেখক যাহাই মনে করুন, অক্ষয়বাবুর উপর আমার এতখানি বিশ্বাস আছে, যাহাতে অসংকোচে বলিতে পারি যে, তিনি এরূপ মনে করিবেন না। তিনি যে আদৌ এমন কষ্টসাধ্য ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, এবং এই কার্যসাধনে (আমার মনের মতো না হউক তবুও) অনেকটা পরিশ্রম করিয়াছেন, তজ্জন্য তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি, ও পূর্ব প্রবন্ধে যদি যথেষ্ট না করিয়া থাকি তবে মার্জনা চাহিতেছি।
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পরিশিষ্ট
উপস্থিত-সংখ্যক ভারতীতে বিদ্যাপতি সম্বন্ধে আমার একটি মাত্র বক্তব্য আছে। প্রাচীন-কাব্য-সংগ্রহ সমালোচনায় আমি “এ সখি, কি পেখনু এক অপরূপ’ ইত্যাদি পদটির অর্থ প্রকাশ করিয়াছিলাম। কিন্তু তাহার এক স্থানে অর্থ বুঝিতে গোলযোগ ঘটায় সন্দিগ্ধভাবে একটা অনুমান-করিয়া-লওয়া ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছিল। আর-একবার মনোযোগপূর্বক ভাবিয়া ইহার যে অর্থ পাইয়াছি, তাহাতে আর সন্দেহ করিবার কিছু নাই। কেহ কেহ বলেন এই পদটির আদিরস-ঘটিত গূঢ় অর্থ আছে; কিন্তু তাহা কোনো মতেই বিশ্বাস করা যায় না। সহজেই ইহার যে অর্থ পাওয়া যায় তাহা অগ্রাহ্য করিয়া ইহার মধ্য হইতে একটা অশ্লীল আদিরস-ঘটিত অর্থ বাহির করা নিতান্ত কষ্টকল্পনা ও অরসিক-কল্পনার কাজ। শ্রীকৃষ্ণের শরীরের বর্ণনাই ইহার মর্ম। প্রথমে পদটি উদ্ধৃত করি।
এ সখি কি পেখনু এক অপরূপ।
শুনাইতে মানবি স্বপন স্বরূপ॥
কমল-যুগল পর চাঁদকি মাল।
তা’পর উপজল তরুণ তমাল॥
তা’পর বেড়ল বিজুরী লতা।
কালিন্দী তীর ধীর চলি যাতা॥
শাখাশিখর সুধাকর পাঁতি।
তাহে নব-পল্লব অরুণক ভাতি॥
বিমল বিম্ব ফল যুগল বিকাশ।
তা’পর কির থির করু বাস॥
তা’পর চঞ্চল খঞ্জন যোড়।
তা’পর সাপিনী ঝাঁপল মোড়॥
সকলেই জানেন, দেবতাদের শরীর বর্ণনায় পা হইতে প্রথমে আরম্ভ করিয়া উপরে উঠিতে হয়। এই পদ্ধতি অনুসারে কবি প্রথমে নখ-চন্দ্র-মালা শোভিত চরণ-কমল-যুগলের বর্ণনা করিয়াছেন, তাহার উপরে তরুণ তমাল স্বরূপ কৃষ্ণের পদদ্বয় উঠিয়াছে। তাহার পর বিজুরী লতা অর্থাৎ পীত বসন সে পদদ্বয় বেষ্টন করিয়াছে; (বিদ্যুতের সহিত পীত বসনের উপমা অন্যত্র আছে, যথা– “অভিনব জলধর সুন্দর দেহ। পীত বসন পরা সৌদামিনী সেহ॥’) পদদ্বয়ের বর্ণনা সমাপ্ত হইলে পর পদদ্বয়ের কার্যের উল্লেখ হইল– “কালিন্দী তীর ধীর চলি যাতা॥’ তাহার পরে বাহুই শাখাদ্বয় ও তাহার অগ্রভাগে নখরের সুধাকর-পঙ্ক্তি ও তাহাতে অরুণভাতি করপল্লব। এইবারে বর্ণনা মুখমণ্ডলে আসিয়া পৌঁছিল। প্রথমে বিম্বফল ওষ্ঠাধর যুগল তাহাতে কিরণ অর্থাৎ হাস্য স্থির রূপে বাস করে। তাহার ঊর্ধ্বে চঞ্চল-খঞ্জন চক্ষু। ও সকলের ঊর্ধ্বে সাপিনীর বেষ্টনের ন্যায় শ্রীকৃষ্ণের চূড়া।
এখন আমি অসংকোচে ও নিঃসন্দিগ্ধ চিত্তে বলিতে পারি যে, উপরি-উক্ত অর্থই, ঐ পদটির যথার্থ অর্থ। ইহা ব্যতীত অন্য কোনো গূঢ় অর্থ বুঝানো কবির অভিপ্রায় ছিল না।
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কার্তিক, ১২৮৮
কর্তৃকারক
একবচন– রাম হাসে, বাঘে মানুষ খায়, ঘোড়ায় লাথি মারে, গোরুতে ধান খায়।
এইখানে একটা কথা পরিষ্কার করা দরকার। “রাম হাসে’ এই বাক্যে “রাম’ শব্দ কর্তৃকারক সন্দেহ নাই। কিন্তু “বাঘে মানুষ খায়’, “ঘোড়ায় লাথি মারে’, “গোরুতে ধান খায়’, বাক্যে “বাঘে’ “ঘোড়ায়’ “গোরুতে’ শব্দগুলি কর্তৃকারক এবং করণকারকের খিচুড়ি। “বাছুরে জন্মায় বা বাছুরে মরে’ এমন বাক্য বৈধ নহে, “বাছুরে তাকে চেটেচে’, চলে– অর্থাৎ এরূপ স্থলে কর্তার সঙ্গে কর্ম চাই। “ঘোড়ায় লাথি মারে’ বলি কিন্তু “ঘোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে’ বলি না। “লোকে নিন্দে করে’ বলি, কিন্তু “লোকে জমেচে’ না বলিয়া “লোক জমেচে’ বলি। আরো একটি কথা বিবেচ্য, বাংলায় কর্তৃকারকের এই প্রকার করণঘেঁষা রূপ কেবল একবচনেই চলে, আমরা বলি না “লোকগুলোতে নিন্দে করে’। তার কারণ, লোকে, বাঘে, ঘোড়ায় প্রভৃতি প্রয়োগ একবচনও নহে বহুবচনও নহে, ইহাকে সামান্যবচন বলা যাইতে পারে। ইহার প্রকৃত অর্থ, লোকসাধারণ, ব্যাঘ্রসাধারণ, ঘোটকসাধারণ। যখন বলা হয় “রামে মারলেও মরব, রাবণে মারলেও মরব’, তখন “রাম ও রাবণ’ ব্যক্তিবিশেষের অর্থত্যাগ করিয়া জাতিবিশেষের অর্থ ধারণ করে।
কর্তৃকারক বহুবচন=রাখালেরা চরাচ্চে, গাছগুলি নড়চে, লোকসব চলেচে।
কর্ম– ভাত খাই, গাছ কাটি, ছেলেটাকে মারি।
এইখানে একটু বক্তব্য আছে। কর্মকারকে সাধারণত প্রাণীপদার্থ সম্বন্ধেই “কে’ বিভক্তি প্রয়োগ হয়। কিন্তু তাহার ব্যতিক্রম আছে। যেমন, “এই টেবিলটাকে নড়াতে পারচি নে’ “সন্ন্যাসী লোহাকে সোনা করতে পারে’ “জিয়োমেট্রির এই প্রব্লেমটাকে কায়দা করতে হবে’ ইত্যাদি। অথচ “এই প্রব্লেমকে কষো, এই লোহাকে আনো, টেবিলকে তৈরি করো’ এরূপ চলে না। অতএব দেখিতেছি, অপ্রাণীবাচক শব্দের উত্তরে “টা’ বা “টি’ যোগ করিলে কর্মকারক তদুত্তরে “কে’ বিভক্তি হয়, যেমন “চৌকিটাকে সোরিয়ে দাও’ (“চৌকিকে সোরিয়ে দাও’ হয় না) “গাছটাকে কাটো’ (গাছকে কাটো’ হয় না)। ইহাতে বুঝা যাইতেছে “টি’ বা “টা’ যোগ করিলে শব্দবিশেষের অর্থ এমন একটা সুনির্দিষ্টতার জোর পায় যে তাহা যেন কতকটা প্রাণের গৌরব লাভ করে। “লোহাকে সোনা করা যায়’, বাক্যে “লোহা’ সেইরূপ যেন ব্যক্তিবিশেষের ভাব ধারণ করিয়াছে।
করণ– ছড়ি দিয়ে মারে, মাঠ দিয়ে যায়, হাত দিয়ে খায়, ঘোলে দুধের সাধ মেটে না, কথায় চিঁড়ে ভেজে না, কানে শোনে না।
অপাদান– রামের চেয়ে (চাইতে) শ্যাম বড়ো, এ গাছের থেকে ও গাছটা বড়ো, তোমা হোতেই এটা ঘট্ল, ঘর থেকে বেরোও।’
সম্বন্ধ– গাছের পাতা, আজকের কথা, সেদিনকার ছেলে।
অধিকরণ– নদীতে জল, লতায় ফুল, পকেটে টাকা।
বাংলায় কর্তৃকারক ছাড়া অপর কারকে বহুবচনসূচক কোনো চিহ্ন নাই।
কালচার ও সংস্কৃতি
১
কালচার্ শব্দের একটা নতুন বাংলা কথা হঠাৎ দেখা দিয়েছে; চোখে পড়েছে কি? কৃষ্টি। ইংরেজি শব্দটার আভিধানিক অর্থের বাধ্য অনুগত হয়ে ঐ কুশ্রী শব্দটাকে কি সহ্য করতেই হবে। এঁটেল পোকা পশুর গায়ে যেমন কাম্ড়ে ধরে ভাষার গায়ে ওটাও তেমনি কামড়ে ধরেছে। মাতৃভাষার প্রতি দয়া করবে না তোমরা?
অন্য প্রদেশে ভদ্রতা বোধ আছে। এই অর্থে সেখানে ব্যবহার “সংস্কৃতি’। যে-মানুষের কালচার আছে তাকে বলা চলে সংস্কৃতিমান, শব্দটাকে বিশেষ্য করে যদি বলা যায় সংস্কৃতিমত্তা, ওজনে ভারি হয় বটে কিন্তু রোমহর্ষক হয় না। নিজের সম্বন্ধে অহংকার করা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ, তবু আন্দাজে বলতে পারি, বন্ধুরা আমাকে কাল্চারড্ বলেই গণ্য করেন। কিন্তু যদি তাঁরা আমাকে সহসা কৃষ্টিমান উপাধি দেন বা আমার কৃষ্টিমত্তা সম্বন্ধে ভালোমন্দ কোনো কথার উত্থাপন করেন তবে বন্ধুবিচ্ছেদ হবে। অন্তত আমার মধ্যে কৃষ্টি আছে এ কথার প্রতিবাদ করাকে আমি আত্মলাঘব মনে করব না।
ইংরেজি ভাষায় চাষ এবং ভব্যতা একই শব্দে চলে গেছে ব’লে কি আমরাও বাংলা ভাষায় ফিরিঙ্গিয়ানা করব? ইংরেজিতে সুশিক্ষিত মানুষকে বলে কাল্টিভেটিভ– আমরা কি সেইরকম উঁচুদরের মানুষকে চাষ করা মানুষ ব’লে সম্মান জানাব, অথবা বলব কেদারনাথ।
[সংস্কৃতভাষায় উৎকর্ষ প্রকর্ষ শব্দের ধাতুগত অর্থে চাষের ভাব আছে কিন্তু ব্যবহারে সে অর্থ কেটে গেছে। কৃষ্টিতে তা কাটে নি। সেইজন্যে তোমাদের সম্পাদকবর্গের কাছে আমার এই প্রশ্ন, চিৎপ্রকর্ষ বা চিত্তপ্রকর্ষ বা চিত্তোৎকর্ষ শব্দটাকে কালচার অর্থে চালালে দোষ কি? কালচারড্ মানুষকে প্রকৃষ্টচিত্ত লোক বলা যেতে পারে। কালচারড্ ফ্যামিলিকে প্রকর্ষবান পরিবার বললে সে-পরিবার গৌরব বোধ করবে। কিন্তু কৃষ্টিমান বললে চন্দনের সাবান মেখে স্নান করতে ইচ্ছা হবে।]
২
গত জ্যৈষ্ঠের (১৩৪২) “প্রবাসীতে একস্থানে ইংরেজি “কাল্চার’ শব্দের প্রতিশব্দ রূপে “কৃষ্টি” শব্দের ব্যবহার দেখে মনে খট্কা লাগল। বাংলা খবরের কাগজে একদিন হঠাৎ-ব্রণের মতো ওই শব্দটা চোখে পড়ল, তার পরে দেখলুম ওটা বেড়েই চলেছে। সংক্রামকতা খবরের কাগজের বস্তি ছাড়িয়ে উপর মহলেও ছড়িয়ে পড়ছে দেখে ভয় হয়। “প্রবাসী’ পত্রে ইংরেজী অভিধানের এই “অবদান’টি সংস্কৃত ভাষার মুখোশ প’রে প্রবেশ করেছে, এটা নিঃসন্দেহ অনবধানতাবশত। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি বর্তমান বাংলাসাহিত্যে “অবদান’ শব্দটির যে প্রয়োগ দেখতে দেখতে ব্যাপ্ত হল সংস্কৃত শব্দকোষে তা খুঁজে পাই নি।
এবারে সেই গোড়াকার কথাটায় ফেরা যাক। কৃষ্টি কথাটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বাংলা ভাষার পায়ে বিঁধেছে। চিকিৎসা করা যদি সম্ভব না হয় অন্তত বেদনা জানাতে হবে। ঐ শব্দটা ইংরেজি শব্দের পায়ের মাপে বানানো। এতটা প্রণতি ভালো লাগে না।
ভাষায় কখনো কখনো দৈবক্রমে একই শব্দের দ্বারা দুই বিভিন্ন জাতীয় অর্থজ্ঞাপনের দৃষ্টান্ত দেখা যায়, ইংরেজিতে কাল্চার কথাটা সেই শ্রেণীর। কিন্তু অনুবাদের সময়েও যদি অনুরূপ কৃপণতা করি তবে সেটা নিতান্তই অনুকরণ-প্রবণতার পরিচায়ক।
সংস্কৃত ভাষায় কর্ষণ বলতে বিশেষভাবে চাষ করাই বোঝায় ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গযোগে মূল ধাতুটাকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থবাচক করা যেতে পারে, সংস্কৃত ভাষার নিয়মই তাই। উপসর্গভেদে এক কৃ ধাতুর নানা অর্থ হয়, যেমন উপকার বিকার আকার। কিন্তু উপসর্গ না দিয়ে কৃতি শব্দকে আকৃতি প্রকৃতি বা বিকৃতি অর্থে প্রয়োগ করা যায় না। উৎ বা প্র উপসর্গযোগে কৃষ্টি শব্দকে মাটির থেকে মনের দিকে তুলে নেওয়া যায়, যেমন উৎকৃষ্টি, প্রকৃষ্টি। ইংরেজি ভাষার কাছে আমরা এমনি কী দাসখৎ লিখে দিয়েছি যে তার অবিকল অনুবর্তন করে ভৌতিক ও মানসিক দুই অসবর্ণ অর্থকে একই শব্দের পরিণয়-গ্রন্থিতে আবদ্ধ করব?
বৈদিক সাহিত্যে সংস্কৃতি শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়, তাতে শিল্প সম্বন্ধেও সংস্কৃতি শব্দের প্রয়োগ আছে। “আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি।’ এ’কে ইংরেজি করা যেতে পারে, Arts indeed are the culture of soul। “ছন্দোময়ং বা এতৈর্যজমান আত্মানং সংস্কুরুতে’– এই-সকল শিল্পের দ্বারা যজমান আত্মার সংস্কৃতি সাধন করেন। সংস্কৃত ভাষা বলতে বোঝায় যে ভাষা বিশেষভাবে cultured, যে ভাষা culturedসম্প্রদায়ের। মারাঠি হিন্দী প্রভৃতি অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষায় সংস্কৃতি শব্দটাই কাল্চার অর্থে স্বীকৃত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ইতিহাস (cultural history) ক্রৈষ্টিক ইতিহাসের চেয়ে শোনায় ভালো। সংস্কৃত চিত্ত, সংস্কৃত বুদ্ধি cultured mind, cultured intelligenceঅর্থে কৃষ্টচিত্ত কৃষ্টবুদ্ধির চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রয়োগ সন্দেহ নেই। যে মানুষ culturedতাকে কৃষ্টিমান বলার চেয়ে সংস্কৃতিমান বললে তার প্রতি সম্মান করা হবে।
৩
মনিয়র বিলিয়ম্সের অভিধানে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ও তার আনুষঙ্গিক শব্দের ইংরেজি কয়েকটি প্রতিশব্দ নিম্নে উদ্ধৃত করা গেল। বর্তমান আলোচ্য প্রসঙ্গে যেগুলি অনাবশ্যক সেগুলি বাদ দিয়েছি।
কৃষ্ট–ploughed or tilled, cultivated ground।
কৃষ্টি–men, races of men, learned man or pandit, ploughing or cultivating the soil।
সংস্কার–making perfect, accomplishment, embellishment।
সংস্কৃত–perfected, refined, adorned, polished, a learned man।
সংস্কৃতি–perfection।
৮ ডিসেম্বর, ১৯৩২
চলতি ভাষার রূপ
নানা জেলায় ভাষার নানা রূপ। এক জেলার ভিন্ন অংশেও ভাষার বৈচিত্র্য আছে। এমন অবস্থায় কোথাকার ভাষা সাহিত্যে প্রবেশ লাভ করবে তা কোনো কৃত্রিম শাসনে স্থির হয় না, স্বতই সে আপনার স্থান আপনি করে। কলকাতা সমগ্র বাংলার রাজধানী। এখানে নানা উপলক্ষে সকল জেলার লোকের সমাবেশ ঘটে আসচে। তাই কলকাতার ভাষা কোনো বিশেষ জেলার নয়। স্বভাবতই এই অঞ্চলের ভাষাই সাহিত্য দখল করে বসেচে। যেটাকে লেখ্য ভাষা বলি সেটা কৃত্রিম, তাতে প্রাণপদার্থের অভাব, তার চলৎশক্তি আড়ষ্ট, সে বদ্ধ জলের মতো, সে ধারা জল নয়। তাতে কাজ চলে বটে কিন্তু সাহিত্য শুধু কাজ চলবার জন্যে নয়, তাতে মন আপনার বিচিত্র লীলার বাহন চায়। এই লীলাবৈচিত্র্য বাঁধা ভাষায় সম্ভব হয় না। এইজন্যেই কলকাতা অঞ্চলের চলতি ভাষাই সাহিত্যের আশ্রয় হয়ে উঠেচে। একদা যখন সাধু ভাষার একাধিপত্য ছিল তখনো যে কোনো জেলার লেখক নাটক প্রভৃতিতে কলকাতার কথাবার্তা ব্যবহার করেচেন, কখনোই পূর্ব বা উত্তর বঙ্গের উপভাষা ব্যবহার করেন নি– স্বভাবতই কলকাতার চলতি ভাষা তাঁরা গ্রহণ করেচেন। এর থেকে বুঝবে সাহিত্য স্বভাবতই কোন্ প্রণালী অবলম্বন করেচে।
৬ কার্তিক, ১৩৩৮
চিহ্নবিভ্রাট
“সঞ্চয়িতা’র মুদ্রণভার ছিল যাঁর ‘পরে, প্রুফ দেখার কালে চিহ্ন ব্যবহার নিয়ে তাঁর খটকা বাধে। সেই উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে আমার যে-চিঠি চলেছিল সেটা প্রকাশ করবার যোগ্য বলে মনে করি। আমার মতই যে সকলে গ্রহণ করবেন এমন স্পর্ধা মনে রাখি নে। আমিও যে-সব জায়গায় সম্পূর্ণ নিজের মতে চলব এত বড়ো সাহস আমার নেই। আমি সাধারণত যে-সাহিত্য নিয়ে কারবার করি পাঠকের মনোরঞ্জনের উপর তার সফলতা নির্ভর করে। পাঠকের অভ্যাসকে পীড়ন করলে তার মন বিগড়ে দেওয়া হয়, সেটা রসগ্রহণের পক্ষে অনুকূল অবস্থা নয়। তাই চল্তি রীতিকে বাঁচিয়ে চলাই মোটের উপর নিরাপদ। তবুও “সঞ্চয়িতা’র প্রুফে যতটা আমার প্রভাব খাটাতে পেরেছি ততটা চিহ্ন ব্যবহার সম্বন্ধে আমার মত বজায় রাখবার চেষ্টা প্রকাশ পেয়েছে। মতটা কী, দুখানা পত্রেই তা বোঝা যাবে। এই মত সাধারণের ব্যবহারে লাগবে এমন আশা করি নে কিন্তু এই নিয়ে উক্তি প্রত্যুক্তি হয়তো উপাদেয় হতে পারে। এখানে “উপাদেয়’ শব্দটা ব্যবহার করলুম ইন্টারেস্টিং শব্দের পরিবর্তে। এই জায়গাটাতে খাটল কিন্তু সর্বত্রই-যে খাটবে এমন আশা করা অন্যায়। “মানুষটি উপাদেয়’ বললে ব্যাঘ্রজাতির সম্পর্কে এ-বাক্যের সার্থকতা মনে আসতে পারে। এ স্থলে ভাষায় বলি, লোকটি মজার, কিংবা চমৎকার, কিংবা দিব্যি। তাতেও অনেক সময়ে কুলোয় না, তখন নতুন শব্দ বানাবার দরকার হয়। বলি, বিষয়টি আকর্ষক, কিংবা লোকটি আকর্ষক। “আগ্রহক’ শব্দও চালানো যেতে পারে। বলা বাহুল্য, নতুন তৈরি শব্দ নতুন নাগরা জুতোর মতোই কিছুদিন অস্বস্তি ঘটায়। মনোগ্রাহী শব্দও যথাযোগ্য স্থানে চলে– কিন্তু সাধারণত ইন্টারেস্টিং বিশেষণের চেয়ে এ বিশেষণের মূল্য কিছু বেশি। কেননা, অনেক সময়ে ইন্টারেস্টিং শব্দ দিয়ে দাম চোকানো, পারা-মাখানো আধলা পয়সা দিয়ে বিদায় করার মতো। বাঙালির গান শুনে ইংরেজ যখন বলে “হাউ ইন্টারেস্টিং’ তখন উৎফুল্ল হয়ে ওঠা মূঢ়তা। যে-শব্দের এত ভিন্নরকমের দাম অন্য ভাষার ট্যাঁকশালে তার প্রতিশব্দ দাবি করা চলে না। সকল ভাষার মধ্যেই গৃহিণীপনা আছে। সব সময়ে প্রত্যেক শব্দ সুনির্দিষ্ট একটিমাত্র অর্থই যে বহন করে তা নয়। সুতরাং অন্য ভাষায় তার একটিমাত্র প্রতিশব্দ খাড়া করবার চেষ্টা বিপত্তিজনক। “ভরসা’ শব্দের একটা ইংরেজি প্রতিশব্দ courage, আর-একটা expectation। আবার কোনো কোনো জায়গায় দুটো অর্থই একত্রে মেলে, যেমন–
নিশিদিন ভরসা রাখিস
ওরে মন হবেই হবে।
এখানে দষয়ক্ষতফন বটে বষসনও বটে। সুতরাং এটাকে ইংরেজিতে তরজমা করতে হলে ও দুটোর একটাও চলবে না। তখন বলতে হবে–
Keep firm the faith, my heart,
it must come to happen।
উল্টে বাংলায় তরজমা করতে হলে “বিশ্বাস’ শব্দের ব্যবহারে কাজ চলে বটে কিন্তু “ভরসা’ শব্দের মধ্যে যে একটা তাল ঠোকার আওয়াজ পাওয়া যায় সেটা থেমে যায়।
ইংরেজি শব্দের তরজমায় আমাদের দাসভাব প্রকাশ পায়, যখন একই শব্দের একই প্রতিশব্দ খাড়া করি। যথা “সিম্প্যাথির’ প্রতিশব্দে সহানুভূতি ব্যবহার। ইংরেজিতে সিম্প্যাথি কোথাও বা হৃদয়গত কোথাও বা বুদ্ধিগত। কিন্তু সহানুভূতি দিয়েই দুই কাজ চালিয়ে নেওয়া কৃপণতাও বটে হাস্যকরতাও বটে। “এই প্রস্তাবের সঙ্গে আমার সহানুভূতি আছে’ বললে মানতে হয় যে প্রস্তাবের অনুভূতি আছে। ইংরেজি শব্দটাকে সেলাম করব কিন্তু অতটা দূর পর্যন্ত তার তাঁবেদারি করতে পারব না। আমি বলব “তোমার প্রস্তাবের সমর্থন করি’।
এক কথা থেকে আর-এক কথা উঠে পড়ল। তাতে কী ক্ষতি আছে। যাকে ইংরেজিতে বলে essay, আমরা বলি প্রবন্ধ, তাকে এমনতরো অবন্ধ করলে সেটা আরামের হয় বলে আমার ধারণা। নিরামিষ-ভোজীকে গৃহস্থ পরিবেশন করবার সময় ঝোল আর কাঁচকলা দিয়ে মাছটা গোপন করতে চেয়েছিল, হঠাৎ সেটা গড়িয়ে আসবার উপক্রম করতেই তাড়াতাড়ি সেরে নিতে গেল, নিরামিষ পঙ্ক্তি-বাসী ব্যাকুল হয়ে বলে উঠল “যো আপসে আতা উসকো আনে দেও।’
তোমাদের কোনো কোনো লেখায় এই রকম আপ্সে আনেওয়ালাদের নির্বিচারে পাতে পড়তে দিয়ো, নিশ্চিত হবে উপাদেয়, অর্থাৎ ইন্টারেস্টিং। এবার পত্র দুটোর প্রতি মন দেও। এইখানে বলে রাখি, ইংরেজিতে, যে-চিহ্নকে অ্যাপসট্রফির চিহ্ন বলে কেউ কেউ বাংলা পারিভাষিকে তাকে বলে “ইলেক’, এ আমার নতুন শিক্ষা। এর যাথার্থ্য সম্বন্ধে আমি দায়িক নই; এই পত্রে উক্ত শব্দের ব্যবহার আছে।
১
একদা আমার মনে তর্ক উঠেছিল যে, চিহ্নগুলো ভাষার বাইরের জিনিস, সেগুলোকে অগত্যার বাইরে ব্যবহার করলে ভাষার অভ্যাস খারাপ হয়ে যায়। যেমন, লাঠিতে ভর ক’রে চললে পায়ের ‘পরে নির্ভর কমে। প্রাচীন পুঁথিতে দাঁড়ি ছাড়া আর-কোনো উপসর্গ ছিল না, ভাষা নিজেরই বাক্যগত ভঙ্গি দ্বারাই নিজের সমস্ত প্রয়োজনসিদ্ধি করত। এখন তার এত বেশি নোকর চাকর কেন। ইংরেজের ছেলে যখন দেশে থাকে তখন একটিমাত্র দাসীতেই তার সব কাজ চলে যায়, ভারতবর্ষে এলেই তার চাপরাসী হরকরা বেহারা বাটলার চোপদার জমাদার মালী মেথর ইত্যাদি কত কী। আমাদের লিখিত ভাষাকেও এইরকম হাকিমী সাহিবিয়ানায় পেয়ে বসেছে। “কে হে তুমি’ বাক্যটাই নিজের প্রশ্নত্ব হাঁকিয়ে চলেছে তবে কেন ওর পিছনে আবার একটা কুঁজ-ওয়ালা সহিস। সব চেয়ে আমার খারাপ লাগে বিস্ময়ের চিহ্ন। কেননা বিস্ময় হচ্ছে একটা হৃদয়ভাব– লেখকের ভাষায় যদি সেটা স্বতই প্রকাশিত না হয়ে থাকে তা হলে একটা চিহ্ন ভাড়া করে এনে দৈন্য ঢাকবে না। ও যেন আত্মীয়ের মৃত্যুতে পেশাদার শোকওয়ালির বুক-চাপড়ানি। “অহো, হিমালয়ের কী অপূর্ব গাম্ভীর্য’। এর পরে কি ঐ ফোঁটা-সওয়ারি দাঁড়িটার আকাশে তর্জনী-নির্দেশের দরকার আছে– (রোসো, প্রশ্নচিহ্নটা এখানে না দিলে কি তোমার ধাঁধা লাগবে?)। কে, কি, কেন, কার, কিসে, কিসের, কত প্রভৃতি এক ঝাঁক অব্যয় শব্দ তো আছেই তবে চিহ্নের খোশামুদি করা কেন। “তুমি তো আচ্ছা লোক’ এখানে “তো’– ইঙ্গিতের পিছনে আরো-একটা চিহ্নের ধাক্কা দিয়ে পাঠককে ডব্ল্ চমক খাওয়ানোর দরকার আছে কি। পাঠক কি আফিমখোর। “রোজ রোজ যে দেরি করে আসো’ এই বাক্যবিন্যাসেই কি নালিশের যথেষ্ট জোর পৌঁছল না। যদি মনে কর অর্থটা স্পষ্ট হল না তা হলে শব্দযোগে অভাব পূরণ করলে ভাষাকে বৃথা ঋণী করা হয় না– যথা, “রোজ রোজ বড়ো-যে দেরি করে আস’। মুশকিল এই যে, পাঠককে এমনি চিহ্ন-মৌতাতে পেয়ে বসেছে, ওগুলো না দেখলে তার চোখের তার থাকে না। লঙ্কাবাটা দিয়ে তরকারি তো তৈরি হয়েছেই কিন্তু সেইসঙ্গে একটা আস্ত লঙ্কা দৃশ্যমান না হলে চোখের ঝাল জিভের ঝালে মিলনাভাবে ঝাঁঝটা ফিকে বোধ হয়।
ছেদ চিহ্নগুলো আর-এক জাতের। অর্থাৎ যদি-সংকেতে পূর্বে ছিল দণ্ডহাতে একাধিপত্য-গর্বিত সিধে দাঁড়ি– কখনো-বা একলা কখনো দোকলা। যেন শিবের তপোবনদ্বারে নন্দীর তর্জনী। এখন তার সঙ্গে জুটে গেছে বাঁকা বাঁকা ক্ষুদে ক্ষুদে অনুচর। কুকুরবিহীন সংকুচিত লেজের মতো। যখন ছিল না তখন পাঠকের আন্দাজ ছিল পাকা, বাক্যপথে কোথায় কোথায় বাঁক তা সহজেই বুঝে নিত। এখন কুঁড়েমির তাগিদে বুঝেও বোঝে না। সংস্কৃত নাটকে দেখেছ রাজার আগে আগে প্রতিহারী চলে– চিরাভ্যস্ত অন্তঃপুরের পথেও ক্ষণে ক্ষণে হেঁকে ওঠে, “এই দিকে’ “এই দিকে’। কমা সেমিকোলনগুলো অনেকটা তাই।
একদিন চিহ্নপ্রয়োগে মিতব্যয়ের বুদ্ধি যখন আমাকে পেয়ে বসেছিল তখনই আমার কাব্যের পুনঃসংস্করণকালে বিস্ময়সংকেত ও প্রশ্নসংকেত লোপ করতে বসেছিলুম। প্রৌঢ় যতিচিহ্ন সেমিকোলনকে জবাব দিতে কুণ্ঠিত হই নি। কিশোর কমা-কে ক্ষমা করেছিলুম, কারণ, নেহাত খিড়কির দরজায় দাঁড়ির জমাদারী মানানসই হয় না। লেখায় দুই জাতের যতিই যথেষ্ট, একটা বড়ো একটা ছোটো। সূক্ষ্ম বিচার করে আরো-একটা যদি আনো তা হলে অতি সূক্ষ্ম বিচার করে ভাগ আরো অনেক বাড়বে না কেন।
চিহ্নের উপর বেশি নির্ভর যদি না করি তবে ভাষা সম্বন্ধে অনেকটা সতর্ক হতে হয়। মনে করো কথাটা এই : “তুমি যে বাবুয়ানা শুরু করেছ।’ এখানে বাবুয়ানার উপর ঠেস দিলে কথাটা প্রশ্নসূচক হয়– ওটা একটা ভাঙা প্রশ্ন– পুরিয়ে দিলে দাঁড়ায় এই, “তুমি যে বাবুয়ানা শুরু করেছ তার মানেটা কী বলো দেখি।’ “যে’ অব্যয় পদের পরে ঠেস দিলে বিস্ময় প্রকাশ পায়। “তুমি যে বাবুয়ানা শুরু করেছ’। প্রথমটাতে প্রশ্ন এবং দ্বিতীয়টাতে বিস্ময়চিহ্ন দিয়ে কাজ সারা যায়। কিন্তু যদি চিহ্ন দুটো না থাকে তা হলে ভাষাটাকেই নিঃসন্দিগ্ধ করে তুলতে হয়। তা হলে বিস্ময়সূচক বাক্যটাকে শুধরিয়ে বলতে হয়– “যে বাবুয়ানা তুমি শুরু করেছ’।
এইখানে আর-একটা আলোচ্য কথা আছে। প্রশ্নসূচক অব্যয় “কি’ এবং প্রশ্নবাচক সর্বনাম “কি’ উভয়ের কি এক বানান থাকা উচিত। আমার মতে বানানের ভেদ থাকা আবশ্যক। একটাতে হ্রস্ব ই ও অন্যটাতে দীর্ঘ ঈ দিলে উভয়ের ভিন্ন জাতি এবং ভিন্ন অর্থ বোঝবার সুবিধা হয়। “তুমি কি রাঁধছ’ “তুমি কী রাঁধছ’– বলা বাহুল্য এ দুটো বাক্যের ব্যঞ্জনা স্বতন্ত্র। তুমি রাঁধছ কিনা, এবং তুমি কোন্ জিনিস রাঁধছ, এ দুটো প্রশ্ন একই নয়, অথচ এক বানানে দুই প্রয়োজন সারতে গেলে বানানের খরচ বাঁচিয়ে প্রয়োজনের বিঘ্ন ঘটানো হবে। যদি দুই “কি’-এর জন্যে দুই ইকারের বরাদ্দ করতে নিতান্তই নারাজ থাক তা হলে হাইফেন ছাড়া উপায় নেই। দৃষ্টান্ত : “তুমি কি রাঁধ্ছ’ এবং “তুমি কি-রাঁধ্ছ’। এই পর্যন্ত থাক্।
২
আমার প্রুফ-সংশোধনপ্রণালী দেখলেই বুঝতে পারবে আমি নিরঞ্জনের উপাসক– চিহ্নের অকারণ উৎপাত সইতে পারি নে। কেউ কেউ যাকে ইলেক বলে (কোন্ ভাষা থেকে পেলে জানি নে) তার ঔদ্ধত্য হাস্যকর অথচ দুঃসহ। অসমাপিকা ক’রে ব’লে প্রভৃতিতে দরকার হ’তে পারে কিন্তু “হেসে’ “কেঁদে’-তে একেবারেই দরকার নেই। “করেছে বলেছে’-তে ইলেক চড়িয়ে পাঠকের চোখে খোঁচা দিয়ে কী পুণ্য অর্জন করবে জানি নে। করবে চলবে প্রভৃতি স্বতঃসম্পূর্ণ শব্দগুলো কী অপরাধ করেছে যে, ইলেককে শিরোধার্য করতে তারা বাধ্য হবে। “যার’-“তার’ উপর ইলেক চড়াও নি ব’লে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। পাছে হল (লাঙল) এবং হল (হইল) শব্দে অর্থ নিয়ে ফৌজদারি হয় সেজন্যে ইলেকের বাঁকা বুড়ো আঙুল না দেখিয়ে অকপটচিত্তে হোলো লিখতে দোষ কী। এ ক্ষেত্রে ঐ ইলেকের ইশারাটার কী মানে তা সকলের তো জানা নেই। হোলো শব্দে দুটো ওকার ধ্বনি আছে– এক ইলেক কি ঐ দুটো অবলাকেই অন্তঃপুরে অবগুণ্ঠিত করেছেন। হতে ক্রিয়াপদ যে-অর্থ স্বভাবতই বহন করে তা ছাড়া আর কোনো অর্থ তার পরে আরোপ করা বঙ্গভাষায় সম্ভব কি না জানি নে অথচ ঐ ভালোমানুষ দাগীরূপে চিহ্নিত করা ওর কোন্ নিয়তির নির্দেশে। স্তম্ভপরে পালঙ্কপরে প্রভৃতি শব্দ কানে শোনবার সময় কোনো বাঙালির ছেলে ইলেকের অভাবে বিপন্ন হয় না, পড়বার সময়েও স্তম্ভ পালঙ্ক প্রভৃতি শব্দকে দিন মুহূর্ত প্রভৃতি কালার্থক শব্দ বলে কোনো প্রকৃতিস্থ লোকের ভূল করবার আশঙ্কা নেই। “চলবার’ “বলবার’ মরবার’ “ধরবার’ শব্দগুলি বিকল্পে দ্বিতীয় কোনো অর্থ নিয়ে কারবার করে না তবু তাদের সাধুত্ব রক্ষার জন্যে লেজগুটোনো ফোঁটার ছাপ কেন। তোমার প্রুফে দেখলুম “হয়ে’ শব্দটা বিনা চিহ্নে সমাজে চলে গেল অথচ “ল’য়ে’ কথাটাকে ইলেক দিয়ে লজ্জিত করেছ। পাছে সংগীতের লয় শব্দটার অধিকারভেদ নিয়ে মামলা বাধে এইজন্যে। কিন্তু সে রকম সুদূর সম্ভাবনা আছে কি। লাখে যদি একটা সম্ভাবনা থাকে তারি জন্যে কি হাজার হাজার নিরপরাধকে দাগা দেবে। কোন্ জায়গায় এরকম বিপদ ঘটতে পারে তার নমুনা আমাকে পাঠিয়ে দিয়ো। যেখানে যুক্ত ক্রিয়াপদে অসমাপিকা থাকে সেখানে তার অসমাপ্তি সম্বন্ধে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না। যেমন, বলে ফেলো, করে দাও ইত্যাদি। অবশ্য করে দাও মানে হাতে দাও হতেও পারে কিন্তু সমগ্র বাক্যের যোগে সে রকম অর্থবিকল্প হয় না– যেমন কাজ করে দাও। “বলে ফেলো’ কথাটাকে খণ্ডিত করে দেখলে আর-একটা মানে কল্পনা করা যায়, কেউ-একজন বলে, “ফেলো’। কিন্তু আমরা তো সব প্রথমভাগ বর্ণপরিচয়ের টুকরো কথার ব্যবসায়ী নই। “তুমি বলে যাও’ কথাটা স্বতই স্পষ্ট, কেবল দুর্দৈবক্রমে, তুমি বল্ নাচে যাও এমন মানে হতেও পারে– সেই ক্কচিৎ দুর্যোগ এড়াবার জন্যে eternal punishment কি দয়া কিংবা ন্যায়ের পরিচায়ক। “দেবতা নিশ্বাস ছাড়ি কহিলেন–‘ সমস্ত বাংলা দেশে যত পাঠশালায় যত ছেলে আছে পরীক্ষা করে দেখো একজনেরও ইলেকের দরকার হয় কি না, তবে কেন তুমি না-হক মুদ্রাকরকে পীড়িত করলে। তোমার প্রুফে তুমি ক্ষুদে ক্ষুদে চিহ্নের ঝাঁকে আমার কাব্যকে এমনি আচ্ছন্ন করেছ যে তাদের জন্য মশারি ফেলতে ইচ্ছে হয়। আবার প্রুফে আমি এর একটাও ব্যবহার করি নি– কেননা, জানি বুঝতে কানাকড়ি পরিমাণেও বাধে না। জানি আমার বইয়ে নানা বানানে চিহ্নপ্রয়োগের নানা বৈচিত্র্য ঘটেছে– তা নিয়েও আমি মাথা বকাই নে– যেখানে দেখি অর্থবোধে বিপত্তি ঘটে সেখানে ছাড়া এইদিকে আমি দৃক্পাতও করি নে। প্রুফে যত অনাবশ্যক সংশোধন বাড়াবে ভুলের সম্ভাবনা ততই বাড়বে– সময় নষ্ট হবে, তার বদলে লাভ কিছুই হবে না। ততো যতো শব্দে ওকার নিতান্ত অসংগত। মতো সম্বন্ধে অন্য ব্যবস্থা। মোটের উপর আমার বক্তব্য এই– পাঠককে গোড়াতেই পাগল নির্বোধ কিংবা আহেলাবেলাতি বলে ধরে নিয়ো না– যেখানে তাদের ভুল করবার কোনো সম্ভাবনা নেই সেখানে কেবলই তাদের চোখে আঙুল দিয়ো না– চাণক্যের মতো চিহ্নের কুশাঙ্কুরগুলো উৎপাটিত কোরো তা হলে বানানভীরু শিশুদের যিনি বিধাতা তাঁর আশীর্বাদ লাভ করবে।
আমি যে নির্বিচারে চিহ্নসূয়যজ্ঞের জনমেজয়গিরি করতে বসেছি তা মনে কোরো না। কোনো কোনো স্থলে হাইফেন চিহ্নটার প্রয়োজন স্বীকার করি। অব্যয় “যে’ এবং সর্বনাম “যে’ শব্দের প্রয়োগভেদ বোঝাবার জন্যে আমি হাইফেনের শরণাপন্ন হই। “তুমি যে কাজে লেগেছ’ বলতে বোঝায় তুমি অকর্মণ্য নও, এখানে “যে’ অব্যয়। “তুমি যে কাজে লেগেছ’ এখানে কাজকে নির্দিষ্ট করবার জন্য “যে’ সর্বনাম বিশেষণ। প্রথম “যে’ শব্দে হাইফেন দিয়ে “তুমি’-র সঙ্গে ও দ্বিতীয় “যে’-কে “কাজ’ শব্দের সঙ্গে যুক্ত করলে অর্থ স্পষ্ট হয়। অন্যত্র দেখো– “তিনি বললেন যে আপিসে যাও, সেখানে ডাক পড়েছে’। এখানে “যে’ অব্যয়। অথবা তিনি বললেন “যে আপিসে যাও সেখানে ডাক পড়েছে।’ এখানে “যে’ সর্বনাম, আপিসের বিশেষণ। হাইফেন চিহ্নে অর্থভেদ স্পষ্ট করা যায়। যথা, “তিনি বললেন-যে আপিসে যাও, সেখানে ডাক পড়েছে।’ এবং “তিনি বললেন যে-আপিসে যাও সেখানে ডাক পড়েছে।’
৮ ডিসেম্বর, ১৯৩২
জাতীয় সাহিত্য
আমরা “বাংলা জাতীয় সাহিত্য’ প্রবন্ধের নামকরণে ইংরাজি “ন্যাশনাল’ শব্দের স্থলে “জাতীয়’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছি বলিয়া “সাহিত্য’-সম্পাদক মহাশয় আমাদের প্রতি কিঞ্চিৎ শ্লেষকটাক্ষপাত করিয়াছেন।
প্রথমত, অনুবাদটি আমাদের কৃত নহে; এই শব্দ বহুকাল হইতে বাংলা সাহিত্যে ন্যাশনাল-শব্দের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। দ্বিতীয়ত, ভাষার পরিণতি সহকারে স্বাভাবিক নিয়মে অনেকগুলি শব্দের অর্থ বিস্তৃতি লাভ করে। “সাহিত্য’ শব্দটি তাহার উদাহরণস্থল। সাহিত্য-সম্পাদক মহাশয়ও “সাহিত্য’ শব্দটিকে ইংরাজি “লিটারেচর’ অর্থে প্রয়োগ করিয়া থাকেন। সম্পাদক মহাশয় সংস্কৃতজ্ঞ, ইহা তাঁহার অবিদিত নাই যে, “লিটারেচর’ শব্দের অর্থ যতদূর ব্যাপক, সাহিত্য শব্দের অর্থ ততদূর পৌঁছে না। শব্দকল্পদ্রুম অভিধানে “সাহিত্য’ শব্দের অর্থ এইরূপ নির্দিষ্ট হইয়াছে “মনুষ্যকৃতশ্লোকময়গ্রন্থবিশেষঃ। স তু ভট্টিরঘুকুমারসম্ভবমাঘভারবিমেঘদূতবিদগ্ধমুখমণ্ডন-শান্তিশতকপ্রভৃতয়ঃ।’ এমন-কি, রামায়ণ মহাভারতও সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হয় নাই, তাহা ইতিহাসরূপে খ্যাত ছিল। এইজন্য মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় “সাহিত্য’ শব্দের পরিবর্তে “বাঙ্ময়’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়া থাকে। রঘুবংশের তৃতীয় সর্গে ২৭শ শ্লোকে আছে–
লিপের্যথাবদ্গ্রহণেন বাঙ্ময়ং
নদীমুখেনেব সমুদ্রমাবিশৎ।
অর্থাৎ রঘু লিপিরূপ নদীপথ দিয়া বাঙ্ময়রূপ সমুদ্রে প্রবেশ করিলেন।
“জাতি’ শব্দ এবং “নেশন্’ শব্দ উভয়েরই মূল ধাতুগত অর্থ এক। জন্মগত ঐক্য নির্দেশ করিবার জন্য উভয় শব্দের উৎপত্তি। আমরা ব্রাহ্মণ প্রভৃতি বর্ণকে জন্মগত ঐক্যবশত জাতি বলি, আবার বাঙালি প্রভৃতি প্রজাবর্গকেও সেই কারণেই জাতি বলিয়া থাকি। জাতি শব্দের শেষোক্ত প্রয়োগের স্থলে ইংরাজিতে “নেশন্’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যথা, বাঙালি জাতি=বেঙ্গলি নেশন্। এরূপ স্থলে “ন্যাশনাল’ শব্দের প্রতিশব্দরূপে “জাতীয়’ শব্দ ব্যবহার করাতে বিশেষ দোষের কারণ দেখা যায় না। আমরাও তাহাই করিয়াছি। কিন্তু সম্পাদক মহাশয় অকস্মাৎ অকারণে অনুমান করিয়া লইয়াছেন যে, আমরা “জাতীয় সাহিত্য’ শব্দে “ভর্ন্যাক্যুলর লিট্রেচর্’ শব্দের অপূর্ব তর্জমা করিয়াছি! বিনীতভাবে জানাইতেছি আমরা এমন কাজ করি নাই। সাহিত্য যে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আমোদ বা শিক্ষাসাধক নহে, তাহা যে সমস্ত জাতির “জাতীয়’ বন্ধন দৃঢ়তর করে, বাংলা সাহিত্য, যে, বাঙালি জাতির ভূত ভবিষ্যৎকে এক সজীব সচেতন নাড়ি-বন্ধনে বাঁধিয়া দিয়া তাহাকে বৃহত্তর এবং ঘনিষ্ঠতর করিয়া তুলিবে– আমাদের প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গের বিশেষরূপ অবতারণা ছিল বলিয়া, আমরা বাংলা সাহিত্যকে, ব্যক্তিগত রসসম্ভোগের হিসাবে নহে, পরন্তু জাতীয় উপযোগিতার হিসাবে আলোচনা করিয়াছিলাম বলিয়াই তাহাকে বিশেষ করিয়া জাতীয় সাহিত্য অ্যাখ্যা দিয়াছিলাম। সভাস্থলে বক্তৃতা পাঠ করিতে হইলে শ্রোতৃসাধারণের দ্রুত অবগতির জন্য বিষয়টিকে কিঞ্চিৎ বিস্তারিত করিয়া বলা আবশ্যক হইয়া পড়ে– আমরাও বক্তৃতার বিষয় যথোচিত বিস্তৃত করিয়া বলিয়া কেবল সম্পাদক মহাশয়ের নিন্দাভাজন হইলাম কিন্তু তথাপিও তিনি আমাদের বক্তব্য-বিষয়টিকে সম্যক্ গ্রহণ করিতে পারিলেন না ইহাতে আমাদের দ্বিগুণ দুঃখ রহিয়া গেল।
আষাঢ়, ১৩০২
নামের পদবী
শ্রীযুক্ত সত্যভূষণ সেন বাঙালি মেয়ের পদবী প্রসঙ্গে আমাকে যে চিঠিখানি লিখেছেন তার উত্তরে আমার যা বলবার আছে বলে নিই, যদিও ফলের আশা রাখি নে।
বাংলা দেশে সামাজিক ব্যবহারে পরস্পরের সম্মানের তারতম্য জাতের সঙ্গে বাঁধা ছিল। দেখাসাক্ষাৎ হলে জাতের খবরটা আগে না জানতে পারলে অভিবাদন অভ্যর্থনা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থাকত। পাকা পরিচয় পেলে তবে একপক্ষ পায়ের ধুলো দেবে, আর-একপক্ষ নেবে, আর বাকি যারা তারা পরস্পরকে নমস্কার করবে কিংবা কিছুই করবে না এই ছিল বিধান। সামাজিক ব্যবহারের বাইরে লৌকিক ব্যবহারে যে-একটা সাধারণ শিষ্টতার নিয়ম প্রায় সকল দেশেই আছে– আমাদের দেশে অনতিকালপূর্বেও তা ছিল না। যেখানে স্বার্থের গরজ ছিল এমন কোনো কোনো স্থলে এ নিয়ে মুশকিল ঘটত। উচ্চপদস্থ বা ধনশালী লোকের কাছে উমেদারি করবার বেলা নতিস্বীকার করে তুষ্ট করা প্রার্থীর পক্ষে অত্যাবশ্যক কিন্তু জাতে-বাঁধা রীতি ছাড়া আর কোনো রীতি না থাকাতে কিছুদিন পূর্বে এই রকম সংকটের স্থলে সম্মানের একটা কৃপণ প্রথা দায়ে পড়ে উদ্ভাবিত হয়েছিল। সে হচ্ছে ডান হাতে মুঠো বেঁধে দ্রুতবেগে নিজের নাসাগ্র আঘাত করা, সেটা দেখতে হত নিজেকে ধিক্কার দেওয়ার মতো। এই রকম সংশয়কুণ্ঠিত অনিচ্ছুক অশোভন বিনয়াচার এখন আর দেখতে পাই নে।
তার প্রধান কারণ, বাঙালিসমাজে পূর্বকালের গ্রাম্যতা এখন নেই বললেই হয়, জাতের গণ্ডি পেরিয়ে লোকব্যবহারে পরস্পরের প্রতি একটা সাধারণ শিষ্টতার দাবি স্বীকার করবার দিন এসেছে। তা ছাড়া কাউকে বিশেষ সম্মান দেবার বেলায় আজ আমরা বিশেষ করে মানুষের জাত খুঁজি নে। মেয়ের বিবাহ-সম্বন্ধ-বেলায় কোনো কোনো পরিবারে আজও কৌলীন্যের আদর থাকতে পারে– কিন্তু বৈঠকমজলিসে সভা-সমিতিতে ইস্কুলেকলেজে আপিসেআদালতে তার কোনো চিহ্ন নেই; সে-সব জায়গায় ব্রাহ্মণের চেয়ে কুলীনের চেয়ে অনেক বড়ো মান সর্বদাই অন্য জাতের লোক পেয়ে থাকে। অতএব আজকের দিনে জনসমাজে কার কোন্ আসন সেটা জাতের দ্বারা ঘের দিয়ে সুরক্ষিত নেই, ভোজের স্থানেও পঙ্ক্তি-বিভাগের দাগটা কোথাও-বা লুপ্ত, কোথাও-বা অত্যন্ত ফিকে। মানুষের পরিচয়ে জাত-পরিচয়ের দাম এক সময়ে যত বড়ো ছিল এখন তা প্রায় নেই বলা যেতে পারে।
দাম যখন বেশি ছিল, এমন-কি, সম্মানের বাজারে সেইটেই যখন প্রায় একান্ত ছিল তখন নামের সঙ্গে পদবী বহন করাটা বাহুল্য ছিল না। কেননা আমাদের পদবী জাতের পদবী। ইংরেজিতে স্মিথ পদবী পারিবারিক, যদিও ছড়িয়ে গিয়ে এর পারিবারিক বিশেষত্ব অনেক পরিমাণে হারিয়ে গেছে। কিন্তু ঘোষ বোস চাটুজ্যে বাঁড়ুজ্যে মূলত কোনো পরিবারকে নির্দেশ করে না, জাতবিশেষের বিভাগকে নির্দেশ করে। পরিবারের চেয়ে এই বিভাগটা অনেক ব্যাপক। এমনতর ব্যাপক সংজ্ঞার যখন বিশেষ মূল্য ছিল তখনি নামের সঙ্গে ব্যবহারে সেটার বিশেষ সার্থকতা ছিল, এখন মূল্য যতই কমে আসছে ততই পারিবারিক পরিচয় হিসাবে ওর বিশিষ্টতা থাকছে না, অন্য হিসাবেও নয়।
ভারতবর্ষে বাংলা দেশ ছাড়া প্রায় সকল প্রদেশেই পদবীহীন নাম বিনা উপদ্রবেই চলে আসছে। এতদিন তো তা নিয়ে কারো মনে কোনো খট্কা লাগে নি। বারাণসীর স্বনামখ্যাত ভগবানদাস তাঁর ব্যক্তিগত নামটুকু নিয়েই আছেন। তাঁর ছেলের নাম শুদ্ধমাত্র শ্রীপ্রকাশ, নামের সঙ্গে কুলপরিচয় নেই। রাষ্ট্রিক উদ্যোগে খ্যাতিলাভের দ্বারা তিনি আপন নিষ্পদবিক নামটিকেই জনাদৃত করে তুলছেন।
প্রাচীনকালের দিকে তাকালে নল-দময়ন্তী বা সাবিত্রী-সত্যবানের কোনো পদবী দেখা যায় না। একান্ত আশা করি, নলকে নলদেববর্মা বলে ডাকা হত না। কুলপদবীর সমাসযোগে যুধিষ্ঠির-পাণ্ডব বা দ্রৌপদী-পাণ্ডব নাম পুরাণ-ইতিহাসে চলে নি, সমাজে চলতি ছিল এমন প্রমাণ নেই। বিশেষ প্রয়োজন হলে ব্যক্তিগত নামের সঙ্গে আরো কিছু বিশেষণ যোগ করা চলত। যেমন সাধারণত ভগবান মনুকে শুদ্ধ মনু নামেই আখ্যাত করা হয়েছে, তাতে অসুবিধা ঘটে নি– তবু বিশেষ প্রয়োজনস্থলেই তাঁকে বৈবস্বত মনু বলা হয়ে থাকে, সর্বদা নয়।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে মহাভারতের দৃষ্টান্ত পুরোপুরি ব্যবহার করতে সাহস করি নে। নামের ভার যথাসম্ভব লাঘব করারই আমি সমর্থন করি, এক মানুষের বহুসংখ্যক নামকরণ দ্বাপর-ত্রেতাযুগে শোভা পেত এখন পায় না। বাপের পরিচয়ে কৃষ্ণার নাম ছিল দ্রৌপদী, জন্মস্থানের পরিচয়ে পাঞ্চালী, জন্ম-ইতিহাসের পরিচয়ে যাজ্ঞসেনী। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, শ্বশুরকুলের পরিচয়ে তাঁকে পাণ্ডবী বলা হয় নি। প্রাচীনকালে কোনো স্ত্রীর নামের সঙ্গে স্বামীর পরিচয় যুক্ত আছে এমন তো মনে পড়ে না।
আমার প্রস্তাব হচ্ছে, ব্যক্তিগত নামটাকে বজায় রেখে আর-সমস্ত বাদ দেওয়া বিশেষ দরকার পড়লে তখন সংবাদ নিয়ে পরিচয় পূর্ণ করা। নামটাকে অত্যন্ত মোটা না করলে নামের সাহায্যেই সম্পূর্ণ ও নিঃসংশয় পরিচয় সম্ভব হয় না। আমাদের বিখ্যাত ঔপন্যাসিককে আমি বলি শরৎচন্দ্র। তাঁর কথা আলোচনা করতে গিয়ে দেখি শরৎচন্দ্র সান্যালও লেখেন উপন্যাস। তখন গ্রন্থি ছাড়াবার জন্যে বলা গেল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে আরো একজন গল্প-লিখিয়ে থাকা বিপুলা পৃথ্বীতে অসম্ভব নয় তার প্রমাণ খুঁজলে পাওয়া যায়। এই দ্বন্দ্বের মীমাংসা করা যেখানে দরকার হয় সেখানে আরো একটা বিশেষণ যোগ করতে বাধ্য হই, যেমন শ্রীকান্ত লেখক শরৎচন্দ্র। ফুলের বৃন্ত যেমন মানুষের ব্যক্তিগত নামটি তেমনি। এই বৃন্ত থেকে প্রশাখায়, প্রশাখা থেকে শাখায়, শাখা থেকে গাছে, গাছ হয়তো আছে টবে। কিন্তু যখন ফুলটির সঙ্গেই বিশেষ ব্যবহার করতে হয়, যেমন মালা গাঁথতে, বোতামের গর্তে গুঁজতে, হাতে নিয়ে তার শোভা দেখতে, গন্ধ শুঁকতে, বা দেবতাকে নিবেদন করতে, তখন গাছসুদ্ধ টবসুদ্ধ যদি টানি তবে বৈশল্যকরণীর প্রয়োজনে গন্ধমাদন নাড়ানোর দ্বিতীয় সংস্করণ হয়। অবশ্য বিশেষ দরকার হলে তখন টবসুদ্ধ নাড়াতে দেখলে সেটাকে শক্তির অপব্যয় বলব না।
পত্রলেখক বাঙালি মেয়ের পদবী সম্বন্ধে আমাকে প্রশ্ন করেছেন। মেয়েরই হোক পুরুষেরই হোক পদবী মাত্রই বর্জন করবার আমি পক্ষপাতী। ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশে তার নজীর আছে এই আমার ভরসা, কিন্তু বিলিতি নজীর আমার বিপক্ষ বলেই হতাশ হতে হয়।
আমার বয়স যখন ছিল অল্প, বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন বঙ্গসাহিত্যের রাজাসনে, তখন প্রসঙ্গক্রমে তাঁর নাম করতে হলে আমরা বলতুম বঙ্কিমবাবু, শুধু বঙ্কিমও কারো কারো কাছে শুনেছি, কিন্তু কখনো কাউকে বঙ্কিম চাটুজ্জে বলতে শুনি নি। সম্প্রতি রুচির পরিবর্তন হয়েছে কি? এখন শরৎচন্দ্রের পাঠকদের মুখে প্রায় শুনতে পাই শরৎ চাটুজ্জে। পরোক্ষে শুনেছি আমি রবি ঠাকুর নামে আখ্যাত। রুচি নিয়ে তর্কের সীমা নেই কিন্তু শরৎচন্দ্রই আমার কানে ভদ্র শোনায়, শরৎবাবুতেও দোষ নেই, কিন্তু শরৎ চাটুজ্জে কেমন যেন খেলো ঠেকে। যাই হোক, এরকম প্রসঙ্গে বাদ-প্রতিবাদ নিরর্থক, মোট কথা হচ্ছে এই, ব্যাঙাচি পরিণত বয়সে যেমন ল্যাজ খসিয়ে দেয় বাঙালির নামও যদি তেমনি পদবী বর্জন করে আমার মতে তাতে নামের গাম্ভীর্য বাড়ে বৈ কমে না। বস্তুত নামটা পরিচয়ের জন্যে নয় ব্যক্তিনির্দেশের জন্যে। পদ্মলোচন নাম নিয়ে আমরা কারো লোচন-সম্পর্কীয় পরিচয় খুঁজি নে একজন বিশেষ ব্যক্তিকেই খুঁজি। বস্তুত নামের মধ্যে পরিচয়কে অতিনির্দিষ্ট করার দ্বারা যদি নামমাহাত্ম্য বাড়ে তবে নিম্নলিখিত নামটাকে সেরা দাম দেওয়া যায়; রাজেন্দ্রসুনু-শশিশেখর মৈমনসৈংহিক বৈষ্ণবনিস্তারিণীপতি চাক্লাদার।
সম্মানরক্ষার জন্যে পুরুষের নামের গোড়ায় বা শেষে আমরা বাবু যোগ করি। প্রশ্ন এই যে, মেয়েদের বেলা কী করা যায়। নিরলংকৃত সম্ভাষণ অশিষ্ট শোনায়। মা মাসি দিদি বউঠাকরুন ঠানদিদি প্রভৃতি পারিবারিক সম্বোধনই আমাদের দেশে মেয়েদের সম্বন্ধে চলে এসেছে। সমাজ-ব্যবহারের যে-গণ্ডির মধ্যে এটা সুসংগত ছিল তার সীমা এখন আমরা ছাড়িয়ে গেছি। আজকাল অনেকে মেয়েদের নামের সঙ্গে দেবী যোগ করাটাই ভদ্র সম্বোধন বলে গণ্য করেন। এটা নেহাত বাড়াবাড়ি। মা অথবা ভগিনীসূচক সম্বোধন গুজরাটে প্রচলিত, যেমন অনসূয়া বেন, কস্তূরী বাই। আমাদের পক্ষে আর্যা শব্দটা দেবীর চেয়ে ভালো, কিন্তু ওটা অনভ্যস্ত, অতএব প্রহসনের বাইরে চলবে না। দেবী শব্দটা যদি প্রথামত উচ্চবর্ণেই প্রযোজ্য তবু নামের সহযোগে ওর ব্যবহার আমাদের কানে সয়ে গেছে। তাই মনে হয় তেমনি অভ্যস্ত শ্রীমতী শব্দটা নামের সঙ্গে জড়িয়ে ব্যবহার করলে কানে অদ্ভুত শোনাবে না, যেমন শ্রীমতী সুনন্দা, শ্রীমতী শোভনা।
বিবাহিতা স্ত্রীর নামকে স্বামীর পরিচয়যুক্ত করা ভারতবর্ষে কোনো কালেই প্রচলিত ছিল না। আমাদের মেয়েদের নামের সঙ্গে তার পিতার বা স্বামীর পদবী জুড়লে প্রায়ই সেটা শ্রুতিকটু এবং অনেক স্থলেই হাস্যকর হয়। ইংরেজি নিয়মে মিসেস ভট্টাচার্য বললে তত দুঃখবোধ হয় না। কিন্তু মণিমালিনী সর্বাধিকারী কানে সইয়ে নিতে অনেকদিন কঠোর সাধনার প্রয়োজন হয়। যে-রকম আবহাওয়া পড়েছে তাতে য়ুরোপে বিবাহিত নারীর পদবী পরিবর্তন বেশিদিন টিঁকবে বলে বোধ হয় না, তখন আবার তাড়াতাড়ি আমাদের ও সহধর্মিণীদের নামের ছাঁট-কাট করতে যদি বসি তবে নিতান্ত নির্লজ্জ না হলে অন্তত কর্ণমূল লাল হয়ে উঠবে। একদা পাশ্চাত্য মহাদেশে মেয়েরা যখন নিজের নাম-সাতন্ত্র্য অবিকৃত রাখা নিয়ে আস্ফালন করবে সেদিন যাতে আমাদের মেয়েরা গৌরব করতে পারে সেই সুযোগটুকু গায়ে পড়ে নষ্ট করা কেন?
এ-সব আলোচনায় বিশেষ কিছু লাভ আছে বলে মনে হয় না। রুচির তর্কে প্রথাকে নিয়ন্ত্রিত করা যায় না। যে কারণে “বাধ্যতামূলক’ “গঠনমূলক’ প্রভৃতি বর্বর শব্দ বাংলা অভিধানকে অধিকার করছে সেই কারণেই বাঙালির বৈঠকে মধুমালতী মজুমদার বা বনজ্যোৎস্না তলাপাত্রের প্রাদুর্ভাবকে নিরস্ত করা যাবে না। ইংরেজিতে প্রথার সঙ্গে যেমন-তেমন করে জোড় মেলানোর ঝোঁক সামলানো দুঃসাধ্য।
শ্রাবণ, ১৩৩৮
প্রতিশব্দ
১
ইংরেজি ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার একটা কারবার চলিয়াছে। সেই কারবার-সূত্রে বিশ্বের হাটে আমাদের ভাবের লেনা-দেনা ঘটিতেছে। এই লেনা-দেনায় সব চেয়ে বিঘ্ন ভাষায় শব্দের অভাব। একদিন আমাদের দেশের ইংরেজি পড়ুয়ারা এই দৈন্য দেখিয়া নিজের ভাষার প্রতি উদাসীন ছিলেন। তাঁহারা ইংরাজিতেই লেখাপড়া শুরু করিয়াছিলেন।
কিন্তু বাংলাদেশের বড়ো সৌভাগ্য এই যে, সেই বড়ো দৈন্যের অবস্থাতেও দেশে এমন সকল মানুষ উঠিয়াছিলেন যাঁহারা বুঝিয়াছিলেন বাংলা ভাষার ভিতর দিয়া ছাড়া দেশের মনকে বলবান করিবার কোনো উপায় নাই। তাঁহার ভরসা করিয়া তখনকার দিনের বাংলা ভাষার গ্রাম্য হাটেই বিশ্বসম্পদের কারবার খুলিয়া বসিলেন। সেই কারবারের মূলধন তখন সামান্য ছিল কিন্তু আশা ছিল মস্ত। সেই আশা দিনে দিনেই সার্থক হইয়া উঠিতেছে। আজ মূলধন বাড়িয়া উঠিয়াছে– আজ শুধু কেবল আমাদের আমদানির হাট নয়– রফ্তানিও শুরু হইল।
ইহার ফল হইয়াছে এই যে বাংলা দেশ, ধনের বাণিজ্যে যথেষ্ট পিছাইয়া আছে বটে কিন্তু ভাবের বাণিজ্যে বাংলাদেশ ভারতের অন্যান্য প্রদেশকে ছাড়াইয়া গেল। মাদ্রাজে যখন গিয়াছিলাম তখন একটা প্রশ্ন বার বার অনেকের কাছেই শুনিয়াছি– “মৌলিন্যে বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে এত অগ্রসর হইল কেন?” তাহার সব কারণ স্পষ্ট করিয়া নির্দেশ করা সহজ নহে। কিন্তু অন্তত একটা কারণ এই যে, বাঙালির ছেলেমেয়ে শিশুকাল হইতেই বাংলা সাহিত্য হইতে তাহাদের মনের খোরাক পাইয়া আসিতেছে। অধিক বয়সে যে পর্যন্ত না ইংরেজি শেখে সে পর্যন্ত তাহার মন উপবাসী থাকে না।
আজ পর্যন্ত আমাদের ভাষা প্রধানত ধর্মসাহিত্য এবং রসসাহিত্য লইয়াই চলিয়া আসিতেছে। দর্শন বিজ্ঞান প্রভৃতির আলোচনায় যে-সকল শব্দের দরকার তাহা আমাদের ভাষায় জমে নাই। এইজন্য আমাদের ভাষায় শিক্ষার উচ্চ অঙ্গ কানা হইয়া আছে।
কিন্তু কেবল পরিভাষা নহে, সকলপ্রকার আলোচনাতেই আমরা এমন অনেক কথা পাই যাহা ইংরেজি ভাষায় সুপ্রচলিত, অথচ যাহার ঠিক প্রতিশব্দ বাংলায় নাই। ইহা লইয়া আমাদের পদে পদেই বাধে। আজিকার দিনে সে-সকল কথার প্রয়োজন উপেক্ষা করিবার জো নাই। এইজন্য শান্তিনিকেতন পত্রে আমরা মাঝে মাঝে এ সম্বন্ধে আলোচনা করিব। আমরা প্রতিশব্দ বানাইবার চেষ্টা করিব– তাহা যে সাহিত্যে চলিবে এমন দাবি করিব না, কেবল তাহার যাচাই করিতে ইচ্ছা করি। আমি চাই আমাদের ছাত্র ও অধ্যাপকেরা এ সময়ে কিছু ভাবিবেন। কোনো শব্দ যদি পছন্দ না হয়, বা আর-একটা শব্দ যদি তাঁহাদের মাথায় আসে, তবে এই পত্রে তাহা জানাইবেন।
ইংরেজি Nation কথাটার আমরা প্রতিশব্দরূপে “জাতি’ কথাটা ব্যবহার করি। নেশান শব্দের মূল ধাতুগত অর্থ জাতি শব্দের সঙ্গে মেলে। যাহাদের মধ্যে জন্মগত বন্ধনের ঐক্য আছে তাহারাই নেশন। তাহাদিগকেই আমরা জাতি বলিতে পারিতাম কিন্তু আমাদের ভাষায় জাতি শব্দ একদিকে অধিকতর ব্যাপক, অন্য দিকে অধিকতর সংকীর্ণ। আমরা বলি পুরুষজাতি, স্ত্রীজাতি, মনুষ্যজাতি, পশুজাতি ইত্যাদি। আবার ব্রাহ্মণ শূদ্রের ভেদও জাতিভেদ। এমন স্থলে নেশনের প্রতিশব্দরূপে জাতি শব্দ ব্যবহার করিলে সেটা ঠিক হয় না। আমি নেশন শব্দের প্রতিশব্দ ব্যবহার না করিয়া ইংরেজি শব্দটাই চালাইবার চেষ্টা করিয়াছি।
ইংরেজি Nation, race, tribe, caste, genus, species– এই ছয়টা শব্দকেই আমরা জাতি শব্দ দিয়া তর্জমা করি। তাহাতে ভাষার শৈথিল্য ঘটে। আমি প্রতিশব্দের একটা খসড়া নিম্নে লিখিলাম– এ সম্বন্ধে বিচার প্রার্থনা করি।
Nation–অধিজাতি। National–আধিজাতিক। Nationalism–অধিজাত্য।
Race–প্রবংশ। Race preservation–প্রবংশ রক্ষা।
Tribe–জাতি সম্প্রদায়।
Caste–জাতি, বর্ণ।
এবং speciesকে যথাক্রমে মহাজাতি ও উপজাতি নাম দেওয়া যাইতে পারে।
২
প্রতিশব্দ সম্বন্ধে আষাঢ়ের শান্তিনিকেতনে যে প্রবন্ধ বাহির হইয়াছিল সে সম্বন্ধে পাঠকদের কাছ হইতে আলোচনা আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু এখনো কাহারো কাছ হইতে কোনো সাড়া মেলে নাই। কিন্তু এ-সব কাজ একতরফা হইলে কাঁচা থাকিয়া যায়। যে-সকল শব্দকে ভাষায় তুলিয়া লইতে হইবে তাহাদের সম্বন্ধে বিচার ও সম্মতির প্রয়োজন।
আমি নিজেই বলিয়াছি নেশন কথাটাকে তর্জমা না করিয়া ব্যবহার করাই ভালো। ওটা নিতান্তই ইংরেজি, অর্থাৎ ঐ শব্দের দ্বারা যে অর্থ প্রকাশ করা হয়, সে অর্থ ইহার আগে আমরা ব্যবহার করি নাই। এমন-কি, ইংরেজিতেও নেশনের সংজ্ঞা নির্ণয় করা শক্ত।
সেইজন্যই বাংলায় প্রচলিত কোনো শব্দ নেশনের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহার করিলে কিছুতেই খাপ খাইবে না। “জাতি” কথাটা ঐ অর্থে আজকাল আমরা ব্যবহার করি বটে কিন্তু তাহাতে ভাষার ঢিলামিকে প্রশ্রয় দেওয়া হইতেছে। বরঞ্চ সাহিত্য ইতিহাস সংগীত বিদ্যালয় প্রভৃতি শব্দ-সহযোগে যখন আমরা “জাতীয়’ বিশেষণ প্রয়োগ করিয়া থাকি তখন তাহাতে কাজ চলিয়া যায়– কারণ ঐ বিশেষণের অন্য কোনো কাজ নাই। সেইজন্যই “জাতীয়’ বিশেষণ শব্দটি ন্যাশনল শব্দের প্রতিশব্দরূপে এমনি শিকড় গাড়িয়া বসিয়াছে যে, উহাকে আর উৎপাটিত করিবার জো নাই। কিন্তু কোনো বৈজ্ঞানিক গ্রন্থে যদি nation, race, tribe, clan শব্দের বিশেষত্ব নির্দেশ করার প্রয়োজন ঘটে তবে বিপদে পড়িতে হইবে। সুতরাং নেশন ও ন্যাশনাল কথাটা বাংলায় জাতে তুলিয়া লওয়া কর্তব্য মনে করি। এমন বিস্তর বিদেশী কথা বাংলায় চলিয়া গেছে।
এই “জাতি’ শব্দের প্রসঙ্গে আর-একটি শব্দ মনে পড়িতেছে যাহার একটা কিনারা করা আশু আবশ্যক। কোনো বিশেষকালে-জাত সমস্ত প্রজাকে ইংরেজিতে generationবলে। বর্তমান অতীত বা ভাবী জেনেরেশন সম্বন্ধে যখন বাংলায় আলোচনার দরকার হয় তখন আমরা পাশ কাটাইয়া যাই। কিন্তু বিঘ্ন দূর না করিয়া বিঘ্ন এড়াইয়া চলিলে ভাষার দুর্বলতা ঘোচে না।
বস্তুত বাংলায় “প্রজা’ কথার অন্য অর্থ যদি চলিত না থাকিত তবে ঐ কথাটি ঠিক কাজে লাগিত। বর্তমানে যাহারা জাত তাহাদিগকে বর্তমানকালের প্রজা, অতীতকালে যাহারা জাত তাহাদিগকে অতীত কালের প্রজা বলিলে কোনো গোল হইত না। কিন্তু এখন আর উপায় নাই।
“জন’ কথাটারও ঐ রকমেরই অর্থ। জন্ম শব্দের সঙ্গেই উহার যোগ। কিন্তু উহার প্রচলিত অর্থটি প্রবল, অন্য কোনো অর্থে উহাকে খাটানো চলিবে না।
অতএব প্রজা এবং জন এই কথার মাঝামাঝি একটা কথা যদি পাওয়া যায় তাহা হইলে সেটা ব্যবহারে লাগানো যায়। যথা, প্রজন। মনুতে স্ত্রীলোকের বর্ণনাস্থলে আছে “প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।’ অর্থাৎ প্রজনের জন্য স্ত্রীজাতি পূজনীয়া। ইংরেজি ভাষায় generation শব্দের অন্য যে-অর্থ আছে অর্থাৎ জন্মদান করা, এই প্রজনের সেই অর্থ। কিন্তু পূর্বকথিত অর্থে এই শব্দকে ব্যবহার করিলে কানে খারাপ লাগিবে না। প্রজন শব্দটা প্রথমে বুঝিতে হয়তো গোল ঠেকিবে, উহার বদলে যদি “প্রজাত’ শব্দ ব্যবহার করা হয় তাহা হইলে অপেক্ষাকৃত সহজে বুঝা যাইবে। এ সম্বন্ধে পাঠকদের মত জানিতে চাই।
আমার “প্রতিশব্দ’ প্রবন্ধ উপলক্ষে একটিমাত্র বিতর্ক উঠিয়াছে। সেটা “মৌলীন্য’ কথা লইয়া। Originality শব্দের যে প্রতিশব্দ আজকাল চলিতেছে সেটা “মৌলিকতা’। সেটা কিছুতেই আমার ভালো লাগে নাই। কারণ “মৌলিক’ বলিলে সাধারণত বুঝায় মূলসম্বন্ধীয়– ইংরেজিতে radical বলিতে যাহা বুঝায়। যথা, radical change–মৌলিক পরিবর্তন। আপনাতেই যাহার মূল, তাহাকে মৌলিক বলিলে কেমন বেখাপ শোনায়। বরং নিজমূলক বলিলে চলে। কখনো কখনো আমি “স্বকীয়তা’ শব্দ Originality অর্থে ব্যবহার করিয়াছি। কিন্তু সর্বত্র ইহা খাটে না। বিশেষ কাব্যকে স্বকীয় কাব্য বলা চলে না। মৌলিক কাব্য বলিলেও যে সুশ্রাব্য হয় তাহা নহে, তবু চোখ কান বুজিয়া সেটাকে কণ্ঠস্থ করা যায়।
এইজন্যই কুলীন শব্দে যেমন কুলগৌরব প্রকাশ করে তেমনি মূলীন শব্দে মূলগৌরব প্রকাশ করিবে এই মনে করিয়াই ঐ কথাটাকে আশ্রয় করিয়াছিলাম। কিন্তু শাস্ত্রী-মহাশয় বলিয়াছেন কুলীন শব্দ ব্যাকরণের যে-বিশেষ নিয়মে উৎপন্ন মূলীন শব্দে সে নিয়ম খাটে না। শুনিয়া ভয় পাইয়াছি। ভুল পুরাতন হইয়া গেলে বৈধ হইয়া উঠে, নূতন ভুলের কৌলীন্য নাই বলিয়াই ভাষায় তাহা পঙ্ক্তি পায় না। বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণের ব্যভিচার অনেক চলিয়াছে; কিন্তু আজকালকার দিনে পূর্বের চেয়ে পাহারা কড়াক্কড় হওয়ায় সে সম্ভাবনা আর নাই। অতএব জাতমাত্রই মৌলীন্য শব্দের অন্ত্যেষ্টি সৎকার করা গেল।
৩
বাংলায় “অপূর্ব’ শব্দ বিশেষ অর্থে প্রচলিত হইয়াছে। “অপূর্ব সৌন্দর্য’ বলিতে আমরা original beauty বুঝি না। যদি বলা যায় কবিতাটি অপূর্ব তাহা হইলে আমরা বুঝি তাহার বিশেষ একটি রমণীয়তা আছে,কিন্তু তাহা যে original এরূপ বুঝি না। ইংরেজিতে যাঁহাকে original man বলা যায় তিনি চিন্তায় কর্মে বা আচরণে অন্য কাহারো অনুসরণ করেন না। বাংলায় যদি তাঁহাকে বলি “লোকটি অপূর্ব’ তাহা হইলে সেটা ঠাট্টার মতো শোনায়। বোধ হয় এরূপ প্রসঙ্গে স্বানুবর্তী ও স্বানুবর্তিতা কথাটা চলিতে পারে। কিন্তু রচনা বা কর্ম সম্বন্ধে ও কথাটা খাটিবে না। “আদিম’ শব্দটি বাংলায় যদি ‘primitive’ অর্থে না ব্যবহৃত হইত তাহা হইলে ওই শব্দটির প্রয়োগ এরূপ স্থলে সংগত হইত। বিশেষ কবিতাটি আদিম বা তাহার মধ্যে আদিমতা আছে বলিলে ঠিক ভাবটি বোঝায়। বস্তুত, অপূর্ব= strange, আদিম= original। অপূর্ব সৌন্দর্য= strange beauty, আদিম সৌন্দর্য= original beauty, আদি গঙ্গা= the original Ganges। আদি বুদ্ধ= the original Buddha আদি জ্যোতি= the original light। অপূর্ব জ্যোতি বলিলে বুঝাইবে, the strange light। আদি পুরুষ= the original ancestor, এরূপ স্থলে অপূর্ব পুরুষ বলাই চলে না।
৪
ইংরেজি পরিভাষিক শব্দের বাংলা করিবার চেষ্টা মাঝে মাঝে হইয়াছে। কিন্তু ইংরেজিতে অনেক নিত্যপ্রচলিত সামান্য শব্দ আছে বাংলায় তাহার তর্জমা করিতে গেলে বাধিয়া যায়। ইংরেজি ক্লাসে বাংলায় ইংরেজি ব্যাখ্যা করিবার সময় পদে পদে ইহা অনুভব করি। ইহার একটা কারণ, তর্জমা করিবার সময় আমরা স্বভাবতই সাধু ভাষার সন্ধান করিয়া থাকি, চলিত ভাষায় যে-সকল কথা অত্যন্ত পরিচিত সেইগুলিই হঠাৎ আমাদের মনে আসে না। চলিত ভাষা লেখাপড়ার গণ্ডির মধ্যে একেবারেই চলিতে পারে না এই সংস্কারটি থাকাতেই আমাদের মনে এইরূপ বাধা ঘটিয়াছে। “আমার ‘পরে তাহার sympathy নাই’ ইহার সহজ বাংলা “আমার ‘পরে তাহার দরদ্ নাই’, কিন্তু চলিত বাংলাকে অপাঙ্ক্তেয় ঠিক করিয়াছি বলিয়া ক্লাসে বা সাহিত্যে উহার গতিবিধি বন্ধ। এইজন্য “সহানুভূতি’ বলিয়া একটা বিকট শব্দ জোর করিয়া বানাইতে হইয়াছে; এই গুরুভার শব্দটা ভীমের গদার মতো, ইহাকে লইয়া সর্বদা সাধারণ কাজে ব্যবহার করিতে গেলে বড়োই অসংগত হয়।
দরদ কথাটা ঘর-গড়া নয়, ইহা সজীব, এইজন্য ইহার ব্যবহারের বৈচিত্র্য আছে। “লোকটা দরদী’ বলিলেই কথাটার ভাব বুঝিতে বিলম্ব হয় না– কিন্তু “লোকটা সহানুভব’ বলিলে কী যে বলা হইল বোঝাই যায় না, যদিচ মহানুভব কথাটা চলিত আছে। আমরা বলি, “ওস্তাদজি দরদ দিয়া গান করেন’, ইংরেজিতে এ স্থলে sympathy শব্দের ব্যবহার আছে কিন্তু “সহানুভূতি দিয়া গান করেন’ বলিলে মনে হয় যেন ওস্তাদজি গানের প্রতি বিষম একটা অত্যাচার করেন।
আসল কথা, অনুভূতি শব্দটা বাংলায় নূতন আমদানি, এইজন্য উহার ‘পরে আমাদের দরদ জন্মে নাই। এইজন্যই “সহানুভূতি’ শব্দটা শুনিলে আমাদের হৃদয় তখনি সাড়া দেয় না। এই কথাটা কাব্যে, এমন-কি, মেঘনাদবধের সমান ওজন কোনো মহাকাব্যেও, ব্যবহার করিতে পারেন এমন দুঃসাহসিক কেহ নাই। অনুভূতি কথাটা যেমন নূতন, বেদনা কথাটা তেমনি পুরাতন। এইজন্য সমবেদনা কথাটা কানে বাজে না। যেখানে দরদ শব্দটা খাপ খায় না সেখানে আমি “সমবেদনা’ শব্দ ব্যবহার করি, পারৎপক্ষে “সহানুভূতি’ ব্যবহার করি না।
তর্জমা করিবার সময় একটা জিনিস আমরা প্রায় ভুলিয়া যাই। প্রত্যেক ভাষায় এমন কোনো কোনো শব্দ থাকে যাহার নানা অর্থ আছে। আমাদের “ভাব’ কথাটা, কোথাও বা idea, কোথাও বা thought, কোথাও বা feeling, কোথাও বা suggestion, কোথাও বা gist। ভাব কথাটাকে ইংরেজিতে তর্জমা করিবার সময়ে সকল জায়গাতেই যদি ভধনত শব্দ প্রয়োগ করি তবে তাহা অদ্ভুত হইবে। “এই প্রস্তাবের সহিত আমাদের সহানুভূতি আছে’ এরূপ বাক্য প্রয়োগ আমরা মাঝে মাঝে শুনিয়াছি। ইহা ইংরেজি ভাষা-ব্যবহারের নকল, কিন্তু বাংলায় ইহা অত্যন্ত অসংগত। এ স্থলে “এই প্রস্তাবে আমাদের সম্মতি আছে’ বলা যায়– কারণ, প্রস্তাবের অনুভূতি নাই, সুতরাং তাহার সহিত সহানুভূতি চলে না। অতএব একভাষায় যেখানে একশব্দের দ্বারা নানা অর্থ বোঝায় অন্য ভাষায় তাহার এক প্রতিশব্দ হইতেই পারে না।
গতবারের শান্তিনিকেতনে originality শব্দের আলোচনাস্থলে আমরা ইহার প্রমাণ পাইয়াছি। কোনো একজন মানুষের originality আছে এই ভাব ব্যক্ত করিবার সময়ে তাঁহার স্বানুবর্তিতা আছে বলা চলে না,সে স্থলে “আদিমতা’ আছে বলিলে ঠিক হয়; যে কবিতা হইতে আর-একটি কবিতা তর্জমা করা হইয়াছে সেই কবিতাকে মূল কবিতা বলিতে হইবে। যে কবিতায় বিশেষ অসামান্যতা আছে, তাহাকে অনন্যতন্ত্র কবিতা বলা চলে। ইহার উপযুক্ত সংস্কৃত কথাটি “স্বতন্ত্র’– কিন্তু বাংলায় অন্য অর্থে তাহার ব্যবহার। বস্তুত আমার মনে হয়, কি মানুষ সম্বন্ধে, কি মানুষের রচনা সম্বন্ধে, উভয় স্থলেই অনন্যতন্ত্র শব্দের ব্যবহার চলিতে পারে।
একটি অত্যন্ত সহজ কথা লইয়া বাংলা ভাষায় আমাদিগকে প্রায় দুঃখ পাইতে হয়– সে কথাটি feeling। Feeling-এর একটা অর্থ বোধশক্তি– ইহাকে আমরা “অনুভূতি’ শব্দের দ্বারা প্রকাশ করিতেছি। আর-একটি অর্থ হৃদয়বৃত্তি। কিন্তু হৃদয়বৃত্তি শব্দটা পারিভাষিক। সর্বদা ব্যবহারে ইহা চলিতে পারে না। অনেক সময়ে কেবলমাত্র “হৃদয়’ শব্দের দ্বারা কাজ চালানো যায়; যেখানে ইংরেজিতে বলে ‘feeling উত্তেজিত হইয়াছে’ সেখানে বাংলায় বলা চলে, “হৃদয়’ উত্তেজিত হইয়াছে। যে মানুষের feeling আছে তাহাকে সহৃদয় বলি। “কবি এই কবিতায় যে feeling প্রকাশ করিয়াছে’ এরূপ স্থলে feeling-এর প্রতিশব্দ স্বরূপে হৃদয়ভাব বলা যায়। শুধু “ভাব’ও অনেক সময়ে পননরভশফ-এর প্রতিশব্দরূপে চলে। Emotion শব্দটি বাংলায় তর্জমা করিবার সময় আমি বরাবর “আবেগ’ ও হৃদয়াবেগ’ শব্দ ব্যবহার করিয়া আসিয়াছি। যাঁহারা সংস্কৃত জানেন তাঁহাদের কাছে আমার প্রশ্ন এই যে, সংস্কৃত ভাষায় পারিভাষিক ও সহজ অর্থে ‘feeling’ শব্দের কোন্ কোন্ প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয়?
ইংরেজি culture শব্দের বাংলা লইয়া অনেক সময় ঠেকিতে হয়। ‘learning’ এবং ‘culture’ শব্দের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তাহা সংস্কৃত কোন্ শব্দের দ্বারা বোঝায় আমি ঠিক জানি না। “বৈদগ্ধ্য’ শব্দের অর্থ ঠিক culture বলিয়া আমার বোধ হয় না। Culture শব্দে যে ভাব প্রকাশ হয় তাহা বাংলায় ব্যবহার না করিলে একেবারেই চলিবে না। একটি বিশেষ স্থলে আমি প্রথমে “চিত্তোৎকর্ষ’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছিলাম; কারণ culture শব্দের মতোই “উৎকর্ষ’ শব্দের মধ্যে কর্ষণের ভাব আছে। পরে আমি “চিত্তোৎকর্ষের’ পরিবর্তে “সমুৎকর্ষ’ শব্দটি গ্রহণ করিয়াছিলাম। আমার জিজ্ঞাস্য এই যে, শুধু “উৎকর্ষ’ শব্দ এই বিশেষ অর্থে চালানো যায় কি না। Cultured mind-এর বাংলা করা যাইতে পারে “প্রাপ্তোৎকর্ষ-চিত্ত’। ভালো শোনায় যে তাহা নহে। “উৎকর্ষিত’ চিত্ত বলা যাইতে পারে; মানুষ সম্বন্ধে ব্যবহারের বেলায় “উৎকর্ষ-বান’ লোক বলিলে ক্ষতি হয় না। উৎকৃষ্ট বিশেষণ শব্দটি হাতছাড়া হইয়া গিয়াছে। যেমন ‘learning’ এবং ‘culture’ তেমনি ‘knowledge’ এবং ‘wisdom’-এর প্রভেদ আছে। কোন্ কোন্ শব্দের দ্বারা সেই প্রভেদ নির্ণীত হইবে তাহার উত্তরের অপেক্ষা করিয়া রহিলাম।
কিছুদিন হইল আর-একটি ইংরেজি কথা লইয়া আমাকে ভাবিতে হইয়াছিল। সেটি ‘degeneracy’ আমি তাহার বাংলা করিয়াছিলাম আপজাত্য। যাহার আপজাত্য ঘটিয়াছে সে অপজাত (degenerate)। প্রথমে জননাপকর্ষ কথাটা মনে আসিয়াছিল, কিন্তু সুবিধামত তাহাকে বিশেষণ করা যায় না বলিয়া ছাড়িয়া দিতে হইল। বিশেষত অপ উপসর্গই যখন অপকর্ষবাচক তখন কথাটাকে বড়ো করিয়া তোলা অনাবশ্যক।
এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করি genetics নামে যে নূতন বিজ্ঞানের উদ্ভব হইয়াছে তাহাকে কি প্রজনতত্ত্ব নাম দেওয়া যাইতে পারে? আমি eugenics শব্দের বাংলা করিয়াছি সৌজাত্যবিদ্যা।
এই প্রজনতত্ত্বের একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় heredity। বাংলায় ইহাকে বংশানুগতি এবং inherited শব্দকে বংশানুগত বলা চলে। কিন্তু inheritance–কে কী বলা যাইবে? বংশাধিকার অথবা উত্তরাধিকার inheritable–বংশানুলোম্য।
শব্দকে আমি অভিযোজন নাম দিয়াছি। নিজের surroundings-এর সহিত adaptation–নিজের পরিবেষ্টনের সহিত অভিযোজন। Adaptability–অভিযুজ্যতা। Adaptable–অভিযোজ্য। Adapted–অভিযোজিত।
৫
কয়েকটি ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ স্থির করিয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিয়া একজন পত্র লিখিয়াছেন।
১ প্রশ্ন। I envy you your interest in art। এখানে interest শব্দের অর্থ কী?
উত্তর। বলা বাহুল্য interest শব্দের অনেকগুলি ভিন্ন অর্থ আছে। বাংলায় তাহাদের জন্য পৃথক শব্দ ব্যবহার করিতে হইবে। এখানে উক্ত ইংরেজি শব্দের স্থলে বাংলায় “অনুরক্তি’ শব্দ ব্যবহার করা চলে।
২ প্রশ্ন। Attention is either spontaneous or reflex। এখানে spontaneous ও reflex শব্দের প্রতিশব্দ কী হওয়া উচিত?
উত্তর। Spontaneous–স্বতঃসৃত। Reflex–প্রতিক্ষিপ্ত।
৩ প্রশ্ন। Forethought-এর প্রতিশব্দ কী?
উত্তর। প্রসমীক্ষা, প্রসমীক্ষণ, পূর্ব-বিচারণা।
৪ প্রশ্ন। ‘By suggestion I can cure you’। ‘The great power latent in this form of suggestiveness is wellknown’। Suggestion ও suggestiveness-এর প্রতিশব্দ কী?
উত্তর। সাধারণত বাংলায় suggestion ও suggestiveness-এর প্রতিশব্দ ব্যঞ্জনা ও ব্যঞ্জনাশক্তি চলিয়া গিয়াছে। কোনো বিশেষ বাক্যপ্রয়োগে শব্দার্থের অপেক্ষা ভাবার্থের প্রাধান্যকে ব্যঞ্জনা বলা হয়। কিন্তু এখানে ‘suggestion’ শব্দ দ্বারা বুঝাইতেছে, আভাসের দ্বারা একটা চিন্তা ধরাইয়া দেওয়া। এ স্থলে “সূচনা’ ও “সূচনাশক্তি’ শব্দ ব্যবহার করা যাইতে পারে।
৫ প্রশ্ন। “Instinct similar to the action inspired by suggestion’ ইহার অনুবাদ কী?
উত্তর। সূচনার দ্বারা প্রবর্তিত যে মানসিক ক্রিয়া তাহারই সমজাতীয় সহজ প্রবৃত্তি। বলা বাহুল্য আমাদের পত্রে আমরা যে প্রতিশব্দের বিচার করি তাহা পাঠকদের নিকট হইতে তর্ক-উদ্দীপন করিবার জন্যই। সকল প্রতিশব্দের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ক্ষমতা আমাদের নাই।
৬
কয়েকটি চিঠি পাইয়াছি তাহাতে পত্রলেখকগণ বিশেষ কতকগুলি ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ জানিতে চাহিয়াছেন। নূতন একটা শব্দ যখন বানানো যায় তখন অধিকাংশ লোকের কানে খট্কা লাগে। এইজন্য অনেকে দেখি রাগ করিয়া উঠেন। সেইজন্য বার বার বলিতেছি আমাদের যেমন শক্তিও অল্প অভিমানও তেমনি অল্প। কেহ যদি কোনো শব্দ না পছন্দ করেন দুঃখিত হইব না। ভাষায় যে-সব ভাবপ্রকাশের দরকার আছে তাহাদের জন্য উপযুক্ত শব্দ ঠিক করিয়া দেওয়া একটা বড়ো কাজ। অনেকে চেষ্টা করিতে করিতে তবে ইহা সম্পন্ন হইবে; আমাদের চেষ্টা যদি এক দিকে ব্যর্থ হয় অন্য দিকে সার্থক হইবে। চেষ্টার দ্বারা চেষ্টাকে উত্তেজিত করা যায়, সেইটেই লাভ। এইজন্যই, কোনো ওস্তাদীর আড়ম্বর না করিয়া আমাদের সাধ্যমত পত্রলেখকদের প্রেরিত ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ ভাবিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছি।
পূর্ববারে লিখিয়াছি হিপ্নটিজ্ম্ প্রক্রিয়ার অন্তর্গত suggestion শব্দের প্রতিশব্দ “সূচনা’। আমরা ভাবিয়া দেখিলাম সূচনা শব্দের প্রচলিত ব্যবহারের সহিত ইহার ঠিক মিল হইবে না। তাই ইংরেজি suggestion-এর স্থলে “অভিসংকেত’ শব্দ পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করিতে ইচ্ছা করি। অভি উপসর্গ দ্বারা কোনো-কিছুর অভিমুখে শক্তি বা গতি বা ইচ্ছা প্রয়োগ করা বুঝায়; ইংরেজি towards-এর সহিত ইহার মিল। অভ্যর্থনা, অভিনন্দন, অভিযান, অভিপ্রায় প্রভৃতি শব্দ তাহার প্রমাণ। Auto-suggestion শব্দের প্রতিশব্দ স্বাভিসংকেত হইতে পারে। একজন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, “আমরা কথায় বলি “তোমায় কয়েকটি উপায় suggest করতে পারি’ এ ক্ষেত্রে বাংলায় কী বলিব?” একটা কথা মনে রাখা দরকার, কোনো টাট্কা তৈরি কথা চলিত কথাবার্তায় অদ্ভুত শোনায়! প্রথমে যখন সাহিত্যে খুব করিয়া চলিবে, তখন মুখের কথায় ধীরে ধীরে তাহার প্রবেশ ঘটিবে। “অভিসংকেত’ কথাটা যদি চলে তবে প্রথমে বইয়ে চলিবে। “কয়েকটি উপায় অভিসংকেত করা যাইতে পারে” লিখিলে বুঝিতে কষ্ট হইবে না।
উক্ত লেখকই প্রশ্ন করিয়াছেন “Adaptability-র বাংলা কী হইতে পারে? আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, “অভিযুজ্যতা’। একজন সংস্কৃতজ্ঞ পাঠক তাঁহার পত্রে জানাইয়াছেন, “উপযোগিতাই ভালো।” উপযোগিতা বলিতে suitability বুঝায়। যাহা উপযুক্ত তাহা স্বভাবতই উপযুক্ত হইতে পারে কিন্তু adapt করা চেষ্টাসাপেক্ষ। “অভিযোজিত’ বলিলে সহজেই বুঝায় একটা-কিছুর অভিমুখে যাহাকে যোজনা করা হইয়াছে, যাহা সহজেই যুক্ত তাহার সহিত ইহার বিশেষ প্রভেদ আছে। আর-একজন পণ্ডিত লিখিয়াছেন–“যোজিত’ অপেক্ষা “যুক্ত’ই ব্যাকরণসম্মত। আমরা ব্যাকরণ সামান্যই জানি কিন্তু আমাদের নজির আছে–
পরমে ব্রহ্মণি যোজিত চিত্তঃ
নন্দতি নন্দতি নন্দত্যেব।
প্রশ্ন : Paradox শব্দের বাংলা আছে কি?
নাই বলিয়াই জানি। শব্দ বানাইতে হইবে, ব্যবহারের দ্বারাই তাহার অর্থ পাকা হইতে পারে। বিসংগত সত্য বা বিসংগত বাক্য এই অর্থে চালাইলে চলিতে পারে কি না জিজ্ঞাসা করি।
-ব্যঙ্গানুকরণ।
শব্দের একটা চলতি বাংলা “অব্যবসায়ী’। কিন্তু ইহার মধ্যে একটু যেন নিন্দার ভাব আছে। তাহা ছাড়া ইহাতে অভ্যস্ত দক্ষতার অভাবমাত্র বুঝায় কিন্তু অনুরাগ বুঝায় না। ইংরেজিতে কখনো কখনো সেইরূপ নিন্দার ভাবেও এই শব্দের ব্যবহার হয়, তখন অব্যবসায়ী কথা চলে। অন্য অর্থে শখ শব্দ বাংলায় চলে, যেমন শখের পাঁচালি, শখের যাত্রা। ব্যবহারের সময় আমরা বলি শৌখিন। যেমন শৌখিন গাইয়ে।
প্রশ্নকর্তা লিখিতেছেন, “Violet কথাটার বাংলা কী? নীলে সবুজে মিলিয়া বেগুনি, কিন্তু নীলে লালে মিলিয়া কী?”
আমার ধারণা ছিল নীলে লালে বেগুনি। ভুল হইতেও পারে। সংস্কৃতে ৎভষরনঢ় শব্দের প্রতিশব্দ পাটল বলিয়া জানি।
পত্রলেখক romantic শব্দের বাংলা জানিতে চহিয়াছেন। ইহার বাংলা নাই এবং হইতেও পারে না। ইংরেজিতে এই শব্দটি নানা সূক্ষ্মভাবে এমনি পাঁচরঙা যে ইহার প্রতিশব্দ বানাইবার চেষ্টা না করিয়া মূল শব্দটি গ্রহণ করা উচিত।
লেখক dilettante শব্দের বাংলা জানিতে চাহিয়াছেন। মোটামুটি পল্লবগ্রাহী বলা চলে। কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গে আরো যে-সব ভাবের আভাস আছে বাংলা শব্দে তাহা পাওয়া যাইবে না। প্রত্যেক ভাষাতেই এমন বিস্তর শব্দ আছে যাহা তাহার মোটা অর্থের চেয়ে বেশি কিছু প্রকাশ করে। সেইরূপ ফরাসি অনেক শব্দের ইংরেজি একেবারেই নাই। আমার মনে আছে– একদা ভগিনী নিবেদিতা আমার নিম্নলিখিত গানের পদটি দুই ঘণ্টা ধরিয়া তর্জমা করিবার চেষ্টা করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলেন–
নিশিদিন ভরসা রাখিস,
ওরে মন, হবেই হবে।
প্রথম বাধিল “ভরসা’ কথা লইয়া। ভরসা কথার সঙ্গে দুটো ভাব জড়ানো, confidence এবং courage। কিন্তু ইংরেজি কোনো এক শব্দে এই দুটো ভাব ঠিক এমন করিয়া মেলে না। Faith, trust, assurance কিছুতেই না। তার পরে “হবেই হবে’ কথাটাকে ঠিক অমন করিয়া একদিকে অস্পষ্ট রাখিয়া আর-এক দিকে খুব জোর দিয়া বলা ইংরেজিতে পারা যায় না। এ স্থলে ইংরেজিতে একটু ঘুরাইয়া বলা চলে–
Keep thy courage of Faith, my heart
And thy dreams will surely come true।
৭
….Two mindednes–কে দ্বৌমানসিকতা বললে কি রকম হয়? কিংবা Two minded=দ্বৈতমনা, ও Two mindedness=দ্বৈতমানস।
৮
মহান = Sublime
মহিমা = Sublimity
সৌন্দর্য ও মহিমা– এইটেই ভালো লাগ্চে। ভূমা শব্দের অসুবিধা অনেক। কারণ বিশেষ্য বিশেষণ একই হওয়া ব্যবহারের পক্ষে একেবারেই ভালো নয়।
৯
আমার শরীর ও মনের অটুট কুঁড়েমি শেষ নৈষ্কর্ম্য রাত্রির পূর্বসন্ধ্যা বলে ধরে নিতে পারো। এই নৈঃশব্দ্যের যুগে আমার কাছে শব্দসৃষ্টির প্রত্যাশা নিয়ে এসেছ, কুণ্ঠিত করেছ আমার লেখনীকে। রচনার প্রসঙ্গে পরিভাষা যখন আপনি এসে পড়ে তখন সেটা মাপসই মানানসই হয়। পা রইল এ পাড়ায় আর জুতো তৈরি হচ্ছে ও পাড়ায় ব্যবহারের পক্ষে এটা অনেক সময়েই পীড়াজনক ও ব্যর্থ হয়। অপর পক্ষে নতুন জুতো প্রথমটা পায়ে আঁট হলেও চলতে চলতে পা তাকে নিজের গরজে আপনার মাপের করে নেয়। পরিভাষা সম্বন্ধেও সেরকম প্রায়ই ঘটে।
Harmony– স্বরসংগম বা স্বরসংগতি।
Concord– স্বরৈক্য
Discord– বিস্বর
Symphony– ধ্বনিমিলন
Symphonic– সংধ্বনিক
সংস্কৃত ধাতুপ্রত্যয় যেখানে সহজে সাড়া না দেয় সেখানে মূল শব্দের শরণ নিয়ো। ভাষায় ম্লেচ্ছ সংস্রবদোষ একদা গর্হিত ছিল। এখন সেদিন নেই–এখন ভাষার অম্নিবাসে ফিরিঙ্গিতে বাঙালিতে ঘেঁষাঘেষি বসে।
১০
… আমার মতে “স্বপ্নাঞ্চিত” কথাটা অন্তত এখনো চলনসই হয় নি–রোমাঞ্চিত কথাটার মানে, রোম carved হয়ে ওঠা– আমি তৃণাঞ্চিত কথা ব্যবহার করেচি– সেটা যদিও অচলিত তবু অচলনীয় নয়। মঞ্জীরকে “তিক্ত” বল্লে ভাষায় ফিরিঙ্গি গন্ধ লাগে। ইংরেজিতে bitter কথাটা রসনাকে ছাড়িয়ে হৃদয় পর্যন্ত প্রবেশ করে– বাংলায় “তীব্র” কথাটা স্বাদে এবং ভাবে আনাগোনা করে কিন্তু তিক্ত কথাটাকে অন্তত নূপুরের বিশেষণরূপে চালাবার পূর্বে তোমার কবিযশকে এখনো অনেক দূর সুপ্রতিষ্ঠিত ও পরিব্যাপ্ত করতে হবে। “স্বীকৃতির” পরিবর্তে খ্যাতি বলাই ভালো। “সুগুপ্ত” কথাটা আমার কানে অত্যন্ত পীড়ন সঞ্চার করে। যেখানে গুপ্ত শব্দের সঙ্গে সু বিশেষণের সংগতি আছে সেখানে দোষ নেই। অনেকে খামকা সু-উচ্চ কথা ব্যবহার করে কিন্তু ওতে কেবল ছন্দোরক্ষার অনাচার প্রকাশ পায়।
১১
কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ চাও। বাণী ছাড়া আর কোনো শব্দ মনে পড়ে না। আমাদের ভাষায় আকাশবাণী দৈববাণী প্রভৃতি কথার ব্যবহার আছে। শুধু “বাণী” কথাটিকে যদি যথেষ্ট মনে না কর তবে “মহাবাণী” ব্যবহার ক’রতে পারো।
১২
আমার মনে হয় নেশান, ন্যাশনাল প্রভৃতি শব্দ ইংরেজিতেই রাখা ভালো। যেমন অক্সিজেন হাইড্রোজেন। ওর প্রতিশব্দ বাংলায় নেই। রাষ্ট্রজন কথাটা চালানো যেতে পারে। রাষ্ট্রজনিক এবং রাষ্ট্রজনিকতা শুন্তে খারাপ হয় না। আমার মনে হয় রাষ্ট্রজনের চেয়ে রাষ্ট্রজাতি সহজ হয়। কারণ নেশন অর্থে জাতি শব্দের ব্যবহার বহুল পরিমাণে চ’লে গেছে। সেই কারণেই রাষ্ট্রজাতি কথাটা কানে অত্যন্ত নতুন ঠেকবে না।
Caste–জাত
Nation–রাষ্ট্রজাতি
Race–জাতি
People–জনসমূহ
Population–প্রজন
১৩
দুরূহ আপনার ফরমাস। Broadcast-এর বাংলা চান। আমি কখনো কখনো ঠাট্টার সুরে বলি আকাশবাণী। কিন্তু সেটা ঠাট্টার বাইরে চলবে না।…
সীরিয়াসভাবে যদি বলতে হয় তা হলে একটা নতুন শব্দ বানানো চলে। বলা বাহুল্য পারিভাষিক শব্দ পুরোনো জুতো বা পুরোনো ভূত্যের মতো– ব্যবহার করতে করতে তার কাছ থেকে পুরো সেবা পাওয়া যায়।
“বাক্প্রসার” শব্দটা যদি পছন্দ হয় টুকে রাখবেন, পছন্দ না যদি হয় তা হলেও দুঃখিত হবো না। ওর চেয়ে ভালো কথা যদি পান তবে তার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।
১৪
শরীর ভালো ছিল না, ব্যস্ত ছিলাম, তার উপরে তোমার প্রশ্ন অত্যন্ত কঠিন, যে চারটে শব্দ তর্জমা করতে অনুরোধ করেছ সেগুলি যদি সশ্রম কারাদণ্ডে ব্যবহার করতে দিতে তা হলে তিন-চার মাসের মেয়াদ ভর্তি হতে পারত।
শব্দের ভাষান্তরে তোমাদের প্রস্তাব “আধিমানসিক মিত্রতাবোধ’। আপত্তি এই, মিত্রতা মানসিক হবে না তো আর কি হতে পারে? মানসিক শব্দের অর্থ intellectual-এর চেয়ে ব্যাপক– বস্তুত ওর ইংরেজী হচ্ছে mental। Intellect-কে বুদ্ধি বল্লে বোঝা সহজ হয় বুদ্ধিগত বা বুদ্ধিমূলক বা বুদ্ধিপ্রধান মৈত্রী অথবা মৈত্রীবোধ বল্লে কানে খটকা লাগবে না। ওর প্রতিকূল হচ্ছে emotionalঅর্থাৎ ভাবপ্রধান বা হৃদয়প্রধান।
শব্দটাকে তর্জমা করা আরো দুঃসাধ্য। তোমাদের প্রস্তাব হচ্ছে “আধি সাংস্কৃতিক’। এর ঠিক মানেটা আন্দাজ করা অসম্ভব বললেই হয়। প্রথমত culture শব্দের বাংলা একটি করতে হবে। আমি বলি মনঃপ্রকর্ষ বা চিত্রপ্রকর্ষ বল্লে ভাবখানার একটা ইসারা পাওয়া যায়। Cultured লোককে বলা যেতে পারে প্রকৃষ্টচিত্ত বা প্রকৃষ্টমনা। যদি বলতে হয় অঙ্কশাস্ত্রে তিনি cultured তা হলে বাংলায় বলবে অঙ্কশাস্ত্রে তিনি প্রকর্ষপ্রাপ্ত। অমুক পরিবারে culture-এর atmosphere আছে বলতে হলে বলা যেতে পারে, অমুক পরিবারে মনঃপ্রকর্ষ বা চিত্তপ্রকর্ষের আবহাওয়া আছে। কৃষ্টি কথাটা আমার কানে একটুও ভালো লাগে না। বরঞ্চ উৎকৃষ্টি বল্লেও কোনোমতে চলত।
যা হোক আমার মতে cultural self-কে চিত্তপ্রকর্ষগত বা মনঃপ্রকর্ষগত সত্তা বা ব্যক্তিত্ব বলা যায়। আরো দুটো কথা দিয়েছ intellectual passion, intellectual self। সংরাগ শব্দকে আমি passion অর্থে ব্যবহার করি। অতএব আমার মতে intellectual passion-কে বুদ্ধিগত সংরাগ ও intellectual self-কে বুদ্ধিগত ব্যক্তিত্ব বল্লে ভাবটা বুঝতে বাধবে না।
যাই হোক বহুল ব্যবহার ছাড়া এ-সব শব্দ ভাষায় প্রাণবান হয়ে ওঠে না।
বলা বাহুল্য physical culture-কে বলতে হবে দেহপ্রকর্ষ চর্চা।
১৫
ভূতত্ত্বের পরিভাষা আলোচনা আমার পক্ষে অসাধ্য। Fossil শব্দকে শিলক ও Fossilized– কে শিলীকৃত বলা চলে। Sub-man-কে অবমানব বললেই ভালো হয়। প্রাতর্ ও প্রত্যুষ শব্দের যোগে যে শব্দ বানিয়েছ কানে অসংগত ঠেকে। প্রাতর্ শব্দের পরিবর্তে প্রথম বা প্রাক্ ব্যবহার করলে চলে না কি, Eolith=প্রাক্প্রস্তর। Eoanthropus=প্রাক্মানব। Eocene=প্রাগাধুনিক।
Proterozoic=পরাজৈবিক।
১৬
পরিভাষা সংকলনের কাজ আপনি যে নিয়মে চালাচ্ছেন সে আমার অনুমোদিত। আপনার কাজ শেষ হতে দীর্ঘকাল লাগবে। কিন্তু বাংলা ভাষার বৈজ্ঞানিক পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজে অধিক দেরি করা চলবে না। বই যাঁরা লিখ্বেন তাঁদের মধ্যে যোগ্যতম ব্যক্তিদের হাতেই পরিভাষার চরম নির্বাচন ও প্রচলন নির্ভর করে; উপস্থিত মতো যথাসম্ভব তাঁদের সাহায্য করবার কাজে আমরা প্রবৃত্ত হয়েছি। ভাষায় সব সময়ে যোগ্যতমের নির্বাচন নীতি খাটে না– অনেক সময়ে অনেক আকস্মিক কারণে অযোগ্য শব্দ টিঁকে যায়। সর্বপ্রধান কারণ হচ্ছে তাড়া– শেষ পর্যন্ত বিচার করবার সময় যখন পাওয়া যায় না তখন আপাতত কাজ সারার মতো শব্দগুলো চিরস্বত্ব দখল করে বসে। আমার মনে হয় যথাসম্ভব সত্বর কাজ করা উচিত– কাজ চলতে চলতে ভাষা গড়ে উঠবে– তখন পারিভাষিক শব্দগুলি অনেক স্থলে প্রথার জোরেই ব্যাকরণ ডিঙিয়ে আপন অর্থ স্থির করে নেবে।
১৭
যখন কোনো ইংরেজি শব্দের নূতন প্রতিশব্দ রচনা করতে বসি তখন প্রায় ভুলে যাই যে অনেক সময়ে সে শব্দের ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ হয়। Background, ছবি সম্বন্ধে এক মানে, বিষয় সম্বন্ধে অন্য মানে, আবার কোনো কোনো জায়গায় ওই শব্দে বোঝায় প্রচ্ছন্ন বা অনাদৃত স্থান। পটভূমিকা শব্দটা আমিই প্রথমে যে জায়গায় ব্যবহার করেছিলেম সেখানে তার সার্থকতা ছিল। পশ্চাদ্ভূমিকা বা পৃষ্ঠাশ্রয় হয়তো অধিকাংশ স্থলে চলতে পারে। “শিশিরবাবুর নাটকে গানের অনুভূমিকা বা পশ্চাদ্ভূমিকা” বললে অসংগত শোনায় না। বলা বাহুল্য নতুন তৈরি শব্দ নতুন জুতোর মতো ব্যবহার করতে করতে সহজ হয়ে আসে। “এই নভেলের ঐতিহাসিক পশ্চাদ্ভূমিকা” বললে অর্থবোধের বিঘ্ন হয় না। কিন্তু আমার প্রশ্ন এই যে এ-সকল স্থানে ইংরেজির অবিকল অনুবাদের প্রয়োজন কী? এ স্থলে যদি বলা যায়– ঐতিহাসিক ভূমিকা বা ভিত্তি তা হলে তাতে কি নালিশ চলে– কোনোমতে ওই “পশ্চাৎ’ শব্দটা কি জুড়তেই হবে? আশ্রয় বা আশ্রয়বস্তু কথাটাও মন্দ নয়। ইংরেজিতেও অনেক সময়ে একই অর্থে foundation বললেও চলে, background বললেও চলে, support বললেও চলে।
“কায়াচিত্র” Tableau-এর ভালো অনুবাদ সন্দেহ নেই।
এবং reference অধিকাংশ স্থলেই সমার্থক। বাংলা করতে হলে ভিন্ন ভিন্ন স্থলে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ প্রয়োগ করতে হবে– যেমন সংকেত, লক্ষ্য, উদ্দেশ, উদাহরণ। বলা যেতে পারে, মল্লিনাথের টীকায় দিঙ্নাগাচার্যের সমুদ্দেশ পাওয়া যায়। Reference স্থলবিশেষে পরিচয় অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন certificate-এর সমর্থক reference।
“সুমেরিয় ইতিহাসে ইন্দ্র দেবতার allusion আছে,” এখানে allusion যদি অস্পষ্ট হয় তবে সেটা ইঙ্গিত, যদি স্পষ্ট হয় তবে সেটা উদাহরণ। Alluding to his character–“তাঁর চরিত্রের প্রতি লক্ষ্য করে।” মোটের উপর অভিনির্দেশ অভিসংকেত শব্দ দ্বারা reference-এর allusion-এর অর্থ বোঝানো যেতে পারে। রক্তকরবীর নন্দিনীকে লক্ষ্য ক’রে যদি ‘art’ শব্দ ব্যবহার করতে হয় তা হলে বলা উচিত “কলারূপিণী’। Technical term-এর প্রচলিত বাংলা– পারিভাষিক শব্দ।
১৮
শব্দের প্রচলিত বাংলা প্রতিশব্দ উৎকীর্ণ-চিত্র–যদি অক্ষর হয় তবে উৎকীর্ণ লিপি।
১৯
Proximo ও Ultimo শব্দের সহজ প্রতিশব্দ গত মাসিক ও আগামী মাসিক।
২০
…Image কথাটার প্রতিশব্দ প্রতিমা– স্থান বিশেষে আর কিছুও হোতে পারে।
আষাঢ়, ১৩২৬
প্রতিশব্দ-প্রসঙ্গ
১
“কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ।
কেন প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতিযুক্ত॥ …
“প্রৈতি’ শব্দটির প্রতি আমরা পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি। বাংলা ভাষায় এই শব্দটির অভাব আছে। যেখানে বেগপ্রাপ্তি বুঝাইতে ইংরেজিতে impulseশব্দের ব্যবহার হয় আমাদের বিবেচনায় বাংলায় সেই স্থলে প্রৈতি শব্দের প্রয়োগ হইতে পারে।”
২
শ্রীযুক্ত সুবোধচন্দ্র মহলানবিশ জীবতত্ত্ব সম্বন্ধে কয়েকটি কথা লিখিয়াছেন।… প্রবন্ধে যে দু-একটি পারিভাষিক শব্দ আছে, তৎসম্বন্ধে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। বাংলায় এভোল্যুশন্ থিওরি-র অনেকগুলি প্রতিশব্দ চলিয়াছে। লেখক মহাশয় তাহার মধ্যে হইতে ক্রমবিকাশতত্ত্ব বাছিয়া লইয়াছেন। পূজ্যপাদ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় এরূপ স্থলে অভিব্যক্তিবাদ শব্দ ব্যবহার করেন। অভিব্যক্তি শব্দটি সংক্ষিপ্ত; ক্রমে ব্যক্ত হইবার দিকে অভিমুখভাব অভি উপসর্গযোগে সুস্পষ্ট; এবং শব্দটিকে অভিব্যক্ত বলিয়া বিশেষণে পরিণত করা সহজ। তা ছাড়া ব্যক্ত হওয়া শব্দটির মধ্যে ভালোমন্দ উন্নতি-অবনতির কোনো বিচার নাই; বিকাশ শব্দের মধ্যে একটি উৎকর্ষ অর্থের আভাস আছে। লেখক মহাশয় natural selection-কে বাংলা নৈসর্গিক মনোনয়ন বলিয়াছেন। এই সিলেক্শন্ শব্দের চলিত বাংলা “বাছাই করা’। বাছাই কার্য যন্ত্রযোগেও হইতে পারে; বলিতে পারি চা-বাছাই করিবার যন্ত্র, কিন্তু চা মনোনীত করিবার যন্ত্র বলিতে পারি না। মন শব্দের সম্পর্কে মনোনয়ন কথাটার মধ্যে ইচ্ছা-অভিরুচির ভাব আসে। কিন্তু প্রাকৃতিক সিলেক্শন্ যন্ত্রবৎ নিয়মের কার্য, তাহার মধ্যে ইচ্ছার অভাবনীয় লীলা নাই। অতএব বাছাই শব্দ এখানে সংগত। বাংলায় বাছাই শব্দের সাধু প্রয়োগ নির্বাচন। “নৈসর্গিক নির্বাচন’ শব্দে কোনো আপত্তির কারণ আছে কি না জানিতে ইচ্ছুক আছি। Fossil শব্দের সংক্ষেপে “শিলাবিকার’ বলিলে কিরূপ হয়? Fossilized শব্দকে বাংলায় শিলাবিকৃত অথবা শিলীভূত বলা যাইতে পারে।
৩
“চরিত্র নীতি’ প্রবন্ধটির লেখক শ্রীযুক্ত খগেন্দ্রনাথ মিত্র।… ইংরেজি ethics শব্দকে তিনি বাংলায় চরিত্রনীতি নাম দিয়াছেন। অনেকে ইহাকে নীতি ও নীতিশাস্ত্র বলেন– সেটাকে লেখক পরিত্যাগ করিয়া ভালোই করিয়াছেন; কারণ নীতি শব্দের অর্থ সকল সময় ধর্মানুকূল নহে।
প্রহরিষ্যন্ প্রিয়ং ব্রুয়াৎ প্রহৃত্যাপি প্রিয়োত্তরম্।
অপিচাস্য শিরশ্ছিত্ত্বা রুদ্যাৎ শোচেৎ তথাপি চ॥
মারিতে মারিতে কহিবে মিষ্ট,
মারিয়া কহিবে আরো।
মাথাটা কাটিয়া কাঁদিয়া উঠিবে
যতটা উচ্চে পারো।
ইহাও এক শ্রেণীর নীতি, কিন্তু এথিক্স্ নহে। সংস্কৃত ভাষায় ধর্ম বলিতে মুখ্যত এথিক্স্ বুঝায়, কিন্তু ধর্মের মধ্যে আরো অনেক গৌণ পদার্থ আছে। মৌনী হইয়া ভোজন করিবে, ইহা ব্রাহ্মণের ধর্ম হইতে পারে কিন্তু ইহা এথিক্স্ নহে। অতএব চরিত্রনীতি শব্দটি উপযুক্ত হইয়াছে, কিন্তু ইহাকে আর-একটু সংহত করিয়া “চারিত্র’ বলিলে ব্যবহারের সুবিধাজনক হয়। চরিত্রনীতিশিক্ষা, চরিত্রনীতিবোধ, চরিত্রনৈতিক উন্নতি অপেক্ষা “চারিত্রশিক্ষা’, “চারিত্রবোধ’, “চারিত্রোন্নতি’ আমাদের কাছে সংগত বোধ হয়। … আর-একটি কথা জিজ্ঞাস্য, metaphysics শব্দের বাংলা কি “তত্ত্ববিদ্যা’ নহে।
৪
লেখক মহাশয় [উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী] সেন্ট্রিপীটাল ও সেন্ট্রিফ্যুগাল ফোর্স-কে কেন্দ্রাভিসারিণী ও কেন্দ্রাপগামিনী শক্তি বলিয়াছেন– কেন্দ্রানুগ এবং কেন্দ্রাতিগ শক্তি আমাদের মতে সংক্ষিপ্ত ও সংগত।
৫
লেখক মহাশয় ইংরেজি ফসিল্ শব্দের বাংলা করিয়াছেন “প্রস্তরীভূত কঙ্কাল’। কিন্তু উদ্ভিদ্ পদার্থের ফসিল সম্বন্ধে কঙ্কাল শব্দের প্রয়োগ কেমন করিয়া হইবে। “পাতার কঙ্কাল’ ঠিক বাংলা হয় না। … ফসিলের প্রতিশব্দ শিলাবিকার হইতে পারে, এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছিলাম। কিন্তু মহলানবিশ মহাশয়ের সহিত আলোচনা করিয়া দেখিয়াছি “শিলাবিকা’ metamorphosed rock-এর উপযুক্ত ভাষান্তর হয়, এবং জীবশিলা শব্দ ফসিলের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইতে পারে।
৬
বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা স্থির হয় নাই, অতএব পরিভাষার প্রয়োগ লইয়া আলোচনা কর্তব্য, কিন্তু বিবাদ করা অসংগত। ইংরেজি মিটিয়রলজির বাংলা-প্রতিশব্দ এখনো প্রচলিত হয় নাই, সুতরাং জগদানন্দবাবু যদি আপ্তের সংস্কৃত অভিধানের দৃষ্টান্তে “বায়ুনভোবিদ্যা’ ব্যবহার করিয়া কাজ চালাইয়া থাকেন, তাঁহাকে দোষ দিতে পারি না। যোগেশবাবু “আবহ’ শব্দ কোনো প্রাচীন গ্রন্থ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, তাহার অর্থ ভূবায়ু। কিন্তু এই ভূবায়ু বলিতে প্রাচীনেরা কী বুঝিতেন, এবং তাহা আধুনিক অ্যাট্মস্ফিয়ার শব্দের প্রতিশব্দ কি না, তাহা বিশেষরূপে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে– এক কথায় ইহার মীমাংসা হয় না। অগ্রে সেই প্রমাণ উপস্থিত না করিয়া জোর করিয়া কিছু বলা যায় না। শকুন্তলার সপ্তম অঙ্কে দুষ্যন্ত যখন স্বর্গলোক হইতে মর্ত্যে অবতরণ করিতেছেন, তখন মাতলিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন আমরা কোন্ বায়ুর অধিকারে অসিয়াছি।” মাতলি উত্তর করিলেন, “গগনবর্তিনী মন্দাকিনী যেখানে বহমানা, চক্রবিভক্তরশ্মি জ্যোতিষ্কলোক যেখানে বর্তমান, বামনবেশধারী হরির দ্বিতীয় চরণপাতে পবিত্র এই স্থান ধূলিশূন্য প্রবহবায়ুর মার্গ।” দেখা যাইতেছে, প্রাচীনকালে “প্রবহ’ প্রভৃতি বায়ুর নাম তৎকালীন একটি কাল্পনিক বিশ্বতত্ত্বের মধ্যে প্রচলিত ছিল– সেগুলি একটি বিশেষ শাস্ত্রের পারিভাষিক প্রয়োগ। দেবীপুরাণে দেখা যায় :
প্রাবাহো নিবহশ্চৈব উদ্বহঃ সংবহস্তথা
বিবহঃ প্রবহশ্চৈব পরিবাহস্তথৈব চ
অন্তরীক্ষে চ বাহ্যে তে পৃথঙ্মার্গবিচারিণঃ।
এই-সকল বায়ুর নাম কি আধুনিক মিটিয়রলজির পরিভাষার মধ্যে স্থান পাইতে পারে। বিশেষ শাস্ত্রের বিশেষ মত ও সংজ্ঞার দ্বারা তাহার পরিভাষাগুলির অর্থ সীমাবদ্ধ, তাহাদিগকে নির্বিচারে অন্যত্র প্রয়োগ করা যায় না। অপর পক্ষে নভঃ শব্দ পারিভাষিক নহে, তাহার অর্থ আকাশ, এবং সে-আকাশ বিশেষরূপে মেঘের সহিত সম্বন্ধযুক্ত– সেইজন্য নভঃ ও নভস্য শব্দে শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস বুঝায়। কিন্তু নভঃ শব্দের সহিত পুনশ্চ বায়ু শব্দ যোগ করিবার প্রয়োজন নাই, এ কথা স্বীকার করি। আপ্তেও তাঁহার অভিধানে তাহা করেন নাই; তাঁহার আভিধানিক সংকেত অনুসারে নভোবায়ু-বিদ্যা বলিতে নভোবিদ্যা বা বায়ুবিদ্যা বুঝাইতেছে।”নভোবিদ্যা’ মিটিয়রলজির প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইলে সাধারণের সহজে বোধগম্য হইতে পারে।
৭
প্রতিষ্ঠান কথাটা আমাকে বানাইতে হইল। ইংরেজি কথাটা institution। ইহার কোনো বাংলা প্রচলিত প্রতিশব্দ পাইলাম না। যে প্রথা কোনো-একটা বিশেষ ব্যবস্থাকে অবলম্বন করিয়া দেশে প্রতিষ্ঠালাভ করা যায়, তাহাকে প্রতিষ্ঠান বলিতে দোষ দেখি না। Ceremony শব্দের বাংলা অনুষ্ঠান এবং institution শব্দের বাংলা প্রতিষ্ঠান করা যাইতে পারে।
১৩০৮
প্রদোষ
১
আমার লেখায় “প্রদোষ” শব্দের প্রয়োগে অর্থের ভুল ঘটেচে, সেই নিন্দা ক্ষালনের জন্য তোমার পত্রিকায় কিছু প্রয়াস দেখা গেল। আমার প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধা আছে জেনেই আমি বলচি এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। অজ্ঞতা ও অনবধানতায় স্বকৃত ও অন্যকৃত দোষে অনেক ভুল আমার লেখায় থেকে গেছে। মেনে নিতে কখনো কুণ্ঠিত হই নে। পাণ্ডিত্যের অভাব এবং অন্য অনেক ত্রুটি সত্ত্বেও সমাদরের যোগ্য যদি কোনো গুণ আমার রচনায় উদ্বৃত্ত থাকে তবে সেইটের পরেই আমার একমাত্র ভরসা; নির্ভুলতার পরে নয়।
রাত্রির অল্পান্ধকার উপক্রমকেই বলে প্রদোষ, রাত্রির অল্পান্ধকার পরিষের বিশেষ কোনো শব্দ আমার জানা নেই। সেই কারণে প্রয়োজন উপস্থিত হলে ওই শব্দটাকে উভয় অর্থেই ব্যবহার করবার ইচ্ছা হয়। এমনি করেই প্রয়োজনের তাগিদে শব্দের অর্থবিস্তৃতি ভাষায় ঘটে থাকে। সংস্কৃত অভিধানে যে শব্দের যে অর্থ, বাংলা ভাষায় সর্বত্র তা বজায় থাকে নি। সেই ওজর করেই আলোচিত লেখাটিকে যখন গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করব তখন প্রদোষ কথাটার পরিবর্তন করব না এই রকম স্থির করেচি। সম্ভবত এই অর্থে এই শব্দটার প্রয়োগ আমার রচনায় অন্যত্রও আছে এবং ভাবীকালেও থাকবে। রাত্রির আরম্ভে ও শেষে যে আলো-অন্ধকারের সংগম, তার রূপটি একই, এবং একই নামে তাকে ডাকবার দরকার ঘটে। সংস্কৃত ভাষায় সন্ধ্যা শব্দের দুই অর্থই আছে কিন্তু বাংলায় তা চল্বে না।
আমার লেখায় এর চেয়ে গুরুতর ভুল, ইস্কুলের নীচের ক্লাসে পড়চে এমন ছেলে চিঠি লিখে একবার আমাকে জানিয়েছিল। আমি মিথ্যা তর্ক করি নি; তাকে সাধুবাদ দিয়ে স্বীকার করে নিয়েচি। –অপবাদের ভাষা ও ভঙ্গি অনুসারে কোনো স্থলে স্বীকার করা কষ্টসাধ্য, কিন্তু না করা ক্ষুদ্রতা। আমি পণ্ডিত নই, শোনা কথা বলচি; কালিদাসের মতো কবির কাব্যেও শাব্দিক ত্রুটি ধরা পড়েচে। কিন্তু ভাবিক ত্রুটি নয় বলেই তার সংশোধনও হয় নি, মার্জনাও হয়েচে। য়ুরোপীয় সাহিত্যে এবং চিত্রকলায় এরূপ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বৈষ্ণব পুরাণে কথিত আছে, রাধিকার ঘটে ছিদ্র ছিল কিন্তু নিন্দুকেরাও সেটা লক্ষ্য করলে না যখন দেখা গেল তৎসত্ত্বেও জল আনা হয়েছে। সাহিত্যে চিত্রকলায় এই গল্পটির প্রয়োগ খাটে।
বুদ্ধির দোষে, শিক্ষার অভাবে এবং মনোযোগের দুর্বলতায় এমন অনেক ভুল করে থাকি যার স্বপক্ষে কোনো কথাই বলা চলে না। তাতে এইমাত্র প্রমাণ হয় আমি অভ্রান্ত নই। ত্রুটি যাঁরা মার্জনা করেন ঔদার্য তাঁদেরই, যাঁরা না করেন তাদের দোষ দেওয়া যায় না। অনতিকাল পূর্বে আমার একটি প্রবন্ধে “ব্যঞ্জনান্ত’ শব্দের স্থলে “হলন্ত’ শব্দ ব্যবহার করেছিলুম। প্রবোধচন্দ্র তাঁর পত্রে আমার এই ভুল স্মরণ করিয়ে দিয়েচেন কিন্তু উল্লাস বা অবজ্ঞা প্রকাশ করেন নি। আমি সেজন্য কৃতজ্ঞ। সবুজপত্রে আমার লিখিত কোনো প্রবন্ধে ঠিক এই ভুলটিই দেখা যায় তার থেকে প্রমাণ হয় এটার কারণ অন্যমনস্কতা নয়, ব্যাকরণের পারিভাষিকে আমার অজ্ঞতা।
২
… প্রত্যুষ শব্দটি কালব্যঞ্জক– অর্থাৎ দিনরাত্রির বিশেষ একটি সময়াংশকে বলে প্রত্যুষ। বাংলা ভাষায় “সন্ধ্যা’ শব্দটিও তেমনি। আলো অন্ধকারের সমবায়ের যে একটি সাধারণ ভাবরূপ আছে, যেটা ইংরেজি twilight শব্দে পাওয়া যায় সাহিত্যে অনেক সময় সেইটেরই বিশেষ প্রয়োজন হয়। প্রদোষ শব্দকে আমি সেই অর্থেই ইচ্ছাপূর্বক ব্যবহার করি।
৩
… অমিয়র চিঠিতে তুমি লিখেচ, সকালবেলাকার আলো অন্ধকারের সময়কে প্রত্যুষ বলা হয়ে থাকে– সেই শব্দটাকে ব্যবহার করলে তার স্থলে প্রদোষ ব্যবহার করবার আভিধানিক দোষ কেটে যায়। প্রত্যুষ শব্দটা দিনরাত্রির একটি বিশেষ সময়কে নির্দেশ করে– অর্থাৎ যাকে বলে ভোরবেলা। ভোরে বা সন্ধ্যায় আলোকের অস্ফুটতায় যে একটি বিশেষ ভাব মনে আনে, প্রত্যুষ শব্দে সেটাকে প্রকাশ করা হয় না। প্রদোষ শব্দকে আমি সেই অর্থে ব্যবহার করি এবং করব। দোষ শব্দের অর্থ রাত্রি– প্র উপসর্গটা সামনের দিকে তর্জনী তোলে– অতএব ওই শব্দটাকে বিশ্লেষণ করে দুই অর্থই পাওয়া যেতে পারে– অর্থাৎ যে সময়টার সম্মুখে রাত্রি, অথবা রাত্রির সম্মুখে যে সময়। রাত্রির প্রবণতা যে দিকে। কিন্তু শব্দ বিশ্লেষণের দরকার নেই, দরকার আছে twilightশব্দের বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়ার। প্রদোষ শব্দটা সাধারণত বেকার বসে থাকে তার দ্বারা আমি সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করব, যেহেতু অন্য কোনো শব্দ নেই।
২১ জুলাই, ১৯৩২
প্রাচীন-কাব্য সংগ্রহ
বিদ্যাপতি
বিদ্যাপতির ন্যায় অমন একজন লোকপ্রিয় কবির পদসমূহ একত্রে পুস্তকাকারে সংগৃহীত হইল, তাহার টীকা, অর্থ, পাঠ-বিভেদ ও (স্থানে স্থানে) ব্যাকরণের সূত্র বাহির হইল, তথাপি তাহা লইয়া একটা আন্দোলন উপস্থিত হইল না, ইহা কেবল বাংলাদেশের জলবাতাসের গুণে। সম্পাদক শ্রীঅক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁহার যথাসাধ্য যে কথার যেরূপ অর্থ করিয়াছেন, যে শ্লোকের যেরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন, পাঠকেরা কি একবার মনোযোগ করিয়া দেখিবেন না, যে, তাহা ব্যাকরণ-শুদ্ধ হইল কি না, সুকল্পনা-সংগত হইল কি না? সে বিষয়ে কি একেবারে মতভেদ হইতেই পারে না? পাঠকেরা কি সম্পাদকবর্গকে একেবারে অভ্রান্ত দেবতা বলিয়া জ্ঞান করেন, অথবা তাঁহাদের স্বদেশের প্রাচীন– আদি কবিদের প্রতি তাঁহাদের এতই অনুরাগের অভাব, এতই অনাদর যে, তাঁহাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার দেয় স্বরূপে যৎসামান্য শ্রম স্বীকার করিতেও পারেন না? বঙ্গভাষা যাঁহাদের নিকট নিজের অস্তিত্বের জন্য ঋণী, এমন-সকল পূজনীয় প্রাচীন কবিদিগের কবিতা-সকলের প্রতি যে-সে যেরূপ ব্যবহারই করুক-না, আমরা কি নিশ্চেষ্ট হইয়া চাহিয়া থাকিব? তাহারা কি আমাদের আদরের সামগ্রী নহে? যিনি এই-সকল কবিতার সম্পাদকতা করিতে চান তিনি নিজের স্কন্ধে একটি গুরুতর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রতি পদে সাধারণের নিকটে হিসাব দিবার জন্য তিনি যেন প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে পাঠক-সাধারণ নিশ্চেষ্ট, নিরীহ-প্রকৃতি, এবং সম্পাদকবর্গও নিজের দম্ভ পাকাইয়া পাকাইয়া একটা অপরিমিত উচ্চ আসন প্রস্তুত করিয়া তুলেন; সেখান হইতে পাঠক বলিয়া যে অতি ক্ষুদ্র-কায়া একদল প্রাণী কখনো কখনো তাঁহাদের নজরে পড়ে, তাহাদের জন্য অধিক ভাবনা করা তাঁহারা আবশ্যক মনে করেন না। কবিদিগের কাব্য যিনি সংগ্রহ করেন, তাঁহার সংগ্রহের মধ্যে যদি অসাবধানতা, অবহেলা, অমনোযোগ লক্ষিত হয়, তবে তাঁহার বিরুদ্ধে আমরা অত্যন্ত গুরুতর তিনটি নালিশ আনিতে পারি– প্রথমত, কবিদের প্রতি তিনি অন্যায় ব্যবহার করিয়াছেন; দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের সহিত তিনি যে চুক্তি করিয়াছিলেন, সে চুক্তি রীতিমত পালন করেন নাই; তৃতীয়ত, পাঠক-সাধারণকে তিনি অপমান করিয়াছেন। তিনি তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, অথচ যথাযোগ্য আয়োজন করেন নাই; যথারীতি সম্ভাষণ করেন নাই; এতই কি তাহারা উপেক্ষার পাত্র? “অক্ষরের ভুল হইল হইলই, তাহাতে এমনি কী আসে যায়? অর্থবোধ হইতেছে না? একটা আন্দাজ করিয়া দেও না, কে অনুসন্ধান করিয়া দেখে?” পাঠকদের প্রতি এরূপ ব্যবহার কি সাহিত্য-আচারের বিরুদ্ধ নহে?
শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার বিদ্যাপতি-রচিত পদাবলী পুস্তকাকারে সংগ্রহ করিয়াছেন, অপ্রচলিত শব্দের ও দুরূহ শ্লোকের অর্থ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আমাদের সাহিত্যে এরূপ উদ্যোগ সম্প্রতি আরম্ভ হইয়াছে; অতএব এই উদ্যোগীদের আমরা নিরুৎসাহ করিতে চাহি না; ইঁহাদের চেষ্টা সর্বতোভাবে প্রশংসনীয়। কেবল আমরা যথাসময়ে ইঁহাদের সাবধান করিয়া দিতে চাই। আধুনিক বঙ্গীয় পাঠকগণকে নিশ্চেষ্ট জানিয়া ইঁহারা যেন নিজ কাজে শৈথিল্য না করেন। ইঁহাদের পরিশ্রম ও উদ্যমের পুরস্কার হাতে হাতে যদি-বা না পান বঙ্গ-সাহিত্যকে ইঁহারা ঋণী করিয়া রাখিবেন, ও একদিন-না-একদিন সে ঋণ পরিশোধ হইবেই।
“যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি, কোহত্র দোষ” সে কথা সত্য বটে; কিন্তু আমাদের আলোচ্য পুস্তকের সম্পাদক নিরলস হইয়া যথাসাধ্য যত্ন করিয়াছেন কি না আমাদের সন্দেহ। রসেটি শেলীর কবিতাসমূহের যে সংস্করণ মুদ্রিত করিয়াছেন, তাহাতে তিনি প্রতি কমা ও সেমিকোলনের উপর মাথা ঘুরাইয়াছেন; ইহাতে কবির প্রতি তাঁহার অসাধারণ অনুরাগ ও সাধারণের সমীপে তাঁহার কর্তব্য পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রকাশ পাইতেছে। কিন্তু এরূপ তুলনা বৃথা। কোনো বিষয়েই যাহাদের সহিত মিলে না, একটা বিশেষ বিষয়ে তাহাদের সহিত তুলনা দিতে যাওয়ার অর্থ নাই। বঙ্গদেশ ইংলণ্ড নহে, এবং সকল লোকই রসেটি নহে।
শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রাচীন কবিতা সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, এজন্য তাঁহাকে উৎসাহ দিয়া তাঁহার কৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা সমূহ লইয়া আলোচনা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম, এরূপ না করিল কবিতা-সকলের যথার্থ মর্ম বাহির হইবার সম্ভাবনা থাকিবে না। এ বিষয়ে তর্ক বিতর্ক ও আলোচনা উত্থাপন করা আবশ্যক।
প্রাচীন কবিতাবলীর টীকা প্রকাশের নানাবিধ দোষ থাকিতে পারে। ১| ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ অর্থ ব্যাখ্যা; ২| সুভাব-বিরুদ্ধ ব্যাখ্যা; ৩| সহজ শ্লোকের প্যাঁচালো অর্থ ব্যাখ্যা; ৪| দুরূহ শ্লোক দেখিয়া মৌন থাকা; ৫| সংশয়ের স্থলে নিঃসংশয় ভাব দেখানো; ইত্যাদি। এই-সকল দোষ যদি বর্তমান পুস্তকে থাকে, তবে তাহা সংশোধন করিয়া দেওয়া আমাদের কর্তব্য কার্য। বিদ্যাপতির পদাবলীর মধ্যে, ঈষৎ হউক, বা অধিক হউক, দুরূহ শ্লোক দেখিলে পাঠকদের সুবিধার জন্য আমরা তাহার অর্থ করিতে চেষ্টা করিব।
পুস্তকে নিবিষ্ট প্রথম গীতিতে কবি রাধিকার শৈশব ও যৌবনের মধ্যবর্তী অবস্থার কথা বর্ণনা করিয়াছেন।
নিরজন উরজ হেরই কত বেরি।
হাসত আপন পয়োধর হেরি॥
পহিল বদরি সম পুন নবরঙ্গ।
দিনে দিনে অনঙ্গ উঘারয়ে অঙ্গ॥
সম্পাদক ইহার শেষ দুই চরণের এইরূপ টীকা করিতেছেন; “প্রথম বর্ষার মতো নূতন নূতন ভাবভঙ্গী প্রকাশ করিতে লাগিল। বদরি (হিন্দি) বর্ষা। নবরঙ্গ শব্দে নারাঙ্গালেবু অভিধানে থাকিলে এই চরণের অন্যরূপ অর্থ হয়। কিন্তু বদরি শব্দের বর্ষা অর্থও সুপ্রসিদ্ধ নহে।” “বর্ষার মতো ভাবভঙ্গী প্রকাশ করা” শুনিলেই কেমন কানে লাগে যে, অর্থটা টানাবোনা। নবরঙ্গ শব্দে নারাঙ্গালেবু অভিধানে থাকিলে কিরূপ অর্থ হয় তাহাও দেখা উচিত ছিল। “প্রথম বর্ষার মতো ভাবভঙ্গী প্রকাশ করিতে লাগিল” এরূপ অর্থ করিলে পুন শব্দের সার্থকতা কী থাকে? যাহা হউক, এ স্থানের অর্থ অতিশয় সহজ, কেবল উপরে উদ্ধৃত চারি চরণের মধ্যে শেষের দুই চরণকে প্রথম দুই চরণের সহিত পৃথক করিয়া পড়াতেই ইহার অর্থবোধে গোল পড়ে। নিম্নলিখিত অর্থটি সহজ বলিয়া বোধ হয়। “রাধা নির্জনে কতবার আপনার উরজ দেখেন, আপনার পয়োধর দেখিয়া হাসেন। সে পয়োধর কিরূপ? না, প্রথমে বদরির (কুল) ন্যায় ও পরে নারাঙ্গার ন্যায়।” নবরঙ্গ শব্দের অর্থ নারাঙ্গা অভিধানে নাই। “নাগরঙ্গ’ ও “নার্য্যঙ্গ’ শব্দ নারাঙ্গা বলিয়া উক্ত হইয়াছে। কিন্তু নবরঙ্গ শব্দের অর্থ নারাঙ্গা, সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। বিদ্যাপতির আর-একটি পদ হইতে এই একই ভাবের দুইটি চরণ উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি, তাহাতে আমাদের কথা আরো স্পষ্ট হইবে।
পহিল বদরী কুচ পুন নবরঙ্গ।
দিনে দিনে বাঢ়য়ে, পীড়য়ে অনঙ্গ।
৩-সংখ্যক পদে সম্পাদক
খেলত না খেলত লোক দেখি লাজ।
হেরত না হেরত সহচরী মাঝ॥
এই দুই চরণের অর্থ করিতেছেন : “খেলার সময় হউক বা না হউক লোক দেখিলে লজ্জিত হয় ও সহচরীগণের মধ্যে থাকিয়া একবার দৃষ্টি করে ও তখনি অপর দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে।” “খেলত না খেলত” এবং “হেরত না হেরত” উভয়ের একই রূপ অর্থ হওয়াই সংগত বোধ হয়; উভয়ের বিভিন্ন অর্থ মনে লয় না। “খেলত না খেলত” অর্থে সম্পাদক কহিতেছেন “খেলার সময় হউক বা না হউক” অর্থাৎ খেলে বা না খেলে, তাহা যদি হয় তবে “হেরত না হেরত” শব্দের অর্থ “দেখে বা না দেখে” হওয়াই উচিত; কিন্তু তাহা হইলে কোনো অর্থই হয় না। ইহার অর্থ নিম্নলিখিত রূপ হওয়াই উচিত; “খেলে, খেলে না; লোক দেখিয়া লজ্জা হয়। সহচরীদের মধ্যে থাকিয়া দেখে, দেখে না।” অর্থাৎ খেলিতে খেলিতে খেলে না; দেখিতে দেখিতে দেখে না; ইহাই ব্যাকরণ-সম্মত ও অর্থ-সংগত।
নয়ন নলিনী দউ অঞ্জনে রঞ্জিত
ভাঙবি ভঙ্গি-বিলাস॥
সম্পাদক “ভাঙবি”, শব্দের অর্থ “প্রকাশ করিতেছে” লিখিয়াছেন। তিনি কহেন “ভাঙ বিভঙ্গি-বিলাস এই পাঠ সংগত বোধ হয় না।” ব্যাকরণ ধরিতে গেলে “ভাঙবি’ শব্দের অর্থ “প্রকাশ করিতেছে’ কোনোমতেই হয় না। “বি’ অন্ত ধাতু কোনোমতেই বর্তমান কাল-বাচক হইতে পারে না। বিদ্যাপতির সমস্ত পদাবলীর মধ্যে কোথাও এমনতর দেখা যায় না। “ভাঙবি’ অর্থে “তুই প্রকাশ করিবি’ হয়, অথবা স্ত্রীলিঙ্গ কর্তা থাকিলে “সে প্রকাশ করিবে’ও হয়, কিন্তু বর্তমান কাল-বাচক ক্রিয়ায় “বি’ যোগ বিদ্যাপতির কোনো পদেই দৃষ্ট হয় না। এমন স্থলে “ভাঙ বিভঙ্গি বিলাস’ পাঠ কী কারণে অসংগত বুঝিতে পারা যায় না। রাধিকার নয়ন-নলিনীদ্বয় অঞ্জনে রঞ্জিত, এবং তাহার ভ্রূ বিভঙ্গি-বিলাস। অর্থাৎ বিভঙ্গিতেই তাহার ভ্রূর বিলাস। এ অর্থ আমাদের নিকট বেশ সুসংগত বোধ হইতেছে।
অলখিতে মোহে হেরি বিহসিতে থোরি।
জনু বয়ান বিরাজে চান্দ উজোরি॥
কুটিল কটাক্ষ ছটা পড়ি গেল।
মধুকর ডম্বর অম্বর ভেল॥
সম্পাদক শেষ দুই চরণের অর্থ এইরূপ করিয়াছেন : “কুটিল কটাক্ষের শোভায় চারি দিক এমন শোভিত হইল যেন মধুকর ডামরে (মৌমাছির ঝাঁকে) আকাশ (অম্বর) আচ্ছন্ন হইল।’ “যেন’ শব্দ কোথা হইতে পাইলেন, এবং “আচ্ছন্ন’ শব্দই বা কোথা হইতে জুটিল? আমরা ইহার এইরূপ অর্থ করি– “অলখিত ভাবে আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাস্য করাতে তাহার মুখ উজ্জ্বল চাঁদের ন্যায় বিরাজ করিতে লাগিল। মুখ যদি চাঁদ হইল, কটাক্ষ সে চাঁদের ছটা স্বরূপ হইয়া পতিত হইতে লাগিল এবং মধুকরের ঝাঁক সে চাঁদের অম্বর অর্থাৎ আকাশ হইল। রাধার মুখের গন্ধে এত মধুকর আকৃষ্ট হইয়াছিল।’ এই গীতেরই মধ্যে মধুপের কথা পুনশ্চ উল্লেখ করা হইয়াছে; যথা–
লীলাকমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি।
চমকি চললু ধনি চকিত নেহারি॥
অর্থাৎ “লীলাকমলের দ্বারা ভ্রমরকে কিবা নিবারণ করিয়া, চকিতে চাহিয়া চমকিয়া ধনী চলিল।’ ইহাতে কুমারসম্ভবের তৃতীয় সর্গে গৌরীর বর্ণনা মনে পড়ে–
ভ্রমর তৃষিত হয়ে নিশ্বাস সৌরভে
বিম্ব অধরের কাছে বেড়ায় ঘুরিয়া,
চঞ্চল নয়ন পাতে ঊষা প্রতিক্ষণ
লীলা-শতদল নাড়ি দিতেছেন বাধা।
আমরা “লীলা-কমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি’ ইত্যাদি দুই চরণের যে অর্থ করিলাম সম্পাদকের টীকার সহিত তাহার ঐক্য হয় না। তাহাতে আছে– “লীলা-কমলে স্থিত ভ্রমর বা বারিবিন্দুর ন্যায় চঞ্চল নয়নে দৃষ্টিপাত করিয়া চমকিয়া চলিল।’ এ অর্থ যে অসংগত, তাহা মনোযোগ করিয়া দেখিলেই প্রতীতি হইবে–
লীলা-কমলে ভ্রমরা কিয়ে বারি।
চমকি চললু ধনি চকিতে নেহারি॥
“লীলা-কমল’ ও “চকিতে নেহারি’ এতদূর; এবং মাঝে “চমকি চললু ধনি’ এমন একটা ব্যবধান স্বরূপে পড়িয়াছে যে উহাকে একত্র করিতে গেলে অনেক টানাটানি করিতে হয় ও “ন্যায়’ নামক একটা যোজক পদার্থ ঘর হইতে তৈরি করিয়া আনিতে হয়। আমরা যে অর্থ দিয়াছি তাহা ইহা অপেক্ষা সহজ। “বারি’ শব্দের অর্থ নিবারণ করা অপ্রচলিত নহে। যথা–
“পুর-রমণীগণ রাখল বারি।’
অর্থাৎ পুর-রমণীগণ নিবারণ করিয়া রাখিল।
১১- সংখ্যক গীতে সম্পাদক,
“একে তনু গোরা, কনক-কটোরা
অতনু, কাঁচলা-উপাম।’
এই দুই চরণের অর্থ করিতে পারেন নাই। তিনি কহিয়াছেন, “এই চরণের অর্থগ্রহ হইল না।’ আমরা ইহার এইরূপ অর্থ করি– “তনু গৌরবর্ণ; কনক কটোরা (অর্থাৎ স্তন) অতনু অর্থাৎ বৃহৎ, এবং কাঁচলা-উপাম, অর্থাৎ ঠিক কাঁচালির মাপে।’
যব গোধূলি সময় বেলি,
ধনি মন্দির বাহির ভেলি,
নব জলধরে বিজুরি-রেখা দ্বন্দ্ব পসারিয়া গেলি॥
সম্পাদক টীকা করিতেছেন : “বিদ্যুৎ রেখার সহিত দ্বন্দ্ব (বিবাদ) বিস্তার করিয়া গেল। অর্থাৎ তাহার সমান বা অধিক লাবণ্যময়ী হইল।’ “সহিত’ শব্দটি সম্পাদক কোথা হইতে সংগ্রহ করিলেন? ইহার সহজ অর্থ এই– “রাধা গোধূলির ঈষৎ অন্ধকারে মন্দিরের বাহির হইলেন; যেন নব জলধরে বিদ্যুৎ রেখা দ্বন্দ্ব বিস্তার করিয়া গেল।’ ইহাই ব্যাকরণশুদ্ধ ও সুভাব-সংগত অর্থ।
সম্পাদক ২০-সংখ্যক গীতের কোনো অর্থ দেন নাই। আমাদের মতে তাহার ব্যাখ্যা আবশ্যক। সে গীতটি এই–
এ সখি কি পেখনু এক অপরূপ।
শুনইতে মানবে স্বপন স্বরূপ॥
কমল যুগলপর চাঁদকি মাল।
তাপর উপজল তরুণ তমাল॥
তাপর বেড়ল বিজুরী লতা।
কালিন্দী তীর ধীর চলি যাতা॥
শাখাশিখর সুধাকর পাঁতি।
তাহে নব পল্লব অরুণক ভাতি॥
বিমল বিম্বফল যুগল বিকাশ।
তাপর কির থির করু বাস॥
তাপর চঞ্চল খঞ্জন যোড়।
তাপর সাপিনী ঝাঁপল মোড়॥
ইহাতে কৃষ্ণের শরীরের বর্ণনা হইতেছে। “নখ চন্দ্রমালা শোভিত-পদকমলদ্বয়ের উপরে তরুণ তমালবৎ কৃষ্ণের শরীর উঠিয়াছে। পীতাম্বর বিদ্যুতে তাঁহাকে বেড়িয়াছে। সে তমাল তরুর শাখাশিখর, অর্থাৎ মুখ, সুধাকর। লাবণ্যই বোধ করি অরুণ ভাতির পল্লব। ওষ্ঠাধর বিম্বফলদ্বয়। তাহার উপর কিরণ অর্থাৎ হাস্য স্থির বাস করে। নেত্র খঞ্জন। কুন্তল, সাপিনী।’
অন্ধকার রাত্রে রাধিকা অভিসার উদ্দেশে বাহির হইয়াছেন, কৃষ্ণ বিঘ্ন আশঙ্কা করিতেছেন।
গগন সঘন, মহী পঙ্কা;
বিঘিনি বিথারিত উপজয়ে শঙ্কা
দশদিশ ঘন আন্ধিয়ারা;
চলইতে খলই, লখই নাহি পারা।
সব যোনি পালটি ভুললি
আওত মানবি ভানত লোলি।
সম্পাদক শেষ দুই চরণের অর্থ নিম্নলিখিতরূপে করিতেছেন। “শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার অনুপস্থিতিতেও তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন “লোলে, (লোলি) তুমি যদি (নিরাপদে) উপস্থিত হও (আওত) তাহা হইলে আমি মনে মনে করিব (মানবি) যে, সকল জীবকে (যোনি) দৃষ্টিপাত দ্বারা (পালটি) তোমার প্রভায় নত করিয়া (ভানত) ভুলাইয়াছে (ভুললি)।’ এইরূপ অর্থ কষ্টসাধ্য সন্দেহ নাই, কিন্তু আমরা অন্য কোনো সুলভ অর্থ বা পাঠ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না।’ সম্পাদক স্বীকার করিয়াছেন উপরি-উদ্ধৃত অর্থটি কষ্টসাধ্য। আমরা কহিতেছি, উহা ব্যাকরণ-সংগতও নহে। “ভুললি’ অর্থে “ভুলাইয়াছ’ হয় না, উহার অর্থ ভুলিলি, অথবা স্ত্রীলিঙ্গ কর্তার সহিত যুক্ত হইলে, ভুলিল। “মানবি’ শব্দের অর্থ “মনে করিব’ নহে, “মনে করিবি’ হইতে পারে; বিশেষত উহার কর্তা স্ত্রীলিঙ্গ নহে। আমরা উপরি-উক্ত দুই চরণের এইরূপ অর্থ করি : “আওত মানবী, ভানত লোলি। ভানত অর্থাৎ ভাবের দ্বারা লোলা, চঞ্চল মানবী আসিতেছেন । সব যোনি পালটি ভুললি। সকল প্রাণীকে দেখিতে ভুলিলেন। এত অধীরা যে, কাহারো প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে পারিতেছেন না।’
রাধিকা শ্যামকে ভর্ৎসনা করিয়া দূতী পাঠাইতেছেন। দূতীকে কহিতেছেন:
যো পুন সহচরি, হোয় মতিমান্।
করয়ে পিশুন-বচন অবধান॥
সম্পাদক টীকা করিতেছেন “কাকের কথাতেই মনঃসংযোগ করেন!’ এ টীকার টীকা কে করিবে? অনেক অনেক মতিমান্ দেখিয়াছি, তাঁহারা কাকের কথায় কিছুমাত্র মনোযোগ দেন না। টীকাকার মহাশয় নিজে কী করেন? যাহা হউক, এমন মতিমান্ যদি কেহ থাকেন যিনি কেবলমাত্র কাকের কথাতেই মনঃসংযোগ না করেন, এক-আধবার আমাদের কথাও তাঁহার কানে পৌঁছায়, তবে তিনি অনুগ্রহ করিয়া এ রহস্য কি আমাদের বুঝাইয়া দিবেন? বলা বাহুল্য, ইহার অর্থ– “যাঁহারা মতিমান্ তাঁহারা পিশুন-বচন অর্থাৎ নিন্দাবাক্যও অবধান করেন।’
“কুজনক পীরিতি মরণ-অধীন।’
এই অতি সহজ চরণটির টীকায় সম্পাদক কহেন– “কুজনের সহিত প্রীতি করিয়া এক্ষণে মরণের বশতাপন্ন হইলাম অথবা কুজনের প্রেম মরণাপেক্ষাও মন্দ।’ এত কথা সম্পাদক কোথায় পাইলেন? ইহার অতি সহজ অর্থঃ
“কুজনের প্রীতি মরণের অধীন, অর্থাৎ অধিক দিন বাঁচে না।’
পুস্তকের এক এক স্থান এমন দুর্বোধ যে, আমাদের সন্দেহ হয়, যে, হয় মূলের হস্ত-লিপিতে নয় ছাপিতে ছাপার ভুল হইয়া থাকিবে। একটা দৃষ্টান্ত দিই,
হরিণী জানয়ে ভাল কুটুম্ব বিবাদ,
তবহুঁ ব্যাধক গীত শুনিতে করু সাধ॥
সম্পাদক ইহার টীকা দেওয়া আবশ্যক বিবেচনা করেন নাই। কিন্তু আমরা ইহার অর্থ খুঁজিয়া পাই না। ইহার ঠিক অর্থ এই–“হরিণী কুটুম্ব-বিবাদ উত্তম রূপ জানে তথাপি ব্যাধের গান শুনিতে তাহার সাধ।’ এখানে “কুটুম্ব-বিবাদ’ কথাটার কেন ব্যবহার হইল, তাহা কি পাঠকেরা কিছু বুঝিতে পারিতেছেন? আমাদের বোধ হয় যে, উহা “কুটিল নিষাদ’ হইবে। অথবা কূট (অর্থাৎ ফাঁদ) শব্দজ একটা কিছু শব্দ ছিল, তাহাই ভ্রমক্রমে “কুটুম্ব’ শব্দে পরিণত হইয়াছে, এবং “বিবাদ’ শব্দ বোধ করি, “নিষাদ’ হইবে। আর-একটি অক্ষর-ভুলের উদাহরণ তুলিয়া দিই–
হরি যদি ফেরি পুছসি ধনি তোয়।
ইঙ্গিতে নিবেদন জানাওবি সোয়॥
যব চিতে দেখবি বড় অনুরাগ।
তৈখনে জানয়বি হৃদয়ে জনু লাগ॥
বিরহিণী রাধিকা কৃষ্ণের নিকট দূতী পাঠাইতেছেন। পাছে অপমান হইতে হয় এইজন্য প্রথমে ইঙ্গিতে কৃষ্ণের মনের ভাব বুঝিতে দূতীকে অনুরোধ করিতেছেন। রাধিকার ইচ্ছা, তাঁহার প্রতি কৃষ্ণের অনুরাগ লক্ষিত হইলে তবেই যেন মুখ ফুটিয়া সমস্ত নিবেদন করা হয়। সমস্ত গীতটির এই ভাব। উপরি-উদ্ধৃত শ্লোকের চতুর্থ চরণটি বুঝা যায় না। কিন্তু “জানয়বি’ শব্দ যদি “জানাওবি’ হয় তবে এইরূপ অর্থ হয়– যখনি চিত্তে বড়ো অনুরাগ দেখিবি, তখনি জানাবি; হৃদয়ে যাহাতে লাগে। অর্থাৎ সেই সময় জানাইলেই হৃদয়ে লাগিবে।
রাধিকা ছল করিয়া সখীদের কহিতেছেন– কাল ঘুমাইয়াছিলাম, এমন সময় এক পুরুষ আসিলেন, তাঁহার অরুণ আঁখি ও লোহিত অধর দেখিয়া ভয়ে আমার কেশপাশ বিশৃঙ্খল হইয়া গেল, কপালে কাজল ও মুখে সিন্দুর লাগিল।
এক পুরুখ পুন আওল আগে।
কোপে অরুণ আঁখি অধরক রাগে॥
সে ভয়ে চিকুর চির (চীর?) আনহি গেল।
কপালে কাজর মুখে সিন্দুর ভেল।
সম্পাদক টীকা করিতেছেন “সেই ভয়ে চিকুর (বিদ্যুৎ) চির (দীর্ঘকালের জন্য) অন্যত্র গমন করিল।’ এ টীকার কি কোনো অর্থ আছে? কোনো কথা নাই, বার্তা নাই, এমন সময় সহসা বিনামেঘে একটা বিদ্যুৎ খেলাইয়া যাইবে কেন, আমরা ভাবিয়া পাই না। চিকুর অর্থে কেশ। রাধিকা বলিতেছেন, সেই পুরুষের ভয়ে তাঁহার চিকুর ও চীর অন্যত্র গেল; এবং বেশভূষার বিপর্যয় হইল।
হিম হিমকর-কর তাপে তাপায়লু
ভৈগেল কাল বসন্ত।
কান্ত কাক মুখে নাহি সম্বাদই
কিয়ে করু মদন দুরন্ত।
শীতল চন্দ্রের কিরণও আমাকে তাপিত করিল, বসন্ত আমার কাল হইল। কান্ত কাহারো মুখে সংবাদ লইলেন না, দুরন্ত মদন কী যে করিতেছে। সম্পাদক টীকা করিয়াছেন “কান্ত কাকমুখেও সংবাদ পাঠাইলেন না, আমি এই দুরন্ত মদনে কি করিব?’ কাকের সহিত সম্পাদকের বিশেষ সখ্য দেখা যাইতেছে। তিনি কাককে প্রেমের দূত এবং মতিমান্ লোকদের মন্ত্রী বলিয়া স্থির করিয়াছেন। কাকের বরঞ্চ বুদ্ধিমান বলিয়া একটা খ্যাতি আছে, কিন্তু প্রেমিক বলিয়া তাহার যশ আজ পর্যন্ত শুনা যায় নাই। হিন্দুস্থানীতে “ক’ বিভক্তি যষ্ঠীতে ব্যবহার হয়, অতএব “কাক’ শব্দের অর্থ কাহার।
মাধব অবলা পেখনু মতিহীনা।
সারঙ্গ শবদে মদন স কোপিত
তেঞ দিনে দিনে অতি ক্ষীণা॥
টীকা উদ্ধৃত করি। “সারঙ্গ শবদে– হরিণের শব্দ শুনিলে’ হরিণের শব্দ শুনিলেও মদন প্রকুপিত হন মদনের এমন স্বভাব কোনো শাস্ত্রে লেখে না। সারঙ্গ শব্দের অর্থ যখন ভ্রমর হয়, কোকিল হয়, মেঘ হয়, ময়ূর হয়, তখন মদনকে রাগাইবার জন্য হরিণকে ডাকিবার আবশ্যক?
দক্ষি পবন বহে কৈছে যুবতী সহে,
তাহে দুখ দেই অনঙ্গ।
গেলনুঁ পারাণ আশা দেই রাখই
দশ নখে লিখই ভুজঙ্গ॥
সম্পাদক কহিতেছেন– “ইহার সম্যক অর্থগ্রহ হয় না।’ চতুর্থ চরণটি অত্যন্ত দুর্বোধ্য সন্দেহ নাই। ইহার অর্থ এমন হইতে পারে যে, “শিবের ভূষণ ভুজঙ্গকে মদন বিশেষরূপে ডরান, এই নিমিত্ত বিরহিণী নখে ভুজঙ্গ আঁকিয়া তাহাকে ভয় দেখাইয়া প্রাণকে আশা দিয়া রাখিতেছেন।’ রাধিকার পক্ষে ইহা নিতান্ত অসম্ভব নহে, কারণ ইতিপূর্বে তিনি রাহু আঁকিয়া বিরহিণীর ভীতিস্বরূপ চাঁদকে ভয় দেখাইতে চেষ্টা পাইয়াছিলেন।
কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করিয়া গেলে পর দূতী তাঁহার নিকটে গিয়া ব্রজ-বিরহিণীদের দুরবস্থা নিবেদন করিতেছেন।
তোহারি মুরলী সো দিগে ছোড়লি
ঝামরু ঝামরু দেহা।
জনু সে সোনারে কোষিক পাথরে
ভেজল কনক রেহা।
সম্পাদক প্রথম দুই চরণের অর্থ স্থির করিতে পারেন নাই। ইহার অর্থ– “তোমার মুরলী তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিল (ছোড়লি; স্ত্রীলিঙ্গেই) ও তাহাদের দেহ শীর্ণ মলিন হইয়া আইল।’ ঝামরু শব্দের অর্থ সম্বন্ধে আমাদের কিছু বক্তব্য আছে পরে কহিব।
বড় অপরূপ দেখিনু সজনি
নয়লি কুঞ্জের মাঝে।
ইন্দ্রনীল মণি কেতকে জড়িত
হিয়ার উপরে সাজে।
সম্পাদক “কেতক’ শব্দের অর্থ নির্মলী বৃক্ষ স্থির করিয়া বলিয়াছেন, “কিরূপ উপমা হইল বুঝিতে পারিলাম না।’ কেতক শব্দে কেয়া ফুল বুঝিতে বাধা কি? রাধা শ্যাম একত্র রহিয়াছেন যেন কেয়াফুলে ইন্দ্রনীল মণি জড়িত রহিয়াছে।
পুস্তকের মধ্যে ছোটো ছোটো অনেকগুলি অসাবধানতা লক্ষিত হয়। তাহার কতকগুলি দৃষ্টান্তস্বরূপে উল্লেখ করা আবশ্যক। আমাদের মতে এরূপ প্রাচীন কবিতা-সমূহ সংগ্রহ করিতে গেলে নিতান্ত সাবধানতার সহিত যথাসম্ভব নিখুঁত করিয়া তোলা উচিত, তিল পরিমাণ দোষ না থাকে যেন।
“কিয়ে’ শব্দের অর্থ” “কি’। কি শব্দ বাংলায় অনেক অর্থে ব্যবহার হয়। জিজ্ঞাসার স্থলে, আশ্চর্যের স্থলে, যেমন– কি সুন্দর! এবং কিংবা অর্থেও প্রয়োগ হইয়া থাকে। প্রাচীন কবিতাতেও “কিয়ে শব্দের ঐ কয়টি অর্থ। সম্পদক মহাশয় স্থানে স্থানে উলটাপালটা করিয়া একটার জায়গায় আর একটা বসাইয়াছেন। দেখিলাম তিনি জিজ্ঞাসাসূচক “কি’ শব্দের উপর নিতান্ত নারাজ।
লোচন জনু থির ভৃঙ্গ আকার,
মধুমাতল কিয়ে উড়ই না পার?
অর্থাৎ, তাঁহার লোচন স্থিরভৃঙ্গের ন্যায়; মধুমত্ত হইয়া সে কি উড়িতে পারিতেছে না? সম্পাদক কহেন “যেন মধুমত্ত হইয়া উড়িতে অক্ষম।’
দারুণ বঙ্ক বিলোকন থোর
কাল হোই কিয়ে উপজল মোর?
নিদারুণ ঈষৎ বঙ্কিম দৃষ্টি কি আমার কাল হইয়াই উৎপন্ন হইল? সম্পাদক কহেন “কি বা আমার কালস্বরূপ হইয়া উপস্থিত হইল!’ ইহা অত্যন্ত হাস্যজনক।
চিকুরে গলয়ে জলধারা
মুখশশি ভয়ে কিয়ে রোয়ে আন্ধিয়ারা?
এখানে “মুখশশির ভয়ে আঁধার কি বা রোদন করিতেছে!’ অর্থ করা অপেক্ষা “মুখশশির ভয়ে কি আঁধার রোদন করিতেছে?’ বলিলেই কানে ভালো শুনায়।
সম্পাদক “কহসি’ শব্দের এইরূপ টীকা করিয়াছেন– “কহে (সি সংস্কৃত বিভক্তি)।’ এ কেমন কথা বুঝিতে পারিলাম না। “কহে’ তৃতীয় পুরুষ, কিন্তু সংস্কৃতে দ্বিতীয় পুরুষ নহিলে “সি’ বিভক্তি হয় না। সম্পাদক এত স্থলে সি-অন্ত ধাতুর ভ্রমাত্মক অর্থ দিয়াছেন যে, উদ্ধৃত করিতে প্রবন্ধের কলেবর বাড়িয়া যায়;
চলইতে চাহি চরণ নাহি যাব॥
সম্পাদক “যাব’ শব্দের অর্থ বিশেষ করিয়া “যায়’ বলিয়া লিখিয়াছেন। ইহা ভবিষ্যৎকাল-বাচক-ক্রিয়া, ইহার অর্থ “যায়’ হইতে পারে না। ইহার অর্থ “চলিতে চাহিতেছে তথাপি পা চলিবে না।’
“ঝামর’ শব্দে সম্পাদক মেঘ কহিয়াছেন। কিন্তু সমস্ত পুস্তকের মধ্যে কোথাও ঝামর শব্দ মেঘ অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই; অথচ পদাবলীর মধ্যে পঞ্চাশ জায়গায় মেঘের উল্লেখ আছে।
কহ সখি সাঙরি ঝামরি দেহা॥
এবে ভেল বিপরীত, ঝামর দেহা॥
পুনমিক চাঁদ টুটি পড়ল জনু
ঝামর চম্পক দামে॥
তোহারি মুরলী সোদিগে ছোড়লি
ঝামরু ঝামরু দেহা॥
কুবলয়-নীল বরণ তনু সাঙরি
ঝামরি, পিউ পিউ ভাষ॥
সর্বত্রই ঝামর অর্থ শুষ্ক মলিন শব্দেউক্ত হইয়াছে। এক স্থলে শ্যামের কেশ বর্ণনায় ঝামর শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে, সে স্থলে তাহার অর্থ কৃষ্ণবর্ণ হইতে পারে। সম্পাদক যদি এই পুস্তক ব্যতীত অন্য কোনো সূত্রে অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইয়া থাকেন যে, ঝামর অর্থে মেঘ, তাহা হইলে আমাদের আর অধিক বক্তব্য থাকে না।
“আশ নিগড় করি জীউ কত রাখব
অবহ যে করত পয়াণ!’
সম্পাদক “নিগড়’ অর্থে “গড়বন্দী করা’ লিখিয়াছেন। সকলেই জানেন নিগড় অর্থ শৃঙ্খল। যাহা হউক, এরূপ ভুল তেমন মারাত্মক নহে; যাঁহারা সংস্কৃত জানেন তাঁহাদের ইহাতে হানি হইবে না।
সমস্ত পুস্তকের মধ্যে এত অসাবধানতা, এত ভ্রম লক্ষিত হয়, যে, কিয়দ্দূর পাঠ করিয়াই সম্পাদকের প্রতি বিশ্বাস চলিয়া যায়। ইহার সমস্ত ভ্রম যে কেবল সম্পাদকের অক্ষমতা-বশত ঘটিয়াছে তাহা নহে, ইহার অনেকগুলি তাঁহার অসাবধানতা-বশত ঘটিয়াছে। এমন-কি, স্থানে স্থানে তিনি অভিধান খুলিয়া অর্থ দেখিবার পরিশ্রমটুকুও স্বীকার করেন নাই। এত অবহেলা এত আলস্য যেখানে, সেখানে এ কাজের ভার গ্রহণ না করিলেই ভালো হইত। আমাদের দেশে পাঠকেরা তেমন কড়াক্কড় নহেন বলিয়া তাঁহাদিগকে বিপথে চালন করিয়া লইয়া যাওয়া নিতান্ত অনুচিত। সম্পাদকের প্রশংসনীয় উদ্যোগ সত্ত্বেও আমরা তাঁহাকে যে এত কথা বলিলাম, তাহারা কারণ বিদ্যাপতির কবিতা আমাদের অতি প্রিয় সামগ্রী, এবং পাঠকসাধারণকে আমরা উপেক্ষণীয় মনে করি না। আমরা এই প্রাচীন কাব্য-সংগ্রহের উদ্যোগকে উৎসাহ দিই। আমাদের ইচ্ছা, কোনো নিরলস, উৎসাহী ও কাব্যপ্রিয় সম্পাদক পুনশ্চ এই কার্যের ভার গ্রহণ করেন। শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার বিদ্যাপতির উপরেই প্রথম হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, এই নিমিত্ত তাহাতে যে-সকল ভ্রম আছে তাহা অনেকটা মার্জনা করা যায়; এখন আশা করি, এ বিষয়ে তাঁহার হাত অনেকটা পাকিয়া আসিয়াছে; অতএব অধিকতর মনোযোগ সহকারে এই দেশহিতকর কার্য তিনি যেন সুচারুতর রূপে সম্পন্ন করিতে পারেন, এই আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা।
শ্রাবণ, ১২৮৮।
বঙ্গভাষা
বাংলা ভাষাতত্ত্ব যিনি আলোচনা করিতে চান, বীম্স্ সাহেবের তুলনামূলক ব্যাকরণ এবং হ্যর্নলে সাহেবের গৌড়ীয় ভাষার ব্যাকরণ তাঁহার পথ অনেকটা প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছে। তাঁহাদের গ্রন্থ হইতে দুটো-একটা ভুল-ত্রুটি বা স্খলন বাহির করা গৌড়ী-ভাষীদের পক্ষে অসম্ভব না হইতে পারে কিন্তু যথোচিত শ্রদ্ধা ভক্তি ও নম্রতার সহিত তাঁহাদিগকে গুরু বলিয়া স্বীকার না করিয়া থাকা যায় না।
সংসারে জড়পদার্থের রহস্য যথেষ্ট জটিল দুর্গম, কিন্তু সজীব পদার্থের রহস্য একান্ত দুরূহ। ভাষা একটা প্রকাণ্ড সজীব পদার্থ। জীবনধর্মের নিগূঢ় নিয়মে তাহার বিচিত্র শাখাপ্রশাখা কত দিকে কতপ্রকার অভাবনীয় আকার ধারণ করিয়া ব্যাপ্ত হইতে থাকে তাহার অনুসরণ করিয়া উঠা অত্যন্ত কঠিন। বীম্স্ সাহেব, হ্যর্নলে সাহেব, হিন্দি ব্যাকরণকার কেলগ সাহেব, মৈথিলী ভাষাতত্ত্ববিৎ গ্রিয়র্সন সাহেব বিদেশী হইয়া ভারতবর্ষ-প্রচলিত আর্য ভাষার পথলুপ্ত অপরিচিত জটিল মহারণ্যতলে প্রবেশপূর্বক অশ্রান্ত পরিশ্রম এবং প্রতিভার বলে যে-সকল প্রচ্ছন্ন তথ্য উদ্ধার করিয়াছেন, তাহা লাভ করিয়া এবং বিশেষত তাঁহাদের আশ্চর্য অধ্যবসায় ও সন্ধানপরতার দৃষ্টান্ত দেখিয়া আমাদের স্বদেশী ভাষার সহিত সম্পর্কশূন্য স্বদেশহিতৈষী-আখ্যাধারীদের লজ্জা ও বিনতি অনুভব করা উচিত।
প্রাকৃত ভাষার সহিত বাংলার জন্মগত যোগ আছে সে-সম্বন্ধে দীনেশচন্দ্রবাবু ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল এবং ডাক্তার হ্যর্নলের সহিত একমত।
হ্যর্নলে সাহেব প্রমাণ করিয়াছেন, প্রাচীন ভারতবর্ষে কথিত প্রাকৃত ভাষা দুই প্রধান শাখায় বিভক্ত ছিল। শৌরসেনী ও মাগধী। মহারাষ্ট্রী লিখিত ভাষা ছিল মাত্র এবং প্রাকৃত ভাষা ভারতবর্ষীয় অনার্যদের মুখে বিকৃতিপ্রাপ্ত হইয়া যে-ভাষায় পরিণত হইয়াছিল তাহার নাম ছিল পৈশাচী।
প্রাচীন ব্যাকরণকারগণ যে-সকল ভাষাকে অপভ্রংশ ভাষা বলিতেন তাহাদের নাম এই আভীরী (সিন্ধি, মাড়োয়ারি), আবন্তী (পূর্ব-রাজপুতানি), গৌর্জরী (গুজরাটি), বাহ্লিকা (পঞ্জাবি), শৌরসেনী (পাশ্চাত্য হিন্দী), মাগধী অথবা প্রাচ্যা (প্রাচ্য হিন্দি), ওড্রী (উড়িয়া), গৌড়ী (বাংলা), দাক্ষিণাত্যা অথবা বৈদর্ভিকা (মারাঠি) এবং সৈপ্পলী (নেপালী?)।
উক্ত অপভ্রংশ তালিকার মধ্যে শৌরসেনী ও মাগধী নাম আছে কিন্তু মহারাষ্ট্রী নাম ব্যবহৃত হয় নাই। মহারাষ্ট্রী যে ভারতবর্ষীয় কোনো দেশ-বিশেষের কথিত ভাষা ছিল না তাহা হ্যর্নলে সাহেব প্রতিপন্ন করিয়াছেন। বিশেষ আধুনিক মহারাষ্ট্রদেশ-প্রচলিত ভাষার অপেক্ষা পাশ্চাত্য হিন্দি ভাষার সহিত তাহার ঘনিষ্ঠতর সাদৃশ্য আছে। প্রাকৃত নাটকে দেখা যায় শৌরসেনী গদ্যাংশে এবং মহারাষ্ট্রী পদ্যাংশে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, ইহা হইতেও কতকটা প্রমাণ হয় মহারাষ্ট্রী সাহিত্য-ভাষা ছিল, কথায়-বার্তায় তাহার ব্যবহার ছিল না।
কিন্তু, আমাদের মতে, ইহা হইতে প্রমাণ হয় না যে, মহারাষ্ট্রী কোনো কালেই কথিত ভাষা ছিল না এবং তাহা সাহিত্যকারদের রচিত কৃত্রিম ভাষা। সর্বদা ব্যবহারের ঘর্ষণে চলিত কথায় ভাষার প্রাচীন রূপ ক্রমশ পরিবর্তিত হইতে থাকে, কিন্তু কাব্যে তাহা বহুকাল স্থায়িত্ব লাভ করে। বাহিরের বিচিত্র সংস্রবে পুরুষসমাজে যেমন ভাষা এবং প্রথার যতটা দ্রুত রূপান্তর ঘটে অন্তঃপুরের স্ত্রীসমাজে সেরূপ ঘটে না–কাব্যেও সেইরূপ। আমাদের বাংলা কাব্যের ভাষায় তাহার অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যাইবে।
বাংলা কাব্যে “ছিল” শব্দের স্থলে “আছিল”, প্রথম পুরুষ “করিল” শব্দের স্থলে “করিলা”, “তোমাদিগকে” স্থলে “তোমা সবে” প্রভৃতি যে-সকল রূপান্তর প্রচলিত আছে তাহাই যে কথিত বাংলার প্রাচীন রূপ ইহা প্রমাণ করা শক্ত নহে। এই দৃষ্টান্ত হইতেই সহজে অনুমান করা যায় যে, প্রাকৃত সাহিত্যে মহারাষ্ট্রী নামক পদ্য ভাষা শৌরসেনী অপভ্রংশ অপেক্ষা প্রাচীন আদর্শমূলক হওয়া অসম্ভব নহে।
পূর্বেই বলা হইয়াছে শৌরসেনী-অপভ্রংশ প্রাকৃত-সাহিত্যের গদ্য ভাষা। সাহিত্য-প্রচলিত গদ্য ভাষার সহিত কথিত ভাষার সর্বাংশে ঐক্য থাকে না তাহাও বাংলা ভাষা আলোচনা করিলে দেখা যায়। একটা ভাষা যখন বহুবিস্তৃত দেশে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে তখন তাহা ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করেই–কিন্তু লিখিবার ভাষা নিয়মে এবং স্থায়ী আকারে বদ্ধ হইয়া দেশান্তর ও কালান্তরের বিকৃতি অনেকটা প্রত্যাখ্যানপূর্বক নানাস্থানীয় পণ্ডিতসাধারণের ব্যবহারযোগ্য ও বোধগম্য হইয়া থাকে, এবং তাহাই স্বভাবত ভদ্রসমাজের আদর্শ ভাষারূপে পরিণত হয়। চট্টগ্রাম হইতে ভাগলপুর এবং আসামের সীমান্ত হইতে বঙ্গসাগরের তীর পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিচিত্ররূপ আছে সন্দেহ নাই কিন্তু সাহিত্য-ভাষায় স্বতই একটি স্থির আদর্শ রক্ষিত হইয়া থাকে। সুন্দররূপে, সুশৃঙ্খলরূপে, সংহতরূপে, গভীররূপে ও সূক্ষ্মরূপে ভাবপ্রকাশের অনুরোধে এ ভাষা যে কতক পরিমাণে কৃত্রিম হইয়া উঠে তাহাতে সন্দেহ নাই কিন্তু এই সাহিত্যগত ভাষাকেই ভিন্ন ভিন্ন প্রাদেশিক অপভাষার মূল আদর্শ বলিয়া ধরিয়া লইতে হইবে।
প্রাচীন ভারতবর্ষে এইরূপ এক দিকে মাগধী ও অন্য দিকে শৌরসেনী মহারাষ্ট্রী এই দুই মূল প্রাকৃত ছিল। অদ্য ভারতবর্ষে যত আর্য ভাষা আছে তাহা এই দুই প্রাকৃতের শাখাপ্রশাখা।
এই দুই প্রাকৃতের মধ্যে মাগধীই প্রাচীনতর। এমন-কি হ্যর্নলে সাহেবের মতে এক সময়ে ভারতবর্ষে মাগধীই একমাত্র প্রাকৃত ভাষা ছিল। তাহা পশ্চিম হইতে ক্রমে পূর্বাভিমুখে পরিব্যাপ্ত হয়। শৌরসেনী আর একটি দ্বিতীয় ভাষাপ্রবাহ ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়া পশ্চিমদেশ অধিকার করে। হ্যর্নলে সাহেব অনুমান করেন, ভারতবর্ষে পরে পরে দুইবার আর্য ঔপনিবেশিকগণ প্রবেশ করে। তাহাদের উভয়ের ভাষায় মূলগত ঐক্য থাকিলেও কতকটা প্রভেদ ছিল।
প্রাকৃত ব্যাকরণকারগণ নিম্নলিখিত ভাষাগুলিকে মাগধী প্রাকৃতের শাখারূপে বর্ণনা করিয়াছেন– মাগধী, অর্ধমাগধী, দাক্ষিণাত্যা, উৎকলী এবং শাবরী। বেহার এবং বাংলার ভাষাকে মাগধীরূপে গণ্য করা যায়। মাগধীর সহিত শৌরসেনী বা মহারাষ্ট্রী মিশ্রিত হইয়া অর্ধমাগধীরূপ ধারণ করিয়াছে–ইহা যে মগধের পশ্চিমের ভাষা অর্থাৎ ভোজপুরী তাহাতে সন্দেহ নাই। বিদর্ভ অর্থাৎ বেরার ও তাহার নিকটবর্তী প্রদেশের ভাষা দাক্ষিণাত্যা নামে অভিহিত। অতএব ইহাই বর্তমান মরাঠীস্থানীয়। উৎকলী উড়িষ্যার ভাষা, এবং এক দিকে দাক্ষিণাত্যা ও অন্য দিকে মাগধী ও উৎকলীর মাঝখানে শাবরী।
দেখা যাইতেছে, প্রাচ্য হিন্দি, মৈথিলী, উড়িয়া, মহারাষ্ট্রী এবং আসামি এইগুলিই বাংলার স্বজাতীয় ভাষা। আশ্চযের বিষয় এই যে, কাফিরিস্থানের কাফিরি ভাষা এবং আফগানিস্থানের পুশতু মাগধী প্রাকৃতের লক্ষণাক্রান্ত, এবং সে হিসাবে বাংলার কুটুম্বশ্রেণীয়। শৌরসেনী প্রাকৃত মাঝে পড়িয়া মাগধী প্রাকৃতের বিস্তারকে খণ্ডীকৃত করিয়া দিয়াছে।
এক্ষণে বাংলার ভাষাতত্ত্ব প্রকৃতরূপে নিরূপণ করিতে হইলে প্রাকৃত, পালি, প্রাচ্য হিন্দি, মৈথিলী, আসামি, উড়িয়া এবং মহারাষ্ট্রী ব্যাকরণ পর্যালোচনা ও তুলনা করিতে হয়।
কথাটা শুনিতে কঠিন, কিন্তু বাংলার ভাষাতত্ত্ব নির্ণয় জীবনের একটা প্রধান আলোচ্য-বিষয়রূপে গণ্য করিয়া লইলে এবং প্রত্যহ অন্তত দুই-এক ঘণ্টা নিয়মিত কাজ করিয়া গেলে এ কার্য একজনের পক্ষে অসাধ্য হয় না। বিশেষত উক্ত ভাষাকয়টির তুলনামূলক এবং স্বতন্ত্র ব্যাকরণ অনেকগুলিই পাওয়া যায়। এবং এইরূপ সম্পূর্ণ একাগ্রতা ও অধ্যবসায়ের গুটিকতক দৃষ্টান্ত না থাকিলে আমাদের বঙ্গসাহিত্য যথোচিত গৌরব লাভ করিতে পারিবে না।
বাংলার ভাষাতত্ত্ব-সন্ধানের একটি ব্যাঘাত, প্রাচীন পুঁথির দুষ্প্রাপ্যতা কবিকঙ্কণচণ্ডী, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি প্রাচীন কাব্যগুলি জনসাধারণের সমাদৃত হওয়াতে কালে কালে অল্পে অল্পে পরিবর্তিত ও সংশোধিত হইয়া আসিয়াছে। প্রাচীন আদর্শ পুঁথি কোনো এক পুস্তকালয়ে যথাসম্ভব সংগৃহীত থাকিলে অনুসন্ধিৎসুর পক্ষে সুবিধার বিষয় হয়। সাহিত্য-পরিষদের অধিকারে এইরূপ একটি পুস্তকালয় স্থাপিত হইতে পারিবে ইহাই আমরা আশা করি।
বৈশাখ, ১৩০৫
বাংলা কথ্যভাষা
বাংলা শব্দতত্ত্ব আলোচনা করিতে হইলে বাংলা দেশের ভিন্ন ভিন্ন জেলায় প্রচলিত উচ্চারণগুলির তুলনা আবশ্যক। অনেক বাংলা শব্দের মূল অনুসন্ধান করিতে গিয়া কৃতকার্য হওয়া যায় না। বাংলার ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে উচ্চারিত শব্দগুলি মিলাইয়া দেখিলে সেই মূল ধরিতে পারা সহজ হইতে পারে। তাহা ছাড়া উচ্চারণতত্ত্বটি শব্দতত্ত্বের একটি প্রধান অঙ্গ। স্বর ও ব্যঞ্জনের ধ্বনিগুলির কী নিয়মে বিকার ঘটে তাহা ভাষাতত্ত্বের বিচার্য। এজন্যও ভিন্ন জেলার উচ্চারণের তুলনা আবশ্যক। বাংলা দেশের প্রায় সকল জেলা হইতেই আমাদের আশ্রমে ছাত্রসমাগম হইয়াছে। তাঁহাদের সাহায্যে বাংলা ধাতুরূপ ও শব্দরূপের তুলনা-তালিকা আমরা বাহির করিতে চাই। নীচে আমরা যে তালিকা দিতেছি তাহার অবলম্বন কলিকাতা বিভাগের বাংলা। পাঠকগণ ইহা অনুসরণ করিয়া নিজ নিজ প্রদেশের উচ্চারণ-অনুযায়ী শব্দতালিকা পাঠাইলে আমাদের উপকার হইবে।
কলিকাতা বিভাগের শব্দের উচ্চারণ সম্বন্ধে দুই-একটা কথা বলা আবশ্যক। যখন “বালক’ পত্র প্রকাশ করিতাম সে অনেক দিনের কথা। তখন সেই পত্রে বাংলা শব্দোচ্চারণের কতকগুলি নিয়ম লইয়া আলোচনা করিয়াছিলাম। আমার সেই আলোচিত উচ্চারণপদ্ধতি কলিকাতা বিভাগের। স্থলবিশেষে বাংলায় অকারের উচ্চারণ ওকারঘেঁষা হইয়া যায় ইহা আমার বিচারের বিষয় ছিল। “করা’ শব্দের ক্-সংলগ্ন অকারের উচ্চারণ এবং “করি’ শব্দের ক্-সংলগ্ন অকারের উচ্চারণ তুলনা করিলে আমার কথা স্পষ্ট হইবে– এ উচ্চারণ কলিকাতা বিভাগের সে কথা পূর্বেই বলিয়াছি। কলিকাতার উচ্চারণে “মসী’ শব্দস্থিত অকার এবং “দোষী’ শব্দস্থিত ওকারের উচ্চারণ একই। “বোল্তা’ এবং “বলব’ও সেইরূপ। বাংলা উচ্চারণে কোনো ওকার দীর্ঘ কোনো ওকার হ্রস্ব; হসন্ত শব্দের পূর্ববর্তী ওকার দীর্ঘ এবং স্বরান্ত শব্দের পূর্ববর্তী ওকার হ্রস্ব। “ঘোর’ এবং “ঘোড়া’ শব্দের উচ্চারণ-পার্থক্য লক্ষ্য করিলেই ইহা ধরা পড়িবে। কিন্তু যেহেতু বাংলায় দীর্ঘ-ও হ্রস্ব-ও একই ওকার চিহ্নের দ্বারা ব্যক্ত হইয়া থাকে সেইজন্য নিম্নের তালিকায় এইসকল সূক্ষ্ম প্রভেদগুলি বিশেষ চিহ্ন দ্বারা নির্দেশ করিতে চেষ্টা করিলাম না।
আমরা প্রথমে ক্রিয়াপদের তালিকা দিতেছি। বাংলায় একবচনে ও বহুবচনে ক্রিয়ার প্রকৃতির কোনো পার্থক্য ঘটে না বলিয়াই জানি, এইজন্য নীচের তালিকায় বহুবচনের উল্লেখ নাই। যদি কোনো জেলায় বহুবচনের বিশেষ রূপ থাকে তবে তাহা নির্দেশ করা আবশ্যক।
এইখানে হসন্ত উচ্চারণ সম্বন্ধে একটা কথা বলা দরকার। বাংলায় সাধারণত শব্দের শেষবর্ণস্থিত অকারের উচ্চারণ হয় না। যেখানে উচ্চারণ হয় সেখানে তাহা ওকারের মতো হইয়া যায়। যেমন “বন’, “মন’, এ শব্দগুলি হসন্ত। “ঘন’ শব্দটি হসন্ত নহে। কিন্তু উচ্চারণ হিসাবে লিখিতে হইলে লেখা উচিত, ঘনো। “কত’=কতো। “বড়’=বড়ো। “ছোট’=ছোটো। প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া রাখি বাংলায় দুই অক্ষরের বিশেষণমাত্রই এইরূপ স্বরান্ত। বাংলায় হসন্তের আর-একটি নিয়ম আছে। বাংলায় যে অসংযুক্ত শব্দের পূর্বে স্বরবর্ণ ও পরে ব্যঞ্জনবর্ণ আছে সে শব্দ নিজের অকার বর্জন করে। “পাগল্’ শব্দের গ আপন অকার রক্ষা করে যেহেতু পরবর্তী ল-এ কোনো স্বর নাই। কিন্তু “পাগ্লা’ বা “পাগ্লী’ শব্দে গ অকার বর্জন করে। এইরূপ– আপন– আপ্নি, ঘটক– ঘট্কী, গরম– গর্মি ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, অনতিপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দে এ নিয়ম খাটে না, যেমন ঘোটক– ঘোটকী। এইপ্রকার হসন্ত সম্বন্ধে বাংলায় সাধারণ নিয়মের যখন প্রায় ব্যতিক্রম দেখা যায় না তখন আমরা এরূপ স্থলে বিশেষভাবে হসন্তচিহ্ন দিব না– যেমন “করেন্’ না লিখিয়া “করেন’ লিখিব, “কোর্চেন’ না লিখিয়া “কোরচেন’ লিখিব।
আমি কোরি তুই কোরিস আমি কোরচি তুই কোরচিস তুমি করো সে করে তুমি কোরচ সে কোরচে আপনি করেন তিনি করেন আপনি কোরচেন তিনি কোরচেন আমি কোরলুম (কোরলেম) তুই কোরলি তুমি কোরলে সে কোরল (করেছিলেম) আপনি কোরলেন তিনি কোরলেন আমি কোরেচি তুই কোরেচিস আমি কোরেছিলুম (কোরেছিলেম) তুমি কোরেচ সে কোরেচে তুমি কোরেছিলে আপনি কোরেচেন তিনি কোরেচেন আপনি কোরেছিলেন আমি কোরছিলুম (কোরছিলেম) তুই কোরছিলি তুমি কোরেছিলে সে কোরেছিল আপনি কোরছিলেন তিনি কোরেছিলেন আমি কোরতুম (কোরতেম) তুই কোরতিস তুমি কোরতে সে কোরত আপনি কোরতেন তিনি কোরতেন করা যাক্ তুমি করো তুই কর তিনি কোরুন করা হোক্ আপনি করুন সে করুক আমি কোরব তুই কোরবি তুমি কোরবে সে কোরবে আপনি কোরবেন তিনি কোরবেন
করা হয়, করা যায়, কোরে থাকে, কোরতে থাকে, করা চাই, কোরতে হবে, কোরলোই বা (কোরলেই বা), নাই কোরলো (নাই কোরলে), কোরলেও হয়, কোরলেই হয়, কোরলেই হোলো, করানো, কোরে কোরে, কোরতে কোরতে।
হোয়ে পড়া, হোয়ে ওঠা, হোয়ে যাওয়া, কোরে ফেলা, কোরে ওঠা, কোরে তোলা, কোরে বসা, কোরে দেওয়া, কোরে নেওয়া, কোরে যাওয়া, করানো।
কেঁদে ওঠা, হেসে ওঠা, বোলে ওঠা, চেঁচিয়ে ওঠা, আঁৎকে ওঠা, ফস্কে যাওয়া, এড়িয়ে যাওয়া, চম্কে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, সেরে যাওয়া, সোরে যাওয়া, মোরে যাওয়া।
বাংলা নির্দেশক
আমরা বাংলা ভাষার নির্দেশক চিহ্ন “টি’ ও “টা’ সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচনা করিয়াছি। এই শ্রেণীর সংকেত আরো কয়েকটি আছে।
খানি ও খানা
বাংলা ভাষায় “গোটা’ শব্দের দ্বারা অখণ্ডতা বুঝায়। এই কারণে, এই “গোটা’ শব্দেরই অপভ্রংশ “টা’ চিহ্ন পদার্থের সমগ্রতা সূচনা করে। হরিণটা, টেবিলটা, মাঠটা, শব্দে একটা সমগ্র পদার্থ বুঝাইতেছে।
বাংলা ভাষার অপর একটি একত্ব নির্দেশক চিহ্ন খানা, খানি। “খণ্ড’ শব্দ হইতে উহার উৎপত্তি। এখনো বাংলায় “খান্ খান্’ শব্দের দ্বারা খণ্ড খণ্ড বুঝায়।
ইহা হইতে মনে হইতে পারে যে, এক-একটি সমগ্র বস্তুকে বুঝাইতে “টা’ চিহ্নের প্রয়োগ এবং এক-একটি খণ্ডকে বুঝাইতে “খানা’ চিহ্নের প্রয়োগ হইয়া থাকে।
গোড়ায় কী ছিল বলিতে পারি না, এখন কিন্তু এরূপ দেখা যায় না। আমরা বলি কাগজখানা, শ্লেটখানা। এই কাগজ ও শ্লেট সমগ্র পদার্থ হইলেও আসে যায় না।
কিন্তু দেখা যাইতেছে যে-সকল সামগ্রী দীর্ঘ প্রস্থ বেধে সম্পূর্ণ, সাধারণত তাহাদের সম্বন্ধে “খানা’ ব্যবহার হয় না। যে জিনিসকে প্রস্থের প্রসারের দিক হইতেই দেখি, লম্বের বা বেধের দিক হইতে নয় প্রধানত তাহারই সম্বন্ধে “খানা’ ও “খানি’র যোগ। মাঠখানা, ক্ষেতখানা; কিন্তু পাহাড়খানা নদীখানা নয়। থালখানা, খাতাখানা; কিন্তু ঘটিখানা বাটিখানা নয়। লুচিখানা, কচুরিখানা; কিন্তু সন্দেশখানা মেঠাইখানা নয়। শালপাতাখানা, কলাপাতাখানা; কিন্তু আমখানা কাঁঠালখানা নয়।
এই যে নিয়মের উল্লেখ করা গেল ইহা সর্বত্র খাটে না। যে জিনিস পাতলা নহে তাহার সম্বন্ধেও “খানা’ ব্যবহার হইয়া থাকে। যেমন খাটখানা, চৌকিখানা, ঘরখানা, নৌকাখানা। ইহাও দেখা গিয়াছে, এই “খানা’ চিহ্নের ব্যবহার সম্বন্ধে সকলের অভ্যাস সমান নহে।
তবে “খানা’র প্রয়োগ সম্বন্ধে কয়েকটা সাধারণ নিয়ম বলা যায়। জীব সম্বন্ধে কোথাও ইহার ব্যবহার নাই; গোরুখানা ভেড়াখানা হয় না। দেহ ও দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্বন্ধে ইহার ব্যবহারে বাধা নাই। দেহখানা, হাতখানা, পাখানা। বুকখানা সাত হাত হয়ে উঠল; মায়ের কোলখানি ভরে আছে; মাংসখানা ঝুলে পড়েছে; ঠোঁটখানি রাঙা; ভুরুখানা বাঁকা।
অরূপ পদার্থ সম্বন্ধে ইহার ব্যবহার নাই। বাতাসখানা বলা চলে না; আলোখানাও সেইরূপ; কারণ, তাহার অবয়ব নাই। যত্নখানা, আদরখানা, ভয়খানা, রাগখানা হয় না। কিন্তু ব্যতিক্রম আছে; যথা, ভাবখানা, স্বভাবখানা, ধরনখানা, চলনখানি।
যে-সকল বস্তু অবয়ব গ্রহণ না করিয়া তরল বা বিচ্ছিন্নভাবে থাকে তাহাদের সম্বন্ধে “খানা’ বসে না। যেমন, বালিখানা, ধুলোখানা, মাটিখানা, দুধখানা, জলখানা, তেলখানা হয় না।
ধুলা কাদা তেল জল প্রভৃতি শব্দের সহিত “এক’ শব্দটিকে বিশেষণরূপে যোগ করা যায় না। যেমন, একটা ধুলা বা একটা জল বলি না। কিন্তু “অনেক’ শব্দটির সহিত এরূপ কোনো বাধা নেই। যেমন, অনেকটা জল বা অনেকখানি জল বলা চলে। বলা বাহুল্য এখানে “অনেক’ শব্দ দ্বারা সংখ্যা বুঝাইতেছে না– পরিমাণ বুঝাইতেছে।
এখানে বিশেষরূপে লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, এরূপ স্থলে আমরা “খানি’ ব্যবহার করি; “খানা’ ব্যবহার করি না। “অনেকখানি দুধ’ বলি, “অনেকখানা দুধ’ বলি না। এ স্থলে দেখা যাইতেছে, পরিমাণ ও সংখ্যা সম্বন্ধে “খানি’ ব্যবহার হয়, “খানা’ কেবলমাত্র সংখ্যা সম্বন্ধেই খাটে।
বাংলায় হাসিখানি শব্দ প্রচলিত আছে। কিন্তু ইহা আদরের ভাষা। আদর করিয়া হাসিকে যেন স্বতন্ত্র একটি বস্তুর মতো করিয়া দেখা যাইতেছে। মনে পড়িতেছে বৈষ্ণব সাহিত্যে এমন ভাবের কথা কোথায় দেখিয়াছি যে, “তাহার মুখের কথাখানির যদি লাগ পাইতাম’– এখানে আদর করিয়া মুখের কথাটিকে যেন মূর্তি দেওয়া হইতেছে। এইরূপ ভাবেই “স্পর্শখানি’ বলিয়া থাকি।
খানি ও খানা যেখানে বসে সেখানে ইচ্ছামত সর্বত্রই টি ও টা বসিতে পারে– কিন্তু টি ও টা-র স্থলে সর্বত্র খানি ও খানার অধিকার নাই।
গাছা ও গাছি
“খানি খানা’ যেমন মোটের উপরে চওড়া জিনিসের পক্ষে, “গাছা’ তেমনি সরু জিনিসের পক্ষে। যেমন, ছড়িগাছা, লাঠিগাছা, দড়িগাছা, সুতোগাছা, হারগাছা, মালাগাছা, চুড়িগাছা, মলগাছা, শিকলগাছা।
এই সংকেতের সঙ্গে যখন পুনশ্চ “টি’ ও “টা’ চিহ্ন যুক্ত হইয়া থাকে তখন “গাছি’ “গাছা’ শব্দের অন্তস্থিত ইকার আকার লুপ্ত হইয়া যায়। যথা, লাঠিগাছটা মালাগাছটা ইত্যাদি।
জীববাচক পদার্থ সম্বন্ধে ইহার ব্যবহার নাই। কেঁচোগাছি বলা চলে না।
সরু জিনিস লম্বায় ছোটো হইলে তাহার সম্বন্ধে ব্যবহার হয় না। দড়িগাছা, কিন্তু গোঁফগাছা নয়। শলাগাছটা, কিন্তু ছুঁচগাছটা নয়। চুলগাছি যখন বলা হয় তখন লম্বাচুলই বুঝায়।
যেখানে গাছি ও গাছা বসে সেখানে সর্বত্রই বিকল্পে টি ও টা বসিতে পারে– এবং কোনো কোনো স্থলে খানি ও খানা বসিতে পারে।
টুকু
টুকু শব্দ সংস্কৃত তনুক শব্দ হইতে উৎপন্ন। মৈথিলি সাহিত্যে তনুক শব্দ দেখিয়াছি। “তনিক’ এখনো হিন্দিতে ব্যবহৃত হয়। ইহার সগোত্র “টুক্রা’ শব্দ বাংলায় প্রচলিত আছে।
টুকু স্বল্পতাবাচক।
সজীব পদার্থ সম্বন্ধে ইহার ব্যবহার নাই। ভেড়াটুকু গাধাটুকু হয় না। পরিহাসচ্ছলে মানুষটুকু বলা চলে।
ক্ষুদ্রায়তন হইলেও এমন পদার্থ সম্বন্ধে ব্যবহৃত হয় না যাহার বিশেষ গঠন আছে। যেমন ইয়ারিংটুকু বলা যায় না, সোনাটুকু বলা যায়। পদ্মটুকু বলা যায় না– চুনটুকু বলা যায়। পাগড়িটুকু বলা যায় না, রেশমটুকু বলা যায়। অর্থাৎ যাহাকে টুকরা করিলে তাহার বিশেষত্ব যায় না তাহার সম্বন্ধেই “টুকু’ ব্যবহার করা চলে। কাগজকে টুকরা করিলেও তাহা কাগজ, কাপড়কে টুকরা করিলেও তাহা কাপড়, এক পুকুর জলও জল, এক ফোঁটা জলও জল, এইজন্য কাগজটুকু কাপড়টুকু জলটুকু বলা যায় কিন্তু চৌকিটুকু খাটটুকু বলা যায় না।
কিন্তু, এই ঐ সেই কত এত তত যত সর্বনামপদের সহিত যুক্ত করিয়া তাহাকে ক্ষুদ্রার্থক সকল বিশেষ্যপদের বিশেষণ রূপে ব্যবহার করা যায়। যেমন, এইটুকু মানুষ ঐটুকু বাড়ি, ঐটুকু পাহাড়।
অরূপ পদার্থবাচক বিশেষ্যপদে ইহার ব্যবহার চলে। যেমন, হাওয়াটুকু, কৌশলটুকু, ভারটুকু, সন্ন্যাসী ঠাকুরের রাগটুকু।
অন্যান্য নির্দেশক চিহ্নের ন্যায় “এক’ বিশেষণ শব্দের সহিত যুক্ত হইয়া ইহা ব্যবহৃত হয়– কিন্তু দুই তিন প্রভৃতি অন্য সংখ্যার সহিত ইহার যোগ নাই। দুইটা, দুইখানি, দুইগাছি হয় কিন্তু দুইটুকু তিনটুকু হয় না। “এক’ শব্দের সহিত যোগ হইলে টুকু বিকল্পে টু হয়, যথা একটু। অন্যত্র কোথাও এরূপ হয় না। এই “একটু’ শব্দের সহিত “খানি’ যোজনা করা যায়– যথা, একটুখানি বা একটুক্খানি। এখানে “খানা’ চলে না। অন্যত্র, যেখানে টুকু বসিতে পারে সেখানে কোথাও বিকল্পে খানি খানা বসিতে পারে না, কিন্তু টি টা সর্বত্রই বসে।
আশ্বিন, ১৩১৮
বাংলা বহুবচন
পূর্বে বলা হইয়াছে “গোটা’ শব্দের অর্থ সমগ্র। বাংলায় যেখানে বলে “একটা’, উড়িয়া ভাষায় সেখানে বলে গোটা। এবং এই গোটা শব্দের টা অংশই বাংলা বিশেষ বিশেষ্যে ব্যবহৃত হয়।
পূর্ববঙ্গে ইহার প্রথম অংশটুকু ব্যবহৃত হয়। পশ্চিমবঙ্গে “চৌকিটা’, পূর্ববঙ্গে “চৌকি গুয়া’।
ভাষায় অন্যত্র ইহার নজির আছে। একদা “কর’ শব্দ সম্বন্ধকারকের চিহ্ন ছিল– যথা, তোমাকর, তাকর। এখন পশ্চিমভারতে ইহার “ক’ অংশ ও পূর্বভারতে “র’ অংশ সম্বন্ধ চিহ্নরূপে ব্যবহৃত হইতেছে। হিন্দি হম্কা, বাংলা আমার।
একবচনে যেমন গোটা, বহুবচনে তেমনি গুলা। (মানুষগোটা), মানুষটা একবচন, মানুষগুলা বহুবচন। উড়িয়া ভাষায় এইরূপ বহুবচনার্থে “গুড়িয়ে’ শব্দের ব্যবহার আছে।
এই “গোটা’রই বহুবচনরূপ গুলা, তাহার প্রমাণ এই যে, “টা’ সংযোগে যেমন বিশেষ্য শব্দ তাহার সামান্য অর্থ পরিত্যাগ করিয়া তাহার বিশেষ অর্থ গ্রহণ করে– গুলা ও গুলির দ্বারাও সেইরূপ ঘটে। যেমন, “টেবিলগুলা বাঁকা’– অর্থাৎ বিশেষ কয়েকটি টেবিল বাঁকা, সামান্যত টেবিল বাঁকা নহে। কাক সাদা বলা চলে না, কিন্তু কাকগুলো সাদা বলা চলে, কারণ, বিশেষ কয়েকটা কাক সাদা হওয়া অসম্ভব নহে।
এই “গুলা’ শব্দযোগে বহুবচনরূপ নিষ্পন্ন করাই বাংলার সাধারণ নিয়ম। বিশেষ স্থলে বিকল্পে শব্দের সহিত “রা’ ও “এরা’ যোগ হয়। যেমন, মানুষেরা, কেরানীরা ইত্যাদি।
এই “রা’ ও “এরা’ জীববাচক বিশেষ্যপদ ছাড়া অন্যত্র ব্যবহৃত হয় না।
হলন্ত শব্দের সঙ্গে “এরা’ এবং অন্য স্বরান্ত শব্দের সঙ্গে “রা’ যুক্ত হয়। যেমন বালকেরা, বধূরা। বালকগুলি, বধূগুলি ইত্যাদিও হয়।
কথিতভাষায় এই “এরা’ চিহ্নের “এ’ প্রায়ই লুপ্ত হইয়া থাকে– আমরা বলি বালকরা, ছাত্ররা ইত্যাদি।
ব্যক্তিবাচক বিশেষ্যপদেরও বহুবচনরূপ হইয়া থাকে। যথা, রামেরা– অর্থাৎ রাম ও আনুষঙ্গিক অন্য সকলে। এরূপ স্থলে কদাপি গুলা গুলির প্রয়োগ হয় না। কারণ রামগুলি বলিলে প্রত্যেকটিরই রাম হওয়া আবশ্যক হয়।
ইহা হইতে বুঝা যাইতেছে এই “এরা’ সম্বন্ধকারকরূপ হইতে উৎপন্ন। অর্থাৎ রামের সহিত সম্বন্ধযুক্ত যাহারা তাহারাই “রামেরা’। যেমন তির্যকরূপে “জন’ শব্দকে জোর দিয়া হইয়াছে “জনা’, সেইরূপ “রামের’ শব্দকে জোর দিয়া হইয়াছে রামেরা।
“সব’, “সকল’ ও “সমুদয়’ শব্দ বিশেষ্য শব্দের পূর্বে বিশেষণরূপে প্রযুক্ত হইয়া বহুত্ব অর্থ প্রকাশ করে। কিন্তু বস্তুত এই বিশেষণগুলি সমষ্টিবাচক। “সব লোক’ এবং “লোকগুলি’-র মধ্যে অর্থভেদ আছে। “সব লোক’ ইংরেজিতে all menএবং লোকগুলি the men।
লিখিত বাংলায়, “সকল’ ও “সমুদয়’ শব্দ বিশেষ্যপদের পরে বসে। কিন্তু কথিত বাংলায় কখনোই তা হয় না। সকল গোরু বলি, গোরু সকল বলি না। বাংলা ভাষার প্রকৃতিবিরুদ্ধ এইরূপ প্রয়োগ সম্ভবত আধুনিককালে গদ্যরচনা সৃষ্টির সময়ে প্রবর্তিত হইয়াছে। লিখিত ভাষায় “সকল’ যখন কোনো শব্দের পরে বসে তখন তাহা তাহার মূল অর্থ ত্যাগ করিয়া শব্দটিকে বহুবচনের ভাব দান করে। লোকগুলি এবং লোকসকল একই অর্থে ব্যবহৃত হইতে পারে।
প্রাচীন লিখিত ভাষায় “সব’ শব্দ বিশেষ্যপদের পরে যুক্ত হইত। এখন সে রীতি উঠিয়া গেছে, এখন কেবল পূর্বেই তাহার ব্যবহার আছে। কেবল বর্তমান কাব্যসাহিত্যে এখনো ইহার প্রয়োগ দেখা যায়– যথা, “পাখি সব করে রব’। বর্তমানে বিশেষ্যপদের পরে “সব’ শব্দ বসাইতে হইলে বিশেষ্য বহুবচন রূপ গ্রহণ করে। যথা, পাখিরা সব, ছেলেরা সব অথবা ছেলেরা সবাই। বলা বাহুল্য, জীববাচক শব্দ ব্যতীত অন্যত্র বহুবচনে এই “রা’ ও “এরা’ চিহ্ন বসে না। বানরগুলা সব, ঘোড়াগুলা সব, টেবিলগুলা সব, দোয়াতগুলা সব– এইরূপ গুলাযোগে, সচেতন অচেতন সকল পদার্থ সম্বন্ধেই “সব’ শব্দ ব্যবহৃত হইতে পারে।
“অনেক’ বিশেষণ শব্দ যখন বিশেষ্যপদের পূর্বে বসে তখন স্বভাবতই তদ্দ্বারা বিশেষ্যের বহুত্ব বুঝায়। কিন্তু এই “অনেক’ বিশেষণের সংস্রবে বিশেষ্যপদ পুনশ্চ বহুবচন রূপ গ্রহণ করে না। ইংরেজিতে many বিশেষণ সত্ত্বেও man শব্দ বহুবচন রূপ গ্রহণ করিয়া লনশ হয় — সংস্কৃতে অনেকা লোকাঃ, কিন্তু বাংলায় অনেক লোকগুলি হয় না।
অথচ “সকল’ বিশেষণের যোগে বিশেষ্যপদ বিকল্পে বহুবচন রূপও গ্রহণ করে। আমরা বলিয়া থাকি, সকল সভ্যেরাই এসেছেন– সকল সভ্যই এসেছেন এরূপও বলা যায়। কিন্তু অনেক সভ্যেরা এসেছেন কোনোমতেই বলা চলে না। “সব’ শব্দও “সকল’ শব্দের ন্যায়। “সব পালোয়ানরাই সমান’ এবং “সব’ পালোয়ানই সমান’ দুই চলে।
“বিস্তর’ শব্দ “অনেক’ শব্দের ন্যায়। অর্থাৎ এই বিশেষণ পূর্বে থাকিলে বিশেষ্যপদ আর বহুবচন রূপ গ্রহণ করে না– “বিস্তর লোকেরা’ বলা চলে না।
এইরূপ আর-একটি শব্দ আছে তাহা লিখিত বাংলায় প্রায়ই ব্যবহৃত হয় না– কিন্তু কথিত বাংলায় তাহারই ব্যবহার অধিক, সেটি “ঢের’। ইহার নিয়ম “বিস্তর’ ও “অনেক’ শব্দের ন্যায়ই। “গুচ্ছার’ শব্দও প্রাকৃত বাংলায় প্রচলিত। ইহা প্রায়ই বিরক্তি-প্রকাশক। যখন বলি গুচ্ছার লোক জমেছে তখন বুঝিতে হইবে সেই লোকসমাগম প্রীতিকর নহে। ইহা সম্ভবত গোটাচার শব্দ হইতে উদ্ভূত।
সংখ্যাবাচক বিশেষ্য পূর্বে যুক্ত হইলে বিশেষ্যপদ বহুবচন রূপ গ্রহণ করে না। যেমন, চার দিন, তিন জন, দুটো আম।
গণ, দল, সমূহ, বৃন্দ, বর্গ, কুল, চয়, মালা, শ্রেণী, পঙ্ক্তি প্রভৃতি শব্দযোগে বিশেষ্যপদ বহুত্ব অর্থ গ্রহণ করে। কিন্তু ইহা সংস্কৃত রীতি। এইজন্য অবিকৃত সংস্কৃত শব্দ ছাড়া অন্যত্র ইহার ব্যবহার নাই। বস্তুত ইহাদিগকে বহুবচনের চিহ্ন বলাই চলে না। কারণ ইহাদের সম্বন্ধেও বহুবচনের প্রয়োগ হইতে পারে– যেমন সৈন্যগণেরা, পদাতিক দলেরা ইত্যাদি। ইহারা সমষ্টিবোধক।
ইহাদের মধ্যে “গণ’ শব্দ প্রাকৃত বাংলার অন্তর্গত হইয়াছে। এইজন্যে “পদাতিকগণ’ এবং “পাইকগণ’ দুই বলা চলে। কিন্তু “লাঠিয়ালবৃন্দ’ কলুকুল’ বা “আটচালাচয়’ বলা চলে না।
গণ, মালা, শ্রেণী ও পঙ্ক্তি শব্দ সর্বত্র ব্যবহৃত হইতে পারে না। গণ ও দল কেবল প্রাণীবাচক শব্দের সহিতই চলে। কখনো কখনো রূপকভাবে মেঘদল তরঙ্গদল বৃক্ষদল প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। মালা, শ্রেণী ও পঙ্ক্তি শব্দের অর্থ অনুসারেই তাহার ব্যবহার, এ কথা বলা বাহুল্য।
প্রাকৃত বাংলায় এইরূপ অর্থবোধক শব্দ ঝাঁক, গোচ্ছা, আঁটি, গ্রাস। কিন্তু এগুলি সমাস-রূপে শব্দের সহিত সংযুক্ত হয় না। আমরা বলি পাখির ঝাঁক, চাবির গোচ্ছা, ধানের আঁটি, ভাতের গ্রাস, অথবা দুই ঝাঁক পাখি, এক গোচ্ছা চাবি, চার আঁটি ধান, দুই গ্রাস ভাত।
“পত্র’ শব্দযোগে বাংলায় কতকগুলি শব্দ বহুত্ব অর্থ গ্রহণ করে। কিন্তু সেই বিশেষ কয়েকটি শব্দ ছাড়া অন্য শব্দের সহিত উহার ব্যবহার চলে না। গহনাপত্র, তৈজসপত্র, আসবাবপত্র, জিনিসপত্র, বিছানাপত্র, ঔষধপত্র, খরচপত্র, দেনাপত্র, চিঠিপত্র, খাতাপত্র, চোতাপত্র, হিসাবপত্র, নিকাশপত্র, দলিলপত্র, পুঁথিপত্র, বিষয়পত্র।
পরিমাণ-সম্বন্ধীয় বহুত্ব বোঝাইবার জন্য বাংলায় শব্দদ্বৈত ঘটিয়া থাকে; যেমন বস্তাবস্তা, ঝুড়িঝুড়ি, মুঠামুঠা, বাক্সবাক্স, কলসিকলসি, বাটিবাটি। এগুলি কেবলমাত্র আধারবাচক শব্দ সম্বন্ধেই খাটে; মাপ বা ওজন সম্বন্ধে খাটে না– গজ-গজ বা সের-সের বলা চলে না।
সময় সম্বন্ধেও বহুত্ব অর্থে শব্দদ্বৈত ঘটে– বার বার, দিন দিন, মাস মাস, ঘড়ি ঘড়ি। বহুত্ব বুঝাইবার জন্য সমার্থক দুই শব্দের যুগ্মতা ব্যবহৃত হয়, যেমন; লোকজন, কাজকর্ম, ছেলেপুলে, পাখিপাখালী জন্তুজানোয়ার, কাঙালগরিব, রাজারাজড়া, বাজনাবাদ্য। এই-সকল যুগ্ম শব্দের দুই অংশের এক অর্থ নহে কাছাকাছি অর্থ এমন দৃষ্টান্তও আছে; দোকানহাট, শাকসবজি, বনজঙ্গল, মুটেমজুর, হাঁড়িকুঁড়ি। এরূপ স্থলে বহুত্বের সঙ্গে কতকটা বৈচিত্র্য বুঝায়। যুগ্ম শব্দের একাংশের কোনো অর্থ নাই এমনও আছে। যেমন, কাপড়চোপড়, বাসনকোসন, চাকরবাকর। এ স্থলেও কতকটা বৈচিত্র্য অর্থ দেখা যায়।
কথিত বাংলায় “ট’ অক্ষরের সাহায্যে একপ্রকার বিকৃত শব্দদ্বৈত আছে। যেমন, জিনিসটিনিস, ঘোড়াটোড়া। ইহাতে প্রভৃতি শব্দের ভাবটা বুঝায়।
কার্তিক, ১৩১৮
বাংলা বানান
আমাদের এই যে দেশকে মুসলমানেরা বাঙ্গালা বলিতেন তাহার নামটি বর্তমানে আমরা কিরূপ বানান করিয়া লিখিব শ্রীযুক্ত বীরেশ্বর সেন মহাশয় [১৩২২] চৈত্রের প্রবাসীতে তার আলোচনা করিয়াছেন।
আমি মনে করি এর জবাবদিহি আমার। কেননা, আমিই প্রথমে বাংলা এই বানান ব্যবহার করিয়াছিলাম।
আমার কোনো কোনো পদ্যরচনার যুক্ত অক্ষরকে যখন দুই মাত্রা হিসাবে গণনা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম তখনই প্রথম বানান সম্বন্ধে আমাকে সতর্ক হইতে হইয়াছিল। “ঙ্গ’ অক্ষরটি যুক্ত অক্ষর– উহার পুরা আওয়াজটি আদায় করিতে হইলে এক মাত্রা ছড়াইয়া যায়। সেটা আমার ছন্দের পক্ষে যদি আবশ্যক হয় তো ভালোই, যদি না হয় তবে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।
এক-একটি অক্ষর প্রধানত এক-একটি আওয়াজের পরিচয়, শব্দতত্ত্বের নহে। সেটা বিশেষ করিয়া অনুভব করা যায় ছন্দরচনায়। শব্দতত্ত্ব অনুসারে লিখিব এক, আর ব্যবহার অনুসারে উচ্চারণ করিব আর, এটা ছন্দ পড়িবার পক্ষে বড়ো অসুবিধা। যেখানে যুক্ত অক্ষরেই ছন্দের আকাঙক্ষা সেখানে যুক্ত অক্ষর লিখিলে পড়িবার সময় পাঠকের কোনো সংশয় থাকে না। যদি লেখা যায়–
বাঙ্গলা দেশে জন্মেছ বলে
বাঙ্গালী নহ তুমি;
সন্তান হইতে সাধনা করিলে
লভিবে জন্মভূমি–
তবে অমি পাঠকের নিকট “ঙ্গ’ যুক্ত-অক্ষরের পুরা আওয়াজ দাবি করিব। অর্থাৎ এখানে মাত্রাগণনায় বাঙ্গলা শব্দ হইতে চার মাত্রার হিসাব চাই। কিন্তু যখন লিখিব, “বাংলার মাটি বাংলার জল’ তখন উক্ত বানানের দ্বারা কবির এই প্রার্থনা প্রকাশ পায় যে “বাংলা’ শব্দের উপর পাঠক যেন তিন মাত্রার অতিরিক্ত নিশ্বাস খরচ না করেন। “বাঙ্গলার মাটি’ যথারীতি পড়িলে এইখানে ছন্দ মাটি হয়।
ঝিঙা না ভাজিয়া ভাজিলে ঝিঙ্গা
ছন্দ তখনি ফুঁকিবে শিঙ্গা।
এই গেল ছন্দব্যবসায়ী কবির কৈফিয়ত।
কিন্তু শুধু কেবল কাব্যক্ষেত্রে ডিক্রি পাইয়াই আমি সন্তুষ্ট থাকিব না, আমার আরো কিছু বলিবার আছে। বীরেশ্বরবাবুর মতে মূল শব্দের সহিত তদ্ভব শব্দের বানানের সাদৃশ্য থাকা উচিত। যদি তাঁর কথা মানিতে হয় তবে বাংলার বানান-মহালে হুলস্থূল পড়িয়া যায়। এই আইন অনুসারে কিরূপ পরিবর্তন হয় তার গোটাকতক নমুনা দেখা যাক। “শাঁখ– শাঙ্খ্। আঁক– আঙ্ক্। চাঁদ– চাঁন্দ্। রাখ– রাক্ষ। আমি– আহ্মি।
হয়তো বীরেশ্বরবাবু বলিলেন, হাঁ এইরূপ হওয়াই উচিত। তাঁর পক্ষে ভালো নজিরও আছে। ইংরেজিতে বানানে-উচ্চারণে ভাসুর-ভাদ্রবৌ সম্পর্ক, পরস্পরের মাঝখানে প্রাচীন শব্দতত্ত্বের লম্বা ঘোমটা। ইংরেজিতে লিখি ট্রেআসূরে (treasure) পড়ি ট্রেজার; লিখি ক্নৌলেডগে (knowledge) পড়ি নলেজ্; লিখি রিঘ্টেওউস (righteous) পড়ি রাইটিয়স। অতএব যদি লিখি পক্ষী অথচ পড়ি পাখী, লিখি বিদ্যুলি পড়ি বিজুলি, লিখি শ্রবণিয়াছিলাম পড়ি শুনিয়াছিলাম, বিলাতিমতে তাহাতে দোষ হয় না।
কিন্তু আমাদের দেশের নজির উল্টা। প্রাকৃত ও পালি, বানানের দ্বারা নির্ভয়ে নিজের শব্দেরই পরিচয় দিয়াছে, পূর্বপুরুষের শব্দতত্ত্বের নহে। কেননা, বানানটা ব্যবহারের জিনিস, শব্দতত্ত্বের নয়। পুরাতত্ত্বের বোঝা মিউজিয়ম বহন করিতে পারে, হাটে বাজারে তাহাকে যথাসাধ্য বর্জন করিতে হয়। এইজন্যই লিখিবার বেলায় আমরা “নুন’ লিখি, পণ্ডিতই জানেন উহার মূল শব্দে একটা মূর্ধন্য ণ ছিল। এইজন্যই লিখিবার বেলা গাম্ভ্লা না লিখিয়া আমরা গাম্লা লিখি, পণ্ডিতই অনুমান করেন উহার মূল শব্দ ছিল কুম্ভ। আমরা লিখিয়া থাকি আঁতুর ঘর, তাহাতে আমাদের কাজের কোনো ক্ষতি হয় না– পাণ্ডিত্যের দোহাই মানিয়া যদি অন্ত্র-ত্রুট্ ঘর বানান করিয়া আঁতুর ঘর পড়িতে হইত তবে যে-শব্দ প্রাচীনের গর্ভ হইতে বাহির হইয়াছে তাহাকে পুনশ্চ গর্ভবেদনা সহিতে হইত।
প্রাচীন বাঙালি, বানান সম্বন্ধে নির্ভীক ছিলেন, পুরানো বাংলা পুঁথি দেখিলেই তাহা বুঝা যায়। আমরা হঠাৎ ভাষার উপর পুরাতত্ত্বের শাসন চালাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছি। এই শাসন ম্যালেরিয়া প্রভৃতি অন্যান্য নানা উপসর্গের মতো চিরদিনের মতো বাঙালির ছেলের আয়ুক্ষয় করিতে থাকিবে। কোনো অভ্যাসকে একবার পুরানো হইতে দিলেই তাহা স্বভাবের চেয়েও প্রবল হইয়া ওঠে। অতএব এখনো সময় থাকিতে সাবধান হওয়া উচিত। সংস্কৃত শব্দ বাংলায় অনেক আছে, এবং চিরদিন থাকিবেই– সেখানে সংস্কৃতের রূপ ও প্রকৃতি আমাদের মানিতেই হইবে– কিন্তু যেখানে বাংলা শব্দ বাংলাই সেখানেও সংস্কৃতের শাসন যদি টানিয়া আনি, তবে রাস্তায় যে পুলিস আছে ঘরের ব্যবস্থার জন্যও তাহার গুঁতা ডাকিয়া আনার মতো হয়। সংস্কৃতে কর্ণ লিখিবার বেলা মূর্ধন্য ণ ব্যবহার করিতে আমরা বাধ্য, কিন্তু কান লিখিবার বেলাও যদি সংস্কৃত অভিধানের কানমলা খাইতে হয় তবে এ পীড়ন সহিবে কেন?
যে সময়ে ফোর্ট উইলিয়াম হইতে বাংলা দেশ শাসন শুরু হইয়াছিল সেই সময়ে বাংলা ভাষার শাসন সেই কেল্লা হইতেই আরম্ভ হয়। তখন পণ্ডিতে-ফৌজে মিলিয়া বাংলার বানান বাঁধিয়া দিয়াছিল। আমাদের ভাষায় সেই ফোর্ট উইলিয়ামের বিভীষিকা এখনো তাই গৌড়সন্তানের চোখের জলকে অক্ষয় করিয়া রাখিয়াছে। সেইজন্য যেখানে আমাদের পিতামহেরা “সোনা’ লিখিয়া সুখী ছিলেন সেখানে আমরা সোণা লেখাইবার জন্য বেত ধরিয়া বসিয়া আছি।
কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামের বর্তমান দণ্ডধারীদের জিজ্ঞাসা করি– সংস্কৃত নিয়মমতেও কি সোণা কাণ বিশুদ্ধ বানান? বর্ণন হইতে যদি বানান হয়, তবে কর্ণ হইতে কি কাণ হইবে? রেফ লোপ হইলেও কি মূর্ধন্য ণ তার সঙিন খাড়া করিয়া থাকিতে পারে?
বৈশাখ, ১৩২৩
বাংলা বানান : ২
বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃক বাংলা বানানের যে নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে তার একটা অংশ সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার আছে– এইখানে সেটা উত্থাপিত করি। যথোচিত আলোচনা দ্বারা তার চরম মীমাংসা প্রার্থনীয়।
হ-ধাতু খা-ধাতু দি-ধাতু ও শু-ধাতুর অনুজ্ঞায় তাঁরা নিম্নলিখিত ধাতুরূপের নির্দেশ করেছেন– হও, হয়ো। খাও, খেও। দাও, দিও। শোও, শুয়ো।
দেখা যাচ্ছে, কেবলমাত্র আকারযুক্ত খা- এবং ইকারযুক্ত দি- ধাতুতে ভবিষ্যৎবাচক অনুজ্ঞায় তাঁরা প্রচলিত খেয়ো এবং দিয়ো বানানের পরিবর্তে খেও এবং দিও বানান আদেশ করেছেন। অথচ হয়ো এবং শুয়ো-র বেলায় তাঁদের অন্যমত।
একদা হয় খায় প্রভৃতি ক্রিয়াপদের বানান ছিল হএ, খাএ। “করে’ “চলে’ যে নিয়মে একারান্ত সেই নিয়মে হয় খায়ও একারান্ত হবার কথা– পূর্বে তাই ছিল। তখন খা, গা, চা, দি, ধা প্রভৃতি একাক্ষরের ধাতুপদের পরে য়-র প্রচলন ছিল না। তদনুসারে ভবিষ্যৎবাচক অনুজ্ঞায় য়-বিযুক্ত “ও’ ব্যবহৃত হত।
এ নিয়মের পরিবর্তন হবার উচ্চারণগত কারণ আছে। বাংলায় স্বরবর্ণের উচ্চারণ সাধারণত হ্রস্ব, যথা খাএ, খাও। কিন্তু অসমাপিকায় যখন বলি খেএ (খেয়ে) বা ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় যখন বলি খেও (খেয়ো) তখন এই স্বরবর্ণের উচ্চারণ কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হয়। খাও এবং খেও শব্দে ওকারের উচ্চারণে প্রভেদ আছে। সন্দেহ নেই এ-সকল স্থলে শব্দের অন্তস্বর আপন দীর্ঘত্ব রক্ষার জন্য য়-কে আশ্রয় করে।
একদা করিয়া খাইয়া শব্দের বানান ছিল, করিআ, খাইআ। কিন্তু পূর্ব স্বরের অনুবর্তী দীর্ঘ স্বর য়-যোজকের অপেক্ষা রাখে। তাই স্বভাবতই আধুনিক বানান উচ্চারণের অনুসরণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শুয়ো হয়ো শব্দে এ কথা স্বীকার করেছেন, অন্যত্র করেন নি। আমার বিশ্বাস এ নিয়মের ব্যতিক্রম নেই।
আমরা যাকে সাধু ভাষা বলে থাকি বিশ্ববিদ্যালয় বোধ করি তার প্রচলিত বানানের রীতিতে অত্যন্ত বেশি হস্তক্ষেপ করতে ইচ্ছুক নন। নতুবা খাইয়া যাইয়া প্রভৃতি শব্দেও তাঁরা প্রাচীন বিধি অনুসারে পরিবর্তন আদেশ করতেন। আমার বক্তব্য এই যে, যে-কারণে সাধুভাষায় করিয়া হইয়া বলিয়ো খাইয়ো চাহিয়ো বানান স্বীকৃত হয়েছে সেই কারণ চলিত ভাষাতেও আছে। দিয়েছে শব্দে তাঁরা যদি “এ’ স্বরের বাহনরূপে য়-কে স্বীকার করেন তবে দিয়ো শব্দে কেন য়-কে উপেক্ষা করবেন? কেবলমাত্র দি- এবং খা- ধাতুর য় অপহরণ আমার মতে তাদের প্রতি অবিচার করা।
কার্তিক, ১৩৪৩
বাংলা বানান : ৩
ধ্বনিসংগত বানান এক আছে সংস্কৃত ভাষায় এবং প্রাচীন প্রাকৃত ভাষায়। আর কোনো ভাষায় আছে কিংবা ছিল কি না জানি নে। ইংরেজি ভাষায় যে নেই অনেক দুঃখে তার আমরা পরিচয় পেয়েছি। আজও তার এলেকায় ক্ষণে ক্ষণে কলম হুঁচট খেয়ে থমকে যায়। বাংলা ভাষা শব্দ সংগ্রহ করে সংস্কৃত ভাণ্ডার থেকে, কিন্তু ধ্বনিটা তার স্বকীয়। ধ্বনিবিকারেই অপভ্রংশের উৎপত্তি। বানানের জোরেই বাংলা আপন অপভ্রংশত্ব চাপা দিতে চায়। এই কারণে বাংলা ভাষার অধিকাংশ বানানই নিজের ধ্বনিবিদ্রোহী ভুল বানান। আভিজাত্যের ভান করে বানান আপন স্বধর্ম লঙ্ঘনের চেষ্টা করাতে শিক্ষার্থীদের পক্ষে সেটা পরম দুঃখকর হয়েছে। যে রাস্তা রেল-পাতা রাস্তা, তার উপর দিয়ে যাতায়াত করার সময় যদি বুক ফুলিয়ে জেদ করে বলি আমার গোরুর গাড়িটা রেলগাড়িই, তা হলে পথ-যাত্রাটা অচল না হতে পারে, কিন্তু সুবিধাজনক হয় না। শিশুদের পড়ানোয় যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা জানেন বাংলা পাঠশিক্ষার প্রবেশ-পথ কি রকম দুর্গম। এক যানের রাস্তায় আর-এক যানকে চালাবার দুশ্চেষ্টাবশত সেটা ঘটেছে। বাঙালি শিশুপালের দুঃখ নিবৃত্তি চিন্তায় অনেকবার কোনো-এক জন বানান-সংস্কারক কেমাল পাশার অভ্যুদয় কামনা করেছি। দূরে যাবারই বা দরকার কী, সেকালের প্রাকৃত ভাষার কাত্যায়নকে পেলেও চলে যেত।
একদা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা প্রাকৃতজনের বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞার চোখেই দেখেছিলেন। সেই অবজ্ঞার অপমান দুঃখ আজও দেশের লোকের মনের মধ্যে রয়ে গেছে। আমাদের সাহিত্যভাষার বানানে তার পরিচয় পাই। বাংলা ভাষাকে যে হরিজন পঙ্ক্তিতে বসানো চলে না তার প্রমাণ কেবল ভাষাতাত্ত্বিক কুলজির থেকেই আহরণ করা যথেষ্ট হয় নি। বর্ণপ্রলেপের যোগে সবর্ণত্ব প্রমাণ করে দেবার চেষ্টা ক্রমাগতই চলছে। ইংরেজ ও বাঙালি মূলত একই আর্যবংশোদ্ভব বলে যাঁরা যথেষ্ট সান্ত্বনা পান নি তাঁরা হ্যাটকোট প’রে যথাসম্ভব চাক্ষুষ বৈষম্য ঘোচাবার চেষ্টা করেছেন এমন উদাহরণ আমাদের দেশে দুর্লভ নয়। বাংলা সাহিত্যের বানানে সেই চাক্ষুষ ভেদ ঘোচাবার চেষ্টা যে প্রবল তার হাস্যকর দৃষ্টান্ত দেখা যায় সম্প্রতি কানপুর শব্দে মূর্ধন্য ণয়ের আরোপ থেকে। ভয় হচ্ছে কখন কানাইয়ের মাথায় মূর্ধন্য ণ সঙিনের খোঁচা মারে।
বাংলা ভাষা উচ্চারণকালে সংস্কৃতের সঙ্গে তার ধ্বনির ভেদ ঘোচানো অসম্ভব কিন্তু লেখবার সময় অক্ষরের মধ্যে চোখের ভেদ ঘোচানো সহজ। অর্থাৎ লিখব এক পড়ব আর, বাল্যকাল থেকে দণ্ডপ্রয়োগের জোরে এই কৃচ্ছ্রসাধন সাহিত্যিক সমাজপতিরা অনায়াসেই চালাতে পেরেছেন। সেকালে পণ্ডিতেরা সংস্কৃত জানতেন এই সংবাদটা ঘোষণা করবার জন্যে তাঁদের চিঠিপত্র প্রভৃতিতে বাংলা শব্দে বানানের বিপর্যয় ঘটানো আবশ্যক বোধ করেন নি। কেবল ষত্ব ণত্ব নয়, হ্রস্ব ও দীর্ঘ ইকার ব্যবহার সম্বন্ধেও তাঁরা মাতৃভাষার কৌলীন্য লক্ষণ সাবধানে বজায় রাখতেন না। আমরা বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের দাবি করে থাকি কৃত্রিম দলিলের জোরে। বাংলায় সংস্কৃত শব্দের উচ্চারণ-বিকার ঘটে নি এমন দৃষ্টান্ত অত্যন্ত দুর্লভ। “জল” বা “ফল’, “সৌন্দর্য’ বা “অরুগ্ণ’ যে তৎসম শব্দ সেটা কেবল অক্ষর সাজানো থেকেই চোখে ঠেকে, ওটা কিন্তু বাঙালির হ্যাটকোটপরা সাহেবিরই সমতুল্য।
উচ্চারণের বৈষম্য সত্ত্বেও শব্দের পুরাতত্ত্বঘটিত প্রমাণ রক্ষা করা বানানের একটি প্রধান উদ্দেশ্য এমন কথা অনেকে বলেন। আধুনিক ক্ষাত্রবংশীয়রা ক্ষাত্রধর্ম ত্যাগ করেছে তবু দেহাবরণে ক্ষাত্র-ইতিহাস রক্ষার জন্যে বর্ম প’রে বেড়ানো তাদের কর্তব্য এ উপদেশ নিশ্চয়ই পালনীয় নয়। দেহাবরণে বর্তমান ইতিহাসকে উপেক্ষা করে প্রাচীন ইতিহাসকেই বহন করতে চেষ্টা করার দ্বারা অনুপযোগিতাকে সর্বাঙ্গে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। কিন্তু এ-সকল তর্ক সংগত হোক অসংগত হোক কোনো কাজে লাগবে না। কৃত্রিম বানানা একবার চলে গেলে তার পরে আচারের দোহাই অলঙ্ঘনীয় হয়ে ওঠে। যাকে আমরা সাধু ভাষা বলে থাকি সেই ভাষার বানান একেবারে পাকা হয়ে গেছে। কেবল দন্ত্য-ন-য়ের স্থলে মূর্ধন্য ণ-য়ের প্রভাব একটা আকস্মিক ও আধুনিক সংক্রামকতারূপে দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সেটারও মীমাংসা করে দিয়েছেন, এখন থেকে কর্নওয়ালিসের কর্ণে মূর্ধন্য ণ-য়ের খোঁচা নিষিদ্ধ।
প্রাকৃত বাংলা আমাদের সাহিত্যে অল্প দিন হল অধিকার বিস্তার করতে আরম্ভ করেছে। তার বানান এখনো আছে কাঁচা। এখনি ঠিক করবার সময়, এর বানান উচ্চারণ-ঘেঁষা হবে, অথবা হবে সংস্কৃত অভিধান ঘেঁষা।
যেমনি হোক, কোনো কর্তৃপক্ষের দ্বারা একটা কোনো আদর্শ স্থির করে দেওয়া দরকার। তার পরে বিনা বিতর্কে সেটাকে গ্রহণ করে স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারবে। সম্প্রতি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সে কাজ করে দিয়েছেন– ব্যক্তিগত মতামতের আলোচনায় ব্যাপারটাকে অনিশ্চিত করে রাখা অনাবশ্যক।
বাংলা ক্রিয়াপদে য়-র যোগে স্বরবর্ণ প্রয়োগ প্রচলিত হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানবিধিসভা কোথাও বা য় রক্ষা করেছেন কোথাও বা করেন নি। সে স্থলে সর্বত্রই য়-রক্ষার আমি পক্ষপাতী এই কথা আমি জানিয়েছিলেম। আমার মতে এ ক্ষেত্রে বানানভেদের প্রয়োজন নেই বলেছি বটে, কিন্তু বিদ্রোহ করতে চাই নে। যেটা স্থির হয়েছে সেটাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছি তবু চিরাভ্যাসকে বর্জন করবার পূর্বে তার তরফের আবেদন জানাবার ঝোঁক সামলাতে পারি নি। এইবার কথাটাকে শেষ করে দেব।
ই-কারের পরে যখন কোনো স্বরবর্ণের আগম হয়, তখন উভয়ে মিলে য় ধ্বনির উদ্ভব হয় এটা জানা কথা। সেই নিয়ম অনুসারে একদা খায়্যা পায়্যা প্রভৃতি বানান প্রচলিত হয়েছিল এবং সেই কারণেই কেতাবী সাধু-বাংলায় হইয়া করিয়া প্রভৃতি বানানের উৎপত্তি। ওটা অনবধানবশত হয় নি এইটে আমার বক্তব্য।
হয় ক্রিয়াপদে হঅ বানান চলে নি। এখানে হয়-এর “য়’ একটি লুপ্ত এ-কার বহন করছে। ব্যাকরণ-বিধি অনুসারে হএ বানান চলতে পারত। চলে নি যে, তার কারণ বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম অনুসারে শব্দের শেষবর্ণ যদি স্বরবর্ণ হয় তবে দীর্ঘস্বর হলেও তার উচ্চারণ হ্রস্ব হয়। হ্রস্ব এ এবং য়-র উচ্চারণে ভেদ নেই। এই অন্ত্য এ স্বরবর্গের উচ্চারণকে যদি দীর্ঘ করতে হত তা হলে য় যোগ করা অনিবার্য হত। তা হলে লিখতে হত হয়ে, হএ লিখে হয়ে উচ্চারণ চলে না।
তেমনি খাও শব্দের ও হ্রস্বস্বর, কিন্তু খেও শব্দের ও হ্রস্ব নয়– সেইজন্যে দীর্ঘ ওকারের আশ্রয় স্বরূপে য়-র প্রয়োজন হয়।
কিন্তু এ তর্কও অবান্তর। আসল কথাটা এই যে, ই-কারের পরবর্তী স্বরবর্ণের যোগে য়-র উদ্ভব স্বরসন্ধির নিয়মানুযায়ী। বেআইন বেআড়া বেআক্কেল বানান সুসংগত কারণ এ-কারের সঙ্গে অন্য স্বরবর্ণের মিলনে ঘটক দরকার করে না। বানান অনুসারে খেও এবং খেয়ো উচ্চারণের ভেদ নেই এ কথা মানা শক্ত। এখানে মনে রাখা দরকার খেয়ো (খাইয়ো) শব্দের মাঝখানে একটা লুপ্ত ই-কার আছে। কিন্তু উচ্চারণে তার প্রভাব লুপ্ত হয় নি। লুপ্ত ই-কার অন্যত্রও উচ্চারণ-মহলে আপন প্রভাব রক্ষা করে থাকে সে কথার আলোচনা আমার বাংলা শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে পূর্বেই করেছি।
পৌষ, ১৩৪৩
বাংলা ব্যাকরণে তির্যক্রূপ
মারাঠি হিন্দি প্রভৃতি অধিকাংশ গৌড়ীয় ভাষায় শব্দকে আড় করিয়া বলিবার একটা প্রথা আছে। যেমন হিন্দিতে “কুত্তা’ সহজরূপ, “কুত্তে’ বিকৃতরূপ। “ঘোড়া’ সহজরূপ, “ঘোড়ে’ বিকৃতরূপ। মারাঠিতে ঘর ও ঘরা, বাপ ও বাপা, জিভ ও জিভে ইহার দৃষ্টান্ত।
এই বিকৃতরূপকে ইংরেজি পারিভাষিকে oblique form বলা হয়; আমরা তাহাকে তির্যক্রূপ নাম দিব।
অন্যান্য গৌড়ীয় ভাষার ন্যায় বাংলা ভাষাতেও তির্যক্রূপের দৃষ্টান্ত আছে।
যেমন বাপা, ভায়া (ভাইয়া), চাঁদা, লেজা, ছাগলা, পাগলা, গোরা, কালা, আমা, তোমা, কাগাবগা (কাকবক), বাদলা বামনা, কোণা ইত্যাদি।
সম্ভবত প্রাচীন বাংলায় এই তির্যক্রূপের প্রচলন অধিক ছিল। তাহা নিম্নে উদ্ধৃত প্রাচীন বাক্য হইতে বুঝা যাইবে।
“নরা গজা বিশে শয়।’
“গণ’ শব্দের তির্যক্রূপ “গণা’ কেবলমাত্র “গণাগুষ্ঠি’ শব্দেই টিঁকিয়া আছে! “মুড়া’ শব্দের সহজরূপ “মুড়’ “মাথা-মোড় খোঁড়া’ “ঘাড়-মুড় ভাঙা’ ইত্যাদি শব্দেই বর্তমান। যেখানে আমরা বলি “গড়গড়া ঘুমচ্চে’ সেখানে এই “গড়া’ শব্দকে “গড়’ শব্দের তির্যক্রূপ বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। “গড় হইয়া প্রণাম করা’ ও “গড়ানো’ ক্রিয়াপদে “গড়’ শব্দের পরিচয় পাই। “দেব’ শব্দের তির্যক্রূপ “দেবা’ ও “দেয়া’। মেঘ ডাকা ও ভূতে পাওয়া সম্বন্ধে “দেয়া’ শব্দের ব্যবহার আছে। “যেমন দেবা তেম্নি দেবী’ বাক্যে “দেবা’ শব্দের পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলায় কাব্যভাষায় “সব’ শব্দের তির্যক্রূপ “সবা’ এখনো ব্যবহৃত হয়। যেমন আমাসবা, তোমাসবা, সবারে, সবাই। কাব্য-ভাষায় “জন’ শব্দের তির্যকরূপ “জনা’। সংখ্যাবাচক বিশেষণের সঙ্গে “জন’ শব্দের যোগ হইলে চলিত ভাষায় তাহা অনেক স্থলেই “জনা’ হয়। একজনা, দুইজনা ইত্যাদি। “জনাজনা’ শব্দের অর্থ প্রত্যেক জন। আমরা বলিয়া থাকি “একো জনা একো রকম’।
তির্যক্রূপে সহজরূপ হইতে অর্থের কিঞ্চিৎ ভিন্নতা ঘটে এরূপ দৃষ্টান্তও আছে। “হাত’ শব্দকে নির্জীব পদার্থ সম্বন্ধে ব্যবহার কালে তাহাকে তির্যক্ করিয়া লওয়া হইয়াছে, যেমন জামার হাতা, অথবা পাকশালার উপকরণ হাতা। “পা’ শব্দের সম্বন্ধেও সেইরূপ “চৌকির পায়া’। “পায়া ভারি’ প্রভৃতি বিদ্রূপসূচক বাক্যে মানুষের সম্বন্ধে “পায়া’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। সজীব প্রাণী সম্বন্ধে যাহা খুর, খাট প্রভৃতি সম্বন্ধে তাহাই খুরা। কান শব্দ কলস প্রভৃতির সংস্রবে প্রয়োগ করিবার বেলা “কানা’ হইয়াছে। “কাঁধা’ শব্দও সেইরূপ।
খাঁটি বাংলা ভাষার বিশেষণপদগুলি প্রায়ই হলন্ত নহে এ কথা রামমোহন রায় তাঁহার বাংলা ব্যাকরণে প্রথম নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। সংস্কৃত শব্দ “কাণ’ বাংলায় তাহা “কানা’। সংস্কৃত “খঞ্জ’ বাংলায় “খোঁড়া’। সংস্কৃত “অর্ধ’ বাংলা “আধা’। শাদা, রাঙা, বাঁকা, কালা, খাঁদা, পাকা, কাঁচা, মিঠা ইত্যাদি বহুতর দৃষ্টান্ত আছে। “আলো’ বিশেষ্য, “আলা’ বিশেষণ। “ফাঁক’ বিশেষ্য “ফাঁকা’ বিশেষণ। “মা’ বিশেষ্য, “মায়্যা (মায়্যা মানুষ) বিশেষণ। এই আকার প্রয়োগের দ্বারা বিশেষণ নিষ্পন্ন করা ইহাও বাংলা ভাষায় তির্যক্রূপের দৃষ্টান্ত বলিয়া গণ্য হইতে পারে।
মারাঠিতে তির্যক্রূপে আকার ও একার দুই স্বরবর্ণের যেমন ব্যবহার দেখা যায় বাংলাতেও সেইরূপ দেখিতে পাই। তন্মধ্যে আকারের ব্যবহার বিশেষ কয়েকটি মাত্র শব্দে বদ্ধ হইয়া আছে; তাহা সজীব ভাবে নাই, কিন্তু একারের ব্যবহার এখনো গতিবিশিষ্ট।
“পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়’ এই বাক্যে “পাগলে’ ও “ছাগলে’ শব্দে যে একার দেখিতেছি তাহা উক্ত প্রকার তির্যক্রূপের একার। বাংলা ভাষায় এই শ্রেণীর তির্যক্রূপ কোন্ কোন্ স্থলে ব্যবহৃত হয় আমরা তাহার আলোচনা করিব।
সা মা ন্য বি শে ষ্য ঃ বাংলায় নাম সংজ্ঞা (Proper names) ছাড়া অন্যান্য বিশেষ্যপদে যখন কোনো চিহ্ন থাকে না, তখন তাহাদিগকে সামান্য বিশেষ্য বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। যেমন, বানর, টেবিল, কলম, ছুরি ইত্যাদি।
উল্লিখিত বিশেষ্যপদগুলির দ্বারা সাধারণভাবে সমস্ত বানর, টেবিল, চৌকি, ছুরি বুঝাইতেছে, কোনো বিশেষ এক বা একাধিক বানর, টেবিল, চৌকি, ছুরি বুঝাইতেছে না বলিয়াই ইহাদিগকে সামান্য বিশেষ্য পদ নাম দেওয়া হইয়াছে। বলা আবশ্যক ইংরেজি common names ও বাংলা সামান্য বিশেষ্যে প্রভেদ আছে। বাংলায় আমরা যেখানে বলি “এইখানে ছাগল আছে’ সেখানে ইংরেজিতে বলে ‘There is a goat here’ কিংবা ‘There are goats here’। বাংলায় এ স্থলে সাধারণভাবে বলা হইতেছে ছাগলজাতীয় জীব আছে। তাহা কোনো একটি বিশেষ ছাগল বা বহু ছাগল তাহা নির্দেশ করিবার প্রয়োজন ঘটে নাই বলিয়া নির্দেশ করা হয় নাই, কিন্তু ইংরেজিতে এরূপ স্থলেও বিশেষ্যপদকে article-যোগে বা বহুবচনের চিহ্নযোগে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করা হয়। ইংরেজিতে যেখানে বলে ‘There is a bird in the cage’ বা ‘There are birds in the cage’ আমরা উভয় স্থলেই বলি “খাঁচায় পাখি আছে’– কারণ এ স্থলে খাঁচার পাখি এক কিংবা বহু তাহা বক্তব্য নহে কিন্তু খাঁচার মধ্যে পাখি নামক পদার্থ আছে ইহাই বক্তব্য। এই কারণে, এ-সকল স্থলে বাংলায় সামান্য বিশেষ্যপদই ব্যবহৃত হয়।
এই সামান্য বিশেষ্যপদ যখন জীববাচক হয় প্রায় তখনই তাহা তির্যকরূপ গ্রহণ করে। কখনো বলি না, “গাছে নড়ে’, বলি “গাছ নড়ে’। কিন্তু “বানরে লাফায়’ বলিয়া থাকি। কেবল কর্তৃকারকেই এই শ্রেণীর তির্যক্রূপের প্রয়োগ দেখা যায়, কিন্তু তাহার বিশেষ নিয়ম আছে।
প্লেগে ধরে বা ম্যালেরিয়ায় ধরে–এরকম স্থলে প্লেগ ও ম্যালেরিয়া বস্তুত অচেতন পদার্থ। কিন্তু আমরা বলিবার সময় উহাতে চেতনতা আরোপ করিয়া উহাকে আক্রমণ ক্রিয়ার সচেষ্ট কর্তা বলিয়াই ধরি। তাই উহা রূপকভাবে চেতন বাচকের পর্যায় স্থান লাভ করিয়া তির্যক্রূপ প্রাপ্ত হয়।
মোটের উপর বলা যাইতে পারে সকর্মক ক্রিয়ার সহযোগেই জীববাচক সামান্য বিশেষ্যপদ কর্তৃকারকে তির্যক্রূপ ধারণ করে। “এই ঘরে ছাগলে আছে’ বলি না কিন্তু “ছাগলে ঘাস খায়’ বলা যায়। বলি “পোকায় কেটেছে’, কিন্তু অকর্মক “লাগা’ ক্রিয়ার বেলায় “পোকা লেগেছে’। “তাকে ভূতে পেয়েছে’ বলি, “ভূত পেয়েছে’ নয়। পাওয়া ক্রিয়া সকর্মক।
কিন্তু এই সকর্মক ও অকর্মক শব্দটি এখানে সম্পূর্ণ খাটিবে না। ইহার পরিবর্তে বাংলায় নূতন শব্দ তৈরি করা আবশ্যক। আমরা এ স্থলে “সচেষ্টক’ ও “অচেষ্টক’ শব্দ ব্যবহার করিব। কারণ প্রচলিত ব্যাকরণ অনুসারে সকর্মক ক্রিয়ার সংস্রবে ঊহ্য বা ব্যক্তভাবে কর্ম থাকা চাই কিন্তু আমরা যে শ্রেণীর ক্রিয়ার কথা বলিতেছি তাহার কর্ম না থাকিতেও পারে। “বানরে লাফায়’ এই বাক্যে “বানর’ শব্দ তির্যক্রূপ গ্রহণ করিয়াছে, অথচ “লাফায়’ ক্রিয়ার কর্ম নাই। কিন্তু “লাফানো’ ক্রিয়াটি সচেষ্টক।
“আছে’ এবং “থাকে’ এই দুইটি ক্রিয়ার পার্থক্য চিন্তা করিয়া দেখিলে দেখা যাইবে, “আছে’ ক্রিয়াটি অচেষ্টক কিন্তু “থাকে’ ক্রিয়া সচেষ্টক–সংস্কৃত “অস্তি’ এবং “তিষ্ঠতি’ ইহার প্রতিশব্দ। “আছে’ ক্রিয়ার কর্তৃকারকে তির্যক্রূপ স্থান পায় না– “ঘরে মানুষে আছে’ বলা চলে না কিন্তু “এ ঘরে কি মানুষে থাকতে পারে’ এরূপ প্রয়োগ সংগত।
“প্লেগে স্ত্রীলোকেই অধিক মরে’ এ স্থলে মরা ক্রিয়া অচেষ্টক সন্দেহ নাই। “বেশি আদর পেলে ভালো মানুষেও বিগড়ে যায়’ “অধ্যবসায়ের দ্বারা মূর্খেও পণ্ডিত হ’তে পারে’,”অকস্মাৎ মৃত্যুর আশঙ্কায় বীরপুরুষেও ভীত হয়’ এ-সকল অচেষ্টক ক্রিয়ার দৃষ্টান্তে আমার নিয়ম খাটে না। বস্তুত এই নিয়মে ব্যতিক্রম যথেষ্ট আছে।
কিন্তু “আছে’ ক্রিয়ার স্থলে কর্তৃপদে একার বসে না, এ নিয়মের ব্যতিক্রম এখনো ভাবিয়া পাই নাই।
আসা এবং যাওয়া ক্রিয়াটি যদিও সাধারণত সচেষ্টক, তবু তাহাদের সম্বন্ধে পূর্বোক্ত নিয়মটি ভালোরূপে খাটে না। আমরা বলি “সাপে কামড়ায়’ বা “কুকুরে আঁচড়ায়’ কিন্তু “সাপে আসে’ বা “কুকুরে যায়’ বলি না। অথচ “যাতায়াত করা’ ক্রিয়ার অর্থ যদিচ যাওয়া আসা করা, সেখানে এ নিয়মের ব্যতিক্রম নাই। আমরা বলি এ পথ দিয়ে মানুষে যাতায়াত করে, বা “যাওয়া আসা করে’ বা “আনাগোনা করে’। কারণ, “করে’ ক্রিয়াযোগে আসা যাওয়াটা নিশ্চিতভাবেই সচেষ্টক হইয়াছে। “খেতে যায়’ বা “খেতে আসে’ প্রভৃতি সংযুক্ত ক্রিয়াপদেও এ নিয়ম অব্যাহত থাকে– যেমন, “এই পথ দিয়ে বাঘে জল খেতে যায়’।
“সকল’ ও “সব’ শব্দ সচেষ্টক অচেষ্টক উভয় শ্রেণীর ক্রিয়া-সহযোগেই তির্যক্রূপ লাভ করে। যথা, এ ঘরে সকলেই আছেন বা সবাই আছে।
ইহার কারণ এই যে, “সকল’ ও “সব’ শব্দ দুটি বিশেষণপদ। ইহারা তির্যক্রূপ ধারণ করিলে তবেই বিশেষ্যপদ হয়। “সকল’ ও “সব’ শব্দটি হয় বিশেষণ, নয় অন্য শব্দের যোগে বহুবচনের চিহ্ন– কিন্তু “সকলে’ বা “সবে’ বিশেষ্য। কথিত বাংলায় “সব’ শব্দটি বিশেষ্যরূপ গ্রহণকালে দ্বিগুণভাবে তির্যক্রূপ প্রাপ্ত হয়– প্রথমত “সব’ হইতে হয় “সবা’ তাহার পরে পুনশ্চ তাহাতে এ যোগ হইয়া হয় “সবাএ’। এই “সবাএ’ শব্দকে আমরা “সবাই’ উচ্চারণ করিয়া থাকি।
“জন’ শব্দ “সব’ শব্দের ন্যায়। বাংলায় সাধারণত “জন’ শব্দ বিশেষণরূপেই ব্যবহৃত হয়। একজন লোক, দুজন মানুষ ইত্যাদি। বস্তুত মানুষের পূর্বে সংখ্যা যোগ করিবার সময় আমরা তাহার সঙ্গে “জন’ শব্দ যোজনা করিয়া দিই। পাঁচ মানুষ কখনোই বলি না, পাঁচজন মানুষ বলি। কিন্তু এই “জন’ শব্দকে যদি বিশেষ্য করিতে হয় তবে ইহাকে তির্যক্রূপ দিয়া থাকি। দুজনে, পাঁচজনে ইত্যাদি। “সবাএ’ শব্দের ন্যায় “জনাএ’ শব্দ বাংলায় প্রচলিত আছে– এক্ষণে ইহা “জনায়’ রূপে লিখিত হয়।
বাংলায় “অনেক’ শব্দটি বিশেষণ। ইহাও বিশেষ্যরূপ গ্রহণকালে “অনেকে’ হয়। সর্বত্রই এ নিয়ম খাটে। “কালোএ’ (কালোয়) যার মন ভুলেছে “শাদাএ’ (শাদায়) তার কি করবে। এখানে কালো ও শাদা বিশেষণপদ তির্যক্রূপ ধরিয়া বিশেষ্য হইয়াছে। “অপর’ “অন্য’ শব্দ বিশেষণ কিন্তু “অপরে’ “অন্যে’ বিশেষ্য। “দশ’ শব্দ বিশেষণ, “দশে’ বিশেষ্য (দশে যা বলে)।
নামসংজ্ঞা সম্বন্ধে এ-প্রকার তির্যক্রূপ ব্যবহার হয় না– কখনো বলি না, “যাদবে ভাত খাচ্চে’। তাহার কারণ পূর্বেই নির্দেশ করা হইয়াছে, বিশেষ নাম কখনো সামান্য বিশেষ্যপদ হইতে পারে না। বাংলায় একটি প্রবাদবাক্য আছে “রামে মারলেও মরব রাবণে মারলেও মরব।’ বস্তুত এখানে “রাম’ ও রাবণ’ সামান্য বিশেষ্যপদ– এখানে উক্ত দুই শব্দের দ্বারা দুই প্রতিপক্ষকে বুঝাইতেছে। কোনো বিশেষ রাম-রাবণকে বুঝাইতেছে না।
তির্যক্রূপের মধ্যে প্রায়ই একটি সমষ্টিবাচকতা থাকে। যথা “আত্মীয়ে তাকে ভাত দেয় না।’এখানে আত্মীয় সমষ্টিই বুঝাইতেছে। এইরূপ “লোকে বলে।’ এখানে লোকে’ অর্থ সর্বসাধারণে। “লোক বলে’ কোনোমতেই হয় না। সমষ্টি যখন বুঝায় তখন “বানরে বাগান নষ্ট করিয়াছে’ ইহাই ব্যবহার্য– “বানর করিয়াছে’ বলিলে বানর দল বুঝাইবে না।
সংখ্যা-সহযোগে বিশেষ্যপদ যদিচ সামান্যতা পরিহার করে তথাপি সকর্মক রূপে তাহাদের প্রতিও একার প্রয়োগ হয়, যেমন “তিন শেয়ালে যুক্তি করে গর্তে ঢুকল’, এমন– কি “আমরা’ “তোমরা’ “তারা’ ইত্যাদি সর্বনাম বিশেষণের দ্বারা বিশেষ্যপদ বিশেষভাবে নির্দিষ্ট হইলেও সংখ্যার সংস্রবে তাহার তির্যক্রূপ গ্রহণ করে। যেমন, “তোমরা দুই বন্ধুতে’ “সেই দুটো কুকুরে’ ইত্যাদি।
অনেকের মধ্যে বিশেষ একাংশ যখন এমন কিছু করে অপরাংশ যাহা করে না তখন কর্তৃপদে তির্যক্রূপ ব্যবহার হয়। যথা “তাদের মধ্যে দুজনে গেল দক্ষিণে’– এরূপ বাক্যের মধ্যে একটি অসমাপ্তি আছে। অর্থাৎ আর কেহ আর কোনো দিকে গিয়াছে বা বাকি কেহ যায় নাই এরূপ বুঝাইতেছে। যখন বলি “একজনে বললে হাঁ’ তখন “আর-একজন বললে না’ এমন আর-একটা কিছু শুনিবার অপেক্ষা থাকে। কিন্তু যদি বলা যায় “একজন বললে, হাঁ’ তবে সেই সংবাদই পর্যাপ্ত।
তির্যক্রূপে হলন্ত শব্দে একার যোজনা সহজ, যেমন বানর বানরে। (বাংলায় বানর শব্দ হলন্ত)। অকারান্ত, আকারান্ত এবং ওকারান্ত শব্দের সঙ্গেও “এ’ যোজনায় বাধা নাই– “ঘোড়াএ’ (ঘোড়ায়) “পেঁচোএ’ (পেঁচোয়) ইত্যাদি। এতদ্ব্যতীত অন্য স্বরান্ত শব্দে “এ’ যোগ করিতে হইলে “ত’ ব্যঞ্জনবর্ণকে মধ্যস্থ করিতে হয়। যেমন “গোরুতে’, ইত্যাদি। কিন্তু শব্দের শেষে যখন ব্যঞ্জনকে আশ্রয় না করিয়া শুদ্ধ স্বর থাকে তখন “ত’কে মধ্যস্থরূপে প্রয়োজন হয় না। যেমন উই, উইএ (উইয়ে), বউ, বউএ (বউয়ে) ইত্যাদি। এ কথা মনে রাখা আবশ্যক বাংলায় বিভক্তিরূপে যেখানে একার প্রয়োগ হয় সেখানে প্রায় সর্বত্রই বিকল্পে “তে’ প্রয়োগ হইতে পারে। এইজন্য “ঘোড়ায় লাথি মেরেছে’, এবং “ঘোড়াতে লাথি মেরেছে’ দুইই হয়। “উইয়ে নষ্ট করেছে’, এবং “উইতে’ বা “উইয়েতে’ নষ্ট করেছে।’ হলন্ত শব্দে এই “তে’ বিভক্তি গ্রহণকালে তাৎপূর্ববর্তী ব্যঞ্জনে পুনশ্চ একার যোগ করিতে হয়। যেমন “বানরেতে’, “ছাগলেতে’।
আষাঢ়, ১৩১৮
বাংলা ব্যাকরণে বিশেষ বিশেষ্য
আমরা পূর্বে এক প্রবন্ধে দেখাইয়াছি, বাংলায় নামসংজ্ঞা ছাড়া বিশেষ্যপদবাচক শব্দ মাত্রই সহজ অবস্থায় সামান্য বিশেষ্য। অর্থাৎ তাহা জাতিবাচক। যেমন শুধু “কাগজ’ বলিলে বিশেষভাবে একটি বা অনেকগুলি কাগজ বোঝায় না, তাহার দ্বারা সমস্ত কাগজকেই বোঝায়।
এমন স্থলে যদি কোনো বিশেষ কাগজকে আমরা নির্দেশ করিতে চাই তবে সেজন্য বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করা আবশ্যক হয়।
ইংরেজি ব্যাকরণে এইরূপ নির্দেশক চিহ্নকে Article বলে। বাংলাতেও এই শ্রেণীর সংকেত আছে। সেই সংকেতের দ্বারা সামান্য বিশেষ্যপদ একবচন ও বহুবচন রূপ ধারণ করিয়া বিশেষ বিশেষ্যে পরিণত হয়। এই কথা মনে রাখা কর্তব্য, বিশেষ্যপদ, একবচন বা বহুবচনরূপ গ্রহণ করিলেই, সামান্যতা পরিহার করে। একটি ঘোড়া বা তিনটি ঘোড়া বলিলেই ঘোড়া শব্দের জাতিবাচক অর্থ সংকীর্ণ হইয়া আসে– তখন বিশেষ এক বা একাধিক ঘোড়া বোঝায়– সুতরাং তখন তাহাকে সামান্য বিশেষ্য না বলিয়া বিশেষ বিশেষ্য বলাই উচিত। এই কথা চিন্তা করিলেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন আমাদের সামান্য বিশেষ্য এবং ইংরেজি Common name এক নহে।
বিশেষ বিশেষ্য একবচন
মোটামুটি বলা যাইতে পারে বাংলার নির্দেশক চিহ্নগুলি শব্দের পূর্বে না বসিয়া শব্দের পরেই যোজিত হয়। ইংরেজি ‘the room’–বাংলায় “ঘরটি’। এখানে “টি’ নির্দেশক চিহ্ন।
টি ও টা
ইংরেজিতে the আর্টিক্ল্ একবচন এবং বহুবচন উভয়ত্রই বসে কিন্তু বাংলায় টি ও টা সংকেতের দ্বারা একটিমাত্র পদার্থকে বিশিষ্ট করা হয়। যখন বলা হয়, “রাস্তা কোন্ দিকে’ তখন সাধারণভাবে পথ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়– যখন বলি, “রাস্তাটা কোন্ দিকে’– তখন বিশেষ একটা রাস্তা কোন্ দিকে সেই সম্বন্ধেই প্রশ্ন করা হয়।
ইংরেজিতে ‘the’ শব্দের প্রয়োগ যত ব্যাপক বাংলায় “টি’ তেমন নহে। আমাদের ভাষায় এই প্রয়োগ সম্বন্ধে মিতব্যয়িতা আছে। সেইজন্যে যখন সাধারণভাবে আমরা খবর দিতে চাই, মধু বাহিরে নাই,তখন আমরা শুধু বলি, মধু ঘরে আছে– ঘর শব্দের সঙ্গে কোনো নির্দেশক চিহ্ন যোজনা করি না। কারণ ঘরটাকেই বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিবার কোনোই প্রয়োজন নাই। ইংরাজিতে এ স্থলেও ‘the room’ বলা হইয়া থাকে। কিন্তু যখন কোনো একটি বিশেষ ঘরে মধু আছে এই সংবাদটি দিবার প্রয়োজন ঘটে তখন আমরা বলি, ঘরটাতে মধু আছে। এইরূপ, যে বাক্যে একাধিক বিশেষ্যপদ আছে তাহাদের মধ্যে বক্তা যেটিকে বিশেষভাবে নির্দেশ করিতে চান সেইটির সঙ্গেই নির্দেশক যোজনা করেন। যেমন, গোরুটা মাঠে চরছে, বা মাঠটাতে গরু চরছে। জাজিমটা ঘরে পাতা, বা ঘরটাতে জাজিম পাতা। “আমার মন খারাপ হয় গেছে’ বা “আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছে’– দুইই আমরা বলি। প্রথম বাক্যে, মন খারাপ হওয়া ব্যাপারটাই বলা হইতেছে– দ্বিতীয় বাক্যে, আমার মনই যে খারাপ হইয়া গিয়াছে তাহার উপরেই ঝোঁক।
“টি’ সংকেতটি ছোটো আয়তনের জিনিস ও আদরের জিনিস সম্বন্ধে “টা’ বড়ো জিনিস সম্বন্ধে বা অবজ্ঞা কিংবা অপ্রিয়তা বুঝাইবার স্থলে বসে। যে পদার্থ সম্বন্ধে আদর বা অনাদর কিছুই বোঝায় না, তৎসম্বন্ধেও “টা’ প্রয়োগ হয়। “ছাতাটি কোথায়’ এই বাক্যে ছাতার প্রতি বক্তার একটু যত্ন প্রকাশ হয়, কিন্তু “ছাতাটা কোথায়’ বলিলে যত্ন বা অযত্ন কিছুই বোঝায় না।
সাধারণত নামসংজ্ঞার সহিত “টা’ “টি’ বসে না। কিন্তু বিশেষ কারণে ঝোঁক দিতে হইলে নামসংজ্ঞার সঙ্গেও নির্দেশক বসে। যেমন, হরিটা বাড়ি গেছে। সম্ভবত হরির বাড়ি যাওয়া বক্তার পক্ষে প্রীতিকর হয় নাই, টা তাহাই বুঝাইল। “রামটি মারা গেছে’, এখানে বিশেষভাবে করুণা প্রকাশের জন্য টি বসিল। এইরূপ শ্যামটা ভারি দুষ্ট, শৈলটি ভারি ভালো মেয়ে। এইরূপে টি ও টা অনেক স্থলে বিশেষ পদের সঙ্গে বক্তার হৃদয়ের সুর মিশাইয়া দেয়। বলা আবশ্যক মান্য ব্যক্তির নাম সম্বন্ধেও টি বা টা ব্যবহার হয় না।
সামান্যতাবাচক বা সমষ্টিবাচক বিশেষ্যপদকে বিশেষভাবে নির্দেশ করিতে হইলে নির্দেশক প্রয়োগ করা যায়। যেমন, “গিরিডির কয়লাটা ভালো’, “বেহারের মাটিটা উর্বরা’, “এখানে মশাটা বড়ো বেশি’, “ভীম নাগ সন্দেশটা করে ভালো’। কিন্তু শুদ্ধ অস্তিত্ব জ্ঞাপনের সময় এরূপ প্রয়োগ খাটে না; বলা যায় না, “ভীমের দোকানে সন্দেশটা আছে।’
এখানে আর একটি লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, যখন বলা যায় “বেহারের মাটিটা উর্বরা’ বা “ভীমের দোকানের সন্দেশটা ভালো’ তখন প্রশংসা সূচনা সত্ত্বেও “টা’ নির্দেশক ব্যবহার হয় তাহার কারণ এই যে, এই বিশেষ্যপদগুলিতে যে-সকল বস্তু বুঝাইতেছে তাহা পরিমাণে অল্প নহে।
যখন আমরা কর্তৃবাচক বিশেষ্যকে সাধারণভাবে উল্লেখ করিয়া পরিচয়বাচক বিশেষ্যকে বিশেষভাবে নির্দেশ করি, তখন শেষোক্ত বিশেষ্যের সহিত নির্দেশক যোগ হয়। যেমন, “হরি মানুষটা ভালো’, “বাঘ জন্তুটা ভীষণ’।
সাধারণত গুণবাচক বিশেষ্যে নির্দেশক যোগ হয় না– বিশেষত শুদ্ধমাত্র অস্তিত্ব জ্ঞাপনকালে তো হয়ই না। যেমন, আমরা বলি, “রামের সাহস আছে।’ কিন্তু “রামের সাহসটা কম নয়’, “উমার লজ্জাটা বেশি’ বলিয়া উমার বিশেষ লজ্জা ও রামের বিশেষ সাহসের উল্লেখকালে টা প্রয়োগ করি।
ইংরেজিতে ‘this’ ‘my’ প্রভৃতি সর্বনাম বিশেষণপদ থাকিলে বিশেষ্যের পূর্বে আর্টিক্ল্ বসে না কিন্তু বাংলায় তাহার বিপরীত। এরূপ স্থলে বিশেষ করিয়াই নির্দেশক বসে। যেমন,”এই বইটা’, আমার কলমটি’।
বিশেষণপদের সঙ্গে “টা’ “টি’ যুক্ত হয় না। যদি যুক্ত হয় তবে তাহা বিশেষ্য হইয়া যায়। যেমন, “অনেকটা নষ্ট হয়েছে’, “অর্ধেকটা রাখো’, “একটা দাও’, “আমারটা লও’, “তোমরা কেবল মন্দটাই দেখো’ ইত্যাদি।
নির্দেশক-চিহ্ন-যুক্ত বিশেষ্যপদে কারকের চিহ্নগুলি নির্দেশকের সহিত যুক্ত হয়। যেমন, “মেয়েটির’, “লোকটাকে’, “বাড়িটাতে’ ইত্যাদি।
অচেতন পদার্থবাচক বিশেষ্যপদে কর্মকারকে “কে’ বিভক্তিচিহ্ন প্রায় বসে না। কিন্তু “টি’ “টা’-র সহযোগে বসিতে পারে। যেমন, “লোহাটাকে’, “টেবিলটিকে’ ইত্যাদি।
ক্রোশটাক্ সেরটাক্ প্রভৃতি দূরত্ব ও পরিমাণ-বাচক শব্দের “টাক্’ প্রত্যয়টি টা ও এক শব্দের সন্ধিজাত। কিন্তু এই “টাক্’ প্রত্যয়যোগে উক্ত শব্দগুলি বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন ক্রোশটাক্ পথ, সেরটাক্ দুধ ইত্যাদি। কেহ কেহ মনে করেন এগুলি বিশেষণ নহে। কারণ, বিশেষ্য ভাবেও উহাদের প্রয়োগ হয়। যেমন, “ক্রোশটাক্ গিয়েই বসে পড়ল’, “পোয়াটাক্ হলেই চলবে’।
যদিচ সাধারণত টি টা প্রভৃতি নির্দেশক সংকেত বিশেষণের সহিত বসে না, তবু এক স্থলে তাহার ব্যতিক্রম আছে। সংখ্যাবাচক শব্দের সহিত নির্দেশক যুক্ত হইয়া বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন, একটা গাছ, দুইটি মেয়ে ইত্যাদি।
বাংলায় ইংরেজি Indefinite article-এর অনুরূপ শব্দ, একটি, একটা। একটা মানুষ বলিলে অনির্দিষ্ট কোনো একজন মানুষ বুঝায়। “একটা মানুষ ঘরে এল’ এবং “মানুষটা ঘরে এল’ এই দুই বাক্যের মধ্যে অর্থভেদ এই– প্রথম বাক্যে যে হউক একজন মানুষ ঘরে আসিল এই তথ্য বলা হইতেছে, দ্বিতীয় বাক্যে বিশেষ কোনো একজন মানুষের কথা বলা হইতেছে।
কিন্তু “একটা’ বা “একটি’ যখন বিশেষভাবে এক সংখ্যাকে জ্ঞাপন করে তখন তাহাকে indefinite বলা চলে না। ইংরেজিতে তাহার প্রতিশব্দ one। সেখানে একটা লোক মানে এক সংখ্যক লোক, কোনো একজন অনির্দিষ্ট লোক নহে।
যেখানে “এক’ শব্দটি অপর একটি বিশেষণের পরে যুক্ত হইয়া ব্যবহৃত হয় সেখানে সাধারণত “টি’ “টা’ প্রয়োগ চলে না, যেমন, লম্বা-এক ফর্দ, মস্ত-এক বাবু, সাতহাত-এক লাঠি।
বলা বাহুল্য, এক ভিন্ন অন্য সংখ্যা সহযোগে যেখানে টি, টা বসে সেখানে তাহাকে Indefinite article-এর সহিত তুলনীয় করা চলে না, সেখানে তাহা সংখ্যাবাচক বিশেষণ।
খানি, খানা প্রভৃতি আরো কয়েকটি নির্দেশক চিহ্ন আছে, তাহাদের কথা পরে হইবে।
বলা আবশ্যক সংস্কৃতের অনুকরণ করিতে গিয়া বাংলা লিখিত ভাষায় নির্দেশক সংকেতের ব্যবহার বিরল হইয়াছে। যাঁহারা সংস্কৃত রীতির পক্ষপাতী তাঁহাদের রচনায় ইহা প্রায় পরিত্যক্ত হইয়াছে। যেহেতু বাংলায় বক্তা ইচ্ছা করিলে কোনো একটি বিশেষ্যপদকে বিশেষভাবে নির্দেশ করিতেও পারেন নাও করিতে পারেন সেইজন্য ইহাকে বর্জন করা সম্ভব হইয়াছে। কিন্তু ভাষার স্বাভাবিক রীতিকে ত্যাগ করিলে নিশ্চয়ই তাহাকে দুর্বল করা হয়। আধুনিক কালের লেখকগণ মাতৃভাষার সবস্ত স্বকীয় সম্পদগুলিকে অকুণ্ঠিতচিত্তে ব্যবহার করিবার চেষ্টা করিয়া ক্রমশই ভাষাকে প্রাণপূর্ণ ও বেগবান করিয়া তুলিতেছেন তাহাতে সন্দেহ নাই।
ভাদ্র, ১৩১৮
বাংলাভাষা ও বাঙালি চরিত্র : ১
অনেক সময় দেখা যায় সংস্কৃত শব্দ বাংলায় রূপান্তরিত হয়ে এক প্রকার বিকৃত ভাব প্রকাশ করে। কেমন একরকম ইতর বর্বর আকার ধারণ করে। “ঘৃণা’ শব্দের মধ্যে একটা মানসিক ভাব আছে। Aversion, indignation, contempt প্রভৃতি ইংরাজি শব্দ বিভিন্ন স্থল অনুসারে “ঘৃণা’র প্রতিশব্দ স্বরূপে ব্যবহৃত হইতে পারে। কিন্তু “ঘেন্না’ বললেই নাকের কাছে একটা দুর্গন্ধ, চোখের সামনে একটা বীভৎস দৃশ্য, গায়ের কাছাকাছি একটা মলিন অস্পৃশ্য বস্তু কল্পনায় উদিত হয়। সংস্কৃত “প্রীতি’ শব্দের মধ্যে একটা বিমল উদার মানসিক ভাব নিহিত আছে। কিন্তু বাংলা “পিরিতি’ শব্দের মধ্যে সেই বিশুদ্ধ ভাবটুকু নাই। বাংলায় “স্বামী’ “স্ত্রী’র সাধারণ প্রচলিত প্রতিশব্দ ভদ্রসমাজে উচ্চারণ করিতে লজ্জা বোধ হয়। “ভর্তা’ এবং তাহার বাংলা রূপান্তর তুলনা করিয়া দেখিলেই এ কথা স্পষ্ট হইবে। আমার বোধ হয় সংস্কৃত ভাষায় “লজ্জা’ বলিলে যতটা ভাব প্রকাশ করে, বাংলায় “লজ্জা’ ততটা করে না। বাংলায় “লজ্জা’ এক প্রকার প্রথাগত বাহ্য লজ্জা, তাহা modesty নহে। তাহা হ্রী নহে। লজ্জার সহিত শ্রীর সহিত একটা যোগ আছে, বাংলা ভাষায় তাহা নাই। সৌন্দর্যের প্রতি স্বাভাবিক লক্ষ্য থাকিলে আচারে ব্যবহারে, ভাবভঙ্গিতে ভাষায় কণ্ঠস্বরে সাজসজ্জায় একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সংযম আসিয়া পড়ে। বাংলায় লজ্জা বলিতে যাহা বুঝায় তাহা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তাহাতে বরঞ্চ আচার-ব্যবহারের সামঞ্জস্য নষ্ট করে, একটা বাড়াবাড়ি আসিয়া সৌন্দর্যের ব্যাঘাত করে। তাহা শরীর-মনের সুশোভন সংযম নহে, তাহার অনেকটা কেবলমাত্র শারীরিক অভিভূতি।
গল্প আছে– বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন উলোয় শিব গড়িতে বাঁদর হইয়া দাঁড়ায়, তেমনি বাংলার মাটির বাঁদর গড়িবার দিকে একটু বিশেষ প্রবণতা আছে। লক্ষ্য শিব এবং পরিণাম বাঁদর ইহা অনেক স্থলেই দেখা যায়। উদার প্রেমের ধর্ম বৈষ্ণব ধর্ম বাংলাদেশে দেখিতে দেখিতে কেমন হইয়া দাঁড়াইল। একটা বৃহৎ ভাবকে জন্ম দিতে যেমন প্রবল মানসিক বীর্যের আবশ্যক, তাহাকে পোষণ করিয়া রাখিতেও সেইরূপ বীর্যের আবশ্যক। আলস্য এবং জড়তা যেখানে জাতীয় স্বভাব, সেখানে বৃহৎ ভাব দেখিতে দেখিতে বিকৃত হইয়া যায়। তাহাকে বুঝিবার, তাহাকে রক্ষা করিবার এবং তাহার মধ্যে প্রাণসঞ্চার করিয়া দিবার উদ্যম নাই।
আমাদের দেশে সকল জিনিসই যেন এক প্রকার slang হইয়া আসে। আমার তাই এক-একবার ভয় হয় পাছে ইংরাজদের বড়ো ভাব বড়ো কথা আমাদের দেশে ক্রমে সেইরূপ অনার্য ভাব ধারণ করে। দেখিয়াছি বাংলায় অনেকগুলি গানের সুর কেমন দেখিতে দেখিতে ইতর হইয়া যায়। আমার বোধ হয় সভ্যদেশে যে যে সুর সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচলিত, তাহার মধ্যে একটা গভীরতা আছে, তাহা তাহাদের national air, তাহাতে তাহাদের জাতীয় আবেগ পরিপূর্ণভাবে ব্যক্ত হয়। যথা Home Sweet Home, Auld lang Syne–, বাংলাদেশে সেরূপ সুর কোথায়? এখানকার সাধারণ-প্রচলিত সুরের মধ্যে গাম্ভীর্য নাই, স্থায়িত্ব নাই, ব্যাপকতা নাই। সেইজন্য তাহার কোনোটাকেই national air বলা যায় না। হিন্দুস্থানীতে যে-সকল খাম্বাজ ঝিঁঝিট কাফি প্রভৃতি রাগিণীতে শোভন ভদ্রভাব লক্ষিত হয়, বাংলায় সেই রাগিণীই কেমন কুৎসিত আকার ধারণ করিয়া “বড় লজ্জা করে পাড়ায় যেতে’ “কেন বল সখি বিধুমুখী’ “একে অবলা সরলা’ প্রভৃতি গানে পরিণত হইয়াছে।
কেবল তাহাই নহে, আমাদের এক-একবার মনে হয় হিন্দুস্থানী এবং বাংলার উচ্চারণের মধ্যে এই ভদ্র এবং বর্বর ভাবের প্রভেদ লক্ষিত হয়। হিন্দুস্থানী গান বাংলায় ভাঙিতে গেলেই তাহা ধরা পড়ে। সুর তাল অবিকল রক্ষিত হইয়াও অনেক সময় বাংলা গান কেমন “রোথো’ রকম শুনিতে হয়। হিন্দুস্থানীর polite “আ’ উচ্চারণ বাংলায় vulgar “অ’ উচ্চারণে পরিণত হইয়া এই ভাবান্তর সংঘটন করে। “আ’ উচ্চারণের মধ্যে একটি বেশ নির্লিপ্ত ভদ্র suggestive ভাব আছে, আর “অ’ উচ্চারণ নিতান্ত গা-ঘেঁষা সংকীর্ণ এবং দরিদ্র। কাশীর সংস্কৃত উচ্চারণ শুনিলে এই প্রভেদ সহজেই উপলব্ধি হয়।
উপরের প্যারাগ্রাফে এক স্থলে commonplace শব্দ বাংলায় ব্যক্ত করিতে গিয়া “রোথো’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছি। কিন্তু উক্ত শব্দ ব্যবহার করিতে কেমন কুণ্ঠিত বোধ করিতেছিলাম। সকল ভাষাতেই গ্রাম্য ইতর শব্দ আছে। কিন্তু দেখিয়াছি বাংলায় বিশেষ ভাবপ্রকাশক শব্দমাত্রই গ্রাম্য। তাহাতে ভাব ছবির মতো ব্যক্ত করে বটে কিন্তু সেইসঙ্গে আরো একটা কী করে যাহা সংকোচজনক। জলভরন শব্দ বাংলায় ব্যক্ত করিতে হইলে হয় “মুচ্কে হাসি’ নয় “ঈষদ্ধাস্য’ বলিতে হইবে। কিন্তু “মুচ্কে হাসি’ সাধারণত মনের মধ্যে যে ছবি আনয়ন করে তাহা বিশুদ্ধ smile নহে, ঈষদ্ধাস্য কোনো ছবি আনয়ন করে কি না সন্দেহ। Peep শব্দকে বাংলায় “উঁকিমারা’ বলিতে হয়। Creep শব্দকে “গুঁড়িমারা’ বলিতে হয়। কিন্তু “উঁকিমারা’ “গুঁড়িমারা’ শব্দ ভাবপ্রকাশক হইলেও সর্বত্র ব্যবহারযোগ্য নহে। কারণ উক্ত শব্দগুলিতে আমাদের মনে এমন-সকল ছবি আনয়ন করে যাহার সহিত কোনো মহৎ বর্ণনার যোগসাধন করিতে পারা যায় না।
হিন্দুস্থানী বা মুসলমানদের মধ্যে একটা আদব-কায়দা আছে। একজন হিন্দুস্থানী বা মুসলমান ভৃত্য দিনের মধ্যে প্রভুর সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হইবা মাত্রই যে সেলাম অথবা নমস্কার করে তাহার কারণ এমন নহে যে, তাহাদের মনে বাঙালি ভৃত্যের অপেক্ষা অধিক দাস্যভাব আছে, কিন্তু তাহার কারণ এই যে, সভ্যসমাজের সহস্রবিধ সম্বন্ধের ইতিকর্তব্যতা বিষয়ে তাহারা নিরলস ও সতর্ক। প্রভুর নিকটে তাহারা পরিচ্ছন্ন পরিপাটি থাকিবে, মাথায় পাগ্ড়ি পরিবে, বিনীত ভাব রক্ষা করিবে। স্বাভাবিক ভাবে থাকা অপেক্ষা ইহাতে অনেক আয়াস ও শিক্ষা আবশ্যক। আমরা অনেক সময়ে যাহাকে স্বাধীন ভাব মনে করি তাহা অশিক্ষিত অসভ্য ভাব। অনেক সময়ে আমাদের এই অশিক্ষিত ও বর্বর ভাব দেখিয়াই ইংরাজেরা আমাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়, অথচ আমরা মনে মনে গর্ব করি যেন প্রভুকে যথাযোগ্য সম্মান না দেখাইয়া আমরা ভারি একটা কেল্লা ফতে করিয়া আসিলাম। এই অশিক্ষা ও অনাচারবশত আমাদের দৈনিক ভাষা ও কাজের মধ্যে একটি সুমার্জিত সুষমা একটি শ্রী লক্ষিত হয় না। আমরা কেমন যেন “আট-পৌরে’ “গায়েপড়া’ “ফেলাছড়া’ “ঢিলেঢালা’ “নড়বোড়ে’ রকমের জাত, পৃথিবীর কাজেও লাগি না, পৃথিবীর শোভাও সাধন করি না।
২
বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা করিতে গিয়া একটি প্রধান ব্যাঘাত এই দেখিতে পাই, বাংলা ভাষায় ছবি আঁকা শব্দ অতি অল্প। কেবল উপ্রি-উপ্রি মোটামুটি একটা বর্ণনা করা যায় মাত্র, কিন্তু একটা জাজ্জ্বল্যমান মূর্তি ফুটাইয়া তুলা যায় না। লেখকের ক্ষমতার অভাব তাহার একমাত্র কারণ নহে। দৃষ্টান্ত– এক “চলা’ শব্দ ইংরেজিতে কম রকমে ব্যক্ত করা যায়– walk, step, move, creep, sweep, totter, waddle, এমন আরো অনেক শব্দ আছে। উহারা প্রত্যেকে বিভিন্ন ছবি রচনা করে, কেবলমাত্র ঘটনার উল্লেখ করে না। ইহা ছাড়া গঠন-বৈচিত্র্য, বর্ণ-বৈচিত্র্য সম্বন্ধে ইংরাজিতে বিচিত্র শব্দ আছে। আমরা কখনো প্রকৃতিকে স্পষ্ট করিয়া লক্ষ্য করি নাই। আমাদের চিত্রশিল্প নাই; আমাদের চিত্রে এবং কবিতায় প্রকৃতির অতি-বর্ণনাই অধিক। আমরা যেন চক্ষে কিছুই দেখি না– অলস কল্পনার মধ্যে প্রকৃতি বিকৃতাকার ধারণ করিয়া উদিত হয়। আমাদের শরীর-বর্ণনা তাহার দৃষ্টান্তস্থল। মানবদেহের এরূপ সামঞ্জস্যহীন অনৈসর্গিক বর্ণনা আর কোথাও দৃষ্ট হয় না। আমরা মোটামুটি একটা তুলনার দ্রব্য পাইলেই অমনি তাহার সাহায্যে বর্ণনা করিতে চেষ্টা করি। পরিষ্কার ছবি ব্যক্ত করিবার ঔদাসীন্য থাকাতে আমাদের ছবির ভাষা নাই। বিরহিনীর বিরহাবস্থা বর্ণনায় আমাদের অতি কল্পনা ও স্বভাবের প্রতি মনোযোগহীনতা প্রকাশ পায়। আমরা আলস্যবশত চোখে যেটুকু কম দেখি, কোণে বসিয়া মনে মনে একটা চার্ট গড়িয়া সেটুকু পূরণ করিয়া লই। আমরা অল্পস্বল্প দেখি, অথচ খুব বিস্তৃত করিয়া generalize করি। তাড়াতাড়ি একটা প্রকাণ্ড system বাঁধিয়া লই, কিন্তু অগাধ কল্পনার ভাণ্ডার হইতে তাহার সরঞ্জাম সঞ্চয় করি। আমাদের অপরিমিত কল্পনা আমাদের নিরীক্ষণ-শক্তির আগে আগে ছুটিয়া চলে, একটু দেখিবা মাত্র তাহার কল্পনা মস্ত হইয়া উঠে। এইজন্য জগৎ স্পষ্ট দেখা হইল না– অথচ সকল বিষয়ে মস্ত মস্ত তন্ত্র বাঁধা হইল। পৃথিবীর একটুখানি দেখিয়াই অমনি সমস্ত পৃথিবীর একটি বিস্তৃত ভূগোল বিবরণ রচনা করা হইয়াছে, এমন আরো দৃষ্টান্ত আছে।
২২ কার্তিক, ১৮৮৮
বাংলার বানান-সমস্যা
বিদেশী রাজার হুকুমে পণ্ডিতেরা মিলে পুঁথিতে আধুনিক গদ্য-বাংলা পাকা করে গড়েছে। অথচ গদ্যভাষা যে-সর্বসাধারণের ভাষা, তার মধ্যে অপণ্ডিতের ভাগই বেশি। পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত ভাষার ছাঁচে ঢালাই করলেন সেটা হল অত্যন্ত আড়ষ্ট। বিশুদ্ধভাবে সমস্ত তার বাঁধাবাঁধি– সেই বাঁধন তার নিজের নিয়মসংগত নয়– তার ষত্ব ণত্ব সমস্তই সংস্কৃত ভাষার ফরমাসে। সে হঠাৎ বাবুর মতো প্রাণপণে চেষ্টা করে নিজেকে বনেদী বংশের বলে প্রমাণ করতে। যারা এই কাজ করে তারা অনেক সময়েই প্রহসন অভিনয় করতে বাধ্য হয়। কর্নেলে গবর্নরে পণ্ডিতি করে মূর্ধন্য ণ লাগায়, সোনা পান চুনে তো কথাই নেই।
এমন সময়ে সাহিত্যে সর্বসাধারণের অকৃত্রিম গদ্য দেখা দিল। তার শব্দ প্রভৃতির মধ্যে যে অংশ সংস্কৃত সে অংশে সংস্কৃত অভিধান-ব্যাকরণের প্রভুত্ব মেনে নিতে হয়েছে– বাকি সমস্তটা তার প্রাকৃত, সেখানে বানান প্রভৃতি সম্বন্ধে পাকা নিয়ম গড়ে ওঠে নি। হতে হতে ক্রমে সেটা গড়ে উঠবে সন্দেহ নেই। হিন্দী ভাষায় গড়ে উঠেছে– কেননা, এখানে পণ্ডিতির উৎপাত ঘটে নি, সেইজন্যেই হিন্দী পুঁথিতে “শুনি’ অনায়াসেই “সুনি’ মূর্তি ধরে লজ্জিত হয় নি। কিন্তু শুনছি বাংলার দেখাদেখি সম্প্রতি সেখানেও লজ্জা দেখা দিতে আরম্ভ করেছে, ওরাও জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে বসেছে আর কি! প্রাচীনকালে যে পণ্ডিতেরা প্রাকৃত ভাষা লিপিবদ্ধ করেছিলেন ভাষার প্রাকৃতত্ব সম্বন্ধে বাঙালিদের মতো তাঁদের এমন লজ্জাবোধ ছিল না।
এখন এ সম্বন্ধে বাংলায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম চলছে– নানা লেখকে মিলে ঠেলাঠেলি করতে করতে একটা কিছু দাঁড়িয়ে যাবে, আশা করা যায়। অন্তত এ কাজটা আমাদের নয়, এ সুনীতিকুমারের দলের। বাংলা ভাষাকে বাংলা ভাষা বলে স্বীকার করে তার স্বভাবসংগত নিয়মগুলি তাঁরাই উদ্ভাবন করে দিন। যেহেতু সম্প্রতি বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষাকে যথোচিত সম্মানের সঙ্গে স্বীকার করে নেবার প্রস্তাব হয়েছে সেই কারণে টেক্স্টবুক প্রভৃতির যোগে বাংলার বানান ও শব্দ প্রয়োগরীতির সংগত নিয়ম স্থির করে দেবার সময় হয়েছে। এখন স্থির করে দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবে সাধারণের মধ্যে সেটা চলে যাবে। নইলে কেন্দ্রস্থলে কোনো শাসন না থাকলে ব্যক্তিবিশেষের যথেচ্ছাচারকে কেউ সংযত করতে পারবে না। আজকাল অনেকেই লেখেন “ভেতর’ “ওপর’ “চিবুতে’ “ঘুমুতে’, আমি লিখি নে, কিন্তু কার বিধানমতে চলতে হবে। কেউ কেউ বলেন প্রাকৃত বাংলা ব্যবহারে যখন এত উচ্ছৃঙ্খলতা তখন ওটাকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে পণ্ডিতি বাংলার শরণ নেওয়াই নিরাপদ। তার অর্থ এই যে, মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করার চেয়ে কাঠের পুতুলের সঙ্গে ব্যবহারে আপদ কম। কিন্তু এমন ভীরু তর্কে সাহিত্য থেকে আজ প্রাকৃতবাংলার ধারাকে নিবৃত্ত করার সাধ্য কারো নেই। সোনার সীতাকে নিয়ে রামচন্দ্রের সংসার চলে নি। নিকষ এবং তৌলদণ্ডের যোগে সেই সীতার মূল্য পাকা করে বেঁধে দেওয়া সহজ, কিন্তু সজীব সীতার মূল্য সজীব রামচন্দ্রই বুঝতেন, তাঁর রাজসভার প্রধান স্বর্ণকার বুঝতেন না, কোষাধ্যক্ষও নয়। আমাদের প্রাকৃত বাংলার যে মূল্য, সে সজীব প্রাণের মূল্য, তার মর্মগত তত্ত্বগুলি বাঁধা নিয়ম আকারে ভালো করে আজও ধরা দেয় নি বলেই তাকে দুয়োরানীর মতো প্রাসাদ ছেড়ে গোয়ালঘরে পাঠাতে হবে, আর তার ছেলেগুলোকে পুঁতে ফেলতে হবে মাটির তলায়, এমন দণ্ড প্রবর্তন করার শক্তি কারো নেই। অবশ্য যথেচ্ছাচার না ঘটে, সেটা চিন্তা করবার সময় হয়েছে সে কথা স্বীকার করি। আমি একসময় সুনীতিকুমারকে প্রাকৃত বাংলার অভিধান বানাতে অনুরোধ করেছিলুম, সেই উপলক্ষে শব্দবিজ্ঞানের নিয়ম অনুসরণ করে বানান যদি বেঁধে দেন তবে বিষয়টাকে মীমাংসার পথে আনা যেতে পারে। এ কাজে হাত লাগাবার সময় হয়েছে সন্দেহ নেই।
৬ শ্রাবণ, ১৩৩৯
বাদানুবাদ
গতবারকার শান্তিনিকেতন পত্রের “বাংলা কথ্যভাষা” ও “অনুবাদ-চর্চা”-র দুইটি অংশের প্রতিবাদ করিয়া শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নিম্নলিখিত পত্রটি পাঠাইয়াছেন।
“আশ্বিনের শান্তিনিকেতনে “বাংলা কথ্য-ভাষা’ নামক প্রবন্ধে লেখক বলিয়াছেন “বাংলায় দুই অক্ষরের বিশেষণমাত্রই স্বরান্ত।’ কিন্তু ইহার ব্যত্যয় আছে যথা– বদ, সব, লাল, নীল, পীত, টক, বেশ, শেষ, মূল, ভুল, খুব ইত্যাদি।
“হসন্ত সম্বন্ধে পাগল্-পাগলা, আপন-আপ্নি ইত্যাদি নিয়মেরও ব্যতিক্রম আছে; যথা দরদ্-দরদী, এ কথাটা পারসী কিন্তু হজম্-হজ্মিও পারসী। তার পর “দরদী” কথাটা ত আর পারসী নয়– ওটা যখন বাংলা তখন বাংলার নিয়মে এর উচ্চারণ হওয়া উচিত ছিল।
” “অনুবাদচর্চা’ প্রবন্ধের “এবং’ শব্দের ব্যবহারনির্দেশক নিয়ম সম্বন্ধে সন্দেহ হইতেছে। “তাঁর অনেক শত্রু আছে এবং তারা সকলেই শক্তিশালী’ আমার ত মনে হয় এরূপ প্রয়োগ বাংলায় বেমানান হয় না। তার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই যে, যে-বাক্যটির অনুবাদ আলোচনা করিতে গিয়া লেখক “এবং’-এর নিয়ম নির্দেশ করিয়াছেন তার লেখককৃত তর্জমাতেই ইহার ব্যতিক্রম আছে– যথা “এমন অনেক জাতীয় পাখি আছে যাহাদের যুদ্ধোপকরণ এবং অভ্যাস সকল কীট আক্রমণের পক্ষে বিশেষ উপযোগী এবং যাহারা কীট শিকারেই সমস্ত জীবন যাপন করে’, এখানে শেষের এবংটি “হয়’ ও “করে’ এই দুই ভিন্ন ক্রিয়াকে যোগ করিতেছে।”
এই প্রতিবাদ সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য নিম্নে লিখিলাম।
দুই অক্ষরের বিশেষণ শব্দ কোনো কোনো স্থলে স্বরান্ত হয় না তাহা আমি মানি– কিন্তু আমাদের ভাষায় তাহার সংখ্যা অতি অল্প। লেখক তাহার উদাহরণে “পীত’ শব্দ ধরিয়া দিয়াছেন। প্রথমত, ঐ শব্দ চলিত ভাষায় ব্যবহৃত হয় না। দ্বিতীয়ত যেখানে হইয়াছে সেখানে উহা হসন্ত নহে। যেমন “পীত ধড়া’। কখনোই “পীৎ-ধড়া’ বলা হয় না। “পীৎ-বর্ণ’, কেহ কেহ বলেন, কিন্তু পীত-বর্ণ’ই বেশির ভাগ লোকে বলিয়া থাকেন। লেখক যে-কয়টি শব্দের তালিকা দিয়াছেন তাহা ছাড়া, বোধ করি কেবল নিম্নলিখিত শব্দগুলিই নিয়মের বাহিরে পড়ে : বীর, ধীর, স্থির, সৎ, ঠিক, গোল, কাৎ, চিৎ, আড়। সংখ্যাবাচক এক, তিন, চার প্রভৃতি শব্দকে যদি বিশেষণ বলিয়া গণ্য করিতে হয় তবে এগুলি অনিয়মের ফর্দটাকে খুব মোটা করিয়া তুলিবে। এই প্রসঙ্গে এ কথা মনে রাখা দরকার “এক’ যেখানে বিশেষভাবে বিশেষণরূপ ধারণ করিয়াছে সেখানে তাহা “একা’ হইয়াছে।
“তিন অক্ষরের বাংলা শব্দ স্বরান্ত হইলে মাঝের অক্ষর আপন অকার বর্জন করে,” লেখক এই নিয়মের একটিমাত্র ব্যতিক্রমের উদাহরণ সংগ্রহ করিয়াছেন, “দরদী’। শব্দটির উচ্চারণ সম্বন্ধে সন্দেহ আছে। “হম্-দর্দী’ কথায় “র’য়ের অকার লুপ্ত। যাহাই হউক এই নিয়মের ব্যতিক্রম আছে বৈকি। যথা, সজনি, বচসা, গরবী, করলা (ফল)। উপসর্গ-বিশিষ্ট শব্দেও এ নিয়ম খাটে না। যেমন, বে-তরো, দো-মনা, অ-ফলা। বলা বাহুল্য খাঁটি সংস্কৃত বাংলায় চলিত থাকিলেও এ নিয়ম মানে না; যেমন, মালতী, রমণী, চপলা ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে বাংলার উচ্চারণ-বিকারের একটা নিয়ম উল্লেখ করা যাইতেছে। অনেক স্থলে তিন অক্ষরের স্বরান্ত শব্দে মধ্য অক্ষরের অকার লুপ্ত না হইয়া উকার হইয়া যায়। কাঁদন কাঁদুনে, আট-পহর আটপহুরে (আটপৌরে), শহর শহুরে, পাথর পাথুরে, কোঁদল কুঁদুলে ইত্যাদি।
২
অনধিকারচর্চায় অব্যবসায়ীর যে বিপদ ঘটে আমারও তাই ঘটিয়াছে। গত আশ্বিন-কার্তিকের শান্তিনিকেতন পত্রে “বাংলা কথ্যভাষা’ “অনুবাদ-চর্চা’ প্রভৃতি কয়েকটা প্রবন্ধে নিতান্তই প্রসঙ্গক্রমে বাংলা ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করিয়াছিলাম। প্রবাসী তাহা উদ্ধৃত করিয়া দেওয়াতে আমার অজ্ঞানকৃত ও অসাবধানকৃত কতকগুলি ভুল বাহির হইয়া পড়িয়াছে, এই উপলক্ষে সেগুলি সংশোধন হইবার সুযোগ হইল বলিয়া আমি কৃতজ্ঞ আছি। শ্রীযুক্ত বিজয়চন্দ্র মজুমদার মহাশয় বাংলা ভাষার ব্যবহারে সাহিত্য-রসিক। আবার তাহার নাড়ী-পরিচয়ে বৈজ্ঞানিক; এইজন্য, তিনি আমার যে ত্রুটি ধরিয়াছেন সাধারণের কাছে তাহা প্রকাশ করা উচিত।
বিজয়বাবু বলেন, “কর্তৃকারকের’ “এ’ কর্তা ও করণের খিচুড়ি হইতে উৎপন্ন বলিয়া মনে হয় না। এক সময়ে প্রাকৃত ভাষার গ্রন্থে সকল কর্তৃকারকের পদ-ই “এ’ দিয়া চিহ্নিত পাই; “মহাবীর বলিলেন’ এইরূপ কথাতে “মহাবীরে’ পাই। এই প্রাকৃতের পূর্ববর্তী প্রাকৃতে দেখিতে পাই যে, একবচনে বেশির ভাগ ওকার চলিয়াছে; ও অল্প পরেই আবার ওকার ও আকার এই উভয় স্থলেই এক একার পাই, ও এই একারটি শেষে কেবল একবচনেই ব্যবহৃত হইয়াছে। উন্নতিশীল বা পরিবর্তনশীল মধ্যবাংলায় ভাষার যত পরিবর্তন ঘটিয়াছে, দূরপ্রদেশে ততটা ঘটে নাই; এখনো রংপুরের প্রাদেশিক ভাষায় কর্তৃকারকে সর্বত্রই একার ব্যবহৃত হয়, আসামের ভাষাতেও উহা রহিয়াছে। একটা প্রাচীন প্রাকৃত হইতেই বাংলা ও ওড়িষ্যার জন্ম; ওড়িয়া ভাষায় এখনো সুনির্দিষ্ট একজন লোকের নাম কর্তৃকারকে একার আছে; একজন নির্দিষ্ট পণ্ডিত বলিলেন যে তিনি আসিতে পারিবেন না, এ কথায় ওড়িয়াতে “পণ্ডিতে কহিলে’ ইত্যাদি চলিয়া থাকে। একজন নির্দিষ্ট গোয়ালাকে লক্ষ্ণণ আংটির বিনিময়ে দুধ চাহিয়াছিলেন, সেই গোয়ালা যেভাবে তাহার অসম্মতি জানাইয়াছিল, তাহা পুঁথিতে এইরূপে লিখিত আছে– “গউড়ে বইলে গছে মুদি ফলি থাএ।”
বিজয়বাবু কর্তৃকারকের এ চিহ্ন সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহা আমি স্বীকার করিয়া লইলাম। আমার পূর্ব মন্তব্যের বিরুদ্ধ কয়েকটা দৃষ্টান্ত আমার মনে পড়িতেছে। যথা “তার অদ্ভুত ব্যবহারে লোকে হাসে” এখানে হাসে ক্রিয়া অকর্মক। “সবায় (সবাই) কোমর বেঁধে দাঁড়াল” ইহাও অকর্মক। এই সবায় বা সবাই শব্দ প্রাচীন পুঁথিতে “সভাএ’ লিখিত হয়, বস্তুত ইহা এ-যুক্ত কর্তৃকারকেরই দৃষ্টান্ত।
হর্নলি প্রভৃতি ভাষাতত্ত্ববিৎ কর্তৃকারকের একার-যুক্ত রূপকে তির্যক্রূপ (oblique form) বলেন। অর্থাৎ ইহাতে শব্দটিকে কেমন যেন আড় করিয়া ধরা হয়। বাংলায় সম্বন্ধ কারকের “র’ চিহ্ন অনেক স্থলেই বিশেষ্য পদের এই তির্যক্রূপের সহিত যুক্ত হয়, যথা, রামের, কানাই-এর; বহুবচনের “রা’ চিহ্ন সম্বন্ধেও সেই নিয়ম, যথা, রামেরা, ভাইএরা ইত্যাদি।
আমি লিখিয়াছিলাম, কর্মকারকে অপ্রাণীবাচক শব্দের উত্তর টা টি যোগ না করিলে তাহার সঙ্গে “কে’-চিহ্ন বসে না। বিজয়বাবু তাহার ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্ত দিয়াছেন– “গাছকে ওড়িশায় গছ বলে”, “অনেক লোকে আকাশকে চাঁদোয়ার মত পদার্থ মনে করে।”
প্রবাসীর একজন কবিরাজ পাঠক “বাংলা কথ্যভাষা প্রবন্ধে আমার একটি বাক্য-ত্রুটি নির্দেশ করিয়াছেন। আমি লিখিয়াছিলাম “বাংলায় যে অসংযুক্ত শব্দের পূর্বে স্বরবর্ণ ও পরে ব্যঞ্জনবর্ণ আছে সে শব্দ নিজের অকার বর্জন করে।” এই বাক্যে অনেকগুলি অদ্ভুত ভুল রহিয়া গিয়াছে। কবিরাজ মহাশয়ের নির্দেশমত আমি তাহা সংশোধন করিলাম– “বাংলায় তিন অক্ষরের শব্দের অন্ত অক্ষরের সহিত যদি স্বর থাকে তবে মধ্যবর্তী বর্ণের অকার বর্জিত হয়, যেমন, পাগ্লা গর্মি ইত্যাদি। কবিরাজ মহাশয় “বচসা, জটলা, দরজা, খামকা, ঝরকা” ইত্যাদি কয়েকটি ব্যাভিচারের দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন। অগ্রহায়ণের শান্তিনিকেতন পত্রে আমরাও এরূপ দৃষ্টান্ত কয়েকটি দিয়াছি।
কবিরাজ মহাশয় বলেন যে, যদিচ আমরা বলি না, “লোকগুলাতে নিন্দা করে” কিন্তু “সব লোকে নিন্দা করে” বলা চলে। অতএব কর্তৃকারকে একার প্রয়োগ কেবল এক-বচনেই চলে এমন কথা জোর দিয়া বলা ঠিক নয়।
কর্মকারকে অপ্রাণীবাচক শব্দের উত্তর সাধারণত “কে” চিহ্ন বসে না, কিন্তু পরে “টা’ বা “টি’ থাকিলে বসে, আমি এই নিয়মের উল্লেখ করিয়াছিলাম। কিন্তু আমার ভাষা-প্রয়োগের দোষে কবিরাজ মহাশয় মনে করিয়াছেন যে আমার মতে “টা’ “টি’ বিশিষ্ট শব্দ কর্মকারকে নির্বিশেষে “কে’ চিহ্ন গ্রহণ করে। এইজন্য তিনি কয়েকটি বিরুদ্ধ দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন যথা, “আগুনের তেজটা দেখ” “তরকারিটা খাওয়া গেল না।” ইত্যাদি।
কবিরাজ মহাশয় আমার বাক্যরচনায় যে শৈথিল্য নির্দেশ করিয়াছেন আমি কৃতজ্ঞতার সহিত সেই ত্রুটি স্বীকার করিতেছি।
কয়েকটি প্রতিশব্দ সম্বন্ধে তিনি যাহা বলেন তাহা চিন্তার যোগ্য। “যে রোগ পিতামাতা হইতে পুত্রপৌত্রে যায়” তাহাকে আয়ুর্বেদে “সঞ্চারিরোগ’ বলে। Heredity কুলসঞ্চারিতা, inherited কুলসঞ্চারী বলিলে হয় না? আয়ুর্বেদে নাছোড়বান্দার একটি ঠিক সংস্কৃত প্রতিশব্দ আছে– “অনুষঙ্গী’।
অগ্রহায়ণ, ১৩২৬
বানান-প্রসঙ্গ
১
পত্রিকায় চণ্ডিদাসের যে নূতন পদাবলী প্রকাশিত হইতেছে তাহা বহুমূল্যবান। … সম্পাদক মহাশয় আদর্শ পুঁথির বানান সংশোধন করিয়া দেন নাই সেজন্য তিনি আমাদের ধন্যবাদভাজন। প্রাচীন গ্রন্থসকলের যে-সমস্ত মুদ্রিত সংস্করণ আজকাল বাহির হয় তাহাতে বানান-সংশোধকগণ কালাপাহাড়ের বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহারা সংস্কৃত বানানকে বাংলা বানানের আদর্শ কল্পনা করিয়া যথার্থ বাংলা বানান নির্বিচারে নষ্ট করিয়াছেন; ইহাতে ভাষাতত্ত্বজিজ্ঞাসুদিগের বিশেষ অসুবিধা ঘটিয়াছে। বর্তমান-সাহিত্যের বাংলা বহুলপরিমাণে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদিগের উদ্ভাবিত বলিয়া বাংলা বানান, এমন-কি, বাংলাপদবিন্যাস প্রণালী তাহার স্বাভাবিক পথভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে, এখন তাহাকে স্বপথে ফিরাইয়া লইয়া যাওয়া সম্ভবপর নহে। কিন্তু আধুনিক বাংলার আদর্শে যাঁহারা প্রাচীন পুঁথি সংশোধন করিতে থাকেন তাঁহারা পরম অনিষ্ট করেন।
১৩০৫
২
বানান লইয়া কয়েকটি কথা বলিতে ইচ্ছা করি। রাঙা ভাঙা ডাঙা আঙুল প্রভৃতি শব্দ ঙ্গ-অক্ষরযোগে লেখা নিতান্তই ধ্বনিসংগতিবিরুদ্ধ। গঙ্গা শব্দের সহিত রাঙা, তুঙ্গ শব্দের সহিত ঢ্যাঙা তুলনা করিলে এ কথা স্পষ্ট হইবে। মূল শব্দটিকে স্মরণ করাইবার জন্য ধ্বনির সহিত বানানের বিরোধ ঘটানো কর্তব্য নহে। সে নিয়ম মানিতে হইলে চাঁদকে চান্দ, পাঁককে পঙ্ক, কুমারকে কুম্ভার লিখিতে হয়। অনেকে মূলশব্দের সাদৃশ্যরক্ষার জন্য সোনাকে সোণা, কানকে কাণ বানান করেন, অথচ শ্রবণশব্দজ শোনাকে শোণা লেখেন না। যে-সকল সংস্কৃত শব্দ অপভ্রংশের নিয়মে পুরা বাংলা হইয়া গেছে সেগুলির ধ্বনি অনুযায়িক বানান হওয়া উচিত। প্রাকৃতভাষার বানান ইহার উদাহরণস্থল। জোড়া, জোয়ান, জাঁতা, কাজ প্রভৃতি শব্দে আমরা স্বাভাবিক বানান গ্রহণ করিয়াছি, অথচ অন্য অনেক স্থলে করি নাই। [সাহিত্য-পরিষৎ] পত্রিকা-সম্পাদকমহাশয় বাংলা বানানের নিয়ম সম্বন্ধে আলোচনা উত্থাপন করিলে আমরা কৃতজ্ঞ হইব।
১৩০৮
৩
টেক্সট্বুক্ কমিটি ক্ষকারকে বাংলা বর্ণমালা হইতে নির্বাসন দিয়াছেন। শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ অনেক পুরাতন নজির দেখাইয়া ক্ষকারের পক্ষে ওকালতি করিয়াছেন। অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের দলে ক্ষ কেমন করিয়া প্রথমে প্রবেশ করিয়াছিল জানি না। কিন্তু সে সময়ে দ্বাররক্ষক যে সতর্ক ছিল, তাহা বলিতে পারি না। আধুনিক ভারতবর্ষীয় আর্যভাষায় মূর্ধন্য ষ-এর উচ্চারণ খ হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং ক্ষকারে মূর্ধন্য ষ-এর বিশুদ্ধ উচ্চারণ ছিল না। না থাকিলেও উহা যুক্ত অক্ষর এবং উহার উচ্চারণ ক্খ। শব্দের আরম্ভে অনেক যুক্ত অক্ষরের যুক্ত উচ্চারণ থাকে না, যেমন জ্ঞান শব্দের জ্ঞ; কিন্তু অজ্ঞ শব্দে উহার যুক্ত উচ্চারণ সম্বন্ধে সন্দেহ থাকে না। ক্ষকারও সেইরূপ– ক্ষয় এবং অক্ষয় শব্দের উচ্চারণে তাহা প্রমাণ হইবে। অতএব অসংযুক্ত বর্ণমালায় ক্ষকার দলভ্রষ্ট একঘরে; তাহাতে সন্দেহ নাই। সেই ব্যঞ্জনপঙ্ক্তির মধ্যে উহার অনুরূপ সংকরবর্ণ আর একটিও নাই। দীর্ঘকালের দখল প্রমাণ হইলেও তাহাকে আরো দীর্ঘকাল অন্যায় অধিকার রক্ষা করিতে দেওয়া উচিত কি।
১৩০৮
৪
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সংকলনে আপনারা বানানের যে রীতি বেঁধে দিয়েছেন আমি তাহার সমর্থন করি। ব্যবহারকালে নিয়মের কিছু কিছু পরিবর্তন অনিবার্য হতে পারে। এইজন্যে বছর দুয়েক পরে পুনঃসংশোধন প্রয়োজন হবে বলে মনে করি।
য়ুরোপীয় লিখিত ভাষা থেকে লিপ্যন্তরকালে অকারবর্গীয় স্বরবর্ণের বাংলারূপ নিয়ে আপনারা আলোচনা করেছেন। বিশেষ চিহ্নযোগ না করে সকল স্থানে এই উচ্চারণ বিশুদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। বক্র আ বোঝাবার জন্যে আপনারা বিশেষ চিহ্ন স্বীকার করেছেন কিন্তু বাংলায় অপ্রচলিত বিকৃত অকারের কোনো চিহ্ন স্বীকার করেন নি। কষৎন শব্দকে লভ্ লিখলে হাস্যোদ্রেক করবে, লাভ লিখলেও যথাযথ হবে না। apathy, recur, such প্রভৃতি শব্দের চিহ্নিত ধ্বনিগুলিকে কি বাংলা অকার দিয়ে ব্যবহার করা চলবে। অপথি এবং অপথিকরি কি একই বানানে চালানো যাবে এবং অক্ষরের কোন্ প্রতিলিপি আপনারা স্থির করেছেন জানি নে। আমার মতে অন্ত্যস্থ ব, এবং অন্ত্যস্থ ভ। award এবং averse বানানে দুই পৃথক অক্ষরের প্রয়োজন। সম্ভবত আপনারা এ সমস্তই আলোচনা করে স্থির করে দিয়েছেন।
কিন্তু প্রবাসী পত্রিকায় আপনি যে প্রবন্ধ পাঠিয়েছেন তার মধ্যে আমি একটি গুরুতর অভাব দেখলেম। বর্তমান বাংলাসাহিত্যে প্রাকৃত বাংলার ব্যবহার ব্যাপকভাবেই চলেছে আমার এই চিঠিখানি তার একটি প্রমাণ। অন্তত চিঠিলেখায় সংস্কৃত বাংলা প্রায় উঠে গেছে বলেই আমার বিশ্বাস। বাংলা গদ্যসাহিত্যে এই প্রাকৃত ভাষার ব্যাপ্তি অনেকের কাছে রুচিকর না হতে পারে কিন্তু একে উপেক্ষা করা চলবে না। এর বানানরীতি নির্দিষ্ট করে দেবার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকদিন আমি অনুরোধ করেছি। প্রাচীনকালে যখন প্রাকৃত ভাষা সাহিত্যে গৃহীত হল তখন তার বানানে বা ব্যাকরণে যথেচ্ছাচার অনুমোদিত হয় নি, হলে এ ভাষার সাহিত্য গড়তে পারত না। সিটি কলেজের বাংলা অধ্যাপক শ্রীযুক্ত বিজনবিহারী ভট্টাচার্য কিছুকালের জন্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশক্রমে বাংলাভাষাসংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে আমার এখানে কাজ করতেন। ভিন্ন ভিন্ন বাংলা গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন লেখক প্রাকৃত বাংলারচনায় বানানের যেরকম নানা বিচিত্র বিসদৃশ ব্যবহার করেছেন তার তালিকা প্রস্তুত করতে তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেম। আমার ইচ্ছা ছিল এই তালিকা অবলম্বন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাকৃত বাংলা বানানের নিয়ম বেঁধে দেবেন। সকলেই জানেন প্রাকৃত বাংলায় সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার বানান আজকাল উচ্ছৃঙ্খলভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে– আমিও এ সম্বন্ধে অপরাধী। অপেক্ষা করে আছি প্রাকৃত বাংলার এই বানান ব্যাপারে আমার মতো পথহারাদের জন্যে বিদ্যাবিধানের কর্তৃপক্ষ পাকা রাস্তা বেঁধে দেবেন। এ সম্বন্ধে আর তাঁরা উদাসীন থাকতে পারেন না যেহেতু বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে প্রাকৃত বাংলার প্রবেশ তাঁরা নিষেধ করতে পারবেন না। প্রশ্নপত্রের উত্তরে পরীক্ষার্থীরা প্রাকৃত বাংলা অবলম্বন করতে পারে এমন অধিকার তাঁরা দিয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষক নিজেদের বিশেষ রুচি ও অভ্যাস-অনুসারে ছাত্রদের বানান প্রভৃতির যদি বিচার করেন তবে পরীক্ষার্থীদের প্রতি গুরুতর অবিচারের আশঙ্কা আছে– নির্বিচারে যথেচ্ছাচারের প্রশ্রয় দেওয়াও চলবে না।
এই গুরুতর বিষয় প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার উপযোগী আমার শরীরের অবস্থা নয়। সংক্ষেপে আমার বক্তব্যের আভাসমাত্র দিলেম।
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫
৫
প্রাকৃত বাংলার বানান সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত কোনো চরম অভ্যাসে আসতে পারি নি। তাড়াতাড়িতে অমনোযোগ তার একটি কারণ। তা ছাড়া বই ছাপাবার সময় প্রুফ দেখার সম্যক ভার নিজে নেবার মতো ধৈর্য বা শক্তি বা সময় নেই– কাজেই আমার ছাপা বইগুলিতে বানান সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টতার পরিচয় পাওয়া যায় না। এই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য দাবি করেছিলুম। তাঁরা দশে মিলে যেটা স্থির করে দেবেন সেটা নিয়ে আর দ্বিধা করব না।
১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৬
৬
আমাদের সাহিত্যে প্রাকৃত বাংলার প্রচলন প্রতিদিন বেড়ে উঠেছে। সেই বাংলায় বানান সম্বন্ধে কোনো আইন নেই, তাই স্বেচ্ছাচারের অরাজকতা চলেছে। যারা হবেন প্রথম আইনকর্তা তাঁদের বিধান অনিন্দনীয় হতেই পারে না, তবু উচ্ছৃঙ্খলতার বাঁধ বেঁধে দেবার কাজ তো শুরু করতেই হবে। সেইজন্যে বিশ্ববিদ্যালয়েরই শরণ নিতে হল। কালক্রমে তাঁদের নিয়মের অনেক পরিবর্তন ঘটবে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই পরিবর্তনের গতি একটা সুচিন্তিত পথ অনুসরণ যদি না করে তা হলে অব্যবস্থার অন্ত থাকবে না। নদীর তট বাঁধা আছে তবু তার বাঁক পরিবর্তন হয়, কিন্তু তট না থাকলে তার নদীত্বই ঘুচবে, সে হবে জলা।
আমার প্রদেশের নাম আমি লিখি বাংলা। হসন্ত ঙ-র চিহ্ন ং। যেমন হসন্ত ত-য়ের চিহ্ন ৎ। “বাঙ্গলা” মুখে বলি নে লিখতেও চাই নে। যুক্তবর্ণ ঙ্গ-এ হসন্ত চিহ্ন নিরর্থক। ঙ-র সঙ্গে হসন্ত চিহ্ন দেওয়া চলে, কিন্তু দরকার কী, হসন্ত চিহ্ন যুক্ত ঙ-র স্বকীয়রূপ তো বর্ণমালায় আছে– সেই অনুস্বরকে আমি মেনে নিয়ে থাকি।
৬ জৈষ্ঠ্য, ১৩৪৩
৭
শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে লেখায় চিহ্ন বর্জন সম্বন্ধে আমার মত প্রকাশ করেছি। নিত্য-ব্যবহারে আমার এ মত চলবে না তা জানি। এটা একটা আলোচনার বিষয় মাত্র। চিহ্নগুলোর প্রতি অতিমাত্র নির্ভরপরতা অভ্যস্ত হলে ভাষায় আলস্যজনিত দুর্বলতা প্রবেশ করে এই আমার বিশ্বাস। চিহ্নসংকেতের সহায়তা পাওয়া যাবে না এ কথা যদি জানি তবে ভাষার আপন সংকেতের দ্বারাতেই তাকে প্রকাশবান করতে সতর্ক হতে পারি; অন্তত আজকাল ইংরেজির অনুকরণে, লিখিত ভাষাগত ইঙ্গিতের জন্যে চিহ্নসংকেতের অকারণ বাড়াবাড়ি সংযত হতে পারে। এই চিহ্নের প্রশ্রয় পেয়ে পাঠসম্বন্ধে পাঠকদেরও মন পঙ্গু হয় প্রকাশ-সম্বন্ধে লেখকদেরও তদ্রূপ। কোনো কোনো মানুষ আছে কথাবার্তায় যাদের অঙ্গভঙ্গি অত্যন্ত বেশি। সেটাকে মুদ্রাদোষ বলা যায়। বোঝা যায় লোকটার মধ্যে সহজ ভাবপ্রকাশের ভাষাদৈন্য আছে। কিন্তু কথার সঙ্গে ভঙ্গি একেবারে চলবে না এ কথা বলা অসংগত তেমনি লেখার সঙ্গে চিহ্ন সর্বত্রই বর্জনীয় এমন অনুশাসনও লোকে মানবে না।
৩|৩|৩৭
৮
প্রাকৃত বাংলার বানান সম্বন্ধে আমার একটা বক্তব্য আছে। ইংরেজি ভাষার লিখিত শব্দগুলি তাদের ইতিহাসের খোলস ছাড়তে চায় না– তাতে করে তাদের ধ্বনিরূপ আচ্ছন্ন। কিন্তু ভারতবর্ষে প্রাকৃত এ পথের অনুসরণ করে নি। তার বানানের মধ্যে অবঞ্চনা আছে, সে যে প্রাকৃত, এ পরিচয় সে গোপন করে নি। বাংলা ভাষার ষত্বণত্বের বৈচিত্র্য ধ্বনির মধ্যে নেই বললেই হয়। সেই কারণে প্রাচীন পণ্ডিতেরাও পুঁথিতে লোকভাষা লেখবার সময় দীর্ঘহ্রস্ব ও ষত্বণত্বকে সরল করে এনেছিলেন। তাঁদের ভয় ছিল না পাছে সেজন্য তাঁদের কেউ মূর্খ অপবাদ দেয়। আজ আমরা ভারতের রীতি ত্যাগ করে বিদেশীর অনুকরণে বানানের বিড়ম্বনায় শিশুদের চিত্তকে অনাবশ্যক ভারগ্রস্ত করতে বসেছি।
ভেবে দেখলে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ একেবারেই নেই। যাকে তৎসম শব্দ বলি উচ্চারণের বিকারে তাও অপভ্রংশ পদবীতে পড়ে। সংস্কৃত নিয়মে লিখি সত্য কিন্তু বলি শোত্তো। মন শব্দ যে কেবল বিসর্গ বিসর্জন করেছে তা নয় তার ধ্বনিরূপ বদলে সে হয়েছে মোন্। এই যুক্তি অনুসারে বাংলা বানানকে আগাগোড়া ধ্বনি-অনুসারী করব এমন সাহস আমার নেই– যদি বাংলায় কেমাল পাশার পদ পেতুম তা হলে হয়তো এই কীর্তি করতুম– এবং সেই পুণ্যে ভাবীকালের অগণ্য শিশুদের কৃতজ্ঞতাভাজন হতুম। অন্তত তদ্ভব শব্দে যিনি সাহসে দেখিয়ে ষত্বণত্ব ও দীর্ঘহ্রস্বের পণ্ডপাণ্ডিত্য ঘুচিয়ে শব্দের ধ্বনিস্বরূপকে শ্রদ্ধা করতে প্রবৃত্ত হবেন তাঁর আমি জয়জয়কার করব। যে পণ্ডিতমূর্খরা “গভর্ণমেন্ট্” বানান প্রচার করতে লজ্জা পান নি তাঁদেরই প্রেতাত্মার দল আজও বাংলা বানানকে শাসন করছেন– এই প্রেতের বিভীষিকা ঘুচবে কবে? কান হোলো সজীব বানান, আর কাণ হোলো প্রেতের বানান এ কথা মানবেন তো? বানান সম্বন্ধে আমিও অপরাধ করি অতএব আমার নজীর কোনো হিসাবে প্রামাণ্য নয়।
১১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৩১
৯
নীচ শব্দ সংস্কৃত, তাহার অর্থ Mean। বাংলায় যে “নিচে” কথা আছে তাহা ক্রিয়ার বিশেষণ। সংস্কৃত ভাষার নীচ শব্দের ক্রিয়ার বিশেষণ রূপ নাই। সংস্কৃতে নিম্নতা বুঝাইবার জন্য নীচ কথার প্রয়োগ আছে কিনা জানি না। হয়তো উচ্চ নীচ যুগ্মশব্দে এরূপ অর্থ চলিতে পারে– কিন্তু সে স্থলেও যথার্থত নীচ শব্দের তাৎপর্য Moral তাহা Physical নহে। অন্তত আমার সেই ধারণা। সংস্কৃতে নীচ ও নিম্ন দুই ভিন্নবর্গের শব্দ– উহাদিগকে একার্থক করা যায় না। এইজন্য বাংলায় নীচে বানান করিলে below না বুঝাইয়া to the mean বুঝানোই সংগত হয়। আমি সেইজন্য “নিচে” শব্দটিকে সম্পূর্ণ প্রাকৃত বাংলা বলিয়াই স্বীকার করিয়া থাকি। প্রাচীন প্রাকৃতে বানানে যে রীতি আছে আমার মতে তাহাই শুদ্ধরীতি; ছদ্মবেশে মর্যাদাভিক্ষা অশ্রদ্ধেয়। প্রাচীন বাংলায় পণ্ডিতেরাও সেই নীতি রক্ষা করিতেন, নব্য পণ্ডিতদের হাতে বাংলা আত্মবিস্মৃত হইয়াছে।
“পুঁথি” শব্দের চন্দ্রবিন্দুর লোপে পূর্ববঙ্গের প্রভাব দেখিতেছি, উহাতে আমার সম্মতি নাই। “লুকাচুরি” শব্দের বানান “লুকোচুরি” হওয়াই সংগত; উহার স্বভাব নষ্ট করিয়া উহার মধ্যে কৃত্রিম ভদ্রভাব চালাইবার চেষ্টা সাধু নহে।
৯ অক্টোবর, ১৯৩৪
১০
বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-বিধির সম্বন্ধে দুটিমাত্র আপত্তি। কখনো কোনো আমারি তোমারি আজো প্রভৃতি শব্দে অন্তস্বর যুক্ত থাকিবে। দ্বিতীয়, ছোটো বড়ো কালো ভালো প্রভৃতি বিশেষণ পদের অন্তস্বর লোপ করা অবৈধ হবে বলে মনে করি।
৪|৬|৩৭
১১
হইয়ো, করিয়োতে “য়’ লাগিয়ো। রানীতে ঈ। গয়লানী প্রভৃতি শব্দে আমি দীর্ঘ ঈ দিই নে তার কারণ এ প্রত্যয় সংস্কৃত প্রত্যয় নয়। এক হিসাবে প্রাকৃত বাংলায় স্ত্রীলিঙ্গের প্রত্যয় নেই। আমরা বিড়ালীও বলি নে বেড়ালনীও বলি নে, কুকুরীও বাংলা নয়, কুকুরনীও নয়। বাঘিনী বলি, উটনী বলি নে। বাঘিনী সংস্কৃত ব্যাকরণ মতে শুদ্ধ নয়। বামনী বলি কিন্তু বদ্যিনী বলি নে, কায়েৎনী বলি। বস্তুত বাঘিনী ছাড়া কোনো জন্তু-শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ বাংলায় দুর্লভ। পাঁঠী আছে, ভেড়ী বলে কিনা জানি নে; হাঁস, কাক, পায়রা (মুরগী আছে) কোকিল দোয়েলে স্ত্রীলিঙ্গ প্রত্যয় বর্জিত। বাংলায় যদি সাধারণ কোনো প্রত্যয় থাকত তা হলে সর্বত্রই খাটত। এইজন্যে আমি বাংলা স্ত্রীজাতিসূচক কথাগুলিকে খাস বাংলা নিয়মেই ব্যবহার করতে চাই– খাস বাংলা হচ্ছে হ্রস্ব ই। সংস্কৃত ইন্প্রত্যয়ের যেখানে নকল করি সেখানেও আমার মন সায় দেয় না; যেমন ইংরেজি, ফারসি ইত্যাদি। তৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈ দিতে আমরা বাধ্য– কিন্তু তদ্ভব শব্দে আমাদের স্বরাজ খাটবে না কেন?
১৩|৬|৩৭
১৩০৫
বানান-বিধি
কিছুদিন পূর্বে ইংরেজি বানান সংস্কার সম্বন্ধে গিলবর্ট মারের একটি পত্র কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ইংরেজি ভাষার যেমন ক্রমশ পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি মাঝে মাঝে তার বানান সংস্কার ঘটেছে। সচল ভাষার অচল বানান অস্বাভাবিক। আধুনিক ইংরেজিতে আর-একবার বানান শোধনের প্রয়োজন হয়েছে এই তাঁর মত। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁরা একটি সভাও স্থাপন করেন।
ঠিক যে সময়ে বাংলা ভাষায় এই রকম চেষ্টার প্রবর্তন সেই সময়েই গিলবর্ট মারের এই চিঠিখানি পড়ে আমাকে ভাবিয়ে দিয়েছে। বস্তুত ভাবনা অনেক দিন থেকেই আমাকে পেয়ে বসেছিল, এই চিঠিতে আরো যেন একটু ধাক্কা দিল।
সুদীর্ঘকালের সাহিত্যিক ব্যবহারে ইংরেজি ভাষা পাকা হয়ে উঠেছে। এই ভাষায় বহুলক্ষ বই ছাপার অক্ষরে আত্মপ্রকাশ করেছে, তা ছাড়া ইস্কুলে য়ুনিভর্সিটিতে বক্তৃতামঞ্চে এই ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনার অন্ত নেই। উচ্চারণের অবস্থা যাই হোক সর্বত্রই এর বানানের সাম্য সুপ্রতিষ্ঠিত। যে ভাষার লিখিত মূর্তি দেশে কালে এমন পরিব্যাপ্ত তাকে অল্পমাত্র নাড়া দেওয়াও সহজ নয়, ghost শব্দের gost বানানের প্রস্তাবে নানা সমুদ্রের নানা তীর বাদে প্রতিবাদে কী রকম ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠতে পারে সে কথা কল্পনা করলে দুঃসাহসিকের মন স্তম্ভিত হয়। কিন্তু ও দেশে বাধা যেমন দূরব্যাপী, সাহসও তেমনি প্রবল। বস্তুত আমেরিকায় ইংরেজি ভাষার বানানে যে পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে তাতে কম স্পর্ধা প্রকাশ পায় নি।
মার্কিন দেশীয় বানানে through শব্দ থেকে তিনটে বেকার অক্ষর বর্জন করে বর্ণবিন্যাসে যে পাগলামির উপশম করা হল আমাদের রাজত্বে সেটা গ্রহণ করবার যদি বাধা না থাকত তা হলে সেইসঙ্গে বাঙালির ছেলের অজীর্ণ রোগের সেই পরিমাণ উপশম হতে পারত। কিন্তু ইংরেজ আচারনিষ্ঠ, বাঙালির কথা বলাই বাহুল্য। নইলে মাপ ও ওজন সম্বন্ধে যে দশমিক মাত্রা য়ুরোপের অন্যত্র স্বীকৃত হওয়াতে ভূরি পরিমাণ পরিশ্রম ও হিসাবের জটিলতা কমে গিয়েছে ইংলণ্ডেই তা গ্রাহ্য হয় নি, কেবলমাত্র সেখানেই তাপ পরিমাপে সেন্টিগ্রেডের স্থলে ফারেনহাইট অচল হয়ে আছে। কাজ সহজ করবার অভিপ্রায়ে আচারের পরিবর্তন ঘটাতে গেলে অভ্যাসে আসক্ত মনের আরামে যেটুকু হস্তক্ষেপ করা হয় সেটুকু ওরা সহ্য করতে পারে না। এই সম্বন্ধে রাজায় প্রজায় মনোভাবের সামঞ্জস্য দেখা যায়।
যা হোক, তবুও ও দেশে অযথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বুদ্ধির উৎসাহ দেখতে পাওয়া যায়। গিলবর্ট মারের মতো মনস্বীর প্রচেষ্টা তারই লক্ষণ।
সংস্কৃত বাংলা অর্থাৎ যাকে আমরা সাধুভাষা বলে থাকি তার মধ্যে তৎসম শব্দের চলন খুবই বেশি। তা ছাড়া সেই-সব শব্দের সঙ্গে ভঙ্গির মিল করে অল্প কিছুকাল মাত্র পূর্বে গড়-উইলিয়মের গোরাদের উৎসাহে পণ্ডিতেরা যে কৃত্রিম গদ্য বানিয়ে তুলেছেন তাতে বাংলার ক্রিয়াপদগুলিকে আড়ষ্ট করে দিয়ে তাকে যেন একটা ক্লাসিকাল মুখোশ পরিয়ে সান্ত্বনা পেয়েছেন; বলতে পেরেছেন, এটা সংস্কৃত নয় বটে, কিন্তু তেমনি প্রাকৃতও নয়। যা হোক, ওই ভাষা নিতান্ত অল্পবয়স্ক হলেও হঠাৎ সাধু উপাধি নিয়ে প্রবীণের গদিতে অচল হয়ে বসেছেন। অন্ধভক্তির দেশে উপাধির মূল্য আছে।
সৌভাগ্যক্রমে কিছুকাল থেকে প্রাকৃত বাংলা আচারনিষ্ঠদের পাহারা পার হয়ে গিয়ে সাহিত্যের সভায় নিজের স্বাভাবিক আসন নিতে পেরেছে। সেই আসনের পরিসর প্রতিদিন বাড়ছে, অবশেষে– থাক্, যা অনিবার্য তা তো ঘটবেই, সকল দেশেই ঘটেছে, আগেভাগে সনাতনপন্থীদের বিচলিত করে লাভ নেই।
এই হচ্ছে সময় যখন উচ্চারণের সঙ্গে মিল করে প্রাকৃত বাংলার বানান অপেক্ষাকৃত নিরাপদে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। আমাদের দেশের পূর্বতন আদর্শ খুব বিশুদ্ধ। বানানের এমন খাঁটি নিয়ম পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় আছে বলে জানি নে। সংস্কৃত ভাষা খুব সূক্ষ্ম বিচার করে উচ্চারণের প্রতি বানানের সদ্ব্যবহার রক্ষা করেছেন। একেই বলা যায় honesty, যথার্থ সাধুতা। বাংলা সাধুভাষাকে honest ভাষা বলা চলে না, মাতৃভাষাকে সে প্রবঞ্চনা করেছে।
প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা যখন লিপিবদ্ধ হয়েছে তখন সে যে ছদ্মবেশে সংস্কৃত ভাষা, পণ্ডিতেরা এমন অভিমান রাখেন নি; তাঁদের যথার্থ পাণ্ডিত্য প্রমাণ হয়েছে বানানের যাথার্থ্যে।
সেই সনাতন সদ্দৃষ্টান্ত গ্রহণ করবার উপযুক্ত সময় এসেছে। এখনো প্রাকৃত বাংলায় বানানের পাকা দলিল তৈরি হয় নি। এই সময়ে যদি উচ্চারণের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান রক্ষা করে বানানের ব্যবস্থা হতে পারত তা হলেও কোনো পক্ষ থেকেই নালিশ-ফরিয়াদের যে কোনো আশঙ্কা থাকত না তা বলি নে, কিন্তু তার ধাক্কা হত অনেক কম।
চিঠিপত্রে প্রাকৃত বাংলার ব্যবহার কিছুকাল পূর্বেও ছিল না, কিন্তু আমি যতটা প্রমাণ পেয়েছি তাতে বলতে পারি যে আজকাল এই ভাষা ব্যবহারের ব্যতিক্রম প্রায় নেই বললেই হয়। মেয়েদের চিঠি যা পেয়ে থাকি তাতে দেখতে পাই যে, উচ্চারণ রক্ষা করে বানান করাকে অপরাধের কোঠায় গণ্য করা হয়েছে, সে সম্বন্ধে তাঁদের হুঁশ নেই। আমি সাধারণ মেয়েদের কথাই বলছি, বাংলায় যাঁরা এম| এ| পরীক্ষার্থিনী তাঁদের চিঠি আমি খুব বেশি পাই নি। একটি মেয়ের চিঠিতে যখন কোলকাতা বানান দেখলুম তখন মনে ভারি আনন্দ হল। এই রকম মেয়েদের কাউকে বানান সংস্কার সমিতিতে রাখা উচিত ছিল। কেননা প্রাকৃত বাংলা বানান বিচারে পুরুষদেরই প্রাধান্য এ কথা আমি স্বীকার করি নে। এ পর্যন্ত অলিখিত প্রাকৃত বাংলা ভাষায় রস জুগিয়ে এসেছে মেয়েরাই, ছেলেবেলায় যখন রূপকথা শুনেছি তখন তার প্রমাণ পেয়েছি প্রতি সন্ধ্যাবেলায়। ব্রতকথার বাংলা ভাষার প্রতি লক্ষ করলেও আমার কথা স্পষ্ট হবে। এটা জানা যাবে প্রাকৃত বাংলা যেটুকু সাহিত্যরূপ নিয়েছে সে অনেকটাই মেয়েদের মুখে। অবশেষে সত্যের অনুরোধে ময়মনসিংহগীতিকা উপলক্ষে পুরুষের জয় ঘোষণা করতে হবে। এমন অকৃত্রিম ভাবরসে ভরা কাব্য বাংলা ভাষায় বিরল।
যে প্রাকৃত বাংলা ভাষা সম্প্রতি সাহিত্যে হরিজন-বর্গ থেকে উপরের পঙ্ক্তিতে উঠেছে, তার উচ্চারণ ওকার-বহুল এ কথা মানতে হবে। অনেক মেয়েদের চিঠিতে দেখেছি তাঁদের ওকার-ভীতি একেবারেই নেই। তাঁরা মুখে বলেন “হোলো’, লেখাতেও লেখেন তাই। কোরচি, কোরবো, লিখতে তাঁদের কলম কাঁপে না। ওকারের স্থলে অর্ধকুণ্ডলী ইলেকচিহ্ন ব্যবহার করে তাঁরা ওই নিরপরাধ স্বরবর্ণটার চেহারা চাপা দিতে চান না। বাংলা প্রাকৃতের বিশেষত্ব ঘোষণার প্রধান নকিব হল ওই ওকার, ইলেকচিহ্নে বা অচিহ্নে ওর মুখ চাপা দেবার ষড়যন্ত্র আমার কাছে সংগত বোধ হয় না। বাঙালির ওকার-ভীতির একটা প্রমাণ পাই ভৌগলিক ও পৌরহিত্য শব্দ ব্যবহারে।
সেদিন নতুন বানান-বিধি অনুসারে লিখিত কোনো বইয়ে যখন “কাল’ শব্দ চোখে পড়ল তখন অতি অল্প একটু সময়ের জন্য আমার খট্কা লাগল। পরক্ষণেই বুঝতে পারলুম লেখক বলতে চান কালো। লিখতে চান কাল। কর্তৃপক্ষের অনুশাসন আমি নম্রভাবে মেনে নিতে পারতুম কিন্তু কালো উচ্চারণের ওকার প্রাকৃত বাংলার একটি মূল তত্ত্বের সঙ্গে জড়িত। তত্ত্বটি এই যে দুই অক্ষরবিশিষ্ট বিশেষণ পদ এই ভাষায় প্রায়ই স্বরান্ত হয়ে থাকে। তার কোনো ব্যতিক্রম নেই তা নয়, কিন্তু সেগুলি সংখ্যায় অতি অল্প। সেই ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্ত যতগুলি আমার মনে পড়ল আগে তার তালিকা লিখে দিচ্ছি। রঙ বোঝায় এমন বিশেষণ, যেমন “লাল’ (“নীল’ তৎসম শব্দ)। স্বাদ বোঝায় যে শব্দে, যেমন টক, ঝাল। তার পরে সংখ্যাবাচক শব্দ, এক থেকে দশ, ও তার পরে বিশ, ত্রিশ ও ষাট। এইখানে একটি কথা বলা আবশ্যক। আমাদের ভাষায় এই সংখ্যাবাচক শব্দ কেবলমাত্র সমাসে চলে, যেমন একজন, দশঘর, দুইমুখো, তিনহপ্তা। কিন্তু বিশেষ্য শব্দের সঙ্গে জোড়া না লাগিয়ে ব্যবহার করতে হলেই আমরা সংখ্যাবাচক শব্দের সঙ্গে টি বা টা, খানা বা খানি যোগ করি, এর অন্যথা হয় না। কখনো কখনো ই স্বর যোগ করতে হয়, যেমন একই লোক, দুইই বোকা। কখনো কখনো সংখ্যাবাচক শব্দে বাক্যের শেষে সাতন্ত্র্য দেওয়া হয়, যেমন হরি ও হর এক। এখানে “এক’ বিশেষ্যপদ, তায় অর্থ, এক সত্তা, এক হরিহর নয়। আরো দুটো সংখ্যাসূচক শব্দ আছে যেমন, আধ এবং দেড়। কিন্তু এরাও সমাসের সঙ্গী, যেমন, আধখানা, দেড়খানা। ওই দুটো শব্দ যখন সাতন্ত্র্য পায় তখন ওরা হয় আধা, দেড়া। আর-একটা সমাসসংশ্লিষ্ট শব্দের দৃষ্টান্ত দেখাই, যেমন জোড়, সমাসে ব্যবহার করি জোড়হাত; সমাসবন্ধন ছুটিয়ে দিলে ওটা হয় জোড়া হাত। “হেঁট’ বিশেষণ শব্দটির ব্যবহার খুব সংকীর্ণ। এক হল হেঁটমুণ্ড, সেখানে ওটা সমাসের অঙ্গ। তা ছাড়া, হেঁট হওয়া হেঁট করা। কিন্তু সাধারণ বিশেষণরূপে ওকে আমরা ব্যবহার করি নে, যেমন আমরা বলি নে, হেঁট মানুষ। বস্তুত হেঁট হওয়া, হেঁট করা জোড়া ক্রিয়াপদ, জুড়ে লেখাই উচিত। “মাঝ’ শব্দটাও এই জাতের, বলি মাঝখানে, মাঝদরিয়া, এ হল সমাস, আর বলি মাঝ থেকে, সেটা হল প্রত্যয়যুক্ত, “থেকে’ প্রত্যয়টি ছাড়িয়ে নিয়ে কাজে লাগাতে পারি নে; বলা যায় না, মাঝ গোরু বা মাঝ ঘর। আর-একটা ফার্সি শব্দ মনে পড়ছে “সাফ্’ অধিকাংশ স্থলে বিশেষণ মাত্রই সমাসের অন্তর্গত, যেমন সাফ কাপড়, কিন্তু ওটা যে সাতন্ত্র্যবান বিশেষণ শব্দ তার প্রমাণ হয়, যখন বলা যায় কাপড়টা সাফ। কিন্তু বলা যায় না “কথা এক’, বলতে হয়, “কথা একটা’, কিংবা, “কথা একই’। বলি, “মোট কথা এই’, কিন্তু বলি নে “এই কথাটাই মোট’। যাই হোক দুই অক্ষরের হসন্ত বাংলা বিশেষণ হয়তো ভেবে ভেবে আরো মনে আনা যেতে পারে, কিন্তু যথেষ্টই ভাবতে হয়।
অপর পক্ষে বেশি খুঁজতে হয় না যথা, বড়ো, ছোটো, মেঝো, সেজো, ভালো, কালো, ধলো, রাঙা, সাদা, ফিকে, খাটো, রোগা, মোটা, বেঁটে, কুঁজো, ত্যাড়া, বাঁকা, সিধে, কানা, খোঁড়া, বোঁচা, নুলো, ন্যাকা, হাঁদা, খাঁদা, টেরা, কটা, গ্যাঁটা, গোটা, ভোঁদা, ন্যাড়া, ক্ষ্যাপা, মিঠে, ডাঁসা, কষা, খাসা, তোফা, কাঁচা, পাকা, সোঁদা, বোদা, খাঁটি, মেকি, কড়া, মিঠে, চোখা, রোখা, আঁটা, ফাটা, পোড়া, ভিজে, হাজা, শুকো, গুঁড়ো, বুড়ো, ছোঁড়া, গোঁড়া, ওঁচা, খেলো, ছ্যাঁদা, ঝুঁটো, ভীতু, আগা, গোড়া, উঁচু, নিচু ইত্যাদি। মত শব্দটা বিশেষ্য, ওইটে থেকে বিশেষণ জন্ম নিতেই সে হল মতো।
কেন আমি বাংলা দুই অক্ষরের বিশেষণ পদ থেকে তার অন্তস্বর লোপ করতে পারব না তার কৈফিয়ত আমার এইখানেই রইল।
বাংলা শব্দে কতকগুলি মুদ্রাভঙ্গি আছে। ভঙ্গিসংকেত যেমন অঙ্গের সঙ্গে অবিচ্ছেদে যুক্ত এগুলিও তেমনি। যে মানুষ রেগেছে তার হাত থেকে ছুরিটা নেওয়া চলে, কিন্তু ভ্রূর থেকে ভ্রূকুটি নেওয়া যায় না। যেমনি, তখনি, আমারো, কারো, কোনো, কখনো শব্দে ইকার এবং ওকার কেবলমাত্র ঝোঁক দেবার জন্যে, ওরা শব্দের অনুবর্তী না হয়ে, যথাসম্ভব তার অঙ্গীভূত থাকাই ভালো যথাসম্ভব বলতে হল এইজন্যে যে স্বরান্ত শব্দে সংকেত স্বরগুলি অগত্যা সঙ্গে থাকে, মিলে থাকে না, যেমন তোমরাও, আমরাই। কিন্তু যেখানে উচ্চারণের মধ্যে মিলনের বাধা নেই, সেখানে আমি ওদের মিলিয়ে রাখব। কেন আমি বিশেষভাবে মিলনের পক্ষপাতী একটা ছড়া দিয়ে বুঝিয়ে দেব।
যেমনি যখনি দেখা দিই তার ঘরে
অমনি তখনি মিথ্যা কলহ করে।
কোনো কোনো দিন কহে সে নোলক নাড়ি
কারো কারো সাথে জন্মের মতো আড়ি॥
যদি বানান করি যেমনই, যখনই, অমনই, তখনই, কোনও, কারও, দৃষ্টিকটুত্বের নালিশ হয়তো গ্রাহ্য না হতে পারে। কিন্তু “যখনই’ বানানের স্বাভাবিক যে উচ্চারণ, ছন্দের অনুরোধে সেটা রক্ষা করতে চায় এমন কবি হয়তো জন্মাতেও পারে, কেননা কাল নিরবধি এবং বিপুলা চ পৃথ্বী যথা :
যখনই দেখা হয় তখনই হাসে,
হয়তো সে হাসি তার খুশি পরকাশে।
কখনও ভাবি, ওগো শ্রীমতী নবীনা,
কোনও কারণে এটা বিদ্রূপ কিনা॥
আপাতত জানিয়ে রাখছি কেবল পদ্যে নয়, গদ্যেও আমি উচ্চারণ অনুগত করে কোনো, কখনো, যখনি, তখনি লিখব। এইখানে একটা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, “কখনই আমি যাব না’ এবং তখনি আমি গিয়েছিলেম এ দুই জায়গায় কি একই বানান থাকা সংগত?
উপসংহারে এই কথাটি বলতে চাই বানানের বিধিপালনে আপাতত হয়তো মোটের উপরে আমরা “বাধ্যতামূলক’ নীতি অনুসরণ করে একান্ত উচ্ছৃঙ্খলতা দমনে যোগ দেব। কিন্তু এই দ্বিধাগ্রস্ত মধ্যপথে ব্যাপারটা থামবে না। অচিরে এমন সাহসিকের সমাগম হবে যাঁরা নিঃসংকোচে বানানকে দিয়ে সম্পূর্ণ ভাবেই উচ্চারণের সত্য রক্ষা করবেন।
বানান সংস্কার ব্যাপারে বিশেষভাবে একটা বিষয়ে কর্তৃপক্ষেরা যে সাহস দেখিয়েছেন সেজন্যে আমি তাঁদের ভূরি ভূরি সাধুবাদ দিই। কী কারণে জানি নে, হয়তো উড়িষ্যার হাওয়া লেগে আধুনিক বাঙালি অকস্মাৎ মূর্ধন্য ণয়ের প্রতি অহৈতুক অনুরাগ প্রকাশ করছেন। আমি এমন চিঠি পাই যাতে লেখক শনিবার এবং শূন্য শব্দ মূর্ধন্য ণ দিয়ে লেখেন। এটাতে ব্যাধির সংক্রামকতার লক্ষণ প্রকাশ পায়। কর্নেল, গবর্নর, জর্নাল প্রভৃতি বিদেশী শব্দে তাঁরা দেবভাষার ণত্ববিধি প্রয়োগ করে তার শুদ্ধিতা সাধন করেন। তাতে বোপদেবের সম্মতি থাকতেও পারে। কিন্তু আজকাল যখন খবরের কাগজে দেখতে পাই কানপুরে মূর্ধন্য ণ চড়েছে তখন বোপদেবের মতো বৈয়াকরণিককে তো দায়ী করতে পারি নে। কানপুরের কান শব্দের দুটো ব্যুৎপত্তি থাকতে পারে, এক কর্ণ শব্দ থেকে। ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে রেফের সংসর্গে নয়ের মূর্ধন্যতা ঘটে। কর্ণ শব্দের “র’ গেলেই মূর্ধন্যতার অস্তিত্বের কৈফিয়ত যায় চলে। কানপুরের কান শব্দ হয়তো কানাই শব্দের অপভ্রংশ। কৃষ্ণ থেকে কান ও কানাই শব্দের আগমন। কৃষ্ণ শব্দে ঋফলার পরে মূর্ধন্য ষ, ও উভয়ের প্রভাবে শেষের ন মূর্ধন্য হয়েছে। আধুনিক প্রাকৃত থেকে সেই ঋফলা হয়েছে উৎপাটিত। তখন থেকে বোধ করি ভারতের সকল ভাষা হতেই কানাই শব্দে মূর্ধন্যের আক্রমণের আশঙ্কা চলে গেছে। কিন্তু নতুন উপক্রমণিকা-পড়া বাঙালি হয়তো কোন্ দিন কানাই শব্দে মূর্ধন্য ণ চালিয়ে তৃপ্তিবোধ করবেন। এই রকম দুটো-একটা শব্দ তাঁদের চোখ এড়িয়ে গেছে। স্বর্ণের রেফহীন অপভ্রংশ সোনায় তাঁরা মূর্ধন্য ণ আঁকড়িয়ে আছেন, অথচ শ্রবণের অপভ্রংশ শোনা তাঁদের মূর্ধন্যপক্ষপাতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। ব্যাকরণের তর্ক থাক্, ওটাতে চিরদিন আমার দুর্বল অধিকার। কৃষ্ণ শব্দের অপভ্রংশে কোনো প্রাকৃতে কাণ্হ বা কাণ থাকতেও পারে, যদি থাকে সেখানে সেটা উচ্চারণের অনুগত। সেখানে কেবল লেখবার বেলা কাণ্হ এবং বলবার বেলা কান্হ কখনই আদিষ্ট হয় নি। কিন্তু প্রাকৃত বাংলায় তো মূর্ধন্য ণয়ের সাড়া নেই কোথাও। মুদ্রাযন্ত্রকে দিয়ে সবই ছাপানো যায় কিন্তু রসনাকে দিয়ে তো সবই বলানো যায় না। কিন্তু যে মূর্ধন্য ণয়ের উচ্চারণ প্রাকৃত বাংলায় একেবারেই নেই, গায়ে পড়ে তার আনুগত্য স্বীকার করতে যাব কেন? এই পাণ্ডিত্যের অভিমানে শিশুপালদের প্রতি যে অত্যাচার করা যায় সেটা মার্জনীয় নয়। প্রাকৃত বাংলায় মূর্ধন্য ণয়ের স্থান কোনোখানেই নেই এমন কথা যে-সাহসে কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করতে পেরেছেন সেই সাহস এখনো আরো কতক দূর তাঁদের ব্যবহার করতে হবে। এখনো শেষ হয় নি কাজ।
আষাঢ়, ১৩৪৪
বানান-বিধি – ০২
১
… বাংলা বানানের নিয়ম বিধিবদ্ধ করবার জন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলুম। তার কারণ এই যে, প্রাকৃত বাংলার ব্যবহার সাহিত্যে অবাধে প্রচলিত হয়ে চলেছে কিন্তু এর বানান সম্বন্ধে স্বেচ্ছাচার ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠছে দেখে চিন্তিত হয়েছিলুম। এ সম্বন্ধে আমার আচরণেও উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকাশ পায় সে আমি জানি, এবং তার জন্য আমি প্রশ্রয় দাবি করি নে। এ রকম অব্যবস্থা দূর করবার একমাত্র উপায় শিক্ষা-বিভাগের প্রধান নিয়ন্তাদের হাতে বানান সম্বন্ধে চরম শাসনের ভার সমর্পণ করা।
বাংলা ভাষার উচ্চারণে তৎসম শব্দের মর্যাদা রক্ষা হয় বলে আমি জানি নে। কেবলমাত্র অক্ষর বিন্যাসেই তৎসমতার ভান করা হয় মাত্র, সেটা সহজ কাজ। বাংলা লেখায় অক্ষর বানানের নির্জীব বাহন– কিন্তু রসনা নির্জীব নয়– অক্ষর যাই লিখুক, রসনা আপন সংস্কারমতই উচ্চারণ করে চলে। সে দিকে লক্ষ করে দেখলে বলতেই হবে যে, অক্ষরের দোহাই দিয়ে যাদের তৎসম খেতাব দিয়ে থাকি, সেই সকল শব্দের প্রায় ষোলো আনাই অপভ্রংশ। যদি প্রাচীন ব্যাকরণকর্তাদের সাহস ও অধিকার আমার থাকত, এই ছদ্মবেশীদের উপাধি লোপ করে দিয়ে সত্য বানানে এদের স্বরূপ প্রকাশ করবার চেষ্টা করতে পারতুম। প্রাকৃত বাংলা ব্যাকরণের কেমাল পাশা হবার দুরাশা আমার নেই কিন্তু কালোহ্যয়ং নিরবধিঃ। উক্ত পাশা এ দেশেও দেহান্তর গ্রহণ করতে পারেন।
এমন-কি, যে-সকল অবিসংবাদিত তদ্ভব শব্দ অনেকখানি তৎসম-ঘেঁষা, তাদের প্রতি হস্তক্ষেপ করতে গেলেও পদে পদে গৃহবিচ্ছেদের আশঙ্কা আছে। এরা উচ্চারণে প্রাকৃত কিন্তু লেখনে সংস্কৃত আইনের দাবি করে। এ সম্বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-সমিতি কতকটা পরিমাণে সাহস দেখিয়েছেন, সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাঁদের মনেও ভয় ডর আছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রাকৃত বাংলায় তদ্ভব শব্দ বিভাগে উচ্চারণের সম্পূর্ণ আনুগত্য যেন চলে এই আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল। কিন্তু যদি নিতান্তই সম্পূর্ণ সেই ভিত্তিতে বানানের প্রতিষ্ঠা নাও হয় তবু এমন একটা অনুশাসনের দরকার যাতে প্রাকৃত বাংলার লিখনে বানানের সাম্য সর্বত্র রক্ষিত হতে পারে। সংস্কৃত এবং প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা ছাড়া সভ্য জগতের অন্য কোনো ভাষারই লিখনব্যবহারে বোধ করি উচ্চারণ ও বানানের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য নেই কিন্তু নানা অসংগতিদোষ থাকা সত্ত্বেও এ সম্বন্ধে একটা অমোঘ শাসন দাঁড়িয়ে গেছে। কাল চলবার পক্ষে সেটার দরকার আছে। বাংলা লেখনেও সেই কাজ চালাবার উপযুক্ত নির্দিষ্ট বিধির প্রয়োজন মানি, আমরা প্রত্যেকেই বিধানকর্তা হয়ে উঠলে ব্যাপরাটা প্রত্যেক ব্যক্তির ঘড়িকে তার স্বনিয়মিত সময় রাখবার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দেবার মতো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়-সমিতির বিধানকর্তা হবার মতো জোর আছে– এই ক্ষেত্রে যুক্তির জোরের চেয়ে সেই জোরেরই জোর বেশি এ কথা আমরা মানতে বাধ্য।
রেফের পর ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জন সম্বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় যে নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা নিয়ে বেশি তর্ক করবার দরকার আছে বলে মনে করি নে। যাঁরা নিয়মে স্বাক্ষর দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেক বড়ো বড়ো পণ্ডিতের নাম দেখেছি। আপনি যদি মনে করেন তাঁরা অন্যায় করেছেন তবুও তাঁদের পক্ষভুক্ত হওয়াই আমি নিরাপদ মনে করি। অন্তত তৎসম শব্দের ব্যবহারে তাঁদের নেতৃত্ব স্বীকার করতে কোনো ভয় নেই, লজ্জাও নেই। শুনেছি “সৃজন’ শব্দটা ব্যাকরণের বিধি অতিক্রম করেছে, কিন্তু যখন বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিত কথাটা চালিয়েছেন তখন দায় তাঁরই, আমার কোনো ভাবনা নেই। অনেক পণ্ডিত “ইতিমধ্যে’ কথাটা চালিয়ে এসেছেন, “ইতোমধ্যে’ কথাটার ওকালতি উপলক্ষে আইনের বই ঘাঁটবার প্রয়োজন দেখি নে– অর্থাৎ এখন ঐ “ইতিমধ্যে’ শব্দটার ব্যবহার সম্বন্ধে দায়িত্ব-বিচারের দিন আমাদের হাত থেকে চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়-বানান-সমিতিতে তৎসম শব্দ সম্বন্ধে যাঁরা বিধান দেবার দায়িত্ব নিয়েছেন, এ নিয়ে দ্বিধা করবার দায়িত্বভার থেকে তাঁরা আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। এখন থেকে কার্ত্তিক কর্ত্তা প্রভৃতি দুই ত-ওয়ালা শব্দ থেকে এক ত আমরা নিশ্চিন্ত মনে ছেদন করে নিতে পারি, সেটা সাংঘাতিক হবে না। হাতের লেখায় অভ্যাস ছাড়তে পারব বলে প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না, কিন্তু ছাপার অক্ষরে পারব। এখন থেকে ভট্টাচার্য্য শব্দের থেকে য-ফলা লোপ করতে নির্বিকার চিত্তে নির্মম হতে পারব, কারণ নব্য বানান-বিধাতাদের মধ্যে তিন জন বড়ো বড়ো ভট্টাচার্য্যবংশীয় তাঁদের উপাধিকে য-ফলা বঞ্চিত করতে সম্মতি দিয়েছেন। এখন থেকে আর্য্য এবং অনার্য্য উভয়েই অপক্ষপাতে য-ফলা মোচন করতে পারবেন, যেমন আধুনিক মাঞ্চু ও চীনা উভয়েরই বেণী গেছে কাটা।
তৎসম শব্দ সম্বন্ধে আমি নমস্যদের নমস্কার জানাব। কিন্তু তদ্ভব শব্দে অপণ্ডিতের অধিকারই প্রবল, অতএব এখানে আমার মতো মানুষেরও কথা চলবে– কিন্তু কিছু চালাচ্ছিও। যেখানে মতে মিলছি নে সেখানে আমি নিরক্ষরদের সাক্ষ্য মানছি। কেননা, অক্ষরকৃত অসত্যভাষণের দ্বারা তাদের মন মোহগ্রস্ত হয় নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-সমিতির চেয়েও তাদের কথার প্রামাণিকতা যে কম তা আমি বলব না– এমন-কি, হয়তো– থাক্ আর কাজ নেই।
তা হোক, উপায় নেই। আমি হয়তো একগুয়েমি করে কোনো কোনো বানানে নিজের মত চালাব। অবশেষে হার মানতে হবে তাও জানি। কেননা, শুধু যে তাঁরা আইন সৃষ্টি করেন তা নয়, আইন মানাবার উপায়ও তাঁদের হাতে আছে। সেটা থাকাই ভালো, নইলে কথা বেড়ে যায়, কাজ বন্ধ থাকে। অতএব তাঁদেরই জয় হোক, আমি তো কেবল তর্কই করতে পারব, তাঁরা পারবেন ব্যবস্থা করতে। মুদ্রাযন্ত্র-বিভাগে ও শিক্ষা-বিভাগে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে সেই ব্যবস্থার দৃঢ়তা নিতান্ত আবশ্যক।
আমি এখানে স্বপ্নদেশ থেকে দূরে এসে বিশ্রামচর্চার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত আছি। কিন্তু প্রারব্ধ কর্মের ফল সর্বত্রই অনুসরণ করে। আমার যেটুকু কৈফিয়ত দেবার সেটা না দিয়ে নিষ্কৃতি নেই। কিন্তু এই যে দুঃখ স্বীকার করলুম এর ফল কেবল একলা আপনাকে নিবেদন করলে বিশ্রামের অপব্যয়টা অনেক পরিমাণেই অনর্থক হবে। অতএব এই পত্রখানি আমি প্রকাশ করতে পাঠালুম। কেননা, এই বানান-বিধি ব্যাপারে যাঁরা অসন্তুষ্ট তাঁরা আমাকে কতটা পরিমাণে দায়ী করতে পারেন সে তাঁদের জানা আবশ্যক। আমি পণ্ডিত নই, অতএব বিধানে যেখানে পাণ্ডিত্য আছে সেখানে নম্রভাবেই অনুসরণের পথ গ্রহণ করব, যে অংশটা পাণ্ডিত্যবর্জিত দেশে পড়ে সে অংশে যতটা শক্তি বাচালতা করব কিন্তু নিশ্চিত জানব, যে একদা “অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর।”
২
… আমি পূর্বেই কবুল করেছি যে, কী সংস্কৃত ভাষায় কী ইংরেজিতে আমি ব্যাকরণে কাঁচা। অতএব প্রাকৃত বাংলায় তৎসম শব্দের বানান নিয়ে তর্ক করবার অধিকার আমার নেই। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, এই বানানের বিচার আমার মতের অপেক্ষা করে না। কেবল আমার মত অনভিজ্ঞ ও নতুন পোড়োদের পক্ষ থেকে পণ্ডিতদের কাছে আমি এই আবেদন করে থাকি যে, ব্যাকরণ বাঁচিয়ে যেখানেই বানান সরল করা সম্ভব হয় সেখানে সেটা করাই কর্তব্য তাতে জীবে দয়ার প্রমাণ হয়। এ ক্ষেত্রে প্রবীণদের অভ্যাস ও আচারনিষ্ঠতার প্রতি সম্মান করতে যাওয়া দুর্বলতা। যেখানে তাঁদের অবিসংবাদিত অধিকার সেখানে তাঁদের অধিনায়কত্ব স্বীকার করতেই হবে। অন্যত্র নয়। বানান-সংস্কার-সমিতি বোপদেবের তিরস্কার বাঁচিয়েও রেফের পর দ্বিত্ব বর্জনের যে বিধান দিয়েছেন সেজন্য নবজাত ও অজাত প্রজাবর্গের হয়ে তাঁদের কাছে আমার নমস্কার নিবেদন করি।
বিশেষজ্ঞতা সকল ক্ষেত্রেই দুর্লভ। ব্যাকরণে বিশেষজ্ঞের সংখ্যা খুবই কম এ কথা মানতেই হবে। অথচ তাঁদের অনেকেরই অন্য এমন গুণ থাকতে পারে যাতে একোহি দোষো গুণসন্নিপাতের জন্য সাহিত্যব্যবহার থেকে তাঁদের নির্বাসন দেওয়া চলবে না। এঁদের জন্যেই কোনো একটি প্রামাণ্য শাসনকেন্দ্র থেকে সাহিত্যে বানান প্রভৃতি সম্বন্ধে কার্যবিধি প্রবর্তনের ব্যবস্থা থাকা একান্ত দরকার। আইন বানাবার অধিকার তাঁদেরই আছে আইন মানাবার ক্ষমতা আছে যাঁদের হাতে। আইনবিদ্যায় যাঁদের জুড়ি কেউ নেই ঘরে বসে তাঁরা আইনকর্তাদের ‘পরে কটাক্ষপাত করতে পারেন কিন্তু কর্তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আইন তাঁরা চালাতে পারবেন না। এই কথাটা চিন্তা করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষদের কাছে বানানবিধি পাকা করে দেবার জন্যে দরখাস্ত জানিয়েছিলেম। অনেক দিন ধরে বানান সম্বন্ধে যথেচ্ছাচার নিজেও করেছি অন্যকেও করতে দেখেছি। কিন্তু অপরাধ করবার অবাধ স্বাধীনতাকে অপরাধীও মনে মনে নিন্দা করে, আমিও করে এসেছি। সর্বসাধারণের হয়ে এর প্রতিবিধানভার ব্যক্তিবিশেষের উপর দেওয়া চলে না– সেইজন্যেই পীড়িত চিত্তে মহতের শরণাপন্ন হতে হল। আপনার চিঠির ভাষার ইঙ্গিত থেকে বোঝা গেল যে বানান-সংস্কার-সমিতির “হোমরাচোমরা’ “পণ্ডিত’দের প্রতি আপনার যথেষ্ট শ্রদ্ধা নেই। এই অশ্রদ্ধা আপনাকেই সাজে কিন্তু আমাকে তো সাজে না, আর আমার মতো বিপুলসংখ্যক অভাজনদেরও সাজে না। নিজে হাল ধরতে শিখি নি, কর্ণধারকে খুঁজি– যে-সে এসে নিজেকে কর্ণধার বলে ঘোষণা করলেও তাদের হাতে হাল ছেড়ে দিতে সাহস হয় না, কেননা, এতে প্রাণের দায় আছে।
এমন সন্দেহ আপনার মনে হতেও পারে যে সমিতির সকল সদস্যই সকল বিধিরই যে অনুমোদন করেন তা সত্য নয়। না হওয়াই সম্ভব। কিন্তু আপসে নিষ্পত্তি করেছেন। তাঁদের সম্মিলিত স্বাক্ষরের দ্বারা এই কথারই প্রমাণ হয় যে এতে তাঁদের সম্মিলিত সমর্থন আছে। যৌথ কারবারের অধিনেতারা সকলেই সকল বিষয়েই একমত কি না, এবং তাঁরা কেউ কেউ কর্তব্যে ঔদাস্য করেছেন কি না সে খুঁটিনাটি সাধারণে জানেও না জানতে পারেও না। তারা এইটুকই জানে যে স্বাক্ষরদাতা ডিরেক্টরদের প্রত্যেকেরই সম্মিলিত দায়িত্ব আছে। (বশিত্ব কৃতিত্ব প্রভৃতি ইন্ভাগান্ত শব্দে যদি হ্রস্ব ইকার প্রয়োগই বিধিসম্মত হয় তবে দায়িত্ব শব্দেও ইকার খাটতে পারে বলে আমি অনুমান করি)। আমরাও বানান-সমিতিকে এক বলে গণ্য করছি এবং তাঁদের বিধান মেনে নিতে প্রস্তুত হচ্ছি। যেখানে স্বস্বপ্রধান দেবতা অনেক আছে সেখানে কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম। অতএব বাংলা তৎসম শব্দের বানানে রেফের পরে দ্বিত্ববর্জনের যে বিধান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বীকৃত হয়েছে সেটা সবিনয়ে আমিও স্বীকার করে নেব।
কিন্তু যে-প্রস্তাবটি ছিল বানান-সমিতি স্থাপনের মূলে, সেটা প্রধানত তৎসম শব্দসম্পর্কীয় নয়। প্রাকৃত বাংলা যখন থেকেই সাহিত্যে প্রবেশ ও বিস্তার লাভ করল তখন থেকেই তার বানানসাম্য নির্দিষ্ট করে দেবার সমস্যা প্রবল হয়ে উঠেছে। প্রাকৃত বাংলার সংস্কৃত অংশের বানান সম্বন্ধে বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নেই– যাঁরা সতর্ক হতে চান হাতের কাছে একটা নির্ভরযোগ্য অভিধান রাখলেই তাঁরা বিপদ এড়িয়ে চলতে পারেন। কিন্তু প্রাকৃত বাংলার প্রামাণ্য অভিধান এখনো হয় নি, কেননা, আজও তার প্রামাণিকতার প্রতিষ্ঠাই হতে পারে নি। কিন্তু এই বানানের ভিত পাকা করার কাজ শুরু করবার সময় এসেছে। এত দিন এই নিয়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত ভাবেই কাটিয়েছি। তখনো কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা প্রাধান্য লাভ করে নি। এই কারণে সুনীতিকেই এই ভার নেবার জন্যে অনুরোধ করেছিলেম। তিনি মোটামুটি একটা আইনের খসড়া তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আইনের জোর কেবল যুক্তির জোর নয় পুলিসেরও জোর। সেইজন্যে তিনি দ্বিধা ঘোচাতে পারলেন না। এমন-কি, আমার নিজের ব্যবহারে শৈথিল্য পূর্বের মতোই চলল। আমার সংস্কার, প্রুফশোধকের সংস্কার, কপিকারকের সংস্কার, কম্পোজিটরের সংস্কার, এবং যে-সব পত্রিকায় লেখা পাঠানো যেত তার সম্পাদকদের সংস্কার এই-সব মিলে পাঁচ ভূতের কীর্তন চলত। উপরওয়ালা যদি কেউ থাকেন এবং তিনিই যদি নিয়ামক হন, এবং দণ্ডপুরস্কারের দ্বারা তাঁর নিয়ন্তৃত্ব যদি বল পায় তা হলেই বানানের রাজ্যে একটা শৃঙ্খলা হতে পারে। নইলে ব্যক্তিগত ভাবে আপনাদের মতো বিচক্ষণ লোকের দ্বারে দ্বারে মত সংগ্রহ করে বেড়ানো শিক্ষার পক্ষে যতই উপযোগী হোক কাজের পক্ষে হয় না।
কেন যে মুশকিল হয় তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। বর্ণন শব্দে আপনি যখন মূর্ধন্য ণ লাগান তখন সেটাকে যে মেনে নিই সে আপনার খাতিরে নয়, সংস্কৃত শব্দের বানান প্রতিষ্ঠিত স্বে মহিম্নি– নিজের মহিমায়। কিন্তু আপনি যখন বানান শব্দের মাঝখানটাতে মূর্ধন্য ণ চড়িয়ে দেন তখন ওটাকে আমি মানতে বাধ্য নই। প্রথমত এই বানানে আপনার বিধানকর্তা আপনি নিজেই। দ্বিতীয়ত আপনি কখনো বলেন প্রচলিত বানান মেনে নেওয়াই ভালো, আবার যখন দেখি মূর্ধন্য ণ-লোলুপ “নয়া’ বাংলা বানান-বিধিতে আপনার ব্যক্তিগত আসক্তিকে সমর্থনের বেলায় আপনি দীর্ঘকাল-প্রচলিত বানানকে উপেক্ষা করে উক্ত শব্দের বুকের উপর নবাগত মূর্ধন্য ণয়ের জয়ধ্বজা তুলে দিয়েছেন তখন বুঝতে পারি নে আপনি কোন্ মতে চলেন। জানি নে “কানপুর’ শব্দের কানের উপর আপনার ব্যবহার নব্য মতে বা পুরাতন মতে। আমি এই সহজ কথাটা বুঝি যে প্রাকৃত বাংলায় মূর্ধন্য ণয়ের স্থান কোথাও নেই, নির্জীব ও নিরর্থক অক্ষরের সাহায্যে ঐ অক্ষরের বহুল আমদানি করে আপনাদের পাণ্ডিত্য কাকে সন্তুষ্ট করছে, বোপদেবকে না কাত্যায়নকে? দুর্ভাগ্যক্রমে বানান-সমিতিরও যদি ণ-এর প্রতি অহৈতুক অনুরাগ থাকত তা হলে দণ্ডবিধির জোরে সেই বানানবিধি আমিও মেনে নিতুম। কেননা, আমি জানি আমি চিরকাল বাঁচব না কিন্তু পাঠ্য-পুস্তকের ভিতর দিয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানে শিক্ষালাভ করবে তাদের আয়ু আমার জীবনের মেয়াদকে ছাড়িয়ে যাবে।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের সঙ্গে প্রাকৃত বাংলা ভাষা সম্বন্ধে আমার আলোচনা হয়েছিল। তিনি প্রাকৃত বাংলা ভাষার স্বতন্ত্র রূপ স্বীকার করবার পক্ষপাতী ছিলেন এ কথা বোধ হয় সকলের জানা আছে। সেকালকার যে-সকল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সংস্কৃত ভাষায় বিশুদ্ধ পাণ্ডিত্য ছিল, তাঁদের কারো কারো হাতের লেখা বাংলা বানান আমার দেখা আছে। বানান-সমিতির কাজ সহজ হত তাঁরা যদি উপস্থিত থাকতেন। সংস্কৃত ভাষা ভালো করে জানা না থাকলে বাংলা ভাষা ব্যবহারের যোগ্যতা থাকবেই না, ভাষাকে এই অস্বাভাবিক অত্যাচারে বাধ্য করা পাণ্ডিত্যাভিমানী বাঙালির এক নূতন কীর্তি। যত শীঘ্র পারা যায় এই কঠোর বন্ধন শিথিল করে দেওয়া উচিত। বস্তুত একেই বলে ভূতের বোঝা বওয়া। এত কাল ধরে সংস্কৃত ব্যাকরণের সাহায্য না নিয়ে যে বহুকোটি বাঙালি প্রতিদিন মাতৃভাষা ব্যবহার করে এসেছে এতকাল পরে আজ তাদের সেই ভাষাই বাংলা সাহিত্যে প্রবেশের অধিকার পেয়েছে। এইজন্য তাদের সেই খাঁটি বাংলার প্রকৃত বানান নির্ণয়ের সময় উপস্থিত হয়েছে। এক কালে প্রাচীন ভারতের কোনো কোনো ধর্মসম্প্রদায় যখন প্রাকৃত ভাষায় পালি ভাষায় আপন আপন শাস্ত্রগ্রন্থ প্রচার করতে প্রবৃত্ত হয়েছিল তখন ঠিক এই সমস্যাই উঠেছিল। যাঁরা সমাধান করেছিলেন তাঁরা অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন; তাঁদের পাণ্ডিত্য তাঁরা বোঝার মতো চাপিয়ে যান নি জনসাধারণের ‘পরে। যে অসংখ্য পাঠক ও লেখক পণ্ডিত নয় তাদের পথ তাঁরা অকৃত্রিম সত্যপন্থায় সরল করেই দিয়েছিলেন। নিজের পাণ্ডিত্য তাঁরা নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ পরিপাক করেছিলেন বলেই এমনটি ঘটা সম্ভব হয়েছিল।
আপনার চিঠিতে ইংরেজি ফরাসি প্রভৃতি ভাষার নজির দেখিয়ে আপনি বলেন ঐ-সকল ভাষায় উচ্চারণে বানানে সামঞ্জস্য নেই। কিন্তু এই নজিরের সার্থকতা আছে বলে আমি মনে করি নে। ঐ-সকল ভাষার লিখিত রূপ অতি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে, এই পরিণতির মুখে কালে কালে যে-সকল অসংগতি ঘটেছে হঠাৎ তার সংশোধন দুঃসাধ্য। প্রাকৃত বাংলা ছাপার অক্ষরের এলেকায় এই সম্প্রতি পাসপোর্ট পেয়েছে। এখন ওর বানান নির্ধারণে একটা কোনো নীতি অবলম্বন করতে হবে তো। কালে কালে পুরোনো বাড়ির মতো বৃষ্টিতে রৌদ্রে তাতে নানা রকম দাগ ধরবে, সেই দাগগুলি সনাতনত্বের কৌলীন্য দাবি করতেও পারে। কিন্তু রাজমিস্ত্রি কি গোড়াতেই নানা লোকের নানা অভিমত ও অভিরুচি অনুসরণ করে ইমারতে পুরাতন দাগের নকল করতে থাকবে। য়ুরোপীয় ভাষাগুলি যখন প্রথম লিখিত হচ্ছিল তখন কাজটা কী রকম করে আরম্ভ হয়েছিল তার ইতিহাস আমি জানি নে। আন্দাজ করছি কতকগুলি খামখেয়ালি লোকে মিলে এ কাজ করেন নি, যথাসম্ভব কানের সঙ্গে কলমের যোগ রক্ষা করেই শুরু করেছিলেন। তাও খুব সহজ নয়, এর মধ্যেও কারো কারো স্বেচ্ছাচার যে চলে নি তা বলতে পারি নে। কিন্তু স্বেচ্ছাচারকে তো আদর্শ বলে ধরে নেওয়া যায় না– অতএব ব্যক্তিগত অভিরুচির অতীত কোনো নীতিকে যদি স্বীকার করা কর্তব্য মনে করি তবে উচ্চারণকেই সামনে রেখে বানানকে গড়ে তোলা ভালো। প্রাচীন ব্যাকরণকর্তারা সেই কাজ করেছেন, তাঁরা অন্য কোনো ভাষার নজির মিলিয়ে কর্তব্য সহজ করেন নি।
এ প্রশ্ন করতে পারেন বানান-বিধিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচারকে মেনে নেওয়াকেই যদি আমি শ্রেয় মনে করি তা হলে মাঝে প্রতিবাদ করি কেন? প্রতিবাদ করি বিচারকদের সহায়তা করবার জন্যেই, বিদ্রোহ করবার জন্যে নয়। এখনো সংস্কার-কাজের গাঁথনি কাঁচা রয়েছে, এখনো পরিবর্তন চলবে, কিন্তু পরিবর্তন তাঁরাই করবেন আমি করব না। তাঁরা আমার কথা যদি কিছু মেনে নেবার যোগ্য মনে করেন সে ভালোই, যদি না মনে করেন তবে তাঁদের বিচারই আমি মেনে নেব। আমি সাধারণ ভাবে তাঁদের কাছে কেবল এই কথাটি জানিয়ে রাখব যে প্রাকৃত ভাষার স্বভাবকে পীড়িত করে তার উপরে সংস্কৃত ব্যাকরণের মোচড় দেওয়াকে যথার্থ পাণ্ডিত্য বলে না। একটা তুচ্ছ দৃষ্টান্ত দেব। প্রচলিত উচ্চারণে আমরা বলি কোলকাতা, কলিকাতাও যদি কেউ বলতে ইচ্ছা করেন বলতে পারেন, যদিও তাতে কিঞ্চিৎ হাসির উদ্রেক করবে। কিন্তু ইংরেজ এই শহরটাকে উচ্চারণ করে ক্যালক্যাটা এবং লেখেও সেই অনুসারে। আপনিও বোধ হয় ইংরেজিতে এই শহরের ঠিকানা লেখবার সময় ক্যালক্যাটাই লেখেন, অথবা ক্যালক্যাটা লিখে কলিকাতা উচ্চারণ করেন না– অর্থাৎ যে জোরে প্রাকৃত বাংলায় আপনারা ষত্ব ণত্ব মেশিনগান চালাতে চেষ্টা করেন, সে জোর এখানে প্রয়োগ করেন না। আপনি বোধ করি ইংরেজিতে চিটাগংকে চট্টগ্রাম সিলোনকে সিংহল বানান করে বানান ও উচ্চারণে গঙ্গাজলের ছিটে দেন না। ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করবামাত্রই যশোরকে আপনারা জেসোর বলেন, এমন-কি, মিত্রকে মিটার লেখার মধ্যে অশুচিতা অনুভব করেন না। অতএব চোখে অঞ্জন দিলে কেউ নিন্দে করবে না, মুখে দিলে করবে। প্রাকৃত বাংলায় যা শুচি, সংস্কৃত ভাষায় তাই অশুচি।
আপনি আমার একটি কথা নিয়ে কিছু হাস্য করেছেন কিন্তু হাসি তো যুক্তি নয়। আমি বলেছিলেম বর্তমান সাধু বাংলা গদ্য ভাষার ক্রিয়াপদগুলি গড় উইলিয়মের পণ্ডিতদের হাতে ক্ল্যাসিক ভঙ্গির কাঠিন্য নিয়েছে। আপনি বলতে চান তা সত্য নয়। কিন্তু আপনার এই উক্তি তো সংস্কৃত ব্যাকরণের অন্তর্গত নয় অতএব আপনার কথায় আমি যদি সংশয় প্রকাশ করি রাগ করবেন না। বিষয়টা আলোচনার যোগ্য। এক কালে প্রাচীন বাংলা আমি মন দিয়ে এবং আনন্দের সঙ্গেই পড়েছিলুম। সেই সাহিত্যে সাধু বাংলায় প্রচলিত ক্রিয়াপদের অভাব লক্ষ্য করেছিলুম। হয়তো ভুল করেছিলুম। দয়া করে দৃষ্টান্ত দেখাবেন। একটা কথা মনে রাখবেন ছাপাখানা চলন হবার পরে প্রাচীন গ্রন্থের উপর দিয়ে যে শুদ্ধির প্রক্রিয়া চলে এসেছে সেটা বাঁচিয়ে দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করবেন।
আর একটি কথা। ইলেক। আপনি বলেন লুপ্ত স্বরের চিহ্ন বলে ওটা স্বীকার্য কেননা ইংরেজিতে তার নজির আছে। “করিয়া’ শব্দ থেকে ইকার বিদায় নিয়েছে অতএব তার স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপে ইলেকের স্থাপনা। ইকারে আকারে মিলে একার হয়– সেই নিয়মে ইকার আকারের যোগে “করিয়া’ থেকে “কোরে’ হয়েছে। প্রথম বর্ণের ওকারটিও পরবর্তী ইকারের দ্বারা প্রভাবিত। যেখানে যথার্থই কোনো স্বর লুপ্ত হয়েছে অথচ অন্য স্বরের রূপান্তর ঘটায় নি এমন দৃষ্টান্তও আছে, যেমন ডাহিন দিক থেকে ডান দিক, বহিন থেকে বোন, বৈশাখ থেকে বোশেখ। এখনো এই-সব লুপ্ত স্বরের স্মরণচিহ্ন ব্যবহার ঘটে নি। গোধূম থেকে গম হয়েছে এখানেও লুপ্ত উকারের শোকচিহ্ন দেখি নে। যে-সকল শব্দে, স্বরবর্ণ কেন, গোটা ব্যঞ্জনবর্ণ অন্তর্ধান করেছে সেখানেও চিহ্নের উপদ্রব নেই। মুখোপাধ্যায়ের পা-শব্দটি দৌড় দিয়ে নিজের অর্থরক্ষা করেছে, পদচিহ্নমাত্র পিছনে ফেলে রাখে নি– এই-সমস্ত তিরোভাবকে চিহ্নিত করবার জন্যে সমুদ্রপার থেকে চিহ্নের আমদানি করার প্রয়োজন আছে কি। ইলেক না দিলে ওকার ব্যবহার করতে হয়, নইলে অসমাপিকার সূচনা হয় না। তাতে দোষ কী আছে।
পুনর্বার বলি আমি উকিল মাত্র, জজ নই। যুক্তি দেবার কাজ আমি করব, রায় দেবার পদ আমি পাই নি। রায় দেবার ভার যাঁরা পেয়েছেন আমার মতে তাঁরা শ্রদ্ধেয়।
বোধ হচ্ছে আর একটিমাত্র কথা বাকি আছে। এখনি তখনি আমারো তোমারো শব্দের ইকার ওকারকে ঝোঁক দেবার কাজে একটা ইঙ্গিতের মধ্যে গণ্য করে ও দুটোকে শব্দের অন্তর্ভুক্ত করবার প্রস্তাব করেছিলেন। তার প্রতিবাদে আপনি পরিহাসের সুরে বলেছেন, তবে কি বলতে হবে, আমরা ভাতি খাই রুটি খাই নে। দুটো প্রয়োগের মধ্যে যে প্রভেদ আছে সেটা আপনি ধরতে পারেন নি। শব্দের উপরে ঝোঁক দেবার ভার কোনো-না-কোনো স্বরবর্ণ গ্রহণ করে। যখন আমরা বলতে চাই বাঙালি ভাতই খায় তখন ঝোঁকটা পড়ে আকারের পরে, ইকারের পরে নয়। সেই ঝোঁকবিশিষ্ট আকারটা শব্দের ভিতরেই আছে স্বতন্ত্র নেই। এমন নিয়ম করা যেতে পারত যাতে ভাত শব্দের ভা-এর পরে একটা হাইফেন স্বতন্ত্র চিহ্নরূপে ব্যবহৃত হত– যথা বাঙালি ভা-তই খায়। ইকার এখানে হয়তো অন্য কাজ করছে, কিন্তু ঝোঁক দেবার কাজ তার নয়। তেমনি “খুবই’ শব্দ, এর ঝোঁকটা উকারের উপর। যদি “তীর’ শব্দের উপর ঝোঁক দিতে হয়, যদি বলতে চাই বুকে তীরই বিঁধেছে, তা হলে ঐ দীর্ঘ ঈকারটাই হবে ঝোঁকের বাহন। দুধটাই ভালো কিংবা তেলটাই খারাপ এর ঝোঁকগুলো শব্দের প্রথম স্বরবর্ণেই। সুতরাং ঝোঁকের চিহ্ন অন্য স্বরবর্ণে দিলে বেখাপ হবে। অতএব ভাতি খাব বানান লিখে আমার প্রতি লক্ষ করে যে-হাসিটা হেসেছেন সেটা প্রত্যাহরণ করবেন। ওটা ভুল বানান, এবং আমার বানান নয়। বলা বাহুল্য “এখনি’ শব্দের ঝোঁক ইকারেরি পরে, খ-এর অকারের উপরে নয়।
এখনি তখনি শব্দের বানান সম্বন্ধে আরো একটি কথা বলবার আছে। যখন বলি কখনই যাব না, আর যখন বলি এখনি যাব দুইয়ের মধ্যে যে প্রভেদ আছে তা ভিন্ন বানানে নির্দেশ করা উচিত। কারো শব্দের বানান সম্বন্ধেও ভাববার বিষয় আছে। “কারো কারো মতে শুক্রবারে শুভকর্ম প্রশস্ত’ অথবা “শুক্রবারে বিবাহে কারোই মত নেই’ এই দুইটি বাক্যে ওকারকে কোথায় স্থাপন করা উচিত? এখানে কি বানান করতে হবে, কারও কারও, এবং কারওই?
আপনার চিঠির একটা জায়গায় ভাষার ভঙ্গিতে মনে হল ক-এ দীর্ঘ ঈকার যোগে যে কী আমি ব্যবহার করে থাকি সে আপনার অনুমোদিত নয়। আমার বক্তব্য এই যে, অব্যয় শব্দ “কি’ এবং সর্বনাম শব্দ “কী’ এই দুইটি শব্দের সার্থকতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাদের ভিন্ন বানান না থাকলে অনেক স্থলেই অর্থ বুঝতে বাধা ঘটে। এমন-কি, প্রসঙ্গ বিচার করেও বাধা দূর হয় না। “তুমি কি জানো সে আমার কত প্রিয়’ আর “তুমি কী জানো সে আমার কত প্রিয়’, এই দুই বাক্যের একটাতে জানা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হচ্ছে আর একটাতে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে জানার প্রকৃতি বা পরিমাণ সম্বন্ধে, এখানে বানানের তফাত না থাকলে ভাবের তফাত নিশ্চিতরূপে আন্দাজ করা যায় না।
আলমোড়া,১২।৬।৩৭
বিবিধ
১
এ কথা আর অস্বীকার করা চলে না যে বাংলা সাহিত্যের ভাষা কলকাতার চলিত ভাষাকে আশ্রয় করেছে। শিশুকাল হতে বাংলার সকল প্রদেশের লোকেরই এই ভাষা শিক্ষা করা আবশ্যক। নইলে সাহিত্যে ব্যবহারের সময় বাধা পেতে হবে।
য়ুরোপের সকল দেশেই প্রদেশভেদে উপভাষা প্রচলিত আছে কিন্তু তৎসত্ত্বেও সে-সকল দেশে ভদ্রসাধারণের কথিত ভাষায় প্রভেদ নেই। এবং সেই ভদ্রসমাজের কথিত ভাষার সঙ্গে সে-সকল দেশের সাহিত্যের ভাষা মোটের উপর অভিন্ন। আমাদের দেশেও ভাষার মধ্যে যথাসম্ভব এইরকম মিল প্রার্থনীয়। বাংলা ভাষা স্বভাবতই দ্রুতবেগে এই মিলের দিকে চলেচে।
কলকাতার কথিত ভাষার মধ্যেও সম্পূর্ণ ঐক্য নেই। লণ্ডনেও ভাষার একটা নিম্নস্বর আছে তাকে বলে কক্নি। সেটা সাহিত্যভাষা থেকে দূরবর্তী।
আমাদের চলিত ভাষামূলক আধুনিক সাহিত্য ভাষার আদর্শ এখনো পাকা হয় নি বলে লেখকদের রুচি ও অভ্যাস-ভেদবশত শব্দব্যবহার সম্বন্ধে যথেচ্ছাচার আছে। আরো কিছুকাল পরে তবে এর নির্মাণকার্য সমাধা হবে।
তবু আপাতত আমি নিজের মনে একটা নিয়ম অনুসরণ করি। আমার কানে যেটা অপভাষা বলে ঠেকে সেটাকে আমি বর্জন করি। “ভিতর” এবং “ভেতর” “উপর” এবং “ওপর” “ঘুমতে” এবং “ঘুমুতে” এই দুইরকমেরই ব্যবহার কলকাতায় আছে কিন্তু শেষোক্তগুলিকে আমি অপভাষা বলি। “দুয়োর” কথার জায়গায় “দোর” কথা ব্যবহার করতে আমার কলমে ঠেকে। কলকাতার “ভাইয়ের বিয়ে” না বলে কেউ কেউ “ভেয়ের বে” কিংবা “করলুম”-এর জায়গায় “কন্নু” বলে, কিন্তু এগুলিকে সাহিত্যে স্বীকার করতে পারি নে। গুছুতে, রেতের বেলা প্রভৃতি ব্যবহার আজকাল দেখি, কিন্তু এগুলিকে স্বীকার করে নিতে পারি নে।
২
প্রণামের শ্রেণীভেদ আছে। ১ নম্বর সহজ প্রণাম হচ্চে গ্রীবা বাঁকিয়ে জোড় হাত কপালে ঠেকানো। যখন বলি গড় করি তোমার পায়ে তখন বোঝায় এমন কোনো ভঙ্গি করা যেটা বিনম্রতার চূড়ান্ত। গড় শব্দে একটা বিশেষ নম্রতার ভঙ্গি বোঝায় তার প্রমাণ তার সঙ্গে “করা’ ক্রিয়াপদের যোগ। সেইরকম ভঙ্গি করে প্রণাম করাই গড় করে প্রণাম করা। নমস্কার হই বলি নে, নমস্কার করি বলি– গড় করি সেই পর্যায়ের শব্দ। গড়াই গড়াগড়ি দিই শব্দে বুঝতে হবে শরীরকে একটা বিশেষ অবস্থাপন্ন করি, এর সংসর্গে “হই’ ক্রিয়াপদ আসতেই পারে না। বস্তুত গড় করে প্রণাম করা হচ্চে পায়ের কাছে গড়িয়ে প্রণাম করা। এই প্রণামে সেই ভঙ্গিটা কৃত হয়।
জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৭
বিবিধ
১
শ্রীযুক্ত বীরেশ্বর পাঁড়ে “জাতীয় সাহিত্য’ প্রবন্ধে আধুনিক ভারতবর্ষীয় ভাষাগুলিকে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মমত চলিতে উত্তেজনা করিয়াছেন! তিনি বলেন, নচেৎ আদর্শের ঐক্য থাকে না। তিনি বলেন, “কেন চট্টগ্রামবাসী নবদ্বীপবাসীর ব্যবহৃত অসংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিতে বাধ্য হইবে।” আমরা বলি, কেহ তো জবরদস্তি করিয়া বাধ্য করিতেছে না, স্বভাবের নিয়মে চট্টগ্রামবাসী আপনি বাধ্য হইতেছে। নবীনচন্দ্র সেন মহাশয় তাঁহার কাব্যে চট্টগ্রামের প্রাদেশিক প্রয়োগ ব্যবহার না করিয়া নবদ্বীপের প্রাদেশিক প্রয়োগ ব্যবহার করিয়াছেন। তাহার বিপরীত করিবার স্বাধীনতা তাঁহার ছিল। কিন্তু নিশ্চয় কাব্যের ক্ষতি আশঙ্কা করিয়া সেই স্বাধীনতাসুখ ভোগ করিতে ইচ্ছা করেন নাই। সকল দেশেই প্রাদেশিক প্রয়োগের বৈচিত্র্য আছে, তথাপি এক-একটি বিশেষ প্রদেশ ভাষাসম্বন্ধে অন্যান্য প্রদেশের উপর কর্তৃত্ব করিয়া থাকে। ইংরেজি ভাষা লাটিন নিয়মে আপনার বিশুদ্ধি রক্ষা করে না। যদি করিত, তবে এ ভাষা এত প্রবল, এত বিচিত্র, এত মহৎ হইত না। ভাষা-সোনা-রুপার মতো জড়পদার্থ নহে যে, তাহাকে ছাঁচে ঢালিব। তাহা সজীব– তাহা, নিজের অনির্বচনীয় জীবনীশক্তির নিয়মে গ্রহণ ও বর্জন করিতে থাকে। সমাজে শাস্ত্র অপেক্ষা লোকাচারকে প্রাধান্য দেয়। লোকাচারের অসুবিধা অনেক, তাহাতে এক দেশের আচারকে অন্য দেশের আচার হইতে তফাত করিয়া দেয়; তা হউক, তবু লোকাচারকে ঠেকাইবে কে। লোককে না মারিয়া ফেলিলে লোকাচারের নিত্য পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য কেহ দূর করিতে পারে না। কৃত্রিম গাছের সব শাখাই এক মাপের করা যায়, সজীব গাছের করা যায় না। ভাষারও লোকাচার শাস্ত্রের অপেক্ষা বড়ো। সেইজন্যই আমরা “ক্ষান্ত’ দেওয়া বলিতে লজ্জা পাই না। সেইজন্যই ব্যাকরণ যেখানে “আবশ্যকতা’ ব্যবহার করিতে বলে, আমরা সেখানে “আবশ্যক’ ব্যবহার করি। ইহাতে সংস্কৃত ব্যাকরণ যদি চোখ রাঙাইয়া আসে, লোকাচারের হুকুম দেখাইয়া আমরা তাহাকে উপেক্ষা করিতে পারি।
২
একটা ছোটো কথা বলিয়া লই। “অনুবাদিত’ কথাটা বাংলায় চলিয়া গেছে– আজকাল পণ্ডিতেরা অনূদিত লিখিতে শুরু করিয়াছেন। ভয় হয় পাছে তাঁহারা সৃজন কথার জায়গায় “সর্জন’ চালাইয়া বসেন।
৩
আপনার গ্রন্থের নামটি যত ভয়ানক বস্তুটি তত ভয়ংকর নয়। কিন্তু তবুও বোপদেব লোহারাম যখন ভ্রূকুটি করেন তখন হৃৎকম্প হয় না বাংলালেখকদের মধ্যে এমন কয়জন আছে, তবে কি না প্রবাদ আছে দুই কানকাটা গ্রামের মাঝখান দিয়াই অসংকোচে চলে। অনেক লিখিয়াছি সুতরাং আমার অপরাধের অন্ত নাই এখন আর লজ্জা করিয়া কী হইবে।
বাংলা ভাষার মুশকিল হইয়াছে এই যে ইহাকে একভাষা বলিয়া গণ্য করিলে চলে না। বাংলা শিখিতে হইলে সংস্কৃতও শিখিতে হইবে। সেও সকলে পারিয়া উঠে না– মাতৃভাষা বলিয়া নির্ভয়ে আবদার করিতে যায়, শেষকালে মাতামহীর কোপে পড়িয়া বিপন্ন হয়। মাতা ও মাতামহীর চাল স্বতন্ত্র, এক ব্যাকরণে তাঁহাদের কুলায় না। এ অবস্থায় হতভাগ্য বাঙালির চলে কি করিয়া, পরম পণ্ডিত না হইলে সে কি নিজের ভাষা ব্যবহার করিতেও পারিবে না।
আর একদিকে দেখুন। বাঙালির ছেলেকে ছেলেবেলা হইতে ইংরেজি শিখিতেই হইবে। অল্প বয়স হইতে যে পরিমাণ বাংলার চর্চা করিলে সে অনায়াসে বাংলায় আপনার ভাব প্রকাশ করিতে পারিত সে তাহার ঘটিয়া উঠে না। ইহাদের যদি বলা যায় তোমরা বাংলা লিখিতে পারিবে না তবে কয়জন লোকে বাংলা লিখিবে।
কারণ, ইহাও সত্য, এখন আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষা ছাড়া অন্য শিক্ষা নাই। সেই শিক্ষিত ব্যক্তির পনেরো-আনা যদি বাংলা লিখিতে না পায় তবে সম্ভবত ভাষা অত্যন্ত বিশুদ্ধ হইবে কিন্তু সে ভাষার প্রয়োজন থাকিবে না।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যটাকে গড়িয়া তুলিতেছেন যাঁহারা, তাঁহারা ইংরেজিনবিশ। তাঁহাদের পেটে কথা জমিয়াছে বলিয়াই তাঁহারা লিখিয়াছেন। যাঁহারা সংস্কৃত ব্যাকরণে পণ্ডিত তাঁহারা বাংলা ভাষার প্রতি মন দেন নাই সে তো জানা কথা। এখনো বাংলা যাঁহারা লেখেন তাঁহাদের অতি অল্প সংখ্যাই সংস্কৃত ভালো করিয়া জানেন। যাহারা ইংরাজি জানেন না কেবল মাত্র সংস্কৃত জানেন তাঁহারা কেহ কেহ বাংলা লেখেন, তাহার ভাষা বিশুদ্ধ কিন্তু বাজারে তাহা চলে না। অনেক লেখক লিখিতে লিখিতে ক্রমে সংস্কৃত শিখিতে থাকেন– কালীপ্রসন্ন ঘোষ মহাশয় যখন প্রথম লিখিতে আরম্ভ করেন তখন তিনি সংস্কৃতে পাকা ছিলেন না, তাঁহার লেখায় তাহার প্রমাণ আছে কাজেই সাহিত্যে এমন অনেক জিনিস জমিয়া উঠিতে থাকে– ব্যাকরণের সূত্র যাহার মধ্যে প্রবেশ করিবার পথ পায় না।
বাংলা লেখকের পুরস্কার যে খুব বেশি তাহা নয়, ইহার উপরে তাহার লেখনী চালনার পথ যদি অত্যন্ত দুর্গম করা হয় তবে সীতা পাইবার আশা পরিত্যাগ করিয়াও লোককে ধনুক ভাঙিতে ডাকা হয়। তাই বলিয়াই যে ভাষার উপরে যে যেমন খুশি দৌরাত্ম্য করিবে তাহাও সহ্য করা যায় না। অতএব একটা রফা নিষ্পত্তির পথ ধরিতেই হয়। কিন্তু সে পথটা কেহ বাঁধিয়া দিতে পারে না– নদীর মতো ভাষা আপনিই স্বল্পতম বাধার পথ হাতড়াইয়া চলে। আপনি সে কথাও বলিয়াছেন। আপনার বই পড়িয়াই আমার মনে বিশেষ করিয়া এই চিন্তার উদয় হইল– বাংলা সাহিত্যের খেয়া পার হইতে হইলে তিন ঘাটে তাহার মাশুল দিতে হয়, বাংলা ইংরেজি এবং সংস্কৃত। বাংলা ও ইংরেজির পারানির কড়ি কোনো প্রকারে সংগ্রহ হয়, সংস্কৃতের বেলায় ঠেকে, কেননা তাহার জন্য দূরে ঘোরাঘুরি করিতে হয়– সকলের সামর্থ্যে ও সময়ে কুলায় না– এইজন্য সংস্কৃতের কুতঘাটায় যাহারা ফাঁকি দেয় তাহাদের প্রতি দণ্ডবিধি কঠোর করিলে খেয়া একেবারে বন্ধ করিতে হয়। এটা আমি নিজের প্রাণের ভয়ে বলিলাম বটে কিন্তু সাহিত্যের প্রতি মমতা রাখি বলিয়াও বলিতে হইল। চিঠিখানা বড়ো হইয়া গেল সুতরাং ইহার মধ্যে পাণিনি-পীড়ন নিশ্চয়ই ঘটিয়াছে– আর অপরাধ বাড়াইবার স্থান নাই অতএব যদি ক্ষমা করেন, তবে বিলাতি কায়দায় আপনার পাণি-নিপীড়ন করিয়া বিদায় গ্রহণ করি।
৪
…আমার চিঠিতে ইংরেজিটাকেও যে বাংলার সঙ্গে জড়াইয়াছি তাহা ভাষা বা ব্যাকরণের দিক হইতে নহে। আমাদের ভাষায় গদ্য সাহিত্যের কোনো একটা পুরাতন আদর্শ নাই। কাদম্বরী বাসবদত্তার আদর্শ আমাদের কাজে লাগে না। রামমোহন রায় হইতে আরম্ভ করিয়া আজ পর্যন্ত যে-কেহ বাংলা গদ্য সাহিত্য গড়িয়া তুলিবার কাজে লাগিয়াছেন সকলেই ইংরেজিশিক্ষিত। ইংরেজি যাঁহারা একেবারেই জানেন না তাঁহারা কেহ কেহ বাংলা ভাষায় সংস্কৃত দর্শন পুরাণ প্রভৃতি আলোচনা করিয়াছেন অন্য দিকে তাঁহাদের কলম খেলে নাই। নৈনিতাল আলু বাংলা দেশের ক্ষেতেও প্রচুর উৎপন্ন হয় কিন্তু প্রতি বৎসরে তাহার বীজ নৈনিতাল হইতে আনাইতে হয়– হয়তো ক্রমে একদিন এখানকার ক্ষেত্র হইতে উৎপন্ন বীজে কাজ চলিবে। দেখা যাইতেছে ইংরেজির সম্বন্ধেও আমাদের সেই দশা। ইংরেজি সাহিত্যের বীজ বাংলা সাহিত্যে বেশ প্রচুর পরিমাণে ফলিতেছে– তাহাতে আমাদের এ দেশী মাছের ঝোল প্রভৃতিও দিব্য রাঁধা চলিতেছে কিন্তু বীজের আমদানি আজও সেইখান হইতেই হয়। ক্রমে তাহার তেমন প্রয়োজন হইবে না বলিয়া মনে হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত দেখা যাইতেছে যাঁহারা বাংলায় ভালো লেখেন তাঁহারা ইংরেজি জানেন। এই ইংরেজি জানার সঙ্গে বাংলা লেখার যে সম্বন্ধ দেখা যাইতেছে সেটাকে কাকতালীয় ন্যায়ের দৃষ্টান্তে বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না। বরঞ্চ দেখা গিয়াছে সংস্কৃত জানা নাই বা অল্পই জানা আছে এমন লোক বাংলা সাহিত্যে নাম করিয়াছেন কিন্তু ইংরেজি জানা নাই এমন লোকের নাম তো মনে পড়ে না। সেইজন্য বলিতেছি বাংলা সাহিত্যে যিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে ইচ্ছা করেন ইংরেজি শিক্ষার পাথেয় সংগ্রহ করিতে না পারিলে তিনি অধিকদূর অগ্রসর হইতে পারিবেন না– ঘাটতলা ছাড়াইয়া আরো কিছুদূর যাইতে পারেন কিন্তু খুব বেশি দূর নহে। আমার এই কথাটা শুনিতে কটু এবং বলিতেও যে রসনা রসসিক্ত হইয়া উঠে তাহা নহে কিন্তু তবু সত্য।
ভাব এবং ছাঁদ এ দুটো আমরা অনেকটা ইংরেজি সাহিত্য হইতে সংগ্রহ করি– সকল ক্ষেত্রে চুরি করি বা নকল করি তাহা নহে– ইংরেজি শিক্ষার সাহায্য না পাইলে সে ভাব সে ছাঁদ আমাদের সাহিত্যের মন হইতে উৎপন্ন হইত না– আমাদের সাহিত্যের ধরন ধারণ ভাবগতিক অন্য প্রকার হইত। কিন্তু যে কারণেই হউক, যে উপায়েই হউক এখন যে ছাঁদটা দাঁড়াইয়া গিয়াছে তাহাকে একেবারে ঠেলিয়া দেওয়া চলিবে না। ইচ্ছা করিলেও কেহ পারিবে না। মৃত্যুঞ্জয় শর্মা প্রভৃতিরা একদিন বাংলা গদ্য সাহিত্যকে সংস্কৃত ভিতের উপর গড়িতে শুরু করিয়াছিলেন। আজ তাহার ধ্বংসাবশেষও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তাহার পরে ইংরেজিনবিশ বঙ্কিমচন্দ্রের দল যখন কোমর বাঁধিয়া লাগিলেন তখন তাঁহাদের ষত্ব ণত্ব লইয়া সংস্কৃত কেল্লা হইতে অনেক গোলাগুলি চলিয়াছিল কিন্তু তাঁহাদের কীর্তি আজও দুষ্ট ব্যাকরণের কলঙ্ক গায়ে মাখিয়াও উজ্জ্বল হইয়া বিরাজ করিতেছে। আজ কলঙ্ক-ভঞ্জনের চেষ্টা হইতেছে। ঘটে যে ছিদ্র আছে সে কথা কেহ অস্বীকার করিতেছে না কিন্তু তবু সে ঘট পূর্ণ হইয়া আছে। কলঙ্ক সত্ত্বেও গৌরবহানি হইতেছে না। জল তোলা চলিতেছে বটে কিন্তু কোডাক্ ক্যামেরার দ্বারা ধরা পড়িয়াছে ছিদ্র আছে; সেটা একেবারে সপ্রমাণ হইয়া গেছে, জল পড়ুক না পড়ুক মাথা হেঁট করিতেই হইবে– কিন্তু আমি বলিতেছি ছিদ্র সারিবে না, তবু কলঙ্ক মোচন হইবে। সাহিত্য লীলার ভিতরে যিনি আছেন তিনি সমস্তই আপনার গূঢ় শক্তিতে সারিয়া লইবেন– ব্যাকরণের সূত্র ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইলে আমরা যতই ভয় করি তিনি ততই হাসিতে থাকেন। সকল দেশেই তিনি এইরূপ ফুটাফাটা লইয়াই চালাইয়া আসিয়াছেন– ক্ষুদ্র যাহারা তাহারাই নিখুঁতের কারবার করে, তিনি খুঁতকে ভয় করেন না ভাষায় ভাষায় সাহিত্যে সাহিত্যে তাহার প্রমাণ আছে।’
৫
ব্যাকরণিকা বাংলা শেখানোর পক্ষে উপযোগী হয়েছে। খাঁটি বাংলা ব্যাকরণের প্রয়োজন আছে।
এককালে সমাসদর্পণ ও লোহারামের ব্যাকরণ আমাদের পড়তে হয়েছে, সেটাতে সংস্কৃত শিক্ষার ভূমিকা হয়েছিল। তাতে খাঁটি বাংলা ভাষাকে যথোচিত স্বীকার করা হয় নি। আমার নিজের মত এই যে, পারিভাষিক ব্যাকরণের অনেক অংশই, বাংলা সাহিত্য পরিচয় অগ্রসর হলে, তার পরে আলোচ্য। ভাষাটা মোটামুটি আয়ত্ত হলে তার পরে বিশ্লেষণের দ্বারা পরিচয় পাকা করবার সময়। বস্তুত বাংলার যে অংশটা সংস্কৃতের অনুবর্তী, যেমন সন্ধি তদ্ধিতপ্রত্যয় সমাস, সেইগুলোই গোড়া থেকে জানা চাই। বাংলায় তৎসম শব্দের উপযুক্ত ব্যবহার কিছুপরিমাণ সংস্কৃত ব্যাকরণের সাহায্যে সম্ভবপর হয়। যে বাংলা শিশুকাল থেকে আমাদের অভ্যস্ত তার ব্যাকরণ, ভাষা-পরিচয়ের জন্য, আবশ্যক নয়, ভাষাতত্ত্ব জানবার জন্যেই সে উপযোগী। কিন্তু শিশুদের জন্যে, বাংলা ক্লাসে বাংলা ব্যাকরণ পড়ানোর বিধি যদি প্রবর্তিত হয়ে থাকে তা হলে এই ব্যাকরণ যথোপযুক্ত হয়েছে বলে বিশ্বাস করি।
সংস্কৃত ভাষার পরিভাষা বাংলায় সর্বত্র খাটে কি না সন্দেহ করি।
বৈশাখ, ১৩০৮
ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা
সর্বপ্রথমে বলে রাখি আমার স্বভাবে এবং ব্যবহারে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব নেই। দুই পক্ষেরই অত্যাচারে আমি সমান লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হই এবং সে রকম উপদ্রবকে সমস্ত দেশেরই অগৌরব বলে মনে করে থাকি।
ভাষামাত্রেরই একটা মজ্জাগত স্বভাব আছে, তাকে না মানলে চলে না। স্কটল্যাণ্ডের ও ওয়েল্সের লোকে সাধারণত আপন স্বজন-পরিজনের মধ্যে সর্বদাই যে-সব শব্দ ব্যবহার করে থাকে তাকে তারা ইংরেজি ভাষার মধ্যে চালাবার চেষ্টামাত্র করে না। তারা এই সহজ কথাটি মেনে নিয়েছে যে, যদি তারা নিজেদের অভ্যস্ত প্রাদেশিকতা ইংরেজি ভাষায় ও সাহিত্যে চালাতে চায় তা হলে ভাষাকে বিকৃত ও সাহিত্যকে উচ্ছৃঙ্খল করে তুলবে। কখনো কখনো কোনো স্কচ লেখক স্কচ ভাষায় কবিতা প্রভৃতি লিখেছেন কিন্তু সেটাকে স্পষ্টত স্কচ ভাষারই নমুনা স্বরূপে স্বীকার করেছেন। অথচ স্কচ ও ওয়েল্স ইংরেজের সঙ্গে এক নেশনের অন্তর্গত।
আয়ারল্যাণ্ডে আইরিশে-ব্রিটিশে ব্ল্যাক অ্যাণ্ড ট্যান নামক বীভৎস খুনোখুনি ব্যাপার চলেছিল কিন্তু সেই হিংস্রতার উত্তেজনা ইংরেজি ভাষার মধ্যে প্রবেশ করে নি। সেদিনও আইরিশ কবি ও লেখকেরা যে ইংরেজি ব্যবহার করেছেন সে অবিমিশ্র ইংরেজিই।
ইংরেজিতে সহজেই বিস্তর ভারতীয় ভাষার শব্দ চলে গেছে। একটা দৃষ্টান্ত jungle– সেই অজুহাতে বলা চলে না, তবে কেন অরণ্য শব্দ চালাব না! ভাষা খামখেয়ালি, তার শব্দ-নির্বাচন নিয়ে কথা-কাটাকাটি করা বৃথা।
বাংলা ভাষায় সহজেই হাজার হাজার পারসী আরবী শব্দ চলে গেছে। তার মধ্যে আড়াআড়ি বা কৃত্রিম জেদের কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু যে-সব পারসী আরবী শব্দ সাধারণ্যে অপ্রচলিত অথবা হয়তো কোনো-এক শ্রেণীর মধ্যেই বদ্ধ, তাকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রক্ষেপ করাকে জবরদস্তি বলতেই হবে। হত্যা অর্থে খুন ব্যবহার করলে সেটা বেখাপ হয় না, বাংলায় সর্বজনের ভাষায় সেটা বেমালুম চলে গেছে। কিন্তু রক্ত অর্থে খুন চলে নি, তা নিয়ে তর্ক করা নিষ্ফল।
উর্দু ভাষায় পারসী ও আরবী শব্দের সঙ্গে হিন্দী ও সংস্কৃত শব্দের মিশল চলেছে– কিন্তু স্বভাবতই তার একটা সীমা আছে। ঘোরতর পণ্ডিতও উর্দু লেখার কালে উর্দুই লেখেন, তার মধ্যে যদি তিনি “অপ্রতিহত প্রভাবে’ শব্দ চালাতে চান তা হলে সেটা হাস্যকর বা শোকাবহ হবেই।
আমাদের গণশ্রেণীর মধ্যে য়ুরেশীয়েরাও গণ্য। তাঁদের মধ্যে বাংলা লেখায় যদি কেউ প্রবৃত্ত হন এবং বাবা মা শব্দের বদলে পাপা মামা ব্যবহার করতে চান এবং তর্ক করেন ঘরে আমরা ঐ কথাই ব্যবহার করে থাকি তবে সে তর্ককে কি যুক্তিসংগত বলব? অথচ তাঁদেরকেও অর্থাৎ বাঙালি য়ুরেশীয়কে আমরা দূরে রাখা অন্যায় বোধ করি। খুশি হব তাঁরা বাংলা ব্যবহার করলে কিন্তু সেটা যদি য়ুরেশীয় বাংলা হয়ে ওঠে তা হলে ধিক্কার দেব নিজের ভাগ্যকে। আমাদের ঝগড়া আজ যদি ভাষার মধ্যে প্রবেশ করে সাহিত্যে উচ্ছৃঙ্খলতার কারণ হয়ে ওঠে তবে এর অভিসম্পাত আমাদের সভ্যতার মূলে আঘাত করবে।
২
আজকাল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে আশ্রয় করে ভাষা ও সাহিত্যকে বিকৃত করবার যে চেষ্টা চলছে তার মতো বর্বরতা আর হতে পারে না। এ যেন ভাইয়ের উপর রাগ করে পারিবারিক বাস্তুঘরে আগুন লাগানো। সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে নিষ্ঠুর বিরুদ্ধতা অন্যান্য দেশের ইতিহাসে দেখেছি কিন্তু আজ পর্যন্ত নিজের দেশ-ভাষাকে পীড়িত করবার উদ্যোগ কোনো সভ্য দেশে দেখা যায় নি। এমনতর নির্মম অন্ধতা বাংলা প্রদেশেই এত বড়ো স্পর্ধার সঙ্গে আজ দেখা দিয়েছে বলে আমি লজ্জা বোধ করি। বাংলা দেশের মুসলমানকে যদি বাঙালি বলে গণ্য না করতুম তবে সাহিত্যিক এই অদ্ভুত কদাচার সম্বন্ধে তাঁদের কঠিন নিন্দা ঘোষণা করে সান্ত্বনা পেতে পারতুম। কিন্তু জগতের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ-প্রসূত এই মূঢ়তার গ্লানি নিজে স্বীকার না ক’রে উপায় কি? বেলজিয়মে জনসাধারণের মধ্যে এক দল বলে ফ্লেমিশ, অন্য দল ফরাসি; কিন্তু ফ্লেমিশভাষী লেখক সাহিত্যে যখন ফরাসি ভাষা ব্যবহার করে, তখন ফ্লেমিশ শব্দ মিশিয়ে ফরাসি ভাষাকে আবিল করে তোলবার কথা কল্পনাও করে না। অথচ সেখানকার দুই সমাজের মধ্যে বিপক্ষতা যথেষ্ট আছে। উত্তর-পশ্চিমে, সিন্ধু ও পঞ্জাব প্রদেশে হিন্দু-মুসলমানে সদ্ভাব নেই। সে-সকল প্রদেশে অনেক হিন্দু উর্দু ব্যবহার করে থাকেন, তাঁরা আড়াআড়ি করে উর্দুভাষায় সংস্কৃত শব্দ অসংগতভাবে মিশল করতে থাকবেন, তাঁদের কাছ থেকে এমনতর প্রমত্ততা প্রত্যাশা করতে পারি নে। এ রকম অদ্ভুত আচরণ কেবলই কি ঘটতে পারবে বিশ্বজগতের মধ্যে একমাত্র বাংলা দেশে? আমাদের রক্তে এই মোহ মিশ্রিত হতে পারল কোথা থেকে? হতভাগ্য এই দেশ, যেখানে ভ্রাতৃবিদ্রোহে দেশবিদ্রোহে পরিণত হয়ে সর্বসাধারণের সম্পদকে নষ্ট করতে কুণ্ঠিত হয় না। নিজের সুবুদ্ধিকে কলঙ্কিত করার মধ্যে যে আত্মাবমাননা আছে দুর্দিনে সে কথাও মানুষ যখন ভোলে তখন সাংঘাতিক দুর্গতি থেকে কে বাঁচাবে?
৩
ভাষাব্যবহার সম্বন্ধে আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। আচারের পার্থক্য ও মনস্তত্ত্বের বিশেষত্ব অনুবর্তন না করলে ভাষার সার্থকতাই থাকে না। তথাপি ভাষার নমনীয়তার একটা সীমা আছে। ভাষার যেটা মূল স্বভাব তার অত্যন্ত প্রতিকূলতা করলে ভাব প্রকাশের বাহনকে অকর্মণ্য করে ফেলা হয়। প্রয়োজনের তাগিদে ভাষা বহুকাল থেকে বিস্তর নতুন কথার আমদানি করে এসেছে। বাংলা ভাষায় পারসী আরবী শব্দের সংখ্যা কম নয় কিন্তু তারা সহজেই স্থান পেয়েছে। প্রতিদিন একটা দুটো করে ইংরেজি শব্দও আমাদের ব্যবহারের মধ্যে প্রবেশ করছে। ভাষার মূল প্রকৃতির মধ্যে একটা বিধান আছে যার দ্বারা নূতন শব্দের যাচাই হতে থাকে, গায়ের জোরে এই বিধান না মানলে জারজ শব্দ কিছুতেই জাতে ওঠে না। ইংরেজি ভাষার দিকে তাকিয়ে দেখলে আমার কথার সত্যতা বুঝতে পারবেন। ওয়েল্স আইরিশ স্কচ ভাষা ইংরেজি ভাষার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, ব্রিটেনের ঐ-সকল উপজাতিরা আপন আত্মীয়মহলে ঐ-সকল উপভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে স্বভাবতই ব্যবহার করে থাকেন কিন্তু যে সাধারণ ইংরেজি ভাষা তাঁদের সাহিত্যের ভাষা ঐ শব্দগুলি তার আসরে জবরদস্তি করতে পারে না। এইজন্যেই ঐ সাধারণ ভাষা আপনি নিত্য আদর্শ রক্ষা করে চলতে পেরেছে। নইলে ব্যক্তিগত খেয়াল অনুসারে নিয়ত তার বিকার ঘটত। খুনখারাবি শব্দটা ভাষা সহজেই মেনে নিয়েছে, আমরা তাকে যদি না মানি তবে তাকে বলব গোঁড়ামি। কিন্তু রক্ত অর্থে খুন শব্দকে ভাষা স্বীকার করে নি, কোনো বিশেষ পরিবারে বা সম্প্রদায়ে ঐ অর্থই অভ্যস্ত হতে পারে তবু সাধারণ বাংলা ভাষায় ঐ অর্থ চালাতে গেলে ভাষা বিমুখ হবে। শক্তিমান মুসলমান লেখকেরা বাংলা সাহিত্যে মুসলমান জীবনযাত্রার বর্ণনা যথেষ্ট পরিমাণে করেন নি, এ অভাব সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সমস্ত সাহিত্যের অভাব। এই জীবনযাত্রার যথোচিত পরিচয় আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক। এই পরিচয় দেবার উপলক্ষে মুসলমান সমাজের নিত্যব্যবহৃত শব্দ যদি ভাষায় স্বতই প্রবেশলাভ করে তবে তাতে সাহিত্যের ক্ষতি হবে না, বরং বলবৃদ্ধি হবে, বাংলা ভাষার অভিব্যক্তির ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত আছে…।
১১ চৈত্র, ১৩৬০
ভাষার কথা
পদ্মায় যখন পুল হয় নাই তখন এপারে ছিল চওড়া রেলপথ, ওপারে ছিল সরু। মাঝখানে একটা বিচ্ছেদ ছিল বলিয়া রেলপথের এই দ্বিধা আমাদের সহিয়াছিল। এখন সেই বিচ্ছেদ মিটিয়া গেছে তবু ব্যবস্থার কার্পণ্যে যখন অর্ধেক রাত্রে জিনিসপত্র লইয়া গাড়ি বদল করিতে হয় তখন রেলের বিধাতাকে দোষ না দিয়া থাকিতে পারি না।
ও তো গেল মানুষ এবং মাল চলাচলের পথ, কিন্তু ভাব চলাচলের পথ হইল ভাষা। কিছুকাল হইতে বাংলাদেশে এই ভাষায় দুই বহরের পথ চলিত আছে। একটা মুখের বুলির পথ, আর-একটা পুঁথির বুলির পথ। দুই-একজন সাহসিক বলিতে শুরু করিয়াছেন যে, পথ এক মাপের হইলে সকল পক্ষেই সুবিধা। অথচ ইহাতে বিস্তর লোকের অমত। এমন-কি তাঁরা এতই বিচলিত যে, সাধু ভাষার পক্ষে তাঁরা যে ভাষা প্রয়োগ করিতেছেন তাহাতে বাংলা ভাষায় আর যা-ই হোক, সাধুতার চর্চা হইতেছে না।
এ তর্কে যদিও আমি যোগ দিই নাই তবু আমার নাম উঠিয়াছে। এ সম্বন্ধে আমার যে কী মত তাহা আমি ছাড়া আমার দেশের পনেরো-আনা লোকেই একপ্রকার ঠিক করিয়া লইয়াছেন, এবং যাঁর যা মনে আছে বলিতে কসুর করেন নাই। ভাবিয়াছিলাম চারি দিকের তাপটা কমিলে ঠাণ্ডার সময় আমার কথাটা পাড়িয়া দেখিব। কিন্তু বুঝিয়াছি সে আমার জীবিতকালের মধ্যে ঘটিবার আশা নাই। অতএব আর সময় নষ্ট করিব না।
ছোটোবেলা হইতেই সাহিত্য রচনায় লাগিয়াছি। বোধ করি সেইজন্যই ভাষাটা কেমন হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে আমার স্পষ্ট কোনো মত ছিল না। যে-বয়সে লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম তখন, পুঁথির ভাষাতেই পুঁথি লেখা চাই, এ কথায় সন্দেহ করিবার সাহস বা বুদ্ধি ছিল না। তাই, সাহিত্য-ভাষার পথটা এই সরু বহরের পথ, তাহা যে প্রাকৃত বাংলা ভাষার চওড়া বহরের পথ নয়, এই কথাটা বিনা দ্বিধায় মনের মধ্যে পাকা হইয়া গিয়াছিল।
একবার যেটা অভ্যাস হইয়া যায় সেটাতে আর নাড়া দিতে ইচ্ছা হয় না। কেননা স্বভাবের চেয়ে অভ্যাসের জোর বেশি। অভ্যাসের মেঠো পথ দিয়া গাড়ির গোরু আপনিই চলে, গাড়োয়ান ঘুমাইয়া পড়িলেও ক্ষতি হয় না। কিন্তু ইহার চেয়ে প্রবল কারণ এই যে, অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে একটা অহংকারের যোগ আছে। যেটা বরাবর করিয়া আসিয়াছি সেটার যে অন্যথা হইতে পারে এমন কথা শুনিলে রাগ হয়। মতের অনৈক্য রাগারাগি হইবার প্রধান কারণই এই অহংকার। মনে আছে বহুকাল পূর্বে যখন বলিয়াছিলাম বাঙালির শিক্ষা বাংলা ভাষার যোগেই হওয়া উচিত তখন বিস্তর শিক্ষিত বাঙালি আমার সঙ্গে যে কেবল মতে মেলেন নাই তা নয় তাঁরা রাগ করিয়াছিলেন। অথচ এ জাতীয় মতের অনৈক্য ফৌজদারি দণ্ডবিধির মধ্যে পড়ে না। আসল কথা, যাঁরা ইংরাজি শিখিয়া মানুষ হইয়াছেন, তাঁরা বাংলা শিখিয়া মানুষ হইবার প্রস্তাব শুনিলেই যে উদ্ধত হইয়া ওঠেন, মূলে তার অহংকার।
একদিন নিজের স্বভাবেই ইহার পরিচয় পাইয়াছিলাম, সে কথাটা এইখানেই কবুল করি। পূর্বেই তো বলিয়াছি যে-ভাষা পুঁথিতে পড়িয়াছি সেই ভাষাতেই চিরদিন পুঁথি লিখিয়া হাত পাকাইলাম; এ লইয়া এপক্ষে বা ওপক্ষে কোনোপ্রকার মত গড়িয়া তুলিবার সময় পাই নাই। কিন্তু “সবুজ পত্র’-সম্পাদকের বুদ্ধি নাকি তেমন করিয়া অভ্যাসের পাকে জড়ায় নাই এইজন্য তিনি ফাঁকায় থাকিয়া অনেকদিন হইতেই বাংলা সাহিত্যের ভাষা সম্বন্ধে একটা মত খাড়া করিয়াছেন।
বহুকাল পূর্বে তাঁর এই মত যখন আমার কানে উঠিয়াছিল আমার একটুও ভালো লাগে নাই। এমন-কি রাগ করিয়াছিলাম। নূতন মতকে পুরাতন সংস্কার অহংকার বলিয়া তাড়া করিয়া আসে, কিন্তু অহংকার যে পুরাতন সংস্কারের পক্ষেই প্রবল এ কথা বুঝিতে সময় লাগে। অতএব, প্রাকৃত বাংলাকে পুঁথির পঙ্ক্তিতে তুলিয়া লইবার বিরুদ্ধে আজকের দিনে যে-সব যুক্তি শোনা যাইতেছে সেগুলো আমিও একদিন আবৃত্তি করিয়াছি।
এক জায়গায় আমার মন অপেক্ষাকৃত সংস্কার-মুক্ত। পদ্য রচনায় আমি প্রচলিত আইন-কানুন কোনোদিন মানি নাই। জানিতাম কবিতায় ভাষা ও ছন্দের একটা বাঁধন আছে বটে, কিন্তু সে বাঁধন নূপুরের মতো, তাহা বেড়ির মতো নয়। এইজন্য কবিতার বাহিরের শাসনকে উপেক্ষা করিতে কোনোদিন ভয় পাই নাই।
“ক্ষণিকা’য় আমি প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রাকৃত বাংলা ভাষা ও প্রাকৃত বাংলার ছন্দ ব্যবহার করিয়াছিলাম। তখন সেই ভাষার শক্তি, বেগ ও সৌন্দর্য প্রথম স্পষ্ট করিয়া বুঝি। দেখিলাম এ ভাষা পাড়াগাঁয়ের টাট্টু ঘোড়ার মতো কেবলমাত্র গ্রাম্য-ভাবের বাহন নয়, ইহার গতিশক্তি ও বাহনশক্তি কৃত্রিম পুঁথির ভাষার চেয়ে অনেক বেশি।
বলা বাহুল্য “ক্ষণিকা’য় আমি কোনো পাকা মত খাড়া করিয়া লিখি নাই, লেখার পরেও একটা মত যে দৃঢ় করিয়া চলিতেছি তাহা বলিতে পারি না। আমার ভাষা রাজাসন এবং রাখালী, মথুরা এবং বৃন্দাবন, কোনোটার উপরেই আপন দাবি সম্পূর্ণ ছাড়ে নাই। কিন্তু কোন্ দিকে তার অভ্যাসের টান এবং কোন্ দিকে অনুরাগের, সে বিচার পরে হইবে এবং পরে করিবে।
এইখানে বলা আবশ্যক চিঠিপত্রে আমি চিরদিন কথ্য ভাষা ব্যবহার করিয়াছি। আমার সতেরো বছর বয়সে লিখিত “য়ুরোপ যাত্রীর পত্রে’ এই ভাষা প্রয়োগের প্রমাণ আছে। তা ছাড়া বক্তৃতাসভায় আমি চিরদিন প্রাকৃত বাংলা ব্যবহার করি, “শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে তাহার উদাহরণ মিলিবে।
যাই হোক এ সম্বন্ধে আমার মনে যে তর্ক আছে সে এই–বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সূত্রপাত হইল বিদেশীর ফরমাশে, এবং তার সূত্রধার হইলেন সংস্কৃত পণ্ডিত, বাংলা ভাষার সঙ্গে যাঁদের ভাসুর-ভাদ্রবউয়ের সম্বন্ধ। তাঁরা এ ভাষার কখনো মুখদর্শন করেন নাই। এই সজীব ভাষা তাঁদের কাছে ঘোমটার ভিতরে আড়ষ্ট হইয়া ছিল, সেইজন্য ইহাকে তাঁরা আমল দিলেন না। তাঁরা সংস্কৃত ব্যাকরণের হাতুড়ি পিটিয়া নিজের হাতে এমন একটা পদার্থ খাড়া করিলেন যাহার কেবল বিধিই আছে কিন্তু গতি নাই। সীতাকে নির্বাসন দিয়া যজ্ঞকর্তার ফরমাশে তাঁরা সোনার সীতা গড়িলেন।
যদি স্বভাবের তাগিদে বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি হইত, তবে এমন গড়াপেটা ভাষা দিয়া তার আরম্ভ হইত না। তবে গোড়ায় তাহা কাঁচা থাকিত এবং ক্রমে ক্রমে পাকা নিয়মে তার বাঁধন আঁট হইয়া উঠিত। প্রাকৃত বাংলা বাড়িয়া উঠিতে উঠিতে প্রয়োজনমত সংস্কৃত ভাষার ভাণ্ডার হইতে আপন অভাব দূর করিয়া লইত।
কিন্তু বাংলা গদ্য-সাহিত্য ঠিক তার উল্টা পথে চলিল। গোড়ায় দেখি তাহা সংস্কৃত ভাষা, কেবল তাহাকে বাংলার নামে চালাইবার জন্য কিছু সামান্য পরিমাণে তাহাতে বাংলার খাদ মিশাল করা হইয়াছে। এ একরকম ঠকানো। বিদেশীর কাছে এ প্রতারণা সহজেই চলিয়াছিল।
যদি কেবল ইংরেজকে বাংলা শিখাইবার জন্যই বাংলা গদ্যের ব্যবহার হইত, তবে সেই মেকি-বাংলার ফাঁকি আজ পর্যন্ত ধরা পড়িত না। কিন্তু এই গদ্য যতই বাঙালির ব্যবহারে আসিয়াছে ততই তাহার রূপ পরিবর্তন হইয়াছে। এই পরিবর্তনের গতি কোন্ দিকে? প্রাকৃত বাংলার দিকে। আজ পর্যন্ত বাংলা গদ্য, সংস্কৃত ভাষার বাধা ভেদ করিয়া, নিজের যথার্থ আকৃতি ও প্রকৃতি প্রকাশ করিবার জন্য যুঝিয়া আসিতেছে।
অল্প মূলধনে ব্যাবসা আরম্ভ করিয়া ক্রমশ মুনফার সঙ্গে সঙ্গে মূলধনকে বাড়াইয়া তোলা, ইহাই ব্যাবসার স্বাভাবিক প্রণালী। কিন্তু বাংলা-গদ্যের ব্যাবসা মূলধন লইয়া শুরু হয় নাই, মস্ত একটা দেনা লইয়া তার শুরু। সেই দেনাটা খোলসা করিয়া দিয়া স্বাধীন হইয়া উঠিবার জন্যই তার চেষ্টা।
আমাদের পুঁথির ভাষার সঙ্গে কথার ভাষার মিলন ঘটিতে এত বাধা কেন, কার কারণ আছে। যে গদ্যে বাঙালি কথাবার্তা কয় সে গদ্য বাঙালির মনোবিকাশের সঙ্গে তাল রাখিয়া চলিয়া আসিয়াছে। সাধারণত বাঙালি যে-বিষয় ও যে-ভাব লইয়া সর্বদা আলোচনা করিয়াছে বাংলার চলিত গদ্য সেই মাপেরই। জলের পরিমাণ যতটা, নদী-পথের গভীরতা ও বিস্তার সেই অনুসারেই হইয়া থাকে। স্বয়ং ভগীরথও আগে লম্বা-চওড়া পথ কাটিয়া তার পরে গঙ্গাকে নামাইয়া আনেন নাই।
বাঙালি যে ইতিপূর্বে কেবলই চাষবাস এবং ঘরকন্নার ভাবনা লইয়াই কাটাইয়াছে এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নহে। কিন্তু ইতিপূর্বে তার চেয়ে বড়ো কথা যাঁরা চিন্তা করিয়াছেন তাঁরা বিশেষ সম্প্রদায়ে বদ্ধ। তাঁরা প্রধানত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের দল। তাঁদের শিক্ষা এবং ব্যাবসা, দুইয়েরই অবলম্বন ছিল সংস্কৃত পুঁথি। এইজন্য ঠিক বাংলা ভাষায় মনন করা বা মত প্রকাশ করা তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল না। তাই সেকালের গদ্য উচ্চ চিন্তার ভাষা হইয়া উঠিতে পারে নাই।
অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালেও আমাদের দেশে ভাষা ও চিন্তার মধ্যে এইরূপ দ্বন্দ্ব চলিয়া আসিয়াছে। যাঁরা ইংরেজিতে শিক্ষা পাইয়াছেন তাঁদের পক্ষে ইংরেজিতেই চিন্তা করা সহজ; বিশেষত যে-সকল ভাব ও বিষয় ইংরেজি হইতেই তাঁরা প্রথম লাভ করিয়াছেন সেগুলা বাংলা ভাষায় ব্যবহার করা দুঃসাধ্য। কাজেই আমাদের ইংরেজি-শিক্ষা ও বাংলা ভাষা সদরে অন্দরে স্বতন্ত্র হইয়া বাস করিয়া আসিতেছে।
এমন সময় যাঁরা শিক্ষার সঙ্গে ভাষার মিল ঘটাইতে বসিলেন বাংলার চলিত গদ্য লইয়া কাজ চালানো তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হইল। শুধু যদি শব্দের অভাব হইত তবে ক্ষতি ছিল না কিন্তু সব চেয়ে বিপদ এই যে, নূতন শব্দ বানাইবার শক্তি প্রাকৃত বাংলার মধ্যে নাই। তার প্রধান কারণ বাংলায় তদ্ধিত প্রত্যয়ের উপকরণ ও ব্যবহার অত্যন্ত সংকীর্ণ। “প্রার্থনা’ সংস্কৃত শব্দ, তার খাঁটি বাংলা প্রতিশব্দ “চাওয়া’। “প্রার্থিত’ “প্রার্থনীয়’ শব্দের ভাবটা যদি ঐ খাঁটি বাংলায় ব্যবহার করিতে যাই তবে অন্ধকার দেখিতে হয়। আজ পর্যন্ত কোনো দুঃসাহসিক “চায়িত’ ও “চাওনীয়’ বাংলায় চালাইবার প্রস্তাব মাত্র করেন নাই। মাইকেল অনেক জায়গায় সংস্কৃত বিশেষ্যপদকে বাংলার ধাতুরূপের অধীন করিয়া নূতন ক্রিয়াপদে পরিণত করিয়াছেন। কিন্তু বাংলায় এ পর্যন্ত তাহা আপদ আকারেই রহিয়া গেছে, সম্পদরূপে গণ্য হয় নাই।
সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে সঙ্গে তার তদ্ধিত প্রত্যয় পর্যন্ত লইতে গেলে সংস্কৃত ব্যাকরণেরও অনেকটা অংশ আপনি আসিয়া পড়ে। সুতরাং দুই নৌকায় পা দিবামাত্রই যে টানাটানি বাধিয়া যায় তাহা ভালো করিয়া সামলাইতে গেলে সাহিত্য-সার্কাসের মল্লগিরি করিতে হয়। তার পর হইতে এ তর্কের আর কিনারা পাওয়া যায় না যে, নিজের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার স্বাধীন অধিকার কতদূর এবং তাহাতে সংস্কৃত শাসনের সীমা কোথায়। সংস্কৃত বৈয়াকরণের উপর যখন জরিপ জমাবন্দীর ভার পড়ে তখন একেবারে বাংলার বাস্তুভিটার মাঝখানটাতে সংস্কৃত ব্যাকরণের খুঁটিগাড়ি হয়, আবার অপর পক্ষের উপর যখন ভার পড়ে তখন তাঁরা বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণ বিভাগে একেবারে দক্ষযজ্ঞ বাধাইয়া দেন।
কিন্তু মুশকিলের বিষয় এই যে, যে-ভাষায় মল্লবিদ্যার সাহায্য ছাড়া এক-পা চলিবার জো নাই সেখানে সাধারণের পক্ষে পদে পদে অগ্রসর হওয়ার চেয়ে পদে পদে পতনের সম্ভাবনাই বেশি। পথটাই যেখানে দুর্গম সেখানে হয় মানুষের চলিবার তাগিদ থাকে না, নয় চলিতে হইলে পথ অপথ দুটোকেই সুবিধা অনুসারে আশ্রয় করিতে হয়। ঘাটে মাল নামাইতে হইলে যে দেশে মাশুলের দায়ে দেউলে হওয়ার কথা সে দেশে আঘাটায় মাল নামানোর অনুকূলে নিশ্চয়ই স্বয়ং বোপদের চোখ টিপিয়া ইশারা করিয়া দিতেন। কিন্তু বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়; বোপদেবের চেলারা যেখানে ঘাঁটি আগলাইয়া বসিয়া আছেন সেখানে বাংলা ভাষায় বাংলা-সাহিত্যের ব্যাবসা চালানো দুঃসাধ্য হইল।
জাপানিদের ঠিক এই বিপদ। চীনা ভাষার শাসন জাপানি ভাষার উপর অত্যন্ত প্রবল। তার প্রধান কারণ প্রাকৃত জাপানি প্রাকৃত বাংলার মতো; নূতন প্রয়োজনের ফরমাশ জোগাইবার শক্তি তার নাই। সে শক্তি প্রাচীন চীনা ভাষার আছে। এই চীনা ভাষাকে কাঁধে লইয়া জাপানি ভাষাকে চলিতে হয়। কাউন্ট ওকুমা আমার কাছে আক্ষেপ করিয়া বলিতেছিলেন যে, এই বিষম পালোয়ানীর দায়ে জাপানি-সাহিত্যের বড়োই ক্ষতি করিতেছে। কারণ এ কথা বোঝা কঠিন নয় যে, যে-ভাষায় ভাবপ্রকাশ করাটাই একটা কুস্তিগিরি সেখানে ভাবটাকেই খাটো হইয়া থাকিতে হয়। যেখানে মাটি কড়া সেখানে ফসলের দুর্দিন। যেখানে শক্তির মিতব্যয়িতা, অসম্ভব শক্তির সদ্ব্যয়ও সেখানে অসম্ভব। যদি পণ্ডিতমশায়দের এই রায়ই পাকা হয় যে, সংস্কৃত ভাষায় মহামহোপাধ্যায় না হইলে বাংলা ভাষায় কলম ধরা ধৃষ্টতা, তবে যাঁদের সাহস আছে ও মাতৃভাষার উপর দরদ আছে, প্রাকৃত বাংলার জয়পতাকা কাঁধে লইয়া তাঁদের বিদ্রোহে নামিতে হইবে।
ইহার পূর্বেও “আলালের ঘরের দুলাল’ প্রভৃতির মতো বই বিদ্রোহের শাঁখ বাজাইয়াছিল কিন্তু তখন সময় আসে নাই। এখনি যে আসিল এ কথা বলিবার হেতু কী? হেতু আছে। তাহা বলিবার চেষ্টা করি।
ইংরেজি হইতে আমরা যা লাভ করিয়াছি যখন আমাদের দেশে ইংরেজিতেই তার ব্যাবসা চলিতেছিল তখন দেশের ভাষার সঙ্গে দেশের শিক্ষার কোনো সামঞ্জস্য ঘটে নাই। রামমোহন রায় হইতে শুরু করিয়া আজ পর্যন্ত ক্রমাগতই নূতন ভাব ও নূতন চিন্তা আমাদের ভাষার মধ্যে আনাগোনা করিতেছে। এমন করিয়া আমাদের ভাষা চিন্তার ভাষা হইয়া উঠিয়াছে। এখন আমরা ঘরে ঘরে মুখে মুখে যে-সব শব্দ নিরাপদে ব্যবহার করি তাহা আর পঁচিশ বছর পূর্বে করিলে দুর্ঘটনা ঘটিত। এখন আমাদের ভাষা-বিচ্ছেদের উপর সাঁড়া ব্রিজ বাঁধা হইয়াছে। এখন আমরা মুখের কথাতেও নূতন পুরাতন সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করি আবার পুঁথির ভাষাতেও এমন শব্দ চলিতেছে পূর্বে সাধু ভাষায় যাদের জল-চল ছিল না। সেইজন্যই পুঁথির ভাষায় ও মুখের ভাষায় সমান বহরের রেল পাতিবার যে-প্রস্তাব উঠিয়াছে, অভ্যাসের আরামে ও অহংকারে ঘা লাগিলেও সেটাকে একেবারে উড়াইয়া দিতে পারি না।
আসল কথা, সংস্কৃত ভাষা যে-অংশে বাংলা ভাষার সহায় সে-অংশে তাহাকে লইতে হইবে, যে-অংশে বোঝা সে-অংশে তাহাকে ত্যাগ করিতে হইবে। বাংলাকে সংস্কৃতের সন্তান বলিয়াই যদি মানিতে হয় তবে সেইসঙ্গে এ কথাও মানা চাই যে, তার ষোলো বছর পার হইয়াছে, এখন আর শাসন চলিবে না, এখন মিত্রতার দিন। কিন্তু যতদিন বাংলা বইয়ের ভাষা চলিত ভাষার ঠাট না গ্রহণ করিবে ততদিন বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার সত্য সীমানা পাকা হইতে পারিবে না। ততদিন সংস্কৃত বৈয়াকরণের বর্গির দল আমাদের লেখকদের ত্রস্ত করিয়া রাখিবেন। প্রাকৃত বাংলার ঠাটে যখন লিখিব তখন স্বভাবতই সুসংগতির নিয়মে সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব বাংলা ভাষার বেড়া ডিঙাইয়া উৎপাত করিতে কুণ্ঠিত হইবে।
পূবেই বলিয়াছি, বেড়ার ভিতরকার গাছ যেখানে একটু-আধটু ফাঁক পায় সেইখান দিয়াই আলোর দিকে ডালপালা মেলে, তেমনি করিয়াই বাংলার সাহিত্য-ভাষা সংস্কৃতের গরাদের ভিতর দিয়া, চল্তি ভাষার দিকে মাঝে মাঝে মুখ বাড়াইতে শুরু করিয়াছিল। তা লইয়া তাহাকে কম লোকনিন্দা সহিতে হয় নাই। এইজন্যই বঙ্কিমচন্দ্রের অভ্যুদয়ের দিনে তাঁকে কটুকথা অনেক সহিতে হইয়াছে। তাই মনে হয় আমাদের দেশে এই কটু কথার হাওয়াটাই বসন্তের দক্ষিণ হাওয়া। ইহা কুঞ্জবনকে নাড়া দিয়া তাড়া দিয়া অস্থির করিয়া দেয়। কিন্তু এই শাসনটা ফুলের কীর্তন পালার প্রথম খোলের চাঁটি।
পুঁথির বাংলার যে অংশটা লইয়া বিশেষভাবে তর্ক প্রবল, তাহা ক্রিয়ার রূপ। “হইবে’র জায়গায় “হবে’, “হইতেছে’র জাগায় “হচ্চে’ ব্যবহার করিলে অনেকের মতে ভাষার শুচিতা নষ্ট হয়। চীনারা যখন টিকি কাটে নাই তখন টিকির খর্বতাকে তারা মানের খর্বতা বলিয়া মনে করিত। আজ যেই তাহাদের সকলের টিকি কাটা পড়িল অমনি তাহারা হাঁফ ছাড়িয়া বলিতেছে, আপদ গেছে। এক সময়ে ছাপার বহিতে “হয়েন’ লেখা চলিত, এখন “হন’ লিখিলে কেহ বিচলিত হন না। “হইবা’ “করিবা’র আকার গেল, “হইবেক’ “করিবেক’-এর ক খসিল, “করহ’ “চলহ’র হ কোথায়? এখন “নহে’র জায়গায় “নয়’ লিখিলে বড়ো কেহ লক্ষ্যই করে না। এখন যেমন আমরা “কেহ’ লিখি, তেমনি এক সময়ে ছাপার বইয়েও “তিনি’র বদলে “তেঁহ’ লিখিত। এক সময়ে “আমারদিগের’ শব্দটা শুদ্ধ বলিয়া গণ্য ছিল, এখন “আমাদের’ লিখিতে কারো হাত কাঁপে না। আগে যেখানে লিখিতাম “সেহ’ এখন সেখানে লিখি “সেও’, অথচ পণ্ডিতের ভয়ে “কেহ’কে “কেও’ অথবা “কেউ’ লিখিতে পারি না। ভবিষ্যৎবাচক “করিহ’ শব্দটাকে “করিয়ো’ লিখিতে সংকোচ করি না, কিন্তু তার বেশি আর একটু অগ্রসর হইতে সাহস হয় না।
এই তো আমরা পণ্ডিতের ভয়ে সতর্ক হইয়া চলি কিন্তু পণ্ডিত যখন পুঁথির বাংলা বানাইয়াছিলেন আমাদের কিছুমাত্র খাতির করেন নাই। বাংলা গদ্য-পুঁথিতে যখন তাঁরা “যাইয়াছি’ “যাইল’ কথা চালাইয়া দিলেন তখন তাঁরা ক্ষণকালের জন্যও চিন্তা করেন নাই যে, এই ক্রিয়াপদটি একেবারে বাংলাই নয়। যা ধাতু বাংলায় কেবলমাত্র বর্তমান কালেই চলে; যথা, যাই, যাও, যায়। আর, “যাইতে’ শব্দের যোগে যে-সকল ক্রিয়াপদ নিষ্পন্ন হয় তাহাতেও চলে; যেমন, “যাচ্চি’ “যাচ্ছিল’ ইত্যাদি। কিন্তু “যেল’ “যেয়েছি’ “যেয়েছিলুম’ পণ্ডিতদের ঘরেও চলে না। এ স্থলে আমরা বলি “গেল’ “গিয়েছি’ “গিয়েছিলুম’। তার পরে পণ্ডিতেরা “এবং’ বলিয়া এক অদ্ভুত অব্যয় শব্দ বাংলার স্কন্ধে চাপাইয়াছেন এখন তাহাকে ঝাড়িয়া ফেলা দায়। অথচ সংস্কৃত বাক্যরীতির সঙ্গে এই শব্দ ব্যবহারের যে মিল আছে তাও তো দেখি না। বরঞ্চ সংস্কৃত “অপর’ শব্দের আত্মজ যে “আর’ শব্দ সাধারণে ব্যবহার করিয়া থাকে তাহা শুদ্ধরীতিসংগত। বাংলায় “ও’ বলিয়া একটা অব্যয় শব্দ আছে তাহা সংস্কৃত অপি শব্দের বাংলা রূপ। ইহা ইংরেজি ‘and’ শব্দের প্রতিশব্দ নহে, too শব্দের প্রতিশব্দ। আমরা বলি আমিও যাব তুমিও যাবে–কিন্তু কখনো বলি না “আমি ও তুমি যাব’। সংস্কৃতের ন্যায় বাংলাতেও আমরা সংযোজক শব্দ ব্যবহার না করিয়া দ্বন্দ্বসমাস ব্যবহার করি। আমরা বলি “বিছানা বালিশ মশারি সঙ্গে নিয়ো’। যদি ভিন্ন শ্রেণীয় পদার্থের প্রসঙ্গ করিতে হয় তবে বলি “বিছানা বালিশ মশারি আর বাইরের বাক্সটা সঙ্গে নিয়ো’। এর মধ্যে “এবং’ কিংবা “ও’ কোথাও স্থান পায় না। কিন্তু পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার আইনকে আমল দেন নাই। আমি এই যে দৃষ্টান্তগুলি দেখাইতেছি তার মতলব এই যে, পণ্ডিতমশায় যদি সংস্কৃতরীতির উপর ভর দিয়া বাংলারীতিকে অগ্রাহ্য করিতে পারেন, তবে আমরাই বা কেন বাংলারীতির উপর ভর দিয়া যথাস্থানে সংস্কৃতরীতিকে লঙ্ঘন করিতে সংকোচ করি? “মনোসাধে’ আমাদের লজ্জা কিসের? “সাবধানী’ বলিয়া তখনি জিব কাটিতে যাই কেন? এবং “আশ্চর্য হইলাম’ বলিলে পণ্ডিতমশায় “আশ্চর্যান্বিত হয়েন’ কী কারণে?
আমি যে-কথাটা বলিতেছিলাম সে এই–যখন লেখার ভাষার সঙ্গে মুখের ভাষার অসামঞ্জস্য থাকে তখন স্বভাবের নিয়ম অনুসারেই এই দুই ভাষার মধ্যে কেবলই সামঞ্জস্যের চেষ্টা চলিতে থাকে। ইংরেজি-গদ্যসাহিত্যের প্রথম আরম্ভে অনেকদিন হইতেই এই চেষ্টা চলিতেছিল। আজ তার কথায় লেখায় সামঞ্জস্য ঘটিয়াছে বলিয়াই উভয়ে একটা সাম্যদশায় আসিয়াছে। আমাদের ভাষায় এই অসামঞ্জস্য প্রবল সুতরাং স্বভাব আপনি উভয়ের ভেদ ঘুচাইবার জন্য ভিতরে ভিতরে আয়োজন করিতেছিল। এমন সময় হঠাৎ আইনকর্তার প্রাদুর্ভাব হইল। তাঁরা বলিলেন লেখার ভাষা আজ যেখানে আসিয়া পৌছিয়াছে ইহার বেশি আর তার নড়িবার হুকুম নাই।
“সবুজ পত্র’-সম্পাদক বলেন বেচারা পুঁথির ভাষার প্রাণ কাঁদিতেছে কথায় ভাষার সঙ্গে মালা বদল করিবার জন্য। গুরুজন ইহার প্রতিবাদী। তিনি ঘটকালি করিয়া কৌলীন্যের নির্মম শাসন ভেদ করিবেন এবং শুভ বিবাহ ঘটাইয়া দিবেন– কারণ কথা আছে শুভস্য শীঘ্রং।
যাঁরা প্রতিবাদী তাঁরা এই বলিয়া তর্ক করেন যে, বাংলায় চলিত ভাষা নানা জিলায় নানা ছাঁচের, তবে কি বিদ্রোহীর দল একটা অরাজকতা ঘটাইবার চেষ্টায় আছে! ইহার উত্তর এই যে, যে যেমন খুশি আপন প্রাদেশিক ভাষায় পুঁথি লিখিবে, চলিত ভাষায় লিখিবার এমন অর্থ নয়। প্রথমত খুশিরও একটা কারণ থাকা চাই। কলিকাতার উপর রাগ করিয়া বীরভূমের লোক বীরভূমের প্রাদেশিক ভাষায় আপন বই লিখিবে এমন খুশিটাই তার স্বভাবত হইবে না। কোনো একজন পাগলের তা হইতেও পারে কিন্তু পনেরো-আনার তা হইবে না। দিকে দিকে বৃষ্টির বর্ষণ হয় কিন্তু জমির ঢাল অনুসারে একটা বিশেষ জায়গায় তার জলাশয় তৈরি হইয়া উঠে। ভাষারও সেই দশা। স্বাভাবিক কারণেই কলিকাতা অঞ্চলে একটা ভাষা জমিয়া উঠিয়াছে তাহা বাংলার সকল দেশের ভাষা। কলিকাতার একটা স্বকীয় অপভাষা আছে যাহাতে “গেনু’ “করনু’ প্রভৃতি ক্রিয়াপদ ব্যবহার হয় এবং “ভেয়ের বে’ (ভাইয়ের বিয়ে) “চেলের দাম’ (চালের দাম) প্রভৃতি অপভ্রংশ প্রচলিত আছে, এ সে ভাষাও নয়। যদি বলো– তবে এই ভাষাকে কে সুনির্দিষ্ট করিয়া দিবে? তবে তার উত্তর এই যে, যে-সকল লেখক এই ভাষা ব্যবহার করিবেন তাঁদের যদি প্রতিভা থাকে তবে তাঁরা তাঁদের সহজ শক্তি হইতেই বাংলার এই সর্বজনীন ভাষা বাহির করিবেন। দান্তে নিজের প্রতিভাবলে প্রমাণ করিয়া দিয়াছেন ইটালির কোন্ প্রাদেশিক ভাষা ইটালির সর্বদেশের সর্বকালের ভাষা। বাংলার কোন্ ভাষাটি সেইরূপ বাংলার বিশ্বভাষা কিছুকাল হইতে আপনিই তার প্রমাণ চলিতেছে। বঙ্কিমের কাল হইতে এ পর্যন্ত বাংলার গদ্য-সাহিত্যে প্রাদেশিক ভাষার প্রাদুর্ভাব ঘটিতেছে বলিয়া কথা উঠিয়াছে কিন্তু সে কোন্ প্রাদেশিক ভাষা? তাহা ঢাকা অঞ্চলের নহে। তাহা কোনো বিশেষ পশ্চিম বাংলা প্রদেশেরও নয়। তাহা বাংলার রাজধানীতে সকল প্রদেশের মথিত একটি ভাষা। সকল ভদ্র ইংরেজের এক ভাষা যেমন ইংলণ্ডের সকল প্রাদেশিক ভাষাকে ছাপাইয়া বিশ্বব্যাপী হইয়া উঠিয়াছে, এ-ও সেইরূপ। এ ভাষা এখনো তেমন সম্পূর্ণভাবে ছড়াইয়া পড়ে নাই বটে, কিন্তু সাহিত্যকে আশ্রয় করিলেই ইহার ব্যাপ্তির সীমা থাকিবে না। সমস্ত দেশের লোকের চিত্তের ঐক্যের পক্ষে কি ইহার কোনো প্রয়োজন নাই? শুধু কি পুঁথির ভাষার ঐক্যই একমাত্র ঐক্যবন্ধন? আর এ কথাও কি সত্য নয় যে, পুঁথির ভাষা আমাদের নিত্য ব্যবহারের ভাষা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকিলে তাহা কখনোই পূর্ণ শক্তি লাভ করিতে পারে না? যখন বঙ্গবিভাগের বিভীষিকায় আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়াছিল তখন আমাদের ভয়ের একটা প্রধান কারণ ছিল এই যে এটা রাজনৈতিক ভূগোলের ভাগ নয়, ভাষার ভাগকে আশ্রয় করিয়া বাংলার পূর্ব-পশ্চিমে একটা চিত্তের ভাগ হইবে। সমস্ত বাংলাদেশের একমাত্র রাজধানী থাকাতে সেইখানে সমস্ত বাংলাদেশের একটি সাধারণ ভাষা আপনি জাগিয়া উঠিতেছিল। তাহা ফরমাশে গড়া কৃত্রিম ভাষা নহে, তাহা জীবনের সংঘাতে প্রাণলাভ করিয়া সেই প্রাণের নিয়মেই বাড়িতেছে। আমাদের পাকযন্ত্রে নানা খাদ্য আসিয়া রক্ত তৈরি হয়,তাহাকে বিশেষ করিয়া পাকযন্ত্রের রক্ত বলিয়া নিন্দা করা চলে না, তাহা সমস্ত দেহের রক্ত। রাজধানী জিনিসটা স্বভাবতই দেশের পাকযন্ত্র। এইখানে নানা ভাব, নানা বাণী এবং নানা শক্তির পরিপাক ঘটিতে থাকে এবং এই উপায়ে সমস্ত দেশ প্রাণ পায় ও ঐক্য পায়। রাগ করিয়া এবং ঈর্ষা করিয়া যদি বলি প্রত্যেক প্রদেশ আপন স্বতন্ত্র পাকযন্ত্র বহন করুক তবে আমাদের হাত-পা বুক-পিঠ বিধাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া বলিতে পারে আমাদের নিজের নিজের একটা করিয়া পাকযন্ত্র চাই। কিন্তু যতই রাগ করি আর তর্ক করি, সত্যের কাছে হার মানিতেই হয় এবং সেইজন্যই সংস্কৃত বাংলা আপনার খোলস ভাঙিয়া যে-ছাঁদে ক্রমশ প্রাকৃত বাংলার রূপ ধরিয়া উঠিতেছে সে-ছাঁদ ঢাকা বা বীরভূমের নয়। তার কারণ নানা প্রদেশের বাঙালি শিখিতে, আয় করিতে, ব্যয় করিতে, আমোদ করিতে, কাজ করিতে অনেক কাল হইতে কলিকাতায় আসিয়া জমা হইতেছে। তাহাদের সকলের সম্মিলনে যে এক-ভাষা গড়িয়া উঠিল তাহা ধীরে ধীরে বাংলার সমস্ত প্রদেশে ছড়াইয়া পড়িতেছে। এই উপায়ে, অন্য দেশে যেমন ঘটিয়াছে, তেমনি এখানেও একটি বিশেষ ভাষা বাংলাদেশের সমস্ত ভদ্রঘরের ভাষা হইয়া উঠিতেছে। ইহা কল্যাণের লক্ষণ। অবশ্য স্বভাবতই এই ভাষার ভূমিকা দক্ষিণ বাংলার ভাষায়। এইটুকু নম্রভাবে স্বীকার করিয়া না লওয়া সদ্-বিবেচনার কাজ নহে। ঢাকাতেই যদি সমস্ত বাংলার রাজধানী হইত তবে এতদিনে নিশ্চয়ই ঢাকার লোকভাষার উপর আমাদের সাধারণ ভাষার পত্তন হইত এবং তা লইয়া দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা যদি মুখ বাঁকা করিত তবে সে বক্রতা আপনিই সিধা হইয়া যাইত, মানভঞ্জনের জন্য অধিক সাধাসাধি করিতে হইত না।
এই যে বাংলাদেশের এক-ভাষা, আজকের দিনে যাহা অবাস্তব নহে, অথচ যাহাকে সাহিত্যে ব্যবহার করি না বলিয়া যাহার পরিচয় আমাদের কাছে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হয় নাই, যখনি শক্তিশালী সাহিত্যিকেরা এই ভাষায় ভাব প্রকাশ করিবেন তখনি ইহা পরিব্যক্ত হইয়া উঠিবে, সেটাতে কেবল ভাষার উন্নতি নয়, দেশের কল্যাণ।
এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে একটা যে তর্ক আছে সেটা একটু ভাবিয়া দেখিতে হইবে। আমরা বাংলা-সাহিত্যে আজ যে-ভাষা ব্যবহার করিতেছি তার একটা বাঁধন পাকা হইয়া গেছে। অধিকাংশ লোকের পক্ষেই এই বাঁধনের প্রয়োজন আছে। নহিলে সাহিত্যে সংযম থাকে না। আবার শক্তি যাদের অল্প অসংযম তাদেরই বেশি। অতএব আমাদের যে চল্তি ভাষাকে সাহিত্যে নূতন করিয়া চালাইবার কথা উঠিয়াছে, তাহার আদব-কায়দা এখনো দাঁড়াইয়া যায় নাই। অতএব এ ক্ষেত্রে উচ্ছৃঙ্খল স্বেচ্ছাচারের আশঙ্কা যথেষ্ট আছে। বস্তুত বর্তমানে এই চল্তি ভাষার লেখা, পুঁথির ভাষার লেখার চেয়ে অনেক শক্ত। বিধাতার সৃষ্টিতে বৈচিত্র্য থাকিবেই, এইজন্য ভদ্রতা সকলের পক্ষে স্বাভাবিক নয়। তাই অন্তত প্রথাগত ভদ্রতার বিধি যদি পাকা না হয় তবে সমাজ অত্যন্ত কুশ্রী হইয়া উঠে। “সবুজ পত্র’-সম্পাদকের শাসনে আজকের দিনে বাংলাদেশের সকল লেখকই যদি চল্তি ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করিয়া দেয় তবে সর্বপ্রথমে তাঁকেই কানে হাত দিয়া দেশছাড়া হইতে হইবে এ কথা আমি লিখিয়া দিতে পারি। অতএব সুখের বিষয় এই যে, এখনি এই দুর্যোগের সম্ভাবনা নাই। নূতনকে যারা বহন করিয়া আনে তারা যেমন বিধাতার সৈনিক, নূতনের বিরুদ্ধে যারা অস্ত্র ধরিয়া খাড়া হইয়া উঠে তারাও তেমনি বিধাতারই সৈন্য। কেননা প্রথমেই বিধানের সঙ্গে লড়াই করিয়া নূতনকে আপন রাজ্য গ্রহণ করিতে হয় কিন্তু যতদিনে তার আপন বিধান পাকা না হইয়া উঠে ততদিনের অরাজকতা সামলাইবে কে?
এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে সাহিত্যে আমরা যে-ভাষা ব্যবহার করি ক্রমে ক্রমে তার একটা বিশিষ্টতা দাঁড়াইয়া যায়। তার প্রধান কারণ সাহিত্যে আমাদিগকে সম্পূর্ণ করিয়া চিন্তা করিতে এবং তাহা সম্পূর্ণ করিয়া ব্যক্ত করিতে হয়, আমাদিগকে গভীর করিয়া অনুভব করিতে এবং তাহা সরস করিয়া প্রকাশ করিতে হয়। অর্থাৎ সাহিত্যের ক্ষেত্র প্রধানত নিত্যতার ক্ষেত্র। অতএব এই উদ্দেশ্যে ভাষাকে বাছিতে সাজাইতে এবং বাজাইতে হয়। এইজন্যই স্বভাবতই সাহিত্যের ভাষা মুখের ভাষার চেয়ে বিস্তীর্ণ এবং বিশিষ্ট হইয়া থাকে।
আমার কথা এই, প্রতিদিনের যে-ভাষার খাদে আমাদের জীবনস্রোত বহিতে থাকে, সাহিত্য আপন বিশিষ্টতার অভিমানে তাহা হইতে যত দূরে পড়ে ততই তাহা কৃত্রিম হইয়া উঠে। চির-প্রবাহিত জীবনধারার সঙ্গে সাহিত্যের ঘনিষ্ঠতা রাখিতে হইলে তাহাকে এক দিকে সাধারণ, আর-এক দিকে বিশিষ্ট হইতে হইবে। সাহিত্যের বিশিষ্টতা তার সাধারণতাকে যখন ছাড়িয়া চলে তখন তার বিলাসিতা তার শক্তি ক্ষয় করে। সকল দেশের সাহিত্যেরই সেই বিপদ। সকল দেশেই বিশিষ্টতার বিলাসে ক্ষণে ক্ষণে সাহিত্য কৃত্রিমতার বন্ধ্যদশায় গিয়া উত্তীর্ণ হয়। তখন তাহাকে আবার কুলরক্ষার লোভ ছাড়িয়া প্রাণরক্ষার দিকে ঝোঁক দিতে হয়। সেই প্রাণের খোরাক কোথায়? সাধারণের ভাষার মধ্যে, যেখানে বিশ্বের প্রাণ আপনাকে মুহূর্তে মুহূর্তে প্রকাশ করিতেছে। ইংরেজি সাহিত্যিক ভাষা প্রথমে পণ্ডিতের ভাষা ল্যাটিন এবং রাজভাষা ফরাসির একটা কৌলীন্য খিচুড়ি ছিল, তার পরে কুল ছাড়িয়া যখন সে সাধারণের ঘরে আশ্রয় লইল তখনি সে ধ্রুব হইল। কিন্তু তার পরেও বারে বারে সে কৃত্রিমতার দিকে ঝুঁকিয়াছে। আবার তাকে প্রায়শ্চিত্ত করিয়া সাধারণের জাতে উঠিতে হইয়াছে। এমন-কি বর্তমান ইংরেজি সাহিত্যেও সাধারণের পথে সাহিত্যের এই অভিসার দেখিতে পাই। বার্নার্ড্ শ, ওয়েল্স্, বেনেট্, চেস্টরটন্, বেলক প্রভৃতি আধুনিক লেখকগুলি হালকা চালের ভাষায় লিখিতেছেন।
আমাদের সাহিত্য যে-ভাষাবিশিষ্টতার দুর্গে আশ্রয় লইয়াছে সেখান হইতে তাহাকে লোকালয়ের ভাষার মধ্যে নামাইয়া আনিবার জন্য “সবুজ পত্র’-সম্পাদক কোমর বাঁধিয়াছেন। তাঁর মত এই যে, সাহিত্য পদার্থটি আকারে সাধারণ এবং প্রকারে বিশিষ্ট– এই হইলেই সত্য হয়। এ কথা মানি। কিন্তু হিন্দুস্থানীতে একটা কথা আছে “পয়লা সামাল্না মুশকিল হ্যয়’। স্বয়ং বিধাতাও মানুষ গড়িবার গোড়ায় বানর গড়িয়াছেন, এখনো তাঁর সেই আদিম সৃষ্টির অভ্যাস লোকালয়ে সদাসর্বদা দেখিতে পাওয়া যায়।
শান্তিনিকেতন, চৈত্র, ১৩২৩
ভাষার খেয়াল
ভাষা যে সব সময়ে যোগ্যতম শব্দের বাছাই করে কিংবা যোগ্যতম শব্দকে বাঁচিয়ে রাখে তার প্রমাণ পাই নে। ভাষায় চলিত একটা শব্দ মনে পড়ছে “জিজ্ঞাসা করা’। এ রকম বিশেষ্য-জোড়া ওজনে ভারী ক্রিয়াপদে ভাষার অপটুত্ব জানায়। প্রশ্ন করা ব্যাপারটা আপামর সাধারণের নিত্যব্যবহার্য অথচ ওটা প্রকাশ করবার কোনো সহজ ধাতুপদ বাংলায় দুর্লভ এ কথা মানতে সংকোচ লাগে। বিশেষ্য বা বিশেষণ রূপকে ক্রিয়ার রূপে বানিয়ে তোলা বাংলায় নেই যে তা নয়। তার উদাহরণ যথা– ঠ্যাঙানো, কিলোনো, ঘুষোনো, গুঁতোনো, চড়ানো, লাথানো, জুতানো। এগুলো মারাত্মক শব্দ সন্দেহ নেই, এর থেকে দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট উত্তেজিত হলে বাংলায় “আনো’ প্রত্যয় সময়ে সময়ে এই পথে আপন কর্তব্য স্মরণ করে। অপেক্ষাকৃত নিরীহ শব্দও আছে, যেমন আগল থেকে আগলানো; ফল থেকে ফলানো, হাত থেকে হাতানো, চমক থেকে চম্কানো। বিশেষণ শব্দ থেকে, যেমন উলটা থেকে উলটানো, খোঁড়া থেকে খোঁড়ানো, বাঁকা থেকে বাঁকানো, রাঙা থেকে রাঙানো।
বিদ্যাপতির পদে আছে “সখি, কি পুছসি অনুভব মোয়’। যদি তার বদলে– “কি জিজ্ঞাসা করই অনুভব মোয়’ ব্যবহারটাই “বাধ্যতামূলক’ হত কবি তা হলে ওর উল্লেখই বন্ধ করে দিতেন। অথচ প্রশ্ন করা অর্থে শুধানো শব্দটা শুধু যে কবিতায় দেখি তা নয় অনেক জায়গায় গ্রামের লোকের মুখেও ওই কথার চল আছে। বাংলা ভাষার ইতিহাসে যাঁরা প্রবীণ তাঁদের আমি শুধাই, জিজ্ঞাসা করা শব্দটি বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে বা লোকসাহিত্যে তাঁরা কোথাও পেয়েছেন কিনা।
ভাবপ্রকাশের কাজে শব্দের ব্যবহার সম্বন্ধে কাব্যের বোধশক্তি গদ্যের চেয়ে সূক্ষ্মতর এ কথা মানতে হবে। লক্ষ্যিয়া, সন্ধিয়া, বন্দিনু, স্পর্শিল, হর্ষিল শব্দগুলো বাংলা কবিতায় অসংকোচে চালানো হয়েছে। এ সম্বন্ধে এমন নালিশ চলবে না যে ওগুলো কৃত্রিম, যেহেতু চলতি ভাষায় ওদের ব্যবহার নেই। আসল কথা, ওদের ব্যবহার থাকাই উচিত ছিল; বাংলা কাব্যের মুখ দিয়ে বাংলা ভাষা এই ত্রুটি কবুল করেছে। (“কব্লেছে’ প্রয়োগ বাংলায় চলে কিন্তু অনভ্যস্ত কলমে বেধে গেল!) “দর্শন লাগি ক্ষুধিল আমার আঁখি’ বা “তিয়াষিল মোর প্রাণ’– কাব্যে শুনলে রসজ্ঞ পাঠক বাহবা দিতে পারে, কেননা, ক্ষুধাতৃষ্ণাবাচক ক্রিয়াপদ বাংলায় থাকা অত্যন্তই উচিত ছিল, তারই অভাব মোচনের সুখ পাওয়া গেল। কিন্তু গদ্য ব্যবহারে যদি বলি “যতই বেলা যাচ্চে ততই ক্ষুধোচ্চি অথবা তেষ্টাচ্চি’ তা হলে শ্রোতা কোনো অনিষ্ট যদি না করে অন্তত এটাকে প্রশংসনীয় বলবে না।
বিশেষ্য-জোড়া ক্রিয়াপদের জোড় মিলিয়ে এক করার কাজে মাইকেল ছিলেন দুঃসাহসিক। কবির অধিকারকে তিনি প্রশস্ত রেখেছেন, ভাষার সংকীর্ণ দেউড়ির পাহারা তিনি কেয়ার করেন নি। এ নিয়ে তখনকার ব্যঙ্গ রসিকেরা বিস্তর হেসেছিল। কিন্তু ঠেলা মেরে দরজা তিনি অনেকখানি ফাঁক ক’রে দিয়েছেন। “অপেক্ষা করিতেছে’ না ব’লে “অপেক্ষিছে’, “প্রকাশ করিলাম’ না ব’লে “প্রকাশিলাম’ বা “উদ্ঘাটন করিল’-র জায়গায় “উদ্ঘাটিল’ বলতে কোনো কবি আজ প্রমাদ গণে না। কিন্তু গদ্যটা যেহেতু চলতি কথার বাহন ওর ডিমক্রাটিক বেড়া অল্প একটু ফাঁক করাও কঠিন। “ত্রাস’ শব্দটাকে “ত্রাসিল’ ক্রিয়ার রূপ দিতে কোনো কবির দ্বিধা নেই কিন্তু “ভয়’ শব্দটাকে “ভয়িল’ করতে ভয় পায় না এমন কবি আজও দেখি নি। তার কারণ ত্রাস শব্দটা চলতি ভাষার সামগ্রী নয়, এইজন্যে ওর সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অসামাজিকতা ডিমক্রাসিও খাতির করে। কিন্তু “ভয়’ কথাটা সংস্কৃত হলেও প্রাকৃত বাংলা ওকে দখল করে বসেছে। এইজন্যে ভয় সম্বন্ধে যে প্রত্যয়টার ব্যবহার বাংলায় নেই তার দরজা বন্ধ। কোন্ এক সময়ে “জিতিল’ “হাঁকিল’ “বাঁকিল’ শব্দ চলে গেছে, “ভয়িল’ চলে নি– এ ছাড়া আর-কোনো কৈফিয়ৎ নেই।
বাংলা ভাষা একান্ত আচারনিষ্ঠ। সংস্কৃত বা ইংরেজি ভাষায় প্রত্যয়গুলিতে নিয়মই প্রধান, ব্যতিক্রম অল্প। বাংলা ভাষার প্রত্যয়ে আচারই প্রধান; নিয়ম ক্ষীণ।– ইংরেজীতে “ঘামছি’ বলতে am perspiring বলে থাকি, “লিখছি’ বলতে am penning বলা দোষের হয় না। বাংলায় ঘামছি বললে লোকে কর্ণপাত করে কিন্তু কল্মাচ্চি বললে সইতে পারে না। প্রত্যয়ের দোহাই পাড়লে আচারের দোহাই পাড়বে। এই কারণেই নূতন ক্রিয়াপদ বাংলায় বানানো দুঃসাধ্য, ইংরেজিতে সহজ। ওই ভাষায় টেলিফোন কথাটার নূতন আমদানি, তবু হাতে হাতে ওটাকে ক্রিয়াপদে ফলিয়ে তুলতে কোনো মুশকিল ঘটে নি। ডানপিটে বাঙালি ছেলের মুখ দিয়েও বের হবে না “টেলিফোনিয়েছি’ বা “সাইক্লিয়েছি’। বাংলা গদ্যের অটুট শাসন কালক্রমে কিছু কিছু হয়তো বা বেড়ি আল্গা করে আচার ডিঙোতে দেবে। বাংলায় কাব্য-সাহিত্যই পুরাতন, এইজন্যেই প্রকাশের তাগিদে কবিতায় ভাষার পথ অনেক বেশি প্রশস্ত হয়েছে। গদ্য-সাহিত্য নূতন, এইজন্যে শব্দসৃষ্টির কাজে তার আড়ষ্টতা যায় নি। তবু ক্রমশ তার নমনীয়তা বাড়বে আশা করি। এমন-কি, আজই যদি কোনো তরুণ লেখক লেখেন, “মাইকেল বাংলা-সাহিত্যে নূতন সম্পদের ভাণ্ডার উদ্ঘাটিলেন’ তা নিয়ে প্রবীণরা খুব বেশি উত্তেজিত না হতে পারেন। ভাবীকালে আধুনিকেরা কতদূর পর্যন্ত স্পর্ধিয়ে উঠবেন বলতে পারি নে কিন্তু অন্তত এখনি তাঁরা “জিজ্ঞাসা করলেন’-এর জায়গায় যদি “জিজ্ঞাসিলেন’ চালিয়ে দেন তা হলে বাংলা ভাষা কৃতজ্ঞ হবে।
“লজ্জা করবার কারণ নেই’ এটা আমরা লিখে থাকি। “লজ্জাবার কারণ নেই’ লেখাটি নির্লজ্জতা। এমন স্থলে ওই জোড়া ক্রিয়াপদটা বর্জন করাই শ্রেয় মনে করি। লিখলেই হয় “লজ্জার কারণ নেই’। “প্রুফ সংশোধন করবার বেলায়’ কথাটা সংশোধনীয়, বলা ভালো “সংশোধনের বেলায়’। সহজ ব’লেই গদ্যে আমরা পুরো মন দিই নে, বাহুল্য শব্দ বিনা বাধায় যেখানে সেখানে ঢুকে পড়ে। আমার রচনায় তার ব্যতিক্রম আছে এমন অহংকার আমার পক্ষে অত্যুক্তি হবে।
ভাষার খেয়াল সম্বন্ধে একটা দৃষ্টান্ত আমার প্রায় মনে পড়ে। ভালো বিশেষণ ও বাসা ক্রিয়াপদ জুড়ে ভালোবাসা শব্দটার উৎপত্তি। কিন্তু ও-দুটো শব্দ একটা অখণ্ড ক্রিয়াপদ রূপে দাঁড়িয়ে গেছে। পূর্বকালে ওই “বাসা’ শব্দটা হৃদয়াবেগসূচক বিশেষ্যপদকে ক্রিয়াপদে মিলিয়ে নিত। যেমন ভয় বাসা, লাজ বাসা। এখন হওয়া করা পাওয়া ক্রিয়াপদ জুড়ে ওই কাজ চালাই। “বাসা’ শব্দটা একমাত্র হৃদয়বোধসূচক; হওয়া পাওয়া করা তা নয়। এই কারণে “বাসা’ কথাটা যদি ছুটি না নিয়ে আপন পূর্ব কাজে বহাল থাকত তা হলে ভাবপ্রকাশে জোর লাগাত। “এ কথায় তার মন ধিক্কার বাস্ল’ প্রয়োগটা আমার মতে “ধিক্কার পেল’র চেয়ে জোরালো।
ভাদ্র, ১৩৪২
মক্তব-মাদ্রাসার বাংলা ভাষা
বৈশাখের [১৩৩৯] প্রবাসীতে মক্তব-মাদ্রাসার বাংলা ভাষা প্রবন্ধটি পড়ে দেখলুম। আমি মূল পুস্তক পড়ি নি, ধরে নিচ্ছি প্রবন্ধ-লেখক যথোচিত প্রমাণের উপর নির্ভর করেই লিখেছেন। সাম্প্রদায়িক বিবাদে মানুষ যে কতদূর ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে ভারতবর্ষে আজকাল প্রতিদিনই তার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, কিন্তু হাস্যকর হওয়াও যে অসম্ভব নয় তার দৃষ্টান্ত এই দেখা গেল। এটাও ভাবনার কথা হতে পারত, কিন্তু সুবিধা এই যে এরকম প্রহসন নিজেকেই নিজে বিদ্রূপ করে মারে।
ভাষা মাত্রের মধ্যে একটা প্রাণধর্ম আছে। তার সেই প্রাণের নিয়ম রক্ষা করে তবেই লেখকেরা তাকে নূতন পথে চালিত করতে পারে। এ কথা মনে করলে চলবে না যে, যেমন করে হোক জোড়াতাড়া দিয়ে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বদল করা চলে। মনে করা যাক, বাংলা দেশটা মগের মুল্লুক এবং মগ রাজারা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের নাক-চোখের চেহারা কোনোমতে সহ্য করতে পারছে না, মনে করছে ওটাতে তাদের অমর্যাদা, তা হলে তাদের বাদশাহী বুদ্ধির কাছে একটিমাত্র অপেক্ষাকৃত সম্ভবপর পন্থা থাকতে পারে সে হচ্ছে মগ ছাড়া আর-সব জাতকে একেবারে লোপ করে দেওয়া। নতুবা বাঙালিকে বাঙালি রেখে তার নাক মুখ চোখে ছুঁচ সুতো ও শিরীষ আঠার যোগে মগের চেহারা আরোপ করবার চেষ্টা ঘোরতর দুর্দাম মগের বিচারেও সম্ভবপর বলে ঠেকতে পারে না।
এমন কোনো সভ্য ভাষা নেই যে নানা জাতির সঙ্গে নানা ব্যবহারের ফলে বিদেশী শব্দ কিছু-না-কিছু আত্মসাৎ করে নি। বহুকাল মুসলমানের সংস্রবে থাকাতে বাংলা ভাষাও অনেক পারসী শব্দ এবং কিছু কিছু আরবীও স্বভাবতই গ্রহণ করেছে। বস্তুত বাংলা ভাষা যে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই আপন তার স্বাভাবিক প্রমাণ ভাষার মধ্যে প্রচুর রয়েছে। যত বড়ো নিষ্ঠাবান হিন্দুই হোক-না কেন ঘোরতর রাগারাগির দিনেও প্রতিদিনের ব্যবহারে রাশি রাশি তৎসম ও তদ্ভব মুসলমানী শব্দ উচ্চারণ করতে তাদের কোনো সংকোচ বোধ হয় না। এমন-কি, সে-সকল শব্দের জায়গায় যদি সংস্কৃত প্রতিশব্দ চালানো যায় তা হলে পণ্ডিতী করা হচ্ছে বলে লোকে হাসবে। বাজারে এসে সহস্র টাকার নোট ভাঙানোর চেয়ে হাজার টাকার নোট ভাঙানো সহজ। সমনজারি শব্দের অর্ধেক অংশ ইংরেজি, অর্ধেক পারসী, এর জায়গায় “আহ্বান প্রচার’ শব্দ সাধু সাহিত্যেও ব্যবহার করবার মতো সাহস কোনো বিদ্যাভূষণেরও হবে না। কেননা, নেহাত বেয়াড়া স্বভাবের না হলে মানুষ মার খেতে তত ভয় করে না যেমন ভয় করে লোক হাসাতে। “মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে’, এ কথা সহজেই মুখ দিয়ে বেরোয় কিন্তু যাবনিক সংসর্গ বাঁচিয়ে যদি বলতে চাই মনের গতিকটা বিকল কিংবা বিমর্ষ বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে আছে তবে আত্মীয়দের মনে নিশ্চিত খটকা লাগবে। যদি দেখা যায় অত্যন্ত নির্জলা খাঁটি পণ্ডিতমশায় ছেলেটার ষত্বণত্ব শুদ্ধ করবার জন্যে তাকে বেদম মারছেন, তা হলে বলে থাকি, “আহা বেচারাকে মারবেন না।’ যদি বলি “নিরুপায় বা নিঃসহায়কে মারবেন না’ তা হলে পণ্ডিতমশায়ের মনেও করুণরসের বদলে হাস্যরসের সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। নেশাখোরকে যদি মাদকসেবী বলে বসি তা হলে খামকা তার নেশা ছুটে যেতে পারে, এমন-কি, সে মনে করতে পারে তাকে একটা উচ্চ উপাধি দেওয়া হল। বদমায়েসকে দুর্বৃত্ত বললে তার চোট তেমন বেশি লাগবে না। এই শব্দগুলো যে এত জোর পেয়েছে তার কারণ বাংলা ভাষার প্রাণের সঙ্গে এদের সহজে যোগ হয়েছে।
শিশুপাঠ্য বাংলা কেতাবে গায়ের জোরে আরবীআনা পারসীআনা করাটাকেই আচারনিষ্ঠ মুসলমান যদি সাধুতা বলে জ্ঞান করেন তবে ইংরেজি স্কুলপাঠ্যের ভাষাকেও মাঝে মাঝে পারসী বা আরবী ছিটিয়ে শোধন না করেন কেন? আমিই একটা নমুনা দিতে পারি। কীট্সের হাইপীরিয়ন নামক কবিতাটির বিষয়টি গ্রীসীয় পৌরাণিক, তথাপি মুসলমান ছাত্রের পক্ষে সেটা যদি বর্জনীয় না হয় তবে তাতে পারসী-মিশোল করলে তার কিরকম শ্রীবৃদ্ধি হয় দেখা যাক–
Deep in the Saya-i-ghamagin of a vale,
Far sunken from the nafas-i-hayat afza-i-morn,
Far from the atshin noon and eve’s one star,
Sat bamoo-i-safid Saturn Khamush as a Sang।
জানি কোনো মৌলবী ছাহাব প্রকৃতিস্থ অবস্থায় ইংরেজি সাহিত্যিক ভাষার এ রকম মুসলমানীকরণের চেষ্টা করবেন না। করলেও ইংরেজি যাঁদের মাতৃভাষা এ দেশের বিদ্যালয়ে তাঁদের ভাষার এ রকম ব্যঙ্গীকরণে উচ্চাসন থেকে তাঁদের মুখ ভ্রূকুটিকুটিল হবে। আপসে যখন কথাবার্তা চালাই তখন আমাদের নিজের ভাষার সঙ্গে ইংরেজি বুলির হাস্যকর সংঘটন সর্বদাই করে থাকি; কিন্তু সে প্রহসন সাহিত্যের ভাষায় চলতি হবার কোনো আশঙ্কা নেই। জানি বাংলা দেশের গোঁড়া মক্তবেও ইংরেজি ভাষা সম্বন্ধে এ রকম অপঘাত ঘটবে না; ইংরেজের অসন্তুষ্টিই তার একমাত্র কারণ নয়। শিক্ষক জানেন পাঠ্যপুস্তকে ইংরেজিকে বিকৃতি করার অভ্যাসকে প্রশ্রয় দিলে ছাত্রদের ইংরেজি শিক্ষায় গলদ ঘটবে, তারা ঐ ভাষা সম্যকরূপে ব্যবহার করতে পারবে না। এমন অবস্থায় কীট্সের হাইপীরিয়নকে বরঞ্চ আগাগোড়াই ফারসীতে তর্জমা করিয়ে পড়ানো ভালো তবু তার ইংরেজিটিকে নিজের সমাজের খাতিরেও দো-আঁশলা করাটা কোনো কারণেই ভালো নয়। সেই একই কারণে ছাত্রদের নিজের খাতিরেই বাংলাটাকে খাঁটি বাংলারূপে বজায় রেখেই তাদের শেখানো দরকার। মৌলবী ছাহাব বলতে পারেন আমরা ঘরে যে বাংলা বলি সেটা ফারসী আরবী জড়ানো, সেইটাকেই মুসলমান ছেলেদের বাংলা বলে আমরা চালাব। আধুনিক ইংরেজি ভাষায় যাঁদের অ্যাংলোইণ্ডিয়ান বলে, তাঁরা ঘরে যে ইংরেজি বলেন, সকলেই জানেন সেটা আন্ডিফাইল্ড আদর্শ ইংরেজি নয়– স্বসম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতবশত তাঁরা যদি বলেন যে, তাঁদের ছেলেদের জন্যে সেই অ্যাংলোইণ্ডিয়ানী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা না করলে তাঁদের অসম্মান হবে, তবে সে কথাটা বিনা হাস্যে গম্ভীরভাবে নেওয়া চলবে না। বরঞ্চ এই ইংরেজি তাঁদের ছেলেদের জন্যে প্রবর্তন করলে সেইটেতেই তাঁদের অসম্মান এই কথাটাই তাঁদের অবশ্য বোঝানো দরকার হবে। হিন্দু বাঙালির সূর্যই সূর্য আর মুসলমান বাঙালির সূর্য তাম্বু, এমনতর বিদ্রূপেও যদি মনে সংকোচ না জন্মে, এতকাল একত্রবাসের পরেও প্রতিবেশীর আড়াআড়ি ধরাতলে মাথা-ভাঙাভাঙি ছাড়িয়ে যদি অবশেষে চন্দ্রসূর্যের ভাষাগত অধিকার নিয়ে অভ্রভেদী হয়ে ওঠে, তবে আমাদের ন্যাশনাল ভাগ্যকে কি কৌতুকপ্রিয় বলব, না বলব পাড়া-কুঁদুলে। পৃথিবীতে আমাদের সেই ভাগ্যগ্রহের যাঁরা প্রতিনিধি তাঁরা মুখ টিপে হাসছেন; আমরাও হাসতে চেষ্টা করি কিন্তু হাসি বুকের কাছে এসে বেধে যায়। পৃথিবীতে কম্যুনাল বিরোধ অনেক দেশে অনেক রকম চেহারা ধরেছে, কিন্তু বাংলা দেশে সেটা এই যে কিম্ভুতকিমাকার রূপ ধরল তাতে আর মান থাকে না।
ভাদ্র, ১৩৩৯
শব্দ-চয়ন : ১
বাংলা ভাষায় গদ্য লিখতে নতুন শব্দের প্রয়োজন প্রতিদিনই ঘটে। অনেক দিন ধরে অনেক রকম লেখা লিখে এসেছি সেই উপলক্ষে অনেক শব্দ আমাকে বানাতে হল। কিন্তু প্রায়ই মনের ভিতরে খটকা থেকে যায়। সুবিধা এই যে বার বার ব্যবহারের দ্বারাই শব্দবিশেষের অর্থ আপনি পাকা হয়ে উঠে, মূলে যেটা অসংগত, অভ্যাসে সেটা সংগতি লাভ করে। তৎসত্ত্বে সাহিত্যের হট্টগোলে এমন অনেক শব্দের আমদানি হয়, যা ভাষাকে যেন চিরদিনই পীড়া দিতে থাকে। যেমন “সহানুভূতি’। এটা sympathy শব্দের তর্জমা। “সিম্প্যাথি’-র গোড়াকার অর্থ ছিল “দরদ’। ওটা ভাবের আমলের কথা, বুদ্ধির আমলের নয়। কিন্তু ব্যবহারকালে ইংরেজিতে “সিম্প্যাথি’-র মূল অর্থ আপন ধাতুগত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই কোনো একটা প্রস্তাব সম্বন্ধেও সিম্প্যাথি-র কথা শোনা যায়। বাংলাতেও আমরা বলতে আরম্ভ করেছি “এই প্রস্তাবে আমার সহানুভূতি আছে’। বলা উচিত “সম্মতি আছে’ বা “আমি এর সমর্থন করি’। যা-ই হোক্– সহানুভূতি কথাটা যে বানানো কথা এবং ওটা এখনো মানান-সই হয় নি তা বেশ বোঝা যায় যখন ও শব্দটাকে বিশেষণ করবার চেষ্টা করি। “সিম্প্যাথেটিক্’-এর কী তর্জমা হতে পারে, “সহানুভৌতিক, বা “সহানুভূতিশীল’ বা “সহানুভূতিমান’ ভাষায় যেন খাপ খায় না– সেইজন্যেই আজ পর্যন্ত বাঙালি লেখক এর প্রয়োজনটাকেই এড়িয়ে গেছে। দরদের বেলায় “দরদী’ ব্যবহার করি, কিন্তু সহানুভূতির বেলায় লজ্জায় চুপ ক’রে যাই। অথচ সংস্কৃত ভাষায় এমন একটি শব্দ আছে, যেটা একেবারেই তথার্থক। সে হচ্ছে “অনুকম্পা’। ধ্বনিবিজ্ঞানে ধ্বনি ও বাদ্যযন্ত্রের তারের মধ্যে সিম্প্যাথি-র কথা শোনা যায়– যে সুরে বিশেষ কোনো তার বাঁধা, সেই সুর শব্দিত হলে সেই তারটি অনুধ্বনিত হয়। এই তো “অনুকম্পন’। অন্যের বেদনায় যখন আমার চিত্ত ব্যথিত হয়, তখন সেই তো ঠিক “অনুকম্পা’। “অনুকম্পায়ী’ কথাটা সংস্কৃতে আছে। “অনুকম্পাপ্রবণ’ শব্দটাও মন্দ শোনায় না। “অনুকম্পালু’ বোধ করি ভালোই চলে। মুশকিল এই যে, দখলের দলিলটাই ভাষায় স্বত্বের দলিল হয়ে ওঠে। কেবলমাত্র এই কারণেই “কান, সোনা, চুন, পান’ শব্দগুলোতে মূর্ধন্য ণ-য়ের অনধিকার নিরোধ করা এত দুঃসাধ্য হয়েছে। ছাপাখানার অক্ষর-যোজকেরা সংশোধন মানে না। তাদের প্রশ্ন করা যেতে পারত যে, কানের এক “সোনায়’ যদি মূর্ধন্য ণ লাগল, তবে অন্য “শোনায়’ কেন দন্ত্য ন লাগে। “শ্রবণ’ শব্দের র-ফলা লোপ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার মূর্ধন্য ণ সংস্কৃত ব্যাকরণ মতেই দন্ত্য ন হয়েছে। অথচ “স্বর্ণ’ শব্দ যখন রেফ বর্জন ক’রে “সোনা’ হল, তখন মূর্ধন্য ণ-য়ের বিধান কোন্ মতে হয়? হাল আমলের নতুন সংস্কৃত-পোড়োরা “সোনা’কে শোধন ক’রে নিয়েছেন, তাঁদের স্বকল্পিত ব্যাকরণবিধির দ্বারা– এখন দখল প্রমাণ ছাড়া স্বত্বের অন্য প্রমাণ অগ্রাহ্য হয়ে গেল। “শ্রবণ’ শব্দের অপভ্রংশ শোনা শব্দ যখন বাংলা ভাষায় বানান-দেহ ধারণ করেছিল, তখন বিদ্যাসাগর প্রভৃতি প্রাচীন পণ্ডিতেরা বিধানকর্তা ছিলেন– সেদিনকার বানানে কান সোনা প্রভৃতিরও মূর্ধন্যত্ব প্রাপ্তি হয় নি। কৃষ্ণ শব্দজাত কানাই শব্দে আজও দন্ত্য ন চলছে, বর্ণ (বর্ণ যোজন) শব্দজাত বানান শব্দে আজও মূর্ধন্য ণ-এর প্রবেশ ঘটে নি তাতে কি পাণ্ডিত্যের খর্বতা ঘটেছে?
কিছুকাল পূর্বে যখন ভারতশাসনকর্তারা “ইন্টার্ন্’ শুরু করলেন, তখন খবরের কাগজে তাড়াতাড়ি একটা শব্দ সৃষ্টি হয়ে গেল– “অন্তরীণ’। শব্দসাদৃশ্য ছাড়া এর মধ্যে আর কোনো যুক্তি নেই। বিশেষণে ওটা কী হতে পার, তাও কেউ ভাবলেন না। Externment-কে কি বলতে হবে “বহিরীণ’? অথচ “অন্তরায়ণ, অন্তরায়িত, বহিরায়ণ, বহিরায়িত’ ব্যবহার করলে আপত্তির কারণ থাকে না, সকল দিকে সুবিধাও ঘটে।
নূতন সংঘটিত শব্দের মধ্যে কদর্যতায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে “বাধ্যতামূলক শিক্ষা’। প্রথমত শিক্ষার মূলের দিকে বাধ্যতা নয়, ওটা শিক্ষার পিঠের দিকে। বিদ্যাদান বা বিদ্যালাভই হচ্ছে শিক্ষার মূলে– তার প্রণালীতেই “কম্পাল্শন্’। অথচ “অবশ্য-শিক্ষা’ শব্দটা বলবামাত্র বোঝা যায় জিনিসটা কী। “দেশে অবশ্য-শিক্ষা প্রবর্তন করা উচিত’– কানেও শোনায় ভালো, মনেও প্রবেশ করে সহজে। কম্পালসারি এডুকেশনের বাংলা যদি হয় “বাধ্যতামূলক শিক্ষা, “কম্পালসারি সাবজেক্ট’ কি হবে “বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয়’? তার চেয়ে “অবশ্য-পাঠ্য বিষয়’, কি সংগত ও সহজ শোনায় না? “ঐচ্ছিক’ (optional) শব্দটা সংস্কৃতে পেয়েছি, তারি বিপরীতে “আবশ্যিক’ শব্দ ব্যবহার চলে কি না, পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করি। ইংরেজিতে যে-সব শব্দ অত্যন্ত সহজ ও নিত্য প্রচলিত, দরকারের সময় বাংলায় তার প্রতিশব্দ সহসা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন তাড়াতাড়ি যা হয় একটা বানিয়ে দিতে হয়। সেটা অনেক সময় বেখাপ হয়ে দাঁড়ায়, অনেক সময় মূল ভাবটা ব্যবহার করাই স্থগিত থাকে। অথচ সংস্কৃত ভাষায় হয়তো তার অবিকল বা অনুরূপ ভাবের শব্দ দুর্লভ নয়। একদিন “রিপোর্ট’ কথাটার বাংলা করবার প্রয়োজন হয়েছিল। সেটাকে বানাবার চেষ্টা করা গেল, কোনোটাই মনে লাগল না। হঠাৎ মনে পড়ল কাদম্বরীতে আছে “প্রতিবেদন’– আর ভাবনা রইল না। “প্রতিবেদন, প্রতিবেদিত, প্রতিবেদক’– যেমন ক’রেই ব্যবহার করো, কানে বা মনে কোথাও বাধে না। জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধি “ওভারপপ্যুলেশন’– বিষয়টা আজকাল খবরের কাগজের একটা নিত্য আলোচ্য; কোমর বেঁধে ওর একটা বাংলা শব্দ বানাতে গেলে হাঁপিয়ে উঠতে হয়– সংস্কৃত শব্দকোষে তৈরি পাওয়া যায়, “অতিপ্রজন’। বিদ্যালয়ের ছাত্র সম্বন্ধে “রেসিডেন্ট’, “নন্রেসিডেন্ট’ বিভাগ করা দরকার, বাংলায় নাম দেব কী? সংস্কৃত ভাষায় সন্ধান করলে পাওয়া যায় “আবাসিক’, অনাবাসিক’। সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারে আমি কিছুদিন সন্ধানের কাজ করেছিলেম। যা সংগ্রহ করতে পেরেছি, তা শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমারের প্ররোচনায় প্রকাশ করবার জন্য তাঁর হাতে অর্পণ করলুম। অন্তত এর অনেকগুলি শব্দ বাংলা লেখকদের কাজে লাগবে ব’লে আমার বিশ্বাস।
অকর্মান্বিত–unemployed
অক্ষিভিষক্–oculist
অঘটমান–incongruous, incoherent
অঙ্কূয়ৎ–moving tortuously : অঙ্কূয়তী নদী
অঙ্গারিত–charred
অতিকথিত, অতিকৃত–exaggerated
অতিজীবন–survival
অতিদিষ্ট–overruled
অতিপরোক্ষ–far out of sight
অতিপ্রজন–over-population
অতিভৃত–well-filled
অতিমেমিষ চক্ষু–staring eyes
অতিষ্ঠা– precedence
অতিষ্ঠাবান–superior in standing
অতিসর্গ–act of parting with
অতিসর্গ দান করা– to bid anyone farewell
অতিসর্পণ–to glide or creep over
অতিসারিত–made to pass through
অতিস্রুত–that which has been flowing over
অত্যন্তগত–completely pertinent, always applicable
অত্যন্তীন–going far
অত্যুর্মি–bubbling over
অধঃখাত–undermined
অধিকর্মা– superintendent
অধিজানু–on the knees
অধিবক্তা–advocate
অধিষ্ঠায়কবর্গ–governing body
অনপক্ষেপ্য–not to be rejected
অনপেক্ষিত–unexpected
অনাত্ম্য–impersonal
অনাপ্ত–unattained
অনাপ্য–unattainable
অনাবাসিক–non-resident
অনাবেদিত–not notified
অনায়ক–having no leader
অনায়তন–groundless
অনায়ুষ্য–fatal to long life
অনারত–without interruption
অনার্তব–unseasonable
অনালম্ব–unsupported
অনাস্থান–having no basis or fulcrum
অনিকামতঃ–involuntarily
অনিজক–not one’s own
অনিন–feeble, inane
অনিভৃত–not private, public
অনির্বিদ–undesponding
অনিষ্ঠা– unsteadiness
অনীহা– apathy
অনুকম্পায়ী–condoling
অনুকল্প–alternative
অনুকাঙক্ষা– longing
অনুকাল–opportune
অনুকীর্ণ–crammed
অনুকীর্তন–proclaiming, publishing
অনুক্রকচ–serrated
অনুগামুক–habitually following
অনুজ্ঞা–permission
অনুজ্ঞাত–allowed
অনুতূন্ন–muffied (sound)
অনুদত্ত– remitted
অনুদেশ–reference to something prior
অনুপর্বত–promontory
অনুপার্শ্ব–lateral
অনুযাত্র–retinue
অনুরথ্যা–side-road
অনুলাপ–repetition
অনুষঙ্গ–association
অন্তঃপাতিত–inserted
অন্তম–intimate
অন্তয্য [অন্তর্য]–interior
অন্তরায়ণ–internment
অন্তরীয়–under-garment
অন্তর্জাত–inborn
অন্তর্ভৌম–subterranean
অন্তশ্ছেদ–intercept
অপক্ষেপ–reject
অপচেতা– spendthrift
অপণ্য–not for sale, unsalable
অপপাঠ–wrong reading
অপম–the most distant
অপলিখন–to scrape off
অপশব্দ–vulgar speech
অপহাস–a mocking laugh
অপাটব–awkwardness
অপ্রতিষ্ঠ–unstable
অপ্রভ–obscure
অপ্সুদীক্ষা– baptism
অবঘোষণা– announcement
অবধুলন–scattering over
অবমতি–contempt
অবমন্তব্য–contemptible
অবরপুরুষ–descendant
অবরার্ধ–the least part
অবর্জনীয়–inevitable
অবশ্চুত–trickled down
অবস্থাপন–exposing goods for sale
অবিতর্কিত–unforeseen
অবুদ্ধিপূর্ব–not preceded by intelligence
অবেক্ষা– observaton
অভয়দক্ষিণা– promise of protection from danger
অভয়পত্র–a safe conduct
অভিজ্ঞানপত্র–certificate
অভিসমবায়–association
অভ্যাঘাত–interruption
অরত–apathetic
অর্থপদবী–path of advantage
অর্ম–ruins, rubbish
অল্পোন–slightly deficient
অশ্রি–angle, sharp side of anything
অসংপ্রতি–not according to the moment
অস্তব্যস্ত–scattered, confused
আকরিক, আখনিক–miner
আকল্প–design
আকৃত–shaped
আগামিক–incoming
আঙ্গিক–technique: আঙ্গিকভাব
আচয়–collection
আচিত–collected
আত্মকীয়, আত্মনীয়, আত্মনী–one’s own, original
আত্মতা– essence
আত্মবিবৃদ্ধি–self-aggrandisement
আত্যয়িক–urgent
আনৈপুণ্য–clumsiness
আপতিক–accidental
আপাতমাত্র–being only momentary
আবাসিক–resident
উক্তপ্রত্যুক্ত–discourse
উচ্চয় অপচয়–rise and fall
উচ্চণ্ড–very passionate
উচ্ছিষ্ট কল্পনা– stale invention
উচ্ছ্রায়, উচ্ছৃতি–elevation
উৎপারণ–to transport over
উত্তত–stretching oneself upwards
উত্তভিত–upheld, uplifted
উদ্গর্জিত–bursting out roaring
উদ্ঘোষ–loud-sounding
উদ্ধর্ষ–courage to undertake anything
উদ্বাসিত–deported
উদ্যোগসমর্থ–capable of exertion
উন্মিতি–measure of altitude
উন্মুখর–loud-sounding
উন্মুদ্র–unsealed
উন্মৃষ্ট–rubbed off
উপজ্ঞা–untaught or primitive knowledge
উপধুপন–fumigation
উপনদ্ধ–inlaid
উপনিপাত–national calamities
উপপাত–accident
উপপুর–suburb
উপস্কর–apparatus
উল্বণ নাদ–shrill sound
ঊনতা– deficiency
ঊর্মিমান, ঊর্মিল–undulating
একতৎপর–solely intent on
একায়ন–footpath
ঐকাঙ্গ–bodyguard
ঐকাত্ম্য–identity
ঐচ্ছিক–optional
ঐতিহ্য–tradition, traditional
কণাকার–granular
কম্বুরেখা– spiral
কম্র–loving, beautiful
করণতা– instrumentality
কাব্যগোষ্ঠী–a conversation on poetry
কাম্যব্রত–voluntary vow (with special aim)
কারু, কারুক–artisan
কালকরণ–appointing time
কালসম্পন্ন–bearing a date
কালাতিক্রমণ–lapse of time
কালান্তর–intermediate time
কির্বির, কির্মীর,– variegated colour, Ljѣla
কুটিল রেখা– curved line
কুলব্রত–family tradition
কুশলতা– cleverness
কূণিত–contracted
কৃতাভ্যাস–trained
কৃশিত–emaciated
কেবলকর্মী–performing mere works without intelligence
কেলিসচিব–minister of the sports
ক্রমভঙ্গ–interruption of order
ক্রয়লেখ্য–deed of sale
ক্ষয়িষ্ণু–perishable
ক্ষিপ্রনিশ্চয়–one who decides quickly
গণক-মহামাত্র–finance minister
গর্গর–whirlpool, eddy
গীতক্রম–arrangement of a song
গুম্ফন–grouping
গৃহব্রত–devoted to home
গেহেশূর–carpet-knight
গোত্রপট–genealogical table
গোপ্রতার–ox-ford (যেখানে গোরু পার করে)
গ্রন্থকূটী–library
গ্রামকূট–congregation of villages
গ্লান–tried, emaciated
চক্রচর–world-trotter
চটুলালস–desirous of flattery
চতুর্ভূমিক–four-storied
চরিষ্ণু–movable
জড়াত্মক–inanimate, unintelligent
জড়াত্মা– stupid
জনপ্রিয়–popular
জনসংসদ–assembly of men
জনাচার–popular usage
জরিষ্ণু–decaying
জ্ঞানসন্ততি–continuity of knowledge
তনিকা– string,বীণার তার
তনুবাদ–rarified atmosphere
তন্তী– string,বীণার তার
তরঙ্গরেখা– curved line
তরস্থান–landing place
তরস্বতী, তরস্বিনী, তরস্বী–quick-moving
তরুণিমা– juvenility
তাৎকালিক–simultaneous
তাৎকাল্য–simultaneousness
তীর্ণপ্রতিজ্ঞ–one who has fulfilled his promise
দিবাতন–diurnal
দুরভিসম্ভব–difficult to be performed
দুর্গত কর্ম–relief work employment offered to the famine-stricken
দুর্মর–dying hard (diehard)
দৃপ্র–arrogant
দ্বয়বাদী–double tongued
দ্বারকপাট–leaf of a door
দ্রপ্স–a drop
দ্রপ্সী–falling in drops
দ্রব্যত্ব–substance, substantiality
দ্রাংক্ষণ–discordant sound
দ্রাঘিত–lengthened
দ্রোহবুদ্ধি–maliciously minded
ধূম্রিমা– obscurity
নঙর্থক [নঞর্থক]–negative
নভস–misty, vapoury
নাব্য–navigable
নিমিশ্ল–attached to
নির্গামিক–outgoing
নির্নিক্ত–polished
নির্বাসিক–non-resident
নিষ্কাসিত–expelled
নীরক্ত–colourless faded
পণ্যসিদ্ধি–prosperity in trade
পতিম্বরা– a woman who chooses her husband
পরাচিত–nourished by another, parasite
পরিলিখন–outline or sketch
পরিস্রাবণ–filtering
পরুত্তন–belonging to the last year
পর্পরীণ–vein of a leaf
পর্যায়চ্যুত–superseded, supplanted
পাদাবর্ত–a wheel worked by feet for raising water
পারণীয়–capable of being completed
পিচ্চট–pressed flat, চ্যাপ্টা
পুটক–pocket
পুনর্বাদ–tautology
পুরন্ধ্রী–matron
পূর্বরঙ্গ–prelude or prologue of a drama
পৃচ্ছনা, পৃচ্ছা– spirit of enquiry
পৃথগাত্মা– individual
পৃথগাত্মিকতা– individuality
প্রচয়–collection
প্রচয়ন–collecting
প্রচয়িকা — [collection]
প্রচিত–collected
প্রণোদন–driving
প্রতিক্রম–reversed or inverted order
প্রতিচারিত–circulated
প্রতিজ্ঞাপত্র–promissory note
প্রতিপণ–barter
প্রতিপতি–a counterpart
প্রতিবাচক–answer
প্রতিভা– কারয়িত্রী–genius for action
প্রতিভা– ভাবয়িত্রী–genius for ideas, or imagination
প্রতিমান–a model, pattern
প্রতিলিপি–a copy, transcript
প্রতীপগমন–retrograde movement
প্রত্যক্ষবাদী–one who admits of no other evidence than perception by the senses
প্রত্যক্ষসিদ্ধ–determined by evidence of the sense
প্রত্যভিজ্ঞা, প্রত্যভিজ্ঞান–recognition
প্রত্যভিনন্দন, প্রত্যর্চন–returning a salutation
প্রত্যরণ্য–near or in a forest
প্রত্যুজ্জীবন–returning to life
প্রথম কল্প–a primary or principal rule
প্রপাঠ, প্রপাঠক–chapter of a book
প্রবাচন–proclamation
প্রলীন–dissolved
প্রসাধিত–ornamented
প্রাগ্রসর–foremost, progressive
প্রাণবৃত্তি–vital function
প্রাণাহ–cement used in building
প্রাতস্তন–matutinal
প্রাতিভজ্ঞান–intuitive knowledge
প্রেক্ষণিকা– exhibition
প্রেক্ষার্থ–for show
প্রোল্লোল–moving to and fro
প্রৌঢ়যৌবন–prime of youth
বর্তিষ্ণু–stationary
বশঙ্গম–influenced
বস্তুমাত্রা– mere outline of any subject
বাগ্জীবন–buffoon
বাগডম্বর–grandiloquence
বাগ্ভাবক–[promoting speech, with a taste for words]
বাতপ্রাবর্তিম–irrigation by wind-power
বিচিতি–collection
বিষয়ীকৃত–realised
বৃত–elected
ভঙ্গিবিকার–distortion of features
ভবিষ্ণু–progressing
ভিন্নক্রম–out of order
ভূমিকা–বাড়ির তলা,
যথা : চতুর্ভূমিক–four-storied
ভেষজালয়–dispensary
ভ্রাতৃব্য–cousin
মণ্ডল কবি–a poet for the crowd
মনোহত–disappointed
মায়াত্মক–illusory
মুদ্রালিপি–lithograph
মুমূর্ষা– desire of death
মৃদুজাতীয়–somewhat soft, weak
মৌল–aboriginal
যথাকথিত–as already mentioned
যথাচিন্তিত–as previously considered
যথাতথ–accurate
যথানুপূর্ব–according to a regular series
যথাপ্রবেশ–according as each one entered(সভাপ্রবেশ সম্বন্ধে)
যথাবিত্ত–according to one’s means
যথামাত্র–according to a particular measure
যন্ত্রকর্মকার–machinist
যন্ত্রগৃহ–manufactory
যন্ত্রপেষণী, জাঁতা– a hand-mill
যমল গান–duet song
রলরোল–wailing, lamenting
রোচিষ্ণু–elegant
লঘুখটি্বকা– easy chair
লোককান্ত– popular
লোকগাথা– folk verses
লোকবিরুদ্ধ–opposed to public opinion
শক্তিকুণ্ঠন–deadening of a faculty
শঙ্কাশীল–hesitating or diffident disposition
শয়নবাস–sleeping garment
শিঞ্জা, শিঞ্জান–tinkling sound
শিথির–flexible, pliant
–loose
শিল্পজীবী–an artisan
শিল্পবিধি–rules of art
শিল্পালয়–[art institute]
শ্মীল–winking, blinking
শ্লক্ষ্ণ–slippery, polished
শ্লথোদ্যম–relaxing one’s effort
সংকেতমিলিত–met by appointment
সংকেতকেতন স্থান–a place of assignation
সংক্রমণকা– a gallery
সংরাগ–passion, vehemence
সংলাপ–conversation
সৎকলা– a fine art
সদ্যস্ক, সদ্যস্তন–belonging to the present day
সময়চ্যুতি–neglect of the right time
সমাহর্তা– collector-general
সমূহকার্য–business of a community
সম্প্রতিবিদ্–knowing only the present, not what is beyond
সহজপ্রণেয়–easily led
সহধূরী–colleague
সাংকথ্য–conversation
সাত্ত্বিক ভাবক–[promoting the quality of purity]
সীতাধ্যক্ষ–the head of the agricultural department
সীমাসন্ধি–meeting of two boundaries
সুশ্লক্ষ্ণ–delicate
সৃপ্ত–slipped out or into
সৃপ্র–slippery, lithesome, supple
সৌচিক–tailor
স্ত্রীদ্বেষী–misogynist
স্ত্রীময়–effiminate, womanish
স্ফায়িত–expanding
স্ফির–tremulous
স্বগোচর–one’s own sphere or range
স্বচর–self-moving
স্বপ্রভুতা– arbitrary power
স্ববহিত–self-impelled
স্ববিধি–own rule or method
স্বমনীষা– own judgement or opinion
স্বয়মুক্তি–voluntary testimony
স্বয়ম্বশ–independent
স্বয়ম্বহ–self-moving
স্বয়ম্ভৃত, স্বয়ম্ভর–self-supporting
স্বসম্বেদ্য–intelligible only to one’s self
স্বসিদ্ধ–spontaneously effected
স্বাবমাননা– self-contempt
স্বৈরবর্তী–following one’s own inclination
স্রস্তর, স্রস্তরা– couch, sofa
স্রোতযন্ত্রপ্রাবর্তিম–[water-power irrigation]
হস্তপ্রাবর্তিম–[hand-power motion irrigation]
হৃদয়ভাবক–[promoting the feeling and sensations moved by sentiments]
শব্দ-চয়ন : ২
অকরণ–passive
সকরণ–active
অকারী–[passive]
সকারী–[active]
অক্রম–disorder
অক্রিয়–[passive]
সক্রিয়–[active]
অঙ্গ সংহতি– bodily symmetry, compactness of body
অঙ্গাঙ্গিতা– mutual relation
অঙ্গোঞ্চ–গামচা [a towel]
অঞ্চিত– curved; অঞ্চিত রেখা
অণিষ্ঠ–অণুতম [most minute]
অতথা– not saying yes, giving a negative answer
অতিঘ্ন–one who is in the condition of utter oblivion
অতিজীব–lively
অতিতর–better, higher
অতিতৃণ্ন–seriously hurt
অতিতৃপ্ত–satiated
অতিত্বরিত–অতিদ্রুত [very fast]
অতিত্রস্নু–very timid
অতিদর্শী–far-sighted
অতিধাবন–to run or rush over
অতিবর্তন–passing beyond
অতিমর্ত্য–super human
অত্বরা– freedom from haste
অত্যণু–very thin
অত্যন্তিক–to close
অত্যভিসৃত–having come too close
অত্যাসন্ন–being too close
অধঃখনন–undermining
অধিকর্ম–superintendence
অননুকৃত্য–inimitable
অনায়ত্ত–independent
অনাশস্ত–not praised
অনিগীর্ণ–not swallowed
অনিরা– languor
অনিরুপ্ত–not distributed, not shared
অনির্জিত–unconquered
অনিস্তীর্ণ–not crossed over
অনীতি–impropriety, immorality
অনুকথিত–repeated
অনুকার, অনুকারী–[imitating]
অনুগুণ–having similar qualities
অনুজন সম্মতি–popular sanction
অনুদেয়–a present
অনুপ্ত–unsown
অনুবর্তন–to follow
অনুবাক–recitation
অনৈতিহ্য–untraditional
অন্তঃশীর্ণ–withered within
অন্তঃস্মিত–inward smile
অন্তঃস্মের–smiling inwardly
অন্তর্গলগত–sticking in the throat
অন্তর্ভাব–inherent nature
অন্তিতম–very near
অন্যোন্যসাপেক্ষ–mutually relating
অপকর্ষ–decline, deterioration
অপপ্রসর–checked, restrained
অপাচী–দক্ষিণ [south] উদীচীর উল্টো
অপাচীন–situated backwards, behind
অপাত্রভৃৎ–supporting the unworthy or worthless
অপিত্র্য–not ancestral
অপ্রতিযোগী–not incompatible with
অপ্রদুগ্ধ–not milked
অবঞ্চনতা– honesty
অবটু–the back or nape of the neck
অবডীন–flight downwards
অবতিতীর্ষু–intending to descend
অবতৃণ্ন–split
অবদংশ–any pungent food, stimulant
অবব্রশ্চ–splinter, chip
অবম–undermost, inferior
অবমর্দিত–crushed
অবরতর–further down
অবরবয়স্ক–younger
অবরস্পর–having the last first, inverted
অবলীন–cowering down
অবশ্যা– hoar-frost
অবশ্যায়–[hoar-frost]
অবসা– liberation
অবস্কর–privy
অবস্তীর্ণ–strewn
অবস্ফূর্জ–the rolling of thunder
অবস্যন্দন–trickle down
অবুধ্ন–bottomless
অবেক্ষণিকা– observatory
অভঙ্গুর–not fragile
অমন্তু– silly
অমম–without egotism
অমম্রি–immortal
অমিনা– impetuous: অমেয়া, অমিতি
অম্বিতমা– dearest mother
অরাল–curved
অর্বাকপঞ্চাশ–under fifty
অশ্লীতপিবতা– invitation to eat and to drink
অসাত্ম্য–unwholesome
অসৌম্য–[disagreeable] : অশোভন
আকাশপথিক–[sky-traveller, sun]
আত্মনীয়তা– originality
আত্মবর্গ–intimate friends
আত্ম্য–personal
আদিৎসা– wish to take
আদিৎসু–[wishing to take]
আদিকালীন–belonging to the primitive time
আনর্ত–dancing room
আনুজাবর–posthumous
আন্তরতম্য–closest relationship
আবশ্যিক–compulsory
আমিশ্ল–having a tendency to mix
আয়ত্তি–magesty, dignity
আরাল–little curvedঃ আরালিত
আশিষ্ট–quickest
আশুকোপী–easily irritated
আশুক্লান্ত– quickly faded
আশুগামী–quickly moving
আসন্দ–chair
ইঞ্চাক–shrimph : ইচা মাছ
ইতাসু–one whose animal spirits have departed
ইষিরা– fresh, vigorous
ইষ্ট ব্রত–[performing desired vows]
ঈর্ষিত–envied
ঈর্ষিতব্য–enviable
ঈর্ষ্যক–envying
ঈর্ষ্যালু–envious
উচ্ছেষ–remainder
উৎকলিকা– [longing for] উৎকণ্ঠা
উত্তমতা– excellence
উত্তরপঞ্চাশ–[over fifty]
উপধূপিত–fumigated
উপনিধি–deposit
উপস্কৃত–furnished
উর্জানী–strength personified
উলুলি–an outcry indicative of prosperity: উলুধ্বনি
উস্রি, উস্রা– morning light
একান্তর–next but one
একোত্তর–greater or more by one
এতষ–dappled–having variegated colour
এষা– running
কটুকিমা– sharpness
কঠোরিত–[strengthened]
কণীচি–a kind of creeper
কথঙ্কথিত–one who is always asking questions; inquisitive
কনক গৌরবর্ণ–জাফরানী রঙ [saffron]
কনীনা– youthful
কপিল–brown, tawny, reddish brown
কপিল ধূসর–brownish grey
কপিশ–reddish brown
কপোত বর্ণ–lead grey
কমা– beautiful
করিষ্ঠ–doing most
কাব্যনিচয়–anthology
কাব্যবিবেচনা– criticism
কাম্ল–slightly acid
কারয়িতা, ভাবয়িতা– genius for action; genius for ideas or imagination
কারী–artist; artificer; mechanic
কুলগরিমা– family pride
কুলচ্যুত–expelled from a family
কুলতন্তু– thread [coming down from a race]
কুলস্থিতি–custom observed in a family
কূটমান–false measure or weight
কূটযুদ্ধ–treacherous battle
কৃতকর্তব্য, কৃতকৃত্য–one who has done his duty
কৃতত্বর–hurrying
কৃশবুদ্ধি–weakminded
কৃষ্ণপিঙ্গল–dark brown
কৃষ্ণলোহিত–purple
ক্রমভ্রষ্ট–irregular order
গিরিকটক–mountain side
গিরিদ্বার–mountain pass
গিরিপ্রস্থ–plateau; side of a hill
গীথা– a song
গুপ্তস্নেহা– having a secret affection
গেহেবিজিতী–a house hero, boaster
গৌরিমা– the being white
চিচীষা– desire to gather
চীনক (মহাভারত)– Chinese
জনপ্রবাদ, জনবাদ–rumour, report
জলনির্গম–water-course
জ্ঞানদুর্বল–deficient in knowledge
ঝন্ঝনিত–tinkling
তথার্থ–real
তনুচ্ছায়–অল্পছায়াবিশিষ্ট [shading little]
তপিষ্ঠ–extremely hot
তমোমণি–[fire-fly]
তরুমণ্ডপ–bower
তলিনা– fine, slender
তুল্যনাম–having the same name
দোষদৃষ্টি–fault-finding
দোষানুবাদ–tale-bearing
দ্রাঘিমা– length
দ্রাঘিষ্ঠ–longest
দ্রোহপর, দ্রোহবৃত্তি–[full of malice, malicious]
দ্রোহভাব–hostile disposition
ধুম্রবুদ্ধি–obscure intellect
নদীবঙ্ক–the bend of a river
নদীমার্গ–course of a river
নদীমুখ–mouth of a river
নানাত্ব–variety, manifoldness
নানাত্যয়–manifold
নিক্কণ–musicalsound
নিচয়–store
নিত্যযৌবনা– [perpetual youth]
নীরাগ–[colourless, faded]
নীলিনী–a species of convolvulus with blue flowers
নেদিষ্ঠ–nearest
পরপরীণ–traditional
পরীবেশ–a halo round the sun or moon
পর্যন্তদেশ–neighbouring district
পর্যন্তস্থিত–adjacent
পর্যাপ্তি–adequacy
পর্যায়ক্রম–order of succession
পলিতম্লান–grey and withered
পাটল–pink
পাণ্ডর–whitish yellow cream colour
পারতন্ত্র্য–সাতন্ত্র্যের বিপরীত [dependence on others]
পারস্পরী–regular succession
পারস্পরীয়–traditional
পিঙ্গল–reddish brown
পিশঙ্গ–tawny
পুররোধ–sieze of a city or fortress
পুরাকথা– an old legend
পুরাবিদ্–[knowing the events of former times]
প্রজ্ঞু–bandy legged
প্রতিচিকীর্ষা– wish to require
প্রতিজীবন–resuscitation
প্রতিবারণ–warding off, preventing
প্রতিবচন, প্রতিবাক্য, প্রত্যুক্তি–answer
প্রতিসংলয়ন–retirement into a lonely place
প্রতিসংলীন–retired
প্রত্যন্তিক–situated at the border, frontiermen
প্রপাত–precipice
প্রভব–origin
প্রসাধন–decoration
প্রসাধনবিধি–[mode of decoration]
প্রাক্পশ্চিমায়ত–running from east to west
প্রাতিভ–intuitive
প্রাতীতিক–subjective
বক্রবাক্য–ambiguous speech
বর্গ–species or genus : যেমন, স্তন্যপায়ীবর্গ
বিকস্বর প্রসারী–expanding
বিনীল–dark blue
বিবেচক–critic
ভাবক [আঙ্গিক ভাবক] [অনুভাব ভাবক]–[having a taste…]
ভাবানুষঙ্গ–[ association of idea]
মাংশ্চতু–light yelow, dun coloured
মির্মির–twinkling
মুখরেখা–feature
যথাপ্রতিজ্ঞা– according to promise
যথাযথ–suitable, fit, proper
যাচিতক–a think borrowed for use
রজিষ্ঠ–straightest, upright, honest
লীলোদ্যান–pleasure garden
লোকনায়ক–[leader of the worlds]
লোকবার্তা– world’s news
লোষ্টভেদন– a harrow
শক্তিগোচর–within one’s power
শিথিলশক্তি–impaired in strength
শিরিণা (ঋগ্বেদ)– night
শীঘ্রকৃত্য–to be done quickly
শ্মীলিত–[winked]
শ্যাব–dark brown
শ্রমখিন্ন–distressed by fatigue
সংখ্যান–calculation
সংখ্যাবিধান–making a calculation
সংজ্ঞু–knock-kneed
সংখাধ্যক্ষ–the chief of the brotherhood
সন্তৃণ্ন–hollowed out, perforated
সমঙ্গী–complete in all parts
সময়াচার–conventional or established practice
সমস্থল–level country
সমূহ–association, community
সম্যক্ প্রয়োগ–right use
সম্যগ্ দর্শন, দৃষ্টি–right perception, insight
সম্যগ্বোধ–right understanding
সাংকথিক–excellent in conversation
সাহিত্যগোষ্ঠী–[a conversation on literature]
সুহিত–kind : সুহিতা
সৃজতি–creation
সেরাল–pale yellow
স্কন্ধপ্রাবর্তিম– [দ্র| হস্তপ্রাবর্তিম : শব্দচয়ন ]
স্তিমিত নয়ন–having the eyes intently fixed
স্ত্রীবাক্যাঙ্কুশপ্রক্ষুণ্ন–driven on by the goad of a woman’s words
স্ফারফুল্ল–full blown
স্ফুটফেনরাজি–bright with lines of foam
স্ফুরণ–glittering, throbbing, vibration, pulsation, twinkling
স্ফুরৎ তরঙ্গজিহ্ব–having tongue like waves
স্ফুরৎ প্রভামণ্ডল–surrounded by a circle of tremulous light
স্বচ্ছন্দতঃ–spontaneously
স্বচ্ছন্দতা–independent action
স্বচ্ছন্দভাব–spontaneity
স্বদনীয়–palatable
স্বয়ম্পাঠ–original text
স্বসমুত্থ–arising within self
স্বৈরাচার–[of unrestrained conduct or behaviour]
স্বৈরালাপ–[unreserved conversation]
স্বৈরাহার–[abandant food]
রবীন্দ্রনাথ-কৃত শব্দচয়ন ১ ও ২-সংখ্যক তালিকায় যেখানে ইংরেজি অর্থ বা প্রতিশব্দের উল্লেখ নাই সে-সব ক্ষেত্রে [] বন্ধনী-মধ্যে মনিয়ের উইলিয়ম্স্-এর অভিধান হইতে ইংরেজি অর্থ সংকলন করিয়া দেওয়া হইল।
উপসংহার : দৃষ্টান্তবাক্য
অকরণ passive আমাদের সমাজে যা কিছু পরিবর্তন হচ্ছে সে অকরণভাবে,
সকরণ active সকরণ বুদ্ধিদ্বারা আমরা তাকে চালনা করি না।
অঙ্গসংহতি bodily symmetry, compactness of body
গ্রামে যে জনসভা স্থাপিত হইয়াছে এখনো তাহা শিথিলভাবেই আছে তাহার অঙ্গসংহতি ঘটে নাই।
অঙ্গারিত charred–প্রাচীন জন্তুর কয়েকখণ্ড অঙ্গারিত অস্থিমাত্র পাওয়া গিয়াছে।
অকর্মান্বিত unemployed–আমেরিকার অকর্মান্বিত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি হইতেছে।
অঙ্গাঙ্গিতা mutual relation–আমাদের দেশের উচ্চবর্ণের লোকের সঙ্গে অন্ত্যজদের অঙ্গাঙ্গিতার অভাব।
অতিকথিত, অতিকৃত exaggerated–অতিকৃত রেখার দ্বারা তাঁহার ছবিকে ব্যঙ্গাত্মক করা হইয়াছে।
মির্মির twinkling– এই জ্যোতিষ্কটি গ্রহ নহে নক্ষত্র তাহা তাহার মির্মির আলোকে সপ্রমাণ হয়।
অতিদিষ্ট overruled–একদা যে বিধি কর্তৃপক্ষের আদিষ্ট ছিল বর্তমানে তাহা অতিদিষ্ট হইয়াছে।
অধিষ্ঠায়ক বর্গ governing body–অধিষ্ঠায়কবর্গের নিকট বিদ্যালয়ের প্রতিবেদন প্রেরিত হইয়াছে।
অধিকর্মা superintendent–বিদ্যালয়ের অধিকর্মা পদে কাহাকেও নিযুক্ত করা হয় নাই।
অনাত্ম্য impersonal–অনাত্ম্যভাবের রাজ্যশাসন প্রজার পক্ষে হৃদ্য নহে। বৈজ্ঞানিক সত্য অনাত্ম্য সত্য।
অননুকৃত্য inimitable–রঙ্গমঞ্চে তাঁহার প্রয়োগনৈপুণ্য অননুকৃত্য।
অনুজ্ঞাত allowed–মন্দিরে হীনবর্ণের প্রবেশাধিকার প্রাঙ্গণ পর্যন্ত অনুজ্ঞাত।
অনুদত্ত remitted –যথাকালে তাঁহার বৃত্তি অনুদত্ত হইয়াছে কিনা
অনুদেশ reference to something prior –তাঁহার পত্রে তাহার কোনো অনুদেশ পাওয়া যায় না।
অনুপার্শ্বগতি lateral movement–বালুকারাশি অনুপার্শ্বগতিতে সরিয়া আসিয়া কূপ পূর্ণ করিয়াছে।
আত্ম personal–সঙ্গে একটিমাত্র তাঁহার আত্ম্য অনুচর (personal attendant) ছিল।
অনুযাত্র retinue –তাঁহার অনুযাত্রদের মধ্যে তাঁহার
অন্তম intimate অন্তম বন্ধু কেহই ছিল না।
অন্তঃপাতিত inserted–কালির রঙ দেখিয়া অনুমান করা যায় পুঁথির মধ্যে এই বাক্যগুলি পরে অন্তঃপাতিত।
অন্তর্ভৌম subterranean–ভূমিকম্পের পূর্বে একটি অন্তর্ভৌম ধ্বনি শুনা গেল।
অন্তরীয় undergarment–পশমের অন্তরীয় বস্ত্র ঘর্মশোষণের পক্ষে উপযোগী।
অন্তরায়ণ internment–রাষ্ট্রিক অপরাধে অন্তরায়িতের প্রতি পীড়ন বর্বরতা।
অপণ্য unsaleable, not for sale–প্রদর্শনীর বিশেষ চিহ্নিত চিত্রগুলি অপণ্য।
অপম the most distant–অন্তম ও অপম আত্মীয়দের লইয়া একান্নবর্তী পরিবার।
অপশব্দ vulgar speech–অপশব্দ অনেক সময় সংস্কৃত শব্দ অপেক্ষা শক্তিশালী।
অপ্রতিষ্ঠ unstable–রাষ্ট্রব্যবস্থা কিছু পরিমাণে অপ্রতিষ্ঠ থাকা প্রজাদের স্বাধীনতার পক্ষে অনুকূল।
অভিজ্ঞানপত্র certificate–তাঁহার উদার ললাটেই বিধাতার স্বহস্ত-রচিত অভিজ্ঞানপত্র।
অভ্যাঘাত interruption–উপদেশ চেষ্টা আখ্যান বিষয়ের অভ্যাঘাত।
অরাল curved–অরাল পক্ষ্ণ কৃষ্ণায়ত চক্ষু।
অরত apathetic–বান্ধবদের প্রতি যাহার অরতি সর্বত্রই তাহার চিরনির্বাসন।
অর্ম ruins, rubbish–নদীগর্ভের পঞ্চাশ ফুট নিম্নে প্রাচীন অর্মস্তূপ পাওয়া গেল।
অবর্জনীয় inevitable–কোনো দুঃখকেই অবর্জনীয় বলিয়া উদাসীন হওয়া মনুষ্যোচিত নহে।
অস্তব্যস্ত scattered, confused–তাঁহার রচনায় ভাবসংহতি নাই, সবই যেন অস্তব্যস্ত।
আত্মতা essence–বীর্যের আত্মতাই ক্ষমা।
আত্মবিবৃদ্ধি self-aggrandisement–আত্মবিবৃদ্ধির অসংযমেই আত্মবিনাশ।
আত্মকীয় original–তাঁহার লেখায় স্বকীয়তা [আত্মকীয়তা] নাই সমস্তই অনুকরণ।
উক্ত প্রত্যুক্ত discourse–এই গ্রন্থটি আকবরের রাজনীতি সম্বন্ধে উক্তি প্রত্যুক্তি।
উপধূপিত fumigated–রোগীর বিছানা গন্ধক বাষ্পে উপধূপিত করা হইল।
আবাসিক resident –আবাসিক ছাত্রদের বেতন কুড়ি টাকা।
অনাবাসিক non-resident –অনাবাসিকদের দেয় ছয় টাকা।
আগামিক incoming– আমাদের আগামিক সভাপতি পরমাসে কাজে যোগ দিবেন।
বিষয়ীকৃত realised–মনে যে আদর্শ আছে জীবনে তাহা বিষয়ীকৃত হয় নাই।
আঙ্গিক technique –এই চিত্রের গুম্ফন যেমন সুন্দর
গুম্ফন grouping –আঙ্গিক তেমন নয়।
শব্দচয়ন : ৩
বর্তমান গ্রন্থের বিভিন্ন রচনায় যে-সব প্রতিশব্দের উল্লেখ আছে প্রবন্ধের বিন্যাসক্রমে সেগুলি সংকলিত হইল :
উপসর্গ-সমালোচনা॥
অপহরণ–abduction
দন্তহীন–edentate
অন্তরেজাত–innate
আসন্ন–adjacent
আক্ষিপ্ত–adjective
আবদ্ধ–adjunct
অভিনয়ন–adduce
অভিদেশ অভিনির্দেশ–address
অভিবর্তন–advent
বাংলা শব্দদ্বৈত॥
পুনর্বৃত্তি–repetition
ধ্বন্যাত্মক শব্দ॥
নিঃশব্দ জ্যোতিষ্কলোক–silent spheres
বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত॥
একমাত্রিক–monosyllabic
বাংলা ব্যাকরণ॥
শাব্দিক–[philologist]
বাংলা ব্যাকরণে তির্যক্রূপ॥
তির্যক্রূপ–oblique form
নাম সংজ্ঞা–proper names
প্রতিশব্দ॥
* অধিজাতি–nation
* আধিজাতিক–national
* আধিজাত্য–nationalism
* প্রবংশ–race
প্রবংশ রক্ষা– race preservation
জাতি সম্প্রদায়–tribe
জাতি, বর্ণ–caste
মহাজাতি–genus
উপজাতি–species
প্রজাত–generation
নিজমূলক
–originality
স্বকীয়তা
অপূর্ব–strange
আদিম–original
দরদ–sympathy
অনন্যতন্ত্র– originality
আবেগ, হৃদয়বেগ–emotion
চিত্তোৎকর্ষ, সমুৎকর্ষ–culture
উৎকর্ষিতচিত্ত, উৎকর্ষবান–culture-minded
অপজাত–degenerate
আপজাত্য–degeneracy
প্রজনতত্ত্ব–genetics
সৌজাত্যবিদ্যা– ugenics
বংশানুগতি–heredity
বংশানুগত–inherited
বংশানুলোম্য–inheritable
অভিযোজন–adaptation
অভিযুজ্যতা– adaptability
অভিযোজ্য–adaptable
অভিযোজিত–adapted
অনুরক্তি–interest
স্বতঃসৃত–spontaneous
প্রতিক্ষিপ্ত–reflex
প্রসমীক্ষা, প্রসমীক্ষণ, পূর্ব-বিচারণা– forethought
সূচনা, অভিসংকেত–suggestion
সূচনাশক্তি–suggestiveness
স্বাভিসংকেত–auto-suggestion
বিসংগত সত্য, বিসংগত বাক্য–paradox
ব্যঙ্গানুকরণ–parody
শখ–amateur
পাটল–violet
পল্লবগ্রাহী–dilettante
দ্বৌমানসিকতা, দ্বৈতমানস–two mindedness
দ্বৈতমনা– two minded
মহান–sublime
মহিমা– sublimity
স্বরসংগম, স্বরসংগতি–harmony
স্বরৈক্য–concord
বিস্বর–discord
ধ্বনিমিলন–symphony
সংধ্বনিক–symphonic
রোমাঞ্চিত, তৃণাঞ্চিত–curved
বাণী, মহাবাণী–the voice
* জাত–caste
জাতি–race
* রাষ্ট্রজাতি–nation
জনসমূহ–people
* প্রজন–population
আকাশবাণী, বাক্প্রসার–broadcast
বুদ্ধিগত মৈত্রী, বুদ্ধিমূলক মৈত্রী, বুদ্ধিপ্রধান মৈত্রী, মৈত্রীবোধ–intellectual friendship
ভাবপ্রধান, হৃদয়প্রধান–emotional
মনঃপ্রকর্ষ, চিত্তপ্রকর্ষ–culture
প্রকৃষ্টচিত্ত, প্রকৃষ্টমনা– cultured
উৎকৃষ্টি–culture
বুদ্ধিগত সংরাগ–intellectual passion
সংরাগ–passion
বুদ্ধিগত ব্যক্তিত্ব–intellectual self
দেহপ্রকর্ষ চর্চা– physical culture
* শিলক–fossil
* শিলীকৃত–fossilized
* অবমানব–sub-man
* প্রাক্প্রস্তর–eolith
* প্রাক্মানব=eoanthropus
* প্রাগাধুনিক=eocene
* পুরাজৈবিক–proterozoic
পটভূমিকা, পশ্চাদ্ভূমিকা, পৃষ্ঠাশ্রয়, অনুভূমিকা, আশ্রয়, আশ্রয়বস্তু –background
সংকেত, লক্ষ্য, উদ্দেশ, উদাহরণ, অভিনির্দেশ, অভিসংকেত–allusion
পরিচয়–reference
গত মাসিক–proximo
আগামী মাসিক–ultimo
প্রতিমা– image
প্রদোষ–twilight
সাংস্কৃতিক ইতিহাস–cultural history
সংস্কৃত চিত্ত–cultured mind
সংস্কৃতবুদ্ধি–cultured intelligence
সংস্কৃতিমান–cultured
প্রৈতি–impulse
নৈসর্গিক নির্বাচন–natural selection
শিলাবিকার–fossil
শিলবিকৃত, শিলীভূত–fossilized
চারিত্র, চারিত্রশিক্ষা, চারিত্রবোধ, চারিত্রোন্নতি–ethics
তত্ত্ববিদ্যা– metaphysics
কেন্দ্রানুগ–সেন্ট্রিপীটাল [centrepetal]
কেন্দ্রাতিগ–সেন্ট্রিফ্যুগাল [centrifugal]
শিলাবিকার–metamorphosed rock
জীবশিলা–ফসিল [fossil]
নভোবিদ্যা–মিটিয়রলজি [meteorolog]
প্রতিষ্ঠান–institution
অনুষ্ঠান–ceremony
অনুবাদ-চর্চা॥
নিত্যনির্বন্ধ=persistent
বাদানুবাদ॥
কুলসঞ্চারিতা= heredity
কুলসঞ্চারী=inherited
বানান-বিধি॥
বৈয়াকরণিক–grammarian
চিহ্নবিভ্রাট॥
অবন্ধ–essay
বাংলাভাষা ও বাঙালি চরিত্র॥
রোথো।–commonplace
শব্দচয়ন : ৪
অক্ষর-যোজক compositor
অগত্যা-প্রেরিত খাটুনি forced labour
অনামা চিঠি unanimous letter
অন্তর্মনস্ক introvert
অসিতচর্ম coloured
আজ্ঞেয়িক agnostic
আঁকনপট canvas
আপিসি শাসন burocracy
উপরাজ্য satellite state
কদুৎসাহী Zealot
কৃতকপুত্র foster son
গঠন পত্রিকা constitution, prospectus
গর্তগড় dug-out
গোষ্ঠবিদ্যা animal husbandry
চতুষ্পথ crossing
চন্দ্রালোক গীতিকা moonlight sonata
চরম তিরস্করণী drop scene
চর্মপত্র parchment
চিত্রবয়ন embroidery
জনাদর popularity
তড়িৎমাপক সূচী galvanometer
তাপজনক খাদ্য caloric food
দরখাস্ত পত্রিকা application
ধর্মমূঢ়বুদ্ধি bigotry
নরভুক্ cannibal
নৈহারিকতা nebulocity
পরিণামদারুণ tragic
পরিণামবাদ theory of evolution
পরিপ্রেক্ষণিকা
পরিপ্রেক্ষণী perspective
পরিপ্রেক্ষিত
প্রত্যক্ষরীকরণ transliteration
ভীতধ্বনি alarm
মনোবিকলনমূলক psycho-analytical
মাশুলখানা Custom House
মিতশ্রমিক যন্ত্র labour-saving machine
রূঢ়িক elementary
শেষমোকাম terminus
সাদর পত্র testimonial
স্বজাতিপূজা Cult of Nationalism
স্বতশ্চালিত automobile
স্বাঙ্গীকরণ assimilation
স্বৈচ্ছিক optional
স্বৈরশাসক despot
হনুকরণ aping
শব্দচয়ন : ৫
A bird in hand is worth two in the bush.
দুটো পাখি ঝোপে থাকার চেয়ে একটা পাখি হাতে থাকা ভালো!
–চিঠিপত্র ৮
ঝোপের মধ্যে গণ্ডাখানেক পাখি থাকার চেয়ে মুঠোর মধ্যে একটা পাখি ঢের ভালো। –ছিন্নপত্র
Ask me not and you will be told no lie.
প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়ো না তাহা হইলে মিথ্যা জবাব শুনিতে হইবে না।
–গল্পগুচ্ছ ১, “অসম্ভব কথা”
Building castles in the air.
আসমানের উপর কত ঘরবাড়ি না বাঁধিয়াছিল।
–বউঠাকুরানীর হাট
Do not look a gift horse in the mouth.
দানের ঘোড়ার দাঁত পরীক্ষা করিয়া লওয়াটা শোভা পায় না।
–শিক্ষা
Enough is as good as a feast.
যা যথেষ্ট সেটাই ভূরিভোজের সমান-দরের। –মানুষের ধর্ম
Example is better than precept.
উপদেশের অপেক্ষা দৃষ্টান্ত অধিক ফলপ্রদ। –ব্যঙ্গকৌতুক
From frying pan to fire.
তপ্ত কড়া থেকে পালাতে গিয়ে জ্বলন্ত আগুনে পড়া।
–বিশ্বভারতী পত্রিকা, মাঘ-চৈত্র ১৩৭৬
তপ্ত কটাহ হতে জ্বলন্ত চুল্লিতে পড়া।
–মোহিতচন্দ্র সেনকে লিখিত পত্র, ১৮ কার্তিক ১৩১০
Greatest good of the greatest number.
প্রচুরতম লোকের প্রভূততম সুখসাধন। –চতুরঙ্গ
Irony of fate.
ভাগ্যের বিদ্রূপ। –ভানুসিংহের পত্রাবলী
Mahomet must come to the mountain.
মহম্মদকে পর্বতের কাছে আসতে হবে। –বি| ভা| প| বর্ষ ১৪ পৃ ১৭১
Not the game but the goose.
শিকার পাওয়া নহে, শিকারের পশ্চাতে অনুধাবন করা –ধর্ম
Penny wise pound foolish
কড়ায় কড়া কাহনে কানা। –সমাজ
পয়সার বেলায় পাকা টাকার বেলায় বোকা। –পথের সঞ্চয়
Rolling stone gathers no moss.
গড়ানে পাথরের কপালে শ্যাওলা জোটে না।
–শেষের কবিতা
গড়িয়ে যাওয়া পাথর শ্যাওলা জমাতে পারে না।
–শান্তি দেবীকে লিখিত, ১৭ অগস্ট ১৯২৭,
চিঠিপত্র ১২, পৃ ২৫৬
Similia Similibus Curantur
শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ।
–“হাতে কলমে”, “ভারতী’, ভাদ্র-আশ্বিন ১২৯১
“সাবিত্রী’, আশ্বিন ১২৯৩
Spare the rod and spoil the child.
বেত বাঁচাইলে ছেলে মাটি করা হয়। –সাহিত্যের পথে
Success brings success.
সিদ্ধিই সিদ্ধিকে টানে। –কালান্তর
The best is the enemy of good.
বেশির জন্যে আকাঙক্ষাটা সম্ভবপরের শত্রু।
–মৈত্রেয়ী দেবীকে লিখিত পত্র, বি, ভা| প| বর্ষ ১২, পৃ ২৫১
Survival of the fittest.
যোগ্যতমের উদ্বর্তন। –সাহিত্যের পথে
There is many a slip between the cup and the lip.
ওষ্ঠ ও পাত্রের মধ্যে অনেকগুলি ব্যাঘাত।–চিঠিপত্র ৮
To err is human, to forgive divine.
দোষ করা মানবের ধর্ম, ক্ষমা করা দেবতার।
–প্রজাপতির নির্বন্ধ
ভুল করা মানবধর্ম, মার্জনা করা দেবধর্ম।
–সমাজ; বাংলা শব্দতত্ত্ব / বীম্সের বাংলা ব্যাকরণ
Two is company, three is crowd.
দুয়ের যোগে সঙ্গ, তিনের যোগে গোলযোগ।
“সংগীতের মুক্তি’, “সংগীতচিন্তা’, পৃ ৪৫
Wild goose chase.
বুনোহাঁস শিকার। –শেষের কবিতা
শব্দচয়ন : ৬
কানাকানি-বিভাগ intelligence department–চার অধ্যায়
ঘণ্টাকর্ণ Slave of the bell–সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, “রবীন্দ্রসংগমে দ্বীপময়
ভারত ও শ্যামদেশ’
চৌকিদারি Chairmanship–রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত পত্র,
২২ কার্তিক ১৩২৪। চিঠিপত্র ১২
জন বৃষ John Bull–ছিন্নপত্র
তদীয় উত্তুঙ্গতা His Exalted Highness
নাট্যি fy dramatization–খাপছাড়া, ৮৮
বলবান অস্বীকৃতি/ ভিগরস্ প্রোটেস্ট Vigorous protest–বাঁশরি
ব্যাঘ্রপাইপ bagpipe–পূরবী
শব্দতত্ত্বের একটি তর্ক
শ্রীযুক্ত বিজনবিহারী ভট্টাচার্য শব্দতত্ত্বঘটিত তাঁর এক প্রবন্ধে “গান গা’ব’ বাক্যের “গা’ব’ শব্দটিকে অশুদ্ধ প্রয়োগের দৃষ্টান্তস্বরূপে উল্লেখ করেছেন। এই দৃষ্টান্তটি আমারই কোনো রচনা থেকে উদ্ধৃত।
স্বীকার করি, এরূপ প্রয়োগ আমি করে থাকি। এটা আমার ব্যক্তিগত বিশেষত্ব কি না তারই সন্ধান করতে গিয়ে আমি মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত বিধুশেখরকে জিজ্ঞাসা করলেম যে যদি বলি, “আজ সভায় আমি গান গা’ব না গা’বেন বসন্তবাবু, এখানে গান গা’বার আরো অনেক লোক আছে’ তাতে কোনো দোষ হবে কি না– প্রশ্ন শুনে তিনি বিস্মিত হলেন, বললেন তাঁর কানে কোথাও ত্রুটি ঠেকছে না। বাংলা শব্দকোষকার পণ্ডিত হরিচরণকেও অনুরূপ প্রশ্ন করাতে তিনি বললেন তিনি স্বয়ং এই রকমই প্রয়োগ ক’রে থাকেন।
বিজনবিহারীর সঙ্গেও আলোচনা করেছি। তিনি বাংলা শব্দতত্ত্বের একটি নিয়মের উল্লেখ করে বললেন, বাংলা গাওয়া শব্দটার মূলধাতু “গাহ্’– যে ইকার এই হ ধ্বনির সঙ্গে মিলিত, তার বৈধব্য ঘটলেও বিনাশ হয় না, হ লোপ হলেও ই টিঁকে থাকে। অতএব গাওয়া থেকে গাইব হয়, গা’ব হ’তে পারে না, সহমরণের প্রথা এ স্থলে প্রচলিত নেই।
আমাকে চিন্তা করতে হল। শব্দের ব্যবহারটা কী, আগে স্থির হলে তবে তার নিয়ম পরে স্থির হতে পারে। বলা বাহুল্য, বাংলার যে ভূভাগের ভাষা প্রাকৃত বাংলা বলে আজকালকার সাহিত্যে চলেছে সেইখানেই অনুসন্ধান করতে হবে।
এখানে হ ধ্বনিযুক্ত ক্রিয়াপদের তালিকা দেওয়া যাক।–
কহ্, গাহ্, চাহ্, নাহ্, সহ্, বহ্, বাহ্, রহ্, দোহ্।
দেখা যায় অধিকাংশ স্থলেই এই-সকল ক্রিয়াপদে ভবিষ্যৎ কারকে বিকল্পে ই থাকে এবং লোপ পায়।
“কথা কইবে’ও হয় “কথা ক’বে’ও, যথা, “গেলে কথা ক’বে না সে নব ভূপতি।’
ভিক্ষে চা’ব না বললেও হয়, ভিক্ষে চাইব বললেও হয়। “তোমার কাছে শান্তি চা’ব না’ গানের পদটি আমারই রচনা বটে, কিন্তু কারো কানে এ পর্যন্ত খটকা লাগে নি।
“এ অপমান স’বে না’ কিংবা “দুঃখের দিন র’বে না’ বললে কেউ বিদেশী বলে সন্দেহ করে না।
যদি বলি “গঙ্গায় না’বে, না তোলা জলে’ তা হলে ভাষার দোষ ধরে শ্রোতা আপত্তি করবে না।
কেবল বহা ও বাহা ক্রিয়াপদে “ব’বে’ “বা’বে’ ব্যবহার শোনা যায় না তার কারণ পাশাপাশি দুটো “ব’-কে ওষ্ঠ পরিত্যাগ করতে চায়।
হ ধ্বনি বর্জিত এই জাতীয় ক্রিয়াপদে প্রাকৃত প্রয়োগে নিঃসংশয়ে ই স্বর লুপ্ত হয়। কথ্য ভাষায় কখনোই বলি নে খাইব, যাইব, পাইব।
“দোহা’ ক্রিয়াপদের আরম্ভে ওকার আছে, তারই জোরে ই থেকে যায়– বলি “গোরু দুইবে’। কিন্তু একেবারেই ই লোপ হ’তে পারে না ব’লে আশঙ্কা করি নে। “রুগ্ণ গোরু কখনোই দোবে না’ বাক্যটা অকথ্য নয়।
“পোহা’ অর্থাৎ প্রভাত হওয়া ক্রিয়াপদের ধাতুরূপ “পোহা’– পোহাইবে বা পোহাইল শব্দে লিখিত ভাষায় ই চলে কিন্তু কথিত ভাষায় চলে না। সন্দেহ হচ্ছে “কখন রাত পুইবে’ বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ “পোয়াবে’ এবং “পুইবে’ দুইই হয়।
শ্রাবণ, ১৩৪৩
সর্বনাম
কর্তা– আমি আমরা, তুমি তোমরা, আপনি আপনারা, সে তারা, তিনি তাঁরা, এ এরা, ইনি এঁরা, ও ওরা, উনি ওঁরা, কে কারা, যে যারা, কি কিসব কোন্গুলো, যা যা’সব যেগুলো, তা সেইসব সেইগুলো।
কর্ম– আমাকে আমাদের তোমাকে তোমাদের (দিগকে), আপনাকে আপনাদের, তাকে তাদের, তাঁকে তাঁদের, একে এদের, এঁকে এঁদের, ওঁকে ওঁদের, কাকে কাদের, কোন্টাকে কোন্গুলোকে, যাকে যাদের, যেটাকে যেগুলোকে, সেটাকে সেগুলোকে।
করণ– আমাকে দিয়ে, তাকে দিয়ে, কোন্টাকে দিয়ে, ইত্যাদি। কেন, কিসে, কিসে কোরে, কি দিয়ে; যাতে, যাতে কোরে, যা দিয়ে; তাতে, তাতে কোরে, তা দিয়ে ইত্যাদি।
অপাদান– আমার চেয়ে এটা ভালো, আমা হতে এ হবে না, আমার থেকে ও বড়ো, এটার চেয়ে, ওটা থেকে ইত্যাদি।
সম্বন্ধ– আমার তোমার তার এগুলোর ওগুলোর ইত্যাদি।
অধিকরণ– আমাতে তোমাতে, এটাতে ওটাতে, আমায় তোমায়, আমাদের মধ্যে, এগুলোতে ইত্যাদি। এখন তখন যখন কখন, এমন তেমন কেমন যেমন অমন, অত তত যত, এখানে যেখানে সেখানে।
২
বাংলায় কথার ভাষা আর লেখার ভাষা নিয়ে যে তর্ক কিছুকাল চলছে আপনি আমাকে সেই তর্কে যোগ দিতে ডেকেছেন। আমার শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত বলে এ কাজে আমি উৎসাহ বোধ করছি নে। সংক্ষেপে দুই-একটা কথা বলব।
কর্ণ অর্জুন উভয়ে সহোদর ভাই হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যখন জাতিভেদ ঘটেছিল, একজন রইল ক্ষত্রিয় আর-একজন হ’ল সূত, তখনি দুই পক্ষে ঘোর বিরোধ বেধে গেল। বাংলা লেখায় আর কথায় আজ সেই দ্বন্দ্ব বেধে গেছে। এরা সহোদর অথচ এদের মধ্যে ঘটেছে শ্রেণীভেদ; একটি হলেন সাধু, আর-একটি হলেন অসাধু। এই শ্রেণীভেদের কারণ ছিলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। সে কথাটা খুলে বলি।
এক সময়ে বাংলায় পদ্য সাহিত্যই একা ছিল; গদ্য ছিল মুখে; লেখায় স্থান পায় নি। পদ্যের ভাষা কোনো এক সময়কার মুখের ভাষার কাছ-ঘেঁষা ছিল সন্দেহ নেই– তার মধ্যে “করিতেছিলাম’ বা “আমারদিগের’ “এবং’ “কিম্বা’ “অথবা’ “অথচ’ “পরন্তু’র ভিড় ছিল না। এমন-কি, “মুই’, “করলুঁ’ “হৈনু’ “মোসবার প্রভৃতি শব্দ পদ্য ভাষায় অপভাষা বলে গণ্য হয় নি। বলা বাহুল্য, এ-সকল কথা কোনো এক সময়ের চলতি কথা ছিল। হিন্দী সাহিত্যেও দেখি কবীর প্রভৃতি কবিদের ভাষা মুখের কথায় গাঁথা। হিন্দীতে আর-একদল কবি আছেন, যাঁরা ছন্দে ভাষায় অলংকারে সংস্কৃত ছাঁদকেই আশ্রয় করেচেন। পণ্ডিতদের কাছে এঁরাই বেশি বাহবা পান। ইংরেজিতে যাকে ড়শষথথভড়বশনড়ড় বলে এ জিনিসটা তাই। হিন্দী প্রাকৃত যথাসম্ভব সংস্কৃত ছদ্মবেশে আপন প্রাকৃতরূপ ঢাকা দিয়ে সাধুত্বের বড়াই করতে গিয়েচে। তাতে তার যতই মান বাড়ুক-না কেন, মথুরার রাজদণ্ডের ভিতর ফুঁ দিয়ে সে বৃন্দাবনের বাঁশি বাজাতে পারে নি।
যা হোক, যখন বাংলা ভাষায় গদ্যসাহিত্যের অবতারণা হল তার ভার নিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। দেশের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে প্রতিদিন যে গদ্য বাণী প্রবাহিত হচ্চে তাকে বহুদূরে রেখে সংস্কৃত সরোবর থেকে তাঁরা নালা কেটে যে ভাষার ধারা আনলেন তাকেই নাম দিলেন সাধুভাষা। বাংলা গদ্য সাহিত্যিক ভাষাটা বাঙালির প্রাণের ভিতর থেকে স্বভাবের নিয়মে গড়ে ওঠে নি, এটা ফরমাসে গড়া। বাঙালির রসময় রসনাকে ধিক্কার দিয়ে পণ্ডিতের লেখনী বলে উঠল গদ্য আমি সৃষ্টি করব। তলব দিলে অমরকোষকে মুগ্ধবোধকে। সে হল একটা অনাসৃষ্টি। তার পর থেকে ক্রমাগতই চেষ্টা চলচে কি ক’রে ভাষার ভিতরকার এই একটা বিদ্ঘুটে অসামঞ্জস্যটাকে মিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বিদ্যাসাগর তাকে কিছু পরিমাণে মোলায়েম ক’রে আনলেন– কিন্তু বঙ্গবাণী তবু বললেন “এহ বাহ্য”। তার পরে এলেন বঙ্কিম। তিনি ভাষার সাধুতার চেয়ে সত্যতার প্রতি বেশি ঝোঁক দেওয়াতে তখনকার কালের পণ্ডিতেরা দুই হাত তুলে বোপদেব অমরের দোহাই পেড়েছিলেন। সেই বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনীর ভাষাও আজ প্রায় মরা গাঙের ভাষা হয়ে এসেচে– এখনকার সাহিত্যে ঠিক সে ভাষার স্রোত চলচে না। অর্থাৎ বাংলা গদ্যসাহিত্যের গোড়ায় যে একটা ষক্ষভফভশতর ড়ভশ ঘটেছে কেবলি সেটাকে ক্ষালন করতে হচ্চে। কৌলিন্যের অভিমানে যে একটা হঠাৎ সাধুভাষা সর্বসাধারণের ভাষার সঙ্গে জল-চল বন্ধ ক’রে কোণ-ঘেঁষা হয়ে বসেছিল, অল্প অল্প ক’রে তার পঙ্ক্তিভেদ ভেঙে দেওয়া হচ্চে। তার জাত যায়-যায়। উভয় ভাষায় কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে অসবর্ণ বিবাহ হতে শুরু হয়েচে। এখন আমরা চলিত কথায় অনায়াসে বলতে পারি “ম্যালেরিয়ায় কুইনীন ব্যবহার করলে সদ্য ফল পাওয়া যায়।’ পঞ্চাশ বছর আগে লোকের সঙ্গে ব্যাভার ছাড়া ব্যবহার কথাটা অন্য কোনো প্রসঙ্গেই ব্যবহার করতুম না। তখন বলতুম, “ম্যালেরিয়ায় কুইনীনটা খুব খাটে।’ আমার মনে আছে, আমার বাল্যকালে আমাদের একজন চাকরের মুখে “অপেক্ষা’ কথাটা শুনে আমাদের গুরুজনরা খুব হেসেছিলেন। কেননা, কেউ অপেক্ষা করচেন, এ কথাটা তাঁরাও বলতেন না– তাঁরা বলতেন “অমুক লোক তোমার জন্যে বসে আছেন।’ আবার এখানকার লেখার ভাষাতেও এমনি করেই মুখের ভাষার ছাঁদ কেবলি এগিয়ে চলছে। এক ভাষার দুই অঙ্গের মধ্যে অতি বেশি প্রভেদ থাকলে সেই অস্বাভাবিক পার্থক্য মিটিয়ে দেবার জন্যে পরস্পরের মধ্যে কেবলি রফা চলতে থাকে।
এ কথা সত্য ইংরেজিতেও মুখের ভাষায় এবং লেখার ভাষায় একেবারে ষোলো-আনা মিল নেই। কিন্তু মিলটা এতই কাছাকাছি যে পরস্পরের জায়গা অদলবদল করতে হলে মস্ত একটা লাফ দিতে হয় না। কিন্তু বাংলায় চলতি ভাষা আর কেতাবী ভাষা একেবারে এপার ওপার– ইংরেজিতে সেটা ডান হাত বাঁ হাত মাত্র– একটাতে দক্ষতা বেশি আর-একটাতে কিছু কম– উভয়ে একত্র মিলে কাজ করলে বেমানান হয় না। আমি কোনো কোনো বিখ্যাত ইংরেজ লেখকের ডিনার-টেবিলের আলাপ শুনেছি, লিখে নিলে ঠিক তাঁদের বইয়ের ভাষাটাকেই পাওয়া যেত, অতি সামান্যই বদল করতে হত। এই জাতিভেদের অভাবে ভাষার শক্তিবৃদ্ধি হয় আমার তো এই মত। অবশ্য মুখের ব্যবহারে ভাষার যে ভাঙ্চুর অপরিচ্ছন্নতা ঘটা অনিবার্য সেটাও যে লেখার ভাষায় গ্রহণ করতে হবে আমি তা মানি না। ঘরে যে ধুতি পরি সেই ধুতিই সভায় পরা চলে কিন্তু কুঁচিয়ে নিতে একটু যত্নের প্রয়োজন হয়, আর সেটা ময়লা হলে সৌজন্য রক্ষা হয় না। ভাষা সম্বন্ধেও সেই কথা।
আশ্বিন-কার্তিক, ১৩২৬
স্ত্রীলিঙ্গ
ভারতবর্ষের অন্যান্য গৌড়ীয় ভাষায় শব্দগুলি অনেক স্থলে বিনা কারণেই স্ত্রী ও পুরুষ শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়াছে। হিন্দিতে ভোঁ (ভ্রূ), মৃত্যু, আগ (অগ্নি), ধূপ শব্দগুলি স্ত্রীলিঙ্গ। সোনা, রুপা, হীরা, প্রেম, লোভ পুংলিঙ্গ। বাংলা শব্দে এরূপ অকারণ, কাল্পনিক, বা উচ্চারণমূলক স্ত্রী পুরুষ ভেদ নাই। এমন-কি, অনেক সময় স্বাভাবিক স্ত্রীবাচক শব্দও স্ত্রীলিঙ্গসূচক কোনো প্রত্যয় গ্রহণ করে না। সেরূপ স্থলে বিশেষভাবে স্ত্রীজাতীয়ত্ব বুঝাইতে হইলে বিশেষণের প্রয়োজন হয়। কুকুর, বিড়াল, উট, মহিষ প্রভৃতি শব্দগুলি সংস্কৃত শব্দের নিয়মে ব্যবহারকালে লিখিত ভাষায় কুক্কুরী, বিড়ালী, উষ্ট্রী, মহিষী হইয়া থাকে কিন্তু কথিত ভাষায় এরূপ ব্যবহার হাস্যকর।
সাধারণত ই এবং ঈ প্রত্যয় ও নি এবং নী প্রত্যয় যোগে বাংলায় স্ত্রীলিঙ্গপদ নিষ্পন্ন হয়। ই ও ঈ প্রত্যয় : ছোঁড়া ছুঁড়ি, ছোকরা ছুকরি, খুড়া খুড়ি, কাকা কাকি, মামা মামি, পাগলা পাগলি, জেঠা জেঠি জেঠাই, বেটা বেটি, দাদা দিদি, মেসো মাসি, পিসে পিসি, পাঁঠা পাঁঠি, ভেড়া ভেড়ি, ঘোড়া ঘুড়ি, বুড়া বুড়ি, বামন বাম্নি, খোকা খুকি, শ্যালা শ্যালি, অভাগা অভাগী, হতভাগা হতভাগী, বোষ্টম বোষ্টমী, নেড়া নেড়ি।
নি ও নী প্রত্যয় : কলু কলুনি, তেলি তেলিনি, গয়লা গয়লানি, বাঘ বাঘিনি, মালি মালিনী, ধোবা ধোবানি, নাপিত নাপ্তানি (নাপ্তিনি), কামার কামারনি, চামার চামারনি, পুরুত পুরুতনি, মেথর মেথরানি, তাঁতি তাঁতিনি, মজুর মজুরনি, ঠাকুর ঠাকুরানি (ঠাক্রুন), চাকর চাকরানি, হাড়ি হাড়িনি, সাপ সাপিনি, পাগল পাগলিনি, উড়ে উড়েনি, কয়েত কায়েতনি, খোট্টা খোট্টানি, চৌধুরী চৌধুরানী, মোগল মোগলানি, মুসলমান মুসলমাননি, জেলে জেলেনি, রাজপুত রাজপুতনি, বেয়াই বেয়ান।
এই প্রত্যয়যোগের নিয়ম কী তাহা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই কারণ এ প্রত্যয়টি কেবলমাত্র কয়েকটি শব্দেই আবদ্ধ, তাহার বাহিরে প্রয়োজন হইলেও ব্যবহার হয় না। পাঞ্জাবি সম্বন্ধে পাঞ্জাবিনি, মারাঠা সম্বন্ধে মারাঠনি, গুজরাটি সম্বন্ধে গুজরাট্নি প্রয়োগ নাই। উড়েনি আছে কিন্তু শিখ্নি মগ্নি মাদ্রাজিনী নাই।
ময়ূর জাতির স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে দৃশ্যত বিশেষ পার্থক্য থাকাতে ভাষায় ময়ূর ময়ূরী ব্যবহৃত হয় কিন্তু চিল সম্বন্ধে এরূপ ব্যবহার নাই।
পুরুষ মেয়ে, অথবা পুরুষ মানুষ, মেয়ে মানুষ, স্বামী স্ত্রী, ভাই বোন, বাপ মা, ছেলে মেয়ে, মদ্দা মাদী, ষাঁড় গাই, বর কনে, জামাই বউ, (বউ শব্দটি পুত্রবধূ ও স্ত্রী উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়)। সাহেব বিবি বা মেম, কর্তা গিন্নি (গৃহিণী), ভূত পেত্নী প্রভৃতি কয়েকটি শব্দ আছে যাহার স্ত্রীলিঙ্গবাচক ও পুংলিঙ্গবাচক রূপ স্বতন্ত্র।
সংস্কৃত ভাষার মতো বাংলা ভাষায় স্ত্রীলিঙ্গ শব্দের বিশেষণ স্ত্রীলিঙ্গ হয় না। বাংলায় লিখিত বা কথিত ভাষায় সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারকালে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দের বিশেষণে কখনো কখনো স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ব্যবহার হয়– কিন্তু ক্রমশ ভাষা যতই সহজ হইতেছে ততই ইহা কমিয়া আসিতেছে। বিষমা বিপদ, পরমা সম্পদ, বা মধুরা ভাষা পরম পণ্ডিতেও বাংলা ভাষায় ব্যবহার করেন না। বিশেষত বিশেষণ যখন বিশেষ্যের পরে ক্রিয়ার সহিত যুক্ত হয় তখন তাহা বর্তমান বাংলায় কখনোই স্ত্রীলিঙ্গ হয় না– অতিক্রান্তা রজনী বলা যাইতে পারে কিন্তু রজনী অতিক্রান্তা হইল, আজকালকার দিনে কেহই লিখে না।
সংস্কৃত ব্যাকরণের উচ্চারণমতে কতগুলি শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ, সে স্থলে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার-কালে আমরা সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম মানি কিন্তু আধুনিক ভাষায় দেশ সম্বন্ধে তাহা খাটে না। ভারতবর্ষ বা ভারত, সংস্কৃত ভাষায় কখনোই স্ত্রী শ্রেণীয় শব্দ হইতে পারে না, কিন্তু আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে তাহাকে ভারতমাতা বলিয়া অভিহিত করা হয়। বঙ্গও সেইরূপ বঙ্গমাতা। দেশকে মাতৃভাবে চিন্তা করাই প্রচলিত হওয়াতে দেশের নামকে সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে মানা হয় না।
কতকগুলি সংস্কৃত শব্দ বাংলায় স্ত্রী প্রত্যয় গ্রহণকালে সংস্কৃত নিয়ম রক্ষা করে না। যেমন, সিংহিনী (সিংহী), গৃধিনী (গৃধ্রী, গৃধ্র শব্দ সচরাচর ব্যবহৃত হয় না), অধীনী (অধীনা), হংসিনী (হংসী), সুকেশিনী (সুকেশী), মাতঙ্গিনী (মাতঙ্গী), কুরঙ্গিনী (কুরঙ্গী), বিহঙ্গিনী (বিহঙ্গী), ভুজঙ্গিনী (ভুজঙ্গী), হেমাঙ্গিনী (হেমাঙ্গী)।
বিশেষণ শব্দ বাংলায় স্ত্রী প্রত্যয় প্রাপ্ত হয় না কিন্তু বিশেষণপদ বিশেষ্য অর্থ গ্রহণ করিলে এ নিয়ম সর্বত্র খাটে না। খেঁদী, নেকী।
ইয়া প্রত্যয়ান্ত শব্দ স্ত্রীলিঙ্গে ইয়া প্রত্যয় ত্যাগ করিয়া ই প্রত্যয় গ্রহণ করে। ঘর- ভাঙানিয়া (ভাঙানে) ঘরভাঙানী, মনমাতানিয়া মনমাতানী, পাড়াকুঁদুলিয়া পাড়াকুঁদুলি, কীর্তনীয়া কীর্তনী।
হিন্দিতে ক্ষুদ্রতা ও সৌকুমার্য-বোধক ই প্রত্যয়যুক্ত শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ বলিয়া গণ্য হয়– পুং গাড়া, স্ত্রীং গাড়ি, পুং রস্সা, স্ত্রীং রস্সী।
বাংলায় বৃহত্ত্ব অর্থে আ ও ক্ষুদ্রত্ব অর্থে ই প্রত্যয় প্রয়োগ হইয়া থাকে, অন্যান্য গৌড়ীয় ভাষার দৃষ্টান্ত অনুসারে ইহাদিগকে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে।
রসা রসি, দড়া দড়ি, ঘড়া ঘটি, বড়া বড়ি, ঝোলা ঝুলি, নোড়া নুড়ি, গোলা গুলি,হাঁড়া হাঁড়ি, ছোরা ছুরি, ঘুষা ঘুষি, কুপা কুপি, কড়া কড়ি, ঝোড়া ঝুড়ি, কলস কল্সি, জোড়া জুড়ি, ছাতা ছাতি।
কোনো কোনো স্থলে এইপ্রকার রূপান্তরে কেবল ক্ষুদ্রত্ব বৃহত্ত্ব ভেদ বুঝায় না একেবারে দ্রব্যভেদ বুঝায়। যথা, কোঁড়া (বাঁশের) কুঁড়ি (ফুলের), জাঁতা জাঁতি, বাটা (পানের) বাটি।
কিন্তু এ কথা বলা আবশ্যক টা ও টি, গুলা ও গুলি স্ত্রীলিঙ্গ পুংলিঙ্গ উভয় প্রকার শব্দেই ব্যবহৃত হয়। মেয়েগুলো, ছেলেগুলা, বউটা, জামাইটি ইত্যাদি।
অগ্রহায়ণ, ১৩১৮
হরপ্রসাদ সংবর্ধন
… সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বাংলার যত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাক্ তবু বাংলার সাতন্ত্র্য যে সংস্কৃত ব্যাকরণের তলায় চাপা পড়বার নয়, আমি জানি এ মতটি শাস্ত্রীমহাশয়ের। এ কথা শুনতে যত সহজ আসলে তা নয়। ভাষায় বাইরের দিক থেকে চোখে পড়ে শব্দের উপাদান। বলা বাহুল্য বাংলা ভাষার বেশির ভাগ শব্দই সংস্কৃত থেকে পাওয়া। এই শব্দের কোনোটাকে বলি তৎসম, কোনোটাকে তদ্ভব।
ছাপার অক্ষরে বাংলা পড়ে পড়ে একটা কথা ভুলেচি যে সংস্কৃতের তৎসম শব্দ বাংলায় প্রায় নেই বললেই হয়। “অক্ষর” শব্দটাকে তৎসম বলে গণ্য করি ছাপার বইয়ে; অন্য ব্যবহারে নয়। রোমান অক্ষরে “অক্ষর” শব্দের সংস্কৃত চেহারা তযড়বতক্ষত বাংলায় ষযযবতক্ষ। মরাঠী ভাষায় সংস্কৃত শব্দ প্রায় সংস্কৃতেরই মতো, বাংলায় তা নয়। বাংলার নিজের উচ্চারণের ছাঁদ আছে, তার সমস্ত আমদানি শব্দ সেই ছাঁদে সে আপন করে নিয়েছে।
তেমনি তার কাঠামোটাও তার নিজের। এই কাঠামোতেই ভাষার জাত চেনা যায়। এমন উর্দু আছে যার মুখোশটা পারসিক কিন্তু ওর কাঠামোটা বিচার করে দেখলেই বোঝা যায় উর্দু ভারতীয় ভাষা। তেমনি বাংলার স্বকীয় কাঠামোটাকে কি বলব? তাকে গৌড়ীয় বলা যাক্।
কিন্তু ভাষার বিচারের মধ্যে এসে পড়ে আভিজাত্যের অভিমান, সেটা স্বাজাত্যের দরদকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। অব্রাহ্মণ যদি পৈতে নেবার দিকে অত্যন্ত জেদ করতে থাকে তবে বোঝা যায় যে, নিজের জাতের পরে তার নিজের মনেই সম্মানের অভাব আছে। বাংলা ভাষাকে প্রায় সংস্কৃত বলে চালালে তার গলায় পৈতে চড়ানো হয়। দেশজ বলে কারো কারো মনে বাংলার পরে যে অবমাননা আছে সেটাকে সংস্কৃত ব্যাকরণের নামাবলী দিয়ে ঢেকে দেবার চেষ্টা অনেকদিন আমাদের মনে আছে। বালক বয়সে যে ব্যাকরণ পড়েছিলুম তাতে সংস্কৃত-ব্যাকরণের পরিভাষা দিয়ে বাংলা ভাষাকে শোধন করবার প্রবল ইচ্ছা দেখা গেছে; অর্থাৎ এই কথা রটিয়ে দেবার চেষ্টা, যে, ভাষাটা পতিত যদিবা হয় তবু পতিতব্রাহ্মণ, অতএব পতিতের লক্ষণগুলো যতটা পারা যায় চোখের আড়ালে রাখা কর্তব্য। অন্তত পুঁথিপত্রের চালচলনে বাংলাদেশে “মস্ত ভিড়”কে কোথাও যেন কবুল করা না হয় স্বাগত বলে যেন এগিয়ে নিয়ে আসা হয় “মহতী জনতা”কে।
এমনি করে সংস্কৃত ভাষা অনেক কাল ধরে অপ্রতিহত প্রভাবে বাংলা ভাষাকে অপত্য নির্বিশেষে শাসন করবার কাজে লেগেছিলেন। সেই যুগে নর্মাল স্কুলে কোনোমতে ছাত্রবৃত্তি ক্লাসের এক ক্লাস নীচে পর্যন্ত আমার উন্নতি হয়েছিল। বংশে ধনমর্যাদা না থাকলে তাও বোধ হয় ঘটত না। তখন যে-ভাষাকে সাধুভাষা বলা হত অর্থাৎ যে-ভাষা ভুল করে আমাদের মাতৃভাষার পাড়ায় পা দিলে গঙ্গাস্নান না করে ঘরে ঢুকতেন না তাঁর সাধনার জন্যে লোহারাম শিরোরত্নের ব্যাকরণ এবং আদ্যানাথ পণ্ডিতমশায়ের সমাসদর্পণ আমাদের অবলম্বন ছিল। আজকের দিনে শুনে সকলের আশ্চর্য লাগবে যে, দ্বিগু সমাস কাকে বলে সুকুমারমতি বালকের তাও জানা ছিল। তখনকার কালের পাঠ্যগ্রন্থের ভূমিকা দেখলেই জানা যাবে সেকালে বালকমাত্রই সুকুমারমতি ছিল।
ভাষা সম্বন্ধে আর্য পদবীর প্রতি লুব্ধ মানুষ আজও অনেকে আছেন, শুদ্ধির দিকে তাঁদের প্রখর দৃষ্টি– তাই কান সোনা পান চুনের উপরে তাঁরা বহু যত্নে মূর্ধন্য ণ-য়ের ছিটে দিচ্ছেন তার অপভ্রংশতার পাপ যথাসাধ্য ক্ষালন করবার জন্যে। এমন-কি, ফার্সি দরুন শব্দের প্রতিও পতিতপাবনের করুণা দেখি। “গবর্নমেন্টে”র উপর ণত্ব বিধানের জোরে তাঁরা ভগবান পাণিনির আশীর্বাদ টেনে এনেছেন। এঁদের “পরণে” “নরুণ-পেড়ে” ধুতি। ভাইপো “হরেনে”র নামটাকে কোন্ ন-এর উপর শূল চড়াবেন তা নিয়ে দো-মনা আছেন। কানে কুণ্ডলের সোনার বেলায় তাঁরা আর্য কিন্তু কানে মন্ত্র শোনার সময় তাঁরা অন্যমনস্ক। কানপুরে মূর্ধন্য ণ চড়েছে তাও চোখে পড়ল,– অথচ কানাই পাহারা এড়িয়ে গেছে। মহামারী যেমন অনেকগুলোকে মারে অথচ তারি মধ্যে দুটো একটা রক্ষা পায়, তেমনি হঠাৎ অল্পদিনের মধ্যে বাংলায় মূর্ধন্য ণ অনেকখানি সংক্রামক হয়ে উঠেছে। যাঁরা সংস্কৃত ভাষায় নতুন গ্রাজুয়েট এটার উদ্ভব তাঁদেরি থেকে, কিন্তু এর ছোঁয়াচ লাগল ছাপাখানার কম্পোজিটরকেও। দেশে শিশুদের পরে দয়া নেই তাই বানানে অনাবশ্যক জটিলতা বেড়ে চলেছে অথচ তাতে সংস্কৃত ভাষার নিয়মও পীড়িত বাংলার তো কথাই নেই।
প্রাচীন ভারতে প্রাকৃত ভাষার ব্যাকরণ লেখা হয়েছিল। যাঁরা লিখেছিলেন তাঁরা আমাদের চেয়ে সংস্কৃত ভাষা কম জানতেন না। তবু তাঁরা প্রাকৃতকে নিঃসংকোচে প্রাকৃত বলেই মেনে নিয়েছিলেন, লজ্জিত হয়ে থেকে থেকে তার উপরে সংস্কৃত ভাষার পলস্তারা লাগান নি। যে দেশ পাণিনির সেই দেশেই তাঁদের জন্ম, ভাষা সম্বন্ধে তাঁদের মোহমুক্ত স্পষ্টদৃষ্টি ছিল। তাঁরা প্রমাণ করতে চান নি যে ইরাবতী চন্দ্রভাগা শতদ্রু গঙ্গা যমুনা ব্রহ্মপুত্র সমস্তই হিমালয়ের মাথার উপরে জমাট করা বিশুদ্ধ বরফেরই পিণ্ড। যাঁরা যথার্থ পণ্ডিত তাঁরা অনেক সংবাদ রাখেন বলেই যে মান পাবার যোগ্য তা নয় তাঁদের স্পষ্ট দৃষ্টি।