শুধু “হে’ শব্দ আহ্বান অর্থে সাহিত্যেই আছে। মুখের কথায় চলে “ওহে’। কিংবা প্রশ্নের ভাবে : কে হে, কেন হে, কী হে। অনুজ্ঞায় “চলো হে’। মাননীয়দের সম্বন্ধে এই “ওহে’র ব্যবহার নেই। “তুমি’ “তোমার’ সঙ্গেই এর চল, “আপনি’ বা “তুই’ শব্দের সঙ্গে নয়।
“রে’ শব্দ অসম্মানে কিংবা স্নেহপ্রকাশে : হাঁ রে, কেন রে, ওরে বেটা ভূত,ওরে হতভাগা, ওরে সর্বনেশে। এর সম্বন্ধ “তুই’ “তোমা’র সঙ্গে।
“লো’ “লা’ মেয়েদের মুখের সম্বোধন। এও “তুই’ শব্দের যোগে। ভদ্রমহল থেকে ক্রমশ এর চলন গেছে উঠে।
অব্যয় শব্দ আরও অনেক আছে, কিন্তু এইখানেই শেষ করা যাক।
বাংলাভাষা পরিচয় – ২১
২১
ভাষার প্রকৃতির মধ্যে একটা গৃহিণীপনা আছে। নতুন শব্দ বানাবার সময় অনেক স্থলেই একই শব্দে কিছু মালমসলা যোগ ক’রে কিংবা দুটো-তিনটে শব্দ পাশাপাশি আঁট করে দিয়ে তাদের বিশেষ ব্যবহারে লাগিয়ে দেয়, নইলে তার ভাণ্ডারে জায়গা হত না। এই কাজে সংস্কৃত ভাষার নৈপুণ্য অসাধারণ। ব্যবস্থাবন্ধনের নিয়মে তার মতো সতর্কতা দেখা যায় না। বাংলা ভাষায় নিয়মের খবরদারি যথেষ্ট পাকা নয়, কিন্তু সেও কতকগুলো নির্মাণরীতি বানিয়েছে। তার মধ্যে অনেকগুলোকে সমাসের পর্যায়ে ফেলা যায়, যেমন : চটামেজাজ নাকিসুর তোলাউনুন ভোলামন। এগুলো হল বিশেষ্য-বিশেষণের জোড়। বিশেষণগুলোও ক্রিয়াপদকে প্রত্যয়ের শান দিয়ে বসানো। সেও একটা মিতব্যয়িতার কৌশল। বদমেজাজি ভালোমানুষি তিনমহলা, এগারোহাতি (শাড়ি) : এখানে জোড়া শব্দের শেষ অংশীদারের পিঠে ইকারের আকারের ছাপ লাগিয়ে দিয়ে তাকে এক শ্রেণীর বিশেষ্য থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে আর-এক শ্রেণীর বিশেষ্যে। অবশেষে সেই বিশেষ্যের গোড়ার দিকে বিশেষণ যোগ ক’রে তাকে বিশেষত্ব দিয়েছে। অবিকৃত বিশেষ্য-বিশেষণের মিলন ঘটানো হয়েছে সহজেই; তার দৃষ্টান্ত অনাবশ্যক। বিশেষ্যের সঙ্গে বিশেষ্য গেঁথে সংস্কৃত বহুব্রীহি মধ্যপদলোপী কর্মধারয়ের মতো এক-একটা বাক্যাংশকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। যেমন “পুজোবাড়ি’, অর্থাৎ পুজো হচ্ছে যে বাড়িতে সেই বাড়ি। কাঠাকয়লা : কাঠ পুড়িয়ে যে কয়লা হয় সেই কয়লা। হাঁটুজল : হাঁটু পর্যন্ত গভীর যে জল সেই জল। মাটকোঠা : মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছে যে কোঠা। দুই বিশেষণের যোগে যে সমাস তারও গ্রন্থি ছাড়িয়ে দিলে অর্থের ব্যাখ্যা বিস্তৃত হয়ে পড়ে; যেমন : কাঁচামিঠে : কাঁচা তবুও মিষ্টি। বাদশাহি-কুঁড়ে : বাদশার সমতুল্য তার কুঁড়েমি। সেয়ানা-বোকা : লোকটাকে বোকার মতো দেখায় কিন্তু আসলে সেয়ানা। বিশেষ্য এবং ক্রিয়া থেকে বিশেষণ-করা শব্দের যোগ, যেমন : পটলচেরা : অর্থাৎ পটল চিরলে যে গড়ন পাওয়া যায় সেই গড়নের। কাঠঠোকরা : কাঠে যে ঠোকর মারে। চুলচেরা : চুল চিরলে সে যত সূক্ষ্ম হয় তত সূক্ষ্ম।
কিন্তু শব্দরচনায় বাংলা আষার নিজের বিশেষত্ব আছে, তার আলোচনা করা যাক।
বাংলা ভঙ্গীওয়লা ভাষা। ভাবপ্রকাশের এরকম সাহিত্যিক রীতি অন্য কোনো ভাষায় আমার জানা নেই।
অর্থহীন ধ্বনিসমবায়ে শব্দরচনার দিকে এই ভাষায় যে ঝোঁক আছে তার আলোচনা পূর্বেই করেছি। আমাদের বোধশক্তি যে শব্দার্থজালে ধরা দিতে চায় না বাংলা ভাষা তাকে সেই অর্থেই বন্ধন থেকে ছাড়া দিতে কণ্ঠিত হয় নি, আভিধানিক শাসনকে লঙ্ঘন ক’রে সে বোবার প্রকাশ-প্রণালীকেও অঙ্গীকার করে নিয়েছে।
ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলিতে তার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি। পোকা কিল্বিল্ করছে : এ বাক্যের ভাবটা ছবিটা কোনো স্পষ্ট ভাষায় বলা যায় না। “খিট্খিটে’ শব্দের প্রতিশব্দ ইংরেজিতে আছে; irritable, peevish, pettish; কিন্তু “খিট্খিটে’ শব্দের মতো এমন তার জোর নেই। নেশায় চুর্চুর্ হওয়া, কট্মট্ ক’রে তাকানো, ধপাস্ ক’রে পড়া, পা টন্ টন্ করা, গা ম্যাজ্ ম্যাজ্ করা : ঠিক এ-সব শব্দের ভাব বোঝানো ধাতুপ্রত্যয়ওয়ালা ভাষার কর্ম নয়। ইংরেজিতে বলে creeping sensation, বাংলায় বলে “গা ছম্ছম্ করা’; আমার তো মনে হয় বাংলারই জিত। গুটিকয়েক রঙের বোধকে ধ্বনি দিয়ে প্রকাশ করায় বাংলা ভাষার একটা আকুতি দেখতে পাওয়া যায় : টুক্টুকে টক্টকে দগ্দগে লাল, ধব্ধবে ফ্যাক্ফেকে ফ্যাট্ফেটে সাদা, মিস্মিসে কুচকুচে কালো।
বাংলায় শব্দের দ্বিত্ব ঘটিয়ে যে ভাবপ্রকাশের রীতি আছে সেও একটা ইশারার ভঙ্গী, যেমন : টাটকা-টাটকা গরম-গরম শীত-শীত মেঘ-মেঘ জ্বর-জ্বর যাব-যাব উঠি-উঠি। অর্থের অসংগতি, অত্যুক্তি, রূপক-ব্যবহার, তাতেও প্রকাশ হয় ভঙ্গীর চাঞ্চল্য; অন্য ভাষাতেও আছে, কিন্তু বাংলায় আছে প্রচুর পরিমাণে।
আকাশ থেকে পড়া, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া, হাড় কালী করে দেওয়া, পিটিয়ে লম্বা করা, তেসে দেওয়া, গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ানো, নাকে তেল দিয়ে ঘুমোনো, তেলে বেগুনে জ্বলা, পিত্তি জ্বলে যাওয়া, হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি, ঘেন্না পিত্তি, বুদ্ধির ঢেঁকি, পাড়া মাথায় করা, তুলো ধুনে দেওয়া, ঘোল খাইয়ে দেওয়া, হেসে কুরুক্ষেত্র, হাসতে হাসতে পেটের নাড়ি ছেঁড়া, কিল খেয়ে কিল চুরি, আদায় কাঁচকলায় আহ্লাদে আটখানা : এমন বিস্তর আছে।
বাংলায় অনেক জোড়া শব্দ আছে যার এক অংশে অর্থ, অন্য অংশে নিরর্থকতা। তাতে করে অর্থের চারি দিকে একটা ঝাপসা পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা হয়েছে; সেই জায়গাটাতে যা তা কল্পনা করবার উপায় থাকে।