ইংরেজিতে সাধারণ ব্যবহারের ক্রিয়াপদ অনুজ্ঞায় প্রায়ই এক মাত্রার হয়, যেমন, run stop cut beat shoot march hold throw। যেখানে যুগ্ম ক্রিয়াপদ ব্যবহার হয় সেখানে এক মাত্রার দুটি শব্দ জোড়া লাগে, যেমন : come in, go out, cut down, stand up, run on ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এইরূপ সংক্ষিপ্ত শব্দে আজ্ঞার জোর পৌঁছয়। স্কাউটের বা ফৌজের কুচকাওয়াজে ইংরেজিতে যে-সব আদেশবাক্য আছে এই কারণে সেগুলো জোরালো হয়। যে-সকল শব্দ ব্যঞ্জনবর্ণে শেষ হয় তারা ধাক্কা দেয় জোরে। stand upশব্দ উভয়ে মিলে দুই মাত্রার বটে কিন্তু তাতে দুই ব্যঞ্জনবর্ণের দুটো ঠোকর আছে।
“দাঁড়াও’ শব্দটাও দুই মাত্রার, কিন্তু তার আগাগোড়া স্বরবর্ণ, তাদের স্পর্শ মোলায়েম। কথাটা ধাঁ করে ছোটে না।
“তুই’ “তোরা’ বর্গের অনুজ্ঞায় এই দুর্বলতা নেই! বোস্ ওঠ্ ছোট্ থাম্ কাট্ মার্ ধর্ খেল্ : এগুলি দৌড়দার শব্দ। আদিকালে ভাষায় “তু’ “তুই’ ছিল একমাত্র মধ্যম-পুরুষের সর্বনাম শব্দ। সেটা যদি চলে আসত তা হলে ক্রিয়াপদকে স্বরবর্ণ এমন নরম করে রাখত না, হসন্ত ব্যঞ্জনবর্ণে তাকে তীক্ষ্ণতা দিত। “করো’ হ’ত “কর্’। “কোরো’ হ’ত “করিস’। “দাঁড়া’ শব্দ যদিও স্বরবর্ণ বহন করে তবু “দাঁড়াও’ শব্দের চেয়ে তার মধ্যে প্রভুশক্তি বেশি। “ঘুমো’ আর “ঘুমোও’ তুলনা করলে অনুজ্ঞার দিক থেকে প্রথমোক্তটির প্রবলতা মানতে হয়।
চলতি বাংলা ভঙ্গীপ্রধান ভাষা, তার একটা লক্ষণ ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞায় অসংগত ভাবে “না’ শব্দের ব্যবহার। এর কাজ হচ্ছে আদেশ বা অনুরোধকে অনুনয়ে নরম করে আনা।
“হোক না’ “করোই না’ ক্রিয়াপদে “না’ শব্দে নির্বন্ধ প্রকাশ পায়, কোনো-এক পক্ষের অনিচ্ছাকে যেন ঠেলে দেওয়া। “না’ শব্দের দ্বারা “হাঁ’ প্রকাশ করা আর প্রথমপুরুষ-বাচক “আপনি’কে মধ্যমপুরুষের অর্থে ব্যবহার একই মনস্তত্ত্বমূলক। যিনি উপস্থিত আছেন যেন তিনি উপস্থিত নেই, তাঁর সঙ্গে মোকাবিলায় কথা বলার স্পর্ধা বক্তার পক্ষে সম্ভব নয়, এই ভাণের দ্বারাই তাঁর উপস্থিতির মূল্য যায় বেড়ে। তেমনি অনুরোধ জানানোর পরক্ষণেই “না’ বলে তার প্রতিবাদ ক’রে অনুরোধের মধ্যে সম্মানের কাকুতি এনে দেওয়া হয়। “না’ শব্দের ক্রিয়াপদের রূপ বাংলা ভাষার আর-একটি বিশেষত্ব, যথা : আমি নই, তুমি নও, সে নয়, তিনি নন, আমি নেই, তুমি নেই, সে নেই, তিনি নেই; হই নে, হও না, হয় না, হন না, হয় নি, হন নি।
বাংলা ক্রিয়াপদে নানারকম শব্দ-যোজনায় নানারকম ভঙ্গী। তার কতকগুলি সার্থক, কতকগুলি নিরর্থক। ক্রিয়াপদে এতরকম ইশারা বোধ হয় আর-কোনো ভাষায় নেই।
পড়ল বা, করলে বা, শব্দে আশঙ্কার সূচনা। কোনো ক্রিয়াবিশেষণ-যোগে এর ভাবটা প্রকাশ হতে পারত না।
এতে যদি ইকার যোগ করা যায় তাতে আর-একরকম ভঙ্গী এসে পড়ে। হলই বা, করলই বা : এর ভঙ্গীতে সুরের বৈচিত্র্য অনুসারে ক্ষমাও বোঝাতে পারে, স্পর্ধাও বোঝাতে পারে, উপেক্ষাও বোঝাতে পারে।
হল বুঝি, করল বুঝি, হল ব’লে, করল ব’লে : আসন্ন অপ্রিয়তার আশঙ্কা।
হল যে, করল যে : উদ্বেগ।
হল তো, করলে তো : অপ্রত্যাশিতের সম্বন্ধে বিস্ময়।
আবার ওকেই প্রশ্নের সুরে বদলিয়ে যদি বলা হয় “হল তো?’ তা হলে জানানো হয় : এখন তো আর কোনো নালিশ রইল না?
হোক না, করুক না, হোক্গে, করুক্গে, মরুক্গে : ঔদাসীন্য।
হলই বা, করলই বা, নাই বা হল, নাহয় হল : স্পর্ধার ভাষা।
হবে বা, হবেও বা : দ্বিধা এবং স্বীকার মিশিয়ে।
হবেই হবে, করবেই করবে : সুনিশ্চিত প্রত্যাশা।
করতেই হবে, হতেই হবে, করাই চাই, হওয়াই চাই : ইচ্ছার জোর প্রয়োগ।
হলেই হল : অর্থাৎ হয় যদি তবে আর-কোনো তর্কের দরকার নেই।
হোকগে ছাই, মরুকগে ছাই : প্রবল ঔদাস্য।
বাংলাভাষা পরিচয় – ২০
২০
অব্যয়। বাংলা ভাষায় প্রশ্নসূচক অব্যয় সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচনা করেছি।
প্রশ্নসূচক কি শব্দের অনুরূপ আর-একটি “কি’ আছে, তাকে দীর্ঘস্বর দিয়ে লেখাই কর্তব্য। এ অব্যয় নয়, এ সর্বনাম। এ তার প্রকৃত অর্থের প্রয়োজন সেরে মাঝে মাঝে খোঁচা দেবার কাজে লাগে, যেমন : কী তোমার ছিরি, কী-যে তোমার বুদ্ধি।
তিনটি আছে যোজক অব্যয় শব্দ : এবং আর ও। “এবং’ সংস্কৃত শব্দ। এর প্রকৃত অর্থ “এইমতো’। ইংরেজি The king marches with his elephants, horses and soldiers। The room is full of chairs, tables, clothes-racks and almirahs.
বাংলায় যদি বলি “রাস্তা দিয়ে চলেছে হাতি আর ঘোড়া’, তা হলে বোঝাবে বিশেষ করে ওরাই চলেছে।
“আর’ শব্দের আরও কয়েকটি কাজ আছে, যেমন : আর কত খাবে : অর্থাৎ অতিরিক্ত আরও কত খাবে। আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না : অর্থাৎ পুনশ্চ দেখা হবে না।
তোমাকে আর চালাকি করতে হবে না : এ একটা ভঙ্গীওয়ালা কথা। এই শব্দ থেকে “আর’ শব্দটা বাদ দিলেও চলে, কিন্তু তাতে ঝাঁজ মরে যায়।
সাহিত্যে “ও’ শব্দটা “এবং’ শব্দের সমান পর্যায়ে চলেছে। কিন্তু চলতি ভাষায় “ও’ সংস্কৃত “চ’এর মতো, যথা : আমি যাচ্ছি তুমিও যাবে, অ্যাঙ যায় ব্যাঙ যায় খল্সে বলে আমিও যাব।
এক কালে এই “ও’ ছিল “হ’ রূপে, যেমন : সেহ, এহ বাহ্য, এহ তো মানুষ নয়। এই “হ’ অবিকৃত রূপে বাকি আছে সাধু ভাষায় “কেহ’ শব্দে। চলতি ভাষায় “কেও’ থেকে ক্রমে “কেউ’ হয়েছে। পুরাতন সাহিত্যে “কেহু’ পাওয়া যায়, “তেঁহ শব্দটা আজ হয়েছে “তিনি’। “ওহ’ নেই কিন্তু সাধু ভাষায় “উহা’ আছে। “যেহ’ নেই, আছে “যাহা’। এই শেষ দুটি বিশেষণ অপ্রাণী সম্পর্কে।