করণকারকে “ক’রে শব্দ অধিকরণরূপের সঙ্গে যুক্ত হয় : গ্লাসে ক’রে জল খাও, তুলিতে ক’রে আঁকো।
করণকারকে “দিয়ে’ আর “ক’রে’ শব্দে পার্থক্য আছে। “পাল্কিতে ক’রে’ যাওয়া চলে, “পাল্কি দিয়ে’ চলে না। খাবার বেলায় বলি “হাতে ক’রে খাও’; নেবার বেলায় বলি “হাত দিয়ে নাও’। একটাতে হাত হচ্ছে উপায়, আর-একটাতে হাত হচ্ছে আধার। পাল্কিতে “ক’রে’ মানুষ যায়, কিন্তু যায় পথ “দিয়ে’। এখানে পাল্কি উপায়, পথ আধার। কিন্তু অর্থহিসাবে বিকল্পে হাত উপায়ও হতে পারে, আধারও হতে পারে। তাই “হাত দিয়ে খাও’ বলাও চলে, “হাতে ক’রে খাও’ বলতেও দোষ নেই।
ব’লে থাকি : বড়ো রাস্তা দিয়ে যখন যাবে গাড়িতে ক’রে যেয়ো। কোনো সাহেব যদি বলে “রাস্তায় ক’রে যাবার সময় গাড়ি দিয়ে যেয়ো’, বুঝব সে বাঙালি নয়। লোক “দিয়ে’ পাঠাব চিঠি, লোকটা উপায়; ব্যাগে “ক’রে’ সে চিঠি নেবে, ব্যাগটা আধার।
বাংলাভাষা পরিচয় – ১৭
১৭
“হতে’ আর “থেকে’ এই দুটো শব্দ বাংলা অপাদানের সম্বল। প্রাচীন হিন্দিতে “হতে’ শব্দের জুড়ি পাওয়া যায় “হুন্তো’, নেপালিতে “ভন্দা’, সংস্কৃত “ভবন্ত’। প্রাচীন রামায়ণে দেখেছি : ঘরে হনে, ভূমি হনে।
অপভ্রংশ প্রাকৃতের অপাদানে পাওয়া যায় : হোংতও হোংতউ। “থেকে’ শব্দটার ধ্বনিসাদৃশ্য পাওয়া যায় নেপালিতে, যেমন : “তাঁহা দেখি = সেখান থেকে, মাঝ দেখি = মাঝ থেকে।’ গুজরাটিতে আছে “থকি’। বাংলায় অপাদানে একটা গ্রাম্য প্রয়োগ আছে “ঠেঞে’ (ঠাঁই হতে), যথা : তোমার ঠেঞে কিছু আদায় করতে হবে।
একদা পালি ব্যাকরণে পেয়েছিলুম “অজ্জতগ্গে’ শব্দ। এর সংস্কৃত মূল “অদ্যতঃ অগ্রে’; “আজ থেকে’ শব্দের সঙ্গে এর ধ্বনি ও অর্থের মিল আছে। জানি নে পণ্ডিতদের কাছে এ ইঙ্গিত গ্রাহ্য হবে কি না।
এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। “পশুর থেকে মানুষের উৎপত্তি’ এ কথা বলা চলে। কিন্তু “মানুষ থেকে গন্ধ বেরচ্ছে’ বলি নে, বলি “মানুষের গা থেকে’ কিংবা “কাপড় থেকে’। “বিপিন থেকে টাকা পেয়েছি’ বলা চলে না, বলতে হয় “বিপিনের কাছ থেকে টাকা পেয়েছি’। এর কারণ, অচেতন পদার্থের নামের সঙ্গেই “থেকে’ শব্দের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ। তাই “মেঘ থেকে’ বৃষ্টি নামে, “পাখি থেকে’ গান ওঠে না, “পাখির কণ্ঠ থেকে’ গান ওঠে।
কেবল “থেকে’ নয়, “হতে’ শব্দ-প্রয়োগেও ঐ একই কথা। “অযোধ্যা হতে’ রাম নির্বাসিত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন “রাবণের কাছ হতে’।
তুলনামুলক অর্থেও ব্যবহৃত হয় : হতে থাকে চেয়ে চাইতে।
অন্য প্রসঙ্গে সম্বন্ধপদের আলোচনা হয়ে গেছে। এক কালে বহুবচনে সম্বন্ধপদের “দিগের’ শব্দের পূর্বেও সম্বন্ধের আর-একটা বিভক্তি থাকত, যেমন “আমারদিগের’।
বাংলা সম্বন্ধপদের একটা প্রত্যয় আছে “কার’। এর ব্যবহার সার্বত্রিক নয়। সময়-বাচক ক্রিয়াবিশেষণে “এখন’ “তখন’ “যখন’ “কখন’এর সঙ্গে “কার’ জোড়া হয়। বিশেষ কোনো “বেলাকার’ “দিনকার’ “রাতকার’ও চলে। “আজ’ এবং “কাল’ শব্দে কর্মকারকের বিভক্তির সঙ্গে যোগ ক’রে ওর ব্যবহার : আজকেকার কালকেকার। “পশুLl’, অমুক “হপ্তাকার’ বা “বছরকার’ হয়, কিন্তু অমুক “মাসকার’ কিংবা অমুক “ঘণ্টাকার’ হয় না। “সকলকার’ হয়, “সমস্তকার’ হয় না। “সত্যকার’ হয়, “মিথ্যাকার’ হয় না। ভিতরকার বাহিরকার উপরকার নিচেকার এদিককার ওদিককার এধারকার ওধারকার– চলে। ব্যক্তি বা বস্তুবাচক শব্দ সম্পর্কে এর ব্যবহার নেই। “জন’ শব্দ যোগে সংখ্যাবাচক শব্দে “কার’ প্রয়োগ হয় : একজনকার দুজনকার। কিন্তু “জন’ ছাড়া মনুষ্যবাচক আর-কোনো শব্দের সঙ্গে ওর যোগ নেই। “ইংরেজকার’ বলা চলে না।
বাংলাভাষা পরিচয় – ১৮
১৮
হওয়া থাকা আর করা, এই তিন অবস্থাকে প্রকাশ করে ক্রিয়াপদে। আমি ধনী, তুমি পণ্ডিত– এ কথা ইংরেজিতে বলতে গেলে এর সঙ্গে “হওয়া’ ক্রিয়াপদ যোগ করতে হয়, বাংলায় সেটা ঊহ্য থাকে। “রাস্তাটা সোজা’, “পুকুরটা গভীর’, যখন বলি তখন সেটাতে তার নিত্য অবস্থা জানায়। কিন্তু “বর্ষায় পুকুর ঘোলা হয়েছে’ এটা আকস্মিক অবস্থা, তাই হওয়ার কথাটা তুলতে হয়। ওর লোভ হয়েছে, মনে হচ্ছে ওর জ্বর হবে– বাক্যগুলিও এইরকম।
সাবেক বাংলায় বিশেষ্য বা সর্বনাম শব্দ-সহযোগে ইংরেজি is ও are-এর অনুরূপ প্রয়োগ পাওয়া যায় : তুমি কে বটো, সে কে বটে, আমি রাজার ঝিয়ারি বটি। অচেতনবাচক শব্দেও চলত, যেমন : ঐ গাছটা কী বটে, এই নদী গঙ্গাই বটে। “বটে’ শব্দটা এখনো ভাষায় আছে, বিশেষ ঝোঁক দেবার জন্যে, যেমন : লোকটা ধনী বটে। আবার ভঙ্গীর কাজেও লাগে, যেমন : বটে, চালাকি পেয়েছ! “বটে’র সঙ্গে “কিন্তু’র যোগ হলে ভঙ্গীটা আরও জমে, যেমন : উনি সর্দারি করেন বটে কিন্তু টের পাবেন। ইংরেজিতে স্বভাব বা অবস্থা বোঝাতে isবা are ব্যতীত বিশেষ্যের গতি নেই, বাংলায় না নয়। ইংরেজিতে বলাই চাই এন ভড় রতলন, কিন্তু বাংলায় যদি বলি “সে খোঁড়া বটে’ তা হলে হয় বোঝাবে, তার খোঁড়া অবস্থাটা একটা বিশেষ আবিষ্কার, নয় ওর সঙ্গে একটা অসংগত ব্যাপারের যোগ আছে। যেমন : ও খোঁড়া বটে কিন্তু দৌড়য় খুব। কিংবা সন্দেহের বিদ্রূপ প্রকাশ করে : তুমি খোঁড়া বটে! অর্থাৎ, খোঁড়া নও যে তা প্রমাণ করতে পারি।
বাংলায় থাকার কথাটা যখন জানাই তখন বলি– আছি বা আছে, ছিলে ছিল বা ছিলুম। “আছিল’ শব্দেরই সংক্ষেপ “ছিল’। কিন্তু ভবিষ্যতের বেলায় হয় “থাকব’। বাংলায় ক্রিয়াপদের রূপ প্রধানত এই থাকার ভাবকে আশ্রয় করে। করেছে করছে করেছিল করছিল– শব্দগুলো “আছি’ ক্রিয়াপদেক ভিত্তি ক’রে স্থিতির অর্থকেই মুখ্য করেছে। সংস্কৃত ভাষায় এটা নেই, গৌড়ীয় ভাষায় আছে। হিন্দিতে বলে “চলা থা’, চলেছিল। কাজটা যদিও চলা, তবু থা শব্দে বলা হচ্ছে, চলার অবস্থাতে স্থিতি করেছিল। গতিটা যেন স্থিতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত।