“কি’ যেখানে অব্যয় সেখানে প্রশ্নের সংকেত। ঊহ্য বিশেষ্যের সহযোগে বিশেষণে ওর প্রয়োগ আছে। তুমি কী করছ : অর্থাৎ “কী কাজ’ করছ। আর-একটা প্রয়োগ বিস্ময় বোঝাতে, যেমন : কী সুন্দর। পূর্বেই বলেছি তীক্ষ্ণধার স্বরবর্ণ ই সঙ্গে না থাকলে এর সৌজন্য বজায় থাকে। বিশেষণ-প্রয়োগে “কী’, যথা : কী কাজে লাগবে জানি নে। “কী’ বিশেষণ শব্দে অচেতন বা নির্বস্তুক বা অনির্দিষ্ট বোঝায় : ওর কী দশা হবে, কী হ’তে কী হল। বিকল্প বোঝাতে ওর প্রয়োগ আছে, যেমন : কী রাম কী শ্যাম কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না। “কোন্’ বিশেষণ জড় চেতন দুইয়েই লাগে।
সর্বনামের কর্মকারকে সাধারণত কে বিভক্তি : আমাকে তোমাকে। “সে’র বেলায় “তাকে’ কিংবা “সেটিকে’ “সেটাকে’।
বাংলা সর্বনাম করণকারকে একটা বিভক্তির উপরে আর-একটি চিহ্ন জোড়া হয়। বিভক্তিটা সম্বন্ধপদের, যেমন “আমার’, ওতে জোড়া হয় “দ্বারা’ শব্দ : আমার দ্বারা। আর-একটা শব্দচিহ্ন আছে “দিয়ে’। তার বেলায় মূলশব্দে লাগে কর্মকারকের বিভক্তি : আমাকে দিয়ে।
“কী’ শব্দের কারণকারকের রূপ : কিসে, কিসে ক’রে, কী দিয়ে, কিসের দ্বারা। অধিকরণণেরও রূপ “কিসে’, যথা : এ লেখাটা কিসে আছে। এ-সমস্তই একবচনের ও অজীববাচকের দৃষ্টান্ত, এরা বহুবচনে হবে : এগুলোকে দিয়ে, সেগুলোকে দিয়ে, কোন্গুলোকে দিয়ে। অসম্মানে মানুষের বেলা হয়, নচেৎ হয় : এদের দিয়ে, তাদের দিয়ে, ওদের দিয়ে।
সাধারণত বাংলায় বিশেষণপদের বহুবচনরূপ নেই। ওদের অধিকৃত বিশেষ্য শব্দগুলিতে বহুবচনের ব্যবস্থা করতে হয়, যথা : বুনো পশুদের, পিতলের ঘটিগুলোর। বলা বাহুল্য “ঘটিদের’ হয় না, “পশুদের’ হয়। রা এবং দের বিভক্তি জড়বাচক শব্দের অধিকারে নেই। তার পক্ষে গুলো শব্দই বৈধ। অথচ গুলো অপর পক্ষের ব্যবহারেও লাগে। কিন্তু পরিমাণবাচক “এত’ “তত’ “যত’ “কত’ বিশেষণের সঙ্গে বহুবচন-বিভক্তি গুলো যুক্ত হয়। তা ছাড়া “এ” “সে’ “যে” “ও’ “ঐ’ “সেই’ “কোন্’ শব্দের সঙ্গে বহুবচনে কর্তৃপদে গুলো ও কর্মকারকে বা সম্বন্ধে দের যোগ করা হয়।
বাংলা সর্বনামশব্দ-প্রয়োগে একটা খটকার জায়গা আছে।
“আমাকে তোমাকে খাওয়াতে হবে’ এমন কথা শোনা যায়। কে কাকে খাওয়াবে তর্কটা পরিষ্কার হয় না। এমন স্থলে যিনি খাওয়াবার কর্তা তাঁকে সম্বন্ধ-আসনে বসালে কথাটা পাকা হয়। আর সেটা যদি ক্রিয়াপদের পূর্বেই থাকে তা হলে দ্বিধা মেটে। “আমাকে তোমার খাওয়াতে হবে’ বাক্যটা স্পষ্ট। গোল বাধে বহুবচনের বেলায়। কেননা বহুবচনে সম্বন্ধপদের দের আর কর্মকারকের দের একই চেহারার। এর একমাত্র উপায় কে বিভক্তি দ্বারা কর্মকারককে নিঃসংশয় করা। “আমাদেরকে তোমাদের খাওয়াতে হবে’ বললে নিশ্চিন্ত মনে নিমন্ত্রণে যাওয়া যায়। সম্বন্ধকারকের চিহ্নে কর্মকারকের কাজ চালিয়ে নেওয়া ভাষার অমার্জনীয় ঢিলেমি।
বাংলাভাষা পরিচয় – ১৫
১৫
বাংলায় নির্দেশকশব্দরূপে প্রধানত ব্যবহৃত হয় : টি টা খানি খানা। ইংরেজিতে এর প্রতিরূপ the। ইংরেজিতে the বসে শব্দের পূর্বে, বাংলায় নির্দেশক শব্দ বসে শব্দের পরে, বস্তুবাচক বা জীববাচক শব্দের অনুষঙ্গে। যা বস্তু বা জীব-বাচক নয় স্থানবিশেষে তার সঙ্গেও যোগ হয়, যেমন : বেশি লজ্জাটা ভালো নয়, ওর হাসিটা বড়ো মিষ্টি। এখানে লজ্জা ও হাসিকে বস্তুর মতোই কল্পনা করে নেওয়া হয়েছে।
এক দুই তিন শব্দ সংখ্যাবাচক। ওদের সঙ্গে প্রায় নিত্যযোগ টি ও টা’র। ইংরেজিতে এ দস্তুর নেই। বাংলায় সংখ্যাবাচক শব্দ যখন সমাসে বাঁধা পড়ে তখন তাদের টি টা পড়ে খ’সে, যেমন : দশসের আটহাত পাঁচমিশলি। তা ছাড়া “জন’ শব্দের সংযোগে টি টা চলে না। “একটি জন’ বলি নে, “একটি মানুষ’ বলেই থাকি।
আরও কয়েকটি নির্দেশক শব্দ আছে, যেমন : টু টুক্ টুকু গোছা গাছি। তেল জল ধুলো কাদা প্রভৃতি অনির্দিষ্ট-আকার-বাচক শব্দে সংখ্যাবাচক শব্দের ব্যবহার চলে না। “একটা তেল’ “একটি ধুলো’ বলি নে, কিন্তু “একটু তেল’ “একটু ধুলো’ বলেই থাকি। “অনেকটা জল’ “অনেকটা ময়দা’ বলে থাকি কিন্তু “অনেকটি’ মাটি বা দুধ বলা চলে না। কেননা টা শব্দে ব্যাপকতা বোঝায়, টি শব্দে বোঝায় খণ্ডতা।
টু টুক্ টুকু : স্বল্পতাসূচক। সজীব পদার্থে এর ব্যবহার নেই। ছোটো গাধার বাচ্ছাকেও কেউ “গাধাটুকু’ বলবে না, পরিহাস ক’রে “মানুষটুকু’ বলা চলে।
সরু লম্বা জিনিসের সঙ্গে “গাছি’ “গাছা’র ব্যবহার : দড়িগাছা বেতগাছা হারগাছা। দুই-একটা ব্যতিক্রম থাকতে পারে, যেমন “চুড়িগাছি’। লম্বায়-ছোটো জিনিসে চলে না; “গোঁফগাছি’ কিছুতেই নয়। টুকু চলে ছোটো জিনিসে, কিন্তু গড়নওয়ালা জিনিসে নয়। “চুনটুকু’ হয়, “পদ্মটুকু’ হয় না; “আংটিটুকু’ হয় না, “পশমটুকু’ হয়। সন্নাসীঠাকুরের “রাগটুকু’ প্রভৃতি অবস্তুবাচক শব্দেও চলে। “একটুক’ হয়, কিন্তু “দুটুকু’ তিনটুকু’ হয় না। “ঐটুক্’ শব্দের সঙ্গে “খানি’ জোড়া যায়, “খানা’ যায় না; “একটুখানি’, কিন্তু “একটুখানা ‘ নয়। জীববাচক শব্দে খাটে না; “একটুক জীব’ নেই কোথাও।
আরও কয়েকটি নির্দেশক পদ আছে যা শব্দের পূর্বে বসে। তারা সর্বনাম জাতের, যেমন : সেই এই ঐ।
বাংলাভাষা পরিচয় – ১৬
১৬
বাংলা বিশেষ্যশব্দে সংস্কৃত বিশেষ্যশব্দের অনুস্বার বিসর্গ না থাকাতে কর্তৃকারকে চিহ্নের কোনো উৎপাত নেই। একেবারে নেই বলাও চলে না। কর্তৃপদে মাঝে মাঝে একারের সংকেত দেখা যায়, যেমন : পাগলে কী না বলে।