সাধু ভাষার সঙ্গে চলতি ভাষার প্রধান প্রভেদ ক্রিয়াপদের চেহারায়। যেমন সাধু ভাষার “করিতেছি’ হয়েছে চলতি ভাষায় “করছি’।
এরও মূল কথাটা হচ্ছে আমাদের ভাষাটা হসন্তবর্ণের শক্ত মুঠোয় আঁটবাঁধা। “করিতেছি’ এলানো শব্দ, পিণ্ড পাকিয়ে হয়েছে “করছি’।
এই ভাষার একটা অভ্যেস দেখা যায়, তিন বা ততোধিক অক্ষরব্যাপী শব্দের দ্বিতীয় বর্ণে হসন্ত লাগিয়ে শেষ অক্ষরে একটা স্বরবর্ণ জুড়ে শব্দটাকে তাল পাকিয়ে দেওয়া। যথা ক্রিয়াপদে : ছিট্কে পড়া, কাৎরে ওঠা, বাৎলে দেওয়া, সাঁৎরে যাওয়া, হন্হনিয়ে চলা, বদ্লিয়ে দেওয়া, বিগ্ড়িয়ে যাওয়া।
বিশেষ্যপদে : কাৎলা ভেট্কি কাঁক্ড়া শাম্লা ন্যাক্ড়া চাম্চে নিম্কি চিম্টে টুক্রি কুন্কে আধ্লা কাঁচ্কলা সক্ড়ি দেশ্লাই চাম্ড়া মাট্কোঠা পাগ্লা পল্তা চাল্তে গাম্লা আম্লা।
বিশেষণ, যেমন : পুঁচ্কে বোট্কা আল্গা ছুট্কো হাল্কা বিধ্কুটে পাৎলা ডান্পিটে শুট্কো পান্সা চিম্সে।
এই হসন্তবর্ণের প্রভাবে আমাদের চলতি ভাষায় যুক্তবর্ণের ধ্বনিরই প্রাধান্য ঘটেছে।
আরও গোড়ায় গেলে দেখতে পাই, এটা ঘটতে পেরেছে অকারের প্রতি ভাষার উপেক্ষাবশত।
সংস্কৃত ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে বাংলা উচ্চারণ মিলিয়ে দেখলে প্রথমেই কানে ঠেকে অ স্বরবর্ণ নিয়ে। সংস্কৃত আ স্বরের হ্রস্বরূপ সংস্কৃত অ। বাংলায় এই হ্রস্ব আ অর্থাৎ অ আমাদের উচ্চারণে আ নাম নিয়েই আছে। যেমন : চালা কাঁচা রাজা। এ-সব আ এক মাত্রার চেয়ে প্রশস্ত নয়। সংস্কৃত আ’কারযুক্ত শব্দ আমরা হ্রস্বমাত্রাতেই উচ্চারণ করি, যেমন “কামনা’।
বাংলা বর্ণমালার অ সংস্কৃত স্বরবর্ণের কোঠায় নেই। ইংরেজি starশব্দের aসংস্কৃত আ, ইংরেজি stir শব্দের iসংস্কৃত অ। ইংরেজি ball শব্দের a বাংলা অ। বাংলায় “অল্পসল্প’র বানান যাই হোক, ওর চারটে বর্ণেই সংস্কৃত অ নেই। হিন্দিতে সংস্কৃত অ আছে, বাংলা অ নেই। এই নিয়েই হিন্দুস্থানি ওস্তাদের বাঙালি শাকরেদরা উচ্চ অঙ্গের সংগীতে বাংলা ভাষাকে অস্পৃশ্য বলে গণ্য করেন।
বাংলা অ যদিও বাংলাভাষার বিশেষ সম্পত্তি তবু এ ভাষায় তার অধিকার খুবই সংকীণ। শব্দের আরম্ভে যখন সে স্থান পায় তখনি সে টিঁকে থাকতে পারে। “কলম’ শব্দের প্রথম বর্ণে অ আছে, দ্বিতীয় বর্ণে সে “ও’ হয়ে গেছে, তৃতীয় বর্ণে সে একেবারে লুপ্ত। ঐ আদিবর্ণের মর্যাদা যদি সে অব্যাঘাতে পেত তা হলেও চলত, কিন্তু পদে পদে আক্রমণ সইতে হয়, আর তখনি পরাস্ত হয়ে থাকে। “কলম’ যেই হল “কল্মি’, অমনি প্রথম বর্ণের আকার বিগড়িয়ে হল ও। শব্দের প্রথমস্থিত অকারের এই ক্ষতি বারে বার নানা রূপেই ঘটছে, যথা : মন বন ধন্য যক্ষ হরি মধু মসৃণ। এই শব্দগুলিতে আদ্য অকার “ও’ স্বরকে জয়গা ছেড়ে দিয়েছে। দেখা গেছে, ন বর্ণের পূর্বে তার এই দুর্গতি, ক্ষ বা ঋ ফলার পূর্বেও তাই। তা ছাড়া দুটি স্বরবর্ণ আছে ওর শত্রু, ই আর উ। তারা পিছনে থেকে ঐ আদ্য অ’কে করে দেয় ও, যেমন : গতি ফণী বধূ যদু। য ফলার পূর্বেও অকারের এই দশা, যেমন : কল্য মদ্য পণ্য বন্য। যদি বলা যায় এইটেই স্বাভাবিক তা হলে আবার বলতে হয়, এ স্বভাবটা সর্বজনীন নয়। পূর্ববঙ্গের রসনায় অকারের এ বিপদ ঘটে না। তা হলেই দেখা যাচ্ছে, অকারকে বাংলা বর্ণমালায় স্বীকার করে নিয়ে পদে পদে তাকে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে বাংলাদেশের বিশেষ অংশে। শব্দের শেষে হসন্ত তাকে খেদিয়েছে, শব্দের আরম্ভে সে কেবলই তাড়া খেতে থাকে। শব্দের মাঝখানেও অকারের মুখোষ প’রে ওকারের একাধিপত্য, যথা : খড়ম বালক আদর বাঁদর কিরণ টোপর চাকর বাসন বাদল বছর শিকড় আসল মঙ্গল সহজ। বিপদে ওর একমাত্র রক্ষা সংস্কৃত ভাষার করক্ষেপে, যেমন : অ-মল বি-জন নী-রস কু-রঙ্গ স-বল দুর্-বল অন্-উপম প্রতি-পদ। এই আশ্রয়ের জোরও সর্বত্র খাটে নি, যথা : বিপদ বিষম সকল।
মধ্যবর্ণের অকার রক্ষা পায় য় বর্ণের পূর্বে, যথা : সময় মলয় আশয় বিষয়।
মধ্যবর্ণের অকার ওকার হয়, সে-যে কেবল হসন্ত শব্দে তা নয়। আকারান্ত এবং যুক্তবর্ণের পূর্বেও এই নিয়ম, যথা : বসন্ত আলস্য লবঙ্গ সহস্র বিলম্ব স্বতন্ত্র রচনা রটনা যোজনা কল্পনা বঞ্চনা।
ইকার আর উকার পদে পদে অকারকে অপদস্থ করে থাকে তার আরও প্রমাণ আছে। সংস্কৃত ভাষায় ঈয় প্রত্যয়ের যোগে “জল’ হয় “জলীয়’। চলতি বাংলায় ওখানে আসে উআ প্রত্যয় : জল + উআ = জলুআ। এইটে হল প্রথম রূপ।
কিন্তু উ স্বরবর্ণ শব্দটাকে স্থির থাকতে দেয় না। তা বাঁ দিকে আছে বাংলা অ, ডান দিকে আছে আ, এই দুটোর সঙ্গে মিশে দুই দিকে দুই ওকার লাগিয়ে দিল, হয়ে দাঁড়ালো “জোলো’।
অকারে বা অযুক্ত বর্ণে যে-সব শব্দের শেষ সেই-সব শব্দের প্রান্তে অ বাসা পায় না, তার দৃষ্টান্ত পূর্বে দিয়েছি। ব্যতিক্রম আছে ত প্রত্যয়-ওয়ালা শব্দে, যেমন : গত হত ক্ষত। আর কতকগুলি সর্বনাম ও অব্যয় শব্দে, যেমন : যত তত কত যেন কেন হেন। আর “এক শো’ অর্থের “শত’ শব্দে। কিন্তু এ কথাটাও ভুল হল। বানানের ছলনা দেখে মনে হয় অন্তত ঐ কটা জায়গায় অ বুঝি টিঁকে আছে। কিন্তু সে ছাপার অক্ষরে আপনার মান বাঁচিয়ে মুখের উচ্চারণে ওকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, হয়েছে : নতো শতো গতো ক্যানো।
অকারের অত্যন্ত অনাদর ঘটেছে বাংলার বিশেষণ শব্দে। বাংলাভাষায় দুই অক্ষরের বিশেষণ শব্দ প্রায়ই অকারন্ত হয় না। তাদের শেষে থাকে আকার একার বা ওকার। এর ব্যতিক্রম অতি অল্পই। প্রথমে সেই ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্ত যতগুলি মনে পড়ে দেওয়া যাক। রঙ বোঝায় যে শব্দে,