ভাদ্র, ১৩৩৯
শব্দ-চয়ন : ১
বাংলা ভাষায় গদ্য লিখতে নতুন শব্দের প্রয়োজন প্রতিদিনই ঘটে। অনেক দিন ধরে অনেক রকম লেখা লিখে এসেছি সেই উপলক্ষে অনেক শব্দ আমাকে বানাতে হল। কিন্তু প্রায়ই মনের ভিতরে খটকা থেকে যায়। সুবিধা এই যে বার বার ব্যবহারের দ্বারাই শব্দবিশেষের অর্থ আপনি পাকা হয়ে উঠে, মূলে যেটা অসংগত, অভ্যাসে সেটা সংগতি লাভ করে। তৎসত্ত্বে সাহিত্যের হট্টগোলে এমন অনেক শব্দের আমদানি হয়, যা ভাষাকে যেন চিরদিনই পীড়া দিতে থাকে। যেমন “সহানুভূতি’। এটা sympathy শব্দের তর্জমা। “সিম্প্যাথি’-র গোড়াকার অর্থ ছিল “দরদ’। ওটা ভাবের আমলের কথা, বুদ্ধির আমলের নয়। কিন্তু ব্যবহারকালে ইংরেজিতে “সিম্প্যাথি’-র মূল অর্থ আপন ধাতুগত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই কোনো একটা প্রস্তাব সম্বন্ধেও সিম্প্যাথি-র কথা শোনা যায়। বাংলাতেও আমরা বলতে আরম্ভ করেছি “এই প্রস্তাবে আমার সহানুভূতি আছে’। বলা উচিত “সম্মতি আছে’ বা “আমি এর সমর্থন করি’। যা-ই হোক্– সহানুভূতি কথাটা যে বানানো কথা এবং ওটা এখনো মানান-সই হয় নি তা বেশ বোঝা যায় যখন ও শব্দটাকে বিশেষণ করবার চেষ্টা করি। “সিম্প্যাথেটিক্’-এর কী তর্জমা হতে পারে, “সহানুভৌতিক, বা “সহানুভূতিশীল’ বা “সহানুভূতিমান’ ভাষায় যেন খাপ খায় না– সেইজন্যেই আজ পর্যন্ত বাঙালি লেখক এর প্রয়োজনটাকেই এড়িয়ে গেছে। দরদের বেলায় “দরদী’ ব্যবহার করি, কিন্তু সহানুভূতির বেলায় লজ্জায় চুপ ক’রে যাই। অথচ সংস্কৃত ভাষায় এমন একটি শব্দ আছে, যেটা একেবারেই তথার্থক। সে হচ্ছে “অনুকম্পা’। ধ্বনিবিজ্ঞানে ধ্বনি ও বাদ্যযন্ত্রের তারের মধ্যে সিম্প্যাথি-র কথা শোনা যায়– যে সুরে বিশেষ কোনো তার বাঁধা, সেই সুর শব্দিত হলে সেই তারটি অনুধ্বনিত হয়। এই তো “অনুকম্পন’। অন্যের বেদনায় যখন আমার চিত্ত ব্যথিত হয়, তখন সেই তো ঠিক “অনুকম্পা’। “অনুকম্পায়ী’ কথাটা সংস্কৃতে আছে। “অনুকম্পাপ্রবণ’ শব্দটাও মন্দ শোনায় না। “অনুকম্পালু’ বোধ করি ভালোই চলে। মুশকিল এই যে, দখলের দলিলটাই ভাষায় স্বত্বের দলিল হয়ে ওঠে। কেবলমাত্র এই কারণেই “কান, সোনা, চুন, পান’ শব্দগুলোতে মূর্ধন্য ণ-য়ের অনধিকার নিরোধ করা এত দুঃসাধ্য হয়েছে। ছাপাখানার অক্ষর-যোজকেরা সংশোধন মানে না। তাদের প্রশ্ন করা যেতে পারত যে, কানের এক “সোনায়’ যদি মূর্ধন্য ণ লাগল, তবে অন্য “শোনায়’ কেন দন্ত্য ন লাগে। “শ্রবণ’ শব্দের র-ফলা লোপ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার মূর্ধন্য ণ সংস্কৃত ব্যাকরণ মতেই দন্ত্য ন হয়েছে। অথচ “স্বর্ণ’ শব্দ যখন রেফ বর্জন ক’রে “সোনা’ হল, তখন মূর্ধন্য ণ-য়ের বিধান কোন্ মতে হয়? হাল আমলের নতুন সংস্কৃত-পোড়োরা “সোনা’কে শোধন ক’রে নিয়েছেন, তাঁদের স্বকল্পিত ব্যাকরণবিধির দ্বারা– এখন দখল প্রমাণ ছাড়া স্বত্বের অন্য প্রমাণ অগ্রাহ্য হয়ে গেল। “শ্রবণ’ শব্দের অপভ্রংশ শোনা শব্দ যখন বাংলা ভাষায় বানান-দেহ ধারণ করেছিল, তখন বিদ্যাসাগর প্রভৃতি প্রাচীন পণ্ডিতেরা বিধানকর্তা ছিলেন– সেদিনকার বানানে কান সোনা প্রভৃতিরও মূর্ধন্যত্ব প্রাপ্তি হয় নি। কৃষ্ণ শব্দজাত কানাই শব্দে আজও দন্ত্য ন চলছে, বর্ণ (বর্ণ যোজন) শব্দজাত বানান শব্দে আজও মূর্ধন্য ণ-এর প্রবেশ ঘটে নি তাতে কি পাণ্ডিত্যের খর্বতা ঘটেছে?
কিছুকাল পূর্বে যখন ভারতশাসনকর্তারা “ইন্টার্ন্’ শুরু করলেন, তখন খবরের কাগজে তাড়াতাড়ি একটা শব্দ সৃষ্টি হয়ে গেল– “অন্তরীণ’। শব্দসাদৃশ্য ছাড়া এর মধ্যে আর কোনো যুক্তি নেই। বিশেষণে ওটা কী হতে পার, তাও কেউ ভাবলেন না। Externment-কে কি বলতে হবে “বহিরীণ’? অথচ “অন্তরায়ণ, অন্তরায়িত, বহিরায়ণ, বহিরায়িত’ ব্যবহার করলে আপত্তির কারণ থাকে না, সকল দিকে সুবিধাও ঘটে।
নূতন সংঘটিত শব্দের মধ্যে কদর্যতায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে “বাধ্যতামূলক শিক্ষা’। প্রথমত শিক্ষার মূলের দিকে বাধ্যতা নয়, ওটা শিক্ষার পিঠের দিকে। বিদ্যাদান বা বিদ্যালাভই হচ্ছে শিক্ষার মূলে– তার প্রণালীতেই “কম্পাল্শন্’। অথচ “অবশ্য-শিক্ষা’ শব্দটা বলবামাত্র বোঝা যায় জিনিসটা কী। “দেশে অবশ্য-শিক্ষা প্রবর্তন করা উচিত’– কানেও শোনায় ভালো, মনেও প্রবেশ করে সহজে। কম্পালসারি এডুকেশনের বাংলা যদি হয় “বাধ্যতামূলক শিক্ষা, “কম্পালসারি সাবজেক্ট’ কি হবে “বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয়’? তার চেয়ে “অবশ্য-পাঠ্য বিষয়’, কি সংগত ও সহজ শোনায় না? “ঐচ্ছিক’ (optional) শব্দটা সংস্কৃতে পেয়েছি, তারি বিপরীতে “আবশ্যিক’ শব্দ ব্যবহার চলে কি না, পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করি। ইংরেজিতে যে-সব শব্দ অত্যন্ত সহজ ও নিত্য প্রচলিত, দরকারের সময় বাংলায় তার প্রতিশব্দ সহসা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন তাড়াতাড়ি যা হয় একটা বানিয়ে দিতে হয়। সেটা অনেক সময় বেখাপ হয়ে দাঁড়ায়, অনেক সময় মূল ভাবটা ব্যবহার করাই স্থগিত থাকে। অথচ সংস্কৃত ভাষায় হয়তো তার অবিকল বা অনুরূপ ভাবের শব্দ দুর্লভ নয়। একদিন “রিপোর্ট’ কথাটার বাংলা করবার প্রয়োজন হয়েছিল। সেটাকে বানাবার চেষ্টা করা গেল, কোনোটাই মনে লাগল না। হঠাৎ মনে পড়ল কাদম্বরীতে আছে “প্রতিবেদন’– আর ভাবনা রইল না। “প্রতিবেদন, প্রতিবেদিত, প্রতিবেদক’– যেমন ক’রেই ব্যবহার করো, কানে বা মনে কোথাও বাধে না। জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধি “ওভারপপ্যুলেশন’– বিষয়টা আজকাল খবরের কাগজের একটা নিত্য আলোচ্য; কোমর বেঁধে ওর একটা বাংলা শব্দ বানাতে গেলে হাঁপিয়ে উঠতে হয়– সংস্কৃত শব্দকোষে তৈরি পাওয়া যায়, “অতিপ্রজন’। বিদ্যালয়ের ছাত্র সম্বন্ধে “রেসিডেন্ট’, “নন্রেসিডেন্ট’ বিভাগ করা দরকার, বাংলায় নাম দেব কী? সংস্কৃত ভাষায় সন্ধান করলে পাওয়া যায় “আবাসিক’, অনাবাসিক’। সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারে আমি কিছুদিন সন্ধানের কাজ করেছিলেম। যা সংগ্রহ করতে পেরেছি, তা শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমারের প্ররোচনায় প্রকাশ করবার জন্য তাঁর হাতে অর্পণ করলুম। অন্তত এর অনেকগুলি শব্দ বাংলা লেখকদের কাজে লাগবে ব’লে আমার বিশ্বাস।