আমাদের তরজমা: “কাঠ আমাদের এতপ্রকার সামগ্রীতে লাগে যে ইহাকে বাদ দিয়া সভ্য মানুষের অবস্থা চিন্তা করা কঠিন; এদিকে ফলবাগানের ফলও আমাদের যার-পর-নাই প্রয়োজনীয়।’
বলা বাহুল্য “যার-পর-নাই’ কথাটা শুনিতে যত একান্ত বড়ো, ব্যবহারে ইহার অর্থ তত বড়ো নহে।
‘Fortunately, the insect foes of trees are not without their own persistent enemies, and among them are many species of brids, whose equipment and habits specially fit them to deal with insects and whose entire lives are spent in pursuit of them.’
পত্রলেখকের তরজমা : “সৌভাগ্যক্রমে বৃক্ষের কীট-অরিগণও নিজেরা তাহাদের স্থায়ী শত্রুহস্ত হইতে মুক্ত নয়, এবং তাহাদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে, যাহাদিগকে তাহাদের অভ্যাস ও দৈহিক উপকরণগুলি বিশেষভাবে কীটদিগের সহিত সংগ্রামে উপযোগী করিয়াছে এবং যাহাদিগের সমস্ত জীবন তাহাদিগকে অনুধাবন করিতে ব্যয়িত হয়।’
“যে’ সর্বনাম শব্দের প্রয়োগ সম্বন্ধে পূর্বেই আমাদের বক্তব্য জানাইয়াছি।
আমাদের তরজমা : “ভাগ্যক্রমে বৃক্ষের শত্রু-কীট-সকলেরও নিজেদের নিত্যশত্রুর অভাব নাই; এই শত্রুদের মধ্যে এমন অনেক জাতীয় পাখি আছে যাহাদের যুদ্ধোপকরণ এবং অভ্যাস সকল কীট-আক্রমণের পক্ষে বিশেষ উপযোগী এবং যাহারা কীট শিকারেই সমস্ত জীবন যাপন করে।’
ইংরেজিতে persistent কথাটি নিতান্ত সহজ। কথ্য বাংলায় আমরা বলি নাছোড়বান্দা। কিন্তু লেখায় সব জায়গায় ইহা চলে না। আমাদের একজন পত্রলেখক “দৃঢ়াগ্রহ’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। কিন্তু “আগ্রহ’ শব্দে, অন্তত বাংলায়, প্রধানত একটি মনোধর্ম বুঝায়। নিষ্ঠা শব্দেও সেইরূপ। Persistent শব্দের অর্থ, যাহা নিরন্তর লাগিয়াই আছে। “নির্বন্ধ’ শব্দটিতে সেই লাগিয়া থাকা অর্থ আছে; “দৃঢ়নির্বন্ধ’ কথাটা বড়ো বেশি অপরিচিত। এখানে কেবল মাত্র “নিত্য’ বিশেষণ যোগে ইংরেজি শব্দের ভাব স্পষ্ট হইতে পারে।
আমাদের আলোচ্য ইংরেজি প্যারাগ্রাফে একটি বাক্য আছে “among them are many species of birds’; আমাদের একজন ছাত্র এই speciesশব্দকে “উপজাতি’ প্রতিশব্দ দ্বারা তরজমা করিয়াছে। গতবারে “প্রতিশব্দ’ প্রবন্ধে আমরাই species-এর বাংলা “উপজাতি’ স্থির করিয়াছিলাম অথচ আমরাই এবারে কেন many ‘species of birds’-কে “নানাজাতীয় পক্ষী’ বলিলাম তাহার কৈফিয়ত আবশ্যক। মনে রাখিতে হইবে এখানে ইংরেজিতে species পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয় নাই। এখানে কোনো বিশেষ একটি মহাজাতীয় পক্ষীরই উপজাতিকে লক্ষ্য করিয়া species কথা বলা হয় নাই। বস্তুত কীটের যে-সব শত্রু আছে তাহারা নানা জাতিরই পক্ষী– কাকও হইতে পারে শালিকও হইতে পারে, শুধু কেবল কাক এবং দাঁড়কাক শালিক এবং গাঙশালিক নহে। বস্তুত সাধারণ ব্যবহারে অনেক শব্দ আপন মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া চলে, কেহ তাহাতে আপত্তি করে না, কিন্তু পারিভাষিক ব্যবহারে কঠোরভাবে নিয়ম মানিয়া চলিতে হয়। যেমন বন্ধুর নিমন্ত্রণক্ষেত্রে মানুষ নিয়মের দিকে দৃষ্টি রাখে না, সামাজিক নিমন্ত্রণে তাহাকে নিয়ম বাঁচাইয়া চলিতে হয়– এও সেইরূপ।
আমাদের তরজমায় আমরা অর্থ স্পষ্ট করিবার খাতিরে দুই-একটা বাড়তি শব্দ বসাইয়াছি। যেমন শেষ বাক্যে মূলে যেখানে আছে, “and among them are many species of birds’, আমরা লিখিয়াছি “এই শত্রুদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে’– অবিকল অনুবাদ করিলে লিখিতে হইত “এবং তাহাদের মধ্যে ইত্যাদি’। ইংরেজিতে একটি সাধারণ নিয়ম এই যে, সর্বনাম শব্দ তাহার পূর্ববর্তী নিকটতম বিশেষ্য শব্দের সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট। এ স্থলে them সর্বনামের অনতিপূর্বেই আছে enemies, এইজন্য এখানে “তাহাদের’ বলিলেই শত্রুদের বুঝাইবে। বাংলায় এ নিয়ম পাকা নহে, এইজন্য, “তাহাদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে’ বলিলে যদি কেহ হঠাৎ বুঝিয়া বসেন, “গাছেদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে, অর্থাৎ পক্ষী বাসা বাঁধিয়া থাকে’ তবে তাঁহাকে খুব দোষী করা যাইবে না।
ইংরেজিতে “and’, আর বাংলায় “এবং’ শব্দের প্রয়োগ-ভেদ আছে। সেটা এখানে বলিয়া লই। “তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তাহারা খবরের কাগজে তাঁহার নিন্দা করে’ এই বাক্যটা ইংরেজি ছাঁচের হইল। এ স্থলে আমরা “এবং’ ব্যবহার করি না। “তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তাহারা সরকারের বেতনভোগী’। এখানেও “এবং’ বাংলায় চলে না। “তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তিনি তাহাদিগকে গ্রাহ্য করেন না’ এরূপ স্থলে হয় “এবং’ বাদ দিই অথবা “কিন্তু’ বসাই। তাহার কারণ, “আছে’র সঙ্গে “আছে’, “করে’র সঙ্গে ক’রে, “হয়’-এর সঙ্গে “হয়’ মেলে, “আছে’র সঙ্গে “করে’, “করে’র সঙ্গে “হয়’ মেলে না। “তাঁহার শত্রু আছে এবং তাঁহার তিনটে মোটর গাড়ি আছে’– এই দুটি অসংশ্লিষ্ট সংবাদের মাঝখানেও “এবং’ চলে কিন্তু তাঁহার শত্রু আছে এবং তিনি শৌখিন লোক’ এরূপ স্থলে “এবং’ চলে না, কেননা “তাঁর আছে’ এবং “তিনি হন’ এ দুটো বাক্যের মধ্যে ভাষার গতি দুই দিকে। এগুলো যেন ভাষার অসবর্ণ বিবাহ, ইংরেজিতে চলে বাংলায় চলে না। ইংরেজির সঙ্গে বাংলার এই সূক্ষ্ম প্রভেদগুলি অনেক সময় অসতর্ক হইয়া আমরা ভুলিয়া যাই।