ধর্ম যখন তাপস তপস্বিনীর মিলনসাধন করিল তখন স্বর্গমর্ত এই প্রেমের সাক্ষী ও সহায়-রূপে অবতীর্ণ হইল; এই প্রেমের আহ্বান সপ্তর্ষিবৃন্দকে স্পর্শ করিল; এই প্রেমের উৎসব লোকলোকান্তরে ব্যাপ্ত হইল। ইহার মধ্যে কোনো গূঢ় চক্রান্ত, অকালে বসন্তের আবির্ভাব ও গোপনে মদনের শরপাতন রহিল না। ইহার যে অম্লানমঙ্গলশ্রী তাহা সমস্ত সংসারের আনন্দের সামগ্রী। সমস্ত বিশ্ব এই শুভমিলনের নিমন্ত্রণে প্রসন্নমুখে যোগদান করিয়া ইহাকে সুসম্পন্ন করিয়া দিল।
সপ্তম সর্গে সেই বিশ্বব্যাপী উৎসব। এই বিবাহ-উৎসবেই কুমারসম্ভবের উপসংহার।
শান্তির মধ্যেই সৌন্দর্যের পূর্ণতা, বিরোধের মধ্যে নহে। কালিদাস তাঁহার কাব্যের রসপ্রবাহকে সেই স্বর্গমর্তব্যাপী সর্বাঙ্গসম্পন্ন শান্তির মধ্যে মিলিত করিয়া তাহাকে মহান পরিণাম দান করিয়াছেন, তাহাকে অর্ধপথে “ন যযৌ ন তস্থৌ’ করিয়া রাখিয়া দেন নাই। মাঝে তাহাকে যে একবার বিক্ষুব্ধ করিয়া দিয়াছেন সে কেবল এই পরিণত সৌন্দর্যের প্রশান্তিকে গাঢ়তর করিয়া দেখাইবার জন্য, ইহার স্থিরশুভ্র মঙ্গলমূর্তিকে বিচিত্রবেশী উদ্ভ্রান্ত সৌন্দর্যের তুলনায় উজ্জ্বল করিয়া তুলিবার জন্য।
মহেশ্বর যখন সপ্তর্ষিদের মধ্যে পতিব্রতা অরুন্ধতীকে দেখিলেন তখন তিনি পত্নীর সৌন্দর্য যে কী তাহা দেখিতে পাইলেন।
তদ্দর্শনাদভূৎ শম্ভোর্-
ভূয়ান্ দারার্থমাদরঃ।
ক্রিয়াণাং খলু ধর্ম্যাণাং
সৎপত্ন্যো মূলকারণম্॥
তাঁহাকে দেখিয়া শম্ভুর দারগ্রহণের জন্য অত্যন্ত আদর জন্মিল। সৎপত্নীই সমস্ত ধর্মকার্যের মূলকারণ। পতিব্রতার মুখচ্ছবিতে বিবাহিতা রমণীর যে গৌরবশ্রী অঙ্কিত আছে তাহা নিয়ত-আচরিত কল্যাণকর্মের স্থির সৌন্দর্য– শম্ভুর কল্পনানেত্রে সেই সৌন্দর্য যখন অরুন্ধতীর সৌম্যমূর্তি হইতে প্রতিফলিত হইয়া নববধূবেশিনী গৌরীর ললাট স্পর্শ করিল তখন শৈলসূতা যে লাবণ্য লাভ করিলেন অকালবসন্তের সমস্ত পুষ্পসম্ভার তাঁহাকে সে সৌন্দর্য দান করিতে পারে নাই।
বিবাহের দিনে গৌরী–
সা মঙ্গলস্নানবিশুদ্ধগাত্রী
গৃহীতপত্যুদ্গমনীয়বস্ত্রা।
নির্বৃত্তপর্জন্যজলাভিষেকা
প্রফুল্লকাশা বসুধের রেজে॥
মঙ্গলস্নানে নির্মলগাত্রী হইয়া যখন পতিমিলনের উপযুক্ত বসন পরিধান করিলেন তখন বর্ষার জলাভিষেকের অবসানে কাশকুসুমে প্রফুল্ল বসুধার ন্যায় বিরাজ করিতে লাগিলেন। এই-যে মঙ্গলকান্তি নির্মল শোভা, ইহার মধ্যে কী শান্তি, কী শ্রী, কী সম্পূর্ণতা! ইহার মধ্যে সমস্ত চেষ্টার অবসান, সমস্ত সজ্জার শেষ পরিণতি। ইহার মধ্যে ইন্দ্রসভার কোনো প্রয়াস নাই, মদনের কোনো মোহ নাই, বসন্তের কোনো আনুকূল্য নাই– এখন ইহা আপনার নির্মলতায় মঙ্গলতায় আপনি অক্ষুব্ধ, আপনি সম্পূর্ণ।
জননীপদ আমাদের দেশের নারীর প্রধান পদ; সন্তানের জন্ম আমাদের দেশে একটি পবিত্র মঙ্গলের ব্যাপার। সেইজন্য মনু রমণীদের সম্বন্ধে বলিয়াছেন–
প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।
তাঁহারা সন্তানকে জন্ম দেন বলিয়া মহাভাগা, পূজনীয়া ও গৃহের দীপ্তিস্বরূপা। সমস্ত কুমারসম্ভব কাব্য কুমারজন্মরূপ মহৎব্যাপারের উপযুক্ত ভূমিকা। মদন গোপনে শর নিক্ষেপ করিয়া ধৈর্যবাঁধ ভাঙিয়া যে মিলন ঘটাইয়া থাকে তাহা পুত্রজন্মের যোগ্য নহে; সে মিলন পরস্পরকে কামনা করে, পুত্রকে কামনা করে না। এইজন্য কবি মদনকে ভস্মসাৎ করাইয়া গৌরীকে দিয়া তপশ্চরণ করাইয়াছেন। এইজন্য কবি প্রবৃত্তির চাঞ্চল্যস্থলে ধ্রুবনিষ্ঠার একাগ্রতা, সৌন্দর্যমোহের স্থলে কল্যাণের কমনীয়দ্যুতি এবং বসন্তবিহ্বল বনভূমির স্থলে আনন্দনিমগ্ন বিশ্বলোককে দাঁড় করাইয়াছেন, তবে কুমারজন্মের সূচনা হইয়াছে। কুমারজন্ম ব্যাপারটা কী, তাহাই বুঝাইতে কবি মদনকে দেবরোষানলে আহুতি দিয়া অনাথ রতিকে বিলাপ করাইয়াছেন।
শকুন্তলাতেও প্রথম অঙ্কে প্রেয়সীর সহিত দুষ্মন্তের ব্যর্থ প্রণয় ও শেষ অঙ্কে ভরতজননীর সঙ্গে তাঁহার সার্থক মিলন কবি অঙ্কিত করিয়াছেন।
প্রথম অঙ্ক চাঞ্চল্যে ঔজ্জ্বলে পূর্ণ; তাহাতে উদ্বেলযৌবনা ঋষিকন্যা, কৌতুকোচ্ছলিতা সখীদ্বয়, নবপুষ্পিতা বনতোষিণী,সৌরভভ্রান্ত মূঢ় ভ্রমর এবং তরু-অন্তরালবর্তী মুগ্ধ রাজা তপোবনের একটি নিভৃত প্রান্ত আশ্রয় করিয়া সৌন্দর্যমদমোদিত এক অপরূপ দৃশ্য উদ্ঘাটিত করিয়াছে। এই প্রমোদস্বর্গ হইতে দুষ্মন্তপ্রেয়সী অপমানে নির্বাসিত হইয়া গিয়াছেন, কিন্তু কল্যাণরূপিণী ভরতজননী যে দিব্যতরা তপোভূমিতে আশ্রয় লইয়াছেন সেখানকার দৃশ্য অন্যরূপ। সেখানে কিশোরী তাপসকন্যারা আলবালে জল সেচন করিতেছে না, লতাভগিনীকে স্নেহদৃষ্টিদ্বারা অভিষিক্ত করিতেছে না, কৃতকপুত্র মৃগশিশুকে নীবারমুষ্টিদ্বারা পালন করিতেছে না। সেখানে তরুলতাপুষ্পপল্লবের সমুদয় চাঞ্চল্য একটিমাত্র বালক অধিকার করিয়া বসিয়া আছে, সমস্ত বনভূমির কোল সে ভরিয়া রহিয়াছে; সেখানে সহকারশাখায় মুকুল ধরে কি না, নবমল্লিকার পুষ্পমঞ্জরী ফোটে কি না, সে কাহারো চক্ষেও পড়ে না। স্নেহব্যাকুল তাপসী মাতার দুরন্ত বালকটিকে লইয়া ব্যস্ত হইয়া রহিয়াছেন। প্রথম অঙ্কে শকুন্তলার সহিত পরিচয় হইবার পূর্বে দূর হইতে তাহার নবযৌবনের লাবণ্যলীলা দুষ্মন্তকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করিয়াছিল। শেষ অঙ্কে শকুন্তলার বালকটি শকুন্তলার সমস্ত লাবণ্যের স্থান অধিকার করিয়া লইয়া রাজার অন্তরতম হৃদয় আর্দ্র করিয়া দিল।