- বইয়ের নামঃ পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ মুঠোবই
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০১
হারুনা-মারু জাহাজ, ২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪
সকাল আটটা। আকাশে ঘন মেঘ, দিগন্ত বৃষ্টিতে ঝাপসা, বাদলার হাওয়া খুঁতখুঁতে ছেলের মতো কিছুতেই শান্ত হতে চাচ্ছে না। বন্দরের শানবাঁধানো বাঁধের ওপারে দুরন্ত সমুদ্র লাফিয়ে লাফিয়ে গর্জে উঠছে, কাকে যেন ঝুঁটি ধরে পেড়ে ফেলতে চায়, নাগাল পায় না। স্বপ্নের আক্রোশে সমস্ত মনটা যেমন বুকের কাছে গুমরে ঠেলে ঠেলে উঠতে থাকে, আর রুদ্ধকণ্ঠের বদ্ধবাণী কান্না হয়ে হা হা করে ফেটে পড়তে চায়, ওই ফেনিয়ে-ওঠা বোবার গর্জন শুনে বৃষ্টিধারায়-পাণ্ডুবর্ণ সমুদ্রকে তেমনি বোধ হচ্ছে একটা অতলস্পর্শ অক্ষম ক্ষোভের দুঃস্বপ্ন।
যাত্রার মুখে এইরকম দুর্যোগকে কুলক্ষণ বলে মনটা ম্লান হয়ে যায়। আমাদের বুদ্ধিটা পাকা, সে একেলে, লক্ষণ-অলক্ষণ মানে না; আমাদের রক্তটা কাঁচা, সে আদিমকালের–তার ভয়ভাবনাগুলো তর্কবিচারকে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ঝেঁকে ওঠে, ওই পাথরের বেড়ার ওপারের অবুঝ ঢেউগুলোরই মতো। বুদ্ধি আপন যুক্তির কেল্লার মধ্যে বিশ্বপ্রকৃতির যতরকম ভাষাহীন আভাস-ইঙ্গিতের স্পর্শ থেকে সরে বসে থাকে। রক্ত থাকে আপন বুদ্ধির বেড়ার বাইরে; তার উপর মেঘের ছায়া পড়ে, ঢেউয়ের দোলা লাগে; বাতাসের বাঁশিতে তাকে নাচায়, আলো-আঁধারের ইশারা থেকে সে কত কী মানে বের করে; আকাশে যখন অপ্রসন্নতা তখন তার আর শান্তি নেই।
অনেকবার দূরদেশে যাত্রা করেছি, মনের নোঙরটা তুলতে খুব বেশি টানাটানি করতে হয় নি। এবার সে কিছু যেন জোরে ডাঙা আঁকড়ে আছে। তার থেকে বোধ হচ্ছে, এতদিন পরে আমার বয়স হয়েছে। না-চলতে চাওয়া প্রাণের কৃপণতা, সঞ্চয় কম হলে খরচ করতে সংকোচ হয়।
তবু মনে জানি, ঘাটের থেকে কিছু দূরে গেলেই এই পিছুটানের বাঁধন খসে যাবে। তরুণ পথিক বেরিয়ে আসবে রাজপথে। এই তরুণ একদিন গান গেয়েছিল, “আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি।” আজই সেই গান কি উজান হাওয়ায় ফিরে গেল। সাগরপারে যে-অপরিচিতা আছে তার অবগুণ্ঠন মোচন করবার জন্যে কি কোনো উৎকণ্ঠা নেই।
কিছুদিন আগে চীন থেকে আমার কাছে নিমন্ত্রণ এসেছিল। সেখানকার লোকে আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চেয়েছিল–কোনো পাকা কথা। অর্থাৎ, সে নিমন্ত্রণ প্রবীণকে নিমন্ত্রণ।
দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এবার আমার নিমন্ত্রণ এল, তাদের শতবার্ষিক উৎসবে যোগ দেবার জন্যে। তাই হালকা হয়ে চলেছি, আমাকে প্রবীণ সাজতে হবে না। বক্তৃতা যত করি তার কুয়াশার মধ্যে আমি আপনি ঢাকা পড়ে যাই। সে তো আমার কবির পরিচয় নয়।
গুটির থেকে প্রজাপতি বেরয় তার নিজের স্বভাবে। গুটির থেকে রেশমের সুতো বেরতে থাকে বস্তুতত্ত্ববিদের টানাটানিতে। তখন থেকে প্রজাপতির অবস্থা শোকাবহ। আমার মাঝবয়স পেরিয়ে গেলে পর আমি আমেরিকার যুক্তরাজ্যে গেলুম; সেখানে আমাকে ধরে-বেঁধে বক্তৃতা করালে, তবে ছাড়লে। তার পর থেকে হিতকথার আসরে আমার আনাগোনার আর অন্ত নেই। আমার কবির পরিচয়টা গৌণ হয়ে গেল। পঞ্চাশ বছর কাটিয়েছিলুম সংসারের বেদরকারি মহলে বেসরকারি ভাবে; মনুর মতে যখন বনে যাবার সময় তখন হাজির হতে হল দরকারের দরবারে। সভা সমিতি আমার কাছে সরকারি কাজ আদায় করতে লেগে গেল। এতেই বোধ হচ্ছে, আমার শনির দশা।
কবি হন বা কলাবিৎ হন তাঁরা লোকের ফরমাশ টেনে আনেন–রাজার ফরমাশ প্রভুর ফরমাশ, বহুপ্রভুর সমাবেশরূপী সাধারণের ফরমাশ। ফরমাশের আক্রমণ থেকে তাঁদের সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি নেই। তার একটা কারণ, অন্দরে তাঁরা মানেন সরস্বতীকে, সদরে তাঁদের মেনে চলতে হয় লক্ষ্মীকে। সরস্বতী ডাক দেন অমৃতভাণ্ডারে, লক্ষ্মী ডাক দেন অন্নের ভাণ্ডারে। শ্বেতপদ্মের অমরাবতী আর সোনার পদ্মের অলকাপুরী ঠিক পাশা-পাশি নেই। উভয়ত্রই যাদের ট্যাক্সো দিতে হয়, এক জায়গায় খুশি হয়ে, আরেক জায়গায় দায়ে প’ড়ে, তাদের বড়ো মুশকিল। জীবিকা অর্জনের দিকে সময় দিলে ভিতরমহলের কাজ চলে না। যেখানে ট্রামের লাইন বসাতে হবে সেখানে ফুলের বাগানের আশা করা মিথ্যে। এই কারণে ফুলবাগানের সঙ্গে আপিসের রাস্তার একটি আপস হয়েছে এই যে, মালি জোগাবে ফুল আর ট্রামলাইনের মালেক জোগাবে অন্ন। দুর্ভাগ্যক্রমে যে-মানুষ অন্ন জোগায় মর্ত্যলোকে তার প্রতাপ বেশি। কারণ, ফুলের শখ পেটের জ্বালার সঙ্গে জবরদস্তিতে সমকক্ষ নয়।
শুধু কেবল অন্ন-বস্ত্র আশ্রয়ের সুযোগটাই বড়ো কথা নয়। ধনীদের যে-টাকা তার জন্যে তাদের নিজের ঘরেই লোহার সিন্দুক আছে, কিন্তু গুণীদের যে-কীর্তি তার খনি যেখানেই থাক্ তার আধার তো তাদের নিজের মনের মধ্যেই নয়। সে-কীর্তি সকল কালের, সকল মানুষের। এইজন্য তার এমন একটি জায়গা পাওয়া চাই যেখান থেকে সকল দেশকালের সে গোচর হতে পারে। বিক্রমাদিত্যের রাজসভার মঞ্চের উপর যে-কবি ছিলেন সেদিনকার ভারতবর্ষে তিনি সকল রসিকমণ্ডলীর সামনে দাঁড়াতে পেরেছিলেন; গোড়াতেই তাঁর প্রকাশ আচ্ছন্ন হয় নি। প্রাচীনকালে অনেক ভালো কবির ভালো কাব্যও দৈবক্রমে এইরকম উঁচু ডাঙাতে আশ্রয় পায় নি ব’লে কালের বন্যাস্রোতে ভেসে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ কথা মনে রাখতে হবে, যাঁরা যথার্থ গুণী তাঁরা একটি সহজ কবচ নিয়ে পৃথিবীতে আসেন। ফরমাশ তাঁদের গায়ে এসে পড়ে, কিন্তু মর্মে এসে বিদ্ধ হয় না। এইজন্যেই তাঁরা মারা যান না, ভাবীকালের জন্যে টিঁকে থাকেন। লোভে প’ড়ে ফরমাশ যারা সম্পূর্ণ স্বীকার করে নেয় তারা তখনই বাঁচে, পরে মরে। আজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের অনেকগুলিকেই কালের ভাঙাকুলো থেকে খুঁটে বের করবার জো নেই। তাঁরা রাজার ফর্মাশ পুরোপুরি খেটেছিলেন, এই জন্যে তখন হাতে হাতে তাঁদের নগদ পাওনা নিশ্চয়ই আর-সকলের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু, কালিদাস ফরমাশ খাটতে অপটু ছিলেন বলে দিঙ্নাগের স্থূল হস্তের মার তাঁকে বিস্তর খেতে হয়েছিল। তাঁকেও দায়ে পড়ে মাঝে মাঝে ফরমাশ খাটতে হয়েছে, তার প্রমাণ পাই মালবিকাগ্নিমিত্রে। যে দুই-তিনটি কাব্যে কালিদাস রাজাকে মুখে বলেছিলেন, “যে আদেশ, মহারাজ। যা বলছেন তা-ই করব” অথচ সম্পূর্ণ আরেকটা কিছু করেছেন, সেইগুলির জোরেই সেদিনকার রাজসভার অবসানে তাঁর কীর্তিকলাপের অন্ত্যেষ্টিসৎকার হয়ে যায় নি–চিরদিনের রসিকসভায় তাঁর প্রবেশ অবারিত হয়েছে।
মানুষের কাজের দুটো ক্ষেত্র আছে–একটা প্রয়োজনের, আর-একটা লীলার। প্রয়োজনের তাগিদ সমস্তই বাইরের থেকে, অভাবের থেকে; লীলার তাগিদ ভিতর থেকে, ভাবের থেকে। বাইরের ফরমাশে এই প্রয়োজনের আসর সরগরম হয়ে ওঠে, ভিতরের ফরমাশে লীলার আসর জমে। আজকের দিনে জনসাধারণ জেগে উঠেছে; তার ক্ষুধা বিরাট, তার দাবি বিস্তর। সেই বহুরসনাধারী জীব তার বহুতরো ফরমাশে মানবসংসারকে রাত্রিদিন উদ্যত করে রেখেছে; কত তার আসবাব আয়োজন, পাইক বরকন্দাজ, কাড়া-নাকাড়া-ঢাকঢোলের তুমুল কলরব–তার “চাই চাই” শব্দের গর্জনে স্বর্গমর্ত্য বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। এই গর্জনটা লীলার আসরেও প্রবেশ করে দাবি প্রচার করতে থাকে যে, “তোমাদের বীণা, তোমাদের মৃদঙ্গও আমাদের জয়যাত্রার ব্যাণ্ডের সঙ্গে মিলে আমাদের কল্লোলকে ঘনীভূত করে তুলুক।” সেজন্যে সে খুব বড়ো মজুরি আর জাঁকালো শিরোপা দিতেও রাজি আছে। আগেকার রাজসভার চেয়ে সে হাঁকও দেয় বেশি দামও দেয় বেশি। সেইজন্যে ঢাকির পক্ষে এ সময়টা সুসময়, কিন্তু বীণাকারের পক্ষে নয়। ওস্তাদ হাত জোড় করে বলে, “তোমাদের হট্টগোলের কাজে আমার স্থান নেই; অতএব বরঞ্চ আমি চুপ করে থাকতে রাজি আছি, বীণাটা গলায় বেঁধে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মরতেও রাজি আছি, কিন্তু আমাকে তোমাদের সদররাস্তায় গড়ের বাদ্যের দলে ডেকো না। কেননা, আমার উপরওয়ালার কাছ থেকে তাঁর গানের আসরের জন্যে পূর্ব হতেই বায়না পেয়ে বসে আছি।” এতে জনসাধারণ নানাপ্রকার কটু সম্ভাষণ করে, সে বলে, “তুমি লোকহিত মান না, দেশহিত মান না, কেবল আপন খেয়ালকেই মান।” বীণকার বলতে চেষ্টা করে, “আমি আমার খেয়ালকেও মানি নে, তোমার গরজকেও মানি নে, আমার উপরওয়ালাকে মানি।” সহস্ররসনাধারী গর্জন করে বলে ওঠে, “চুপ!”
জনসাধারণ বলতে যে প্রকাণ্ড জীবকে বোঝায় স্বভাবতই তার প্রয়োজন প্রবল এবং প্রভূত। এইজন্যে স্বভাবতই প্রয়োজনসাধনের দাম তার কাছে অনেক বেশি, লীলাকে সে অবজ্ঞা করে। ক্ষুধার সময়ে বকুলের চেয়ে বার্তাকুর দাম বেশি হয়। সেজন্যে ক্ষুধাতুরকে দোষ দিই নে; কিন্তু বকুলকে যখন বার্তাকুর পদ গ্রহণ করবার জন্যে ফরমাশ আসে তখন সেই ফরমাশকেই দোষ দিই। বিধাতা ক্ষুধাতুরের দেশেও বকুল ফুটিয়েছেন, এতে বকুলের কোনো হাত নেই। তার একটিমাত্র দায়িত্ব আছে এই যে, যেখানে যা-ই ঘটুক, তাকে কারো দরকার থাক্ বা না থাক্, তাকে বকুল হয়ে উঠতেই হবে; ঝরে পড়ে তো পড়বে, মালায় গাঁথা হয় তো তা-ই সই। এই কথাটাকেই গীতা বলেছেন, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।” দেখা গেছে, স্বধর্মে জগতে খুব মহৎ লোকেরও নিধন হয়েছে, কিন্তু সে নিধন বাইরের, স্বধর্ম ভিতরের দিক থেকে তাঁকে বাঁচিয়েছে। আর এও দেখা গেছে, পরধর্মে খুব ক্ষুদ্র লোকেও হঠাৎ বড়ো হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার নিধন ভিতরের থেকে, যাকে উপনিষদ্ বলেন, “মহতী বিনষ্টিঃ”।
যে-ব্যক্তি ছোটো তারও স্বধর্ম বলে একটি সম্পদ আছে। তার সেই ছোটো কৌটোটির মধ্যেই সেই স্বধর্মের সম্পদটিকে রক্ষা করে সে পরিত্রাণ পায়। ইতিহাসে তার নাম থাকে না, হয়তো তার বদনাম থাকতেও পারে, কিন্তু তার অন্তর্যামীর খাসদরবারে তার নাম থেকে যায়। লোভে পড়ে স্বধর্ম বিকিয়ে দিয়ে সে যদি পরধর্মের ডঙ্কা বাজাতে যায় তবে হাটে বাজারে তার নাম হবে। কিন্তু, তার প্রভুর দরবার থেকে তার নাম খোওয়া যাবে।
এই ভূমিকার মধ্যে আমার নিজের কৈফিয়ত আছে। কখনো অপরাধ করি নি তা নয়। সেই অপরাধের লোকসান ও পরিতাপ তীব্র বেদনায় অনুভব করেছি ব’লেই সাবধান হই। ঝড়ের সময় ধ্রুবতারাকে দেখা যায় না ব’লে দিক্ভ্রম হয়। এক-এক সময়ে বাহিরের কল্লোলে উদ্ভ্রান্ত হয়ে স্বধর্মের বাণী স্পষ্ট করে শোনা যায় না। তখন “কর্তব্য’ নামক দশমুখ-উচ্চারিত একটা শব্দের হুঙ্কারে মন অভিভূত হয়ে যায়; ভুলে যাই যে, কর্তব্য বলে একটা অবচ্ছিন্ন পদার্থ নেই, আমার “কর্তব্য’ই হচ্ছে আমার পক্ষে কর্তব্য। গাড়ির চলাটা হচ্ছে একটা সাধারণ কর্তব্য, কিন্তু ঘোরতর প্রয়োজনের সময়েও ঘোড়া যদি বলে “আমি সারথির কর্তব্য করব”, বা চাকা বলে “ঘোড়ার কর্তব্য করব”, তবে সেই কর্তব্যই ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ডিমক্রেসির যুগে এই উড়ে-পড়া পড়ে-পাওয়া কর্তব্যের ভয়াবহতা চারিদিকে দেখতে পাই। মানবসংসার চলবে, তার চলাই চাই; কিন্তু তার চলার রথের নানা অঙ্গ–কর্মীরাও একরকম করে তাকে চালাচ্ছে, গুণীরাও একরকম ক’রে তাকে চালাচ্ছে, উভয়ের স্বানুবর্তিতাতেই পরস্পরের সহায়তা এবং সমগ্র রথের গতিবেগ; উভয়ের কর্ম একাকার হয়ে গেলেই মোট কর্মটাই পঙ্গু হয়ে যায়।
এই উপলক্ষে একটি কথা আমার মনে পড়ছে। তখন লোকমান্য টিলক বেঁচে ছিলেন। তিনি তাঁর কোনো এক দূতের যোগে আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন, আমাকে য়ুরোপে যেতে হবে। সে সময়ে নন্-কো-অপারেশন আরম্ভ হয় নি বটে কিন্তু পোলিটিক্যাল আন্দোলনের তুফান বইছে। আমি বললুম, “রাষ্ট্রিক আন্দোনের কাজে যোগ দিয়ে আমি য়ুরোপে যেতে পারব না।” তিনি বলে পাঠালেন, আমি রাষ্ট্রিক চর্চায় থাকি, এ তাঁর অভিপ্রায়বিরুদ্ধ। ভারতবর্ষের যে-বাণী আমি প্রচার করতে পারি সেই বাণী বহন করাই আমার পক্ষে সত্য কাজ, এবং সেই সত্য কাজের দ্বারাই আমি ভারতের সত্য সেবা করতে পারি। আমি জানতুম, জনসাধারণ টিলককে পোলিটিক্যাল নেতারূপেই বরণ করেছিল এবং সেই কাজেই তাঁকে টাকা দিয়েছিল। এইজন্য আমি তাঁর পঞ্চাশ হাজার টাকা গ্রহণ করতে পারি নি। তার পরে, বোম্বাই-শহরে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমাকে পুনশ্চ বললেন, “রাষ্ট্রনীতিক ব্যাপার থেকে নিজেকে পৃথক রাখলে তবেই আপনি নিজের কাজ সুতরাং দেশের কাজ করতে পারবেন; এর চেয়ে বড়ো আর কিছু আপনার কাছে প্রত্যাশাই করি নি।” আমি বুঝতে পারলুম, টিলক যে গীতার ভাষ্য করেছিলেন সে কাজের অধিকার তাঁর ছিল; সেই অধিকার মহৎ অধিকার।
অনেক ধনী আছে যারা নিজের ভোগেই নিজের অর্থের ব্যয় ও অপব্যয় করে থাকে। সাধারণের দাবি তাদের ভোগের তহবিলে যদি ভাঙন ধরাতে পারে তাতে দুঃখের কথা কিছুই নেই। অবকাশ পদার্থটা হচ্ছে সময়ধন–সংসারী এই ধনটাকে নিজের ঘরসংসারের চিন্তায় ও কাজে লাগায়, আর কুঁড়ে যে সে কোনো কাজেই লাগায় না। এই সংসারী বা কুঁড়ের অবকাশের উপর লোকহিতের দোহাই দিয়ে উপদ্রব করলে দোষের হয় না। আমার অবকাশের অনেকটা অংশ আমি কুঁড়েমিতেই খাটাই, বাইরে থেকে কেউ কেউ এমন সন্দেহ করে। এ কথাটা জানে না যে, কুঁড়েমিটাই আমার কাজের প্রধান অঙ্গ। পেয়ালার যতটা চীনেমাটি দিয়ে গড়া ততটাই তার প্রধান অংশ নয়, বস্তুত সেটাই তার গৌণ; যতটা তার ফাঁক ততটাই তার মুখ্য অংশ। ওই ফাঁকটাই রসে ভরতি হয়, পোড়া চীনেমাটি উপলক্ষ মাত্র। ঘরের খুঁটিটা যেমন, গাছ ঠিক তেমন জিনিস নয়। অর্থাৎ, সে কেবলমাত্র নিজের তলাটার মাটিতেই দাঁড়িয়ে থাকে না। তার দৃশ্যমান গুঁড়ি যতটুকু মাটি জুড়ে থাকে তার অদৃশ্য শিকড় তার চেয়ে অনেক বেশি মাটি অধিকার করে ব’লেই গাছটা রসের জোগান পায়। আমাদের কাজও সেই গাছের মতো; ফাঁকা অবকাশের তলা থেকে গোপনে সে রস আদায় করে নেয়। দশে মিলি তার সেই বিধিদত্ত অবকাশের লাখেরাজের উপর যদি খাজনা বসায় তা হলে তার সেই কাজটাকেই নিঃস্ব করা হতে থাকে। এইজন্যেই দেশের সমস্ত সাময়িক পত্রে হরির লুঠের জোগান দেবার জন্যে অন্য কোনো দেশেই কবিকে নিয়ে এমনতরো টানাহেঁচড়া করে না।
আমাদের দেশের গার্হস্থ্য ব্যাকরণে যাঁরা কর্তা তাঁদের প্রধান পরিচয় ক্রিয়াকর্মে। লোকে তাঁদের দশকর্মা বলে। সেই গার্হস্থ্যে আবার এমন সব লোক আছে যারা অকর্মা; তারা কেবল ফাইফরমাশ খাটে। কাজের চেয়ে অকাজে তাদের বেশি দরকার। অর্থাৎ, তাস খেলবার যখন জুড়ি না জোটে তখন তাদের ডাক পড়ে, আর দূর-সম্পর্কের জ্যাঠাইমার গঙ্গাযাত্রার সময় তারই প্রধান সহায়।
আমাদের শাস্ত্রে গৃহস্থ-আশ্রমের উপর আরণ্য-আশ্রমের বিধি। বর্তমানকালে এই শেষের আশ্রম বাদ পড়েছে; আরণ্য-আশ্রম নেই, কিন্তু তার জায়গা জুড়েছে সাধারণ্য-আশ্রম। এখন দেশে আরণ্যক পাওয়া যায় না, কিন্তু সাধারণ্যকের সংখ্যা কম নয়। তাঁরা পাবলিক-নামক বৃহৎ সংসারের ঘোরতর সংসারী।
শেষোক্ত সংসারে দুই দলের লোক আছেন। একদল দশকর্মা, আর-একদল অকর্মা; যাঁদের ইংরেজিতে লীডার বলে আমি তাঁদের বলতে চাই কর্তাব্যক্তি। কেউ বা বড়ো-কর্তা, কেউ বা মেজো-কর্তা, কেউ বা ছোটো-কর্তা। এই কর্তারা নিত্য-সভা, নৈমিত্তিক-সভা, যুদ্ধ-সভা, শ্রাদ্ধ-সভা প্রভৃতিতে সর্বদাই ব্যস্ত; তা ছাড়া আছে সাময়িক পত্র, অসাময়িক পত্র, চাঁদার খাতা, বার্ষিক বিবরণী। আর, যাঁরা এই সাধারণ্য আশ্রমের কর্তাব্যক্তি নন, ক্রিয়াকর্ম তাঁদের অধীন নয়, তাঁরা থাকেন চ-বৈ-তু-হি নিয়ে; যত রকম জোড়াতাড়া দেওয়ার কাজে তাঁদের ডাক; হঠাৎ ফাঁক পড়লে সেই ফাঁক উপস্থিতমতো তাঁরা পূরণ করে থাকেন। তাঁরা ভলাণ্টীয়ারি করেন, চৌকি সাজান, চাঁদা সাধেন, করতালিঘাতে সভার উৎসাহবৃদ্ধি করেন, কখনো বা অপঘাতে সভার অকাল-সমাপ্তি-সাধনেও যোগ দেন।
পাব্লিক শহরে কর্তৃপদ হাটে ঘাটে মেলে না, আর সাবধানে তাদের ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু অব্যয় পদের ছড়াছড়ি–এইজন্যে অব্যয়ের অপব্যয় সর্বদাই ঘটে। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ ছন্দপূরণের কাজে তাদের অস্থানে তলব পড়ে; তাতে মাত্রা রক্ষা হয় এই মাত্র, তার বেশি কিছু না; যেন কুলীনকন্যার কলাগাছের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া।
বর্তমান বয়সে আমার জীবনের প্রধান সংকট এই যে, যদিচ স্বভাবত আমি আরণ্যক তবু আমার কর্মস্থানের কুগ্রহ সকৌতুকে আমাকে সাধারণ্যকে করে দাঁড় করিয়েছেন। দীর্ঘকাল আমার জীবন কেটেছে কোণে, কাব্যরচনায়; কখন একসময় বিধাতার খেয়ালের খেয়া আমাকে পৌঁছে দিয়েছে জনতার ঘাটে–এখন অকাব্যসাধনে আমার দিন কাটছে। এখন আমি পাব্লিকের কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু হাঁস যখন চলে তখন তার নড়বড়ে চলন দেখেই বোঝা যায় তার পায়ের তেলো ডাঙায় চলবার জন্যে নয়, জলে সাঁতার দেবার জন্যেই। তেমনি পাব্লিক ক্ষেত্রে আমার পদচারণভঙ্গি আমার অভ্যাসদোষে অথবা বিধাতার রচনাগুণে আজ পর্যন্ত বেশ সুসংগত হয় নি।
এখানে কর্তৃপদে আমার যোগ্যতা নেই, যাকে অব্যয়পদ বলেছি তার কাজেও পদে পদে বিপদ ঘটে। ভলাণ্টীয়ারি করবার বয়স গেছে; দুর্দিনের তাড়নায় চাঁদার খাতা নিয়ে ধনপতিদের অর্গলবদ্ধ দ্বারে অনর্গল ঘুরে বেড়াতে হয়, তাতে অঙ্কপাত যা হয় তার চেয়ে অশ্রুপাত হয় অনেক বেশি। তার পরে, গ্রন্থের ভূমিকা লেখবার জন্যে অনুরোধ আসে; গ্রন্থকার অভিমতের দাবি করে গ্রন্থ পাঠান; কেউ বা অনাবশ্যক পত্র লেখেন, ভিতরে মাশুল দিয়ে দেন জবাব লেখবার জন্যে আমাকে দায়ী করবার উদ্দেশ্যে; নবপ্রসূত কুমারকুমারীদের পিতামাতারা তাঁদের সন্তানদের জন্যে অভূতপূর্ব নূতন নাম চেয়ে পাঠান; সম্পাদকের তাগিদ আছে; পরিণয়োৎসুক যুবকদের জন্যে নূতন-রচিত গান চাই; কী উপায়ে নোবেলপ্রাইজ অর্জন করতে হয় সে সম্বন্ধে পরামর্শের আবেদন আসে; দেশের হিতচেষ্টায় পত্রলেখকের সঙ্গে কেন আমার মতের কিছু পার্থক্য ঘটে তার জবাবদিহির জন্যে সাক্রোশে তলব পড়ে। এই-সমস্ত উত্তেজনায় প্রতিনিয়ত যে-সকল কর্ম জমিয়ে তুলছি আবর্জনামোচনে কালের সম্মার্জনী সুপটু বলেই বিধাতার কাছে সেজন্যে মার্জনা আশা করি। সভাকর্তৃত্বের কাজেও মাঝে মাঝে আমার ডাক পড়ে। যখন একান্ত কাব্যরসে নিমগ্ন ছিলুম তখন এ বিপদ আমার ছিল না। রাখালকে কেউ ভুলেও রাজসিংহাসনে আমন্ত্রণ করে না, এইজন্যেই বটতলায় সে বাঁশি বাজাবার সময় পায়। কিন্তু, যদি দৈবাৎ কেউ ক’রে বসে, তা হলে পাঁচনিকে রাজদণ্ডের কাজে লাগাতে গিয়ে রাখালি এবং রাজত্ব দুয়েরই বিঘ্ন ঘটে। কাব্যসরস্বতীর সেবক হয়ে গোলেমালে আজ গণপতির দরবারের তকমা পরে বসেছি; তার ফলে কাব্যসরস্বতী আমাকে প্রায় জবাব দিয়েছেন, আর গণপতির বাহনটি আমার সকল কাজেরই ছিদ্র অন্বেষণ করছেন।
ফরমাশের শরশয্যাশায়ী হবার ইচ্ছা আমার কেন নেই, সেই কথাটা এই উপলক্ষে জানালুম। যেখানে দশে মিলে কাজ সেখানে আমার অবকাশের সব গোরু বাছুর বেচে খাজনা জোগাবার তলবে কেন আমি সিভিল অথবা আন্সিভিল ডিস্-ওবিডিয়েন্সের নীতি অবলম্বন করতে চেষ্টা করি তার একটা কৈফিয়ত দেওয়া গেল। সব সময়ে অনুরোধ উপরোধ এড়িয়ে উঠতে পারি নি, তার কারণ আমার স্বভাব দুর্বল। পৃথিবীতে যাঁরা বড়োলোক তাঁরা রাশভারি শক্তলোক; মহৎ সম্পদ অর্জন করবার লক্ষ্যপথে যথাযোগ্য স্থানে যথোচিত দৃঢ়তার সঙ্গে “না” বলবার ক্ষমতাই তাঁদের পাথেয়। মহৎ সম্পদকে রক্ষা করবার উপলক্ষে রাশভারি লোকেরা “না”-মন্ত্রের গণ্ডিটা নিজের চারিদিকে ঠিক জায়গায় মোট করে টেনে দিতে পারেন। আমার সে মহত্ত্ব নেই, পেরে উঠি নে; হাঁ-না দুই নৌকার উপর পা দিয়ে দুলতে দুলতে হঠাৎ অগাধ জলের মধ্যে গিয়ে পড়ি। তাই একান্ত মনে আজ প্রার্থনা করি, “ওগো না-নৌকার নাবিক, আমাকে জোরের সঙ্গে তোমার নৌকোয় টেনে নিয়ে একেবারে মাঝদরিয়ায় পাড়ি দাও–অকাজের ঘাটে আমার তলব আছে, দোটানায় পড়ে যেন বেলা বয়ে না যায়!”
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০২
২৫শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪
কাল সমস্ত দিন জাহাজ মাল বোঝাই করছিল। রাত্রে যখন ছাড়ল তখন বাতাসের আক্ষেপ কিছু শান্ত। কিন্তু, তখনো মেঘগুলো দল পাকিয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে। আজ সকালে একখানা ভিজে অন্ধকারে আকাশ ঢাকা। এবার আলোকের অভিনন্দন পেলুম না। শরীরমনও ক্লান্ত।
জাহাজটা তীর থেকে যেন একটুকরো সংসার ছিন্ন করে নিয়ে ভেসে চলেছে। ডাঙায় মানুষে মানুষে ফাঁক থাকবার অবকাশ আছে; এখানে জায়গা অল্প, ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে হয়। কিন্তু, তবু পরস্পর পরিচয় কত কঠিন। প্রত্যেকবার জাহাজে ওঠবার আগে এই চিন্তাটি মনকে পীড়া দেয়, এই নৈকট্যের দূরত্ব, এই সঙ্গবিহীন সাহচর্য।
আদিম অবস্থায় মানুষ যে-বাসা বাঁধে তার দেয়াল পাতলা; তার ছিটে বেড়ায় যথেষ্ট ফাঁক, ঝাঁপটা ঠেলে ফেলে ঘরে ঢোকা সহজ। কালক্রমে বাসা বাঁধবার নৈপুণ্য তার যতই বেড়ে ওঠে, ততই ইঁটকাঠ-লোহাপাথরে ঘরের দেয়াল পাকা হয়ে ওঠে, দরজা হয় মজবুত। তার মধ্যে মনের অভ্যেসগুলো হয়ে যায় পাঁচিলে ঘেরা। খাওয়া-পরা শোওয়া-বসা সব-কিছুর জন্যই আড়ালের দরকার হয়। এই আড়ালটা সভ্যতার সর্বপ্রধান অঙ্গ। এইটেকে রচনা ও রক্ষা করতে বিস্তর খরচ লাগছে। ঘর-বাহিরের মাঝখানে মানুষের সহজ-চলাচলের রাস্তায় পদে-পদে নিষেধ।
প্রত্যেক মানুষের একটা সহজ বেড়ার দরকার আছে, নইলে ভিড়ের টানে দশের সঙ্গে মিশে গেলে নিজের বিশেষত্বের সম্পদ ব্যর্থ হয়ে যায়। নিজেকে বিচ্ছিন্ন না করলে নিজেকে প্রকাশ করাই যায় না। বীজ আপনাকে প্রকাশ করবার জন্যই মাটির ভিতরে আড়াল খোঁজে; ফল আপনাকে পরিণত করবার জন্যেই বাহিরের দিকে একটা খোসার পর্দা টেনে দেয়। বর্বর অবস্থায় মানুষের ব্যক্তিগত বিশেষত্বের জোর থাকে না, তার কাজও থাকে কম। এইজন্যেই ব্যক্তিবিশেষের গোপনতার পরিবেষ্টন সৃষ্ট হয়ে ওঠে তার সভ্যতার উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে।
কিন্তু, এই বেড়া জিনিসটার আত্মপ্রাধান্যবোধ ক্রমেই অতিমাত্র বাড়তে থাকে। তখন মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনে যে একান্ত প্রয়োজন আছে, সেটা বাধাগ্রস্ত হয়ে অনভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সেই আতিশয্যটাই হল বিপদ।
এই মারাত্মক বিপদটা কোন্ অবস্থায় ঘটে। ভোগের আদর্শ অপরিমিত বেড়ে উঠে মানুষের যখন বিস্তর উপকরণের প্রয়োজন, যখন অন্যের জন্যে তার সময় ও সম্বল খরচ করবার বেলায় বিস্তর হিসেব করা অনিবার্য, যখন তার জীবিকার উপাদান উৎপাদন করবার জন্যে প্রভূত আয়োজন চাই, তখন তার সভ্যতার বাহন-বাহিনীর বিপুলতায় তার লোকালয় অতি প্রকাণ্ড হয়ে ওঠে। জনতার পরিমিত আয়তনেই মানুষের মধ্যে আত্মীয়তার ঐক্য সম্ভবপর। তাই পল্লীর অধিবাসীরা কেবল যে একত্র হয় তা নয়, তারা এক হয়। শহরের অতিবৃহৎ জনসমাবেশ আপন অতিবিস্তীর্ণ অঙ্গপ্রতঙ্গ্যের মধ্যে এক-আত্মীয়তার রক্তস্রোত সঞ্চারিত করবার উপযুক্ত হৃৎপিণ্ড তৈরি করে উঠতে পারে না। প্রকাণ্ড জনসঙ্ঘ কাজ চালাবারই যোগ্য, আত্মীয়তা চালাবার নয়। কারখানা ঘরে হাজার লোকের মজুরি দরকার, পরিবারের মধ্যে হাজার লোকের জটলা হলে তাকে আর গৃহ বলে না। যন্ত্রের মিলন যেখানে সেখানে অনেক লোক, আর অস্ত্রের মিলন যেখানে সেখানে লোকসংখ্যা কম। তাই শহর মানুষকে বাহিরের দিকে কাছে টানে, অন্তরের দিকে ফাঁক ফাঁক করে রাখে।
আমরা আজন্মকাল সেই দেয়াল-কোটরে ভাগে ভাগে বিভক্ত সভ্য মানুষ। হঠাৎ এসে ঠেসাঠেসি করে মিলেছি এক জাহাজে। মেলবার অভ্যেস মনের মধ্যে নেই। তীর্থে যারা দল বেঁধে রাস্তায় চলে মিলতে তাদের সময় লাগে না; তারা গাঁয়ের লোক, মেলাই তাদের অভ্যেস। সার্থবাহ যারা মরুর মধ্যে দিয়ে উটে চড়ে গেলে তারাও মনকে নীরব আড়ালের বুর্খা দিয়ে ঢেকে চলে না; তাদের সভ্যতা ইঁট-পাথরে অমিলকে পাকা করে গেঁথে তোলে নি। কিন্তু, স্টীমারের যাত্রী, রেলগাড়ির প্যাসেঞ্জার বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে আসে তাদের দেয়ালগুলোর সূক্ষ্ম শরীর তাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলতে থাকে।
তাই দেখি, শহরের কলেজে-পড়া ছেলে হঠাৎ দেশাত্মবোধের তাড়ায় যখন খামকা পল্লীর উপকার করতে ছোটে তখন তারা পল্লীবাসীর পাশে এসেও কাছে আসতে পারে না। তারা বেড়ার ভিতর দিয়ে কথা কয়, পল্লীর কানে বাজে যেন আরবি আওড়াচ্ছে।
যা হোক, যদিও শহুরে সভ্যতার পাকে আমাদেরকেও খুব কষে টান দিয়েছে, তবু মনের গ্রাম্য অভ্যেস এখনো যায় নি। সময়কে বলতে আরম্ভ করেছি, মূল্যবান, কিন্তু কেউ যদি সে-মূল্য গ্রাহ্য না করে তাকে ঠেকিয়ে রাখবার কোনো ব্যবস্থা আজও তৈরি হয় নি। আমাদের আগন্তুকবর্গ অভিমন্যুর মতো অতি সহজেই ঘরে প্রবেশ করতে জানেন, কিন্তু নির্গমনের পথ যে তাঁরা জানেন সে তাঁদের ব্যবহারে বোঝা যায় না। অত্যন্ত বেগার লোককেও যদি বলা যায়, “কাজ আছে”, সে বলে “ঈস! লোকটা ভারি অহংকারী”। অর্থাৎ, তোমার কাজটা আমাকে দেখা দেওয়ার চেয়েও মহার্ঘ, এ কথা মনে করা স্পর্ধা।
অসুস্থ শরীরে একদিন আমার তিন-তলার ঘরে অর্ধশয়ান অবস্থায় একটা লেখায় নিযুক্ত আছি। আমি নিতান্তই মৃদুস্বভাবের মানুষ ব’লেই আমার সেই অন্দরের ঘরটাকেও আমার বন্ধু, অনতিবন্ধু ও অবন্ধুরা দুর্গম বলে গণ্য করেন না। এইটুকুমাত্র সুবিধা যে, পথটা পুরবাসীদের সকলেরই জানা নেই। খবর এল, একটি ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন। অস্বাস্থ্য বা ব্যস্ততার ওজরকে আমাদের ভদ্রলোকেরা শ্রদ্ধা করেন না, তাই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে লেখা বন্ধ করে নীচে গেলুম। দেখি, একজন কাঁচা বয়সের যুবক; হঠাৎ তার চাদরের অজ্ঞাতবাস থেকে একটা মোটা-গোছের খাতা বেরল। বুঝলুম, আমারই আপন সম্প্রদায়ের লোক। কবিকিশোর একটুখানি হেসে আমাকে বললে, “একটা অপেরা লিখেছি।” আমার মুখে বোধ হয় একটা পাংশুবর্ণ ছায়া পড়ে থাকবে, তাই হয়তো আশ্বাস দেবার জন্যে বলে উঠল, “আপনাকে আর কিছুই করতে হবে না, কেবল গানের কথাগলোতে সুর বসিয়ে দেবেন, সবসুদ্ধ পঁচিশটা গান।” কাতর হয়ে বললুম, “সময় কই!” কবি বললে, “আপনার কতটুকুই বা সময় লাগবে। গান-পিছু বড়ো-জোর আধ ঘণ্টাই হোক।” সময় সম্বন্ধে এর মনের ঔদার্য দেখে হতাশ হয়ে বললুম, “আমার শরীর অসুস্থ।” অপেরা-রচয়িতা বললে, “আপনার শরীর অসুস্থ, এর উপরে আর কী বলব! কিন্তু যদি–“। বুঝলুম প্রবীণ ডাক্তারের সার্টিফিকেট আনলেও নবীন কবি বিচলিত হবে না। কোনো-একজন ইংরেজ গ্রন্থকারের ঘরে এই নাট্যের অবতারণা হলে কোন্ ফৌজদারিতে তার যবনিকাপতন হত, সে-কথা মনে করলেও শরীর রোমাঞ্চিত হয়।
মানুষের ঘরে “দরওয়াজা বন্ধ্” এ কথাটিও কটু, আর তার ঘরে কোথাও পর্দা নেই এটাও বর্বরতা। মধ্যম পন্থাটাই দেখি সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। দুই বিরুদ্ধ শক্তির সমন্বয়েই সৃষ্টি, তাদের একান্ত বিচ্ছেদই প্রলয়, মানুষ নিজের ব্যবহারক্ষেত্রে এইটেই কেবলই ভোলে আর মার খেয়ে মরে।
সূর্যের উদয়াস্ত আজও বাদলার ছায়ায় ঢাকা পড়ে রইল। মেঘের থলিটার মধ্যে কৃপণ আকাশ তার সমস্ত সোনার আলো এঁটে বন্ধ করে রেখেছে।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৩
২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪
আজ ক্ষণে ক্ষণে রৌদ্র উঁকি মারছে, কিন্তু সে যেন তার গারদের গরাদের ভিতর থেকে। তার সংকোচ এখনো ঘুচল না। বাদল-রাজের কালো-উর্দি-পরা মেঘগুলো দিকে দিকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।
আচ্ছন্ন সূর্যের আলোয় আমার চৈতন্যের স্রোতস্বিনীতে যেন ভাঁটা পড়ে গেছে। জোয়ার আসবে রৌদ্রের সঙ্গে সঙ্গে।
পশ্চিমে, বিশেষত আমেরিকায় দেখেছি, বাপমায়ের সঙ্গে অধিকাংশ বয়স্ক ছেলে-মেয়ের নাড়ীর টান ঘুচে গেছে। আমাদের দেশে শেষ পর্যন্তই সেটা থাকে। তেমনিই দেখেছি, সূর্যের সঙ্গে মানুষের প্রাণের যোগ সে-দেশে তেমন যেন অন্তরঙ্গভাবে অনুভব করে না। সেই বিরলরৌদ্রের দেশে তারা ঘরে সূর্যের আলো ঠেকিয়ে রাখবার জন্যে যখন পর্দা, কখনো বা অর্ধেক কখনো বা সম্পূর্ণ নামিয়ে দেয় তখন সেটাকে আমি ঔদ্ধত্য বলে মনে করি।
প্রাণের যোগ নয় তো কী। সূর্যের আলোর ধারা তো আমাদের নাড়ীতে নাড়ীতে বইছে। আমাদের প্রাণমন, আমাদের রূপরস, সবই তো উৎসরূপে রয়েছে ওই মহাজ্যোতিষ্কের মধ্যে। সৌরজগতের সমস্ত ভাবীকাল একদিন তো পরিকীর্ণ হয়ে ছিল ওরই বহ্নিবাষ্পের মধ্যে। আমার দেহের কোষে কোষে ওই তেজই তো শরীরী, আমার ভাবনার তরঙ্গে তরঙ্গে ওই আলোই তো প্রবহমান। বাহিরে ওই আলোরই বর্ণচ্ছটায় মেঘে মেঘে পত্রে পুষ্পে পৃথিবীর রূপ বিচিত্র; অন্তরে ওই তেজই মানসভাব ধারণ করে আমাদের চিন্তায় ভাবনায় বেদনায় রাগে অনুরাগে রঞ্জিত। সেই এক জ্যোতিরই এত রঙ, এত রূপ, এত ভাব, এত রস। ওই যে-জ্যোতি আঙুরের গুচ্ছে গুচ্ছে এক-এক চুমুক মদ হয়ে সঞ্চিত সেই জ্যোতিই তো আমার গানে গানে সুর হয়ে পুঞ্জিত হল। এখনই আমার চিত্ত হতে এই যে চিন্তা ভাষার ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে, সে কি সেই জ্যোতিরই একটি চঞ্চল চিন্ময়স্বরূপ নয় যে-জ্যোতি বনস্পতির শাখায় শাখায় স্তব্ধ ওঙ্কারধ্বনির মতো সংহত হয়ে আছে।
হে সূর্য, তোমারই তেজের উৎসের কাছে পৃথিবীর অন্তর্গূঢ় প্রার্থনা ঘাস হয়ে, গাছ হয়ে আকাশে উঠছে, বলছে, জয় হোক! বলছে, অপাবৃণু, ঢাকা খুলে দাও! এই ঢাকা-খোলাই তার প্রাণের লীলা, এই ঢাকা-খোলাই তার ফুলফলের বিকাশ। অপাবৃণু, এই প্রার্থনারই নির্ঝরধারা আদিম জীবাণু থেকে যাত্রা করে আজ মানুষের মধ্যে এসে উপস্থিত, প্রাণের ঘাট পেরিয়ে চিত্তের ঘাটে পাড়ি দিয়ে চলল। আমি তোমার দিকে বাহু তুলে বলছি, হে পূষন্, হে পরিপূর্ণ, অপাবৃণু, তোমার হিরন্ময় পাত্রের আবরণ খোলো, আমার মধ্যে যে গুহাহিত সত্য তোমার মধ্যে তার অবারিত জ্যোতিঃস্বরূপ দেখে নিই। আমার পরিচয় আলোকে আলোকে উদ্ঘাটিত হোক।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৪
২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪
আজ মেঘ সম্পূর্ণ কেটে গেছে। আলোকের দাক্ষিণ্য আজ আকাশের বিস্তীর্ণ, রৌদ্রচকিত সমুদ্রের তরঙ্গে তরঙ্গে আজ আমন্ত্রণের ইঙ্গিত। সুরলোকের আতিথ্য থেকে আজ একটুও বঞ্চিত হতে ইচ্ছা করছে না।
আজকের দিনে কি ডায়ারি লিখতে একটুও মন সরে। ডায়ারি লেখাটা কৃপণের কাজ। প্রতিদিন থেকে ছোটোবড়ো কিছুই নষ্ট না হোক, সমস্তই কুড়িয়ে-কুড়িয়ে রাখি, এই ইচ্ছে ওতে প্রকাশ পায়। কৃপণ এগতে চায় না। আগলাতে চায়।
বিধাতা আমাকে মস্ত একটি বর দিয়েছেন, সে হচ্ছে আমার অসামান্য বিস্মরণশক্তি। সংবাদের ভাণ্ডারঘরের জিম্মে তিনি আমার হাতে দেন নি। প্রহরীর কাজ আমার নয়; আমাকে আমার মনিব প্রহরে প্রহরে ভুলে যাবার অধিকার দিয়েছেন।
ভুলে যেতে দেওয়া যদি হারিয়ে যেতে দেওয়া হত তা হলে তিনি তেমন বিষম ভুল করতেন না। বসন্ত বারে বারেই তার ফুলের সমারোহ ভুলে গিয়ে শূন্যসাজি হাতে অন্যমনস্ক হয়ে উত্তরের দিকে চলে যায়; সেই ভুলের ফাঁকা রাস্তা দিয়েই ফুলের দল তাদের নবজন্মের সিংহদ্বার খোলা পায়। আমার চৈতন্যের উপরে তলায় আমি এত বেশি ভুলি যে, তাতে আমার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় ভারি অসুবিধা হয়। কিন্তু, আমার ভোলা সামগ্রীগুলো চৈতন্যের রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে নীচের তলায় নেপথ্যে এসে জড়ো হয়; সেখানে নতুন-নতুন বেশপরিবর্তনের সুযোগ ঘটে। আমার মনটাকে বিধাতা নাট্যশালা করতে ইচ্ছা করেছেন, তাকে তিনি জাদুঘর বানাতে চান না। তাই, জমা করে পাওয়া আমার লোকসান, হারিয়ে হারিয়ে পাওয়াই আমার লাভ। এই হারিয়ে-যাওয়ার ভিতর দিয়ে এক যখন আর সেজে এসে হাজির হয় তখন তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিওয়ালা বৈজ্ঞানিক যদি সওয়ালজবাব করতে শুরু করে, তা হলে মুশকিল। তখন বিশ্লেষণের চোটে বেরিয়ে পড়তে পারে, যেটাকে নতুন বলছি সেটা পুরোনো, যেটাকে আমার বলছি সেটা আর-কারো। কিন্তু, সৃষ্টির তো এই লীলা, এই জন্যে তো তাকে মায়া বলে। কড়া পাহারা বসিয়ে শিশিরবিন্দুর যদি আঁচল ঝাড়া দেওয়া যায় তা হলে বেরিয়ে পড়বে দুটো অদ্ভুত বাষ্প, তাদের নাম যেমন কর্কশ তাদের মেজাজও তেমনি রাগী। কিন্তু, শিশির তবুও স্নিগ্ধ শিশির, তবুও সে অশ্রুজলের মতোই মধুর।
কথায় কথায় কথা বেড়ে যায়। বলতে যাচ্ছিলুম, ডায়ারি লেখাটা আমার স্বভাব-সংগত নয়। আমি ভোলানাথের চেলা, ঝুলি বোঝাই করে আমি তথ্য সংগ্রহ করি নে। আমার জলাশয়ের যে-জলটাকে অন্যমনস্ক হয়ে উবে যেতে দিই সেইটেই অদৃশ্য শূন্যপথে মেঘ হয়ে আকাশে জমে, নইলে আমার বর্ষণ বন্ধ।
তা ছাড়া, আমার ব্যক্তিগত জীবনের সব সত্যকেই আমি একটিমাত্র সরকারি বাটখারা দিয়ে ওজন করতে চাই নে। কিন্তু, বিশেষ ঘটনার বিশেষ তুলাদণ্ড তৈরি হয়ে উঠতে সময় লাগে। ঘটনা যখনই ঘটে তখনই সেটাকে পাওয়া যায় না। তখন সরকারি পরিমাপের আদর্শ যেটাকে দেখায় ভারী সেটাই হয়তো হালকা, যেটাকে বুঝি হালকা সেটাই হয়তো ভারী। দীর্ঘকালে আনুষঙ্গিক অনেক বাজে জিনিস ভুলে যাওয়ার ভিতর দিয়েই বিশেষ জিনিসের বিশেষ ওজন পাওয়া যায়।
যারা জীবনচরিত লেখে তারা সমসাময়িক খাতাপত্র থেকে অতিবিশ্বাসযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করে লেখে; সেই অচল সংবাদগুলো নিজেকে না কমাতে না বাড়াতে পারে। অথচ, আমাদের প্রাণপুরুষ তার তথ্যগুলোকে পদে পদে বাড়িয়ে-কমিয়েই এগিয়ে চলেছে। অতিবিশ্বাসযোগ্য তথ্য স্তূপাকার করে তা দিয়ে স্মরণস্তম্ভ হতে পারে, কিন্তু জীবনচরিত হবে কী করে। জীবনচরিত থেকে যদি বিস্মরণধর্মী জীবনটাই বাদ পড়ে তা হলে মৃতচরিতের কবরটাকে নিয়ে হবে কী। আমি যদি বোকামি করে প্রতিদিনের ডায়ারি লিখে যেতুম তা হলে তাতে করে হত আমার নিজের স্বাক্ষরে আমার নিজের জীবনের প্রতিবাদ। তা হলে আমার দৈনিক জীবনের সাক্ষ্য আমার সমগ্র-জীবনের সত্যকে মাটি করে দিত।
যে-যুগে রিপোর্টার ছিল না, মানুষ খবরের কাগজ বের করে নি, তখন মানুষের ভুলে যাবার স্বাভাবিক শক্তি কোনো কৃত্রিম বাধা পেত না। তাই তখনকার কালের মধ্যে থেকেই মানুষ আপন চিরস্মরণীয় মহাপুরুষদের পেয়েছে। এখন হতে আমরা তথ্য কুড়ুনে তীক্ষ্ণবুদ্ধি বিচারকদের হাত থেকে প্রতিদিনের মানুষকে পাব, চিরদিনের মানুষকে সহজে পাব না। বিস্মরণের বৃহৎ ভিতের উপর স্থাপিত মহাসিংহাসনেই কেবল যাঁদের ধরে, সর্বসাধারণের ঠাসাঠাসি ভিড়ে তাঁদের জন্যে জায়গা হবে না। এখন ক্যামেরাওয়ালা, ডায়ারিওয়ালা, নোটটুক্নেওয়ালা অত্যন্ত সতর্ক হয়ে চারি দিকেই মাচা বেঁধে ব’সে।
ছেলেবেলায় আমাদের অন্তঃপুরের যে-বাগানে বিশ্বপ্রকৃতি প্রত্যহই এক-একটি সূর্যোদয়কে তার নীল থালায় সাজিয়ে এক-একটি বিশেষ উপহারের মতো আমার পুলকিত হৃদয়ের মাঝখানে রেখে দিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসত, ভয় আছে, একদিন আমার কোনো ভাবী চরিতকার ক্যামেরা হাতে সেই বাগানের ফোটোগ্রাফ নিতে আসবে। সে অরসিক জানবেই না, সে-বাগান সেইখানেই যেখানে আছে ইদেনের আদিম স্বর্গোদ্যান। বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের প্রতি উদাসীন আর্টিস্ট সেই স্বর্গে যেতেও পারে, কিন্তু কোনো ক্যামেরাওয়ালার সাধ্য নেই সেখানে প্রবেশ করে–দ্বারে দেবদূত দাঁড়িয়ে আছে জ্যোর্তিময় খড়গ হাতে।
এত বুদ্ধি যদি আমার, আর এত ভয়, তবে কেন ডায়ারি লিখতে বসেছি। সে-কথা কাল বলব।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৫
২৮শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪
যখন কলম্বোতে এসে পৌঁছলুম বৃষ্টিতে দিগ্দিগন্তর ভেসে যাচ্ছে। গৃহস্থের ঘরে যেদিন শোকের কান্না, যেদিন লোকসানের আলোড়ন, সেদিন তার বাড়িতে আগন্তুকদের অধিকার থাকে না। কলম্বোয় অশান্ত আকাশের আতিথ্য সেদিন আমার কাছে তেমনি সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল; মনটা নিজেকে বেশ মেলে দিয়ে বসবার জায়গা পাচ্ছিল না। বাহির জগতের প্রথম গেটটার কাছেই অভ্যর্থনার ঔদার্যের অভাব দেখে মনে হল, আমার নিমন্ত্রণের ভূমিকাতেই কোন্ কুগ্রহ এমন করে কালি ঢেলে দিলে। দরজাটা খোলা থাকলে হবে কী, নিমন্ত্রণকর্তার মুখে যে হাসি নেই।
এমন সময়ে এই বিমর্ষ দিনের বিমুখতার মধ্যে একটি বাঙালি ঘরের বালিকার একখানি চিঠি পাওয়া গেল। এই বালিকাই কিছুকাল পূর্বে আমার শিলঙবাসের একটি পদ্যময় বর্ণনার জরুরি দাবি করে তাড়া দিয়েছিল। সে দাবি আমি অগ্রাহ্য করি নি। এবার সে আমার এই প্রবাসযাত্রায় মঙ্গলকামনা জানিয়েছে। মনে হল, বাঙালি মেয়ের এই শুভ-ইচ্ছা আমার আজকের দিনের এই বদ্মেজাজি ভাগ্যটাকে অনুকূল করে তুলবে।
পুরুষের আছে বীর্য আর মেয়েদের আছে মাধুর্য, এ কথাটা সব দেশেই প্রচলিত। আমরা তার সঙ্গে আরো একটা কথা যোগ করেছি, আমরা বলি মেয়েদের মধ্যে মঙ্গল। অনুষ্ঠানের যে সকল আয়োজন, যে-সকল চিহ্ন শুভ সূচনা করে, আমাদের দেশে তার ভার মেয়েদের উপর। নারীশক্তিতে আমরা মধুরের সঙ্গে মঙ্গলের মিলন অনুভব করি। প্রবাসে যাত্রায় বাপের চেয়ে মায়ের আশীর্বাদের জোর বেশি ব’লে জানি। মনে হয়, যেন ঘরের ভিতর থেকে মেয়েদের প্রার্থনা নিয়ত উঠছে দেবতার কাছে, ধূপপাত্র থেকে সুগন্ধি ধূপের ধোঁয়ার মতো। সে-প্রার্থনা তাদের সিঁদুরের ফোঁটায়, তাদের কঙ্কণে, তাদের উলুধ্বনি-শঙ্খধ্বনিতে, তাদের ব্যক্ত এবং অব্যক্ত ইচ্ছায়। ভাইয়ের কপালে মেয়েরাই দেয় ভাইফোঁটা। আমরা জানি, সাবিত্রীই মৃত্যুর হাত থেকে স্বামীকে ফিরিয়েছিল, নারীর প্রেমে পুরুষের কেবল যে আনন্দ তা নয়, তার কল্যাণ।
তার মানে, আমরা একরকম ক’রে এই বুঝেছি, প্রেম জিনিসটা কেবল যে একটা হৃদয়ের ভাব তা নয়, সে একটা শক্তি, যেমন শক্তি বিশ্বের ভারাকর্ষণ। সর্বত্রই সে আছে। মেয়েদের প্রেম সেই বিশ্বশক্তিকে সহজে নাড়া দিতে পারে। বিষ্ণুর প্রকৃতিতে যে-প্রেমের শক্তি বিশ্বকে পালন করছে সেই শক্তিই তো লক্ষ্মী, বিষ্ণুর প্রেয়সী। লক্ষ্মী সম্বন্ধে আমাদের মনে যে ভাবকল্পনা আছে তাকে আমরা প্রত্যক্ষ দেখি নারীর আদর্শে।
লক্ষ্মীতে সৌন্দর্য হচ্ছে পরিপূর্ণতার লক্ষণ। সৃষ্টিতে যতক্ষণ দ্বিধা থাকে ততক্ষণ সুন্দর দেখা দেয় না। সামঞ্জস্য যখন সম্পূর্ণ হয় তখনই সুন্দরের আবির্ভাব।
পুরুষের কর্মপথে এখনো তার সন্ধানচেষ্টার শেষ হয় নি। কোনো কালেই হবে না। অজানার মধ্যে কেবলই সে পথ খনন করছে, কোনো পরিণামের প্রান্তে এসে আজও সে অবকাশ পেলে না। পুরুষের প্রকৃতিতে সৃষ্টিকর্তার তুলি আপন শেষ রেখাটা টানে নি। পুরুষকে অসম্পূর্ণই থাকতে হবে।
নারীপ্রকৃতি আপনার স্থিতিতে প্রতিষ্ঠ। সার্থকতার সন্ধানে তাকে দুর্গম পথে ছুটতে হয় না। জীবপ্রকৃতির একটা বিশেষ অভিপ্রায় তার মধ্যে চরম পরিণতি পেয়েছে। সে জীবধাত্রী, জীবপালিনী; তার সম্বন্ধে প্রকৃতির কোনো দ্বিধা নেই। প্রাণসৃষ্টি প্রাণপালন ও প্রাণতোষণের বিচিত্র ঐশ্বর্য তার দেহে মনে পর্যাপ্ত। এই প্রাণসৃষ্টি-বিভাগে পুরুষের প্রয়োজন অত্যল্প, এইজন্যে প্রকৃতির একটা প্রবল তাগিদ থেকে পুরুষ মুক্ত। প্রাণের ক্ষেত্রে ছুটি পেয়েছে ব’লেই চিত্তক্ষেত্রে সে আপন সৃষ্টিকার্যের পত্তন করতে পারলে। সাহিত্যে কলায় বিজ্ঞানে দর্শনে ধর্মে বিধিব্যবস্থায় মিলিয়ে যাকে আমরা সভ্যতা বলি সে হল প্রাণপ্রকৃতির পলাতক ছেলে পুরুষের সৃষ্টি।
তানের বেগে চঞ্চল গান তার সুরসঙ্ঘের প্রবাহ বহন করে ছোটবার সময় যেমন নিজের কল্যাণের জন্যেই একটা মূল লয়ের মূল সুরের স্থিতির দিকে সর্বদাই ভিতরে ভিতরে লক্ষ্য রাখে, তেমনি গতিবেগমত্ত পুরুষের চলমান সৃষ্টি সর্বদাই স্থিতির একটা মূল সুরকে কানে রাখতে চায়; পুরুষের শক্তি তার অসমাপ্ত সাধনার ভার বহন ক’রে চলবার সময় সুন্দরের প্রবর্তনার অপেক্ষা রাখে। সেই স্থিতির ফুলই হচ্ছে নারীর মাধুর্য, সেই স্থিতির ফলই হচ্ছে নারীর মাঙ্গল্য, সেই স্থিতির সুরই হচ্ছে নারীর শ্রীসৌন্দর্য।
নারীর ভিতর দিয়ে বিচিত্র রসময় প্রাণের প্রবর্তনা যদি পুরুষের উদ্যমের মধ্যে সঞ্চারিত হবার বাধা পায় তা হলেই তার সৃষ্টিতে যন্ত্রের প্রাধান্য ঘটে। তখন মানুষ আপনার সৃষ্ট যন্ত্রের আঘাতে কেবলই পীড়া দেয়, পীড়িত হয়।
এই ভাবটা আমার রক্তকরবী নাটকের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। যক্ষপুরে পুরুষের প্রবল শক্তি মাটির তলা থেকে সোনার সম্পদ ছিন্ন করে আনছে। নিষ্ঠুর সংগ্রহের লুব্ধ চেষ্টার তাড়নায় প্রাণের মাধুর্য সেখান থেকে নির্বাসিত। সেখানে জটিলতার জালে আপনাকে আপনি জড়িত করে মানুষ বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই সে ভুলেছে, সোনার চেয়ে আনন্দের দাম বেশি; ভুলেছে, প্রতাপের মধ্যে পূর্ণতা নেই, প্রেমের মধ্যেই পূর্ণতা। সেখানে মানুষকে দাস করে রাখবার প্রকাণ্ড আয়োজনে মানুষ নিজেকেই নিজে বন্দী করেছে।
এমন সময়ে সেখানে নারী এল, নন্দিনী এল; প্রাণের বেগ এসে পড়ল যন্ত্রের উপর; প্রেমের আবেগ আঘাত করতে লাগল লুব্ধ দুশ্চেষ্টার বন্ধনজালকে। তখন সেই নারীশক্তির নিগূঢ় প্রবর্তনায় কী করে পুরুষ নিজের রচিত কারাগারকে ভেঙে ফেলে প্রাণের প্রবাহকে বাধামুক্ত করবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হল, এই নাটকে তাই বর্ণিত আছে।
যে কথাটা বলতে শুরু করেছিলুম সে হচ্ছে এই যে পুরুষের অধ্যবসায়ের কোথাও সমাপ্তি নেই, এইজন্যেই সুসমাপ্তির সুধারসের জন্যে তার অধ্যবসায়ের মধ্যে একটা প্রবল তৃষ্ণা আছে। মেয়েদের হৃদয়ের মাধুর্য এই রসই তাকে পান করায়। পুরুষের সংসারে কেবলই চিন্তার দ্বন্দ্ব, সংশয়ের দোলা, তর্কের সংঘাত, ভাঙাগড়ার আবর্তন–এই নিরন্তর প্রয়াসে তার ক্ষুব্ধ দোলায়িত চিত্ত প্রাণলোকের সরল পরিপূর্ণতার জন্যে ভিতরে ভিতরে উৎসুক হয়ে থাকে। মেয়েদের মধ্যে সেই প্রাণের লীলা। বাতাসে লতার আন্দোলনের মতো, বসন্তের নিকুঞ্জে ফুল ফোটবার মতোই এই লীলা সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত; চিন্তাক্লিষ্ট চিত্তের পক্ষে পূর্ণতার এই প্রাণময়ী মূর্তি নিরতিশয় রমণীয়। এই সুসমাপ্তির সৌন্দর্য, এই প্রাণের সহজ বিকাশ পুরুষের মনে কেবল যে তৃপ্তি আনে তা নয়, তাকে বল দেয়, তার সৃষ্টিকে অভাবনীয় রূপে উদ্ঘাটিত করে দিতে থাকে। আমাদের দেশে এইজন্যে পুরুষের সাধনায় মেয়েকে শক্তি বলে স্বীকার করে। কর্মের প্রকাশ্য ক্ষেত্রে এই শক্তিকে দেখি নে; ফুলকে দেখি প্রত্যক্ষ কিন্তু যে গূঢ় শক্তিতে সেই ফুল ফোটায় তাকে কোথাও ধরা-ছোঁওয়া যায় না। পুরুষের কীর্তিতে মেয়ের শক্তি তেমনি নিগূঢ়।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৬
২৯শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪
যে-মেয়েটি আমাকে শুভ-ইচ্ছা জানিয়ে চিঠি লিখেছিল তার চিঠিতে একটি অনুরোধ ছিল, “আপনি ডায়ারি লিখবেন।” তখনই জবাব দিলুম, “না, ডায়ারি লিখব না।” কিন্তু, মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে গেছে ব’লেই যে সেই কথাটা অটল সত্যের গৌরব লাভ করবে এতবড়ো অহংকার আমার নেই।
তার পর চব্বিশে তারিখে জাহাজে উঠলুম। বাদলার হাওয়া আরো যেন রেগে উঠল; সে যেন একটা অদৃশ্য প্রকাণ্ড সাপের মতো জাহাজটার উপর ক্ষণে-ক্ষণে ছোবল মেরে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। যখন দেখলুম দুর্দৈবের ধাক্কায় মনটা হার মানবার উপক্রম করছে তখন তেড়ে উঠে বললুম, “না, ডায়ারি লিখবই।” কিন্তু, লেখবার আছে কী। কিছুই না, যা-তা লিখতে হবে। সকল লেখার সেরা হচ্ছে যা-তা লেখা। যথেচ্ছারের অধিকার রাজার অধিকার।
বিশেষ কোনো-একজনকে চিঠি লেখবার একটা প্রচ্ছন্ন বীথিকা যদি সামনে পাওয়া যেত তা হলে তারই নিভৃতছায়ার ভিতর দিয়ে আমার নিরুদ্দেশ বাণীকে অভিসারে পাঠাতুম। কিন্তু সে-বীথিকা আজ নেই। তাই অপরিচিত ক্যাবিনে আলো জ্বেলে নিজের কাছেই নিজে বকতে বসলুম। আলাপের এই অদ্বৈতরূপ আমার পছন্দসই নয়। সংসারে যখন মনের মতো দ্বৈত দুর্লভ হয়ে ওঠে তখনই মানুষ অদ্বৈতসাধনায় মনকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। কারণ, সকলের চেয়ে দুর্বিপাক হচ্ছে অ-মনের মতো দ্বৈত।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৭
হারুনা-মারু জাহাজ, ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪
আমার ডায়ারিতে মেয়ে-পুরুষের কথা নিয়ে যে-আলোচনা ছিল সে সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠেছে এই যে, “আচ্ছা বোঝা গেল যে, প্রাণের টানে মেয়ে আটকা পড়েছে আর পুরুষ ছুটেছে মনের তাড়ায়। তার পরে, তারা যে-প্রেমে মেলে সেটা কি ঠিক একজাতের।”
গোড়াতেই বলে রাখা ভালো যে, প্রাণই বল আর মনই বল, মেয়ে কিম্বা পুরুষের একেবারে নিজস্ব দখলে নেই। অবস্থাগতিকে পক্ষভেদে একটা মুখ্য, অন্যটা গৌণ।
মন জিনিসটা প্রাণের ঘরেই মানুষ, প্রাণের অন্ন খেয়ে; সেই জন্যেই অন্তরে অন্তরে তার একটা অকৃতজ্ঞতা আছে। প্রাণের আনুগত্য ছাড়িয়ে একাধিপত্য করবার জন্যে সে প্রায় মাঝে মাঝে আস্ফালন করে। এই বিদ্রোহটা ভিতরে ভিতরে কম বেশি পরিমাণে প্রায় সব পুরুষের মধ্যেই আছে। প্রাণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে তার কিছু-না-কিছু কসরত এবং কুচকাওয়াজ চলছেই। খামকা প্রাণটাকে ক্লিষ্ট করবার, বিপন্ন করবার লোভ পুরুষের। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার শখটা পুরুষের; তার একমাত্র কারণ ঘরের খাওয়াতে তাকে প্রাণের শাসন মানতে হয় কিন্তু বনের মোষ তাড়ানোতে, প্রাণের প্রতি তার যে রাজভক্তি নেই, এইটে প্রচার করবার একটা উপলক্ষ জোটে–সেটাকে সে পৌরুষ মনে করে। পুরুষ যুদ্ধ করে এসেছে সব সময়ে যে প্রয়োজন আছে বলে তা নয়, কেবল স্পর্ধা ক’রে এইটে দেখাবার জন্যে যে, প্রাণের তাগিদকে সে গ্রাহ্যই করে না। এই জন্যে যুদ্ধ করার মতো এত বড়ো একটা গোঁয়ারের কাজকে পুরুষ চিরকালই অত্যন্ত বেশি সমাদর করেছে; তার কারণ এ নয় যে, হিংসা করাটাকে সে ভালো মনে করে; তার কারণ এই যে, নানাপ্রকার লোভের ও ভয়ের বন্ধনে প্রাণ তাঁকে বেঁধে রাখবার যে বিস্তৃত আয়োজন করে রেখেছে সেইটেকে সে বিনা প্রয়োজনেও অস্বীকার করতে পারলে গর্ব বোধ করে। আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের একটি শিশু বালক আছে, তাকে দেখি, আমাদের বাড়িতে যে-জায়গাটা স্থিতির পক্ষে সবচেয়ে অযোগ্য, পৃথিবীর ভারাকর্ষণশক্তিটাকে অশ্রদ্ধা জানানো ছাড়া যেখানে ওঠবার আর কোনো হেতুই নেই, সেইখানেই সে চড়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে ভারাকর্ষণশক্তিও তাকে ছেড়ে কথা কয় নি, কিন্তু তবু তাকে দমিয়ে দিতে পারলে না। এমনি করে বিদ্রোহে সে হাত পাকাচ্ছে আর-কি।
মনে আছে, ছেলেবেলায় আমাদের তেতালার ছাদের সংকীর্ণ কার্নিসটার উপর দিয়ে চলে যাওয়াটাকে উঁচুদরের খেলা বলে মনে করতুম। ভয় করত না বলে নয়, ভয় করত বলেই। ভয় নামক প্রাণের পাহারাওয়ালাটা ঠিক সেই মোড়ের মাথায় দেখা দিত বলেই তাকে ব্যঙ্গ করাটা মজা বলে মনে হত।
পুরুষের মধ্যে এই যে কাণ্ডটা হয়, এ সমস্তই মনের চক্রান্তে। সে বলে, “প্রাণের সঙ্গে আমার নন্-কো-অপারেশন যতই পাকা হবে ততই আমার মুক্তি হবে সহজ।” কেন রে বাপু, প্রাণ তোমার কী অপরাধটা করেছে, আর এই মুক্তি নিয়েই বা করবে কী। মন বলে, “আমি অশেষের রাজ্যে সন্ধান করতে বেরব, আমি দুঃসাধ্যের সাধনা করব, দুর্গমের বাধা কাটিয়ে দিয়ে দুলর্ভকে উদ্ধার করে আনব। আমি একটু নড়ে বসতে গেলেই যে-দুঃশাসন নানারকম ভয় দেখিয়ে আমাকে পিছমোড়া করে বাঁধতে আসে তাকে আমি সম্পূর্ণ হার মানাব তবে ছাড়ব।” তাই পুরুষ তপস্বী বলে বসে, “না খেয়েই বা বাঁচা যাবে না কেন। নিশ্বাস বন্ধ করলেই যে মরতে হবে, এমন কী কথা আছে।” শুধু তাই নয়, এর চেয়েও শক্ত কথা বলে; বলে, “মেয়েদের মুখ দেখব না। তারা প্রকৃতির গুপ্তচর, প্রাণরাজত্বের যতসব দাস সংগ্রহ করবার তারাই আড়কাঠি।” যে-সব পুরুষ তপস্বী নয় শুনে তারাও বলে, “বাহবা!”
প্রকৃতিস্থ অবস্থায় সাধারণত কোনো মেয়ের দল বলে না, পুরুষকে সম্পূর্ণ বর্জন করাটাই তাদের জীবনের চরম এবং মহোচ্চ লক্ষ্য। সম্প্রতি কোথাও কোথাও কখনো এমন কথার আভাস শোনা যায়, কিন্তু সেটা হল আস্ফালন। প্রাণের রাজ্যে মেয়েদের যে চিরকেলে স্থান আছে সেখানকার বন্দরের নোঙর ছিঁড়ে মনটাকে নিয়ে তারা নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, এমন কথা দুই-একজন মেয়ে বলতেও পারে; কারণ, যাত্রারম্ভে ভাগ্যদেবতা যখন জীবনের সম্বল স্ত্রীপুরুষের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দেয় তখন প্যাক করবার সময় কিছু যে উলটোপালটা হয় না, তা নয়।
আসল কথা হচ্ছে, প্রকৃতির ব্যবস্থায় মেয়েরা একটা জায়গা পাকা করে পেয়েছে, পুরুষরা তা পায় নি। পুরুষকে চিরদিন জায়গা খুঁজতে হবে। খুঁজতে খুঁজতে সে কত নতুনেরই সন্ধান পাচ্ছে কিন্তু চরমের আহ্বান তাকে থামতে দিচ্ছে না, বলছে, “আরো এগিয়ে এসো।”
একজায়গায় এসে যে পৌঁচেছে তার একরকমের আয়োজন, আর যাকে চলতে হবে তার আর-একরকমের। এ তো হওয়াই চাই। স্থিতি যে পেয়েছে বসে বসে ক্রমে ক্রমে চারি দিকের সঙ্গে আপন সম্বন্ধকে সে সত্য করতে, পূর্ণ করতে চেষ্টা করে। কেননা, সম্বন্ধ সত্য হলেই তবেই তার মধ্যে মুক্তি পাওয়া যাবে। যার সঙ্গে ঘর করতে হচ্ছে তার সঙ্গে যদি কেবলই খিটিমিটি বাধতে থাকে তা হলে তার মতো জীবনের বাধা আর কিছু নেই। যদি ভালোবাসা হয় তা হলেই তার সঙ্গে সম্বন্ধের মধ্যে মুক্তি ঘটে। সে মুক্তি বাইরের সমস্ত দুঃখ-অভাবের উপর জয়ী হয়। এইজন্যেই মেয়ের জীবনে সকলের চেয়ে বড়ো সার্থকতা হচ্ছে প্রেমে। এই প্রেমে সে স্থিতির বন্ধনরূপ ঘুচিয়ে দেয়; বাইরের অবস্থার সমস্ত শাসনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
মুক্তি না হলে কর্ম হতে পারে কিন্তু সৃষ্টি হতে পারে না। মানুষের মধ্যে সকলের চেয়ে চরমশক্তি হচ্ছে সৃষ্টিশক্তি। মানুষের সত্যকার আশ্রয় হচ্ছে আপনার সৃষ্টির মধ্যে; তার থেকে দৈন্যবশত যে বঞ্চিত সে “পরাবসথশায়ী’। মেয়েকেও সৃষ্টি করতে হবে, তবে সে আপনার বাসা পাবে। তার পক্ষে এই সৃষ্টি প্রেমের দ্বারাই সম্ভব। যে-পুরুষসন্ন্যাসী নিজের কৃচ্ছ্রসাধনের প্রবল দম্ভে মনে করে যে, যেহেতু মেয়েরা সংসারে থাকে এই জন্যে তাদের মুক্তি নেই, সে সত্যকে জানে না। যে মেয়ের মধ্যে সত্য আছে সে আপন বন্ধনকে স্বীকার করেই প্রেমের দ্বারা তাকে অতিক্রম করে; বন্ধনকে ত্যাগ করার চেয়ে এই মুক্তি বড়ো। সব মেয়েই যে তার জীবনের সার্থকতা পায় তা নয়; সব পুরুষই কি পায়। অনুরাগের সত্যশক্তি সব মেয়ের নেই, বৈরাগ্যের সত্যশক্তি সব পুরুষে মেলে না।
কিন্তু, অন্তত আমাদের দেশে দেখা যায়, পুরুষ সাধক সংসারকে বন্ধনশালা বলেই জানে; তার থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে বহুদূরে পালিয়ে যাওয়াকেই মুক্তির উপায় মনে করে। তার মানে, আমরা যাকে সংসার বলি স্বভাবত সেটা পুরুষের সৃষ্টিক্ষেত্র নয়। এইজন্যে সেখানে পুরুষের মন ছাড়া পায় না। মেয়েরা যখনই মাতৃত্বের অধিকার পেয়েছে তখনই এমন-সকল হৃদয়বৃত্তি পেয়েছে যাতে করে সংসারের সঙ্গে সম্বন্ধস্থাপন তাদের পক্ষে সহজ হতে পারে। এই জন্যে যে-মেয়ের মধ্যে সেই হৃদয়বৃত্তির উৎকর্ষ আছে সে আপনার ঘরসংসারকে সৃষ্টি করে তোলে। এ সৃষ্টি তেমনই যেমন সৃষ্টি কাব্য, যেমন সৃষ্টি সংগীত, যেমন সৃষ্টি রাজ্যসাম্রাজ্য। এতে কত সুবুদ্ধি, কত নৈপুণ্য, কত ত্যাগ, কত আত্মসংযম পরিপূর্ণভাবে সম্মিলিত হয়ে অপরূপ সুসংগতি লাভ করেছে। বিচিত্রের এই সম্মিলন একটি অখণ্ডরূপের ঐক্য পেয়েছে; তাকেই বলে সৃষ্টি। এই কারণেই ঘরকন্নায় মেয়েদের এত একান্ত প্রয়োজন; নির্ভরের জন্যে নয়, আরামের জন্যে নয়, ভোগের জন্যে নয়–মুক্তির জন্যে। কেননা, আত্মপ্রকাশের পূর্ণতাতেই মুক্তি।
পূর্বেই বলেছি, মেয়েদের এই সৃষ্টির কেন্দ্রগত জ্যোতির উৎস হচ্ছে প্রেম। এই প্রেম নিজের স্ফূর্তির জন্যে, সার্থকতার জন্যে, যাকে চায় সেই জিনিসটি হচ্ছে মানুষের সঙ্গ। প্রেমের সৃষ্টিক্ষেত্র নিঃসঙ্গ নির্জনে হতেই পারে না, সে ক্ষেত্র সংসারে। ব্রহ্মার সৃষ্টিক্ষেত্র হতে পারে শূন্যে, কিন্তু বিষ্ণুর শক্তি খাটে লোকজগতে। নারীর সেই বিষ্ণুর শক্তি, তার সৃষ্টিতে ব্যক্তিবিশেষের প্রাধান্য; ব্যক্তিবিশেষের তুচ্ছতাও প্রেমের কাছে মূল্যবান। ব্যক্তিবিশেষের ছোটোবড়ো বিচিত্র দাবির সমস্ত খুঁটিনাটিতে সেই প্রেমের আত্মদানশক্তি নিজেকে বহুধারায় উন্মুক্ত করে। ব্যক্তিবিশেষের সেই নানা ক্ষুধার নানা চাওয়া মেয়ের প্রেমের উদ্যমকে কেবলই জাগিয়ে রেখে দেয়। যে-পুরুষ আপন দাবিকে ছোটো করে সে খুব ভালো লোক হতে পারে, কিন্তু মেয়েকে সে পীড়া দেয়, অপূর্ণ করে রাখে। এই জন্যে দেখা যায়, যে পুরুষ দৌরাত্ম্য করে বেশি মেয়ের ভালোবাস সেই পায় বেশি।
নারীর প্রেম যে-পুরুষকে চায় তাকে প্রত্যক্ষ চায়, তাকে নিরন্তর নানা আকারে বেষ্টন করবার জন্যে সে ব্যাকুল। মাঝখানে ব্যবধানের শূন্যতাকে সে সইতে পারে না। মেয়েরাই যথার্থ অভিসারিকা। যেমন করেই হোক, যত দুর্গমই হোক, বিচ্ছেদ পার হবার জন্য তাদের সমস্ত প্রাণ ছট্ফট করতে থাকে। এই জন্যেই সাধনারত পুরুষ মেয়ের এই নিবিড় সঙ্গবন্ধনের টান এড়িয়ে অতি নিরাপদ দূরত্বের মধ্যে পালাতে ইচ্ছা করে।
পূর্বেই বলেছি, আপন পূর্ণতার জন্যে প্রেম ব্যক্তিবিশেষকে চায়। এই ব্যক্তিবিশেষ জিনিসটি অত্যন্ত বাস্তব জিনিস। তাকে পেতে গেলে তার সমস্ত তুচ্ছ খুঁটিনাটির কোনোটাকে বাদ দেওয়া চলে না, তার দোষ-ত্রুটিকেও মেনে নিতে হয়। ব্যক্তিরূপের উপর ভাবের আবরণ টেনে দিয়ে তাকে অপরূপ করে তোলা প্রেমের পক্ষে অনাবশ্যক অভাবকে অসম্পূর্ণতাকে প্রেম কামনা করে, নইলে তার নিজের সম্পূর্ণতা সফল হবে কিসে।
দেবতার মনের ভাব ঠিকমতো জানি বলে অভিমান রাখি নে কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কার্তিকের চেয়ে গণেশের ‘পরে দুর্গার স্নেহ বেশি। এমনকি, লম্বোদরের অতি অযোগ্য ক্ষুদ্র বাহনটার ‘পরে কার্তিকের খোশপোশাকি ময়ূর লোভদৃষ্টি দেয় বলে তার পেখমের অপরূপ সৌন্দর্য সত্ত্বেও তার উপরে তিনি বিরক্ত; ওই দীনাত্মা ইঁদুরটা যখন তাঁর ভাণ্ডারে ঢুকে তাঁর ভাঁড়গুলোর গায়ে সিঁধ কাটতে থাকে তখন হেসে তিনি তাকে ক্ষমা করেন। শাস্ত্রনীতিজ্ঞ পুরুষবর নন্দী বলে, “মা, তুমি ওকে শাসন কর না, ও বড়ো প্রশ্রয় পাচ্ছে। দেবী স্নিগ্ধকণ্ঠে বলেন, “আহা, চুরি করে খাওয়াই যে ওর স্বধর্ম, তা ওর দোষ কী! ও যে চোরের দাঁত নিয়েই জন্মেছে, সে কি বৃথা হবে।”
বাক্যের অপূর্ণতাকে সংগীত যেমন আপন রসে পূর্ণ করে তোলে, প্রেম তেমনি সুযোগ্যতার অপেক্ষা করে না, অযোগ্যতার ফাঁকের মধ্যে সে নিজেকে ঢেলে দেবার সুযোগ পায়।
মেয়েদের সৃষ্টির আলো যেমন এই প্রেম তেমনি পুরুষের সৃষ্টির আলো কল্পনাবৃত্তি। পুরুষের চিত্ত আপন ধ্যানের দৃষ্টি দিয়ে দেখে, আপন ধ্যানের শক্তি দিয়ে গড়ে তোলে। We are the dreamers of dreams–এ কথা পুরুষের কথা। পুরুষের ধ্যানই মানুষের ইতিহাসে নানা কীর্তির মধ্যে নিরন্তর রূপপরিগ্রহ করছে। এই ধ্যান সমগ্রকে দেখতে চায় বলেই বিশেষের অতিবাহুল্যকে বর্জন করে; যে-সমস্ত বাজে খুঁটিনাটি নিয়ে বিশেষ সেইগুলো সমগ্রতার পথে বাধার মতো জমে ওঠে। নারীর সৃষ্টি ঘরে, এই জন্যে সব-কিছুকেই সে যত্ন করে জমিয়ে রাখতে পারে; তার ধৈর্য বেশি কেননা, তার ধারণার জায়গাটা বড়ো। পুরুষের সৃষ্টি পথে পথে, এই জন্যে সব-কিছুর ভার লাঘব করে দিয়ে সমগ্রকে সে পেতে ও রাখতে চায়। এই সমগ্রের তৃষ্ণা, এই সমগ্রের দৃষ্টি, নিমর্ম পুরুষের কত শত কীর্তিকে বহুব্যয়, বহুত্যাগ, বহু পীড়নের উপর স্থাপিত করেছে। পুরুষ অমিতব্যয়ী, সে দুঃসাহসিক লোকসানের ভিতর দিয়ে লাভ করতে কুণ্ঠিত হয় না। কারণ, তার ধ্যান সমস্ত লোকসানকে পেরিয়ে সমগ্র লাভটাকে সুস্পষ্ট দেখে; ছোটো ছোটো ক্ষতি তার কাছে নগণ্য হয়ে যায়। পুরুষের কল্পনাবৃত্তির সাহস এত অত্যন্ত বেশি তার কারণ, স্থিতির ক্ষেত্রে স্থির হয়ে বসে বিচিত্রের সহস্র খুঁটিনাটিকে মমত্বের আঁকড়ি দিয়ে জড়িয়ে ধরবার দীর্ঘ সময় তার কখনো ছিল না। এই জন্যে সৃষ্টির প্রয়োজনে প্রলয় করতে তার দ্বিধা নেই।
মোট কথা বাস্তবের মধ্যে যে-সব বিশেষের বাহুল্য আছে তাকে বাদ দিয়ে পুরুষ একের সম্পূর্ণতা খোঁজে। এই জন্যেই অধ্যাত্মরাজ্যে পুরুষেরই তপস্যা; এই জন্যে সন্ন্যাসের সাধনায় এত পুরুষের এত আগ্রহ। এবং এই জন্যেই ভাবরাজ্যের পুরুষের সৃষ্টি এত বেশি উৎকর্ষ এবং জ্ঞানরাজ্যের এত বেশি সম্পদ লাভ করেছে।
পুরুষের এই সমগ্রতার পিপাসা তার প্রেমেও প্রকাশ পায়। সে যখন কোনো মেয়েকে ভালোবাসে তখন তাকে একটি সম্পূর্ণ অখণ্ডতায় দেখতে চায় আপনার চিত্তের দৃষ্টি দিয়ে, ভাবের দৃষ্টি দিয়ে। পুরুষের কাব্যে বারবার তার পরিচয় পাওয়া যায়। শেলির এপিসিকীডিয়ন্ পড়ে দেখো। মেয়েরা এ কথা জানে। পুরুষের এই প্রার্থনা মেয়েদের বিশেষ করে সৃষ্টি করতে থাকে। কেননা, প্রার্থনার বেগ, প্রার্থনার তাপ, মানুষের সংসারে সৃষ্টি একটা প্রধান শক্তি। আমরা কী চাইব সেটা যদি ঠিকমতো ধরতে পারি তা হলে আমরা কী পাব সেটা নিয়ে ভাবতে হয় না। পুরুষেরা একরকম ক’রে চেয়ে চেয়ে মেয়েদের একরকম করে গড়ে তুলেছে। মেয়েরা আপনার জীবনে এত জায়গায় এত পর্দা খাটায় এই জন্যে; আপনার থেকে সে কত কী বাদ দিয়ে চলে। আমরা বলি লজ্জা স্ত্রীলোকের ভূষণ। তার মানে, লজ্জা হচ্ছে সেই বৃত্তি যাতে করে মেয়েরা আপনার বাস্তবের বাহুল্যকে সরিয়ে রাখে; মেয়ের রাজ্যে এই জন্যে মস্ত একটা অগোচরতার ব্যবস্থা আছে। সে আপনার এতখানি বাকি রেখেছে যা পুরুষ আপনার মন দিয়ে পুরিয়ে নিতে পারে। সে আপনার যাওয়া-শোওয়া, চাল-চলন, বাসনা-সাধনা, সমস্ত থেকেই অতিবাস্তবের প্রত্যক্ষতা এতটা পরিমাণে ঢাকা দেয় যাতে পুরুষের ভাবের মধ্যে তার ছবি সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে বাধা না পায়।
মেয়েদের সঙ্গে পুরুষের ব্যবহারে সম্পূর্ণ এর উলটো দিকটাও দেখা যায়। পুরুষ কখনো কখনো এমন কাণ্ড করে যেন নারীর মধ্যে অনির্বচনীয়তার কোনো আভাস নেই, যেন তার মাটির প্রদীপে কোনো আলোই জ্বলে নি; তখন লুব্ধ দাঁত দিয়ে তাকে সে আখের মতো চিবিয়ে আবর্জনার মধ্যে ফেলে দেয়। সাত্ত্বিকের ঠিক উলটোপিঠেই থাকে তামসিক, পূর্ণিমারই অন্য পারে অমাবস্যা। রাস্তার এ দিকটাতে যে সত্য থাকে ঠিক তার সামনের দিকেই তার বিপরীতের বাসা। ফেউ সাক্ষ্য দেয় বাঘেরই অস্তিত্বের। সেই একই কারণে মেয়ে সংসারস্থিতির লক্ষ্মী, আবার সংসার ছারখার করবার প্রলয়ংকরীও তার মতো কেউ নেই।
যা হোক, এটা দেখা যাচ্ছে, সর্বত্রই সর্বকালেই মেয়ে নিজের চারদিকেই একটা বিচিত্র চিত্রখচিত বেড়ার দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে। দুর্গমকে পার হবার জন্যে পুরুষের যে স্বাভাবিক অধ্যবসায় আছে সেইটেকে যতটা পারে সে জাগরূক করে রাখে। পড়ে-পাওয়া জিনিস মূল্যবান হলেও তাতে পুরুষের তৃপ্তি নেই; যাকে সে জয় করে পায় তাকেই সে যথার্থ পায় বলে জানে; কেননা, জয় করে পাওয়া হচ্ছে মন দিয়ে পাওয়া। এই জন্যে অনেক ছল-যুদ্ধের আয়োজনে মেয়েদের সময় কাটে।
নীতিনিপুণ বলে বসবে, এই মায়া তো ভালো নয়। পুরুষ নিজেই চিরকাল ধরে দাবি করলে এই মায়াকে; এই মায়াসৃষ্টির বড়ো বড়ো উপকরণ সে জুগিয়ে দিলে নিজের কল্পরাজ্য থেকে; কবিরা চিত্রীরা মিলে নারীর চারদিকে রঙবেরঙের মায়ামণ্ডল আপন ইচ্ছায় বানিয়ে দিলে–অবশেষে এই মায়ার কাছে পরাভবশঙ্কায় ত্রস্ত সাধুসজ্জন মেয়েজাতকে মায়াবিনী বলে গাল দিতে লেগেছে; তার মায়াদুর্গের উপরে বহুকাল থেকে তার নীরস শ্লোকের শতঘ্নী বর্ষণ করছে, কোথাও দাগ পড়ছে না।
যারা বাস্তবের উপাসক তারা অনেকে বলে, মেয়েরা অবাস্তবের কুয়াশা দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলেছে–এ-সমস্তর ভিতর থেকে একেবারে খাঁটি সত্য-মেয়েটিকে উদ্ধার করা চাই। তাদের মতে, সাহিত্যে শিল্পে সব জায়গাতেই এই অবাস্তব মেয়ের ভূতের উপদ্রব অত্যন্ত বেশি। এরা মনে করে, মায়া থেকে ছাড়িয়ে নিলেই বাস্তব সত্যকে পাওয়া যাবে।
কিন্তু, বাস্তব সত্য বলে কোনো জিনিস কি সৃষ্টিতে আছে। সে সত্য যদি-বা থাকে তবে এমন সম্পূর্ণ নির্বিকার মন কোথায় পাওয়া যাবে যার মধ্যে তার বিশুদ্ধ প্রতিবিম্ব পড়তে পারে! মায়াই তো সৃষ্টি; সেই সৃষ্টিকেই যদি অবাস্তব বল তা হলে অনাসৃষ্টি আছে কোন্ চুলোয়? তার নাগাল পাবে কোন্ পণ্ডিত?
নানা ছলাকলায় হাবে-ভাবে সাজে-সজ্জায় নারী নিজের চারদিকে যে-একটি রঙিন রহস্য সৃষ্টি করে তুলেছে সেই আবরণটা ছাড়িয়ে নিয়ে দেখাই তাকে সত্য দেখা, একথা মানি নে। গোলাপ ফুলের মায়ার পর্দাটা তুলে ফেলে তাকে কার্বন নাইট্রোজেন বলে দেখা যেমন সত্য দেখা নয়, এও তেমনি। তুমি বাস্তববাদী বলবে, গোলাপ ফুলের মায়া অকৃত্রিম, মেয়ের মায়া কৃত্রিম। একেবারেই বাজে কথা। মেয়ে নিজের হাতে রঙ বেঁটে যখন তার কাপড় রাঙায় তখন তার হাতের গোপনে সেই প্রকৃতিই থাকে যে-প্রকৃতি সকলের অগোচরে প্রজাপতির পাখায় নিজের অদৃশ্য তুলি বুলিয়ে দেয়। প্রাণের রাজ্যে মায়ার খেলা কত বর্ণে গন্ধে রসে, কত লুকোচুরিতে, আভাসে ইশারায় দিনরাত প্রকাশ পাচ্ছে। প্রকৃতির সেই-সকল নিত্য অথচ অনিত্য চঞ্চলতায়, সেই-সব নিরর্থক হাব-ভাবেই তো বিশ্বের সৌন্দর্য। চিরপলাতকের এই চিরপরিবর্তনশীল লীলা থেকে বাদ দিয়ে যে অতি সারবান ভারবান নিশ্চল ধুলোমাটি লোহাপাথরের পিণ্ডটা বাকি থাকে তাকেই তুমি বাস্তবসত্য বল না কি। বসনে ভূষণে, আড়ালে আবডালে, দ্বিধায় দ্বন্দ্বে, ভাবে ভঙ্গীতে মেয়ে তো মায়াবিনীই বটে। তার মায়ার জগতে সে ইন্দ্রজাল বিস্তার করেছে–যেমন মায়া যেমন ইন্দ্রজাল জলে স্থলে, ফুলে ফলে, সমুদ্র পর্বতে, ঝড়ে বন্যায়।
যাই হোক্, এই মায়াবিনীই চাঁদের সঙ্গে, ফুলের সঙ্গে, নববর্ষার মেঘের সঙ্গে, কলনৃত্যভঙ্গিনী নদীর সঙ্গে মিলে পুরুষের সামনে এসে দাঁড়াল। এই নারী একটা বাস্তবের পিণ্ডমাত্র নয়; এর মধ্যে কলাসৃষ্টির একটা তত্ত্ব আছে; অগোচর একটি নিয়মের বাঁধনে ছন্দের ভঙ্গীতে সে রচিত; সে একটি অনিবর্চনীয় সুসমাপ্তির মূর্তি। নানা বাজে খুঁটিনাটিকে সে মধুর নৈপুণ্যে সরিয়ে দিয়েছে; সাজে-সজ্জায় চালে-চলনে নানা ব্যঞ্জনা দিয়ে নিজেকে সে বস্তুলোকের প্রত্যন্তদেশের রসলোকের অধিবাসিনী করে দাঁড় করিয়েছে। “কাজ করে থাকি” এই কথাটা জানিয়ে পুরুষ হাত খালি রেখেছে; মেয়ে সেই হাতে কাঁকন পরে জানিয়েছে, “আমি তো কাজ করি নে, আমি সেবা করি।” সেবা হল হৃদয়ের সৃষ্টি, শক্তির চালনা নয়। যে রাস্তায় চলবে সেই রাস্তাটাকে খুব স্পষ্ট করে নিরীক্ষণ করবার জন্যে পুরুষ তার চোখদুটো খুলে রেখেছে, ওটাকে সে গম্ভীর ভাষায় বলে দর্শনেন্দ্রিয়। মেয়ে সেই চোখে একটু কাজলের রেখা টেনে দিয়ে বলেছে, চোখ দিয়ে বাইরের জিনিস দেখা যায় এইটেই চরম কথা নয়–চোখের ভিতরেও দেখবার জিনিস আছে, হৃদয়ের বিচিত্র মায়া।
অন্তরে বাহিরে হৃদয়ের রাগরঞ্জিত লীলা নিয়ে পুরুষের জগতে নারী মূর্তিমতী কলা-লক্ষ্মী হয়ে এল। রস যেখানে রূপ গ্রহণ করে সেই কলামূর্তির গুণ হচ্ছে এই যে, তার রূপ তাকে অচল বাঁধনে বাঁধে না। খবরের কাগজের সংবাদ-লেখা প্যারাগ্রাফের ছন্দ নেই, রস নেই, সেই জন্যে সে একেবারে নিরেট, সে যা সে তাই মাত্র। মন তার মধ্যে ছুটি পায় না। ভালো কবিতা যে-রূপ গ্রহণ করে সে-রূপ নির্দিষ্ট হয়েও অনির্দিষ্ট, পাঠকের সাতন্ত্র্যকে সে হাঁকিয়ে দেয় না। মনে আছে, বহুকাল হল, রোগশয্যায় কালিদাসের কাব্য আগাগোড়া সমস্ত পড়েছিলুম। যে-আনন্দ পেলুম সে তো আবৃত্তির আনন্দ নয়, সৃষ্টির আনন্দ। সেই কাব্যে আমার মন আপন বিশেষ স্বত্ব উপলব্ধি করবার বাধা পেল না। বেশ বুঝলুম, এ-সব কাব্য আমি যেরকম করে পড়লুম দ্বিতীয় আর-কেউ তেমন করে পড়ে নি।
মেয়ের মধ্যেও পুরুষের কল্পনা তেমনি করেই আপন মুক্তি পায়। নারীর চারিদিকে যে-পরিমণ্ডল আছে তা অনির্বচনীয়তার ব্যঞ্জনা দিয়ে তৈরি; পুরুষের কল্পনা সেখানে আপনার রসের রঙ, আপনার ভাবের রূপ মিলিয়ে দিতে কঠিন বাধা পায় না। অর্থাৎ, সেখানে তার নিজের সৃষ্টি চলে, এই জন্যে তার বিশেষ আনন্দ। মোহমুক্ত মানুষ তাই দেখে হাসে; কিন্তু মোহমুক্ত মানুষের কাছে সৃষ্টি ব’লে কোনো বালাই নেই, সে প্রলয়ের মধ্যে বাস করে।
পূর্বে বলেছি, মেয়ের প্রেম পুরুষের সমস্ত খুঁটিনাটি দোষত্রুটি সমেত বিশেষত্বকে প্রত্যক্ষ করে পেতে চায়। সঙ্গ তার নিতান্তই চাই। পুরুষও আপনাকে লুকিয়ে রাখে নি, ঢেকে রাখে নি; সে অত্যন্ত অসজ্জিত এলোমেলো আটপৌরে ভাবেই মেয়ের ভালোবাসার কাছে আগাগোড়া নিজেকে ফেলে রেখে দিয়েছে; এতেই মেয়ে যথার্থ সঙ্গ পায়, আনন্দ পায়।
কিন্তু, পুরুষের পক্ষে মেয়ে আপনার সঙ্গে সঙ্গেই একটা দূরত্ব নিয়ে আসে; তার মধ্যে খানিকটা পরিমাণে নিষেধ আছে, ঢাকা আছে। ফোটোগ্রাফের মধ্যে সব আছে, কিন্তু আর্টিস্টের ছবির মধ্যে সব নেই; এই জন্যে তাতে যে-ফাঁকা থাকে সেইখানে রসজ্ঞের মন কাজ করতে পারে। সেইরকমের ফাঁকাটুকু মেয়েদের একটা সম্পদ, সেটা সম্পূর্ণ লুপ্ত করতে নেই। বিয়াত্রিচে দান্তের কল্পনাকে যেখানে তরঙ্গিত করে তুলেছে সেখানে বস্তুত একটি অসীম বিরহ। দান্তের হৃদয় আপনার পূর্ণচন্দ্রকে পেয়েছিল বিচ্ছেদের দূর আকাশে। চণ্ডীদাসের সঙ্গে রজকিনী রামীর হয়তো বাইরের বিচ্ছেদ ছিল না, কিন্তু কবি যেখানে তাকে ডেকে বলছে,
তুমি বেদবাদিনী, হরের ঘরনী,
তুমি সে নয়নের তারা–
সেখানে রজকিনী রামী কোন্ দূরে চলে গেছে তার ঠিক নেই। হোক-না সে নয়নের তারা, তবুও যে-নারী বেদবাদিনী, হরের ঘরনী, সে আছে বিরহলোকে। সেখানে তার সঙ্গ নেই, ভাব আছে। নারীর প্রেমে মিলনের গান বাজে, পুরুষের প্রেমে বিচ্ছেদের বেদনা।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৮
২রা অক্টোবর, ১৯২৪
আমি বলছিলুম, মেয়েরা পর্দানশিন। যে কৃত্রিম পর্দা দিয়ে কৃপণ পুরুষ তাদের অদৃশ্য করে লুকিয়ে রাখে আমি সেই বর্বর পর্দাটার কথা বলছি নে; নিজেকে সুসমাপ্তভাবে প্রকাশ করবার জন্যেই তারা যে-সব আবরণকে সহজপটুত্বে আভরণ করে তুলেছে আমি তার কথাই বলছি। এই যে নিজের দেহকে, গৃহকে, আচরণকে, মনকে নানা বর্ণ দিয়ে, ভঙ্গী দিয়ে, সংযম দিয়ে, অনুষ্ঠান দিয়ে, নিজের বিচিত্র একটি বেষ্টনকে তারা সুসজ্জিত করতে পেরেছে, এর কারণ, তারা স্থিতির অবকাশ পেয়েছে। স্থিতির মূল্যই হচ্ছে তার আবরণের ঐশ্বর্যে, তার চারিদিকের দাক্ষিণ্যে, তার আভাসে, ব্যঞ্জনায়, তার হাতে যে সময় আছে সেই সময়টার মনোহর বৈচিত্র্যে। সবুরে মেওয়া ফলে, কেননা, মেওয়া যে প্রাণের জিনিস, কলের ফরমাশে তাকে তাড়াহুড়ো করে গড়ে তোলা যায় না। সেই বহুমূল্য সবুরটা হচ্ছে স্থিতির ঘরের জিনিস। এই সবুরটাকে যদি সরস এবং সফল করতে না পারা গেল তবে তার মতো আপদ আর নেই। মরুভূমি অনাবৃত, তার অবকাশের অভাব নেই অথচ সেই অবকাশ রিক্ত; এই কঠিন নগ্নতা পীড়া দেয়। কিন্তু, যেখানে পোড়ো জমি পোড়ো হয়ে নেই সেখানে সে ফসলে ঢাকা, ফুলে বিচিত্র; সেখানে তার সবুজ ওড়না বাতাসে দুলে উঠছে। যে-পথিক পথে চলে সেখানেই সে পায় তার তৃষ্ণার জল, ক্ষুধার অন্ন, তার আরামের ছায়া, ক্লান্তির শুশ্রূষা। সেখানকার স্থিতির পূর্ণতাই তার গতির সহায়; অবারিত মরুভূমি সবচেয়ে বাধা। নারী স্বভাবতই যে-স্থিতি পেয়েছে বসে বসে ধীরে ধীরে সেই স্থিতিকে রাঙিয়ে তুলে আপন হৃদয়রসে রসিয়ে নিয়ে তাই দিয়ে আপন বুকের কাঁচলি আপন মুখের ঘোমটা বানিয়েছে। এই ঢাকাতেই সে আপনার ঐশ্বর্য প্রকাশ করেছে পুষ্পপল্লবের আবরণেই যেমন লতার ঐশ্বর্য।
কিন্তু, হঠাৎ আজকাল পাশ্চাত্যসমাজে শুনতে পাচ্ছি, নারী বলছে, “আমি মায়ার আবরণ রাখব না, পুরুষের সঙ্গে ব্যবধান ঘুচিয়ে দেব। আমি হব বিজ্ঞানের চাঁদ; তার চারিদিকে বায়ুমণ্ডল নেই, মেঘ নেই, রঙ নেই, কোমল শ্যামলের চঞ্চল বিচিত্রতা নেই, তার কালো কালো ক্ষতগুলোর উপরে পর্দা নেই, আমিও হব তেমনি। এতদিন যাকে বলে এসেছি লজ্জা, যাকে বলে এসেছি শ্রী, আজ তাতে আমার পরাভব ঘটছে; সে সব বাধা বর্জন করব। পুরুষের চালে তার সমান তালে পা ফেলে তার সমান রাস্তায় চলব।” এমন কথা যে একদল স্ত্রীলোকের মুখ দিয়ে বের হল, এটা সম্ভব হল কী করে। এতে বোঝা যায়, পুরুষের প্রকৃতির মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। মেয়েকে সে চাচ্ছে না। এমন নয় যে সে হঠাৎ সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছে; ঠিক তার উলটো–সে হয়েছে বিষয়ী; মেয়েকে সে কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে চায়; কড়ায় গণ্ডায় যার হিসাব মেলে না তাকে সে মনে করে বাজে জিনিস, তাকে সে মনে করে ঠকা। সে বলে, “আমি চোখ খুলে সব স্পষ্ট করে তন্ন তন্ন করে দেখব।” অর্থাৎ, ধ্যানের দেখায় যা মনকে ভরিয়ে তোলে সেটাকে সে জানে ফাঁকি। কিন্তু, পুরুষের সংসারে সত্যকার মেয়ে তো কেবলমাত্র চোখের দেখার নয়, সে তো ধ্যানের জিনিসও বটে। সে যে শরীরী অশরীরী দু’য়ে মিলিয়ে, পৃথিবী যেমন নিজের মাটি ধুলো এবং নিজের চার দিকের অসীম আকাশ ও বায়ুমণ্ডল মিলিয়ে। মেয়ের যা অশরীরী তা যে শরীরী মেয়েকে ঘিরে আছে; তার ওজন নেই, কিন্তু তার বর্ণ আছে, ভঙ্গী আছে; তা ঢাকে অথচ তা প্রকাশ করে।
পাশ্চাত্য সভ্যতায় যারা উন্নতির বড়াই করে, তারা বলবে, এই মেয়েলির প্রতি অসহিষ্ণুতায় চলার উৎসাহ প্রকাশ পায়। আমার মনে হয়, এটাই থামবার পূর্বলক্ষণ। চলার ছন্দই থাকে না যদি স্থিতির সঙ্গে তার সমস্ত আপোষ একেবারে মিটে যায়। গাড়িটার ঘোড়াও চলছে, সারথিও চলছে, যাত্রীরাও চলছে, গাড়ির জোড় খুলে গিয়ে তার অংশপ্রত্যংশগুলোও চলছে, একে তো চলা বলে না; এ হচ্ছে মরণোন্মুখ চলার উন্মত্ত প্রলাপ, সাংঘাতিক থামার ভূমিকা। মেয়েরা সমাজের চলাকেই স্থিতির ছন্দ দেয়–সে ছন্দ সুন্দর।
একদল মেয়ে বলতে শুরু করেছে যে, “মেয়ে হওয়াতে আমাদের অগৌরব, আমাদের ক্ষতি। অর্থাৎ, আমাদের আত্মপ্রকাশের ধারায় পুরুষের সঙ্গে প্রভেদটাতে পীড়া পাচ্ছি।” এর থেকে বোধ হচ্ছে, একদিন যে-পুরুষ সাধক ছিল এখন সে হয়েছে বণিক। বণিক বাইরের দিকে যদিবা চলে, অন্তরের দিকে আপনার সঞ্চয়ের বোঝার কাছে সতর্ক হয়ে পড়ে আছে। তার স্থিতি সারবান কিন্তু সুন্দর নয়। তার কারণ, মানুষের সম্বন্ধকে হৃদয়মাধুর্যে সত্য ক’রে পূর্ণ ক’রে তোলা তার স্থিতির ধর্ম নয়; ধনসঞ্চয়ের তলায় মানুষের সম্বন্ধকে চাপা দিয়ে চ্যাপটা করে দেওয়াই হয়েছে তার কাজ। সুতরাং, সে যে কেবল চলে না তা নয়, আপন স্থিতিকে ভারগ্রস্ত নীরস নির্মম অসুন্দর করে। অঙ্কের কোঠার মধ্যে যাকে ধরে না তাকে সে আবর্জনার মধ্যে ফেলে দেয়।
পুরুষ একদিন ছিল মিষ্টিক্, ছিল অতল রসের ডুবারি, ছিল ধ্যানী। এখন সে হয়েছে মেয়েদের মতোই সংসারী। কেবল প্রভেদ এই যে, তার সংসারে আলো নেই, বাতাস নেই, আকাশ নেই; বস্তুপিণ্ডে সমস্ত নিরেট। সে ভারি ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মধ্যে সেই আকাশ সে পায় না যে-আকাশে আপন কল্পনাকে রূপে রসে মুক্তি দিতে পারে।
আজকালকার কবি আপন কাব্যে, শিল্পী আপন কারুতে, অনির্বচনীয়কে সুন্দরকে অবজ্ঞা প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছে। এটা কি পৌরুষের উলটো নয়। পুরুষই তো চিরদিন সুন্দরের কাছে থেকে আপন শক্তির জয়মাল্য কামনা করেছে। মিষ্টিক্ পুরুষ তার ধ্যানশক্তিতে, তার ফলাসক্তিবিহীন সাধনায়, বাস্তবের আবরণ একটার পর একটা যতই মোচন করেছে ততই রসের লোকে, অধ্যাত্মলোকে সে ভূমার পরিচয় পেয়েছে। আজ কেবলই সে থলির পর থলির মুখ বাঁধছে, সিন্দুকের পর সিন্দুকে তালা লাগাচ্ছে; আজ তার সেই মুক্তি নেই যে-মুক্তির মধ্যে সুন্দর আপন সিংহাসন রচনা করে। তাই তার মেয়েরা বলছে, “আমরা পুরুষ সাজব।” তাই তার কাব্যসরস্বতী বলছে, বীণার, তারগুলোকে যত্ন করে না বাঁধলে যে-সুরটা ঝন্ঝন্ করতে থাকে সেইটেই খাঁটি বাস্তবের সুর, উপেক্ষার উচ্ছৃঙ্খল দুরন্তপনায় রূপের মধ্যে যে-বিপর্যয় যে-ছিন্নভিন্নতা ঘটে সেইটেই আর্ট।
দিন চলে গেল। ভুলে ছিলুম যে, সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে চলেছি। মন চলেছিল আপন রাস্তায়, এক ভাবনা থেকে আর-এক ভাবনায়। চলেছিল বললে বেশি বলা হয়। উট যেমন বোঝা পিঠে নিয়ে মরুর মধ্যে পথ আন্দাজ করে চলে এ তেমন চলা নয়; এ যেন পথের খেয়াল না রেখে ভেসে যাওয়া, কোনো বিশেষ ঘাটের কাছে বায়না না নিয়ে শুধু-শুধু বেরিয়ে পড়া, কথাগুলোকে নিজের চেষ্টায় চালনা না ক’রে দিকের হিসেব না রেখে তাদের আপনার ঝোঁকে চলতে দেওয়া। তার সুবিধা হচ্ছে এই যে, কথাগুলো নিজেরাই হয় বক্তা, আর মনটা হয় শ্রোতা। মন তখন অন্যকে কিছু দেবার কথা ভাবে না, নিজের কাছ থেকে নিজে পায়। মনের ভূগোলে অনাবিষ্কৃতের আর অন্ত নেই। সে-সব জায়গায় পৌঁছে দেবার পথগুলো সবই নদীর মতো, অর্থাৎ সে-পথ নিজে চলে ব’লেই চালায়; তারই স্রোতে মন আপনাকে ভাসিয়ে দিতে পারলে নিজের মধ্যে অপরিচিতের পরিচয় পেতে থাকে। আর্যাবর্তের বুকের উপর দিয়ে যে-গঙ্গা চলে গেছে সেই তো ভারতবর্ষের অপরিচিত পূর্বের সঙ্গে অপরিচিত পশ্চিমকে সহজেই মুখোমুখি করে দিয়েছিল। তেমনি যে-মানুষের মনের মাঝখান দিয়ে চলতি নদী থাকে সে মানুষ আপনার কাছ থেকে আপনি শিক্ষা করবার সুযোগ পায়। আমার মনে সেই নদীটা আছে। তারই ডাকে ছেলেবেলায় আমি ইস্কুল পালিয়েছিলুম। যে-সব জ্ঞান শিখে শিখতে হয় তার বিস্তর অভাব রয়ে গেল কিন্তু অন্যদিকে ক্ষতিপূরণ হয়েছে। সেজন্যে আমার মনের ভিতরকার ভাগীরথীকে আমি প্রণাম করি।
বাইরে ডেকে এসে দাঁড়ালুম। তখন সূর্য অল্পক্ষণ আগেই অস্ত গেছে। শান্ত সমুদ্র, মৃদু বাতাসটা যেন মুখচোরা। জল ঝিল্মিল্ করছে। পশ্চিমদিক্প্রান্তে দু-একটা মেঘের টুকরো সোনার ধারায় অভিষিক্ত হয়ে স্থির হয়ে পড়ে আছে। আর-একটু উপরে তৃতীয়ার চাঁদের কণা। সেখানকার আকাশে তখনো সন্ধ্যার ঘোর লাগে নি; দিনের সভা যদিও ভেঙে গেছে, তবু সেখানে তার সাদা জাজিমখানা পাতা। চাঁদটাকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন অসময়ে অজায়গায় এসে পড়েছে। যেন একদেশের রাজপুত্র আর-এক রাজার দেশে হঠাৎ উপস্থিত, যথোচিত অভ্যর্থনার আয়োজন হয় নি, তার নিজের অনুচর তারাগুলো পিছিয়ে পড়েছে। এদিকে ঠিক সেই সময়ে পশ্চিম আকাশের সমস্ত সোনার মশাল, সমস্ত সমারোহ, সূর্যের অস্তযাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত; ওই চাঁদটুকুকে কেউ দেখতেই পাচ্ছে না।
এই জনশূন্য সমুদ্র ও আকাশের সঙ্গমস্থলে পশ্চিমদিগন্তে একখানি ছবি দেখলুম। অল্প কয়েকটি রেখা, অল্প কিছু উপকরণ; আকাশ এবং সমুদ্রের নীলের ভিতর দিয়ে অবসানদিনের শেষ আলো যেন তার শেষ কথাটি কোনো-একটা জায়গায় রেখে যাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু উদাস শূন্যের মধ্যে ধরে রাখবার জায়গা কোথাও না পেয়ে ম্লান হয়ে পড়ছে–এই ভাবটিই যেন সেই ছবিটির ভাব।
ডেকের ওপর স্তব্ধ দাঁড়িয়ে শান্ত একটি গভীরতার মধ্যে তলিয়ে গিয়ে আমি যা দেখলুম তাকে আমি বিশেষ অর্থেই ছবি বলছি, যাকে বলে দৃশ্য এ তা নয়। অর্থাৎ, এর মধ্যে যা-কিছুর সমাবেশ হয়েছে কেউ যেন সেগুলিকে বিশেষভাবে বেছে নিয়ে পরস্পরকে মিলিয়ে, একটি সম্পূর্ণতার মধ্যে সাজিয়ে ধরেছে। এমন একটি সরল গভীর মহৎ সম্পূর্ণতার ছবি কলকাতার আকাশে একমুহূর্তে এমন সমগ্র হয়ে আমার কাছে হয়তো দেখা দিত না। এখানে চারিদিকের এই বিপুল রিক্ততার মাঝখানে এই ছবিটি এমন একান্ত এক হয়ে উঠে আমার কাছে প্রকাশ পেলে। একে সম্পূর্ণ করে দেখবার জন্যে এতবড়ো আকাশ এবং এত গভীর স্তব্ধতার দরকার ছিল।
জাপানের কথা আমার মনে পড়ে। ঘরের মধ্যে একেবারে কোনো আসবাব নেই। একটি দেয়ালে একখানি ছবি ঝুলছে। ওই ছবি আমার সমস্ত চোখ একা অধিকার ক’রে; চারি পাশে কোথাও চিত্তবিক্ষেপ করবার মতো কিছুই নেই। রিক্ততার আকাশে তার সমস্ত অর্থটি জ্যোতির্ময় হয়ে প্রকাশ পায়। ঘরে যদি নানা জিনিস ভিড় করত তবে তাদের মধ্যে এই ছবি থাকত একটি আসবাবমাত্র হয়ে, তার ছবির মাহাত্ম্য ম্লান হত, সে আপনার সব কথা বলতে পারত না।
কাব্য সংগীত প্রভৃতি অন্য-সমস্ত রসসৃষ্টিও এইরকম বস্তুবাহুল্যবিরল রিক্ততার অপেক্ষা রাখে। তাদের চারিদিকে যদি অবকাশ না থাকে তা হলে সম্পূর্ণ মূর্তিতে তাদের দেখা যায় না। আজকালকার দিনে সেই অবকাশ নেই, তাই এখনকার লোকে সাহিত্য বা কলাসৃষ্টির সম্পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত। তারা রস চায় না, মদ চায়; আনন্দ চায় না, আমোদ চায়। চিত্তের জাগরণটা তাদের কাছে শূন্য, তারা চায় চমকলাগা। ভিড়ের ঠেলাঠেলির মধ্যে অন্যমনস্কের মন যদি কাব্যকে গানকে পেতে হয় তা হলে তার খুব আড়ম্বরের ঘটা করা দরকার। কিন্তু, সে-আড়ম্বরে শ্রোতার কানটাকেই পাওয়া যায় মাত্র, ভিতরের রসের কথাটা আরো বেশি করে ঢাকাই পড়ে। কারণ, সরলতা স্বচ্ছতা আর্টের যথার্থ আভরণ। যেখানে কোলাহল বেশি, ভিড় বৃহৎ, মন নানা-কিছুতে বিক্ষিপ্ত, আর্ট সেখানে কসরত দেখাবার প্রলোভনে মজে, আপনাকে দেখাতে ভুলে যায়। আড়ম্বর জিনিসটা একটা চীৎকার; যেখানে গোলমালের অন্ত নেই সেখানে তাকে গোচর হয়ে ওঠবার জন্যে চীৎকার করতে হয়; সেই চীৎকারটাকেই ভিড়ের লোক শক্তির লক্ষণ জেনে পুলকিত হয়ে ওঠে। কিন্তু, আর্ট তো চীৎকার নয়, তার গভীরতম পরিচয়ে হচ্ছে তার আত্মসংবরণে। আর্ট বরঞ্চ ঠেলা খেয়ে চুপ করে যেতে রাজি আছে, কিন্তু ঠেলা মেরে পালোয়ানি করার মতো লজ্জা তার আর নেই। হায় রে লোকের মন, তোমাকে খুশি করবার জন্যে রামচন্দ্র একদিন সীতাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন; তোমাকে ভোলবার জন্যেই আর্ট আজ আপনার শ্রী ও হ্রী বিসর্জন দিয়ে নৃত্য ভুলে পাঁয়তারা মেরে বেড়াচ্ছে।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৯
হারুনা-মারু জাহাজ, ৩রা অক্টোবর, ১৯২৪
এখনো সূর্য ওঠে নি। আলোকের অবতরণিকা পূর্ব আকাশে। জল স্থির হয়ে আছে সিংহবাহিনীর পায়ের তলাকার সিংহের মতো। সূর্যোদয়ের এই আগমনীর মধ্যে মজে গিয়ে আমার মুখে হঠাৎ ছন্দে-গাঁথা এই কথাটা আপনিই ভেসে উঠল–
হে ধরণী, কেন প্রতিদিন তৃপ্তিহীন একই লিপি পড় বারে বারে।
বুঝতে পারলুম আমার কোনো-একটি আগন্তুক কবিতা মনের মধ্যে এসে পৌঁছবার আগেই তার ধুয়োটা এসে পৌঁচেছে। এইরকমের ধুয়ো অনেক সময়ে উড়ো বীজের মতো মনে এসে পড়ে, কিন্তু সব সময়ে তাকে এমন স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যায় না।
সমুদ্রের দূর তীরে যে ধরণী আপনার নানা-রঙ আঁচলখানি বিছিয়ে দিয়ে পূবের দিকে মুখ করে একলা বসে আছে, ছবির মতো দেখতে পেলুম, তার কোলের উপর একখানি চিঠি পড়ল খসে কোন্ উপরের থেকে। সেই চিঠিখানি বুকের কাছে তুলে ধরে সে একমনে পড়তে বসে গেল; তালতমালের নিবিড় বনচ্ছায়া পিছনে রইল এলিয়ে, নুয়ে-পড়া মাথার থেকে ছড়িয়ে-পড়া এলোচুল।
আমার কবিতার ধুয়ো বলছে, প্রতিদিন সেই একই চিঠি। সেই একখানির বেশি আর দরকার নেই; সেই ওর যথেষ্ট। সে এত বড়ো, তাই সে এত সরল। সেই একখানিতেই সব আকাশ এমন সহজে ভরে গেছে।
ধরণী পাঠ করছে কত যুগে থেকে। সেই পাঠ-করাটা আমি মনে মনে চেয়ে দেখছি। সুরলোকের বাণী পৃথিবীর বুকের ভিতর দিয়ে, কণ্ঠের ভিতর দিয়ে, রূপে রূপে বিচিত্র হয়ে উঠল। বনে বনে হল গাছ, ফুলে ফুলে হল গন্ধ, প্রাণে প্রাণে হল নিশ্বসিত। একটি চিঠির সেই একটি মাত্র কথা, সেই আলো। সেই সুন্দর, সেই ভীষণ; সেই হাসির ঝিলিকে ঝিকিমিকি, সেই কান্নার কাঁপনে ছলছল।
এই চিঠি-পড়াটাই সৃষ্টির শ্রোত; যে দিচ্ছে আর যে পাচ্ছে সেই দুজনের কথা এতে মিলেছে, সেই মিলনেই রূপের ঢেউ। সেই মিলনের জায়গাটা হচ্ছে বিচ্ছেদ। কেননা, দূর-নিকটের ভেদ না ঘটলে স্রোত বয় না, চিঠি চলে না। সৃষ্টি-উৎসের মুখে কী-একটা কাণ্ড আছে, সে এক ধারাকে দুই-ধারায় ভাগ করে। বীজ ছিল নিতান্ত এক, তাকে দ্বিধা করে দিয়ে দুখানি কচি পাতা বেরল, তখনই সেই বীজ পেল তার বাণী; নইলে সে বোবা, নইলে সে কৃপণ, আপন ঐশ্বর্য আপনি ভোগ করতে জানে না। জীব ছিল একা, বিদীর্ণ হয়ে স্ত্রী-পুরুষে সে দুই হয়ে গেল। তখনই তার সেই বিভাগের ফাঁকের মধ্যে বসল তার ডাকবিভাগ। ডাকের পর ডাক, তার অন্ত নেই। বিচ্ছেদের এই ফাঁক একটা বড়ো সম্পদ; এ নইলে সব চুপ, সব বন্ধ। এই ফাঁকটার বুকের ভিতর দিয়ে একটা অপেক্ষার ব্যথা, একটা আকাঙক্ষার টান, টন্টন্ করে উঠল; দিতে-চাওয়ার আর পেতে-চাওয়ার উত্তর-প্রত্যুত্তর এ-পারে ও-পারে চালাচালি হতে লাগল। এতেই দুলে উঠল সৃষ্টিতরঙ্গ, বিচলিত হল ঋতুপর্যায়, কখনো বা গ্রীষ্মের তপস্যা, কখনো বর্ষার প্লাবন, কখনো বা শীতের সংকোচ, কখনো বা বসন্তের দাক্ষিণ্য। একে যদি মায়া বল তো দোষ নেই, কেননা, এই চিঠিলিখনের অক্ষরে আবছায়া, ভাষায় ইশারা; এর আবির্ভাব-তিরোভাবের পুরো মানে সব সময়ে বোঝা যায় না। যাকে চোখে দেখা যায় না সেই উত্তাপ কখন্ আকাশপথ থেকে মাটির আড়ালে চলে যায়; মনে ভাবি, একেবারেই গেল বুঝি। কিছু কাল যায়, একদিন দেখি, মাটির পর্দা ফাঁক করে দিয়ে একটি অঙ্কুর উপরের দিকে কোন্-এক আর-জন্মের চেনা-মুখ খুঁজছে। যে- উত্তাপটা ফেরার হয়েছে ব’লে সেদিন রব উঠল সেই তো মাটির তলার অন্ধকারে সেঁধিয়ে কোন্ ঘুমিয়ে-পড়া বীজের দরজায় বসে বসে ঘা দিচ্ছিল। এমনি করেই কত অদৃশ্য ইশারার উত্তাপ এক-হৃদয়ের থেকে আর-এক হৃদয়ের ফাঁকে ফাঁকে কোন্ চোরকোঠায় গিয়ে ঢোকে, সেখানে কার সঙ্গে কী কানাকানি করে জানি নে, তার পরে কিছুদিন বাদে একটি নবীন বাণী পর্দার বাইরে এসে বলে, “এসেছি”।
আমার সহযাত্রী বন্ধু আমার ডায়ারি প’ড়ে বললেন, “তুমি ধরণীর চিঠি-পড়ায় আর মানুষের চিঠি-পড়ায় মিশিয়ে দিয়ে একটা যেন কী গোল পাকিয়েছ। কালিদাসের মেঘদূতে বিরহী-বিরহিণীর বেদনাটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তোমার এই লেখায় কোন্খানে রূপক কোন্খানে সাদা কথা বোঝা শক্ত হয়ে উঠেছে।” আমি বললুম, কালিদাস যে মেঘদূত কাব্য লিখেছেন সেটাও বিশ্বের কথা। নইলে তার একপ্রান্তে নির্বাসিত যক্ষ রামগিরিতে, আর-একপ্রান্তে বিরহণী কেন অলকাপুরীতে। স্বর্গমর্ত্যের এই বিরহই তো সকল সৃষ্টিতে। এই মন্দাক্রান্তাছন্দেই তো বিশ্বের গান বেজে উঠছে। বিচ্ছেদের ফাঁকের ভিতর দিয়ে অণু-পরমাণু নিত্যই যে-অদৃশ্য চিঠি চালাচালি করে সেই চিঠিই সৃষ্টির বাণী। স্ত্রীপুরুষের মাঝখানেও, চোখে চোখেই হোক, কানে কানেই হোক, মনে মনেই হোক, আর কাগজে-পত্রেই হোক, যে-চিঠি চলে সেও ওই বিশ্বচিঠিরই একটি বিশেষ রূপ।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১০
৫ই অক্টোবর, ১৯২৪
মানুষের আয়ুতে ষাটের কোঠা অন্তদিগন্তের দিকে হেলে-পড়া। অর্থাৎ, উদয়ের দিগন্তটা এই সময়ে সামনে এসে পড়ে, পূর্বে পশ্চিমে মুখোমুখি হয়।
জীবনের মাঝমহলে, যে-কালটাকে বলে পরিণত বয়স, সেই সময়ে অনেক বড়ো বড়ো সংকল্প, অনেক কঠিন সাধনা, অনেক মস্ত লাভ, অনেক মস্ত লোকসান এসে জমেছিল। সব জড়িয়ে ভেবেছি, এইবার আসা গেল পাকা-পরিচয়ের কিনারাটাতে। সেই সময়ে কেউ যদি হঠাৎ এসে জিজ্ঞাসা করত “তোমার বয়স কত।” তা হলে আমার গোড়ার দিকের ছত্রিশটা বছর সরিয়ে রেখে বলতুম, আমি হচ্ছি বাকিটুকু। অর্থাৎ, আমার বয়স হচ্ছে কুষ্ঠির শেষদিকের সাতাশ। এই পাকা সাতাশের রকম-সকম দেখে গম্ভীর লোকে খুশি হল। তারা কেউ বললে, “নেতা হও”, কেউ বললে, “সভাপতি হও”, কেউ বললে, “উপদেশ দাও।” আবার কেউ বা বললে, “দেশটাকে মাটি করতে বসেছ।” অর্থাৎ, স্বীকার করলে দেশটাকে মাটি করে দেবার মতো অসামান্য ক্ষমতা আমার আছে।
এমন সময়ে ষাটে পড়লুম। একদিন বিকেলবেলায় সামনের বাড়ির ছাতে দেখি, দশ-বারো বছরের একটি ছেলে খালি-গায়ে যা-খুশি করে বেড়াচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে চা খেতে-খেতে একটা জরুরি কথা ভাবছি।
ভাবনাটা একদমে এক-লাইন থেকে আর-এক লাইনে চলে গেল। হঠাৎ নিতান্ত এই একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা মনে উঠল যে, ওই ছেলেটা এই অপরাহ্নের আকাশের সঙ্গে একেবারে সম্পূর্ণ মিশ খেয়ে গেছে; কোনো একটা অন্যমনস্কতার ঠেলায় বিশ্ব-পৃথিবীর সঙ্গে ওর জোড় ভেঙে যায় নি। সমস্ত দিগ্দিগন্তরকে ওই ছেলে তার সর্বাঙ্গ দিয়ে পেয়েছে, দিগম্বর শিবের মতো। কিসে যেন একটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে মনে করিয়ে দিলে যে, অমনি করেই নগ্ন হয়ে সমস্তর মধ্যে মগ্ন হয়ে নিখিলের আঙিনায় আমিও একদিন এসে দাঁড়িয়েছিলুম। মনে হল, সেটা কম কথা নয়। অর্থাৎ, আজও যদি বিশ্বের স্পর্শ প্রত্যক্ষ প্রাণের মধ্যে তেমনি করে এসে লাগত তা হলে ঠকতুম না। তা হলে আমার জীবন-ইতিহাসের মধ্যযুগে অকালে যুগান্তর-অবতারণার যে-সব আয়োজন করা গেছে তার ভার আমার চেয়ে যোগ্যতর লোকের হাতেই পড়ত, আর বাদশাই কুঁড়ের সিংহাসনটা আমি স্থায়ীরূপে দখল করে বসবার সময় পেতুম। সেই কুঁড়েমির ঐশ্বর্য আমি যে একলা ভোগ করতুম তা নয়, এই রসের রসিক যারা তাদের জন্যে ভাণ্ডারের দ্বার খুলে দিয়ে বলা যেত, পীয়তাং ভুজ্যতাম্।
চায়ের পাত্রটা ভুলে গিয়ে ভাবতে লাগলুম, যে-পুলকটাতে আজ মন আবিষ্ট হয়েছে সেটার কথা সবাইকে বুঝিয়ে বলি কী করে। বয়স যখন ছত্রিশের নীচে ছিল তখন বলা-ই আমার কাজ ছিল, বুঝিয়ে বলার ধার ধারতুম না। কেননা, তখন তেপান্তর মাঠের মাঝখানটাতে আমার ঘোড়া ছুটছে, যারা না বুঝে কিছুতেই ছাড়ে না তারা আমার ঠিকানা পায় নি। আজ পনেরো-ষোলো বিশ-পঁচিশ আশি-পঁচাশি প্রভৃতি নানা-বয়সের প্রাচীন লোকের ঠেসাঠেসি ভিড়ের মধ্যে এসে পড়েছি। ওদের বোঝাব কী করে, এই দুর্ভাবনা এখন ভুলে থাকাই শক্ত। মুশকিল এই যে, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ আছে, মশা আছে, পুলিস আছে,স্বরাজ পররাজ দ্বৈরাজ নৈরাজের ভাবনা আছে, এরই মধ্যে ওই গাখোলা ছেলেটা দিনের শেষ প্রহরের বেকার বেলাতে ছাদের উপরে ঘুরে বেড়ায়। আকাশের আলিঙ্গনে-বাঁধা ওই ভোলা মন ছেলেটিতে একটি নিত্যকালের কথা আছে, সে আমি শুনেছি, কিন্তু সে আমি ভাষায় কেমন করে স্পষ্ট করে তুলব।
আজ মনে হচ্ছে, ওই ছেলেটার কথা আমারই খুব ভিতরের কথা, গোলেমালে অনেক কাল তার দিকে চোখ পড়ে নি। বারো বছরের সেই নিত্য-ভোলা ইস্কুল-পালানো লক্ষ্মীছাড়াটা গাম্ভীর্যের নিবিড় ছায়ায় কোথায় লুকিয়ে লুকিয়ে খেলা করছিল। এখন ভাবনা ধরিয়ে দিলে, আমার আসল পরিচয় কোন্ দিকটায়। সেই আরম্ভ-বেলাকার সাতাশের দিকে, না, শেষ-বেলাকার?
দায়িত্বের বোঝা মাথায় করে ষাটের আরম্ভে একবার আমেরিকায় গিয়েছিলুম। তখন য়ুরোপের যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, কিন্তু তারই নেশায় তখনো আমেরিকার চোখ যে রকম রক্তবর্ণ য়ুরোপেরও এমন নয়। তার উপর তখন ইংরেজ নানা উপায়ে আমেরিকার শ্রবণেন্দ্রিয়ের পথ জুড়ে নিজের ভেঁপুটা বাজাচ্ছে। ডিমক্রাসির গুণ এই যে, নিজে ভাববার না আছে তার উদ্যম, না আছে তার শক্তি। যে-চতুর লোক কানে মন্ত্র দেবার ব্যবস্থা আয়ত্ত করেছে সে নিজের ভাবনা তাকে ভাবায়। ঠিক এখনকার খবর জানি নে, তখন ইংরেজ আমেরিকার বিপুলকায় ডিমক্রাসিকে কানে ধরে নিজের ভাবনা ভাবাচ্ছিল। সেই কানে মন্ত্র দেবার যন্ত্রটা আমার বিরুদ্ধে তার চাকা চালিয়ে দিলে। ভয় ছিল পাছে, আমি ইংরেজের অপযশ রটাই। তার আগেই জালিয়ানওয়ালাবাগের ব্যাপার ঘটেছিল।
যাই হোক, যে-কয়টা মাস আমেরিকায় কাটিয়েছি, হাওয়ার মধ্যে যেন একটা বিরোধের ঠেলা ছিল। ভাবুক যেখানেই আছে সেখানেই মানুষের আপনার দেশ, কোনো দেশে সেই ভাবুকতার স্রোতে যখন কমতি পড়ে তখন পদে পদে পাঁকের বাধায় বিদেশী পথিককে গ্লানি দেয়। যেদিন ভাবুকতার ঔদার্য থেকে রিক্ত আমেরিকাকে দেখলুম সেদিন দেখি সে ভয়ংকর ধনী, ভয়ংকর কেজো, সিদ্ধির নেশায় তার দুই চক্ষু রক্তবর্ণ। তারই পাশে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে চেয়ে দেখি, আমি নিতান্ত কাঁচা, জন্ম-গরিব, একেবারে অস্থিতে-মজ্জাতে বেহিসাবি। এও বুঝলুম, এ জগতে কাঁচা মানুষের খুব একটা পাকা জায়গা আছে, চিরকেলে জায়গা। ষাট বছরে পৌঁছে হঠাৎ দেখলুম, সেই জায়গাটা দূরে ফেলে এসেছি।
যতই বুঝতে পারি ততই দেখতে পাই, পাকা দেয়ালগুলোই মায়া, পাথরের কেল্লাই কয়েদখানা। মন কাঁদছে, মরবার আগে গাখোলা ছেলের জগতে আর-একবার শেষ ছেলেখেলা খেলে নিতে, দায়িত্ববিহীন খেলা। আর, কিশোর বয়সে যারা আমাকে কাঁদিয়েছিল, হাসিয়েছিল, আমার কাছ থেকে আমার গান লুঠ করে নিয়ে ছড়িয়ে ফেলেছিল, আমার মনের কৃতজ্ঞতা তাদের দিকে ছুটল। তারা মস্ত বড়ো কিছুই নয়; তারা দেখা দিয়েছে কেউ বা বনের ছায়ায়, কেউ বা নদীর ধারে, কেউ বা ঘরের কোণে, কেউ বা পথের বাঁকে। তারা স্থায়ী কীর্তি রাখবার দল নয়, ক্ষমতার ক্ষয়বৃদ্ধি নিয়ে তাদের ভাবনাই নেই; তারা চলতে চলতে দুটো কথা বলেছে, সব কথা বলবার সময় পায় নি; তারা কালস্রোতের মাঝখানে বাঁধ বাঁধবার চেষ্টা করে নি, তারই ঢেউয়ের উপর নৃত্য করে চলে গেছে, তারই কলস্বরে সুর মিলিয়ে; হেসে চলে গেছে, তারই আলোর ঝিলিমিলির মতো। তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললুম, “আমার জীবনে যাতে সত্যিকার ফসল ফলিয়েছে সেই আলোর, সেই উত্তাপের দূত তোমরাই। প্রণাম তোমাদের। তোমাদের অনেকেই এসেছিল ক্ষণকালের জন্য আধো-স্বপ্ন আধো-জাগার ভোরবেলায় শুকতারার মতো। প্রভাত না হতেই অস্ত গেল।” মধ্যাহ্নে মনে হল তারা তুচ্ছ; বোধ হল, তাদের ভুলেই গেছি। তার পরে সন্ধ্যার অন্ধকারে যখন নক্ষত্রলোক সমস্ত আকাশ জুড়ে আমার মুখের দিকে চাইল তখন জানলুম সেই ক্ষণিকা তো ক্ষণিকা নয়, তারাই চিরকালের; ভোরের স্বপ্নে বা সন্ধ্যাবেলার স্বপ্নাবেশে জানতে না-জানতে তারা যার কপালে একটুখানি আলোর টিপ পরিয়ে দিয়ে যায় তাদের সৌভাগ্যের সীমা নেই। তাই মন বলছে, একদিন যারা ছোটো হয়ে এসেছিল আজ আমি যেন ছোটো হয়ে তাদের কাছে, আর-একবার যাবার অধিকার পাই; যারা ক্ষণকালের ভান করে এসেছিল, বিদায় নেবার দিনে আর-একবার যেন তারা আমাকে বলে “তোমাকে চিনেছি”, আমি যেন বলি, “তোমাদের চিনলুম”।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১১
৭ই অক্টোবর, ১৯২৪
একজন অপরিচত যুবকের সঙ্গে একদিন এক-মোটরে নিমন্ত্রণসভায় যাচ্ছিলুম। তিনি আমাকে কথাপ্রসঙ্গে খবর দিলেন যে, আজকাল পদ্য আকারে যে-সব রচনা করছি সেগুলি লোকে তেমন পছন্দ করছে না। যারা পছন্দ করছে না তাদের সুযোগ্য প্রতিনিধিস্বরূপে তিনি উল্লেখ করলেন তাঁর কোনো কোনো আত্মীয়ের কথা, সেই আত্মীয়েরা কবি; আর, যে-সব পদ্যরচনা লোকে পছন্দ করে না তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন আমার গানগুলো আর আমার “শিশু ভোলানাথ’ নামক আধুনিক কাব্যগ্রন্থ। তিনি বললেন, আমার বন্ধুরাও আশঙ্কা করছেন আমার কাব্য লেখবার শক্তি ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে।
কালের ধর্মই এই। মর্ত্যলোকে বসন্তঋতু চিরকাল থাকে না। মানুষের ক্ষমতার ক্ষয় আছে, অবসান আছে। যদি কখনো কিছু দিয়ে থাকি, তবে মূল্য দেবার সময় তারই হিসাবটা স্মরণ করা ভালো। রাত্রিশেষে দীপের আলো নেববার সময় যখন সে তার শিখার পাখাতে বার-কতক শেষ ঝাপটা দিয়ে লীলা সাঙ্গ করে, তখন আশা দিয়ে নিরাশ করবার দাবিতে প্রদীপের নামে নালিশ করাটা বৈধ নয়। দাবিটাই যার বেহিসাবি দাবি অপূরণ হবার হিসাবটাতেও তার ভুল থাকবেই। পঁচানব্বই বছর বয়সে একটা মানুষ ফস্ করে মারা গেল বলে চিকিৎসাশাস্ত্রটাকে ধিক্কার দেওয়া বৃথা বাক্যব্যয়। অতএব, কেউ যদি বলে আমার বয়স যতই বাড়ছে আমার আয়ু ততই কমে যাচ্ছে, তা হলে তাকে আমি নিন্দুক বলি নে, বড়ো জোর এই বলি যে, লোকটা বাজে কথা এমনভাবে বলে যেন সেটা দৈববাণী। কালক্রমে আমার ক্ষমতা হ্রাস হয়ে যাচ্ছে, এই বিধিলিপি নিয়ে যুবক হোক, বৃদ্ধ হোক, কবি হোক, অকবি হোক, কারো সঙ্গে তকরার করার চেয়ে ততক্ষণ একটা গান লেখা ভালো মনে করি, তা সেটা পছন্দসই হোক আর না হোক। এমন কি, সেই অবসরে “শিশু ভোলানাথ’-এর জাতের কবিতা যদি লিখতে পারি, তা হলেও মনটা খুশি থাকে। কারণটা কী বলে রাখি।
আজ-নাগাদ প্রায় পনেরো-ষোলো বছর ধরে খুব কষে গানই লিখছি। লোকরঞ্জনের জন্যে নয়, কেননা, পাঠকেরা লেখায় ক্ষমতার পরিচয় খোঁজে। ছোটো ছোটো একটু একটু গানে ক্ষমতার কায়দা দেখাবার মতো জায়গাই নেই। কবিত্বকে যদি রীতিমতো তাল ঠুকে বেড়াতেই হয় তা হলে অন্তত একটা বড়ো আখড়া চাই। তা ছাড়া গান জিনিসে বেশি বোঝাই সয় না; যারা মালের ওজন ক’রে দরের যাচাই করে, তারা এরকম দশ-বারো লাইনের হালকা কবিতার বাজার মাড়াতে চায় না। তবু আমি এই কয় বছরে এত গান লিখেছি যে, অন্তত সংখ্যা হিসাবে লম্বা দৌড়ের বাজিতে আমি বোধ হয় পয়লা নম্বরের পুরস্কার পেতে পারি।
আর-একটা কথা বলে রাখি, গান লিখতে যেমন আমার নিবিড় আনন্দ হয় এমন আর কিছুতে হয় না। এমন নেশায় ধরে যে, তখন গুরুতর কাজের গুরুত্ব একেবারে চলে যায়, বড়ো বড়ো দায়িত্বের ভারাকর্ষণটা হঠাৎ লোপ পায়, কর্তব্যের দাবিগুলোকে মন এক-ধার থেকে নামঞ্জুর করে দেয়।
এর কারণ হচ্ছে, বিশ্বকর্মার লীলাখেলার স্রোতটার মধ্যে হঠাৎ পড়ে গেলে শুকনো ডাঙার কথাটা একেবারেই মনে থাকে না। শরতের গাছতলা শিউলি ফুলের অপব্যয়ে ছেয়ে গেল, নিকেশ নেবার কোনো কথাই কেউ বলে না। যা হল কেবল তাই দেখেই বলি, যথেষ্ট হয়েছে। ঘোর গরমে ঘাসগুলো শুকিয়ে সব হলদে হয়ে গেল; বর্ষার প্রথম পসলা বৃষ্টি হয়ে যাবার পরেই হঠাৎ দেখি, ঘাসে অতি ছোটো ছোটো বেগনি ফুলে হলদে ফুলে মাতামাতি। কে দেখে কে না দেখে তার খেয়াল নেই। এটা হল রূপের লীলা, কেবলমাত্র হয়ে ওঠাতেই আনন্দ। এই মেঠো ফুলের একটি মঞ্জরী তুলে ধরে আমি বলি, বাহবা। কেন বলি। ও তো খাবার জিনিস নয়, বেচবার জিনিস নয়, লোহার সিন্দুকে তালা বন্ধ করে রাখবার জিনিস নয়। তবে ওতে আমি কী দেখলুম যাতে আমার মন বললে “সাবাস”। বস্তু দেখলুম? বস্তু তো একটা মাটির ঢেলার মধ্যে ওর চেয়ে অনেক বেশি আছে। তবে? আমি দেখলুম, রূপ। সে কথাটার অর্থ কী। রূপ ছাড়া আর কোনোই অর্থ নেই। রূপ শুধু বলে, “এই দেখো, আমি হয়ে উঠেছি।” যদি আমার মন সায় দিয়ে বলে “তাই তো বটে, তুমি হয়েছ, তুমি আছ” আর এই বলেই যদি সে চুপ করে যায়, তা হলেই সে রূপ দেখলে; হয়ে-ওঠাকেই চরম বলে জানলে। কিন্তু, সজনে ফুল যখন অরূপসমুদ্রে রূপের ঢেউ তুলে দিয়ে বলে “এই দেখো আমি আছি”, তখন তার কথাটা না বুঝে আমি যদি গোঁয়ারের মতো বলে বসি “কে আছ”–তার মুখ থেকে যদি অত্যন্ত মিথ্যে জবাব আদায় করে নিই, যদি তাকে দিয়ে বলাই “তুমি খাবে বলেই আছি”, তা হলে রূপের চরম রহস্যটা দেখা হল না। একটি ছোট্টো মেয়ে কোথা থেকে আমার যাত্রাপথে জুটে গেছে। তার বয়স আড়াই বছর। তার মধ্যে প্রাণের আনন্দ টলমল করে ওঠে, কত মধুর প্রলাপে, কত মন-ভোলানো ভঙ্গীতে; আমার মন বলে, “মস্ত একটা পাওনা আমি পেলুম।” কী যে পেলুম তাকে হিসাবের অঙ্কে ছ’কে নেবার জো নেই। আর-কিছু নয়, একটি বিশেষ হয়ে-ওঠাকেই আমি চরম করে দেখলুম। ওই ছোট্ট মেয়ের হয়ে-ওঠাই আমার পরম লাভ। ও আমার ঘর ঝাঁট দেয় না, রান্না করে না, তাতে ওর ওই হয়ে-ওঠার হিসাবটাতে কিছুই কম পড়ছে না। বৈজ্ঞানিক এর হয়তো একটা মোটা কৈফিয়ত দেবে, বলবে, “জীবজগতে বংশরক্ষাটাই সবচেয়ে বড়ো দরকার; ছোটো মেয়েকে সুন্দর না লাগলে সেই দরকারটাতে বাধা পড়ে।” মোটা কৈফিয়তটাকে আমি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করি নে, কিন্তু তার উপরেও একটা সূক্ষ্ম তত্ত্ব আছে যার কোনো কৈফিয়ত নেই। একটা ফলের ডালি দেখলে মন খুশি হয়ে ওঠে, আর মাছের ঝোলের পাত্র দেখলে যারা নিরামিষাশী নয় তাদের মন খুশি হতে পারে; আহারের প্রয়োজনটা উভয়তই আছে; সুতরাং খুশির একটা মোটা কৈফিয়ত উভয়তই পাওয়া যায়। তৎসত্ত্বেও ফলের ডালিতে এমন একটা বিশেষ খুশি আছে যা কোনো কৈফিয়ত তলবই করে না। সেইখানে ওই একটিমাত্র কথা, ফলগুলি বলছে “আমি আছি”–আর আমার মন বলে, সেইটেই আমার লাভ। আমার জীবনযাত্রার এই আড়াই বছরের ক্ষুদ্রতমা সহচরীটিও মানবের বংশরক্ষার কৈফিয়ত দাখিল করেও এমন কিছু বাকি রাখে যেটা বিশ্বের মর্মকুহর হতে উত্থিত ওঙ্কারধ্বনিরই সুর। বিশ্ব বলছে ওঁ; বলছে, হাঁ; বলছে, অয়মহং ভোঃ, এই-যে আমি। ওই মেয়েটিও সেই ওঁ, সেই হাঁ, সেই এই-যে আমি। সত্তাকে সত্তা বলেই যেখানে মানি সেখানে তার মধ্যে আমি সেই খুশিকেই দেখি যে খুশি আমার নিজের মধ্যে চরমরূপে রয়েছে। দাসের মধ্যে সেই খুশিকে দেখি নে বলেই দাসত্ব এত ভয়ংকর মিথ্যে আর মিথ্যে বলেই এত ভয়ংকর তার পীড়া।
সৃষ্টির মূলে এই লীলা, নিরন্তর এই রূপের প্রকাশ। সেই প্রকাশের অহৈতুক আনন্দে যখন যোগ দিতে পারি তখন সৃষ্টির মূল আনন্দে গিয়ে মন পৌঁছয়। সেই মূল আনন্দ আপনাতেই আপনি পর্যাপ্ত, কারো কাছে তার কোনো জবাবদিহি নেই।
ছোটো ছেলে ধুলোমাটি কাটাকুটো নিয়ে সারাবেলা বসে বসে একটা কিছু গড়ছে। বৈজ্ঞানিকের মোটা কৈফিয়ত হচ্ছে এই যে, গড়বার শক্তি তার জীবনযাত্রার সহায়, সেই শক্তির চালনা চাই। এ কৈফিয়ত স্বীকার করে নিলুম; তবুও কথাটার মূলের দিকে অনেকখানি বাকি থাকে! গোড়াকার কথা হচ্ছে এই যে, তার সৃষ্টিকর্তা মন বলে “হোক”, “Let there be”–সেই বাণীকে বহন করে ধুলোমাটি কুটোকাটি সকলেই বলে ওঠে, “এই দেখো হয়েছে।”
এই হওয়ার অনেকখানিই আছে শিশুর কল্পনায়। সামনে যখন তার একটা ঢিবি তখন কল্পনা বলছে, “এই তো আমার রূপকথার রাজপুত্রের কেল্লা।” তার ওই ধুলোর স্তূপের ইশারার ভিতর দিয়ে শিশু সেই কেল্লার সত্তা মনে স্পষ্ট অনুভব করছে; এই অনুভূতিতেই তার আনন্দ। গড়বার শক্তিকে প্রকাশ করছি বলে আনন্দ নয়, কেননা, সে শক্তি এ ক্ষেত্রে বিশেষ প্রকাশ পাচ্ছে না। একটি রূপবিশেষকে চিত্তে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব’লে আনন্দ। সেই রূপটাকে শেষলক্ষ্য করে দেখাই হচ্ছে সৃষ্টিকে দেখা; তার আনন্দই সৃষ্টির মূল আনন্দ।
গান জিনিসটা নিছক সৃষ্টিলীলা। ইন্দ্রধনু যেমন বৃষ্টি আর রৌদ্রের জাদু, আকাশের দুটো খামখেয়ালি মেজাজ দিয়ে গড়া তোরণ, একটি অপূর্ব মুহূর্তকাল সেই তোরণের নীচে দিয়ে জয়যাত্রা করবে। হয়ে গেল এই খেলা, মুহূর্তটি তার রঙিন উত্তরীয় উড়িয়ে দিয়ে চলে গেল–তার বেশি আর কিছু নয়। মেজাজের এই রঙিন খেলাই হচ্ছে গীতিকাব্য। ওই ইন্দ্রধনুর কবিটিকে পাকড়াও করে যদি জিজ্ঞাসা করা যেত, “এটার মানে কী হল” সাফ জবাব পাওয়া যেত “কিছুই না”। “তবে?” “আমার খুশি।” রূপেতেই খুশি–সৃষ্টির সব প্রশ্নের এই হল শেষ উত্তর।
এই খুশির খেলাঘরে রূপের খেলা দেখে আমাদের মন ছুটি পায় বস্তুর মোহ থেকে; একেবারে পৌঁছয় আনন্দে, এমন কিছুতে যার ভার নেই, যার মাপ নেই, যা সেদিন সমুদ্রের মাঝে পশ্চিম আকাশে, “ধূমজ্যোতিঃসলিলমরুতে’ গড়া সূর্যাস্তের একখানি রূপসৃষ্টি দেখলুম। আমার যে-পাকাবুদ্ধি সোনার খনির মুনফা গোনে সে বোকার মতো চুপ করে রইল,আর আমার যে কাঁচা মনটা বললে, “দেখেছি” সে স্পষ্ট বুঝতে পারলে সোনার খনির মুনফাটাই মরীচিকা আর যার আবির্ভাবকে ক্ষণকালের জন্যে ওই চিহ্নহীন সমুদ্রে নামহীন আকাশে দেখা গেল তারই মধ্যে চিরকালের অফুরান ঐশ্বর্য, সেই হচ্ছে অরূপের মহাপ্রাঙ্গণে রূপের নিত্যলীলা।
সৃষ্টির অন্তরতম এই অহৈতুক লীলার রসটিকে যখন মন পেতে চায় তখনই বাদশাহি বেকারের মতো সে গান লিখতে বসে। চারখানি পাপড়ি নিয়ে একটি ছোটো জুঁইফুলের মতো একটুখানি গান যখন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে তখন সেই মহা-খেলাঘরের মেজের উপরেই তার জন্যে জায়গা করা হয় যেখানে যুগ যুগ ধরে গ্রহনক্ষত্রের খেলা হচ্ছে। সেখানে যুগ আর মুহূর্ত একই, সেখানে সূর্য আর সূর্যমণি ফুলে অভেদাত্মা, সেখানে সাঁঝসকালে মেঘে মেঘে যে-রাগরাগিণী আমার গানের সঙ্গে তার অন্তরের মিল আছে।
আজ পনেরো-ষোলো বছর ধরে কতর্ব্যবুদ্ধি আমাকে নানা ভাবনা নানা ব্যস্ততার মধ্যে জোরে টেনে নিয়ে ফেলে আমার কাছ থেকে কষে কাজ আদায় করে নিচ্ছে। এখানকার সকল কাজই মোটা কৈফিয়তের অপেক্ষা রাখে। খোঁচা দিয়ে দিয়ে কেবলই জিজ্ঞাসা করে, “ফল হবে কি।” সেইজন্যে যার ফরমাশ কৈফিয়তের সীমানা পেরিয়ে আপন বেদরকারি পাওনা দাবি করে ভিতরে-ভিতরে সে আমাকে কেবলই প্রশ্ন করতে থাকে, “তুমি কবি, চির-ছুটির পরোয়ানা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ, তার করলে কী। কাজের ভিড়ের টানাটানিতে পড়ে একেবারেই জাত খুইয়ে বোসো না।” নিশ্চয় ওরই এই তাগিদেই আমাকে গান লেখায়; হট্টগোলের মধ্যেও নিজের পরিচয়টা বজায় রাখবার জন্যে, লোকরঞ্জনের জন্যে নয়। কর্তব্যবুদ্ধি তার কীর্তি ফেঁদে গম্ভীরকণ্ঠে বলে, “পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে গুরুতর।” তাই আমার ভিতরকার বিধিদত্ত ছুটির খেয়াল বাঁশি বাজিয়ে বলে, “পৃথিবীতে আমিই সবচেয়ে লঘুতম।” লঘু নয় তো কী! সেই জন্যে সব জায়গাতেই হাওয়ায় হাওয়ায় তার পাখা চলে, তার রঙ-বেরঙের পাখা। ইমারতের মোটা ভিত ফেঁদে সময়ের সদ্ব্যয় করা তার জাত-ব্যাবসা নয়; সে লক্ষ্মীছাড়া ঘুরে বেড়ায় ফাঁকির পথে, যে-পথে রঙের ঝরনা রসের ধারা ঝরে ঝরে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে বিপুল একটা বাজেখরচের মতো।
আমার কেজো পরিচয়টার প্রতি ঈর্ষা ক’রে অবজ্ঞা ক’রে আমার অকেজো পরিচয়টা আমাকে যখন-তখন গান লিখিয়ে লিখিয়ে নিজের দলিল ঠিক করে রাখছে। যখন বিরুদ্ধপক্ষে মাতব্বর সাক্ষী এসে জোটে, তখনই নিজের দাবির দলিল খুব বড়ো করে তুলতে হয়। যতদিন ধরে এক পক্ষে আমার কাজের রোকড় খুব মোটা হয়ে উঠছে ততদিন ধরেই অন্যপক্ষে আমার ছুটির নথিও অসম্ভব-রকম ভারী হয়ে উঠল। এই-যে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলছে, এটা আমার অন্তরের খাস-কামরায়। আমি আসলে কোন্ পক্ষের, সেইটের বিচার নিয়ে আমারই কাছে নালিশ।
তার পরে কথাটা এই যে, ওই “শিশু ভোলানাথ’-এর কবিতাগুলো খামকা কেন লিখতে বসেছিলুম। সেও লোকরঞ্জনের জন্যে নয়, নিতান্ত নিজের গরজে।
পূর্বেই বলেছি, কিছুকাল আমেরিকার প্রৌঢ়তার মরুপারে ঘোরতর কার্যপটুতার পাথরের দুর্গে আটকা পড়েছিলুম। সেদিন খুব স্পষ্ট বুঝেছিলুম, জমিয়ে তোলবার মতো এত বড়ো মিথ্যে ব্যাপার জগতে আর কিছুই নেই। এই জমাবার জমাদারটা বিশ্বের চিরচঞ্চলতাকে বাধা দেবার স্পর্ধা করে; কিন্তু কিছুই থাকবে না, আজ বাদে কাল সব সাফ হয়ে যাবে। যে-স্রোতের ঘূর্ণিপাকে এক-এক জায়গায় এই-সব বস্তুর পিণ্ডগুলোকে স্তূপাকার করে দিয়ে গেছে সেই স্রোতেরই অবিরত বেগে ঠেলে ঠেলে সমস্ত ভাসিয়ে নীল সমুদ্রে নিয়ে যাবে–পৃথিবীর বক্ষ সুস্থ হবে। পৃথিবীতে সৃষ্টির যে লীলাশক্তি আছে সে-যে নির্লোভ, সে নিরাসক্ত, সে অকৃপণ; সে কিছু জমতে দেয় না, কেননা, জমার জঞ্জালে তার সৃষ্টির পথ আটকায়; সে-যে নিত্যনূতনের নিরন্তর প্রকাশের জন্যে তার অবকাশকে নির্মল করে রেখে দিতে চায়। লোভী মানুষ কোথা থেকে জঞ্জাল জড়ো ক’রে সেইগুলোকে আগলে রাখবার জন্যে নিগড়বদ্ধ লক্ষ লক্ষ দাসকে দিয়ে প্রকাণ্ড সব ভাণ্ডার তৈরি করে তুলছে। সেই ধ্বংসশাপগ্রস্ত ভাণ্ডারের কারাগারে জড়বস্তুপুঞ্জের অন্ধকারে বাসা বেঁধে সঞ্চয়গর্বের ঔদ্ধত্যে মহাকালকে কৃপণটা বিদ্রূপ করছে; এ বিদ্রূপ মহাকাল কখনোই সইবে না। আকাশের উপর দিয়ে যেমন ধূলানিবিড় আঁধি ক্ষণকালের জন্যে সূর্যকে পরাভূত করে দিয়ে তার পরে নিজের দৌরাত্ম্যের কোনো চিহ্ন না রেখে চলে যায়, এ-সব তেমনি করেই শূন্যের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
কিছুকালের জন্যে আমি এই বস্তু-উদ্গারের অন্ধযন্ত্রের মুখে এই বস্তুসঞ্চয়ের অন্ধভাণ্ডারে বদ্ধ হয়ে আতিথ্যহীন সন্দেহের বিষবাষ্পে শ্বাসরুদ্ধপ্রায় অবস্থায় কাটিয়েছিলুম। তখন আমি এই ঘন দেয়ালের বাইরের রাস্তা থেকে চিরপথিকের পায়ে শব্দ শুনতে পেতুম। সেই শব্দের ছন্দই যে আমার রক্তের মধ্যে বাজে, আমার ধ্যানের মধ্যে ধ্বনিত হয়। আমি সেদিন স্পষ্ট বুঝেছিলুম, আমি ওই পথিকের সহচর।
আমেরিকার বস্তুগ্রাস থেকে বেরিয়ে এসেই “শিশু ভোলানাথ’ লিখতে বসেছিলুম। বন্দী যেমন ফাঁক পেলেই ছুটে আসে সমুদ্রের ধারে হাওয়া খেতে, তেমনি করে। দেয়ালের মধ্যে কিছুকাল সম্পূর্ণ আটকা পড়লে তবেই মানুষ স্পষ্ট করে আবিষ্কার করে, তার চিত্তের জন্যে এত বড়ো আকাশেরই ফাঁকাটা দরকার। প্রবীণের কেল্লার মধ্যে আটকা পড়ে সেদিন আমি তেমনি করেই আবিষ্কার করেছিলুম, অন্তরের মধ্যে যে-শিশু আছে তারই খেলার ক্ষেত্র লোকে-লোকান্তরে বিস্তৃত। এইজন্যে কল্পনায় সেই শিশুলীলার মধ্যে ডুব দিলুম, সেই শিশুলীলার তরঙ্গে সাঁতার কাটলুম, মনটাকে স্নিগ্ধ করবার জন্যে, নির্মল করবার জন্যে, মুক্ত করবার জন্যে।
এ কথাটার এতক্ষণ ধরে আলোচনা করছি এইজন্যে যে, যে লীলালোকে জীবনযাত্রা শুরু করেছিলুম, সে-লীলাক্ষেত্রে জীবনের প্রথম অংশ অনেকটা কেটে গেল, সেইখানেই জীবনটার উপসংহার করবার উদ্বেগে কিছুকাল থেকেই মনের মধ্যে একটা মন-কেমন-করার হাওয়া বইছে। একদা পদ্মার ধারে আকাশের পারে সংসারের পথে যারা আমার সঙ্গী ছিল তারা বলছে, সেদিনকার পালা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায় নি, বিদায়ের গোধূলিবেলায় সেই আরম্ভের কথাগুলো সাঙ্গ করে যেতে হবে। সেইজন্যেই সকাল-বেলাকার মল্লিকা সন্ধ্যাবেলাকার রজনীগন্ধা হয়ে তার গন্ধের দূত পাঠাচ্ছে। বলছে, “তোমার খ্যাতি তোমাকে না টানুক, তোমার কীর্তি তোমাকে না বাঁধুক, তোমার গান তোমাকে পথের পথিক ক’রে তোমাকে শেষযাত্রায় রওনা করে দিক। প্রথম বয়সের বাতায়নে বসে তুমি তোমার দূরের বঁধুর উত্তরীয়ের সুগন্ধি হাওয়া পেয়েছিলে। শেষবয়সের পথে বেরিয়ে গোধূলিরাগে রাঙা আলোতে তোমার সেই দূরের বঁধুর সন্ধানে নির্ভয়ে চলে যাও। লোকের ডাকাডাকি শুনো না। সুর যে-দিক থেকে আসছে সেই দিকে কান পাতো–আর সেই দিকেই ডানা মেলে দাও সাগরপারের লীলালোকের আকাশপথে। যাবার বেলায় কবুল করে যাও যে, তুমি কোনো কাজের নও, তুমি অস্থায়ীদের দলে।”
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১২
ক্রাকোভিয়া জাহাজ, ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯২৫
মার্স্যেল্স্ বন্দরে নেমে রেলে চড়লেম। পশ্চিমদেশের একটা পরিচয় পেলেম ভোজন-কামরায়। আকাশে গ্রহমালার আবর্তনের মতো থালার পর থালা ঘুরে আসছে, আর ভোজের পর ভোজ্য।
ঘরের দাবি পথের উপর চলে না। ঘরে আছে সময়ের অবসর, ঘরে আছে স্থানের অবকাশ। সেখানে জীবনযাত্রার আয়োজনের ভার বেশি করে জমে ওঠবার বাধা নেই। কিন্তু, চলতি পথে উপকরণভার যথাসম্ভব হালকা করাই সাধারণ লোকের পক্ষে সংগত। হরিণের শিঙ বটগাছের ডাল-আবডালের মতো অত অধিক, অত বড়ো, অত ভারী হলে সেটা জঙ্গম প্রাণীর পক্ষে বেহিসাবি হয়।
চিরকাল, বিশেষত পূর্বকালে, রাজা-রাজড়া আমীর-ওমরাওরা ভোগের ও ঐশ্বর্যের বোঝাকে সর্বত্র সকল অবস্থাতেই ভরপুরভাবে টেনে বেড়িয়েছে। সংসারের উপর তাদের আবদার অত্যন্ত বেশি। সে আবদার সংসার মেনে নিয়েছে, কেননা, এদের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। রেলগাড়ির ভোজনশালায় থালার সংখ্যা, ভোজ্যের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য পরিচর্যার ব্যবস্থা, এত বাহুল্যময় যে, পূর্বকালের রাজকীয় সম্প্রদায়ই পথিক-অবস্থাতেও তা দাবি করতে পারত। এখন জনসাধারণের সকলের জন্যে এই আয়োজন।
ভোগের এত বড়ো বাহুল্যে সকল মানুষেরই অধিকার আছে, এই কথাটার আকর্ষণ অতি ভয়ানক। এই আকর্ষণে দেশজোড়া মানুষের সিঁধকাঠি বিশ্বভাণ্ডারের দেয়াল ফুটো করতে উদ্যত হয়; লুব্ধ সভ্যতার এই উপদ্রব সর্বনেশে।
যেটা বাহুল্য তাতে ছোটো বড়ো কোনো মানুষের কোনো অধিকার নেই, এই কথাটা গত যুদ্ধের সময়ে ইংলণ্ড ফ্রান্স জর্মনি প্রভৃতি যুদ্ধরত দেশকে অনেকদিন ধরেই স্বীকার করতে হল। তখন তারা আপনার সহজ আয়োজনের অনুপাতে নিজের ভোগকে সংযত করেছিল। তখন তারা বুঝেছিল, মানুষের আসল প্রয়োজনের ভার খুব বেশি নয়। যুদ্ধ-অবসানে সে কথাটা ভুলতে দেরি হয় নি।
অনতিপ্রয়োজনীয়কে প্রয়োজনীয় করে তোলা যখন দেশসুদ্ধ সকল লোকেরই নিত্য সাধনা হয় তখন বিশ্বব্যাপী দস্যুবৃত্তি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। লোকসংখ্যাবৃদ্ধির সমস্যা নিয়ে পাশ্চাত্যেরা অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন। সমস্যাটি কঠিন হবার প্রধান কারণ হচ্ছে, সর্বসাধারণেরই ভোগবাহুল্যের প্রতি দাবি। এত বড়ো ব্যাপক দাবি মেটাতে গেলে ধর্মরক্ষা করা চলে না, মানুষকে মানুষপীড়ক হতেই হয়। সেই পীড়ন-কার্যে ভালো করে হাত পাকানো হয় দূরস্থ অনাত্মীয় জাতির উপর দিয়ে। এর বিপদ এই যে, জীবনক্ষেত্রের যে কিনারাতেই ধর্মবুদ্ধিতে আগুন লাগানো হোক-না, সে আগুন সেইখানেই থেমে থাকে না। ভোগী স্বভাবতই যে-নিষ্ঠুরতার সাধনা করে তার সীমা নেই, কারণ, আত্মম্ভরিতা কোথাও এসে বলতে জানে না, “এইবার বস্ হয়েছে।” বস্তুগত আয়োজনের অসংগত বাহুল্যকেই যে-সভ্যতার প্রধান লক্ষণ বলে মানা হয় সে-সভ্যতা অগত্যাই নরভুক্। নররক্তশোষণের বিশ্বব্যাপী চর্চা একদিন আত্মহত্যায় ঠেকবেই, এতে আর সন্দেহ করা চলে না।
রেলগাড়ির ভোজনশালায় এক দিকে যেমন দেখা গেল ভোগের বাহুল্য, আর-এক দিকে তেমনি দেখলেম কর্মের গতিবেগ। সময় অল্প, আরোহী অনেক, ভোজ্যের বৈচিত্র্য প্রচুর, ভোজের উপকরণ বিস্তর–তাই পরিবেশনকর্মের অভ্যাস অতি আশ্চর্য দ্রুত হয়ে উঠেছে। পরিবেশনের যন্ত্রটাতে খুবই প্রবল জোরে দম দেওয়া হয়েছে। যেটা এই পরিবেষনে দেখা গেল পাশ্চাত্যের সমস্ত কর্মচালনার মধ্যেই সেই ক্ষিপ্রবেগ।
যে-যন্ত্র বাহিরের ব্যবহারের জন্য তার গতির ছন্দ দম দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত বাড়িয়ে তোলা চলে। কিন্তু আমাদের প্রাণের, আমাদের হৃদয়ের ছন্দের একটা স্বাভাবিক লয় আছে; তার উপরে দ্রুত প্রয়োজনের জবরদস্তি খাটে না। দ্রুত-চলাই যে দ্রুত-এগোনো সে কথা সত্য হতে পারে কলের গাড়ির পক্ষে, মানুষের পক্ষে না। মানুষের চলার সঙ্গে হওয়া আছে; সেই চলাতে হওয়াতে মিল ক’রে চলাই মানুষের চলা, কলের গাড়ির সে-উপসর্গ নেই। আপিসের তাগিদে মুহূর্তের মধ্যে এক গ্রাসের জায়গায় চার গ্রাস খাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু, সেই চার গ্রাস ঘড়ি ধরে হজম করা কলের মনিবের হুকুমে হতে পারে না। গ্রামোফোনের কান যদি মলে দেওয়া যায় তবে যে-গান গাইতে চার মিনিট লেগেছিল তাকে শুনতে আধ মিনিটের বেশি না লাগতে পারে, কিন্তু সংগীত হয়ে ওঠে চীৎকার। রসভোগ করবার জন্যে রসনার নিজের একটা নির্ধারিত সময় আছে; সন্দেশকে যদি কুইনিনের বড়ির মতো টপ্ করে গেলা যায় তা হলে বস্তুটাকে পাওয়া যায়, বস্তুর রস পাওয়া যায় না। তীরবেগে বাইসিক্ল্ ছুটিয়ে যদি পদাতিক বন্ধুর চাদর ধরি তা হলে বাইসিক্লের জয়পতাকা হাতে আসবে, কিন্তু বন্ধুকে বুকে পাবার উপায় সেটা নয়; কলের বেগ বাইরের দরকারে কাজে লাগে, অন্তরের দাবি মেটাবার বেলায় অন্তরের ছন্দ না মানলে চলে না।
বাইরের বেগ অন্তরের ছন্দকে অত্যন্ত বেশি পেরোয় কখন। যখন বাহ্য প্রয়োজনের বড়ো বাড় বাড়ে। তখন মানুষ পড়ে পিছিয়ে, কলের সঙ্গে সে তাল রাখতে পারে না। য়ুরোপে সেই মানুষ-ব্যক্তিটি দিনে দিনে বহু দূরে পড়ে গেল; কল গেল এগিয়ে; তাকেই সেখানকার লোকে বলে অগ্রসরতা, প্রোগ্রেস্।
সিদ্ধি, যাকে ইংরেজিতে বলে সাক্সেস্, তার বাহন যত দৌড়ে চলে ততই ফল পায়। য়ুরোপের দেশে দেশে রাষ্ট্রনীতির যুদ্ধনীতির বাণিজ্যনীতির তুমুল ঘোড়দৌড় চলছে জলে স্থলে আকাশে। সেখানে বাহ্য প্রয়োজনের গরজ অত্যন্ত বেশি হয়ে উঠল, তাই মনুষ্যত্বের ডাক শুনে কেউ সবুর করতে পারছে না। বীভৎস সর্বভুক্ পেটুকতার উদ্যোগে পলিটিক্স্ নিয়ত ব্যস্ত। তার গাঁট-কাটা ব্যবসায়ের পরিধি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্বকালে যুদ্ধবিগ্রহের পদ্ধতিতে ধর্মবুদ্ধি যেখানে মাঝে মাঝে বাধা খাড়া করে রেখেছিল, ডিপ্লমাসি সেখানে আজ লাফ-মারা হার্ড্ল্ রেস্ খেলে চলেছে। সবুর সয় না যে। বিষবায়ুবাণ যুদ্ধের অস্ত্ররূপে যখন এক পক্ষ ব্যবহার করলে তখন অন্য পক্ষ ধর্মবুদ্ধির দোহাই পাড়লে। আজ সকল পক্ষই বিষের সন্ধানে উঠে পড়ে লেগেছে; যুদ্ধকালে নিরস্ত্র পুরবাসীদের প্রতি আকাশ থেকে অগ্নিবাণ বর্ষণ নিয়ে প্রথমে শোনা গেল ধর্মবুদ্ধির নিন্দাবাণী। আজ দেখি, ধার্মিকেরা স্বয়ং সামান্য কারণে পল্লীবাসীদের প্রতি কথায় কথায় পাপবজ্র সন্ধান করছে। গত যুদ্ধের সময় শত্রুর সম্বন্ধে নানা উপায়ে সজ্ঞানে সচেষ্টভাবে সত্যগোপন ও মিথ্যা-প্রচারের শয়তানি অস্ত্র ব্যবহার প্রকাণ্ডভাবে চলল। যুদ্ধ থেমেছে কিন্তু সেই শয়তানি আজও থামে নি। এমন কি, অক্ষম ভারতবর্ষকেও প্রবলের প্রপাগাণ্ডা রেয়াত করে না। এইসব নীতি হচ্ছে সবুর-না-করা নীতি; এরা হল পাপের দ্রুত চাল; এরা প্রতি পদেই বাহিরে জিতছে বটে কিন্তু সে জিত অন্তরের মানুষকে হারিয়ে দিয়ে। মানুষ আজ নিজের মাথা থেকে জয়মাল্য খুলে নিয়ে কলের গলায় পরিয়ে দিলে। রসাতল থেকে দানব বলছে, “বাহবা!”–
রথীরে কহিল গৃহী উৎকণ্ঠায় ঊর্ধ্বস্বরে ডাকি,
“থামো, থামো, কোথা তুমি রুদ্রবেগে রথ যাও হাঁকি,
সম্মুখে আমার গৃহ।”
রথী কহে, “ওই মোর পথ,
ঘুরে গেলে দেরি হবে, বাধা ভেঙে সিধা যাবে রথ।”
গৃহী কহে, “নিদারুণ ত্বরা দেখে মোর ডর লাগে–
কোথা যেতে হবে বলো।”
রথী কহে, “যেতে হবে আগে।”
“কোন্খানে” শুধাইল।
রথী বলে, “কোনোখানে নহে,
শুধু আগে।”
“কোন্ তীর্থে, কোন্ সে মন্দিরে” গৃহী কহে।
“কোথাও না, শুধু আগে।”
“কোন্ বন্ধু সাথে হবে দেখা।”
“কারো সাথে নহে, যাব সব আগে আমি মাত্র একা।”
ঘর্ঘরিত রথবেগ গৃহভিত্তি করি দিল গ্রাস;
হাহাকারে, অভিশাপে, ধূলিজালে ক্ষুভিল বাতাস
সন্ধ্যার আকাশে! আঁধারের দীপ্ত সিংহদ্বার-বাগে
রক্তবর্ণ অস্তপথে ছোটে রথ লক্ষ্যশূন্য আগে।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৩
ক্রাকোভিয়া জাহাজ, ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯২৫
ক
বিষয়ী লোক শতদলের পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটি একটি করে জমা করে আর বলে, “পেয়েছি!” তার সঞ্চয় মিথ্যে। সংশয়ী লোক শতদলের পাপড়ি একটি একটি করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাকে কেটে কুটে নিঙরে মুচড়ে বলে, “পাই নি!” অর্থাৎ, সে উলটো দিকে চেয়ে বলে, “নেই।” রসিক লোক সেই শতদলের দিকে “আশ্চর্যবৎ পশ্যতি”। এই আশ্চর্যের মানে হল পেয়েছি পাই-নি দুই-ই সত্য। প্রেমিক বললে, “লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু, তবু হিয়ে জুড়ন না গেল।” অর্থাৎ, বললে লক্ষযুগের পাওয়া অল্পকালের মধ্যেই পেয়েছি আবার সেই সঙ্গেই লক্ষযুগের না-পাওয়াও লেগেই রইল। সময়টা-যে আপেক্ষিক, রসের ভাষায় সে কথাটা অনেকদিন থেকে বলা চলছে, বিজ্ঞানের ভাষায় আজ বলা হল।
যখন ছোটো ছিলেম, মনে পড়ে, বিশ্বজগৎ আমার কাছে প্রতিদিন অন্ধকার রাত্রির গর্ভ থেকে নূতন দেহ ধরে জন্ম নিত। পরিচয় আর অপরিচয় আমার মনের মধ্যে এক হয়ে মিলেছিল। আর সেই শিশুকাল পথিকের কাল। তখন পথের শেষের দিকে লক্ষ্য খুঁজি নি, পথের আশেপাশে চেয়ে চেয়ে চলছি, যেন কোন্ আবছায়ার ভিতর থেকে আচমকা দেখা দেবে একটা “কী জানি”, একটা “হয়তো”। বারান্দার কোণে খানিকটা ধুলো জড়ো করে আতার বিচি পুঁতে রোজ জল দিয়েছি। আজ যেটা আছে বীজ কাল সেটা হবে গাছ, ছেলেবেলায় সে একটা মস্ত “কী জানি”র দলে ছিল। সেই কী জানিকে দেখাই সত্য দেখা। সত্যের দিকে চেয়ে যে বলে “জানি” সেও তাকে হারায়, যে বলে “জানি নে” সেও করে ভুল, আমাদের ঋষিরা এই বলেন। যে বলে “খুব জানি” সেই অবোধ সোনা ফেলে চাদরের গ্রন্থিকে পাওয়া মনে করে, যে বলে “কিছুই জানি নে” সে তো চাদরটাকে সুদ্ধ খুইয়ে বসে। আমি ঈশোপনিষদের এই মানেই বুঝি। “জানি না” যখন “জানি”র আঁচলে গাঁঠছড়া বেঁধে দেখা দেয় তখন মন বলে “ধন্য হলেম।” পেয়েছি মনে করার মতো হারানো আর নেই।
খ
এইজন্যেই ভারতবর্ষকে ইংরেজ যেমন করে হারিয়েছে এমন আর য়ুরোপের কোনো জাত নয়। ভারতবর্ষের মধ্যে যে একটা চিরকেলে রহস্য আছে সেটা তার কাছ থেকে সরে গেল। তার ফৌজের গাঁঠের মধ্যে যে-বস্তুটাকে কষে বাঁধতে পারলে সেইটেকেই সে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ বলে বুক ফুলিয়ে গদীয়ান হয়ে বসে রইল। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তার বিস্ময় নেই, অবজ্ঞা যথেষ্ট আছে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বাইরে ইংরেজ ভারত সম্বন্ধে যত অল্প আলোচনা করেছে এমন ফ্রান্স করে নি, জর্মনি করে নি। পোলিটিশনের চশমার বাইরে ভারতবর্ষ ইংরেজজাতির গোচরে আছে, এ কথাটা তার দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিক কাগজ পড়ে দেখলে বোঝা যায় না।
এর একমাত্র কারণ, ভারতবর্ষে ইংরেজের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি। প্রয়োজনসাধনের দেখা নিছক পাওয়ারই দেখা, তার মধ্যে না-পাওয়ার আমেজ নেই। এইজন্যেই একে সত্যের দেখা বলা যায় না। এই দেখায় সত্য নেই ব’লেই তাতে বিস্ময় নেই, শ্রদ্ধা নেই।
প্রয়োজনের সম্বন্ধ হচ্ছে কেবলই গ্রহণের সম্বন্ধ; তাতে লোভ আছে, আনন্দ নেই। সত্যের সম্বন্ধ হচ্ছে পাওয়া এবং দেওয়ার মিলিত সম্বন্ধ; কেননা, আনন্দই মন খুলে দিতে জানে। এই কারণেই দেখতে পাই, ভারতবর্ষের প্রতি ইংরেজের ব্যক্তিগত বদান্যতার অদ্ভুত অভাব। এ কথা নিয়ে নালিশ করা বৃথা, এইটেই স্বাভাবিক। ইংরেজের লোভ যে ভারতবর্ষকে পেয়েছে ইংরেজের আত্মা সেই ভারতবর্ষকে হারিয়েছে। এইজন্যেই ভারতবর্ষে ইংরেজের লাভ, ভারতবর্ষে ইংরেজের গর্ব, ভারতবর্ষে ইংরেজের ক্লেশ। এইজন্যে ভারতবর্ষকে স্বাস্থ্য দেওয়া, শিক্ষা দেওয়া, মুক্তি দেওয়া সম্বন্ধে ইংরেজের ত্যাগ দুঃসাধ্য কিন্তু শাস্তি দেওয়া সম্বন্ধে ইংরেজের ক্রোধ অত্যন্ত সহজ। ইংরেজ-ধনী বাংলাদেশের রক্ত-নেংড়ানো পাটের বাজারে শতকরা চার-পাঁচশো টাকা মুনফা শুষে নিয়েও যে দেশের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে এক পয়সাও ফিরিয়ে দেয় না, তার দুর্ভিক্ষে বন্যায় মারী-মড়কে যার কড়ে আঙুলের প্রান্তও বিচলিত হয় না, যখন সেই শিক্ষাহীন স্বাস্থ্যহীন উপবাসক্লিষ্ট বাংলাদেশের বুকের উপর পুলিসের জাঁতা বসিয়ে রক্তচক্ষু কর্তৃপক্ষ কড়া আইন পাস করেন তখন সেই বিলাসী ধনী স্ফীত মুনফার উপর আরামের আসন পেতে বাহবা দিতে থাকে; বলে, “এই তো পাকা চালে ভারতশাসন।”
এইটেই স্বাভাবিক। কেননা, ওই ধনী বাংলাদেশকে একেবারেই দেখতে পায় নি, তার মোটা মুনফার ওপারে বাংলাদেশ আড়ালে পড়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রাণের নিকেতনে যেখানে ক্ষুধাতৃষ্ণার কান্না, বাংলাদেশের হৃদয়ের মাঝখানে যেখানে তার সুখ-দুঃখের বাসা, সেখানে মানুষের প্রতি মানুষের মৈত্রীর একটা বড়ো রাস্তা আছে, সেখানে ধর্মবুদ্ধির বড়ো দাবি বিষয়বুদ্ধির গরজের চেয়ে বেশি, এ কথা জানবার ও ভাববার মতো তার সময়ও নেই শ্রদ্ধাও নেই। তাই যখনই দেখে দরোয়ানির ব্যবস্থা কঠোরতর করা হচ্ছে তখনই মুনফা-বৎসলেরা পুলকিত হয়ে ওঠে। ল অ্যাণ্ড্ অর্ডার রক্ষা হচ্ছে দরোয়ানিতন্ত্র, পালোয়ানের পালা; সিম্প্যাথি অ্যাণ্ড রেস্পেক্ট্ হচ্ছে ধর্মতন্ত্র, মানুষের নীতি।
অবিচার করতে চাই নে, রাজ্যশাসন মাত্রেই ল অ্যাণ্ড অর্ডার চাই। নিতান্ত স্নেহপ্রেমের এলাকাতেও কানমলার বরাদ্দ থাকে। রাজ্যে ছট্ফটানি বৃদ্ধি হলে সাধারণ দণ্ডবিধি অসাধারণ অবৈধ হয়ে উঠলেও দোষ দিই নে। একপক্ষে দুরন্তপনা ঘটলে অন্যপক্ষে দৌরাত্ম্য ঘটা শক্তিমানের পক্ষে গৌরবের বিষয় না হলেও সেটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে। আসল কথা, কোনো শাসনতন্ত্রকে বিচার করতে হলে সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃতি বিচার করা চাই। যদি দেখা যায়, দেশের সকল মহলেই দরোয়ানের ঠেসাঠেসি ভিড়, অথচ তৃষ্ণায় যখন ছাতি ফাটছে, ম্যালেরিয়ায় যখন নাড়ী ছেড়ে যায়, তখন জনপ্রাণীর সাড়া নেই–যখন দেখি, দরোয়ানের তকমা শিরোপা বকশিশ বাহবা সম্বন্ধে দাক্ষিণ্যের অজস্রতা, কোতোয়ালি থেকে শুরু করে দেওয়ানি ফৌজদারি কোনো বিভাগের কারো দুঃখ গায়ে সয় না, কারো আবদার ব্যর্থ হতে চায় না অথচ ঘরের ছেলের প্রাণ যখন কণ্ঠাগত তখন আত্মনির্ভর সম্বন্ধে সৎপরামর্শ ছাড়া আর কোনো কথা নেই–অর্থাৎ গলায় যখন ফাঁস তখন দুর্গানাম স্মরণ করা ছাড়া আর কোনো উপদেশ যেখান থেকে মেলে না সেখানে পরিমাণের অসংগতিতেই দরোয়ানটাকে যমদূত বলে সহজেই মনে হয়। যে পাকা বাড়িটাতে সুহৃদ্ সহায় আত্মীয়ের চেয়ে পাহারাওয়ালার প্রভাবই বেশি সেই জায়গাটাকেই তো চলতি ভাষায় জেলখানা বলে থাকে। বাগানে তো ইচ্ছে করেই লোকে কাঁটাগাছের বেড়া দেয়, সে কি আমরা জানি নে। কিন্তু, যেখানে কাঁটাগাছেরই যত আদর, ফুলগাছ শুকিয়ে মরে গেল, সে-বাগানে আমাদের মনে যদি উৎসাহ না হয় তা হলে মালী সেটাকে আমাদের অবিবেচনা মনে করে কেন। যদি শাসনকর্তা জিজ্ঞাসা করেন, “তোমরা কি চাও না দেশে ল অ্যাণ্ড অর্ডার থাকে”, আমি বলি, “খুবই চাই, কিন্তু লাইফ অ্যাণ্ড্ মাইণ্ড্ তার চেয়ে কম মূল্যবান নয়।” মানদণ্ডের একটা পাল্লায় বিশ পঁচিশ মণ বাটখারা চাপানো দোষের নয়, অন্য পাল্লাটাতে যে-মাল চাপানো হয় তাতে যদি আমাদের নিজের স্বত্ব কিছু থাকে। কিন্তু যখন দেখি এ-পক্ষের দিকটাতেই যত রাজ্যের ইঁটপাথর, আর মালের পনেরো আনাই হল অন্য পক্ষের দিকে, তখন ফৌজে-পুলিশে-গড়া মানদণ্ডটা অপমানদণ্ড বলেই ঠেকে। নালিশ আমাদের পুলিশের বিরুদ্ধে নয়, নালিশ আমাদের এই ওজনের বিরুদ্ধে; নালিশ–আগুন জ্বলে ব’লে নয়, রান্না চড়ানো হয় না ব’লে। বিশেষত, সেই আগুনের বিল যখন আমাদেরই চোকাতে হয়। চুলিতে কাঠের খরচটাই এত সর্বনেশে হয়ে ওঠে যে হাঁড়িতে চাল ডাল জোগাবার কড়ি বাকি থাকে না। সেই অবস্থায় যখন পেটের জ্বালায় চোখে জল আসে তখন যদি কর্তা রাগ করে বলেন “তবে কি চুলোতে আগুন জ্বালব না”, ভয়ে ভয়ে বলি, “জ্বালবে বৈকি, কিন্তু ওটা-যে চিতার আগুন হয়ে উঠল।”
যে-দুঃখের কথাটা বলছি এটা জগৎ জুড়ে আজ ছড়িয়ে পড়েছে; আজ মুনফার আড়ালে মানুষের জ্যোতির্ময় সত্য রাহুগ্রস্ত। এইজন্যই মানুষের প্রতি কঠিন ব্যবহার করা, তাকে বঞ্চনা করা, এত সহজ হল। তাই পাশ্চাত্যে পলিটিক্স্ই মানুষের সকল চেষ্টার সর্বোচ্চ চূড়া দখল করে বসেছে। অর্থাৎ, মানুষের ফুলে-ওঠা পকেটের তলায় মানুষের চুপসে-যাওয়া হৃদয় পড়েছে চাপা। সর্বভুক্ পেটুকতার এমন বিস্তৃত আয়োজন পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনোদিন এমন কুৎসিত আকারে দেখা দেয় নি।
গ
আমাদের রিপু সত্যের সম্পূর্ণ-মূর্তিতে আচ্ছন্ন করে। কামে আমরা মাংসই দেখি, আত্মাকে দেখি নে; লোভে আমরা বস্তুই দেখি, মানুষকে দেখি নে; অহংকারে আমরা আপনাকেই দেখি, অন্যকে দেখি নে। একটা রিপু আছে যা এদের মতো উগ্র নয়, যা ফাঁকা। তাকে বলে মোহ; সে হচ্ছে জড়তা, অসাড়তা। আমাদের চৈতন্যের আলো ম্লান করে দিয়ে সে সত্যকে আবৃত করে। সে বিঘ্ন নয়, সে আবরণ। অভ্যাস অনেক সময় সেই মোহরূপে আমাদের মনকে আবিষ্ট করে।
কুয়াশায় পৃথিবীর বস্তুকে নষ্ট করে না, তার আকাশকে লুপ্ত করে। অসীমকে অগোচর করে দেয়। অভ্যাসের মোহ মনের সেই কুয়াশা। অনির্বচনীয়কে সে আড়াল করে, বিস্ময়রসকে সে শুকিয়ে ফেলে। তাতে সত্য পদার্থের গুরুত্ব কমে না, তার গৌরব কমে যায়। আমাদের মন তখন সত্যের অভ্যর্থনা করতে পারে না। বিস্ময় হচ্ছে সত্যের অভ্যর্থনা।
ডাক্তার বলে, প্রতিদিন একই অভ্যস্ত খাওয়া পরিপাকের পক্ষে অনুকূল নয়। ভোজ্য সম্বন্ধে রসনার বিস্ময় না থাকলে দেহ তাকে গ্রহণ করতে আলস্য করে। শিশুছাত্রদের একই ক্লাসে একই সময়ে একই বিষয় শিক্ষার পুনরাবৃত্তি করানোতেই তাদের শিক্ষার আগ্রহ ঘুচিয়ে দেওয়া হয়।
প্রাণের স্বভাবই চির-উৎসুক। প্রকৃতি তাকে ক্ষণে ক্ষণে আকস্মিকের স্পর্শে চঞ্চল করে রাখে। এমন কি, এই আকস্মিক যদি দুঃখ আকারেও আসে তাতেও চিত্তের বড়ো রকমের উদ্বোধন ঘটে। সীমার অতীত যা, আকস্মিক হচ্ছে তারই দূত; অভাবনীয়ের বার্তা নিয়ে সে আসে, চেতনাকে জড়ত্ব থেকে মুক্তি দেয়।
আমাদের দেশে তীর্থযাত্রা ধর্মসাধনার একটি প্রধান অঙ্গ। দেবতাকে যখন অভ্যাসের পর্দায় ঘিরে রাখে তখন আমরা সেই পর্দাকেই পূজা করি। যাদের মন স্বভাবতই বিষয়ী, ধর্মচর্চাতেও যারা বস্তুকে বেশি দাম দেয়, তারা দেবতার চেয়ে পর্দাকেই বেশি শ্রদ্ধা করে।
তীর্থযাত্রায় সেই পর্দা ঠেলে দিয়ে মন পথে বেরিয়ে পড়ে। তখন প্রতিদিনের সীমাবদ্ধ জানাকে চিরদিনের অসীম অজানার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা সহজ হয়। প্রতিদিন ও চিরদিনের সংগমস্থলেই সত্যের মন্দির।
এবারে তাই পথের দুই পাশে চাইতে চাইতে বেরিয়েছিলুম। অভ্যাসের জগতে যাকে দেখেও দেখি নে, মন জেগে উঠে বললে, সেই চির-অপরিচিত হয়তো কোথায় অজানা ফুলের মালা প’রে অজানা তারার রাত্রে দেখা দেবে। অভ্যাস বলে ওঠে, “সে নেই গো নেই, সে মরীচিকা।” গণ্ডীর বাইরেকার বিশ্ব বলে, “আছে বৈকি, তাকিয়ে দেখো। দেখা হয়ে চুকেছে মনে ক’রে দেখা বন্ধ কর, তাই তো দেখা হয় না।” তখন ক্ষণে ক্ষণে মনে হয়, “দেখা হল বুঝি।” পথিকের প্রাণের উদ্বোধন সেই কী-জানি। সেই কী-জানির উদ্দেশে গান লিখেছি। জীবনের সকল নৈরাশ্য, সকল বিড়ম্বনা, সকল তুচ্ছতার অবসাদ অতিক্রম করেও সেই কী-জানির আভাস আলোতে-ছায়াতে ঝল্মল্ করে উঠছে, পথিক তারই চমক নেবার জন্যে তার জানা ঘরের কোণ ফেলে পথে বেরিয়েছে।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৪
ক্রাকোভিয়া জাহাজ, ১১ই ফেব্রুয়ারী ১৯২৫
বৈষ্ণবী আমাকে বলেছিল, “কার বাড়িতে বৈরাগির কখন অন্ন জোটে তার ঠিকানা নেই; সে-অন্নে নিজের জোর দাবি খাটে না, তাই তো বুঝি এ অন্ন তিনিই জুগিয়ে দিলেন।” এই কথাই কাল বলেছিলাম, বাঁধা পাওয়ায় পাওয়ার সত্য ম্লান হয়ে যায়। না-পাওয়ার রসটা তাকে ঘিরে থাকে না। ভোগের মধ্যে কেবলমাত্রই পাওয়া, পশুর পাওয়া; আর সম্ভোগের মধ্যে পাওয়া না-পাওয়া দুই-ই মিলেছে, সে হল মানুষের।
ছেলেবেলা হতেই বিদ্যার পাকা বাসা থেকে বিধাতা আমাকে পথে বের করে দিয়েছেন। অকিঞ্চন-বৈরাগির মতো অন্তরের রাস্তায় একা চলতে চলতে মনের অন্ন যখন-তখন হঠাৎ পেয়েছি। আপন-মনে কেবলই কথা বলে গেছি, সেই হল লক্ষ্মীছাড়ার চাল। বলতে বলতে এমন কিছু শুনতে পাওয়া যায় যা পূর্বে শুনি নি। বলার স্রোতে যখন জোয়ার আসে তখন কোন্ গুহার ভিতরকার অজানা সামগ্রী ভেসে ভেসে ঘাটে এসে লাগে। মনে হয় না, তাতে আমার বাঁধা বরাদ্দের জোর আছে। সেই আচমকা পাওয়ার বিস্ময়ই তাকে উজ্জ্বল করে তোলে, উল্কা যেমন হঠাৎ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে আগুন হয়ে ওঠে।
পৃথিবীতে আমার প্রেয়সীদের মধ্যে যিনি সর্বকনিষ্ঠ তাঁর বয়স তিন। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে যেতে তাঁর এক মুহূর্ত বিরাম নেই। শ্রোতা যারা তারা উপলক্ষ; বস্তুত কথাগুলো নিজেকেই নিজে শোনানো; যেমন বাস্পরাশি ঘুরতে ঘুরতে গ্রহতারারূপে দানা বেঁধে ওঠে তেমনি কথা-বলার বেগে আপনিই তার সজাগ মনে চিন্তার সৃষ্টি হতে থাকে। বাইরে থেকে মাস্টারের বাচালতা যদি এই স্রোতকে ঠেকায় তা হলে তার আপন চিন্তাধারার সহজ পথ বন্ধ হয়ে যায়। শিশুর পক্ষে অতিমাত্রায় পুঁথিগত বিদ্যাটা ভাবনার স্বাভাবিক গতিকে আটকিয়ে দেওয়া। বিশ্বপ্রকৃতি দিনরাত্রি কথা কইছে, সেই কথা যখন শিশুর মনকে কথা কওয়ায় তখন তার সেই আপন কথাই তার সব চেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রণালী। মাস্টার নিজে কথা বলে, আর ছেলেকে বলে “চুপ”। শিশুর চুপ-করা মনের উপর বাইরের কথা বোঝার মতো এসে পড়ে, খাদ্যের মতো নয়। যে-শিশুশিক্ষাবিভাগে মাস্টারের গলাই শোনা যায়, শিশুরা থাকে নীরব, সেখানে আমি বুঝি মরুভূমির উপর শিলবৃষ্টি হচ্ছে।
যাই হোক, মাস্টারের হাতে বেশি দিন ছিলেম না বলে আমি যা-কিছু শিখেছি সে কেবল বলতে-বলতে। বাইরে থেকেও কথা শুনেছি, বই পড়েছি; সে কোনোদিনই সঞ্চয় করবার মতো শোনা নয়, মুখস্থ করবার মতো পড়া নয়। কিছু-একটা বিশেষ ক’রে শেখবার জন্যে আমার মনের ধারার মধ্যে কোথাও বাঁধ বাঁধি নি। তাই সেই ধারার মধ্যে যা এসে পড়ে তা কেবলই চলাচল করে, ঠাঁই বদল করতে করতে বিচিত্র আকারে তারা মেলে মেশে। এই মনোধারার মধ্যে রচনার ঘূর্ণি যখন জাগে তখন কোথা হতে কোন্ সব ভাসা কথা কোন্ প্রসঙ্গমূর্তি ধরে এসে পড়ে তা কি আমি জানি?
অনেকে হয়তো ভাবেন, ইচ্ছা করলেই বিশেষ বিষয় অবলম্বন করে আমি বিশেষভাবে বলতে বা লিখতে পারি। যাঁরা পাকা বক্তা বা পাকা লেখক তাঁরা পারেন; আমি পারি নে। যার আছে গোয়াল, ফরমাশ করলেই বিশেষ বাঁধা গোরুটাকে বেছে এনে সে দুইতে পারে। আর যার আছে অরণ্য, যে-গোরুটা যখন এসে পড়ে তাকে নিয়েই তার উপস্থিতমতো কারবার। আসু মুখুজ্জে মশায় বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করতে হবে। তখন তো ভয়ে ভয়ে বললেম, আচ্ছা। তার পরে যখন জিজ্ঞাসা করলেন বিষয়টা কী, তখন চোখ বুজে বলে দিলেম, সাহিত্য সম্বন্ধে। সাহিত্য সম্বন্ধে কী যে বলব আগেভাগে তা জানবার শক্তিই ছিল না। একটা অন্ধ ভরসা ছিল যে, বলতে বলতেই বিষয় গড়ে উঠবে। তিনদিন ধরে বকেছিলেম। শুনেছি অনেক অধ্যাপকের পছন্দ হল না। বিষয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় দুইয়েরই মর্যাদা রাখতে পারি নি। তাঁদের দোষ নেই, সভাস্থলে যখন এসে দাঁড়ালেম তখন মনের মধ্যে বিষয় বলে কোনো বালাই ছিল না। বিষয় নিয়েই যাঁদের প্রতিদিনের কারবার বিষয়হীনের অকিঞ্চনতা তাঁদের কাছে ফস্ করে ধরা পড়ে গেল।
এবার ইটালিতে মিলান শহরে আমাকে বক্তৃতা দিয়ে হয়েছিল। অধ্যাপক ফর্মিকি বারবার জিজ্ঞাসা করলেন, বিষয়টা কী? কী করে তাঁকে বলি যে, যে-অন্তর্যামী তা জানেন তাঁকে প্রশ্ন করলে জবাব দেন না। তাঁর ইচ্ছা ছিল,যদি একটা চুম্বক পাওয়া যায় তবে আগেই সেটা তর্জমা করে ছাপিয়ে রাখবেন। আমি বলি, সর্বনাশ! বিষয় যখন দেখা দেবে চুম্বক তার পরেই সম্ভব। ফল ধরবার আগেই তার আঁঠি খুঁজে পাই কী উপায়ে। বক্তৃতা সম্বন্ধে আমার ভদ্র অভ্যাস নেই, আমার অভ্যাস লক্ষ্মীছাড়া। ভেবে বলতে পারি নে, বলতে বলতে ভাবি, মৌমাছির পাখা যেমন উড়তে গিয়ে গুন্গুন্ করে। সুতরাং, অধ্যাপক হবার আশা আমার নেই, এমন কি, ছাত্র হবারও ক্ষমতার অভাব।
এমনি করে দৈবক্রমে বৈরাগির তত্ত্বকথাটা বুঝে নিয়েছি। যারা বিষয়ী তারা বিশ্বকে বাদ দিয়ে বিশেষকে খোঁজে। যারা বৈরাগি তারা পথে চলতে চলতেই বিশ্বের সঙ্গে মিলিয়ে বিশেষকে চিনে নেয়। উপরি-পাওনা ছাড়া তাদের কোনো বাঁধাপাওনাই নেই। বিশ্বপ্রকৃতি স্বয়ং যে এই লক্ষ্যহীন বৈরাগি–চলতে চলতেই তার যা-কিছু পাওয়া। জড়ের রাস্তায় চলতে চলতে সে হঠাৎ পেয়েছে প্রাণকে, প্রাণের রাস্তায় চলতে চলতে সে হঠাৎ পেয়েছে মানুষকে। চলা বন্ধ করে যদি সে জমাতে থাকে তা হলেই সৃষ্টি হয়ে ওঠে জঞ্জাল। তখনই প্রলয়ের ঝাঁটার তলব পড়ে।
বিশ্বের মধ্যে একটা দিক আছে যেটা তার স্থাবর বস্তুর অর্থাৎ বিষয়সম্পত্তির দিক নয়; যেটা তার চলচ্চিত্তের নিত্য প্রকাশের দিক। যেখানে আলো ছায়া সুর, যেখানে নৃত্য গীত বর্ণ গন্ধ, যেখানে আভাস ইঙ্গিত। যেখানে বিশ্ববাউলের একতারার ঝংকার পথের বাঁকে বাঁকে বেজে বেজে ওঠে, যেখানে সেই বৈরাগির উত্তরীয়ের গেরুয়া রঙ বাতাসে বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে উড়ে যায়। মানুষের ভিতরকার বৈরাগিও আপন কাব্যে গানে ছবিতে তারই জবাব দিতে দিতে পথে চলে, তেমনিতরোই গানের নাচের রূপের রসের ভঙ্গীতে। বিষয়ী লোকে আপন খাতাঞ্চিখানায় বসে যখন তা শোনে তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “বিষয়টা কী। এতে মুনফা কী আছে। এতে কী প্রমাণ করে।” অধরকে ধরার জায়গা সে খোঁজে তার মুখবাঁধা থলিতে, তার চামড়াবাঁধানো খাতায়। নিজের মনটা যখন বৈরাগি হয় নি তখন বিশ্ববৈরাগির বাণী কোনো কাজে লাগে না। তাই দেখেছি, খোলা রাস্তার বাঁশিতে হঠাৎ-হাওয়ায় যে-গান বনের মর্মরে নদীর কল্লোলের সঙ্গে সঙ্গে বেজেছে, যে-গান ভোরের শুকতারার পিছে পিছে অরুণ-আলোর পথ দিয়ে চলে গেল, শহরের দরবারে ঝাড়লণ্ঠনের আলোতে তারা ঠাঁই পেল না; ওস্তাদেরা বললে, “এ কিছুই না”, প্রবীণেরা বললে, “এর মানে নেই”! কিছু নয়ই তো বটে; কোনো মানে নেই, সে-কথা খাঁটি; সোনার মতো নিকষে কষা যায় না, পাটের বস্তার মতো দাঁড়িপাল্লায় ওজন চলে না। কিন্তু, বৈরাগি জানে, অধর রসেই ওর রস। কতবার ভাবি গান তো এসেছে গলায় কিন্তু শোনাবার লগ্ন রচনা করতে তো পারি নে; কান যদি-বা খোলা থাকে আন্মনার মন পাওয়া যাবে কোথায়। সে-মন যদি তার গতি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে তবেই-তো যা বলা যায় না তাই সে শুনবে, যা জানা যায় না তাই সে বুঝবে।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৫
ক্রাকোভিয়া জাহাজ, ১২ই ফেব্রুয়ারী ১৯২৫
জন্মকাল থেকে আমাকে একখানা নির্জন নিঃসঙ্গতার ভেলার মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তীরে দেখতে পাচ্ছি লোকালয়ের আলো, জনতার কোলাহল; ক্ষণে ক্ষণে ঘাটেও নামতে হয়েছে, কিন্তু কোনোখানে জমিয়ে বসতে পারি নি। বন্ধুরা ভাবে তাদের এড়িয়ে গেলুম; শত্রুরা ভাবে, অহংকারেই দূরে দূরে থাকি। যে-ভাগ্যদেবতা বরাবর আমাকে সরিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল, পাল গোটাতে সময় দিলে না, রশি যতবার ডাঙার খোঁটায় বেঁধেছি টান মেরে ছিঁড়ে দিয়েছে, সে কোনো কৈফিয়ত দিলে না।
সুখদুঃখের হিসাবনিকাশ নিয়ে ভাগ্যের সঙ্গে তকরার করে লাভ নেই। যা হয়েছে তার একটা হেতু আছে, সেই হেতুর উপর রাগ করলে হাওয়ার উপরেই রাগতে হয়। ঘড়া রাগ করে ঠং ঠং শব্দে যদি বলে “আমাকে শূন্য করে গড়েছে কেন”, তার জবাব হচ্ছে, “তোমাকে শূন্য করবে বলেই ঘড়া করে নি, ঘড়া করবে বলেই শূন্য করেছে।” ঘড়ার শূন্যতা পূর্ণতারই অপেক্ষায়। আমার একলা-আকাশের ফাঁকটাকে ভরতি করতে হবে, সেই প্রত্যাশাটা আমার সঙ্গে সঙ্গে লেগে আছে। দৈবের এই দাবিটিই আমার সম্মান; একে রক্ষা করতে হলে পুরাপুরি দাম দিতে হবে।
তাই শূন্য আকাশে একলা বসে ভাগ্যনির্দিষ্ট কাজ করে থাকি। তাতেই আমার হওয়ার অর্থটা বুঝি, কাজেই আনন্দও পাই। বাঁশির ফাঁকটা যখন সুরে ভরে ওঠে তখন তার আর-কোনো নালিশ থাকে না।
শরীরে মনে প্রাণের দক্ষিণ হাওয়া যখন জোরে বয় তখন আত্মপ্রকাশের দাক্ষিণ্যেই আমার যথেষ্ট পুরস্কার মেলে। কিন্তু যখন ক্লান্তি আসে, যখন পথ ও পাথেয় দুই-ই যায় কমে অথচ সামনে পথটা দেখতে পাই সুদীর্ঘ, তখন ছেলেবেলা থেকে যে-ঘর বাঁধবার সময় পাই নি সেই ঘরের কথা মন জিজ্ঞাসা করতে থাকে। তখনই আকাশের তারা ছেড়ে দীপের আলোর দিকে চোখ পড়ে। জীবলোকে ছোটো ছোটো মাধুরীর দৃশ্য যা তীরের থেকে দেখা দিয়ে সরে সরে গিয়েছে, চোখের উপরকার আলো ম্লান হয়ে এলে সেই অন্ধকারে তাদের ছবি ফুটে ওঠে; তখন বুঝতে পারি, সেই-সব ক্ষণিকের দেখা প্রত্যেকেই মনের মধ্যে কিছু-না-কিছু ডাক দিয়ে গেছে। তখন মনে হয়, বড়ো বড়ো কীর্তি গড়ে তোলাই-যে বড়ো কথা তা নয়, পৃথিবীতে যে-প্রাণের যজ্ঞ সম্পন্ন করবার জন্যে নিমন্ত্রণ পেয়েছি তাতে উৎসবের ছোটো পেয়ালাগুলি রসে ভরে তোলা শুনতে সহজ, আসলে দুঃসাধ্য।
এবারে ক্লান্ত দুর্বল শরীর নিয়ে বেরিয়েছিলুম। তাই, অন্তরে যে-নারী প্রকৃতি অন্তঃপুরচারিণী হয়ে বাস করে ক্ষণে ক্ষণে সে আপন ঘরের দাবি জানবার সময় পেয়েছিল। এই দাবির মধ্যে আমার পক্ষে কেবল যে আরামের লোভ তা নয়, সার্থকতার আশাও রয়েছে। জীবনপথের শেষদিকে বিশ্বলক্ষ্মীর আতিথ্যের জন্যে শ্রান্ত চিত্তের যে ঔৎসুক্য সে কেবল শক্তির অপচয় নিবারণের আগ্রহে, পাথেয় পূর্ণ করে নেবার জন্যে। কাজের হুকুম এখনো মাথার উপর অথচ উদ্যম এখন নিস্তেজ, মন তাই প্রাণশক্তির ভাণ্ডারীর খোঁজ করে। শুষ্ক তপস্যার পিছনে কোথায় আছে অন্নপূর্ণার ভাণ্ডার।
দিনের আলো যখন নিবে আসছে, সামনের অন্ধকারে যখন সন্ধ্যার তারা দেখা দিল, যখন জীবনযাত্রার বোঝা খালাস করে অনেকখানি বাদ দিয়ে অল্প-কিছু বেছে নেবার জন্যে মনকে তৈরি হতে হচ্ছে, তখন কোন্টা রেখে কোন্টা নেবার জন্যে মনের ব্যগ্রতা আমি তাই লক্ষ্য করে দেখছি। সমস্ত দিন প্রাণপণ চেষ্টায় যা-কিছু সে জমিয়েছিল, গড়ে তুলেছিল, সংসারের হাটে যদি তার কিছু দাম থাকে তবে তা সেইখানেই থাক্, যারা আগলে রাখতে চায় তারাই তার খবরদারি করুক; রইল টাকা, রইল খ্যাতি, রইল কীর্তি, রইল পড়ে বাইরে; গোধূলির আঁধার যতই নিবিড় হয়ে আসছে ততই তারা ছায়া হয়ে এল; তারা মিলিয়ে গেল মেঘের গায়ে সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটার সঙ্গে। কিন্তু, যে-অনাদি অন্ধকারের বুকের ভিতর থেকে একদিন এই পৃথিবীতে বেরিয়ে এসেছি সেখানকার প্রচ্ছন্ন উৎস থেকে উৎসারিত জলধারা ক্ষণে ক্ষণে আমার যাত্রাপথের পাশে পাশে মধুর কলস্বরে দেখা দিয়ে আমার তৃষ্ণা মিটিয়েছে, আমার তাপ জুড়িয়েছে, আমার ধূলো ধুয়ে দিয়েছে, সেই তীর্থের জল ভরে রইল আমার স্মৃতির পাত্রখানি। সেই অন্ধকার অপরিসীমের হৃদয়কন্দর থেকে বারবার যে-বাঁশির ধ্বনি আমার প্রাণে এসে পৌঁচেছিল, কত মিলনে, কত বিরহে, কত কান্নায়, কত হাসিতে; শরতের ভোরবেলায়, বসন্তের সায়াহ্নে, বর্ষার নিশীথরাত্রে; কত ধ্যানের শান্তিতে, পূজার আত্মনিবেদনে দুঃখের গভীরতায়; কত দানে, কত গ্রহণে, কত ত্যাগে, কত সেবায়–তারা আমার দিনের পথে সুর হয়ে বেজেছিল, আজ তারাই আমার রাত্রের পথে দীপ হয়ে জ্বলে উঠছে। সেই অন্ধকারের ঝরনা থেকেই আমার জীবনের অভিষেক, সেই অন্ধকারের নিস্তব্ধতার মধ্যে আমার মৃত্যুর আমন্ত্রণ; আজ আমি তাকে বলতে পারব, হে চিরপ্রচ্ছন্ন, আমার মধ্যে যা-কিছু তুমি তোমার গভীরের ভিতর থেকে তারার মতো প্রকাশ করেছ রূপে ও বাণীতে, তাতেই নিত্যকালের অমৃত; আমি খুঁজে খুঁজে পাথর কুড়িয়ে কুড়িয়ে কীর্তির যে-জয়স্তম্ভ গেঁথেছি, কালস্রোতের ভাঙনের উপরে তার ভিত। সেইজন্যেই আজ গোধূলির ধূসর আলোয় একলা বসে ভাবছিলুম, রঙিন রসের অক্ষরে লেখা যে-লিপি তোমার কাছ থেকে ক্ষণে ক্ষণে এসেছিল ভালো করে তা পড়া হয় নি, ব্যস্ত ছিলুম। তার মধ্যে নিমন্ত্রণ ছিল। কোথায়। কারখানাঘরে নয়, খাতঞ্চিখানায় নয়, ছোটো ছোটো কোণে যেখানে ধরণীর ছোটো সুখগুলি লুকানো। তাই আজ পিছন ফিরে তাকিয়ে মনে মনে ভেবে দেখছি, কতবার বঞ্চিত হলুম। জনতার জয়ধ্বনির ডাকে কতবার অন্যমনে গভীর নিভৃতের পাশ দিয়ে চলে এসেছি; মায়ামৃগের অনুসরণে কতবার সরল সুন্দরের দিকে চোখ পড়ল না। জীবনপথে আশে পাশে সুধার-কণা-ভরা যে বিনামূলের ফলগুলি পাতার আড়ালে ঢাকা ছিল, তাদের এড়িয়ে উপবাসী হয়ে চলে এসেছি বলেই এত শ্রান্তি, এত অবসাদ। প্রভাত যেখান থেকে আপন পেয়ালা আলোতে ভরে নেয়, রাত্রি যার আঙিনায় বসে প্রাণের ছিন্ন সূত্রগুলি বারে বারে জুড়ে তোলে, ওই লুকিয়ে-থাকা ছোটো ফলগুলি সেই মহান্ধকারেরই রহস্য-গর্ভ থেকে রস পেয়ে ফলে উঠছে, সেই অন্ধকার–যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৬
ক্রাকোভিয়া জাহাজ, ১৩ই ফেব্রুয়ারী ১৯২৫
বাংলা ভাষায় প্রেম অর্থে দুটো শব্দের চল আছে; ভালোলাগা আর ভালোবাসা। এই দুটো শব্দে আছে প্রেমসমুদ্রের দুই উলটোপারের ঠিকানা। যেখানে ভালোলাগা সেখানে ভালো আমাকে লাগে, যেখানে ভালোবাসা সেখানে ভালো অন্যকে বাসি। আবেগের মুখটা যখন নিজের দিকে তখন ভালোলাগা, যখন অন্যের দিকে তখন ভালোবাসা। ভালোলাগায় ভোগের তৃপ্তি, ভালোবাসায় ত্যাগের সাধন।
সংস্কৃত ভাষায় অনুভব বলতে যা বুঝি তার খাঁটি বাংলা প্রতিশব্দ একদিন ছিল। এতবড়ো একটা চলতি ব্যবহারের কথা হারালো কোন্ ভাগ্যদোষে বলতে পারি নে। এমন দিন ছিল যখন লাজবাসা ভয়বাসা বলতে বোঝাত লজ্জা অনুভব করা, ভয় অনুভব করা। এখন বলি, লজ্জা পাওয়া, ভয় পাওয়া। কিল খাওয়া, গাল খাওয়া, যেমন ভাষার বিকার–লজ্জা পাওয়া, ভয় পাওয়াও তেমনি।
কারো ‘পরে আমাদের অনুভব যখন সম্পূর্ণ ভালো হয়ে ওঠে, ভালো-ভাষায় ভালো-ইচ্ছায় মন কানায় কানায় ভরতি হয় তখন তাকেই বলি ভালোবাসা। পূর্ণ উৎকর্ষের ভাবকেই বলা যায় ভালো। স্বাস্থ্য যেমন প্রাণের পূর্ণতা, সৌন্দর্য যেমন রূপের পূর্ণতা, সত্য যেমন জ্ঞানের পূর্ণতা, ভালোবাসা তেমনি অনুভূতির পূর্ণতা। ইংরেজিতে গুড্ ফীলিং বলে এ তা নয়, একে বলা যেতে পারে পারফেক্ট্ ফীলিং।
শুভ-ইচ্ছার পূর্ণতা হচ্ছে নৈতিক, তার ক্রিয়া ব্যবহারের উপর; ভালোবাসার পূর্ণতা আত্মিক, সে হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিস্বরূপে (personality-র) পরম প্রকাশ; শুভ-ইচ্ছা অন্ধকারে যষ্টি, প্রেম অন্ধকারে চাঁদ। মায়ের স্নেহ মায়ের শুভ-ইচ্ছা মাত্র নয়, তা তাঁর পূর্ণতার ঐশ্বর্য। তা অন্নের মতো নয়, তা অমৃতের মতো। এই অনুভূতির পূর্ণতা একটি শক্তি। ভালোবাসার বিষয়ের মধ্যে অসীমকে বোধ করবার শক্তি; ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে অপরিমেয়কে দেখতে পাওয়া এবং স্বীকার করাই অপরিমেয়কে সীমার মন্দিরে জাগিয়ে তোলবার শক্তি।
নিজের অস্তিত্বের মূল যে-মানুষ ছোটো করে দেখে আত্ম-অবিশ্বাসের অবসাদেই সে নিজের সম্পদ উদ্ঘাটিত করতে ভরসা পায় না। বিশ্ব আপনার সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রত্যেক মানুষকে গ্রহণ ও ধারণ করে, মানুষের অন্তরে এই মস্ত সত্যটির অনুভব হচ্ছে প্রেম। ব্যক্তিবিশেষকে সে ডাক দিয়ে বলে, “তুমি কারোর চেয়ে কম নও, তোমার মধ্যে এমন মূল্য আছে যার জন্যে প্রাণ দেওয়া চলে।” মানুষ যেখানে আপন সীমা টেনে দিয়ে নিজেকে সাধারণের শামিল করে অলস হয়ে বসে থাকে প্রেম ব্যক্তিবিশেষের সেই সাধারণ সীমাকে মানে না, তাকে অর্ঘ্য দিয়ে বলে, “তোমার কপালে আমি তিলক দিয়েছি, তুমি অসাধারণ।” সূর্যের আলো বৃষ্টির জল যেমন নির্বিচারে সর্বত্রই মাটির জড়তা ও দৈন্য অস্বীকার করে, মরুকে বারবার স্পর্শ করে, তাকে শ্যামলতায় পুলকিত করে তোলে, যে-ভূমি রিক্ত তারও সফলতার জন্যে যেমন তাদের নিরন্তর প্রতীক্ষা, তার কাছেও যেমন পূর্ণতার দাবি, মানুষের সমাজে প্রেম তেমনি সব জায়গাতেই অসীম প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখে। ব্যক্তিকে সে যে মূল্য দেয় সে মূল্য মহিমার মূল্য। অন্তর্নিহিত এই মহিমার আশ্বাসে মানুষের সৃষ্টিশক্তি নানাদিকে পূর্ণ হয়ে ওঠে; তার কর্মের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
এই ব্যক্তিগত প্রেমের বাহন নারী। ইতিহাসের অপ্রকাশিত লিখন যদি বের করা যেত তা হলে দেখতে পেতাম নারীর প্রেমের প্রেরণা মানুষের সমাজে কী কাজ করেছে। শক্তির যে-ক্রিয়া উদ্যত চেষ্টারূপে চঞ্চল আমরা তাকেই শক্তির প্রকাশরূপে দেখি, কিন্তু যে-ক্রিয়া গূঢ় উদ্দীপনারূপে পরিব্যাপ্ত তার কথা মনেই আনি নে। বিস্ময়ের কথা এই যে বিশ্বের স্ত্রীপ্রকৃতিকেই ভারতবর্ষ শক্তি বলে জেনেছে।
সকলেই জানে, এই শক্তিরই বিকারের মতো এমন সর্বনেশে বিপদ আর কিছুই নেই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীমের হৃদয়ের মধ্যে অদৃশ্য থেকে দ্রৌপদী তাঁকে বল জুগিয়েছেন। বীর আণ্টনির হৃদয় অধিকার করে ক্লিওপাট্রা তাঁর বল হরণ করে নিল। সত্যবানকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করেন সাবিত্রী, কিন্তু কত নারী পুরুষের সত্য নষ্ট করে তাকে মৃত্যুর মুখে নিয়ে গেছে তার সংখ্যা নেই।
তাই তো গোড়ায় বলেছি, প্রেমের দুই বিরুদ্ধ পার আছে। এক পারে চোরাবালি, আর-এক পারে ফসলের খেত। এক পারে ভালোলাগার দৌরাত্ম, অন্য পারে ভালোবাসার আমন্ত্রণ। মাতৃস্নেহের মধ্যেও এই দুই জাতের প্রেম। একটাতে প্রধানত আসক্তি নিজের পরিতৃপ্তি খোঁজে; সেই অন্ধ মাতৃস্নেহ আমাদের দেশে বিস্তর দেখতে পাই। তাতে সন্তানকে বড়ো ক’রে না তুলে তাকে অভিভূত করে। তাতে কোনো পক্ষেরই কল্যাণ নেই। যে-প্রেম ত্যাগের দ্বারা মানুষকে মুক্তি দিতে জানে না পরন্তু ত্যাগের বিনিময়ে মানুষকে আত্মসাৎ করতে চায় সে-প্রেম তো রিপু। এক পক্ষকে ক্ষুধার দাহে সে দগ্ধ করে, অন্য পক্ষকে লালায়িত আসক্তি দ্বারা লেহন করে জীর্ণ করে দেয়। এই মাতৃলালনপাশের পরিবেষ্টনের মধ্যে যারা চির-অবরুদ্ধ আমাদের দেশে তাদের সংখ্যা বিস্তর; তাদের শৈশব আর ছাড়তে চায় না। আসক্তি-পরায়ণ মাতার মূঢ় আদেশপালনের অনর্থ বহন করে অপমানের মধ্যে অভাবের মধ্যে চিরজীবনের মতো মাথা হেঁট হয়ে গেছে, এমন-সকল বয়স্ক নাবালকের দল আমাদের দেশে ঘরে ঘরে। আমাদের দেশে মাতার ক্রোড়রাজত্ববিস্তারে পৌরুষের যত হানি হয়েছে এমন বিদেশি শাসনের হাতকড়ির নির্মমতার দ্বারাও হয় নি।
স্ত্রীপুরুষের প্রেমেও সেই একই কথা। নারীর প্রেম পুরুষকে পূর্ণশক্তিতে জাগ্রত করতে পারে; কিন্তু সে-প্রেম যদি শুক্লপক্ষের না হয়ে কৃষ্ণপক্ষের হয় তবে তার মালিন্যের আর তুলনা নেই। পুরুষের সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ তপস্যায়; নারীর প্রেমে ত্যাগধর্ম সেবাধর্ম সেই তপস্যারই সুরে সুর-মেলানো; এই দুয়ের যোগে পরস্পরের দীপ্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নারীর প্রেমে আর-এক সুরও বাজতে পারে, মদনধনুর জ্যায়ের টঙ্কার–সে মুক্তির সুর না, সে বন্ধনের সংগীত। তাতে তপস্যা ভাঙে, শিবের ক্রোধানল উদ্দীপ্ত হয়।
কেন বলি, পুরুষের ধর্ম তপস্যা। কারণ, জীবলোকের কাজে প্রকৃতি তাকে নারীর তুলনায় অনেক পরিমাণে অবকাশ দিয়েছে। সেই অবকাশটাকে নষ্ট করলেই তার সবচেয়ে ফাঁকি। পুরুষ সেই অবকাশকে আপন সাধনার ক্ষেত্র করেছে বলেই মানুষের উৎকর্ষ জৈব প্রকৃতির সীমানা অনেক দূরে ছাড়িয়ে গেল। প্রকৃতির দাবি থেকে মুক্তি নিয়েই পুরুষ জ্ঞানকে ধ্যানকে শক্তিকে অসীমের মধ্যে অনুসরণ করে চলছে। সেইজন্যে পুরুষের সাধনায় চিরকালই প্রকৃতির সঙ্গে বিরুদ্ধতা আছে। নারীর প্রেম যেখানে এই বিরোধের সমন্বয় করে দেয়, কঠোর জ্ঞানের বেদিপ্রাঙ্গণে সে যখন পূজামাধুর্যের আসন রচনা করে–পুরুষের মুক্তিকে যখন সে লুপ্ত করে না, তাকে সুন্দর করে তোলে–তার পথকে অবরুদ্ধ করে না, পথের পাথেয় জুগিয়ে দেয়–ভোগবতীর জলে ডুবিয়ে দেয় না, সুরধুনীর জলে স্নান করায়–তখন বৈরাগ্যের সঙ্গে অনুরাগের, হরের সঙ্গে পার্বতীর, শুভপরিণয় সার্থক হয়।
বিচ্ছেদের ভিতর দিয়েই শক্তি কাজ করবার ক্ষেত্র পায়। চাঁদ ও পৃথিবীর মাঝখানে যে-বিরহ আছে তারই অবকাশে পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রকে চাঁদ কথা কওয়ায়। স্ত্রীপুরষের পরস্পরে মাঝে বিধাতা একটি দূরত্ব রেখে দিয়েছেন। এই দূরত্বের ফাঁকটাই কেবলই সেবায় ক্ষমায় বীর্যে সৌন্দর্যে কল্যাণে ভরে ওঠে; এইখানেই সীমায় অসীমে শুভদৃষ্টি। জৈবক্ষেত্রে প্রকৃতির অধিকারের মধ্যে মানুষের অনেক সৃষ্টি আছে, কিন্তু চিত্তক্ষেত্রে তার সৃষ্টির অন্ত নেই। চিত্তের মহাকাশ স্থূল আসক্তির দ্বারা জমাট হয়ে না গেলে তবেই সেই সৃষ্টির কাজ সহজ হয়। দীপশিখাকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে যে-মাতাল বেশি করে পেতে চায়, সে নিজেও পোড়ে, আলোটিকেও নিবিয়ে দেয়।
মুক্ত অবকাশের মধ্যে পুরুষ মুক্তিসাধনার যে-মন্দির বহুদিনের তপস্যায় গেঁথে তুলেছে পূজারিনী নারী সেইখানে প্রেমের প্রদীপ জ্বালবার ভার পেল। সে-কথা যদি সে ভুলে যায়, দেবতার নৈবেদ্যকে যদি সে মাংসের হাটে বেচতে কুণ্ঠিত না হয়, তা হলে মর্ত্যের মর্মস্থানে যে-অমরাবতী আছে তার পরাভব ঘটে; পুরুষ যায় প্রমত্ততার রসাতলে, আর নারীর হৃদয়ে যে রসের পাত্র আছে তা ভেঙে গিয়ে সে-রস ধূলাকে পঙ্কিল করে।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৭
ক্রাকোভিয়া, ১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯২৫
ফুলের মধ্যে যে-আনন্দ সে প্রধানত ফলের প্রত্যাশার আনন্দ, এটা অত্যন্ত মোটা কথা। বিশ্বসৃষ্টিতে দেখতে পাই সৃষ্টিতেই আনন্দ, হওয়াটাই চরম কথা। তার ফুলেও আছে হওয়া, ফলেও আছে হওয়া। ফুলটা হল উপায় আর ফলটা হল উদ্দেশ্য, তাই বলে উভয়ের মধ্যে মূল্যের কোনো ভেদ দেখতে পাই নে।
আমার তিন বছরের প্রিয়সখী, যাকে নাম দিয়েছি নন্দিনী, তার হওয়ার উদ্দেশ্য কী এ প্রশ্নের কোনো জবাব-তলবের কথা মনে আসে না। সে-যে কুলরক্ষার সেতু, সে-যে পিণ্ড-জোগানের হেতু, সে-যে কোনো এক ভাবীকালে প্রজনার্থং মহাভাগা, এ-সব হল শাস্ত্রসংগত বিজ্ঞানসম্মত মূল্যের কথা। ফলের দরে ফুলের বিচার ব্যাবসাদারের। কিন্তু, ভগবান তো সৃষ্টির ব্যাবসা ফাঁদেন নি। তাঁর সৃষ্টি একেবারেই বাজে খরচ; অর্থাৎ, আয় করবার জন্যে খরচ করা নয়, এইজন্যই আয়োজনে প্রয়োজনে সমান হয়ে মিশে গেছে। এইজন্য যে-শিশু জীবলোকের প্রয়োজনসাধনের পক্ষে অপূর্ণ, সেই তিনবছরের শিশুর অপূর্ণতাই সৃষ্টির আনন্দগৌরবে পূর্ণ। আমি তো দেখি বিশ্ব রচনায় মুখ্যের চেয়ে গৌণটাই বড়ো। ফুলের রঙের মুখ্য কথাটা হতে পারে পতঙ্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করা; গৌণ কথাটা হচ্ছে সৌন্দর্য। মানুষ যখন ফুলের বাগান করে তখন সেই গৌণের সম্পদই সে খোঁজে। বস্তুত, গৌণ নিয়েই মানুষের সভ্যতা। মানুষ কবি যখন প্রেয়সীর মুখের একটি তিলের জন্য সমরখন্দ বোখারা পণ করতে বসে তখন সে প্রজনার্থং মহাভাগার কথা মনেই রাখে না। এই বে-হিসাবি সৃষ্টিতে বে-হিসাবি আনন্দরূপকেই সে সৃষ্টির ঐশ্বর্য বলে জানে।
প্রাণীসংসারে জৈবপ্রকৃতিই সকলের গোড়ায় আপন ভিত ফেঁদে, জাজিম পেতে, আলো জ্বেলে, পৃথিবীর ভাণ্ডার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র মালমসলা নিজের ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে সংসার পেতে বসেছিল। ভোরের বেলায় সে মুখ্য জায়গাটা দখল করে বসল। তারই বচন হচ্ছে, সা ভার্যা যা প্রজাবতী। অর্থাৎ, যদি কাজে লাগল তবেই তার দাম।
চিৎপ্রকৃতি এসে জুটলেন কিছু দেরিতে। তাই, জৈবপ্রকৃতির আশ্রয়ে তাঁকে পরাভূত হতে হল। পুরানো পথে পুরানো ঘাটে পুরানো কালের মালমসলা নিয়েই সে ফাঁদলে তার নিজের ব্যাবসা। তখন সে সাবেক আমলের মুখ্য থেকে হাল আমলের গৌণ ফলিয়ে তুলতে বসল। আহারকে করে তুললে ভোজ, শব্দকে করে তুললে বাণী, কান্নাকে করে তুললে কাব্য। মুখ্যভাবে যেটা ছিল আঘাত গৌণভাবে সেটা হল আবেদন; যেটা ছিল বন্দিনীর শৃঙ্খল, সেটা হল বধূর কঙ্কণ; যেটা ছিল ভয় সেটা হল ভক্তি; যেটা ছিল দাসত্ব সেটা হল আত্মনিবেদন। যারা উপরের স্তরের চেয়ে নীচের স্তরকে বিশ্বাস করে বেশি তারা মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করতে গেলেই পুরাতন তাম্রশাসন বেরিয়ে পড়ে। বৈজ্ঞানিকের চশমায় ধরা পড়ে যে, খেতের মালিক জৈবপ্রকৃতি; অতএব ফসলের অধিকার নির্ণয় করতে গেলে বৈজ্ঞানিকের কাছে চিৎপ্রকৃতির দাবি অগ্রাহ্য হয়ে আসে। আপিলে সে যতই বলে, “প্রণালী আমার, প্ল্যান আমার, হাললাঙল আমার, চাষ আমার” কিছুতেই অপ্রমাণ করতে পারে না যে, মাটির তলাকার তাম্রশাসনে মোটা অক্ষরে খোদা আছে “জৈবপ্রকৃতি’। মোটা অক্ষরের উপরে বিচারকের নজরও পড়ে বেশি। কাজেই, রায় যখন বেরয় তখন পাকা প্রমাণসহ প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, সাবেক আমলের ভূতই বর্তমান আমলে ভগবান সেজে এসেছে।
জৈবপ্রকৃতিতে শিশুর একটা অর্থ আছে। সেই অর্থটাকেই যদি সম্পূর্ণ বলে স্বীকার করে নিই তা হলে বলতে হয়, মাছের ছানার সঙ্গে মানুষের শিশুর কোনো প্রভেদ নেই। অর্থাৎ, তার একমাত্র অর্থ বংশবৃদ্ধি।
কিন্তু, চিৎপ্রকৃতি সেই অর্থটাকে নিয়ে যখন আপনার চিন্ময় জিনিস করে তুললে, তখন তাকে চোর বদনাম দিয়ে মূলকেই মালেক স্বীকার করি যদি তা হলে শেক্স্পিয়ারেরও মাল থানায় আটক করতে হয়। মসলা আর মাল তো একই জিনিস নয়; মাটির মালেক যদি হয় ভূপতি ভাঁড়ের মালেক তো কুমোর।
আমাদের চিত্ত শিশুর মধ্যে সৃষ্টির অহৈতুক আনন্দটি দেখতে পায়। বয়স্ক মানুষের মধ্যে উদ্দেশ্য-উপায়-ঘটিত নানা তর্ক আছে; কেউ বা কাজের কেউ বা অকাজের, কারো বা অর্থ আছে কারো বা নেই। কিন্তু শিশুকে যখন দেখি তখন কোনো প্রত্যাশার দ্বারা আচ্ছন্ন করে দেখি নি। সে-যে আছে, এই সত্যটাই বিশুদ্ধভাবে আমাদের মনকে টানে। সেই অপরিণত মানুষটির মধ্যে একটি পূর্ণতার ছবি দেখা দেয়। শিশুর মধ্যে মানুষের প্রাণময় রূপটি স্বচ্ছ অনাবিল আকাশে সুপ্রত্যক্ষ। নানা কৃত্রিম সংস্কারের ষড়যন্ত্রে তার সহজ আত্মপ্রকাশে একটুও দ্বিধা ঘটিয়ে দেয় না। প্রাণের বেগে নন্দিনী যে-রকম সহজে নেচেকুঁদে গোলমাল করে বেড়ায় আমি যদি তা করতে যাই, তা হলে যে-প্রভূত সংস্কারের পরিমণ্ডল আমাকে নিবিড় করে ঘিরে আছে সে-সুদ্ধ নড়্চড়্ করতে থাকে, সেটা একটা অসংগত ব্যাপার হয়ে ওঠে। শিশু যা-তা নিয়ে যেমন-তেমন করে খেলে, তাতেই খেলার বিশুদ্ধ রূপটি দেখি। খেলার উপকরণের কৃত্রিম মূল্য, খেলার লক্ষ্যের কৃত্রিম উত্তেজনা, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে না। নন্দিনী যখন লুব্ধভাবে কমলালেবু খায় তখন সেই অসংকোচ লোভটিকে সুন্দর ঠেকে। সহজ প্রাণের রসবোধের সঙ্গে কমলালেবুর যে মধুর সম্বন্ধ, ভদ্রতার কোনো বিধানের দ্বারা সেটা ক্ষুণ্ন হয় নি। ঝগড়ু-বেহারাটার প্রতি নন্দিনীর যে বন্ধুত্বের টান সেটা দেখতে ভালো লাগে, কেননা, যে-কোনো দুই মানুষের মধ্যে এই সম্বন্ধটি সত্য হওয়ার কোনো বাধা থাকা উচিত না। কিন্তু, সামাজিক ভেদবুদ্ধির নানা অভ্যস্ত সংস্কারকে যেমনি আমি স্বীকার করেছি অমনি ঝগড়ু-বেহারার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়েছে; অথচ এমন ভদ্রবেশধারীকে আমি সমকক্ষভাবে অনায়াসে গ্রহণ করতে পারি যার মনুষ্যত্বের আন্তরিক মূল্য ঝগড়ুর চেয়ে অনেক কম। জাহাজে তার সমবয়স্ক য়ুরোপীয় বালিকার সঙ্গে নন্দিনীর ঝগড়াও হয়, ভাবও হয়, পরস্পরের মধ্যে সম্পত্তির বিনিময়ও চলছে। য়ুরোপীয় পুরষযাত্রীর সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার মাথা-নাড়ানাড়ি হয়ে থাকে, শরীরের স্বাস্থ্য ও আবহাওয়া নিয়ে বাজে কথা বলাবলিও হয়; সংস্কারের বেড়া ডিঙিয়ে তার বেশি আর সহজে এগোতে পারি নে। সহজ মানুষের সত্যটি সামাজিক মানুষের কুয়াশায় ঢেকে রেখে দেয়। অর্থাৎ আমরা নানা অবান্তর তথ্যের অস্বচ্ছতার মধ্যে বাস করি। শিশুর জীবনের যে সত্য তার সঙ্গে অবান্তরের মিশোল নেই। তাই, তার দিকে যখন চেয়ে দেখবার অবকাশ পাই তখন প্রাণলীলার প্রত্যক্ষ স্বরূপটি দেখি; তাতে সংস্কারভারে পীড়িত চিন্তাক্লিষ্ট মন গভীর তৃপ্তি পায়।
শিশুর মধ্যে আমরা মুক্তির সহজ ছবি দেখতে পাই। মুক্তি বলতে কী বোঝায়। প্রকাশের পূর্ণতা। ভগবান সম্বন্ধে প্রশ্নোত্তরছলে ঋষি একটি চরম কথা বলেছেন : স ভগবঃ কস্মিন্ প্রতিষ্ঠিত ইতি। স্বে মহিম্নি। সেই ভগবান কিসের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। তার উত্তর, নিজের মহিমাতেই। অর্থাৎ, তিনি স্বপ্রকাশ। শিশুরও সেই কথা। সে আপনাতে আপনি পরিব্যক্ত। তাকে দেখে আমাদের যে-আনন্দ সে তার বাধামুক্ত সহজ প্রকাশে। য়ুরোপে আজকাল চিত্রকলার ইতিহাসে একটা বিপ্লব এসেছে, দেখতে পাই। এতকাল ধরে এই ছবি-আঁকার চার দিকে–হিন্দুস্থানি গানের তানকর্তবের মতো–যে সমস্ত প্রভূত ওস্তাদি জমে উঠেছিল আজ সকলে বুঝেছে, তার বারো-আনাই অবান্তর। তা সুঠাম হতে পারে, কোনো-না-কোনো কারণে মনোহর হতেও পারে, তার আড়ম্বর-বাহুল্যে বিশেষ-একটা শক্তিসম্পদও প্রকাশ করতে পারে, অর্থাৎ ঝড়ের মেঘের মতো তার আশ্চর্য রঙের ঘটা থাকতে পারে, কিন্তু আসল যে জিনিসটি পড়েছে ঢাকা সে হচ্ছে সরল সত্যের সূর্য, যাকে স্বচ্ছ আকাশে তার আপন নির্মল মহিমায় দেখে বিশ্ব আনন্দিত হয়।
গান বল, চিত্র বল, কাব্য বল, ওস্তাদি প্রথমে নম্রশিরে, মোগল দরবারে ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মতো, তাদের পিছনে থাকে। কিন্তু, যেহেতু প্রভুর চেয়ে সেবকের পাগড়ির রঙ কড়া, তার তকমার চোখ-ধাঁধানি বেশি, এই কারণে তারা ভিড়ে উৎসাহ যতই পায় ততই পিছন ছেড়ে সামনে এসে জমে যায়। যথার্থ আর্ট তখন হার মানে, তার স্বাধীনতা চলে যায়। যথার্থ আর্টের মধ্যে সহজ প্রাণ আছে বলেই তার বৃদ্ধি আছে, গতি আছে; কিন্তু, যেহেতু কারুনৈপুণ্যটা অলংকার, যেহেতু তাতে প্রাণের ধর্ম নেই, তাই তাকে প্রবল হতে দিলেই আভরণ হয়ে ওঠে শৃঙ্খল; তখন সে আর্টের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বন্ধ করে দেয়, তার গতি রোধ করে। তখন যেটা বাহাদুরি করতে থাকে সেটা আত্মিক নয়, সেটা বৈষয়িক; অর্থাৎ, তার মধ্যে প্রাণগত বৃদ্ধি নেই, বস্তুগত সঞ্চয় আছে। তাই আমাদের হিন্দুস্থানি গানে বৃদ্ধি দেখতে পাই নে। তানসেন প্রভৃতির অক্ষয় কমণ্ডলু থেকে যে-ধারা প্রবাহিত হয়েছিল ওস্তাদ প্রভৃতি জহ্নুমুনি কারদানি দিয়ে সেটি গিলে খেয়ে বসে আছে। মোট কথা, সত্যের রসরূপটি সুন্দর ও সরল করে প্রকাশ করা যে-কলাবিদ্যার কাজ অবান্তরের জঞ্জাল তার সবচেয়ে শত্রু। মহারণ্যের শ্বাস রুদ্ধ করে দেয় মহাজঙ্গল।
আধুনিক কলারসজ্ঞ বলেছেন, আদিমকালের মানুষ তার অশিক্ষিতপটুত্বে বিরলরেখায় যে-রকম সাদাসিধে ছবি আঁকত, ছবির সেই গোড়াকার ছাঁদের মধ্যে ফিরে না গেলে এই অবান্তরভারপীড়িত আর্টের উদ্ধার নেই। মানুষ বারবার শিশু হয়ে জন্মায় বলেই সত্যের সংস্কারবর্জিত সরলরূপের আদর্শ চিরন্তন হয়ে আছে; আর্টকেও তেমনি শিশুজন্ম নিয়ে অতি-অলংকারের বন্ধনপাশ থেকে বারে বারে মুক্তি পেতে হবে।
এই অবান্তরবর্জন কি শুধু আর্টেরই পরিত্রাণ। আজকের দিনের ভারজর্জর সভ্যতারও এই পথে মুক্তি। মুক্তি যে সংগ্রহের বাহুল্যে নয়, ভোগের প্রাচুর্যে নয়, মুক্তি যে আত্মপ্রকাশের সত্যতায়, আজকের দিনে এই কথাই মানুষকে বারবার স্মরণ করাতে হবে। কেননা, আজ মানুষ যেরকম বন্ধনজালে জড়িত, এমন কোনো দিনই ছিল না।
লোভমোহের বন্ধন থেকে মানুষ কবেই বা মুক্ত ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তির সাধনা ছিল সজাগ। বৈষয়িকতার বেড়ায় তখন ফাঁক ছিল; সেই ফাঁকের ভিতর দিয়ে সত্যের আলো আসত বলে সেই আলোর প্রতি কোনো দিন বিশ্বাস যায় নি। আজ জটিল অবান্তরকে অতিক্রম করে সরল চিরন্তনকে অন্তরের সঙ্গে স্বীকার করবার সাহস মানুষের চলে গেছে।
আজ কত পণ্ডিত তথ্যের গভীর অন্ধকূপে ঢুকে টুকরো-টুকরো সংবাদের কণা খুঁটে খুঁটে জমাচ্ছেন। য়ুরোপে যখন বিদ্বেষের কলুষে আকাশ আবিল তখন এই-সকল পণ্ডিতদেরও মন দেখি বিষাক্ত। সত্যসাধনার যে-উদার বৈরাগ্য ক্ষুদ্রতা থেকে ভেদবুদ্ধি থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, তাঁরা তার আহ্বান শুনতে পান নি। তার প্রধান কারণ, জ্ঞানসাধনায় উপরের দিকে খাড়া হয়ে মানুষের যে-মাথা একদিন বিশ্ব-দেখা দেখত আজ সেই মাথা নীচে ঝুঁকে পড়ে দিনরাত টুকরো-দেখা দেখছে।
ভারতের মধ্যযুগে যখন কবীর দাদু প্রভৃতি সাধুদের আবির্ভাব হয়েছিল তখন ভারতের সুখের দিন না। তখন রাষ্ট্রনৈতিক ভাঙাগড়ার দেশের অবস্থার কেবলই উলটপালট চলছিল। তখন শুধু অর্থ বিরোধ নয়, ধর্মবিরোধের তীব্রতাও খুব প্রবল। যখন অন্তরে বাহিরে নানা বেদনা সেই অস্থিরতার কালে স্বভাবত মানুষের মন ছোটো হয়, তখন রিপুর সংঘাতে রিপু জেগে ওঠে। তখন বর্তমানের ছায়াটাই কালো হয়ে নিত্যকালের আলো আচ্ছন্ন করে, কাছের কান্নাই বিশ্বের সকল বাণী ছাপিয়ে কানে বাজে। কিন্তু, সেই বড়ো কৃপণ সময়েই তাঁরা মানুষের ভেদের চেয়ে ঐক্যকে সত্য করে দেখেছিলেন। কেননা, তাঁরা সকলেই ছিলেন কবি, কেউ পণ্ডিত ছিলেন না। শব্দের জালে তাঁদের মন জড়িয়ে যায় নি, তথ্যের খুঁটনাটির মধ্যে উঞ্ছবৃত্তি করতে তাঁরা বিরত ছিলেন। তাই, হিন্দুমুসলমানের অতিপ্রত্যক্ষ বিরোধ ও বিদ্বেষবুদ্ধির মধ্যে থেকেও তাদের মনুষ্যত্বের অন্তরে একের আবির্ভাব তাঁরা বিনা বাধায় স্পষ্ট করে দেখেছিলেন। সেই দেখাতেই দেখার মুক্তি।
এর থেকেই বুঝতে পারি, তখনো মানুষ শিশুর নবজন্ম নিয়ে সত্যের মুক্তিরাজ্যে সহজে সঞ্চরণ করবার অবকাশ ও অধিকার হারায় নি। এইজন্যেই আকবরের মতো সম্রাটের আবির্ভাব তখন সম্ভবপর হয়েছিল, এইজন্যেই যখন ভ্রাতৃরক্তপঙ্কিল পথে অওরংজেব গোঁড়ামির কঠোর শাসন বিস্তার করেছিলেন তখন তাঁরই ভাই দারাশিকো সংস্কারবর্জিত অসাম্প্রদায়িক সত্যসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তখন বড়ো দুঃখের দিনেও মানুষের পথ ছিল সহজ। আজ সে-পথ বড়ো দুর্গম। এখনকার দিনে প্রবীণেরা পথের প্রত্যেক কাঁকর গুনে বাধারই হিসাবকে প্রকাণ্ড করে তোলে; মৃত্যুঞ্জয় মানবাত্মার অপরাহত শক্তিকে তারা উপস্থিতের ছোটো ছোটো বিরুদ্ধসাক্ষ্যের জোরে অবজ্ঞা করে। তাই, তারা এত কৃপণ, এত সন্দিগ্ধ, এত নিষ্ঠুর, এত আত্মম্ভরি। বিশ্বাস যার নেই সে কখনো সৃষ্টি করতে পারে না, সে কেবলই সংগ্রহ করতে পারে; অবশেষে এই সংগ্রহ নিয়েই যত মারামারি কাটাকাটি।
আজকের এই বিশ্বাসহীন আনন্দহীন অন্ধযুগ কবির বাণীকে প্রার্থনা করছে এই কথা শোনাবার জন্যে যে, আত্মম্ভরিতায় বন্ধন, আত্মপ্রকাশেই মুক্তি; আত্মম্ভরিতায় জড় বস্তুরাশির জটিলতা, আত্মপ্রকাশে বিরলভূষণ সত্যের সরল রূপ।
হারুনা-মারু জাহাজ থেকে নেমে প্যারিসে কয়েক দিন মাত্র ভূমিমাতার শুশ্রূষা ভোগ করতে পেরেছিলাম। হঠাৎ খবর এল, যথাসময়ে পেরুতে পৌঁছতে হলে অবিলম্বে জাহাজ ধরা চাই। তাড়াতাড়ি শের্বুর্গ্-বন্দর থেকে আণ্ডেস্ জাহাজে উঠে পড়লুম। লম্বায় চওড়ায় জাহাজটা খুব মস্ত কিন্তু আমার শরীরের বর্তমান অবস্থায় আরামের পক্ষে যে-সব সুবিধার প্রয়োজন ছিল, তা পাওয়া গেল না। জাপানি জাহাজে আতিথ্যের প্রচুর দাক্ষিণ্যে আমার অভ্যাসটাও কিছু খারাপ করে দিয়েছিল। সেইজন্যে এখানে ক্যাবিনে প্রবেশ করেই মনটা অপ্রসন্ন হল। কিন্তু, যেটা অনিবার্য নিজের গরজেই মন তার সঙ্গে যত শীঘ্র পারে রফা করে নিতে চায়। অত্যন্ত দুষ্পাচ্য জিনিসও পেটে পড়লে পাকযন্ত্র হাল ছেড়ে দিয়ে জারকরস প্রয়োগ বন্ধ করে না। মনেরও জারকরস আছে; অনভ্যস্ত কোনো দুঃখকে হজম করে নিয়ে তাকে সে আপনার অভ্যস্ত বিশ্বের শামিল করে নিশ্চিন্ত হতে চায়। অসুবিধাগুলো একরকম সহ্য হয়ে এল, আর দিনের-পর-দিন চরকার একঘেয়ে সুতো কাটার মতো একটানে চলতে লাগল।
বিষুবরেখা পার হয়ে চলেছি, এমন সময় হঠাৎ কখন শরীর গেল বিগড়ে; বিছানা ছাড়া গতি রইল না। ক্যাবিন জিনিসটাই একটা স্থায়ী ব্যাধি, ইন্দ্রিয়গুলো যদি তার সঙ্গে যোগ দিয়ে জুলুম শুরু করে তা হলে পুলিসের আকস্মিক বন্ধনের বিরুদ্ধে আদালতে পর্যন্ত আপিল বন্ধ হয়, কোথাও কিছুই সান্ত্বনা থাকে না। শান্তিহীন দিন আর নিদ্রাহীন রাত আমাকে পিঠমোড়া করে শিকল কষতে লাগল। বিদ্রোহের চেষ্টা করতে গেলে শাসনের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। রোগ-গারদের দারোগা আমার বুকের উপর দুর্বলতার বিষম একটা বোঝা চাপিয়ে রেখে দিলে; মাঝে মাঝে মনে হত, এটা স্বয়ং যমরাজের পায়ের চাপ। দুঃখের অত্যাচার যখন অতিমাত্রায় চ’ড়ে ওঠে তখন তাকে পরাভূত করতে পারি নে; কিন্তু, তাকে অবজ্ঞা করবার অধিকার তো কেউ কাড়তে পারে না–আমার হাতে তার একটা উপায় আছে, সে হচ্ছে কবিতা-লেখা। তার বিষয়টা যা-ই হোক-না কেন, লেখাটাই দুঃখের বিরুদ্ধে সিডিশন-বিশেষ। সিডিশনের দ্বারা প্রতাপশালীর বিশেষ অনিষ্ট হয় না, তাতে পীড়িত চিত্তের আত্মসম্ভ্রম রক্ষা হয়।
আমি সেই কাজে লাগলুম, বিছানায় পড়ে পড়ে কবিতা লেখা চলল। ব্যাধিটা-যে ঠিক কী তা নিশ্চিত বলতে পারি নে, কেবল এই জানি, সে একটা অনির্বচনীয় পীড়া। সে-পীড়া শুধু আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নয়, ক্যাবিনের সমস্ত আসবাবপত্রের মধ্যে সর্বত্র সঞ্চারিত–আমি আর আমার ক্যাবিন সমস্তটা মিলে যেন একটা অখণ্ড রুগ্ণতা।
এমনতরো অসুখের সময় স্বভাবতই দেশের জন্যে ব্যাকুলতা জন্মে। ক্যাবিনের জঠরের মধ্যে দিবারাত্রি জীর্ণ হতে হতে আমারও মন ভারতবর্ষের আকাশের উদ্দেশে উৎসুক হয়ে উঠল। কিন্তু, অন্ধ উত্তাপের পরিমাণ বেড়ে বেড়ে ক্রমে যেমন তা আলোকিত হয়, দুঃখের তেমনি পরিমাণভেদে প্রকাশভেদ হয়ে থাকে। যে-দুঃখ প্রথমে কারাগারের মতো বিশ্ব থেকে পৃথক করে মনকে কেবলমাত্র নিজের ব্যথার মধ্যেই বদ্ধ করে, সেই দুঃখেরই বেগ বাড়তে বাড়তে অবশেষে অবরোধ ভেঙে পড়ে এবং বিশ্বের দুঃখসমুদ্রের কোটালের বানকে অন্তরে প্রবেশ করবার পথ ছেড়ে দেয়। তখন নিজের ক্ষণিক ছোটো দুঃখটা মানুষের চিরকালীন বড়ো দুঃখের সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়; তার ছট্ফটানি চলে যায়। তখন দুঃখের দণ্ডটা একটা দীপ্ত আনন্দের মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে। প্রলয়কে ভয় যেই না-করা যায় অমনি দুঃখবীণার সুর বাঁধা সাঙ্গ হয়। গোড়ায় ওই সুর-বাঁধবার সময়টাই হচ্ছে বড়ো কর্কশ, কেননা, তখনো যে দ্বন্দ্ব ঘোচে নি। এই অভিজ্ঞতার সাহায্যে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের অবস্থা কল্পনা করতে পারি। বোধ হয়, প্রথম অবস্থায় ভয়ে ভরসায় যতক্ষণ টানাটানি চলতে থাকে ততক্ষণ ভারি কষ্ট। যতক্ষণ ভীষণকেই একমাত্র করে দেখি নে, যতক্ষণ তাকে অতিক্রম করেও জীবনের চিরপরিচিত ক্ষেত্রটা দেখা যায়, ততক্ষণ সেই দ্বন্দ্বের টানে ভয় কিছুতেই ছাড়তে চায় না। অবশেষে তাপের তীব্রতা বাড়তে বাড়তে রুদ্র যখন অদ্বিতীয় হয়ে দেখা দেন, প্রলয়ের গর্জন তখন সংগীত হয়ে ওঠে; তখন তার সঙ্গে নির্বিচারে সম্পূর্ণভাবে যোগ দেবার নিরতিশয় আগ্রহে মরিয়া করে তোলে। মৃত্যুকে তখন সত্য বলে জেনে গ্রহণ করি; তার একটা পূর্ণাত্মক রূপ দেখতে পাই বলে তার শূন্যাত্মকতার ভয় চলে যায়।
কয়দিন রুদ্ধকক্ষে সংকীর্ণ শয্যায় পড়ে পড়ে মৃত্যুকে খুব কাছে দেখতে পেয়েছিলাম, মনে হয়েছিল প্রাণকে বহন করবার যোগ্য শক্তি আমার শেষ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় প্রথম ইচ্ছার ধাক্কাটা ছিল দেশের আকাশে প্রাণটাকে মুক্ত করে দেওয়া। ক্রমে সেই ইচ্ছার বন্ধন শিথিল হয়ে এল। তখন মৃত্যুর পূর্বেই ঘরের বাইরে নিয়ে যাবার যে-প্রথা আমাদের দেশে আছে, তার অর্থটা মনে জেগে উঠল। ঘরের ভিতরকার সমস্ত অভ্যস্ত জিনিস হচ্ছে প্রাণের বন্ধনজাল। তারা সকলে মিলে মৃত্যুকে তীব্রভাবে প্রতিবাদ করতে থাকে। জীবনের শেষ ক্ষণে মনের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের কোলাহল যদি জেগে ওঠে তবে তাতেই বেসুর কর্কশ হয়; মৃত্যুর সম্পূর্ণ সংগীত শুনতে পাই নে, মৃত্যুকে সত্য বলে স্বীকার করে নেবার আনন্দ চলে যায়।
বহুকাল হল আমি যখন প্রথম কাশীতে গিয়েছিলাম তখন মৃত্যুকালের যে-একটি মনোহর দৃশ্য চোখে পড়েছিল, তা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। ঠিক মনে নেই, বোধ করি তখন শরৎকাল; নির্মল আকাশ থেকে প্রভাতসূর্য জীবধাত্রী বসুন্ধরাকে আলোকে অভিষিক্ত করে দিয়েছে। এপারের লোকালয়ের বিচিত্র চাঞ্চল্য, ওপারের প্রান্তরের সুদূরবিস্তীর্ণ নিস্তব্ধতা, মাঝখানে জলধারা–সমস্তকে দেবতার পরশমণি ছোঁয়ানো হল। নদীর ঠিক মাঝখানে দেখি একটি ডিঙি নৌকা খরস্রোতে ছুটে চলেছে। আকাশের দিকে মুখ করে মুমূর্ষু স্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে, তারই মাথার কাছে করতাল বাজিয়ে উচ্চস্বরে কীর্তন চলছে। নিখিল বিশ্বের বক্ষের মাঝে মৃত্যুর যে-পরম আহ্বান, আমার কাছে তারই সুগম্ভীর সুরে আকাশ পূর্ণ হয়ে উঠল। যেখানে তার আসন সেখানে তার শান্তরূপ দেখতে পেলে মৃত্যু যে কত সুন্দর, তা স্পষ্ট প্রত্যক্ষ হয়। ঘরের মধ্যে সমস্তই তাকে উচ্চৈঃস্বরে অস্বীকার করে; সেইজন্য সেখানকার খাটপালঙ সিন্দুক চৌকি দেওয়াল করি বরগা, সেখানকার প্রাত্যহিক ক্ষুধাতৃষ্ণা কর্ম ও বিশ্রামের ছোটোখাটো সমস্ত দাবিতে মুখর চঞ্চল ঘরকরনার ব্যস্ততার মাঝখানে সমস্ত ভিড় ঠেলে, সমস্ত আপত্তি অতিক্রম ক’রে, মৃত্যু যখন চিরন্তনের লিপি হাতে নিয়ে প্রবেশ করে তখন তাকে দস্যু বলে ভ্রম হয়, তখন তার হাতে মানুষ আত্মসমর্পণ করবার আনন্দ পায় না। মৃত্যু বাঁধন ছিন্ন করে দেবে, এইটেই কুৎসিত। আপনি বাঁধন আলগা করে দিয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে তার হাত ধরব, এইটেই সুন্দর।
হিন্দু কাশীকে পৃথিবীর বাহিরের স্থান বলেই বিশ্বাস করে। তার কাছে কাশীর ভৌগোলিক সীমানা একটা মায়া, পরমার্থত সেখানে নিখিল বিশ্বের পরিচয়, সেখানে বিশ্বেশ্বরের আসন। অতএব, বিশেষ দেশবাসীর কাছে বিশেষ দেশের যে আকর্ষণবেগ তার প্রাণকে সেখানকার মাটি জল আকাশের সঙ্গে নানা বিশেষ সূত্রে বাঁধে, কাশীর মধ্যে যেন পৃথিবীর সেই বিশেষ দেশগত বন্ধনও নেই। অতএব, যথার্থ হিন্দুর কানে মৃত্যুর মুক্তিবাণী কাশীতে বিশুদ্ধ সুরে প্রবেশ করে।
বর্তমান যুগে ন্যাশনাল বৈষয়িকতা বিশ্বব্যাপী হয়ে স্বদেশগত অহমিকাকে সুতীব্রভাবে প্রবল করে তুলেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই সংঘ-আশ্রিত অতি প্রকাণ্ডকায় রিপুই বর্তমান যুগের সমস্ত দুঃখ ও বন্ধনের কারণ। তাই, সেদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মনে হল, আমিও যেন মুক্তির তীর্থক্ষেত্রে মরতে পারি; শেষ মুহূর্তে যেন বলতে পারি, সকল দেশই আমার এক দেশ, সর্বত্রই এক বিশ্বেশ্বরের মন্দির, সকল দেশের মধ্য দিয়েই এক মানবপ্রাণের পবিত্র জাহ্নবীধারা এক মহাসমুদ্রের অভিমুখে নিত্যকাল প্রবাহিত।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৮
ক্রাকোভিয়া স্টিমার, ১৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯২৫
পূর্বেই বলেছি, নন্দিনী তার নাম, তিন বছর তার বয়স, সে তৃতীয়ার চাঁদটুকুর মতো। আধুনিক নবেল পড়বার সময় তার এখনো হয় নি। ঘুম-পাড়াবার আগে তাকে গল্প শোনাবার লোক চাই। তাই, যে-আমি এতকাল জনসাধারণকে ঘুম পাড়াবার বায়না নিয়েছিলুম, দায়ে পড়ে সেই-আমার পদবৃদ্ধি হল। আজকাল এই ক্ষুদ্র মহারানীর শয্যাপার্শ্বে আমার তলব হচ্ছে।
কাল রাত্রে আহার সেরে জাহাজের কামরায় এসে বসেছি। হুকুম হল, “দাদামশায়, বাঘের গল্প বলো।” আমি কবি ভবভূতির মতো বিনয় করে বললুম, “আমার সমযোগ্য লোক হয়তো জাহাজে এক-আধজন মিলতেও পারে, কারণ, যাত্রী অনেক এবং বিপুলা চ তরণী।” কিন্তু, নিষ্কৃতি পেলুম না। তখন শুরু করে দিলুম–
এক যে ছিল বাঘ,
তার সর্ব অঙ্গে দাগ।
আয়নাতে তাই হঠাৎ দেখে
হল বিষম রাগ।
ঝগড়ুকে সেই বললে ডেকে,
“এখ্খনি তুই ভাগ,
যা চলে তুই প্রাগ্,
সাবান যদি না মেলে তো
যাস হাজারিবাগ।”
বীণাপাণির কৃপা এইখানে এসে থেমে গেল, ছড়া আর এগোল না। তখন ছন্দের বেড়া ডিঙিয়ে গদ্যের মধ্যে নেমে পড়লুম। পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন গল্পের মূল ধারাটা হচ্ছে, বাঘের সর্বাঙ্গীণ কলঙ্কমোচনের জন্যে সাবান-অন্বেষণের দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ে ঝগড়ু-নামধারী বেহারার যাত্রা।
কথা উঠবে, ঝগড়ুর তাগিদটা কিসের। দয়ারও নয়, মৈত্রীরও নয়, ভয়ের তাগিদ। বাঘ শাসিয়েছিল, সাবান না আনতে পারলে তার কান ছিঁড়ে নেবে। এতে বাস্তব-বিলাসীরা আশ্বস্ত হবেন, বুঝবেন, তা হলে গল্পটা নেহাত আজগুবি নয়।
প্রথমে দেখাতে হল, পাথেয় এবং সাবানের মূল্যের জন্যে কী অসম্ভব উপায়ে ঝগড়ু একেবারে পাঁচ তিন নয় সাত দশ পয়সা সংগ্রহ করলে। টেঁকে গুঁজে গোরুর গাড়ি করে সে বৃহস্পতিবারের বারবেলায় চেকোস্লোভাকিয়ায় রওনা হল। বোলপুরের কাছে ধোবাপাড়ার রাস্তায় আসতেই খামকা একটা ব্রাউনরঙের গাধা সাদারঙের গোরুটার গা চেটে দিলে। বর্ণভেদে শ্রদ্ধাবান গোরুটা জাতিচ্যুতির ক্ষোভে গাড়িটা উলটিয়ে দিয়ে বন্ধনমুক্তভাবে চার পা তুলে সংসার ত্যাগ করে যাওয়াতে, সেই অপঘাতে ঝগড়ুর পা ভেঙে তাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে হল। বেলা বয়ে যায়, দূর থেকে ক্ষণে-ক্ষণে বাঘের ডাকও শোনা যাচ্ছে। এখন হতভাগার কান বাঁচে কী করে। এমন সময় ঝুড়িকাঁখে জোড়াসাঁকোর মোক্ষদা চলেছে হাটে লাউশাক কিনতে। ঝগড়ু বললে, “মোক্ষদা, ও মোক্ষদা, তোমার ঝুড়িতে করে আমাকে ইস্টিশনে পৌঁছিয়ে দাও।” মোক্ষদা যদি তখনই দয়া করে সহজে রাজি হত, তা হলে বাস্তবওয়ালার মতে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হত না। তাই দেখাতে হল, ঝগড়ু যখন টেঁকের থেকে দু-পয়সা নগদ দেবে কবুল করলে তখনই মোক্ষদা তাকে ঝুড়িতে তুলে নিলে। আশা করেছিলুম, গল্পের এই সন্ধিস্থলে এসে পৌঁছোবার পূর্বেই শ্রোত্রীর ঘুম আসবে। তার পরে, কাল আবার যদি আমাকে ধরে তা হলে উপসংহারে দেখাতে হবে, ভালোমানুষ ঝগড়ুর কানের তো কোনো অপচয় হলই না, বরঞ্চ পূর্বের চেয়ে এই প্রত্যঙ্গটা দীর্ঘতর হয়ে উঠে কানের বানানে দন্ত্য “ন’কে মাত্রাছাড়া মূর্ধন্য “ণ’য়ে খাড়া করে তোলবার পক্ষে সাক্ষ্য দিলে। কেবল কাটা গেল ওই দুষ্ট বাঘের লেজটা। সংসারে ধর্মের পুরস্কার ও অধর্মের তিরস্কার-মূলক উপদেশের সাহায্যে কলুষিত বঙ্গসাহিত্যে স্বাস্থ্যকর হাওয়া বইয়ে দেবার ইচ্ছাটাও আমার মনে ছিল।
কিন্তু, গল্পের গোড়ায় নন্দিনীর চোখে যে-একটু ঘুমের আবেশ ছিল সেটা কেটে গিয়ে তার দৃষ্টি শরৎকালের আকাশের মতো জ্বল্জ্বল্ করতে লাগল। ভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক, বাঘ যদি বা ঝগড়ুর কানটা ছেড়ে দিতে রাজি হয়, নন্দিনী গল্পটাকে ছাড়তে কিছুতেই রাজি হল না। অবশেষে দুই-চার জন আত্মীয়স্বজনের মধ্যস্থতায় কাল রাত্রির মতো ছুটি পেয়েছি।
আর্টিস্ট বললেন, গল্পের প্রবাহে নানারকম ভেসে-আসা ছবি ওর মনকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে রাখছিল। তা হলেই তর্ক ওঠে, ছবির এমন কী গুণ আছে যাতে ঔৎসুক্য জাগিয়ে রাখে। কোনো দৃশ্য যখন বিশেষ করে আমাদের চোখ ভোলায় তখন কেন আমরা বলি, যেন ছবিটি।
মুখ্যত ছবির গুণ হচ্ছে দৃশ্যতা। তাকে আহার করা নয়, ব্যবহার করা নয়, তাকে দেখা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্যই নেই। তা হলেই বলতে হবে, যাকে আমরা পুরোপুরি দেখতে পাই তাকে আমাদের ভালো লাগে। যাকে উদাসীনভাবে দেখি তাকে পুরো দেখি নে; যাকে প্রয়োজনের প্রসঙ্গে দেখি তাকেও না; যাকে দেখার জন্যেই দেখি তাকেই দেখতে পাই। বোলপুরের রাস্তায় গোরু, গাধা, গাড়ি উলটে ঝগড়ুর পা-ভাঙা প্রভৃতি দৃশ্যের দাম কিসেরই বা। চলতি ভাষায় যাকে মনোহর বলে এ তো তা নয়। কিন্তু, গল্পের বেগে তারা মনের সামনে এসে হাজির হচ্ছিল; শিশুর মন তাদের প্রত্যেককেই স্বীকার করে নিয়ে বললে, “হাঁ, এরা আছে।” এই বলে স্বহস্তে এদের কপালে অস্তিত্বগৌরবের টীকা পরিয়ে দিলে। এই দৃশ্যগুলি গল্প-বলার বেষ্টনীর মধ্যে একটি বিশেষ ঐক্য লাভ করেছিল। বিশ্বের ছাড়া-ছাড়া সমস্ত ছড়ানো তথ্যের অস্পষ্টতা থেকে স্বতন্ত্র হয়ে তারা সুনির্দিষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই জোরে তারা কেবলই দাবি করতে লাগল “আমাকে দেখো!” সুতরাং, নন্দিনীর চোখের ঘুম আর টিঁকল না।
কবি বল, চিত্রী বল, আপনার রচনার মধ্যে সে কী চায়। সে বিশেষকে চায়। বাতাসে যে অঙ্গারবাষ্প সাধারণভাবে আছে গাছ তাকে আত্মসাৎ ক’রে আপন ডালে-পালায় ফলে ফুলে আপন ছন্দে রঙে অত্যন্ত বিশেষ করে যখন তোলে, তখনই তাতে সৃষ্টিলীলা প্রকাশ পায়। নীহারিকায় জ্যোতির্বাষ্প একটা একাকার ব্যাপার, নক্ষত্র-আকারে বিশেষত্ব লাভ করায় তার সার্থকতা। মানুষের সৃষ্টিচেষ্টাও সেইরকম অনির্দিষ্ট সাধারণ থেকে সুনির্দিষ্ট বিশেষকে জাগাবার চেষ্টা। আমাদের মনের মধ্যে নানা হৃদয়াবেগ ঘুরে বেড়ায়। ছন্দে সুরে কথায় যখন সে বিশেষ হয়ে ওঠে তখন সে হয় কাব্য, সে হয় গান। হৃদয়াবেগকে প্রকাশ করা হল বলেই-যে আনন্দ তা নয়। তাকে বিশিষ্টতা দেওয়া হল বলেই আনন্দ। সেই বিশিষ্টতার উৎকর্ষেই তার উৎকর্ষ। মানুষের যে-কোনো রচনা সেই উৎকর্ষ পেয়েছে তাকেই আর্ট-সৃষ্টিরূপে দেখি; সেই একান্ত দেখাতেই আনন্দ।
ইংরেজি ভাষায় ক্যারেক্টার্ শব্দের একটা অর্থ, স্বভাব, নৈতিক চরিত্র; আর-একটা অর্থ, চরিত্ররূপ। অর্থাৎ, এমন কতকগুলি গুণের এমন সমাবেশ যাতে এই সমাবেশটি বিশেষভাবে লক্ষ্যগোচর হয়। পূর্বেই বলেছি, এইরকম বিশেষ গোচরতাই আর্টের ধর্ম। নাট্যে কাব্যে চিত্রে নৈতিক সদ্গুণের চেয়ে এই ক্যারেক্টারের মূল্য বেশি।
সৃষ্টির দিকে বিশেষত্ব এই তো আছে ক্যারেক্টার, সৃষ্টিকর্তার দিকে বিশেষত্ব প্রতিভায়। সেটা হচ্ছে দৃষ্টির বিশেষত্ব, অনুভূতির বিশেষত্ব, রচনার বিশেষত্ব নিয়ে। ভক্ত সমুদ্র-পর্বত-অরণ্যে সৃষ্টিকর্তার একটি স্বরূপ দেখতে পান, তাতেই সে-দৃশ্যগুলি বিশেষভাবে তাঁর অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে। রূপকারের রচনাতেও তেমনি করেই স্রষ্টাব্যক্তিটি আপন প্রতিভার স্বরূপ দিয়ে আপন সৃষ্টির রূপটিকে দ্রষ্টাব্যক্তিটির কাছে সুনির্দিষ্ট করে দেয়। তাতে যে-আনন্দ পাই সে সৌন্দর্যের বা স্বার্থবুদ্ধির শুভবুদ্ধির আনন্দ নয়, বিশেষকে ব্যক্ত দেখার আনন্দ। আমার ভিতরকার ব্যক্তি সেই পরিব্যক্তিতে নিজেরই বিস্তার দেখে। বস্তুতত্ব (সবঁড়ভদড়) সমস্ত বস্তুর মধ্যে সাধারণ, সেটা হল বিজ্ঞানের; আর, চেহারা পদার্থটা বিশেষের, সেটা হল আর্টের। বিশেষের বেড়া ভাঙতে ভাঙতে বিজ্ঞান যখন ব্যাপককে পায় তখন তার সার্থকতা; আর, ব্যাপকের পর্দাটা তুলে ধরে আর্ট যখন বিশেষকে পায় তখন সে হয় খুশি।
সুন্দর সেই বিশেষের কোঠায় এসে পড়ে তো ভালো, নইলে সুন্দর বলেই তার গুমোর নেই। আর্টের এলেকায় সাহেবপাড়ার সরকারি বাগানের স্থান নেই, আছে চিৎপুর রোডের। সরকারি বাগানের অনেক সদ্গুণ আছে, তাকে সুন্দর বললে লক্ষণে মেলে; সে-বাগানে সাধারণ উপকার আছে, কিন্তু বিশেষ স্বাদ নেই। চিৎপুর রোডের স্বাদ আছে, উপকার নেই বললেই হয়। কলকাতার ইডেন-গার্ডেন ফোটোগ্রাফের অন্ত্যজ পঙ্ক্তিতে স্থান পেতে পারে, কিন্তু চিৎপুর রোডের পঙ্ক্তি আর্টের অভিজাতবর্গের কোঠায়। কুলীনের মেয়ের মতোই চিৎপুর রোড আর্টিস্টের তুলিতে আপন পর্যায় পাবার জন্যে আজ পর্যন্ত অপেক্ষা করে আছে। কোনো কালে না-ও যদি পায় তবু তার কৌলীন্য ঘুচবে না!
হেডমাস্টার তাঁর ইস্কুলের সবচেয়ে শিষ্টশান্ত অধ্যয়নরত ভালো ছেলেটির প্রতি তর্জনী নির্দেশ করে তাকে আমাদের দৃষ্টান্তগোচর করে রাখবার চেষ্টা করেন। কিন্তু, তর্জনীর জোরেও আমরা তাকে স্পষ্ট দেখতে পাই নে। যাকে খুবই দেখতে পাওয়া যায় সে হেডমাস্টারের আদর্শ ছেলে নয়, ছাত্রবৃত্তি তার কপালে প্রায়ই জোটে না। সেটা ডানপিটে ইস্কুলপালানো ছেলে, আপন প্রাণপূর্ণ বিশেষত্ব দ্বারা সে খুবই স্বপ্রকাশ। ব্যবহারের দিক থেকে তাকে অবজ্ঞা করা চলে, কিন্তু প্রয়োজন নিরপেক্ষ প্রকাশের দিক থেকে সে-ছেলে সেরা ছেলে। সে হেডমাস্টারের বর্জনীয়, কিন্তু আর্টিস্টবিধাতার বরণীয়। চরিত্রনীতিবিলাসী ঐতিহাসিক তাঁর মহাভারতে যুধিষ্ঠিরকে ধর্মরাজ নাম দিয়ে সদ্গুণের উচ্চ পীঠের উপর দাঁড় করিয়ে সর্বদা আমাদের চোখের উপর ধরে রেখেছেন, কিন্তু তবু যুধিষ্ঠির স্পষ্ট করে চোখে পড়েন না; আর চরিত্রচিত্রবিলাসী কবি তাঁর ভীমসেনকে নানা অবিবেচনা ও অসংযমের অপবাদে লাঞ্ছিত করেও আমাদের কাছে সুস্পষ্ট করে তুলেছেন। যারা সত্য কথা বলতে ভয় করে না তারা স্বীকার করবেই যে, সর্বগুণের যুধিষ্ঠিরকে ফেলে দোষগুণে-জড়িত ভীমসেনকেই তারা ভালোবাসে। তার একমাত্র কারণ, ভীমসেন সুস্পষ্ট। শেক্স্পিয়রের ফল্স্টাফ্ও স্বাস্থ্যকর দৃষ্টান্ত বলে সমাজে আদরণীয় নয়, স্পষ্ট প্রত্যক্ষ বলেই সাহিত্যে আদরণীয়। রামচন্দ্রের ভক্তদের আমি ভয় করি; তাই খুব চুপিচুপি বলছি, সাহিত্যে রামের চেয়ে লক্ষ্ণণ বড়ো। বাল্মীকিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিশ্চয়ই মানবেন যে, রামকে তিনি ভালো বলেন, কিন্তু লক্ষ্ণণকে তিনি ভালোবাসেন।
আমরা হাজার প্রমাণ দেখাতে পারি যে, আর্টে আমরা গুণবানকে চাই নে, রূপবানকে চাই। এখানে রূপবান বলতে সুন্দরকে বলছি নে। রূপের স্পষ্টতায় যে সুপ্রত্যক্ষ সেই রূপবান। শ্রীমন্ত সদাগরের চেয়ে রূপবান ভাঁড়ুদত্ত; বিষবৃক্ষে অনেক নামজাদা নায়কনায়িকা আছেন, অনেক সাধু লেখক তাদের চরিত্র বিচার করেছেন, তার উপরে আমি আর কিছু বলতে চাই নে, কেবল এইটুক বলে রাখি, বিষবৃক্ষে হীরা রূপবান। হীরা আমাদের ঘুমোতে দেয় না, সে সুন্দর ব’লে নয়, গুণবান ব’লে নয়, রূপবান ব’লে; সাধারণ অস্পষ্টতার মাঝখানে সে বিশেষ ব’লে সুপ্রত্যক্ষ বলে।
এ কথা মানতে হবে, চলতি ভাষায় যাকে সুন্দর বলে তাকে নিয়ে কবি কিম্বা রূপকার আপনাদের রচনায় খুব ব্যবহার করে থাকেন। তার প্রধান কারণ, সৌন্দর্য হচ্ছে একটা বিশিষ্টতা। জীবনের পথে চলতে চলতে অগণ্য বস্তুর ভিড়কে আমরা পাশ কাটিয়ে যাই। সুন্দর হঠাৎ বলে ওঠে, “চেয়ে দেখো।” প্রতিদিন হাজার হাজার জিনিসকে যা না বলি তাকে তাই বলি; বলি, “তুমি আছ।” ওইটেই হল আসল কথা। সে-যে নিশ্চিত আছে, এই বার্তাটাই তার সৌন্দর্য আমার কাছে উপস্থিত করলে। সে-যে সৎ, এইটে একান্ত উপলব্ধি করতে পারলুম বলেই সে এত আনন্দ দিলে। শিশুর কাছে তার খেলার জিনিস মহার্ঘ্য বলেই দামি নয়, সুন্দর বলেই প্রিয় নয়। আপন কল্পনাশক্তি দিয়ে তাকে স্পষ্ট উপলব্ধি করে বলেই ছেঁড়া নেকড়ায় তৈরি হলেও সে তার কাছে সত্য, এবং সত্য বলেই আনন্দময়; কারণ, সত্যের রসই হচ্ছে আনন্দ।
এক রকমের গায়ে-পড়া সৌন্দর্য আছে যা ইন্দ্রিয়তৃপ্তির সঙ্গে যোগ দিয়ে অতিলালিত্যগুণে সহজে আমাদের মন ভোলায়। চোর যেমন দ্বারীকে ঘুষ দিয়ে চুরি করতে ঘরে ঢোকে। সেইজন্যে যে-আর্ট আভিজাত্যের গৌরব করে সে-আর্ট এই সৌন্দর্যকে আমল দিতেই চায় না। একজাতের বাইজিমহলে চলতি খেলো সংগীত তার হালকা চালের সুরতালের উত্তেজনায় সাধারণ লোকের মনে নেশা ধরিয়ে দেয়। বড়ো ওস্তাদেরা এই নেশাধরানো কানভোলানো ফাঁকিকে অত্যন্ত অবজ্ঞা করেন। তাতে তাঁরা সাধারণ লোকের সস্তা বকশিশ থেকে বঞ্চিত হওয়াকেই পুরস্কার বলে মেনে নেন। তাঁরা যে বিশিষ্টতাকে আর্টের সম্পদ বলে জানেন সে-বিশিষ্টতা প্রলোভননিরপেক্ষ উৎকর্ষ। তাকে দেখাতে গেলে যেমন সাধনা, তাকে পেতে গেলেও তেমনি সাধনা চাই। এইজন্যেই তার মূল্য। নিরলংকার হতে তার ভয় নেই। সরলতার অভাবকে, আড়ম্বরকে সে ইতর বলে ঘৃণা করে। সুললিত বলে নিজের পরিচয় দিতে সে লজ্জা বোধ করে, সুসংগত বলেই তার গৌরব।
গীতায় আছে, কর্মের বিশুদ্ধ মুক্তরূপ হচ্ছে তার নিষ্কামরূপ। অর্থাৎ, ত্যাগের দ্বারা নয়, বৈরাগ্যের দ্বারাই কর্মের বন্ধন চলে যায়। তেমনি ভোগেরও বিশুদ্ধরূপ আছে, সেই রূপটি পেতে গেলে বৈরাগ্য চাই। বলতে হয়, মা গৃধঃ, লোভ কোরো না। সৌন্দর্যভোগ মনকে জাগাবে, এইটেই তার স্বধর্ম; তা না করে মনকে যখন সে ভোলাতে বসে তখন সে আপনার জাত খোয়ায়, তখন সে হয়ে যায় নীচ। উচ্চ-অঙ্গের আর্ট এই নীচতা থেকে বহু যত্নে আপনাকে বাঁচাতে চায়। লোভীর ভিড় তাড়াবার জন্যে সে অনেক সময়ে কঠোরকে দ্বারের কাছে বসিয়ে রাখে, এমন কি, অনেক সময় কিছু বিশ্রী, কিছু বেসুর তার রচনার সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। কেননা, তার সাহস আছে; সে জানে, যে-বিশিষ্টতা আর্টের প্রাণ তার সঙ্গে গায়ে পড়ে মিষ্টি মিশোল করবার কোনো দরকার নেই। উমার হৃদয় পাবার জন্যে শিবকে কন্দর্প সাজতে হয় নি।
বিশেষকে দেখবার আর-একটা কৌশল আছে, সে হচ্ছে নূতনত্ব। অতিপরিচয়ের আবরণে বিশেষ ঢাকা পড়ে, এইজন্যে অনভ্যস্তকেই বিশেষ বলে খাড়া করবার দিকে দুর্বল আর্টিস্টের প্রলোভন আসতে পারে। এই প্রলোভন আর্টিস্টের তপোভঙ্গের কারণ। অতিপরিচয়ের ম্লানতার মধ্যেই চির-বিশেষের উজ্জ্বলরূপ দেখাতে পারে যে-গুণী সেই তো গুণী। যেখানটা সর্বদা আমাদের চোখে পড়ে অথচ দেখতে পাই নে, সেইখানেই দেখবার জিনিসকে দেখানো হচ্ছে আর্টিস্টের কাজ। সেইজন্যেই তো বড়ো বড়ো আর্টিস্টের রচনার বিষয় চিরকালের জিনিস। আর্ট পুরাতনকে বারে বারে নূতন করে। বিশেষকে সে দেখতে পায় হাতের কাছে, ঘরের কাছে। সৃষ্টি তো খনির জিনিস নয় যে খুঁড়তে খুঁড়তে তার পুঁজি ফুরিয়ে যাবে। সে-যে ঝরনা; তার প্রাচীন ধারা যে চিরদিনই নবীন হয়ে বইছে, এইটে প্রমাণ করবার জন্যে তাকে কোনো অদ্ভুত ভঙ্গী করতে হয় না। অশোকের মঞ্জীর কালিদাসের আমলেও যে-রঙে বসন্তের শ্যামল বক্ষ রাঙিয়ে দিয়েছে আজও নূতনত্বের ভান করে সেই রঙ বদল করবার তার দরকার হয় নি। নির্ভয়ে সে বর্ষে বর্ষে পুরাতনের বাসরঘরেই নবীনের ঘোমটা খুলে দিচ্ছে। বারে বারেই চোখের উপর থেকে জড়তার মোহ কেটে যাচ্ছে, আর চিরবিশেষকে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, ইঁটের ঢেলার চেয়ে অশোকমঞ্জরীকেই বিশেষ করে দেখি কেন, এইটেই দাঁড়ায় প্রশ্ন। এর উত্তর এই যে, আপন অংশ-প্রত্যংশের সমাবেশ নিয়ে অশোক আপনার মধ্যে একটি সুসংগত বিশেষ ঐক্যকে প্রকাশ করে বলেই তার মধ্যে আমাদের মন একটি পুরো দেখাকে দেখে। ইঁটের ঢেলায় আমাদের কাছে সত্তার সেই চরমতা নেই। একটা স্টীম ইঞ্জিনের মধ্যে প্রয়োজনঘটিত সুষমার ঐক্য আছে। কিন্তু, সেই ঐক্য প্রয়োজনেরই অনুগত। সে নিজেকেই চরম বলে প্রকাশ করে না, আর-কিছুকে প্রকাশ করে। সেই ইঞ্জিনের মধ্যে ব্যবহারের আনন্দ, তার মধ্যে কৌতূহলের বিষয় থাকতে পারে। কিন্তু তাতে বিশুদ্ধ দেখার অহৈতুক বিষয় নেই।
সত্তাকে সকলের চেয়ে অব্যবহিত করে অনুভব করি নিজের মধ্যে। আমার মধ্যে একটি এক নিয়ত বলছে “আছি”। গানের মধ্যে, ছবির মধ্যে, এক যদি তেমনি জোরে বলে উঠতে পারে “এ-যে আমি”, তা হলেই তাতে-আমাতে মিলনের সুর পূর্ণ হয়ে বাজল। একেই বলে শুভদৃষ্টি; ঐক্যের উপলব্ধিতে দেখবার বিষয় চোখে-পড়া।
আর্টিস্ট প্রশ্ন করছে, আর্টের সাধনা কী। আমি বলি “দেখো”, তবেই দেখাতে পারবে। সত্তার প্রবাহিনী ঝরে পড়ছে; তারই স্রোতের জলে মনের অভিষেক হোক; ছোটো-বড়ো সুন্দর-অসুন্দর সব নিয়ে তার নৃত্য। সেই প্রকাশধারার বেগ চিত্তকে স্পর্শ করলে চিত্তের মধ্যেও প্রকাশের বেগ প্রবল হয়ে ওঠে। সৃষ্টির লীলা চারদিকেই আছে, এই সহজ সত্যটি যদি আর্টিস্ট আজও আবিষ্কার করতে না পেরে থাকে, পুরাণ-কাহিনীর পুঁথির মধ্যে, প্রাচীন রাজপুতানার পটের মধ্যে, যদি সে দেখার জিনিস খুঁজে বেড়ায় তা হলে বুঝব, কলাসরস্বতীর পদ্মাসন তার মনের মধ্যে বিকশিত হয় নি। তাই সে সেকেণ্ড্-হ্যাণ্ড্ আসবাবের দোকানে নির্জীব কাঠের চৌকি খুঁজতে বেরিয়েছে।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৯
পরিশিষ্ট, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৪
মানুষ যে মানুষের পক্ষে কত সুদূরের জীব তা য়ুরোপে আমেরিকায় গেলে বুঝতে পারা যায়। সেখানকার সমাজ হচ্ছে দ্বীপশ্রেণী–ছোটো এক এক দল জ্ঞাতির চারিদিকে বৃহৎ অজ্ঞাতির লবণসমুদ্র; পরস্পরসংলগ্ন মহাদেশের মতো নয়। জ্ঞাতি শব্দটা তার ধাতুগত বিশেষ অর্থে আমি ব্যবহার করছি; অর্থাৎ, যে-কয়জনের মধ্যে জানাশোনা আছে, আনাগোনা চলে; আমাদেরে দেশে পরস্পর আনাগোনার জন্য জানাশোনার দরকার হয় না। আমরা তো খোলা জায়গায় রাস্তায় চৌমাথায় বাস করি। একে আমাদের আয়ু কম, তার উপরে অবাধ সামাজিকতায় পরস্পরের সময় নষ্ট ও কাজ নষ্ট করতে আমাদের সংকোচমাত্র নেই।
আবার অন্যপক্ষে, ভোগের আদর্শ যেখানে অত্যন্ত বেশি ব্যয়সাধ্য, সুতরাং যেখানে সময়-জিনিসটাকে মানুষ টাকার দরে যাচাই করতে বাধ্য, সেখানে মানুষে মানুষে মিল কেবলই বাধাগ্রস্ত হবেই, আর সেই মিল যতই প্রতিহত ও অনভ্যস্ত হতে থাকবে ততই মানুষের সর্বনাশের দিন ঘনিয়ে আসবেই। একদিন দেখা যাবে, মানুষ বিস্তর জিনিস সংগ্রহ করেছে, বিস্তর বই লিখেছে, বিস্তর দেয়াল গেঁথে তুলেছে, কেবল নিজে গেছে হারিয়ে। মানুষ আর মানুষের কীর্তির মধ্যে সামঞ্জস্য ভেঙে গিয়েছে ব’লেই আজ মানুষ খুব সমারোহ করে আপন গোরস্থান তৈরি করতে বসেছে।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ২০
২৬ সেপ্টেম্বর
একজন আধুনিক জাপানি রূপদক্ষের রচিত একটি ছবি আমার কাছে আছে। সেটি যতবার দেখি আমার গভীর বিস্ময় লাগে। দিগন্তে রক্তবর্ণ সূর্য–শীতের বরফ-চাপা শাসন সবে-মাত্র ভেঙে গেছে, প্লাম গাছের পত্রহীন শাখাগুলি জয়ধ্বনির বাহুভঙ্গীর মতো সূর্যের দিকে প্রসারিত, সাদা সাদা ফুলের মঞ্জরীতে গাছ ভরা। সেই প্লাম গাছের তলায় একটি অন্ধ দাঁড়িয়ে তার আলোকপিপাসু দুই চক্ষু সূর্যের দিকে তুলে প্রার্থনা করছে।
আমাদের ঋষি প্রার্থনা করেছেন; তমসো মা জ্যোতির্গময়, অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাও। চৈতন্যের পরিপূর্ণতাকে তাঁরা জ্যোতি বলেছেন। তাঁদের ধ্যানমন্ত্রে সূর্যকে তাঁরা বলেছেন : ধিয়োয়োনঃ প্রচোদয়াৎ, আমাদের চিত্তে তিনি ধীশক্তির ধারাগুলি প্রেরণ করছেন।
ঈশোপনিষদে বলেছেন, হে পূষন্, তোমার ঢাকা খুলে ফেলো, সত্যের মুখ দেখি; আমার মধ্যে যিনি সেই পুরুষ তোমার মধ্যে।
এই বাদলার অন্ধকারে আজ আমার মধ্যে যে ছায়াচ্ছন্ন বিষাদ সে ওই ব্যাকুলতারই একটি রূপ। সেও বলছে, হে পূষন্, তোমার ওই ঢাকা খুলে ফেলো, তোমার জ্যোতির মধ্যে আমার আত্মাকে উজ্জ্বল দেখি। অবসাদ দূর হোক। আমার চিত্তের বাঁশিতে তোমার আলোকের নিশ্বাস পূর্ণ করো–সমস্ত আকাশ আনন্দের গানে জাগ্রত হয়ে উঠুক। আমার প্রাণ-যে তোমার আলোকেরই একটি প্রকাশ, আমার দেহও তাই। আমার চিত্তকে তোমার জ্যোতিরঙ্গুলি যখনই স্পর্শ করে তখনই তো ভূর্ভুবস্বঃদীপ্যমান হয়ে ওঠে। মেঘে মেঘে তোমার যেমন নানা রঙ আমার ভাবনায় ভাবনায় তোমার তেজ তেমনি সুখদুঃখের কত রঙ লাগিয়ে দিচ্ছে। একই জ্যোতি বাইরের পুষ্পপল্লবের বর্ণে গন্ধে এবং অন্তরের রাগে অনুরাগে বিচিত্র হয়ে ঠিকরে পড়ছে। প্রভাতে সন্ধ্যায় তোমার গান দিকে দিগন্তে বেজে ওঠে; তেমনি তোমারই গান আমার কবির চিত্ত গলিয়ে দিয়ে ভাষার স্রোতে ছন্দের নাচে বয়ে চলল। এক জ্যোতির এত রঙ, এত রূপ, এত ভাব, এত রস! অন্ধকারের সঙ্গে নিত্য ঘাতে প্রতিঘাতে তার এত নৃত্য, এত গান, তার এত ভাঙা, এত গড়া–তারি সারথ্যে যুগযুগান্তরের এমন রথযাত্রা। তোমার তেজের উৎসের কাছে পৃথিবীর অন্তর্গূঢ় প্রার্থনাই তো গাছ হয়ে, ঘাস হয়ে আকাশে উঠছে, বলছে, অপাবৃণু–ঢাকা খুলে দাও। এই ঢাকা খোলাই তার প্রাণের লীলা, এই ঢাকা খোলা থেকেই তার ফুল ফল। এই প্রার্থনাই আদিম জীবাণুর মধ্যে দিয়ে আজ মানুষের মধ্যে এসে উপস্থিত। মানুষের প্রাণের ঘাট পেরিয়ে মানুষের চিত্তের ঘাটে পাড়ি দিয়ে চলল। মানুষের ইতিহাস বলছে, অপাবৃণু, ঢাকা খোলো। জীব বলছে, আমার মধ্যে যে-সত্য আছে তার জ্যোতির্ময় পূর্ণস্বরূপ দেখি। হে পূষন্, হে পরিপূর্ণ, তোমার হিরণ্ময় পাত্রের মুখের আবরণ ঘুচুক, তার অন্তরের রহস্য প্রকাশিত হোক–সেই রহস্য আমার মধ্যে তোমার মধ্যে একই।
প্রাণ যখন ক্লান্ত হয় তখন বলি, সুখদুঃখের দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যাক, সৃষ্টির লীলাতরঙ্গে আর উঠতে নামতে পারি নে; পাত্রের ঢাকা কেবল খুলে যাক তা নয় পাত্রটাই যাক ভেঙে, একের বক্ষে বিরাজ না করে একের মধ্যে বিলুপ্ত হই। ভারতবর্ষে এই প্রার্থনা ক্ষণে ক্ষণে শুনতে পাই।
কিন্তু আমি বলি, অপাবৃণু; সত্যের মুখ খুলে দাও–এককে অন্তরে বাহিরে ভালো করে দেখি, তা হলেই অনেককে ভালো করে বুঝতে পারব। গানের মধ্যে আগাগোড়া যে একটি আনন্দময় এক আছে তাকে যতক্ষণ বুঝতে না পারি ততক্ষণ সুরের সঙ্গে সুরের দ্বন্দ্ব আমাকে সুখ দেয় না, আমাকে পীড়া দেয়। তাই বলে আমি বলব না, গান যাক লুপ্ত হয়ে; আমি বলব, পূর্ণ গানটাকে অন্তরে যেন জানি, তা হলেই খণ্ড সুরের দ্বন্দ্বটা বাহিরে আমাকে আর বাজবে না, সেটাকেও অখণ্ড আনন্দের মধ্যে বিধৃত করে দেখব।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ২১
২৭ সেপ্টেম্বর
বয়স যখন অল্প ছিল তখন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা মনকে খুব নাড়া দিয়েছে। এই ঘটনাগুলোর সত্যের গৌরব যদি যাচাই করতে চাই তবে দেখতে পাব, দুই বড়ো বড়ো সাক্ষী দুই-রকমের বাটখারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে ওজনের মিল নেই। বৈজ্ঞানিক পুরাতাত্ত্বিক যে-প্রমাণকে সব চেয়ে খাঁটি বলে মানে সে হচ্ছে, যাকে বলা যেতে পারে সাধারণ প্রমাণ, সে হচ্ছে নির্বিশেষ। কিন্তু, মানুষ যেহেতু একান্ত বৈজ্ঞানিক নয়, সেইজন্যে মানুষের জগতে যে-সকল ঘটনা ঘটে সেগুলি যদি নিতান্ত তুচ্ছ না হয় তা হলে তাদের ওজন সাধারণ বাটখারার ওজন মানে না। তাদের বেলায় বিজ্ঞানকে হুট্ করে দিয়ে কোথা থেকে একটা অসাধারণ তুলাদণ্ড এসে খাড়া হয়। বৈজ্ঞানিক সেই ওজনটাকে সাধারণ ওজনের সঙ্গে মিল করতে গিয়ে ভারি গোলমাল করতে থাকে। একটা খুব বড়ো দৃষ্টান্ত দেখা যাক, বুদ্ধদেব। যদি তাঁর সময়ে সিনেমাওয়ালা এবং খবরের কাগজের রিপোর্টারের চলন থাকত তা হলে তাঁর খুব একটা সাধারণ ছবি পাওয়া যেত। তাঁর চেহারা, চালচলন, তাঁর মেজাজ, তাঁর ছোটোখাটো ব্যক্তিগত অভ্যাস, তাঁর রোগ তাপ ক্লান্তি ভ্রান্তি সব নিয়ে আমাদের অনেকের সঙ্গে মিল দেখতুম। কিন্তু, বুদ্ধদেব সম্বন্ধে এই সাধারণ প্রমাণটাকেই যদি প্রামাণিক বলে গণ্য করা যায় তা হলে একটা মস্ত ভুল করি। সে ভুল হচ্ছে পরিপ্রেক্ষিতের–ইংরেজিতে যাকে বলে পার্স্পেক্টিভ্। যে-জনতাকে আমরা সর্বসাধারণ বলি, সে কেবল ক্ষণকালের জন্যে মানুষের মনে ছায়া ফেলে মুহর্তে মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। অথচ, এমন সব মানুষ আছেন যাঁরা শত শত শতাব্দী ধরে মানুষের চিত্তকে অধিকার করে থাকেন। যে-গুণে অধিকার করেন সেই গুণটাকে ক্ষণকালের জাল দিয়ে ধরাই যায় না। ক্ষণকালের জাল দিয়ে যেটা ধরা পড়ে সেই হল সাধারণ মানুষ; তাকে ডাঙায় তুলে মাছকোটার মতো কুটে বৈজ্ঞানিক যখন তার সাধারণত্ব প্রমাণ ক’রে আনন্দ করতে থাকেন তখন দামি জিনিসের বিশেষ দামটা থেকেই তাঁরা মানুষকে বঞ্চিত করতে চান। সুদীর্ঘকাল ধরে মানুষ অসামান্য মানুষকে এই বিশেষ দামটা দিয়ে এসেছে! সাধারণ সত্য মত্ত হস্তীর মতো এসে এই বিশেষ সত্যের পদ্মবনটাকে দলন করলে সেটা কি সহ্য করা যাবে। সিনেমা-ছবিতে গ্রামোফোনের ধ্বনিতে যে-বুদ্ধকে পাওয়া যেতে পারে সে তো ক্ষণকালের বুদ্ধ; সুদীর্ঘকাল মানুষের সজীব চিত্তের সিংহাসনে ব’সে যিনি অসংখ্য নরনারীর ভক্তিপ্রেমের অর্ঘ্যে অলংকৃত হয়েছেন তিনি চিরকালের বুদ্ধ। তাঁর ছবি সুদীর্ঘ যুগযুগান্তরের পটে আঁকা হয়েই চলেছে। তাঁর সত্য কেবলমাত্র তাঁকে নিয়ে নয়, তাঁর সত্য বহু দেশকালপাত্রের বিপুলতাকে নিয়ে; সেই বৃহৎ পরিমণ্ডলের মধ্যে তাঁর দৈনিক ঘটনা, তাঁর সাময়িক মানসিক অবস্থার চঞ্চল ছায়ালোকপাত চোখে দেখতেই পাওয়া যাবে না। যদি কোনো অণুবীক্ষণ নিয়ে সেইগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি তা হলে তাঁর বৃহৎ রূপটাকে দেখা অসম্ভব হবে। যে-মানুষ আপন সাধারণ-ব্যক্তিগত পরিধির মধ্যে বিশেষ দিনে জন্মলাভ করে বিশেষ দিনে মরে গেছেন তিনি বুদ্ধই নন। মানুষের ইতিহাস সেই আপন বিস্মরণশক্তির গুণেই সেই ছোটো বুদ্ধের প্রতিদিনের ছোটো ছোটো ব্যাপার ভুলে যেতে পেরেছে, তবেই একটি বড়ো বুদ্ধকে পেয়েছে। মানুষের স্মরণশক্তি যদি ফোটোগ্রাফের প্লেটের মতো সম্পূর্ণ নির্বিকার হত তা হলে সে আপন ইতিহাস থেকে উঞ্ছবৃত্তি করে মরত, বড়ো জিনিস থেকে বঞ্চিত হত।
বড়ো জিনিস যেহেতু দীর্ঘকাল থাকে এইজন্যে তাকে নিয়ে মানুষ অকর্মকভাবে থাকতেই পারে না। তাকে নিজের সৃষ্টিশক্তি নিজের কল্পনাশক্তি দিয়ে নিয়তই প্রাণ জুগিয়ে চলতে হয়। কেননা, বড়ো জিনিসের সঙ্গে তার-যে প্রাণের যোগ, কেবলমাত্র জ্ঞানের যোগ নয়। এই যোগের পথ দিয়ে মানুষ আপন প্রাণের মানুষদের কাছ থেকে যেমন প্রাণ পায় তেমনি তাদের প্রাণ দেয়।
এই প্রসঙ্গে একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো দৃষ্টান্ত আমার মনে পড়ছে। ম্যাক্সিম গোর্কি টলস্টয়ের একটি জীবনচরিত লিখেছেন। বর্তমানকালের প্রখরবুদ্ধি পাঠকেরা বাহবা দিয়ে বলছেন, এ-লেখাটা আর্টিস্টের যোগ্য লেখা বটে। অর্থাৎ, টলস্টয় দোষে গুণে ঠিক যেমনটি সেই ছবিতে তীক্ষ্ণ রেখায় তেমনটি আঁকা হয়েছে; এর মধ্যে দয়ামায়া ভক্তি-শ্রদ্ধার কোনো কুয়াশা নেই। পড়লে মনে হয়, টলস্টয় যে সর্বসাধারণের চেয়ে বিশেষ কিছু বড়ো তা নয়, এমন কি, অনেক বিষয়ে হেয়। এখানে আবার সেই কথাটাই আসছে। টলস্টয়ের কিছুই মন্দ ছিল না, এ কথা বলাই চলে না; খুঁটিনাটি বিচার করলে তিনি-যে নানা বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতোই এবং অনেক বিষয়ে তাদের চেয়েও দুর্বল, এ কথা স্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু, যে-সত্যের গুণে টলস্টয় বহুলোকের এবং বহুকালের, তাঁর ক্ষণিকমূর্তি যদি সেই সত্যকে আমাদের কাছ থেকে, আচ্ছন্ন করে থাকে তা হলে এই আর্টিস্টের আশ্চর্য ছবি নিয়ে আমার লাভ হবে কী। প্রথম যখন আমি দার্জিলিং দেখতে গিয়েছিলুম দিনের পর দিন কেবলই দেখেছিলুম মেঘ আর কুয়াশা। কিন্তু জানা ছিল, এগুলো সাময়িক এবং যদিও হিমালয়কে আচ্ছন্ন করবার এদের শক্তি আছে তবুও এরা কালো বাষ্পমাত্র, কাঞ্চনজঙ্ঘার ধ্রূব শুভ্র মহত্ত্বকে এরা অতিক্রম করতে পারে না। আর যাই হোক, হিমালয়কে এই কুয়াশার দ্বারা তিরস্কৃত দেখে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে মূঢ়তা হত। ক্ষণকালের মায়ার দ্বারা চিরকালের স্বরূপকে প্রচ্ছন্ন করে দেখাই আর্টিস্টের দেখা, এ কথা মানতে পারি নে। তা ছাড়া, গোর্কির আর্টিস্ট-চিত্ত তো বৈজ্ঞানিক হিসাবে নির্বিকার নয়। তাঁর চিত্তে টলস্টয়ের যে-ছায়া পড়েছে সেটা একটা ছবি হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসাবেও সেটা যে সত্য তা কেমন করে বলব। গোর্কির টলস্টয়ই কি টলস্টয়? বহুকালের ও বহুলোকের চিত্তকে যদি গোর্কি নিজের চিত্তের মধ্যে সংহত করতে পারতেন তা হলেই তাঁর দ্বারা বহুকালের ও বহুলোকের টলস্টয়ের ছবি আঁকা সম্ভবপর হত। তার মধ্যে অনেক ভোলবার সামগ্রী ভুলে যাওয়া হত; আর তবেই যা না-ভোলবার তা বড়ো হয়ে, সম্পূর্ণ হয়ে, দেখা দিত।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ২২
জাহাজ ক্রাকোভিয়া, ৭ই ফেব্রয়ারি, ১৯২৫
মানুষের মধ্যে মন প্রাণ দেহ এই তিনে মিলে কাজ চালায়, এই তিনের আপোসে আমাদের কর্মবেগের একটা ছন্দ তৈরি করে। শীতের দেশে দেহ সহজেই ছুটে চলতে চায়; তারই সঙ্গে তাল রাখবার জন্যে মনেরও তাড়াতাড়ি ভাবা দরকার। গরম দেশে আমরা ধীরে সুস্থে চলি, ধীরে সুস্থে ভাবি, কোনো বিষয়ে মন স্থির করতে বিলম্ব ঘটে। শীতের দেশে যে-তেজকে দেহের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হয় গরম দেশে সেই তেজ দেহের বাইরে; সেই আকাশব্যাপী তেজ শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি; সেইজন্যেই আভ্যন্তরিক উত্তেজনা যাতে বেড়ে না ওঠে আমাদের শরীরের সেই অভিপ্রায়। চলাফেরার দম সর্বদাই তাকে কমিয়ে রাখতে হয়, তাই আমাদের মনের মধ্যে কর্মচিন্তার ছন্দ মন্দাক্রান্তা।
মনের ভাবনা ও হুকুমের অপেক্ষায় যখন দেহকে কাজ চালাবার জন্যে পথ চেয়ে থাকতে হয় না তখন তাকেই বলে অভ্যাস, সেই অভ্যাসেই নৈপুণ্য। কর্মের তাল যতই দ্রুত হয়, দেহের পক্ষে ততই দ্বিধাবিহীন হওয়া দরকার। ভাবতে মনের যে-সময় লাগে তার জন্যে সবুর করতে গেলেই দ্বিধা ঘটে। বাহিরে কর্মের ফল সেই সবুরের জন্যে যদি অপেক্ষা করতে না পারে তা হলেই বিভ্রাট। মোটরগাড়ির একটা বিশেষ বেগ আছে, কখন তার হাল বাঁয়ে ফেরাব, কখন ডাইনে, তা ঠিক করতে হলে সেই কলের বেগের দ্রুত ছন্দেই ঠিক করতে হয়, নইলে বিপদ ঘটে। সেই দ্রুততা বারবার অভ্যাসের জোরেই সহজ হয়। অভ্যাসের বাহিরে কোনো নূতন অবস্থা এসে পড়লে অপঘাত ঘটায়, অর্থাৎ যেখানে মনের দরকার সেখানে মনকে প্রস্তুত না পেলেই মুশকিল।
দম দিয়ে কলের তাল দুন চৌদুন করা শক্ত নয়, সেই সঙ্গে অভ্যাসের বেগও অনেক পরিমাণে বাড়ানো চলে। কিন্তু এই দ্রুত অভ্যাসের নৈপুণ্যে সেই-সব কাজই সম্ভবপর হয় যা “বস্তুগত’। অর্থাৎ, এক বস্তা বাঁধবার জায়গায় দুই বস্তা বাঁধা যায়। কিন্তু, যা কিছু প্রাণগত ভাবগত তা কলের ছন্দের অনুবর্তী হতে চায় না।
যারা পালোয়ান প্রকৃতির লোক সংগীতে তারা দুন চৌদুনের বেগ দেখে পুলকিত হয়ে ওঠে; কিন্তু পদ্মবনের তরঙ্গদোলায় যারা বীণাপাণির মাধুর্যে মুগ্ধ, ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে তাঁর মোটরযাত্রার প্রস্তাবে তাদের মন হায়-হায় করতে থাকে।
পশ্চিমমহাদেশে মানুষের জীবনযাত্রার তাল কেবলই দুন থেকে চৌদুনের অভিমুখে চলেছে। কেননা, জীবনের সার্থকতার চেয়ে বস্তুর প্রয়োজন অত্যন্ত বেড়ে উঠেছে। ঘর ভেঙে হাট তৈরি হল, রব উঠল : ঝভলন ভড় খষশনঁ। এই বেগের পরিমাপ সহজ। সেইজন্যে সেখানে একটা জিনিস সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে, যেটা সকলেরই কাছে সুস্পষ্ট, যেটা বুঝতে কারো মুহূর্তকাল দেরি হয় না, সে হচ্ছে পাখোয়াজের হাত দুটোর দুড় দাড় তাণ্ডবনৃত্য। গান বুঝতে যে সবুর করা অত্যাবশ্যক, সেটা সম্পূর্ণ বাদ দিয়েও রক্ত গরম হয়ে ওঠে, ভিড়ের লোকে বলে, “সাবাস! এ একটা কাণ্ড বটে!”
এবার জাহাজে সিনেমা অভিনয় দেখা আমার ভাগ্যে ঘটেছিল। দেখলুম, তার প্রধান জিনিসটাই হচ্ছে দ্রুত লয়। ঘটনার দ্রুততা বারে বারে চমক লাগিয়ে দিচ্ছে। এই সিনেমা আজকালকার দিনে সর্বসাধারণের একটা প্রকাণ্ড নেশা। ছেলে বুড়ো সকলকেই প্রতিদিন এতে মাতিয়ে রেখেছে। তার মানে হচ্ছে সকল বিভাগেই বর্তমান যুগে কলার চেয়ে কারদামি বড়ো হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনসাধনের মুগ্ধদৃষ্টি কারদানিকেই পছন্দ করে। সিদ্ধি, ইংরেজিতে যাকে সাক্সেস্ বলে, তার প্রধান বাহন হচ্ছে দ্রুত নৈপুণ্য। পাপকর্মের মধ্য দিয়েও সেই নৈপুণ্যের লীলাদৃশ্য আজ সকলের কাছে উপাদেয়। সুষমাকে কল্যাণকে উপলব্ধি করবার মতো শান্তি ও অবকাশ প্রতিদিন প্রতিহত হতে চলল; সিদ্ধির ঘোড়দৌড় জুয়োখেলার উত্তেজনা পশ্চিমদিগন্তে কেবলই ঘূর্ণি হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে।
পশ্চিমমহাদেশের অন্ধকার পটের উপর আবর্তমান পলিটিক্সের দৃশ্যটাকে একটা সিনেমার বিপুলাকার চলচ্ছবির মতো দেখতে হয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে, দ্রুতলয়ের প্রতিযোগিতা। জলে স্থলে আকাশে কে একটুমাত্র এগিয়ে যেতে পারে তারই উপর হারজিত নির্ভর করছে। গতি কেবলই বাড়ছে, তার সঙ্গে শান্তির কোনো সমন্বয় নেই। ধর্মের পথে ধৈর্য চাই, আত্মসংবরণ চাই; সিদ্ধির পথে চাতুরীর ধৈর্য নেই, সংযম নেই, তার হস্তপদচালনা যতই দ্রুত হবে ততই তার ভেলকি বিস্ময়কর হয়ে উঠবে–তাই যাদুকরের সভ্যতায় বেগের পরিমাণ সকল দিকেই এত বেশি ত্বরান্বিত যে, মানুষের মন অসত্যে লজ্জিত ও অপঘাতসম্ভাবনায় শঙ্কিত হবার সময় পাচ্ছে না।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ২৩
ক্রাকোভিয়া। এডেন বন্দর, ১২ই ফেব্রয়ারি ১৯২৫
ঘর বলে, পেয়েছি; পথ বলে, পাই নি। মানুষের কাছে “পেয়েছি” তারও একটা ডাক আছে, আর “পাই নি” তারও ডাক প্রবল। ঘর আর পথ নিয়েই মানুষ। শুধু ঘর আছে পথ নেই সেও যেমন মানুষের বন্ধন, শুধু পথ আছে ঘর নেই সেও তেমনি মানুষের শাস্তি। শুধু “পেয়েছি” বদ্ধ গুহা, “পাই নি” অসীম মরুভূমি।
যাকে আমরা ভালোবাসি তারই মধ্যে সত্যকে আমরা নিবিড় করে উপলব্ধি করি। কিন্তু, সেই সত্য-উপলব্ধির লক্ষণ হচ্ছে পাওয়ার সঙ্গে না-পাওয়াকে অনুভব করা। সত্যের মধ্যে এই একান্ত বিরুদ্ধতার সমন্বয় আছে বলেই সত্য-উপলব্ধির জবানবন্দি এমন হয় যে, আদালতে তা গ্রাহ্যই হতে পারে না। সুন্দরকে দেখে আমাদের ভাষায় যখন বলি “আ মরি”, তখন বাহিরের দাঁড়িপাল্লার ওজনে তাকে অত্যুক্তি বলা চলে, কিন্তু অন্তর্যামী তাকে বিশ্বাস করেন। সুন্দরের মধ্যে অন্তরের স্পর্শ যখন পাই তখন আমার মধ্যে যে-অন্ত আছে সে বলে, “আমি নেই। কেবল ওই আছে।” অর্থাৎ যাকে আমি অত্যন্ত পেয়েছি সে নেই, আর যাকে আমি পেয়েও পাই নে সেই অত্যন্ত আছে।
ঘড়ি-ধরা অবিশ্বাসী, সময়কে আপেক্ষিক অর্থাৎ মায়া বলে মানতে চায় না, সে জানে না–নিমেষেই বল আর লক্ষ যুগই বল, দুয়ের মধ্যেই অসীম সমানভাবেই আছেন, শুধু কেবল উপলব্ধির অপেক্ষা। এইজন্যই কবি প্রেমের ভাষায় অর্থাৎ নিবিড় সত্য উপলব্ধির ভাষায় বলেছেন, “নিমিষে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি।” যারা আয়তনকে ঐকান্তিক সত্য বলে মনে করে তারাই অসীমের সীমা শুনলে কানে হাত দেয়। কিন্তু, দেশই বল, আর কালই বল, যাতে করে সৃষ্টির সীমা নির্দেশ করে দেয়, দুইই আপেক্ষিক, দুইই মায়া। সিনেমাতে কালের পরিমাণ বদল করে দিয়ে যে ব্যায়াম-ক্রীড়া দেখানো হয় তাতে দেখি যে ঘড়ি-ধরা কালে যা একভাবে প্রত্যক্ষ, কালকে বিলম্বিত করে দিলে তাকেই অন্যভাবে দেখা যায়, অর্থাৎ স্বল্পকালের সংহতিতে যা চঞ্চল, বৃহৎ কালের ব্যাপ্তিতে তাই স্থির। শুধু কাল কেন, আকাশ সম্বন্ধেও এই কথাই খাটে। আমাদের দৃষ্টির আকাশে গোলাপফুলকে যে-আয়তনে দেখছি অণুবীক্ষণের আকাশে তাকে সে-আয়তনে দেখি নে। আকাশকে আরো অনেক বেশি আণুবীক্ষণিক করে দেখতে পারলে গোলাপের পরমাণুপুঞ্জকে বৈদ্যুতিক যুগলমিলনের নৃত্যলীলারূপে দেখতে পারি, সে-আকাশে গোলাপ একেবারে গোলাপই থাকে না। অথচ, সে-আকাশ দূরস্থ নয়, স্বতন্ত্র নয়, এই আকাশেই। তাই পরম সত্যকে উপনিষৎ বলেছেন : তদেজতি তন্নৈজতি। একই কালে তিনি চলেনও, তিনি চলেনও না।
সংস্কৃত ভাষায় ছন্দ শব্দের একটা অর্থ হচ্ছে কাব্যের মাত্রা, আর-একটা অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা। মাত্রা আকারে কবির সৃষ্টি-ইচ্ছা কাব্যকে বিচিত্র রূপ দিতে থাকে। বিশ্বসৃষ্টির বৈচিত্র্যও দেশকালের মাত্রা-অনুসারে। কালের বা দেশের মাত্রা বদল করবামাত্রই সৃষ্টির রূপ এবং ভাব বদল হয়ে যায়। এই বিশ্বছন্দের মাত্রাকে আমরা আরো গভীর করে দেখতে পারি; তা হলে চরম বিশ্বকবির ইচ্ছাশক্তির মধ্যে গিয়ে পৌঁছতে হবে। মাত্রা সেখানে মাত্রার অতীতের মধ্যে; সীমার বৈচিত্র্য সেখানে অসীমের লীলা অর্থে প্রকাশ পায়।
দেশকালের মধ্যেই দেশকালের অতীতকে উপলব্ধি করে তবেই আমরা বলতে পারি “মরি-মরি”। সেই আনন্দ না হলে মরা সহজ হবে কেমন করে। তাল আর সা-রে-গ-ম যখন কেবলমাত্র বাহিরের তথ্যরূপে কানের উপর মনের উপর পড়তে থাকে তখন তার থেকে মুক্তি পাবার জন্যে চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে, কিন্তু যখন সেই তাল আর সা-রে-গ-মের ভিতর থেকেই সংগীতকে দেখতে পাই তখন মাত্রায় অমাত্রকে, সীমায় অসীমকে, পাওয়ায় অপাওয়াকে জানি; তখন সেই আনন্দে মনে হয় এর জন্যে সব দিতে পারি। কার জন্যে। ওই সা-রে-গ-মের জন্যে? ওই ঝাঁপতাল-চৌতালের জন্যে, দুন-চৌদুনের কসরতের জন্যে? না; এমন-কিছুর জন্যে যা অনির্বচনীয়, যা পাওয়া না-পাওয়ার এক হয়ে মেশা; যা সুর নয়, তাল নয়, সুরতালে ব্যাপ্ত হয়ে থেকে সুরতালের অতীত যা, সেই সংগীত।
প্রয়োজনের জানা নিতান্তই জানার সীমানার মধ্যে বদ্ধ, তার চারদিকে না-জানার আকাশমণ্ডলটা চাপা; সেইজন্যে তাকে সত্যরূপে দেখা হয় না, সেইজন্যে তার মধ্যে যথার্থ আনন্দ নেই, বিস্ময় নেই, শ্রদ্ধা নেই। সেইজন্যে তার উদ্দেশ্যে যথার্থ ত্যাগ স্বীকার সম্ভব হতে পারে না। এই কারণেই ভারতবর্ষের প্রতি ইংরেজের ব্যক্তিগত বদান্যতার অদ্ভুত অভাব। অথচ, এ সম্বন্ধে তার সংগতির বোধ এতই অল্প যে, ভারতবর্ষের জন্যে তার ত্যাগের তালিকা হিসাব করবার বেলায় সর্বদাই সে অহংকার করে বলে যে, তার সিভিল সার্ভিস, তার ফৌজের দল ভারতবর্ষের সেবায় গরমে দগ্ধ হয়ে, লিভার বিকৃত ক’রে, প্রবাসের দুঃখ মাথায় নিয়ে কী কষ্টই না পাচ্ছে। বিষয়কর্মের আনুষঙ্গিক দুঃখকে ত্যাগের দুঃখ নাম দেওয়া, রাষ্ট্রনীতির আইন ও ব্যবস্থা রক্ষার উপলক্ষে যে-কৃচ্ছ্রসাধন তাকে সত্যের তপস্যা, ধর্মের সাধনা, বলাটা হয় গুপ্ত পরিহাস নয় মিথ্যা অহংকার।
বাসনার চোখে বা বিদ্বেষের চোখে বা অহংকারের চোখে যাকে দেখি তাকে সীমায় বেঁধে দেখি; তার প্রতি পূর্ণ সত্যের ব্যবহার কোনোমতেই হতে পারে না ব’লে তার থেকে এত দুঃখের উৎপত্তি হয়। মুনফার লোভে, ক্ষমতার অত্যাকাঙক্ষায়, মানুষের সত্য আজ সর্বত্র যেমন আচ্ছন্ন হয়েছে এমন আর কখনোই হয় নি। মানুষের মধ্যে সত্যকে না দেখতে পাওয়ার নিরানন্দ এবং অন্যায়, বিশ্বের পূর্ণ অধিকার থেকে বিশ্বজিগীষু কুস্তিগিরদের আজ যেমন বঞ্চিত করেছে এমন কোনোদিন করে নি। সেইজন্যেই বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে মানুষ এ কথা বলতে লজ্জাও করছে না যে, মানুষকে শাসন করবার অধিকারই শ্রেষ্ঠ অধিকার; অর্থাৎ, তাকে পৃথক করে রাখবার নীতিই বড়ো নীতি।
বহু অল্পসংখ্যক য়ুরোপীয় বালকবালিকার শিক্ষার জন্য তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ গবর্নমেণ্ট ব্যয় করতে সম্মত হয়েছেন বলে দেশি লোকেরা যে নালিশ করে থাকে, শুনলুম, তার জবাবে আমাদের শাসনকর্তা বলেছেন, যেহেতু অনেক মিশনারি বিদ্যালয় ভারতের জন্য আত্মসমর্পণ করেছে সেই কারণে এই নালিশ অসংগত। আমি নিজে এই নালিশ করি নে, যে-কোনো সমাজের লোকের জন্য যত অধিক পরিমাণ অর্থব্যয় করা হোক আমার তাতে আপত্তি নেই। য়ুরোপীয় বালকবালিকারা যদি অশিক্ষিতভাবে মানুষ হয় তাতে আমাদেরও মন্দ ছাড়া ভালো হবার আশা নেই। কিন্তু, মিশনারি বিদ্যালয়ের ওজর দিয়ে আত্মগ্লানি দূর করবার চেষ্টা ঠিক নয়। এ কথা স্বীকৃত যে, এই পঁয়ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর শতকার দশ অংশও শিক্ষিত নয়; আজ প্রায় শতাব্দীকাল ইংরেজশাসনে শিক্ষার ব্যবস্থা হয় নি ব’লেই এটা ঘটেছে। সেটার প্রধান কারণ, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব। কিন্তু য়ুরোপীয় বালকবালিকার প্রতি সে-অভাব নেই। আমাদের পক্ষে শতকরা পাঁচভাগ শিক্ষাই যথেষ্ট, কিন্তু য়ুরোপীয় ছাত্রদের জন্য শতকরা নিরানব্বই ভাগ শিক্ষার ব্যবস্থা হলেও ওই একভাগের জন্য খুঁৎখুঁৎ থেকে যায়। জাপান তো জাপানি ছেলেদের জন্যে এমন কথা বলে নি, সেখানেও তো মিশনারি বিদ্যালয় আছে। যে-কারণে ভারতের অর্থে পুষ্ট ইংরেজধনীর মধ্যে প্রায়ই কেউ ভারতের দৈন্যদুঃখলাঘবের জন্য মুনফার সামান্য অংশও দিতে পারে নি, সেই কারণেই ভারত-গবর্নমেণ্ট ভারতের অজ্ঞতা-অপমানলাঘবের জন্যে উপযুক্ত পরিমাণ শিক্ষার ব্যয় বহন করতে পারে নি, সহজ বদান্যতার অভাবে। ভারতের সঙ্গে ইংলণ্ডের অস্বাভাবিক সম্বন্ধ–এই কারণেই ইংলণ্ডের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় রাজামহারাজার দান দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু ইংলণ্ডের কোনো ধনী ভারতের কোনো অনুষ্ঠানে দানের মতো কোনো দান করেছে শুনতে পাই নি। অথচ, ভারত নিঃস্ব, ইংরেজ ধনী।
মিশনারি বিদ্যালয়ে ইংরেজের অর্থ আছে এমন কথা উঠবে। কিন্তু, সে কি ইংরেজের অর্থ। সে-যে খৃষ্টিয়ানের অর্থ। সে-যে ধর্মফলকামী সমস্ত ইউরোপের অর্থ। ধার্মিকের দান, আত্মীয়তার দান নয়, অধিকাংশ সময়েই তা পারলৌকিক বৈষয়িকতার দান। ভারতীয় খৃষ্টিয়ানের সঙ্গে ইংরেজ খৃষ্টিয়ানের যে কি সম্বন্ধ তা সকলেই জানে। ভারতের কোনো একটি পাহাড়ের শহরে চার্চ্ অফ ইংলণ্ডের সম্প্রদায়গত একজন ভারতীয় ভক্ত খৃষ্টিয়ান ছিলেন। তাঁর অন্ত্যেষ্টিসৎকারের অনুষ্ঠান নির্বাহের জন্য তাঁর বিধবা স্ত্রী সেখানকার একমাত্র স্বসাম্প্রদায়িক পাদ্রিকে অনুরোধ করেন। পাদ্রি আপন মর্যাদাহানি করতে সম্মত হলেন না; বোধ করি এতে পোলিটিকাল প্রেস্টিজেরও খর্বতাসম্ভাবনা আছে। অগত্যা বিধবা প্রেস্বিটেরিয়ান পাদ্রির শরণাপন্ন হলেন; তিনি ভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়া অকর্তব্য বোধ করলেন। ভারতে কোনো যথার্থ ভক্ত ইংরেজ মিশনারি নেই, এ কথা আমি বলি নে। কিন্তু, মিশনারি অনুষ্ঠানের যে-অংশে সাধারণ ইংরেজ ধার্মিকের অর্থ আছে সেখানে শ্রদ্ধা আছে এ কথা মানব না। শ্রদ্ধয়া দেয়ম্, অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম্। আমরা তো এই জানি, ভারতীয় চরিত্র ও ভারতীয় ধর্ম ও সমাজনীতির প্রতি সত্য মিথ্যা নানা উপায়ে অশ্রদ্ধা জাগিয়ে দিয়ে এই অর্থ সংগ্রহ হয়ে থাকে। অর্থাৎ, ভারতের প্রতি ইংরেজের যে-অবজ্ঞা ইংরেজ ধর্মব্যবসায়ীরা সর্বদাই তার ভূমিকা পত্তন ও ভিত্তি দৃঢ়ৃ করে এসেছে, সেখানকার শিশুদের মনে তারা খৃষ্টের নাম করে ভারতীয়ের প্রতি অপ্রীতির বীজ বপন করেছে। সেই বড়ো হয়ে যখন শাসনকর্তা হয় তখন জালিয়ানওয়ালাবাগের অমানুষিক হত্যাকাণ্ডকেও ন্যায়সংগত বলে বিচারকের আসন থেকে ঘোষণা করতে লজ্জা বোধ করে না। যেমন অশ্রদ্ধা তেমনি কার্পণ্য।
আমাদের পক্ষে সকলের চেয়ে প্রধান ও সাধারণ আবরণ হচ্ছে অভ্যাসের মোহ। এই অভ্যাসে চেতনায় যে-জড়তা আসে তাতে সত্যের অনন্তরূপ আনন্দরূপ দেখতে দেয় না। শিক্ষাবিধি সম্বন্ধে এই তত্ত্বটাকে আমরা একেবারেই অগ্রাহ্য করেছি। ছাত্রদের প্রতিদিন একই ক্লাসে একই সময়ে একই বিষয়ে শিক্ষার পুনরাবৃত্তি করানোর চেয়ে মনের জড়ত্বের কারণ আর কিছুই হতে পারে না। শিক্ষা সম্বন্ধে ছাত্রদের প্রধানত যে-বিতৃষ্ণা জন্মে শিক্ষার বিষয় কঠিন বলেই যে তা ঘটে তা সম্পূর্ণ সত্য নয়; শিক্ষাবিধি অত্যন্ত একঘেয়ে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। মানুষের প্রাণ যন্ত্রকে ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু যন্ত্রকে আত্মীয় করতে পারে না; শিক্ষাকে যন্ত্র করে তুললে তার থেকে কোনো বাহ্য ফলই হয় না তা নয়, কিন্তু সে শিক্ষা আত্মগত হতে গুরুতর বাধা পায়।
আকস্মিক হচ্ছে সীমার বাইরেকার দূত, অভাবনীয়ের বার্তা নিয়ে সে আসে। তাতেই আমাদের চেতনা জড়তা থেকে মুক্তির আনন্দ পায়। অভাবনীয়কে অনুভব করাতেই তার মুক্তি। বিশ্বের সর্বত্রই সেই অভাবনীয়। এই অভাবনীয়কে বোধের মধ্যে আনতে গেলে চিত্তকে প্রাণবান করে রাখা চাই, অর্থাৎ তাকে উৎসুক করে তুলতে হয়। এই ঔৎসুক্যই তাকে বদ্ধতার সীমার দিক থেকে বৃদ্ধির অসীমতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। অথচ, প্রাণের এই ঔৎসুক্য নষ্ট করে দিয়ে পুনরাবৃত্তির অন্ধ প্রদক্ষিণের জোয়ালে জোর করে চিত্তকে জুড়ে দেওয়াকেই অনেকে ডিসিপ্লিন বলে গৌরব করেন। অর্থাৎ, বিধাতা যে-মানুষকে প্রাণী করেছে সেই মানুষকেই তাঁরা যন্ত্র করতে চান। সেটা হয় সিদ্ধির লোভে। যন্ত্র হচ্ছে সিদ্ধিদেবীর বাহন, প্রাণকে পিষে সে প্রবল হয়। বিশেষ নির্দিষ্ট কোনো-একটা সংকীর্ণ ফল দেওয়াই তার কাজ। বিশ্বসত্যে নির্দিষ্টের চারিদিকে যে অসীম অনির্দিষ্ট আছে তাকে সে দেখতে পারে না, কেননা, প্রাণকে সে কেবলই গণ্ডীর বাহিরে আহ্বান করে। গণ্ডীর বাহিরে বিধাতার বাঁশি বাজে; ফলকামী সেই ধ্বনি রুদ্ধ করে প্রাচীর তোলে।
আমার মতে শিক্ষার প্রণালী হচ্ছে বৈরাগির রাস্তায়। ছাত্রদের নিয়ে বিবাগি হয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। চলতে চলতে নিয়ত নব নব বিস্ময়ে অজানার ভিতর দিয়ে জেনে চলাই হচ্ছে প্রাণবান শিক্ষা। প্রাণের ছন্দের সঙ্গে এই শিক্ষাপ্রবাহের তাল মেলে। বদ্ধ ক্লাস হচ্ছে প্রাণধর্মী চিত্তের সহজজ্ঞানের পথে কঠিন বাধা। খাঁচার মধ্যে পাখিকে বাঁধা খোরাক খাওয়ানো যায়, কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ পাখি হতে শেখানো যায় না। বনের পাখি ওড়ার সঙ্গে খাওয়ার মিল করে আনন্দিত হয়। প্রকৃতির অভিপ্রায় ছিল চলার সঙ্গে পাওয়ার মিল করে মানুষকে শেখানো। কিন্তু, হতভাগ্য মানবসন্তানের পক্ষে চলা বন্ধ করে দিয়ে শেখানোই শিক্ষাপ্রণালী বলে গণ্য হয়েছে। তাতে কত ব্যর্থতা, কত দুঃখ তার হিসেব কে রাখে। আমি তো পথ-চলা শিক্ষাব্যবস্থার কথা অনেকবার প্রস্তাব করেছি, কিন্তু কারো মন পাই নে। কারণ, যারা ভদ্রশিক্ষা পেয়েছে তারা বাঁধনের শিক্ষাকেই বিশ্বাস করতে শিখেছে। আমার ভাগ্য আমাকে শিক্ষায় বিবাগি করেছে বলেই খোলা পথের শিক্ষার ধারাকেই আমি সব চেয়ে সম্মান দিই।
পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ২৪
ক্রাকোভিয়া। ভারতসাগর, ১৫ ফেব্রয়ারি ১৯২৫
শিশু যে-জগতে সঞ্চরণ করে তার প্রায় সমস্তই সে প্রবল করে দেখে। জীবনে নানা অবান্তর বিষয় জমে উঠে তার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে নি। যখন আমি শিশু ছিলুম তখন আমাদের ছাদের উপর দিয়ে গয়লাপাড়ার দৃশ্য প্রতিদিনই দেখেছি; প্রতিদিনই তা সম্পূর্ণ চোখে পড়েছে, প্রতিদিনই তা ছবি ছিল। আমার দৃষ্টি আর আমার দৃষ্টির বিষয়ের মাঝখানে কোনো ভাবনা, অভ্যাসের কোনো জীর্ণতা আড়াল করে নি। আজ সেই গোয়ালপাড়া কতকটা তেমনি করে দেখতে হলে সুইজর্ল্যাণ্ডে যেতে হয়। সেখানে মন ভালো করে স্বীকার করে, হাঁ, আছে।
শিশুর কাছে বিশ্ব খুব করে আছে, আমরা বয়স্কেরা সে কথা ভুলে যাই। এইজন্যে,শিশুকে কোনো ডিসিপ্লিনের ছাঁচে ঢালবার জন্যে যখন তাকে জগৎ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের নিজের বানানো কলের মধ্যে বন্ধ করি তখন তাকে যে কতখানি বঞ্চিত করি তা নিজের অভ্যাসদোষেই বুঝতে পারি নে। বিশ্বের প্রতি তার এই একান্ত স্বাভাবিক ঔৎসুক্যের ভিতর দিয়েই-যে তাকে শিক্ষা দিতে হবে, নিতান্ত গোঁয়ারের মতো সে-কথা আমরা মানি নে। তার ঔৎসুক্যের আলো নিবিয়ে তার মনটা অন্ধকার করে দিয়ে শিক্ষার জন্যে তাকে এডুকেশন-জেলখানার দারোগার হাতে সমর্পণ করে দেওয়াই আমরা পন্থা বলে জেনেছি। বিশ্বের সঙ্গে মানুষের মনের যে স্বাভাবিক সম্বন্ধ এই উপায়ে সেটাকে কঠোর শাসনে শিশুকাল থেকেই নষ্ট ও বিকৃত করে দিই।
ছবি বলতে আমি কী বুঝি সেই কথাটাই আর্টিস্টকে খোলসা করে বলতে চাই।
মোহের কুয়াশায়, অভ্যাসের আবরণে, সমস্ত মন দিয়ে জগৎটাকে “আছে” বলে অভ্যর্থনা করে নেবার আমরা না পাই অবকাশ, না পাই শক্তি। সেইজন্য জীবনের অধিকাংশ সময়ই আমরা নিখিলকে পাশ কাটিয়েই চলেছি। সত্তার বিশুদ্ধ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েই মারা গেলুম।
ছবি, পাশ কাটিয়ে যেতে আমাদের নিষেধ করে। যদি সে জোর গলায় বলতে পারে “চেয়ে দেখো”, তা হলেই মন স্বপ্ন থেকে সত্যের মধ্যে জেগে ওঠে। কেননা, যা আছে তাই সৎ; যেখানেই সমস্ত মন দিয়ে তাকে অনুভব করি সেখানেই সত্যের স্পর্শ পাই।
কেউ না ভেবে বসেন, যা চোখে ধরা পড়ে তাই সত্য। সত্যের ব্যাপ্তি অতীতে ভবিষ্যতে, দৃশ্যে অদৃশ্যে, বাহিরে অন্তরে। আর্টিস্ট সত্যের সেই পূর্ণতা যে-পরিমাণে সামনে ধরতে পারে “আছে”‘ ব’লে মনের সায় সেই পরিমাণে প্রবল, সেই পরিমাণে স্থায়ী হয়; তাতে আমাদের ঔৎসুক্য সেই পরিমাণে অক্লান্ত, আনন্দ সেই পরিমাণে গভীর হয়ে ওঠে।
আসল কথা, সত্যকে উপলব্ধির পূর্ণতার সঙ্গে সঙ্গে একটা অনুভূতি আছে, সেই অনুভূতিকেই আমরা সুন্দরের অনুভূতি বলি। গোলাপফুলকে সুন্দর বলি এইজন্যেই যে, গোলাপ ফুলের দিকে আমার মন যেমন করে চেয়ে দেখে ইঁটের ঢেলার দিকে তেমন করে চায় না। গোলাপফুল আমার কাছে তার ছন্দের রূপে সহজেই সত্তারহস্যের কী একটা নিবিড় পরিচয় দেয়। সে কোনো বাধা দেয় না। প্রতিদিন হাজার জিনিসকে যা না বলি, তাকে তাই বলি; বলি, “তুমি আছ।”
একদিন আমার মালী ফুলদানি থেকে বাসি ফুল ফেলে দেবার জন্যে যখন হাত বাড়ালো, বৈষ্ণবী তখন ব্যথিত হয়ে বলে উঠল, “লিখতে পড়তেই তোমার সমস্ত মন লেগে আছে, তুমি তো দেখতে পাও না।” তখনই চমকে উঠে আমার মনে পড়ে গেল, হাঁ, তাই তো বটে। ওই “বাসি’ বলে একটা অভ্যস্ত কথার আড়ালে ফুলের সত্যকে আর আমি সম্পূর্ণ দেখতে পাই নে। যে আছে সেও আমার কাছে নেই; নিতান্তই অকারণে, সত্য থেকে, সুতরাং আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলুম। বৈষ্ণবী সেই বাসি ফুলগুলিকে অঞ্চলের মধ্যে সংগ্রহ করে তাদের চুম্বন করে নিয়ে চলে গেল।
আর্টিস্ট তেমনি করে আমাদের চমক লাগিয়ে দিক্। তার ছবি বিশ্বের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দিয়ে বলুক, “ওই দেখো, আছে।” সুন্দর বলেই আছে তা নয়, আছে বলেই সুন্দর।
সত্তাকে সকলের চেয়ে অব্যবহিত ও সুস্পষ্ট করে অনুভব করি আমার নিজের মধ্যে। “আছি” এই ধ্বনিটি নিয়তই আমার মধ্যে বাজছে। তেমনি স্পষ্ট করে যেখানেই আমরা বলতে পারি “আছে” সেখানেই তার সঙ্গে, কেবল আমার ব্যবহারের অগভীর মিল নয়, আত্মার গভীরতম মিল হয়। “আছি” অনুভূতিতে আমার যে-আনন্দ, তার মানে এ নয় যে, আমি মাসে হাজার টাকা রোজগার করি বা হাজার লোকে আমাকে বাহবা দেয়। তার মানে হচ্ছে এই যে, আমি যে সত্য এটা আমার কাছে নিঃসংশয়, তর্ক করা সিদ্ধান্তের দ্বারা নয়, নির্বিচার একান্ত উপলব্ধির দ্বারা। বিশ্বে যেখানে তেমনি একান্তভাবে “আছে” এই উপলব্ধি করি সেখানে আমার সত্তার আনন্দ বিস্তীর্ণ হয়। সত্যের ঐক্যকে সেখানে ব্যাপক করে জানি।
কোনো ফরাসি দার্শনিক অসীমের তিনটি ভাব নির্ণয় করেছেন–ঢ়বন ঝক্ষয়ন, ঢ়বন ঋষষধ, ঢ়বন আনতয়ঢ়ভপয়র। ব্রাহ্মসমাজে তারই একটি সংস্কৃত তর্জমা খুব চলতি হয়েছে–সত্যং শিবং সুন্দরম্। এমন কি, অনেকে মনে করেন, এটি উপনিষদের বাণী। উপনিষৎ সত্যের স্বরূপ যে ব্যাখ্যা করেছেন সে হচ্ছে, শান্তং শিবং অদ্বৈতম্। শান্তং হচ্ছে সেই সামঞ্জস্য যার যোগে সমস্ত গ্রহতারা নিয়ে বিশ্ব শান্তিতে বিধৃত, যার যোগে কালের গতি চিরন্তন ধৃতির মধ্যে নিয়মিতঃ নিমেষা মুহূর্তাণ্যর্ধমাসা ঋতবঃ সংবৎসরা ইতি বিধৃতাস্তিষ্ঠন্তি।–শিবং হচ্ছে মানবসমাজের মধ্যে সেই সামঞ্জস্য যা নিয়তই কল্যাণের মধ্যে বিকাশ লাভ করছে, যার অভিমুখে মানুষের চিত্তের এই প্রার্থনা যুগে যুগে সমস্ত বিরোধের মধ্য দিয়েও গূঢ়ভাবে ও প্রকাশ্যে ধাবিত হচ্ছে : অসতো মা সদ্গময় তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোর্মামৃতং গময়। আর, অদ্বৈতং হচ্ছে আত্মার মধ্যে সেই ঐক্যের উপলব্ধি যা বিচ্ছেদের ও বিদ্বেষের মধ্য দিয়েও আনন্দে প্রেমে নিয়ত আত্মীয়তাকে ব্যাপ্ত করছে।
যাঁদের মন খৃস্টিয়ানতত্ত্বের আবহাওয়াতে অত্যন্ত অভ্যস্ত তাঁরা উপনিষৎ সম্বন্ধে ভয়ে ভয়ে থাকেন, খৃস্টিয়ান দার্শনিকদের নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে উপনিষদের বাণীকে কিছু-না-কিছু বদল চালিয়ে দেওয়া তাঁদের ভিতরকার ইচ্ছা। কিন্তু, শান্তং শিবং অদ্বৈতম্ এই মন্ত্রটিকে চিন্তা করে দেখলেই তাঁরা এই আশ্বাস পাবেন যে, অসীমের মধ্যে দ্বন্দ্বের অভাবের কথা বলা হচ্ছে না, অসীমের মধ্যে দ্বন্দ্বের সামঞ্জস্য এইটেই তাৎপর্য। কারণ, বিপ্লব না থাকলে শান্তির কোনো মানেই নেই, মন্দ না থাকলে ভালো একটা শব্দমাত্র, আর বিচ্ছেদ না থাকলে অদ্বৈত নিরর্থক। তাঁরা যখন সত্যের ত্রিগুণাত্মক ধ্যানের মন্ত্রস্বরূপে “সত্যং শিবং সুন্দরম্’ বাক্যটি ব্যবহার করেন তখন তাঁদের বোঝা উচিত যে, সত্যকে সত্য বলাই বাহুল্য এবং সুন্দর সত্যের একটা তত্ত্ব নয়, আমাদের অনুভূতিগত বিশেষণমাত্র, সত্যের তত্ত্ব হচ্ছে অদ্বৈত। যে-সত্য বিশ্বপ্রকৃতি লোকসমাজ ও মানবাত্মা পূর্ণ করে আছেন তাঁর স্বরূপকে ধ্যান করবার সহায়তাকল্পে “শান্তং শিবং অদ্বৈতম’ মন্ত্রটি যেমন সম্পূর্ণ উপযোগী এমন আমি তো আর কিছুই জানি নে। মানবসমাজে যখন শিবকে পাবার সাধনা করি তখন কল্যাণের উপলব্ধিকে শান্তং আর অদ্বৈতং এই দুই-এর মাঝখানে রেখে দেখি, অর্থাৎ ইংরেজিতে বলতে গেলে, ল এবং লভ্ এর পূর্ণতাই হচ্ছে সমাজের ওয়েল্ফেয়ার্।
আমাদের চিত্তের মধ্যে তামসিকতা আছে, সেইজন্য বিশ্বকে দেখার বাধা হচ্ছে। কিন্তু, মানুষের মন তো বাধাকে মেনে বসে থাকবে না। এই বাধার ভিতর দিয়ে কেবলই দেখার পথ করতে হবে। মানুষ যতদিন আছে ততদিনই এই পথ-খোদা চলে আসছে। মানুষ অন্ন বস্ত্র সংগ্রহ করছে, মানুষ বাসা বাঁধছে, তার সঙ্গে-সঙ্গেই কেবলমাত্র সত্তার গভীর টানে আত্মা দিয়ে দেখার দ্বারা বিশ্বকে আপন করে চলছে। তাকে জানার দ্বারা নয়, ব্যবহারের দ্বারা নয়, সম্পূর্ণ করে দেখার দ্বারা; ভোগের দ্বারা নয়, যোগের দ্বারা।
আর্টিস্ট আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আর্টের সাধনা কী। আর্টের একটা বাইরের দিক আছে সেটা হচ্ছে আঙ্গিক, টেক্নিক্, তার কথা বলতে পারি নে। কিন্তু ভিতরের কথা জানি। সেখানে জায়গা পেতে চাও যদি তা হলে সমস্ত চিত্ত দিয়ে দেখো, দেখো, দেখো।
অর্থাৎ, বিশ্বের যেখানে প্রকাশের ধারা, প্রকাশের লীলা, সেখানে যদি মনটাকে সম্পূর্ণ করে ধরা দিতে পার তা হলেই অন্তরের মধ্যে প্রকাশের বেগ সঞ্চারিত হয়–আলো থেকেই আলো জ্বলে। দেখতে-পাওয়া মানে হচ্ছে প্রকাশকে পাওয়া। সংবাদ গ্রহণ করা এক জিনিস আর প্রকাশকে গ্রহণ করা আর-এক জিনিস। বিশ্বের প্রকাশকে মন দিয়ে গ্রহণ করাই হচ্ছে আর্টিস্টের সাধনা; তাতেই প্রকাশের শক্তি সচেষ্ট হয়ে ওঠে, প্রকাশের আঙ্গিকপদ্ধতি তার সঙ্গে-সঙ্গেই অনেকটা আপনি এসে পড়ে, কতকটা শিক্ষা ও চর্চার দ্বারা নৈপুণ্যকে পাকিয়ে তোলা যায়। এইটুকু সাধনা করতে হবে, হাতিয়ারের বোঝা যেন হাতটার উপর দৌরাত্ম্য না করে, সহজ-স্রোতকে আটক করে রেখে কষ্টকল্পিত পন্থাটাই যেন বাহবা নেবার জন্যে ব্যগ্র হয়ে না ওঠে। বিশ্বপ্রবাহের প্রবাহিণীর মধ্যে গলা ডুবিয়ে তারই কলধ্বনি থেকে প্রকাশের মন্ত্র অন্তরের মধ্যে গ্রহণ করো, তারই ধারার ছন্দ তোমার রক্তের স্রোতে আপন তাল বেঁধে দেবে–এই হল গোড়াকার কথা; এই হল বর্ষণ, তার পরে তোমার যদি আধার থাকে তো ভরে উঠবে; এই হল আগুন, প্রদীপ বের করতে পার যদি তো শিখা জ্বলবার জন্যে ভাবনা থাকবে না।
হারুনা-মারু জাহাজ, ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৪