ইহা শুনিয়া সঙ্গিনী যে ঘোর হাস্য করিল, নবীনা তাহাতেই বুঝিলেন,-তাঁহার আপত্তি গ্রাহ্য হইল না। তিনি পুনরায় কহিলেন, “যাবি কখন লা কনক, আর কি বেলা আছে?” “এখনও দুপুর বেলা” বলিয়া কনক অঙ্গুলী নির্দ্দেশে দেখাইলেন যে, এ পর্য্যন্ত সূর্য্যকর বৃক্ষোপরে দীপ্তিমান্ রহিয়াছে।
নবীনা তখন কিঞ্চিৎ গাম্ভীর্য্য সহকারে বলিলেন, “তুই জানিস্ ত কনক দিদি, আমি কখন জল আনিতে যাই না।”
কনক কহিল, “সেই জন্যই ত যাইতে কহি, তুই কেন সারাদিন পিঁজরেতে কয়েদ থাক্বি? আর বাড়ীর বউমানুষে জল আনে না?”
নবীনা গর্ব্বিত বচনে কহিলেন, “জল আনা দাসীর কর্ম্ম।”
“কেন, কে জল এনে দেয় লো? দাসী চাকর কোথা?”
“ঠাকুরঝি জল আনে।”
“ঠাকুরঝি যদি দাসীর কর্ম্ম করিতে পারে, তবে বৌ পারে না?”
তখন তরুণী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্বরে কহিল, “কথায় কাজ নাই কনক! তুমি জান আমার স্বামী আমাকে জল আনিতে বারণ করিয়াছেন। তুমি তাঁহাকে চেন ত?”
কনকময়ী কোনও উত্তর না করিয়া সচকিত কটাক্ষে চতুর্দ্দিকে নিরীক্ষণ করিলেন, যেন কেহ আসিতেছে কি না দেখিলেন। কোথাও কেহ নাই দেখিয়া সমভিব্যাহারিণীর মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন, যেন কিছু বলিতে বাসনা আছে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আশঙ্কাপ্রযুক্ত কথনেচ্ছা দমন করিয়া অধোদৃষ্টি করতঃ চিন্তা করিতে লাগিলেন। তরুণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাবিতেছিস্?”
কনক কহিল-“যদি-যদি তোর চোখ্ থাকত্___”
নবীনা আর না শুনিয়া ইঙ্গিতের দ্বারা নিষেধ করিয়া কহিল, “চুপ্ কর্, চুপ্ কর্-বুঝিয়াছি।”
কনক বলিল, “বুঝিয়া থাক ত কি করিবে এখন?”
তরুণী কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, ঈষৎ অধরকম্পে এবং অল্প ললাট-রক্তিমায় প্রকাশ পাইতে লাগিল যে, যুবতীর মনোমধ্যে কোন্ চিন্তা প্রবল। তাদৃশ ঈষৎ দেহকম্পনে আরও দেখা গেল যে, সে চিন্তায় হৃদয় অতি চঞ্চল হইতেছে। ক্ষণেক পরে কহিলেন, “চল যাই, কিন্তু ইহাতে কি পাপ আছে?”
কনক হাসিতে হাসিতে কহিল, “পাপ আছে! আমি ভুঁড়ে ভট্টাচার্য্যনহি, শাস্ত্রের খবরও রাখি না; কিন্তু আমার আড়াই কুড়ি মিন্সে থাকিলেও যাইতাম।”
“বড় বুকের পাটা” বলিয়া হাসিতে হাসিতে যুবতী কলসী আনিতে উঠিল; “পঞ্চাশটা! হাঁলো, এতগুলো কি তোর সাধ?”
কনক দুঃখের হাসি হাসিয়া কহিল, “মুখে আনিতে পাপ; কিন্তু বিধাতা যে একটা দিয়াছেন, পঞ্চাশটাও যদি তেমনি হয়, তবে কোটীখানেকেই বা কি ক্ষতি? কাহারও সঙ্গে যদি দেখা সাক্ষাৎ না হইল তবে আমি কোটী পুরুষের স্ত্রী হইয়াও সতী সাধ্বী পতিব্রতা।”
“কুলীনে কপাল” বলিয়া তরুণী চঞ্চল পদে পাকশালা হইতে একটি ক্ষুদ্র কলসী আনয়ন করিলেন। যেমন বারিবাহিনী তেমনই কলসী। তখন উভয়ে প্রবাহিণী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। কনক হাসিতে হাসিতে কহিল, “এখন এস দেখি মোর গৌরবিণী, হাঁ-করাগুলোকে একবার রূপের ছটাটা দেখাইয়া আনি।”
“মর্ পোড়ার বাঁদর” বলিয়া কনকের সমভিব্যাহারিণী অবগুণ্ঠনে সলজ্জ বদন আচ্ছন্ন করিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অপনীত সূর্য্যকর নারিকেলাদি বৃক্ষাগ্রভাগ হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে; কিন্তু এখনও পর্য্যন্ত নিশা ধরাবাসিনী হয় নাই। এমন সময় কনক ও তাহার সমভিব্যাহারিণী কলসীকক্ষে গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিল। পথিপার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র উদ্যান ছিল; পূর্ব্ববঙ্গ মধ্যে তদ্রূপ উদ্যান বড় বিরল। সুশোভন লৌহ রেইলের পরিধি মধ্য হইতে অসংখ্য গোলাপ ও মল্লিকার কলি পথিকার নেত্রমোদন করিতেছিল। পূর্ব্বতন পদ্ধতিমত চতুষ্কোণ ও অণ্ডাকার বহুতর চান্কার মধ্যে পরিষ্কার ইষ্টকচূর্ণ পথ সুরচিত ছিল। উদ্যানমধ্যে একটি পুষ্করিণী। তাহার তীর কোমল তৃণাবলিতে সুসজ্জিত; একদিকে ইষ্টকনির্ম্মিত সোপানাবলী। ঘাটের সম্মুখে বৈঠকখানা। বৈঠকখানার বারাণ্ডায় দাঁড়াইয়া দুই ব্যক্তি কথোকথন করিতেছিল।
বয়োধিক যে ব্যক্তি, তাহার বয়স ত্রিশ বৎসরের ঊর্দ্ধ হইবে; দীর্ঘ শরীর, স্থূলাকার পুরুষ। অতি স্থূলকায় বলিয়াই সুগঠন বলা যাইতে পারিল না। বর্ণ কঠোর শ্যাম; কান্তি কোনও অংশে এমত নহে যে, সে ব্যক্তিকে সুপুরুষ বলা যাইতে পারে; বরং মুখে কিছু অমধুরতা ব্যক্ত ছিল। বস্তুতঃ সে মুখাবয়ব অপর সাধারনের নহে; কিন্তু তাহার বিশেষত্ব কি যে, তাহাও হঠাৎ নিশ্চয় করা দুর্ঘট। কটিদেশে ঢাকাই ধুতি; লম্বা লম্বা পাকান ঢাকাই চাদরে পাগড়ি বাঁধা। পাগড়িটার দৌরাত্ম্যে, যে দুই এক গাছি চুল মাথায় ছিল, তাহাও দেখিতে পাওয়া ভার। ঢাকাই মলমলের পিরহাণ গাত্রে;-সুতরাং তদভ্যন্তরে অন্ধকারময় অসীম দেহখানি বেশ দেখা যাইতেছিল; আর সঙ্গে সঙ্গে সোনার কবচখানিও উঁকিঝুঁকি মারিতেছিল। কিন্তু গলদেশে যে হেলেহার মন্দর পর্ব্বতে বাসুকির ন্যায় বিরাজ করিতেছিল, সে একেবারে পিরহাণের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। পিরহাণের সোনার বোতাম, তাহাতে চেন্ লাগান; প্রায় সকল আঙ্গুলেই অঙ্গুরীয়; হস্তে যমদণ্ডতুল্য পিচের লাঠি। বামনদেবের পাদপদ্মতুল্য দুইখানি পায়ে ইংরাজি জুতা।
ইহার সমভিব্যাহারী পরম সুন্দর, বয়স অনুমান বাইশ বৎসর। তাঁহার সুবিমল স্নিগ্ধ বর্ণ, শারীরিক ব্যায়ামের অসদ্ভাবেই হউক, বা ঐহিক সুখ সম্ভোগেই হউক, ঈষৎ বিবর্ণ হইয়াছিল। তাঁহার পরিচ্ছদ অনতিমূল্যবান্,-একখানি ধুতি, অতি পরিপাটী একখানি চাদর, একটি কেমব্রিকের পিরাণ; আর গোরার বাটীর জুতা পায়। একটি আঙ্গুলে একটি আংটি; কবচ নাই, হারও নাই।
বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি অপরকে কহিল, “তবে মাধব, তুমি আবার কলিকাতা ধরিয়াছ! আবার এ রোগ কেন?”
মাধব উত্তর করিলেন, “রোগ কিসে? মথুর দাদা, আমার কলিকাতার উপর টান যদি রোগ হয়, তবে তোমার রাধাগঞ্জের উপর টানও রোগ।”
মথুর জিজ্ঞাসা করিল, “কিসে?”
মাধব। নয় কিসে? তুমি রাধাগঞ্জের আমবাগানের ছায়ায় বয়স কাটাইয়াছ, তাই তুমি রাধাগঞ্জ ভালবাসে; আমি কলিকাতার দুর্গন্ধে কাল কাটাইয়াছি, আমিও তাই কলিকাতা ভালবাসি।
মথুর। শুধু দুর্গন্ধ! ডেরেনের শুকো দুই; তাতে দুটো একটা পচা ইঁদুর, পচা বেরাল উপকরণ-দেবদুর্ল্লভ।
মাধব হাসিয়া কহিল, “শুধু এ সকল সুখের জন্য কলিকাতায় যাইতেছি না, আমার কাজও আছে।”
মথুর। কাজ ত সব জানি।-কাজের মধ্যে নূতন ঘোড়া নূতন গাড়ি-ঠক্ বেটাদের দোকানে টো টো করা-টাকা উড়ান-তেল পুড়ান-ইংরাজিনবিশ ইয়ার বক্শিকে মদ খাওয়ান-আর হয়ত রসের তরঙ্গে ঢলাঢল্। হাঁ করিয়া ওদিক কি দেখিতেছ? তুমি কি কখন কন্কিকে দেখ নাই? না ওর সঙ্গের ছুঁড়িটা আস্মান থেকে পড়েছে?-তাই ত বটে! ওর সঙ্গে ওটি কে?
মাধব কিঞ্চিৎ রক্তিমকান্তি হইলেন; কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভাবান্তর প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “কনকের কি স্বভাব দেখেছ? কপালে বিধাতা এত দুঃখ লিখেছেন, তবু হেসে হেসে মরে।”
মথুর। তা হউক-সঙ্গে কে?
মাধব। তা আমি কেমন করিয়া বলিব, আমার কি কাপড় ফুঁড়ে চোখ চলে? ঘোমটা দেখিতেছ না?
বস্তুতঃ কনক ও তাহার সঙ্গিনী কলসীকক্ষে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিল। কনককে সকলেই চিনিত; কিন্তু দ্বিতীয় কুলকামিনীর প্রতি পদসঞ্চারে যে অনির্ব্বচনীয় লাবণ্য বিকাশ হইতেছিল, তাঁহার বস্ত্র ভেদ করিয়া যে অপূর্ব্ব অঙ্গসৌষ্ঠব দেদীপ্যমান হইতেছিল, তাহাতে প্রথমে মাধবের, পশ্চাৎ মথুরের দৃষ্টি মুগ্ধ হইল; এবং উভয়ে সঙ্গীতধ্বনিদত্তচিত্ত কুরঙ্গের ন্যায় অবহিত মনে তৎপ্রতি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।
শেষ লিখিত কয়েকটি কথা যে সময়ে মাধবের মুখ হইতে নির্গত হইল, সেই সময় একবার মন্দ সমীরণ-হিল্লোল রমণীদিগের শিরোপরে বাহিত হইল; এই সময় তরুণী স্বীয় কক্ষস্থিত কলসী অনভ্যস্ত কক্ষে উত্তমরূপে বসাইবার জন্য অবগুণ্ঠন হইতে হস্ত লইবার সময়, দুষ্ট সমীরণ অবগুণ্ঠনদি উড়াইয়া ফেলিল। মুখ দেখিয়া মাধব বিস্মিতের ন্যায় ললাট আকুঞ্চিত করিলেন। মথুর কহিল, “ওই দেখ-তুমি ওকে চেন?”
“চিনি।”
“চেন? তুমি চেন, আমি চিনি না; অথচ আমি এইখানে জন্ম কাটাইলাম, আর তুমি কয়দিন! চেন যদি, তবে কে এটি?”
“আমার শ্যালী।”
“তোমার শ্যালী? রাজমোহনের স্ত্রী?”
“হাঁ।”
“রাজমোহনের স্ত্রী, অথচ আমি কখন দেখি নাই?”
“দেখিবে কিরূপে? উনি কখন বাটীর বাহির হয়েন না।”
মথুর কহিল, “হয়েন না, তবে আজ হইয়াছেন কেন?”
মাধব। কি জানি।
মথুর। মানুষ কেমন?
মাধব। দেখিতেই পাইতেছ-বেশ সুন্দর।
মথুর। ভবিষ্যদ্বক্তা গণকঠাকুর এলেন আর কি? তা বলিতেছি না-বলি, মানুষ ভাল?
মাধব। ভাল মানুষ কাহাকে বলে?
মথুর। আঃ কালেজে পড়িয়া একেবারে অধঃপাতে গিয়াছ। একবার যে সেখানে গিয়া রাঙ্গামুখোর শ্রাদ্ধর মন্ত্র পড়িয়া আসে, তাহার সঙ্গে দুটো কথা চলা ভার। বলি ওর কি-?
মাধবের বিকট ভ্রূভঙ্গ দৃষ্টে মথুর যে অশ্লীল উক্তি করিতে চাহিতেছিলেন তাহা হইতে ক্ষান্ত হইলেন।
মাধব গর্ব্বিত বচনে কহিলেন, “আপনার এত স্পষ্টতার প্রয়োজন নাই; ভদ্রলোকের স্ত্রী পথে যাইতেছে, তাহার সম্বন্ধে আপনার এত বক্তৃতার আবশ্যক কি?”
মথুর কহিল, “বলিয়াছি ত দু’ পাত ইংরেজি উল্টাইলে ভায়ারা সব অগ্নি-অবতার হইয়া বসেন। আর ভাই, শ্যালীর কথা কব না ত কাহার কথা কব? বসিয়া বসিয়া কি পিতামহীর যৌবন বর্ণনা করিব? যাক্ চুলায় যাক্; মুখখানা ভাই, সোজা কর-নইলে এখনই কাকের পাল পিছনে লাগিবে। রাজমুহুনে গোবর্দ্ধন এমন পদ্মের মধু খায়?”
মাধব কহিল, “বিবাহকে বলিয়া থাকে সুরতি খেলা।”
এইরূপ আর কিঞ্চিৎ কথোপকথন পরে উভয়ে স্ব স্ব স্থানে গমন করিলেন।