“ভাল, সারি, সত্য বল দেখি, তোমার বিশ্বাস কি? ভূত আছে?”
বরদা, ছোট ভাই সারদাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিল। সন্ধ্যার পর, টেবিলে দুই ভাই খাইতেছিল-একটু রোষ্ট মটন প্লেটে করিয়া, ছুরি কাঁটা দিয়া তৎসহিত খেলা করিতে করিতে জ্যেষ্ঠ বরদা এই কথা কনিষ্ঠকে জিজ্ঞাসা করিল।
সারদা প্রথমে উত্তর না করিয়া এক টুকরো রোষ্টে উত্তম করিয়া মাষ্টার্ড মাখাইয়া, বদনমধ্যে প্রেরণপূর্ব্বক, আধখানা আলুকে তৎসহবাসে প্রেরণ করিয়া, একটি রুটি ভাঙ্গিয়া বাম হস্তে রক্ষাপূর্ব্বক, অগ্রজের মুখ পানে চাহিতে চাহিতে চর্ব্বর্ণ কার্য্য সমাপন করিল। পরে, এতটুকু সেরি দিয়া, গলাটা ভিজাইয়া লইয়া বলিল, “ভূত? না।”
এই বলিয়া সারদাকৃষ্ণ সেন পরলোকগত এবং সুসিদ্ধ মেষশাবকের অবশিষ্টাংশকে আক্রমণ করিবার উদ্যোগ করিলেন।
বরদাকৃষ্ণ কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হইয়া বলিল, “Rather laconic.”
সারদাকৃষ্ণের রসনার সহিত রসাল মেষমাংসের পুনরালাপ হইতেছিল, অতএব সহসা উত্তর করিল না। যথাবিহিত সময়ে অবসর প্রাপণান্তর তিনি বলিলেন, “Laconic? বরং একটা কথা বেশী বলিয়াছি। তুমি জিজ্ঞাসা করিলে ‘ভূত আছে’-আমার বলিলেই হইত ‘না।’ আমি বলিয়াছি, ‘ভূত? না।’ ‘ভূত?’ কথাটা বেশী বলিয়াছি। কেবল তোমার খাতিরে।”
“অতএব তোমার ভ্রাতৃভক্তির পুরস্কারস্বরূপ, এই স্বর্গপ্রাপ্ত চতুষ্পদের খণ্ডান্তর প্রসাদ দেওয়া গেল।” এই বলিয়া বরদা, আর কিছু মটন কাটিয়া ভ্রাতার প্লেটে ফেলিয়া দিলেন। সারদা অবিচলিতচিত্তে, তৎপ্রতি মনোভিনিবেশ করিল!
তখন বরদা বলিল, Seriously সারি, ভূত আছে বিশ্বাস কর না?”
সারি। না।
বরদা। কেন বিশ্বাস কর না?
সারদা। সেই প্রাচীন ঋষির কথা-প্রমাণাভাবাৎ। কপিল প্রমাণ-অভাবে ঈশ্বর মানিলেন না-আর আমি প্রমাণ-অভাবে ভূত মানিব?
এই বলিয়া সারদা এক গেলাস সেরি মেষের সৎকারার্থ আপনার উদরমধ্যে প্রেরণ করিল।
বরদাকৃষ্ণ চটিয়া উঠিল-বলিল, “কোথাকার বাঁদর। ভূত নাই!- ঈশ্বর নাই! তবে তুমিও নেই, আমিও নেই?”
সারি। তাই বটে। তোমার মটন রোষ্ট ফুরাইল, দেখিয়া, আমি নেই। আর আমার আহারের ঘটা দেখিয়া, বোধ হয় তুমিও নেই।
বরদা, “কই, খেলি কই?” এই বলিয়া অবশিষ্ট মাংসটুকু কাটিয়া ভাইয়ের প্লেটে সংস্থাপিত করিয়া, গ্লাসে সেরি ঢালিয়া দিলেন। সারদা যতক্ষণ মাংসের ছেদন, বিন্ধন, মুখে উত্তোলন এবং চর্ব্বণ ইত্যাদি কার্য্যে নিযুক্ত ততক্ষণ বরদা চুপ করিয়া রহিল, পরে অবসর পাইলে, সারদা জ্যেষ্ঠকে বলিল, “তুমি নাই, আর আমি নাই-ইহা প্রায় philosophically true -কেন না, আমরা “mere permanent possibilities of sensation.” আর এই যে আহার করিলাম, ইহাও না করার মধ্যে জানিবে,-কেবল সেই possible sensation গুলার মধ্যে কতকগুলা sensation হইল মাত্র।
বরদা। সেই কথাই জিজ্ঞাসা করিতেছি, ভূত দেখা, ভূতের শব্দ শুনা, এ সব possible sensation নহে?
সারদা। ভূত থাকিলে possible.
বর। ভূত নাই?
সার। তা ঠিক বলিতেছি না-তবে প্রমাণ নাই বলিয়া ভূতে বিশ্বাস নাই, ইহাই বলিয়াছি।
বর। প্রত্যক্ষ কি প্রমাণ নহে?
সার। আমি কখন ভূত প্রত্যক্ষ করি নাই।
বর। টেমস্ নদী প্রত্যক্ষ করিয়াছ?
সার। না।
বর। টেমস্ নদী আছে মান?
সার। যাহাদের কথায় বিশ্বাস করা যায়, এমন লোক প্রত্যক্ষ করিয়াছে।
বর। ভূতও এমন লোক প্রত্যক্ষ করিয়াছে।
সার। বিশ্বাসযোগ্য এমন কে? এক জনের নাম কর দেখি?
বর। মনে কর, আমি।
এই কথা বলিতে বরদার মুখ কালো হইয়া গেল-শরীর রোমাঞ্চিত হইল।
সার। তুমি?
বর। তা হইলে বিশ্বাস কর।
সার। তুমি একটু imaginative, একটু sentimental-রজ্জুকে সর্প ভ্রম হইতে পারে।
বর। তুমি দেখিবে?
সার। দেখিব না কেন?
বর। আচ্ছা তবে আহার সমাপ্ত করা যাউক।
-‘নারায়ণ’, বৈশাখ ১৩২২, পরিশিষ্ট।
ভিক্ষা
আমি ভাবিয়া চিন্তিয়া স্থির করিয়াছি, এ যাত্রা ভিক্ষা করিয়া কাটাইব। আমাদের দেশ-ভাল দেশ, ভিক্ষায় বড় মান ; যে নির্ব্বোধ, সে পরিশ্রম করুক, আমি ভিক্ষা করিব।
কেহ মনে করিবেন না যে, আমি অন্ধ, কি খঞ্জ, কি বধির, কি পীড়িত, কি দীনদুঃখী। এ দেশে ভিক্ষা করিতে সে সব আড়ম্বরের প্রয়োজন কি? ভিক্ষা করিলেই হইল।
কে ভিক্ষা না করে? দীন-হীন, ধনবানের নিকট ভিক্ষা করে, ধনবানও দীন-হীনের নিকট ভিক্ষা করে। বড় বড় প্রকাণ্ডোদর জমীদারেরা দুঃখী প্রজাদের কাছে ভিক্ষা করেন ; আজ পিতৃশ্রাদ্ধ, কাল পুত্রের যজ্ঞোপবীত, তার পরদিন কন্যার বিবাহ। প্রজার নিকট ভিক্ষা না করিলে এ সব কর্ম্মে মান থাকে কই? বড় বড় কুলীন, তাঁহারা স্ত্রীর কাছে ভিক্ষা করিয়া উদর পরিপূরণ করেন, নহিলে নবধা কুললক্ষণ উজ্জ্বল হয় না। বড় বড় অধ্যাপক আচার্য্য গোস্বামীরা ভিক্ষা করেন, নহিলে পরকালের কাজ হয় না। তাঁহারা একান্ত পরহিতৈষী সন্দেহ নাই।
কে ভিক্ষা না করে? আমাদের দেশে সকলেই ভিক্ষা করে, কেবল ভিক্ষুক বিশেষে আর ভিক্ষার সময় বিশেষে, ভিক্ষার বিশেষ বিশেষ নাম আছে মাত্র। জমীদারের ভিক্ষার নাম মাঙ্গন, তাঁহাদের অনুচরদিগের ভিক্ষার নাম পার্ব্বণী, ভব-পারাবারের ত্রাণকর্ত্তা গুরুবর্গের ভিক্ষার নাম প্রণামী, আত্মীয় সমতুল্য ব্যক্তির ভিক্ষার নাম বিদায়। বরযাত্রীর ভিক্ষার নাম গণ, বরের বাপের ভিক্ষার নাম পণ, যে গ্রামে বিবাহ সে গ্রামের ভদ্রলোকদিগের ভিক্ষার নাম ডেলাভাঙ্গানি, আর তাহাদের যুবতীদের – অবলাবালাদিগের ভিক্ষার নাম -সেজতোলানি। নাছোড়বন্ধ ব্রাহ্মণ ভিখারীর ভিক্ষার নাম বার্ষিক। যাঁহার বাড়ীতে ঠাকুরদেবতা আছেন, তাঁহার ভিক্ষার নাম দর্শনী। রাজরাজড়ার ভিক্ষার নাম নজর ; কেবল খঞ্জ দীন দুঃখীর ভিক্ষার নাম ভিক্ষা। না হবেই না কেন? তাহারা যে পরের ধন চাহিয়া লইবার বাসনা করে, তাহাদের এত বড় যোগ্যতা!
ভিক্ষা আমাদের সংস্কার। সকল জাতির একটা একটা বিশেষ সংস্কার থাকে ; আমাদের সংস্কার ভিক্ষা। জন্মগ্রহণ করিয়াই ভিক্ষা পাই, তারে বলি যৌতুক। তার পর অন্নপ্রাশন ; অন্নপ্রাশনেও যৌতুক। ব্রাহ্মণের তার পর উপনয়ন, উপনয়নে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে না করিলে ব্রাহ্মণ হয় না। পরে বিবাহ, তখন সোণায় সোহাগা, নববধূর চাঁদমুখ দেখাইয়া ভিক্ষা লই। শেষ মৃত্যু ; সে ব্যাপারটায় বড় বাঁধাবাঁধি,-যম ছেড়ে দেয় না, সুতরাং পুত্র গলায় কাচা বাঁধিয়া আমাদের জন্য ভিক্ষায় বাহির হয়।
আমাদের চক্ষে ভিক্ষাবৃত্তির অপেক্ষা আর শ্রেষ্ঠ বৃত্তি নাই। সেই জন্য আমাদের পূজ্য-দেবতামধ্যে প্রধান-মহাদেবকে ভিখারী সাজাইয়াছি। আর বিষ্ণু বামন-অবতারে ভিক্ষা করিয়া ত্রিলোক রক্ষা করিলেন। এখনও কোন দেবমূর্ত্তি দর্শন করিতে গেলে ঠাকুরকে পয়সাটি না দিলে দর্শন মঞ্জুর হয় না। যখন বর্ণবিভাগ বদ্ধমূল হইল, তখন ইতর বর্ণ ইতর বৃত্তি অবলম্বন করিল ; যথা,-বৈশ্যে বাণিজ্য, ক্ষত্রিয়ে রাজত্ব, শ্রেষ্ঠ বর্ণ ব্রাহ্মণের বৃত্তিও শ্রেষ্ঠ হইল,-তিনি ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিলেন। অতএব ইহা স্থির যে, এ সংসারে ভিক্ষাই সার পদার্থ।
ভিক্ষায় আর এক সুখ আছে,-আদায়ের সুখ। খাতক যদি আমার কর্জ্জ শোধ না দেয়, তবে মহাকষ্ট ; তাহার নামে নালিশ করিতে হয়। প্রভু যদি বেতন না দেয়, তবে আরও জঞ্জাল ; উপায় নাই বলিলেই হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমনই সুনীতি যে, ভিক্ষা আদায়ের নানা শাসন আছে। প্রজা যদি জমীদারকে ভিক্ষা না দেয়, জরিমানা কর-মিথ্যা নালিশ কর-চাল কাটিয়া উঠাইয়া দাও। শিষ্যযজমান যদি ব্রাহ্মণকে ভিক্ষা না দেয়, অভিসম্পাত কর-বেটার সবংশে নির্ব্বংশ দাও ; তাহাতেও না দেয়, পইতা ছেঁড়-আর একটা পইতা কিনিয়া পরিও ; ইচ্ছা হয় তেরাত্রি কর, পার যদি ত লুকাইয়া লুকাইয়া কিছু কিছু আহার করিও ; উনানে পা পুরিও, কিন্তু দেখো, উনানে যেন আগুন না থাকে। আর যদি ব্রাহ্মণ না হইয়া জাতি-ভিখারী হও, তবে ধণ্বা দিও, মারে কাটে দ্বার ছেড়ো না। শ্রাদ্ধের সময় ভিক্ষা করিতে গেলে, যার শ্রাদ্ধ তার নরক দেখাইতে ভুলিও না। পশ্চিম দেশে আর একটা প্রথা আছে, সেইটা সর্ব্বাপেক্ষা ভাল,-তাহারা ঝাঁটা মারিয়া ভিক্ষা করে ; পার ত দাতাকে প্রথমে সেইরূপ সমাদরসূচক অভ্যর্থনা করিও।
ব্রাহ্মণ-ভিখারী! তোমাকে আরও দুই একটা পরামর্শ দিবার আছে। তুমি ভিক্ষুক-পূজ্য ব্যক্তি, যাহার দান লইবে, তাহার সহিত একাসনে বসিও না-উচ্চাসনে বসিও ; সে ব্যক্তি দাতা বইত নয়, তোমার সমানস্পর্দ্ধী? দাতার যদি সহজে মন না ভিজে, তাহার মাথায় শ্রীচরণখানি তুলিয়া দিও ; ইহাতে কোন ক্রমেই সঙ্কোচ করিও না। ভিখারীর পাদপদ্ম কখন কখন কাদা, গোবর ও বিষ্ঠায় পরিপূর্ণ থাকে-তথাপি দাতার মাথায় সোণার কিরীট থাকিলেও তাহার উপর পদ স্থাপন করিতে সঙ্কোচ করিও না। তাহাতে কার্য্যোদ্ধার না হয়, ভ্রূভঙ্গী করিও-ফিরিয়া দাঁড়াইও ; আগে বলিও, “দেবে না কেন? তাহাতেও না দেয়, অভিসম্পাত করিও ; পুত্রগুলির অমঙ্গলটা আগে দেখাইও। তবু কিছু না দেয়, বাপ চৌদ্দপুরুষকে গালি দিয়া চলিয়া আসিও। কার্য্যোদ্ধারের আর এক উপায় আছে,-ডিপে-হাতে বৈদ্য, কি পাঁজি-হাতে এদৈবজ্ঞ ইত্যাদি লোকের দেখা পাইলে দুই চারিটি উদ্ভট কবিতা শিখিয়া রাখিও ; কষ্ট করিয়া অর্থ লিখিবার প্রয়োজন নাই। প্রথমে আসন গ্রহণ করিয়াই দুই একটা কবিতা ছাড়িও ; পরে উপস্থিত কথার সহিত সংলগ্ন বা অসংলগ্ন যা হোক একটা অর্থ করিয়া দিও। তসর কাপড়খানা আর ফোঁটার আড়ম্বরটা চাই, আর যখন তখন তেমনি দাঁও ফাঁদিয়া বসিও। সুদের সুদ ছাড়িও না,-শাস্ত্রসম্মত দানটা হইলে দক্ষিণাটা না এড়ায়। যদি শুনিতে পাও যে, অমুক বাবুদের বাড়ী একটা বড় ক্রিয়া, সেই সময় কালে গোহালের গরুগুলা বাহিরে বাঁধিয়া তথায় টোল ফাঁদিয়া বসিও ; মামাত পিসিতত ভাইগুলাকে সাধিয়া পাড়িয়া দিন দুই তথায় পুরিও। পরে পত্রখানা জুটিলে সভায় উপস্থিত হইও। দেখ, গ্রামের বার্ষিক সমাজিকগুলিন যেন না ফস্কায় ; সেটায় বড় মান। ফলাহারে কামাই দিও না ; ফলাহার করিতে বসিয়া পাত হইতে গোটাকতক সন্দেশ চুরি করিয়া রাখিও ; বিদ্যাটি ছেলেগুলিকে শিখাইও। দেখো, চিঁড়ে দইয়ের ফলাহারে নুন মাখিতে ভুলে যেও না। কণ্ঠায় কণ্ঠায় ফলাহারের সমাপ্ত করিয়া আচমনের পর খড়িকা খাইতে খাইতে বলিও, “এত কপালে ছিল, পাষণ্ড বেটার বাড়ী আহার করিতে হইল।” এমন কথা দুটা একটা না বলিলে পাছে লোকে বলে তুমি পেটের দায়ে ফলাহার করিতে গিয়াছিলে।
-‘বঙ্কিম-জীবনী’, ৩য় সং, পৃ. ৩৬৫-৬৮।
রাজমোহনের স্ত্রী
প্রথম পরিচ্ছেদ