“অশ্ব শৃঙ্গহীন উদ্ভিদ্ভোজী চতুষ্পদ বিশেষ।”
ইহাতে অনেক কথা বুঝিবার কষ্ট আছে। যাহা যাহা বুঝিবার কষ্ট, তাহার প্রথম অধ্যায়ে সপ্তম পাঠে সম্প্রসারিত বাক্যগুলিতে পরিষ্কার হইয়াছে। আর এক প্রকারের উদাহরণ দেখ।
মনে কর, এ বৎসর বৃষ্টি কম হইয়াছে। লোকে বলে “ঊন বর্ষায় দুনো শীত।” অর্থাৎ যে বার বৃষ্টি কম হয় সে বার শীত বেশী হয়। মনে কর, তুমি সে কথা জান না। এমন অবস্থায় ভাদ্র মাসে তোমাকে যদি কেহ বলে, “এ বৎসর শীত বেশী হইবে,” তাহা হইলে তুমি তাহার কথার মর্ম কিছু বুঝিতে পারিবে না, হয়ত তাহাকে পাগল মনে করিবে। কিন্তু সে যদি নিজ বাক্যের সম্প্রসারণ করিয়া বলে, “যে যে বৎসর কম বর্ষা হইয়াছে, সেই সেই বৎসর বেশী শীত হইয়াছে দেখা গিয়াছে। এ বৎসর কম বর্ষা হইয়াছে, অতএব এ বৎসর বেশী শীত হইবে।” তাহা হইলে বুঝিবার কষ্ট থাকে না।
ন্যায়শাস্ত্রে ইহাকে বলে “অবয়ব” বলে। ন্যায়শাস্ত্রে অবয়বের এইরূপ উদাহরণ দেয়, যথা—
“পর্বতে আগুন লাগিয়াছে,
কেন না পর্বতে ধুঁয়া দেখিতেছি।”
যেখানে যেখানে ধুঁয়া দেখা গিয়াছে, সেইখানে আগুন দেখা গিয়াছে।
এই পর্বতে ধুঁয়া দেখা যাইতেছে,
অতএব ইহাতে আগুন লাগিয়াছে।
অনেক সময়ে এইরূপ লিখিলে রচনা বড় পরিষ্কার হয়।
চতুর্থ পাঠ
অলঙ্কার
অলঙ্কার ধারণ করিলে যেমন মনুষ্যের শোভা বৃদ্ধি পায়, অলঙ্কার ধারণ করিলে রচনারও সেইরূপ শোভা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অলঙ্কার প্রয়োগ বড় কঠিন। আর, সকল প্রকার রচনায় অলঙ্কারের সমাবেশ করা যায় না ; বিশেষ, যাহারা প্রথম রচনা করিতে শিখে, তাহাদিগের পক্ষে অলঙ্কার প্রয়োগ বিধেয় নহে। অতএব অলঙ্কার সম্বন্ধে কিছু লেখা গেল না।
৩য় অধ্যায়
পত্রলিপি
পত্র লিখিতে জানা, সকলেরই পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। অন্য প্রকার রচনার ক্ষমতা অনেকের পক্ষে নিষ্প্রয়োজন হইতে পারে, কিন্তু পত্র লিখিবার ক্ষমতা সকলের পক্ষে প্রয়োজনীয়। এই জন্য পত্র লেখার পদ্ধতি বলিয়া দিবার জন্য একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় লিখিলাম। পত্র লেখা অতি সহজ। বাঙ্গালায় পত্র লেখার কয়েক প্রকার পাঠ প্রচলিত আছে।
পূজ্য ব্যক্তি, যাঁহাকে প্রণাম করিতে হয়, তাঁহাকে “সেবক” ও “প্রণাম” পাঠ লিখিতে হয়। যথা—
সেবক শ্রীরমানাথ দেবশর্মণঃ প্রণামাঃ শতসহস্রনিবেদনঞ্চ বিশেষং। এই “দেবশর্মণঃ” শব্দ সম্বন্ধে একটা কথা বুঝিবার আছে। ব্রাহ্মণেরা সকলেই আপন নামের পর “শর্মা” বা “দেবশর্মা” লিখিতে বা বলিতে পারেন। রমানাথ বন্দোপাধ্যায়কে যদি কেহ জিজ্ঞাসা করে, মহাশয়ের নাম কি? তিনি উত্তর করিতে পারেন, “আমার নাম শ্রীরমানাথ শর্মা” অথবা “শ্রীরমানাথ দেবশর্মা”। কিন্তু দেখিবে পত্রের পাঠে লিখিত হইল “দেবশর্মণঃ”—“দেবশর্ম্মা” নহে। ইহার কারণ এই যে, আসল শব্দটি “শর্মণ্”। প্রথমায় ইহা শর্মা হয়—“শর্মণঃ” ষষ্ঠ্যন্ত। শব্দ ষষ্ঠ্যন্ত হইলে সম্বন্ধ পদ হয়। অতএব “শর্মণঃ” কি “দেবশর্মণঃ” বলিলে “শর্মার” ও “দেবশর্মার” বুঝায়। উপরে যে পাঠ লেখা হইয়াছে, তাহার অর্থ এই যে, “আপনার সেবক শ্রীরমানাথ দেবশর্মার শতসহস্র প্রণাম ও নিবেদন।” ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য জাতীয় লেখক হইলেও লেখকের নামটি ঐরূপ ষষ্ঠ্যন্ত হইবে, যথা—
“সেবক শ্রীরমানাথ দাস ঘোষস্য প্রণামাঃ শতসহস্রনিবেদনঞ্চ বিশেষং”।
“সেবক শ্রীরামচন্দ্র সেন গুপ্তস্য প্রণামাঃ” ইত্যাদি।
“সেবক শ্রীরামনিধি দাস বসোঃ প্রণামাঃ” ইত্যাদি।
ব্রাহ্মণকন্যারা সকলেই আপনার নামের পর “দেবী” লিখিতে পারেন, শূদ্রকন্যাদিগকে “দাসী” লিখিতে হয়। “দেবী” শব্দ ষষ্ঠ্যন্ত হইলে দেব্যাঃ” হয়; “দাসী” শব্দ “দাস্যাঃ” হয়। এজন্য মোক্ষদা দেবী কি কৃষ্ণপ্রিয়া দাসী পত্র লিখিতে গেলে, পাঠ লিখিবে,—
“মোক্ষদা দেব্যাঃ প্রণামাঃ” ইত্যাদি, “কৃষ্ণপ্রিয়া দাস্যাঃ প্রণামাঃ” ইত্যাদি।
এইরূপ ষষ্ঠ্যন্ত পদ পত্রের ভিতরে লিখিত হয় বলিয়া এ দেশের লৌকিক আচারে একটা ঘোরতর ভ্রম প্রবেশ করিয়াছে। লোকের বিশ্বাস হইয়াছে যে, স্ত্রীলোকের নামই বুঝি “দেব্যাঃ” ও দাস্যাঃ”। সাধারণ লেখকেরা, কর্তৃকারকেও “দেব্যাঃ” লেখেন, কর্মকারকেও “দেব্যাঃ” লেখেন, অপাদান, সম্প্রদান, করণ, অধিকরণ, সর্বত্রই “দেব্যাঃ” ও দাস্যাঃ”। ইহা বড় ভুল। “দেব্যাঃ” অর্থ দেবীর” ; “দাস্যাঃ” অর্থ “দাসীর”। সংস্কৃত ভিন্ন বাঙ্গালা লেখায় উহা ব্যবহৃত হইতে পারে না। পত্রের পাঠ সংস্কৃত, এই জন্য সে স্থানে ইহা ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃতেও সম্বন্ধ না বুঝাইলে ব্যবহৃত হইবে না।
সেইরূপ “দেবশর্মণঃ”। আজিও এমন অনেক মূর্খ ব্রাহ্মণকুমার আছে যে, নাম বলিতে গেলে বলে, “আমার নাম শ্রীঅমুক দেবশর্মণঃ।” ইহা ভুল। ইহার অর্থ “আমার নাম শ্রীঅমুক দেবশর্মার।” নাম বলিতে হইবে, “আমার নাম শ্রীঅমুক দেবশর্মা।”
এখনই সেই “সেবক” পাঠ পুনর্বার পড়িয়া দেখ—
“সেবক শ্রীরমানাথ দেবশর্মণঃ
“প্রণামাঃ শতসহস্রনিবেদনঞ্চ বিশেষং”—এখন তোমার বিশেষ নিবেদন কি, তাহা সহজ বাঙ্গালায় লিখিবে, যথা—
“মহাশয়ের আজ্ঞাপত্র প্রাপ্ত হইয়া শিরোধার্য করিলাম। আপনি যেরূপ লেখা পড়া ও আহারাদির নিয়ম বলিয়া দিয়াছেন, আমি সেই নিয়মানুসারেই চলিব। আমি জ্বরে কিছু কষ্ট পাইতেছি। চিকিৎসা করাইতেছি। ইতি, তারিখ সন ১২৮২। ২৭শে শ্রাবণ।”
এই “ইতি” শব্দের অন্বয়, উপরে যে “নিবেদনঞ্চ বিশেষং”—লিখিয়াছ, তাহা সঙ্গে “নিবেদনঞ্চ বিশেষং ইতি”, অর্থাৎ এই আমার বিশেষ নিবেদন।”
উপরে লেখকের নাম আছে, পত্রের নীচে আর তোমার নাম লিখিতে হইবে না। কিন্তু অনেকে শেষে নাম লেখেন। তাঁহারা সেবক পাঠ উপরে না লিখিয়া নীচে লেখেন। যথা—
“প্রণামাঃ শতসহস্রনিবেদনঞ্চ বিশেষং—
মহাশয়ের আজ্ঞাপত্র পাইয়া” ইত্যাদি লিখিয়া শেষে লেখেন, “ইতি, তারিখ সন ১২৮২। ২৭শে শ্রাবণ।
সেবক শ্রীরমানাথ দেবশর্মণঃ।
উপরে “নিবেদনং” পদ আছে, এজন্য “দেবশর্মণঃ” লেখা হইল, “দেবশর্মার নিবেদন” বুঝাইল। নহিলে “দেবশর্মা লিখিতে হইত।
এক্ষণে পত্র সমাপ্ত হইল। এখন পত্র মুড়িয়া তাহার উপরে শিরোনাম লিখিতে হইবে। যেমন পত্রের পাঠ আছে, তেমনই শিরোনামেরও পাঠ আছে। পূজ্য ব্যক্তি, যাঁহাকে সেবক পাঠ লিখিতে হয়, তাঁহাকে শিরোনামে “পরমপূজনীয়” লিখিতে হয়। নামের পর “শ্রীচরণেষু” বা “শ্রীচরণকমলেষু” কি এইরূপ অন্য কোন সম্মানসূচক পদ লিখিতে হয়। যথা—
“পরমপূজনীয়,
শ্রীযুক্ত বাবু মাধবচন্দ্র ঘোষাল
মাতুল মহাশয় শ্রীচরণকমলেষু।”
নীচে পত্রের ঠিকানা লিখিয়া দিবে, যথা—দেয়, (বা দেনা) মোং বর্ধমান।
পূজ্য ব্যক্তিকে “প্রণাম” করিতে হয়, তুল্য ব্যক্তিকে “নমস্কার” করিতে হয়। এই জন্য তুল্য ব্যক্তিকে যে পত্র লেখা যায়, তাহার পাঠের নাম “নমস্কার” পাঠ। যথা—
“সবিনয় নমস্কারাঃ নিবেদনঞ্চ বিশেষং অথবা বাঙ্গালায়—
“বিনয় পূর্বক নমস্কার নিবেদন।” অনেকে সংক্ষেপ করিয়া শুধু লেখেন—
“নমস্কার নিবেদন।”
আগে রীতি ছিল, লেখকের নাম পত্রের প্রথমে থাকিত, যথা—
“আজ্ঞাকারী শ্রীরমানাথ দেবশর্মণঃ” কিন্তু এখন “সেবক” পাঠ ভিন্ন যে পদ্ধতি প্রায় অপ্রচলিত হইয়াছে। ইংরাজী পত্রের নিয়মানুসারে, নাম শেষে লেখা হয়। শিরোনামে পূর্বরীত্যনুসারে “মদেকদয়” বা “পোষ্টৃবর” কি এমনই একটি ঘনিষ্ঠতাসূচক পদ ব্যবহৃত হইত। এখন, সে সকল পদ তত ব্যবহৃত হয় না। “মান্যবর” কি “বিজ্ঞবর” কি এমনই অপর কোন নিঃসম্বন্ধ পদ ব্যবহৃত হয়। যথা—
“মান্যবর শ্রীযুক্ত বাবু বিজয়মাধব মিত্র মহাশয় সমীপেষু।” তবে ইহা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, “শ্রীযুক্ত বাবু” শিরোনামে এখনকার দিনে কখনও পরিত্যাগ করা যায় না। কেবল অধ্যাপক, গুরু পুরোহিত প্রভৃতিকে লিখিতে “বাবু” শব্দ ত্যাগ করিতে হয়। স্ত্রীলোককে লিখিতে গেলে, সধবা বা কুমারীকে “শ্রীমতী” লিখিতে হয়। যথা— “পরমপূজনীয়া শ্রীমতী কৃষ্ণমোহিনী দেবী মাতুলানী মহাশয়া শ্রীচরণকমলেষু।” বিধবাকে “শ্রীযুক্তা” লেখা যায়। মুসলমানকেও বাবু লেখা নিষিদ্ধ। মুসলমানকে “মৌলবী” বা “মুন্সী” লিখিতে হয়। নামের পর “সাহেব” লিখিতে হয়। যথা— “মান্যবর শ্রীযুক্ত মৌলবী লতাফৎ হোসেন খাঁ সাহেব বরাবরেষু।” যাঁহাদের কোন উপাধি আছে, যথা রাজা, মহারাজা, রায় বাহাদুর, খাঁ বাহাদুর ইত্যাদি, তাঁহাদের সে উপাধি শিরোনামে লিখিতে হইবে। যথা— “মহারাজাধিরাজ শ্রীলশ্রীযুক্ত বর্ধমানাধিপতি মহাতাপচন্দ বাহাদুর প্রজাপালকবরেষু।” “মহামান্য শ্রীযুক্ত অনরেবল্ সর্ আশ্লী ইডেন, কে, সি, এস, আই বরাবরেষু।” তার পর, যাহারা সম্বন্ধে ছোট, তাহাদিগকে “আশীর্বাদ” পাঠ লেখা যায়। আশীর্বাদ পাঠ অনেক প্রকার আছে, যথা— “পরমশুভাশীর্বাদ” ইত্যাদি “শুভাশিষাং রাশয়ঃ সন্তু।”
কিন্তু অনেকেই এ সকল পরিত্যাগ করিয়াছেন। আত্মীয় ব্যক্তি হইলে, তাঁহারা “প্রিয়তমেষু” “প্রিয়বরেষু” এইরূপ লেখেন; বিশেষ আত্মীয়তা না থাকিলে শুধু “কল্যাণবরেষু” লিখিয়া থাকেন। শিরোনামে, “পরমকল্যাণীয়” বা “কল্যাণীয়া” পাঠ লিখিতে হয়। শেষে কিছু আশীর্বাদ বাক্য থাকা চাই। সকল স্থলে “শ্রীযুক্ত” পরিবর্তে “শ্রীমান্” শব্দ ব্যবহৃত হয়। যথা—
“পরমকল্যাণীয় শ্রীমান্ বাবু রাধানাথ দাস বাবাজীউ চিরজীবেষু।” “কল্যাণীয় শ্রীমান্ নিশিকান্ত ঘোষ ভাইজীউ মঙ্গলাস্পদেষু।”
শূদ্রকে পত্র লিখিতে গেলে, ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ পাঠ লেখাই উচিত। ব্রাহ্মণকে পত্র লিখিতে হইলে শূদ্রের প্রণাম পাঠ লেখাই কর্তব্য। কিন্তু এখন অনেক শূদ্র ইহা মানেন না।
স্থূল কথা, এখন অনেক ইংরাজি পত্র লেখার প্রথানুসারে লিখিতে হয়। তাহার দুই একটি উদাহরণ দিয়া ক্ষান্ত হইব।