২। স্ত্রীলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে ইচ্ছামত স্ত্রীলিঙ্গান্ত না করিলে, না করিতে পার ; কিন্তু যদি কতকগুলি বিশেষণ থাকে আর তাহার একটিকে স্ত্রীলিঙ্গান্ত কর, তবে আর সকলগুলিকেও স্ত্রীলিঙ্গান্ত করিতে হইবে। “সুন্দর বালিকা” বলিতে পার, কিন্তু “সুসজ্জিতা সুন্দর বালিকা” বলিতে পার না, “সুসজ্জিতা সুন্দরী বালিকা” বলিতে হইবে। “প্রখর নদী” বলিতে পার, কিন্তু “কুলপ্লাবিনী প্রখর নদী” বলিতে পার না ; এখানে “প্রখরা” বলিতে হইবে।
৩। বিশেষণ হইলে সংস্কৃত শব্দই স্ত্রীলিঙ্গান্ত হয়, অসংস্কৃত বিশেষণ স্ত্রীলিঙ্গান্ত হয় না। যথা “একটা বড় বাঘিনী” ভিন্ন “একটা বড়ী বাঘিনী” বলা যায় না ; “ঢেঙ্গা মেয়ে” ব্যতীত “ঢেঙ্গী মেয়ে” বলা যায়। “ফুটো কৌড়ি” “ফুটী কৌড়ি” নহে। হিন্দীর নিয়ম বিপরীত। হিন্দীতে “ফুটী কৌড়ি” বলিতে হইবে।
৪। অসংস্কৃত শব্দের স্ত্রীলিঙ্গান্ত বিশেষণ ভাল শুনায় না। “গর্ভবতী মেয়ে” না বলিয়া “গর্ভবতী কন্যা” বলাই ভাল। “সুশীলা বউ” না বলিয়া “সুশীলা বধূ” বলা উচিত। “মুখরা চাকরাণী” না বলিয়া “মুখরা দাসী” বলিব।
কারক। সকল বাক্যে কর্তা ও কর্ম যেন নির্দিষ্ট থাকে। বাঙ্গালায় এ বিষয়ে ভুল সর্বদা হয়। “আমাকে মারিয়াছে।” কে মারিয়াছে তাহার ঠিক নাই। “বুঝি দেশে রহিতে দিল না।” কে রহিতে দিল না তাহার ঠিক নাই।
দ্বিতীয় পাঠ
অর্থব্যক্তি
তোমার যাহা বলিবার প্রয়োজন, রচনায় তাহা যদি প্রকাশ করিতে না পারিলে, তবে রচনা বৃথা হইল। অর্থব্যক্তির বিশেষ কোন নিয়ম নাই, তবে দুই একটা সঙ্কেত আছে।
যে কথাটিতে তোমার কাজ হইবে, সেই কথাটি ব্যবহার করিবে। তাহা শুনিতে ভাল নয়, কি বিদেশী কথা, এরূপ আপত্তি গ্রাহ্য করিও না। এক সময়ে লেখকদিগের প্রতিজ্ঞা ছিল যে, সংস্কৃতমূলক শব্দ ভিন্ন অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করিবে না। কিন্তু এখনকার উৎকৃষ্ট লেখকেরা প্রায়ই এ নিয়ম ত্যাগ করিয়াছেন। যে কথাটিতে মনের ভাব ঠিক ব্যক্ত হয়, তাঁহারা সেই কথাই ব্যবহার করেন।
একটি উদাহরণ দিতেছি। তুমি কোন আদালতের ইশ্তিহারের কথা লিখিতেছ। আদালত হইতে যে সকল আজ্ঞা, সকলের জানিবার জন্য প্রচারিত হয়, তাহাকে ইশ্তিহার বলে। ইহার আর একটি নাম “বিজ্ঞাপন”। “বিজ্ঞাপন” সংস্কৃত শব্দ, ইশ্তিহার বৈদেশিক শব্দ, এজন্য অনেকে “বিজ্ঞাপন” শব্দ ব্যবহার করিতে চাহিবেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনের একটু দোষ আছে, তাহার অনেক অর্থ হইয়া উঠিয়াছে। গ্রন্থকর্তা গ্রন্থ লিখিয়া গ্রন্থের পরিচয় জন্য প্রথম যে ভূমিকা লেখেন তাহার নাম “বিজ্ঞাপন”। দোকানদার আপনার জিনিস বিক্রয়ের জন্য খবরের কাগজে বা অন্যত্র যে খবর লেখে, তাহার নাম “বিজ্ঞাপন”। সভা কি রাজকর্মচারীর রিপোর্টের নাম “বিজ্ঞাপন”। “বিজ্ঞাপন” শব্দের এইরূপ অর্থের গোলযোগ আছে। এস্থলে, আমি ইশ্তিহার শব্দই ব্যবহার করিব। কেন না, ইহার অর্থ সকলেই বুঝে, লৌকিক ব্যবহার আছে। অর্থেরও কোন গোল নাই।
দ্বিতীয় সঙ্কেত এই যে, যদি এমন কোন শব্দই না পাইলাম যে তাহাতে আমার মনের ভাব ঠিক ব্যক্ত হয়, তবে যেটি উহারই মধ্যে ভাল, সেইটি ব্যবহার করিব। ব্যবহার করিয়া তাহার পরিভাষা করিয়া অর্থ বুঝাইয়া দিব। দেখ, “জাতি” শব্দ নানার্থ। প্রথম, জাতি (Caste) অর্থে হিন্দুসমাজের জাতি ; যেমন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কৈবর্ত ইত্যাদি। দ্বিতীয়, জাতি অর্থে দেশবিদেশের মনুষ্য (Nation); যেমন ইংরেজজাতি, ফরাসীজাতি, চীনজাতি। তৃতীয়, জাতি অর্থে মনুষ্যবংশ (Race); যেমন আর্যজাতি, সেমীয়জাতি, তুরাণীজাতি ইত্যাদি। চতুর্থ, জাতি অর্থে কোন দেশের মনুষ্যদিগের শ্রেণীবিশেষ মাত্র (Tribe); যেমন, য়িহুদায় দশজাতি ছিল। পঞ্চম, ‘নানাজাতি পক্ষী’, ‘কুক্কুরের জাতি’ (Species) বলিলে যে অর্থ বুঝায়, তাই। ইহার মধ্যেও কোনও অর্থ প্রকাশ করিতে গেলে, জাতি ভিন্ন বাঙ্গালায় অন্য শব্দ নাই। এস্থলে জাতি শব্দই ব্যবহার করিতে হইবে। কিন্তু ব্যবহার করিয়া তাহার পরিভাষা করিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবে যে, কোন্ অর্থে ‘জাতি’ শব্দ ব্যবহার করা যাইতেছে। বুঝাইয়া দিয়া উপরে যেমন দেওয়া গেল, সেইরূপ উদাহরণ দিলে আরও ভাল হয়।
তৃতীয় পাঠ
প্রাঞ্জলতা
প্রাঞ্জলতা রচনার বড় গুণ। তুমি যাহা লিখিবে, লোকে পড়িবামাত্র যেন তাহা বুঝিতে পারে। যাহা লিখিলে, লোকে যদি তাহা না বুঝিতে পারিল, তবে লেখা বৃথা। কিন্তু অনেক লেখক এ কথা মনে রাখেন না। কতকগুলি নিয়ম, আর কতকগুলি কৌশল মনে রাখিলে রচনা খুব প্রাঞ্জল করা যায়। দুই রকমই বলিয়া দিতেছি।
১। একটি বস্তুর অনেকগুলি নাম থাকিতে পারে, যেমন আগুনের নাম অগ্নি, হুতাশন অথবা হুতভুক্, অনল, বৈশ্বানর, বায়ুসখা ইত্যাদি। এখন, আগুনের কথা লিখিতে গেলে ইহার মধ্যে কোন্ নামটি ব্যবহার করিব? যেটি সবাই জানে, অর্থাৎ আগুন বা অগ্নি। যদি বলি, “হুতভুক্ সাহায্যে বাষ্পীয় যন্ত্র সঞ্চালিত হয়,” তবে অধিকাংশ বাঙ্গালী আমার কথা বুঝিবে না। যদি বলি যে, “অগ্নির সাহায্যে বাষ্পীয় যন্ত্র চলে” সকলেই বুঝিবে।
২। অনর্থক কতকগুলা সংস্কৃত শব্দ লইয়া সন্ধি সমাসের আড়ম্বর করিও না—অনেকে বুঝিতে পারে না। যদি বলি, “মীনক্ষোভাকুল কুবলয়” তোমরা কেহ কি সহজে বুঝিবে? আর যদি বলি, “মাছের তাড়নে যে পদ্ম কাঁপিতেছে,” তবে কে না বুঝিবে?
৩। অনর্থক কথা বাড়াইও না। অল্প কথায় কাজ হইলে, বেশী কথার প্রয়োজন কি? “এবম্বিধ বিবিধ প্রকার ভয়াবহ ব্যাপারের বশীভূত হইয়া, যখন সূর্যদেব পূর্বগগনে অধিষ্ঠান করিয়া পৃথিবীতে স্বীয় কিরণমালা প্রেরণ করিলেন, তখন আমি সেই স্থান পরিত্যাগ পূর্বক অন্যত্র গমন করিলাম।” এরূপ না বলিয়া যদি বলি, “এইরূপ অনেক বিষয়ে ভয় পাইয়া, যখন সূর্য উঠিল তখন আমি সেস্থান হইতে চলিয়া গেলাম” তবে অর্থের কোন ক্ষতি হয় না, অথচ সকলে সহজে বুঝিতে পারে।
৪। জটিল বাক্য রচনা করিও না। অনেকগুলি বাক্য একত্র জড়িত করা হইলে বাক্য জটিল হয়। যেখানে বাক্য জটিল হইয়া আসিবে, সেখানে জটিল বাক্যটি ভাঙ্গিয়া ছোট ছোট সরল বাক্যে সাজাইবে। উদাহরণ দেখঃ—
“দিন দিন পল্লীগ্রাম সকলের যেরূপ শোচনীয় অবস্থা দাঁড়াইতেছে, তাহাতে অল্পকাল মধ্যে পল্লীগ্রাম যে জলহীন হইবে, এবং তদ্ধেতুক যে কৃষিকার্যের বিশেষ ব্যাঘাত ঘটিবে, এরূপ অনুমান করিয়াও অনেক দেশহিতৈষী ব্যক্তি তাহার প্রতিবিধানে যত্ন করেন না, দেখিয়া আমরা বড় দুঃখিত হইয়াছি।”
এই বাক্য অতি জটিল। সহজে বুঝা যায় না। কিন্তু ছোট ছোট বাক্যে ইহাকে বিভক্ত করিয়া লইলে কত সহজ হয় দেখ। “দিন দিন পল্লীগ্রাম সকলের শোচনীয় অবস্থা দাঁড়াইতেছে। যেরূপ শোচনীয় অবস্থায় দাঁড়াইতেছে, তাহাতে অল্পকাল মধ্যে অনেক পল্লীগ্রাম জলহীন হইবে। পল্লীগ্রাম সকল জলহীন হইলে কৃষিকার্যের বিশেষ ব্যাঘাত ঘটিবে। অনেক দেশহিতৈষী ব্যক্তি ইহা অনুমান করিয়াছেন। কিন্তু অনুমান করিয়াও তাঁহারা ইহার প্রতিবিধানের যত্ন করেন না। ইহা দেখিয়া আমরা বড় দুঃখিত হইয়াছি।”
একটি বাক্যের স্থানে ছয়টি হইয়াছে। কিন্তু বুঝিবার আর কোন কষ্ট নাই।
৫। উদাহরণ। যেখানে স্থূল কথাটা বুঝিতে কঠিন, সেখানে উদাহরণ প্রয়োগে বড় পরিষ্কার হয়। এই গ্রন্থে সকল কথার উদাহরণ দেওয়া গিয়াছে, সুতরাং উদাহরণের আর পৃথক্ উদাহরণ দিবার প্রয়োজন নাই।
৬। সম্প্রসারণ। স্থূল বাক্যটি বড় সংক্ষিপ্ত হইলে অনেক সময়ে বুঝিবার কষ্ট হয়। এমন স্থলে সম্প্রসারণ করিবে। অশ্বের উদাহরণ পূর্বে প্রথম অধ্যায়ে সপ্তম পাঠে দিয়াছি; তাহা দেখিলেই বুঝিতে পারিবে।