পরীক্ষার্থ
নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয়ে এইরূপ সম্প্রসারিত প্রবন্ধ লেখ।
হস্তী, কুক্কুর, চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষ, বিদ্যা, মাতাপিতা, রাগ, সাহস, শিক্ষক, দয়া।
ইহাও স্মরণ রাখিবে যে, সকল বিষয়েই প্রবন্ধকে ঐরূপ চারি ভাগে বিভক্ত করা যায় না। কখন কোনটি ছাড়িয়া দিতে হয়। যথা, চন্দ্র সূর্যের জাতিভেদ নাই—উহা ছাড়িয়া দিবে; তবে চন্দ্র সূর্য সম্বন্ধে লোকের মতভেদ আছে, পার ত, তাহা লিখিবে। আর এই চারিটি ভাগ ছাড়া আর যাহা কিছু বক্তব্য লিখিতে চাও তাহাতে আপত্তি নাই। বিশেষ কোন বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিতে গেলে পূর্বগামী লেখকদিগের মত সঙ্কলন করা প্রথা আছে ; আবশ্যক মতে তাহা করিতে পার। ভাল বুঝিলে তাহার প্রতিবাদ করিতে পার।
২য় অধ্যায়
প্রথম পাঠ—বিশুদ্ধি
রচনার চারিটি গুণ বিশেষ করিয়া শিখিতে হইবে। এই চারিটির নাম (১) বিশুদ্ধি, (২) অর্থব্যক্তি, (৩) প্রাঞ্জলতা, (৪) অলঙ্কার।
প্রথমে বিশুদ্ধি। রচনার ভাষা শুদ্ধ না হইলে সব নষ্ট হইল। বিশুদ্ধির প্রতি সর্বাগ্রে মনোযোগ করিতে হইবে। বিশুদ্ধি সর্বপ্রধান গুণ।
যাহা বিশুদ্ধ নহে, তাহা অশুদ্ধ। কি হইলে রচনা অশুদ্ধ হয়, তাহা বুঝিলেই, বিশুদ্ধি কি তাহা বুঝিবে।
পূর্বেই বলিয়াছি যে মৌখিক রচনা যেরূপ, লিখিত রচনাও সেইরূপ ; তবে কিছু প্রভেদ আছে। লিখিত রচনা কতকগুলি নিয়মের অধীন, মৌখিক রচনা সে সব নিয়মের অধীন নয়। অথবা অধীন হইলেও মৌখিক রচনায় সে সকল নিয়ম লঙ্ঘনে দোষ ধরা যায় না। লিখিত রচনায় যে সকল নিয়ম লঙ্ঘিত হইলে দোষ ধরিতে হয়, সেই সকল নিয়ম লঙ্ঘিত হইলেই রচনা অশুদ্ধ হইল। সেই সকল দোষের কথা এখন লিখিতেছি।
১। বর্ণাশুদ্ধি। মুখে সকলেই বলে, “পষ্ট” “মেগ” “শপত” “শট” “বাঁদ” “দুবল” “নেত্য” কিন্তু লিখিতে হইবে “স্পষ্ট, মেঘ, শপথ, শঠ, বাঁধ, দুর্বল, নৃত্য।”
২। সংক্ষিপ্তি। মুখে বলি, “কোরে, “কচ্চি”, “কর্ব” “কল্লুম” “কচ্ছিলুম” কিন্তু লিখিতে হইবে “করিয়া” “করিতেছি” “করিব” “করিলাম” “করিতেছিলাম” ইত্যাদি।
৩। প্রাদেশিকতা। বাঙ্গালার কোন প্রদেশের লোকে বলে, “কল্লুম”, কোন প্রদেশে, “কল্লেম”, কোথাও, “কল্লাম”, কোথাও “কন্নু”। কোন প্রদেশবিশেষেরই ভাষা ব্যবহার করা হইবে না ;—যাহা লিখিত ভাষায় চিরপ্রচলিত, তাহাই ব্যবহৃত হইবে।
অন্যান্য স্থানের অপেক্ষা রাজধানীর ভাষাই সমধিক পরিচিত। অতএব রাজধানীর ভদ্রসমাজে যে ভাষা চলিত তাহা লিখিত রচনায় ব্যবহৃত হইতে পারে। কোন দেশে বলে “ছড়ি” কোন দেশে বলে “নড়ি।” “ছড়ি” কলিকাতার ভদ্রসমাজে চলিত। উহা ব্যবহৃত হইতে পারে। “লগি” “লগা” “চৈড়”—ইহার মধ্যে লগিই কলিকাতায় চলিত, উহাই ব্যবহৃত হইতে পারে। অপর দুইটি ব্যবহৃত হইতে পারে না।
৪। গ্রাম্যতা। কেবল ইতর লোক বা গ্রাম্য লোকের মধ্যে যে সকল শব্দ প্রচলিত, তাহা ব্যবহৃত হইতে পারে না। “কৌশল্যার পো রাম,” “দশরথের বেটা লক্ষ্মণ,” এ সকল বাক্য গ্রাম্যতা-দোষে দুষ্ট।
নাটক ও উপন্যাস গ্রন্থে, যে স্থানে কথোপকথন লিখিত হইতেছে, সেখানে এই চারিটি দোষ অর্থাৎ বর্ণাশুদ্ধি সংক্ষিপ্ত প্রাদেশিকতা ও গ্রাম্যতা থাকিলে দোষ ধরা যায় না। কেন না মৌখিক রচনা এ সকল নিয়মের অধীন নহে বলিয়াছি। কথোপকথন মৌখিক রচনা মাত্র। কবিতা রচনাতেও অনেক স্থানে এ সকল নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়।
৫। ব্যাকরণ-দোষ। রচনায় ব্যাকরণের সকল নিয়মগুলি বজায় রাখিতে হইবে। ব্যাকরণের সকল নিয়মগুলি এখানে লেখা যাইতে পারে না—তাহা হইলে এইখানে একখানি ব্যাকরণের গ্রন্থ লিখিত হয়। কিন্তু উদাহরণস্বরূপ দুই একটা সাধারণ নিয়ম বুঝাইয়া দেওয়া যাইতেছে।
সন্ধি। সংস্কৃতের নিয়ম, সন্ধির যোগ্য দুইটি বর্ণ একত্রে থাকিলে সকল স্থানেই সন্ধি হইবে। কিন্তু বাঙ্গালার নিয়ম তাহা নহে, বাঙ্গালার সমাস ব্যতীত সন্ধি হয় না। যে দুইটি শব্দে সমাস হয় না, সে দুইটি শব্দে সন্ধিও হইবে না।
সহজ উদাহরণ;—“সঃ অস্তি,” সংস্কৃতে, “সোহস্তি” হইবে; কিন্তু বাঙ্গালায় “তিনি আছেন” “তিন্যাছেন” হইবে না। “অঙ্গুলি” “উত্থিত” এই দুইটি শব্দ সংস্কৃতে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, মধ্যে আর কিছু না থাকিলে, “অঙ্গুল্যুত্থিত” হইয়া যাইবে, কিন্তু বাঙ্গালায় যদি বলি, “তিনি অঙ্গুলি উত্থিত করিলেন,” সে স্থলে “তিনি অঙ্গুল্যুত্থিত করিলেন,” এরূপ কখনই লিখিতে পারিব না। কেন না এখানে সমাস নাই।
বাঙ্গালায় সন্ধির দ্বিতীয় নিয়ম এই যে, সংস্কৃতে ও অসংস্কৃতে কখন সন্ধি হইবে না। “আমার অঙ্গুলি” বলিতে হইবে, “আমারাঙ্গুলি” হয় না। সন্ধি করিতে হইলে, “মমাঙ্গুলি” বলিবে, সেও ভাল বাঙ্গালা হয় না—কেন না সমাস নাই। “মড়াহারী পক্ষী” বলা যায় না; “শবাহারী” বলিতে হইবে। “গাধাকৃত পশু” বলা যায় না ; “গর্দভাকৃত” বলিতে হইবে। সকলেই “মনান্তর” বলে, কিন্তু ইহা অশুদ্ধ। কেন না “মন” বাঙ্গালা শব্দ; সংস্কৃত মনস্, প্রথমায় মনঃ, এজন্য, “মনোদুঃখ”, “মনোরথ” শুদ্ধ।
তৃতীয় নিয়ম। যদি দুইটি শব্দ অসংস্কৃত হয়, তবে কখনই সন্ধি হইবে না। যথা, “পাকা আতা” সন্ধি হয় না।
সমাজ। সমাসেরও নিয়ম ঐরূপ ; সংস্কৃতে এবং অসংস্কৃতে সমাস হয় না। যেমন, “মহকুমাধ্যক্ষ” ; “উকীলাগ্রগণ্য” ; “মোক্তারাদি” এ সকল অশুদ্ধ। অথচ এরূপ অশুদ্ধি এখন সচরাচর দেখা যায়।
উভয় শব্দ সংস্কৃত হইলেও সমাস করা না করা লেখকের ইচ্ছাধীন। “অধরের অমৃত” বলিতে পার, অথবা “অধরামৃত” বলিতে পার। “অধরামৃত” বলিতে সমাস হইল “অধরের অমৃত” বলিলে সমাস হইল না। সন্ধি করা না করাও লেখকের ইচ্ছাধীন। কেহ লেখেন “অধরামৃত”, কেহ লেখেন “অধর অমৃত”।
বাঙ্গালায় সন্ধি সমাসের বাহুল্য ভাল নহে। সহজ রচনায় উহা যত কম হয়, তত ভাল।
প্রত্যয়। প্রত্যয় সম্বন্ধে সংস্কৃতের যে নিয়ম, বাঙ্গালা রচনায় সংস্কৃত প্রত্যয় ব্যবহারকালে সেই সকল বজায় রাখিতে হইবে। “সৌজন্যতা” “ঐক্যতা” এ সকল অশুদ্ধ। “সৌজন্য” “ঐক্য এইরূপ হইবে।
সংস্কৃত শব্দের পরে অসংস্কৃত প্রত্যয় ব্যবহার হইতে পারে না। “মূর্খামি” বলা যায় না, কেন না “মূর্খ” সংস্কৃত শব্দ, “মি” সংস্কৃত প্রত্যয় নহে ; “মূর্খতা” বলিতে হইবে। “অহম্মুখ” সংস্কৃত শব্দ ; এজন্য “আহাম্মুখি” অশুদ্ধ, “অহম্মুখতা” বলিতে হইবে।
স্ত্রীত্ব। সংস্কৃতে এই নিয়ম আছে যে, বিশেষ্য যে লিঙ্গান্ত হইবে, বিশেষণও সেই লিঙ্গান্ত হইবে। যথা, সুন্দরী বালিকা, সুন্দর বালক ; বেগবান্ নদ, বেগবতী নদী।
বাঙ্গালায় এই নিয়মের অনুবর্তী হওয়া লেখকের ইচ্ছাধীন। অনেকেই সুন্দরী বলিকা লেখেন; কিন্তু সুন্দর বালিকাও বলা যায়। বিশেষতঃ বিশেষণ বিশেষ্যের পরে থাকিলে ইহাতে কোন দোষই হয় না। যথা, “এই বালিকাটি বড় সুন্দর।” “রামের স্ত্রী বড় মুখর।” অনেক সময়ে বিশেষণ স্ত্রীলিঙ্গান্ত হইলে বড় কদর্য শুনায়। যথা, “রামের মা উত্তমা পাচিকা” এখানে “উত্তম পাচিকা” বলিতে হইবে।
বাঙ্গালা রচনায় স্ত্রীত্ব সম্বন্ধে কয়েকটি নিয়ম প্রবল ;—
১। স্ত্রীলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে পুংলিঙ্গান্ত রাখিতে পার। যেমন সুন্দর বালিকা উর্বর ভূমি। কিন্তু পুংলিঙ্গান্ত বা ক্লীবলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে কখন স্ত্রীলিঙ্গান্ত করিতে পার না। “পঞ্চমী দিবস” “মহতী কার্য” “সুবিস্তৃতা জনপদ” এ সকল অশুদ্ধ।