——————-
1পাঠক মহাশয় বৃহল্লাঙ্গুলের ন্যায়শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি দেখিয়া বিস্মিত হইবেন না। এইরূপ তর্কে মক্ষমূলর স্থির করিয়াছেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষীয়েরা লিখিতে জানিতেন না। এইরূপ তর্কে জেমস মিল স্থির করিয়াছেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষীয়েরা অসভ্য জাতি, এবং সংস্কৃত ভাষা অসভ্য ভাষা। বস্তুতঃ এই ব্যাঘ্র পণ্ডিতে এবং মনুষ্য পণ্ডিতে অধিক বৈলক্ষণ্য দেখা যায় না।
০২. ইংরাজস্তোত্র
(মহাভারত হইতে অনুবাদিত)
হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১ ||
তুমি নানাগুণে বিভূষিত, সুন্দর কান্তিবিশিষ্ট, বহুল সম্পদ্যুক্ত; অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২ ||
তুমি হর্ত্তা-শত্রুদলের; তুমি কর্ত্তা-আইনাদির; তুমি বিধাতা-চাকরি প্রভৃতির। অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৩ ||
তুমি সমরে দিব্যাস্ত্রধারী, শিকারে বল্লমধারী, বিচারাগারে অর্দ্ধ ইঞ্চি পরিমিত ব্যাসবিশিষ্ট বেত্রধারী, আহারে কাঁটা-চাম্চেধারী; অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৪ ||
তুমি একরূপে রাজপুরী মধ্যে অধিষ্ঠান করিয়া রাজ্য কর; আর একরূপে পণ্যবীথিকা মধ্যে বাণিজ্য কর; আর একরূপে কাছাড়ে চার চাষ কর; অতএব হে ত্রিমূর্ত্তে! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৫ ||
তোমার সত্ত্বগুণ তোমার প্রণীত গ্রন্থাদিতে প্রকাশ; তোমার রজোগুণ তোমার কৃত যুদ্ধাদিতে প্রকাশ; তোমার তমোগুণ তোমার প্রণীত ভারতবর্ষীয় সম্বাদপত্রাদিতে প্রকাশ।-অতএব হে ত্রিগুণাত্মক! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৬ ||
তুমি আছ, এই জন্যই তুমি সৎ! তোমার শত্রুরা রণক্ষেত্রে চিৎ; এবং তুমি উমেদারবর্গের আনন্দ; অতএব হে সচ্চিদানন্দ! তোমাকে আমি প্রণাম করি। ৭ ||
তুমি ব্রহ্মা-কেন না, তুমি প্রজাপতি; তুমি বিষ্ণু-কেন না, কমলা তোমার প্রতিই কৃপা করেন; এবং তুমি মহেশ্বর-কেন না, তোমার গৃহিণী গৌরী। অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৮ ||
তুমি ইন্দ্র, কামান তোমার বজ্র; তুমি চন্দ্র, ইন্কম টেক্স তোমার কলঙ্ক; তুমি বায়ু, রেইলওয়ে তোমার গমন; তুমি বরুণ, সমুদ্র তোমার রাজ্য; অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ৯ ||
তুমিই দিবাকর, তোমার আলোকে আমাদের অজ্ঞানান্ধকার দূর হইতেছে; তুমিই অগ্নি-কেন না, সব খাও; তুমিই যম, বিশেষ আমলাবর্গের। ১০ ||
তুমি বেদ, আর ঋক্যজুষাদি মানি না; তুমি স্মৃতি-মন্বাদি ভুলিয়া গিয়াছি; তুমি দর্শন ন্যায়, মীমাংসা প্রভৃতি তোমারই হাত। অতএব হে ইংরাজ! তোমাকে প্রণাম করি। ১১ ||
হে শ্বেতকান্ত! তোমার অমল-ধবল দ্বিরদ-রদশুভ্র মহাশ্মশ্রুশোভিত মুখমণ্ডল দেখিয়া আমার বাসনা হইয়াছে, আমি তোমার স্তব করিব; অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১২ ||
তোমার হরিতকপিশ পিঙ্গললোহিত কৃষ্ণশুভ্রাদি নানা বর্ণশোভিত, অতিযত্নরঞ্জিত, ভল্লুকমেদমার্জ্জিত কুন্তলাবলি দেখিয়া আমার বাসনা হইয়াছে, আমি তোমার স্তব করিব; অতএব হে ইংরাজ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৩ ||
তুমি কলিকালে গৌরাঙ্গাবতার, তাহার সন্দেহ নাই। হ্যাট তোমার সেই গোপবেশের চূড়া; পেণ্টুলন সেই ধড়া-আর হুইপ্ সেই মোহন মুরলী-অতএব হে গোপীবল্লভ! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৪ ||
হে বরদ! আমাকে বর দাও। আমি শামলা মাথায় বাঁধিয়া তোমার পিছু পিছু বেড়াইব-তুমি আমাকে চাকরি দাও। আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৫ ||
হে শুভঙ্কর! আমার শুভ কর। আমি তোমার খোশামোদ করিব, তোমার প্রিয় কথা কহিব, তোমার মনরাখা কাজ করিব-আমায় বড় কর, আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৬ ||
হে মানদ! আমায় টাইটল দাও, খেতাব দাও, খেলাত দাও;-আমাকে তোমার প্রসাদ দাও-আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৭ ||
হে ভক্তবৎসল! আমি তোমার পাত্রাবশেষ ভোজন করিতে ইচ্ছা করি-তোমার করস্পর্শে লোকমণ্ডলে মহামানাস্পদ হইতে বাসনা করি,-তোমার স্বহস্তলিখিত দুই একখানা পত্র বাক্সমধ্যে রাখিবার স্পর্দ্ধা করি-অতএব হে ইংরাজ! তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও; আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৮ ||
হে অন্তর্যামিন্! আমি যাহা কিছু করি, তোমাকে ভুলাইবার জন্য। তুমি দাতা বলিবে বলিয়া আমি দান করি; তুমি পরোপকারী বলিবে বলিয়া আমি পরোপকার করি, তুমি বিদ্বান্ বলিবে বলিয়া আমি লেখাপড়া করি। অতএব হে ইংরাজ! তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও। আমি তোমাকে প্রণাম করি। ১৯ ||
আমি তোমার ইচ্ছামতে ডিস্পেন্সরি করিব; তোমার প্রীত্যর্থ স্কুল করিব; তোমার আজ্ঞামত চাঁদা দিব; তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও, আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২০ ||
হে সৌম্য! যাহা তোমার অভিমত, তাহাই আমি করিব। আমি বুট পাণ্টালুন পরিব, নাকে চস্মা দিব, কাঁটা চাম্চে ধরিব, টেবিলে খাইব-তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২১ ||
হে মিষ্টভাষিন্! আমি মাতৃভাষা ত্যাগ করিয়া তোমার ভাষা কহিব; পৈতৃক ধর্ম্ম ছাড়িয়া ব্রাহ্মধর্ম্মাবলম্বন করিব; বাবু নাম ঘুচাইয়া মিষ্টর লেখাইব; তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও! আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২২ ||
হে সুভোজক! আমি ভাত ছাড়িয়াছি, পাঁউরুটি খাই; নিষিদ্ধ মাংস নহিলে আমার ভোজন হয় না; কুক্কুট আমার জলপান। অতএব হে ইংরাজ! আমাকে চরণে রাখিও, আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২৩ ||
আমি বিধবার বিবাহ দিব; কুলীনের জাতি মারিব; জাতিভেদ উঠাইয়া দিব-কেন না, তাহা হইলে তুমি আমার সুখ্যাতি করিবে। অতএব হে ইংরাজ! তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও। ২৪ ||
হে সর্ব্বদ! আমাকে ধন দাও, মান দাও, যশঃ দাও;-আমার সর্ব্ববাসনা সিদ্ধ কর। আমাকে বড় চাকরি দাও, রাজা কর, রায়বাহাদুর কর, কৌন্সিলের মেম্বর কর, আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২৫ ||
যদি তাহা না দাও, তবে আমাকে ডিনরে আট্হোমে নিমন্ত্রণ কর; বড় বড় কমিটির মেম্বর কর, সেনেটের মেম্বর কর, জুষ্টিস কর, অনরারী ম্যাজিষ্ট্রেট্ কর, আমি তোমাকে প্রণাম করি। ২৬ ||
আমার স্পীচ্ শুন, আমার এশে পড়, আমায় বাহাবা দাও,-আমি তাহা হইলে সমগ্র হিন্দুসমাজের নিন্দাও গ্রাহ্য করিব না। আমি তোমাকেই প্রণাম করি। ২৭ ||
হে ভগবন্! আমি অকিঞ্চন-আমি তোমার দ্বারে দাঁড়াইয়া থাকি, তুমি আমাকে মনে রাখিও। আমি তোমাকে ডালি পাঠাইব, তুমি আমাকে মনে রাখিও। হে ইংরাজ! আমি তোমাকে কোটি কোটি প্রণাম করি। ২৮ ||
০৩. বাবু
জনমেজয় কহিলেন, হে মহর্ষে! আপনি কহিলেন যে, কলিযুগে বাবু নামে এক প্রকার মনুষ্যেরা পৃথিবীতে আবির্ভূত হইবেন। তাঁহারা কি প্রকার মনুষ্য হইবেন এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কি কার্য্য করিবেন, তাহা শুনিতে বড় কৌতূহল জন্মিতেছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরবর! আমি সেই বিচিত্রবুদ্ধি; আহারনিদ্রাকুশলী বাবুগণকে আখ্যাত করিব, আপনি শ্রবণ করুন। আমি সেই চস্মাঅলঙ্কৃত, উদরচরিত্র, বহুভাষী, সন্দেশপ্রিয় বাবুদিগের চরিত্র কীর্ত্তিত করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন। হে রাজন্, যাঁহারা চিত্রবসনাবৃত, বেত্রহস্ত, রঞ্জিতকুন্তল, এবং মহাপাদুক, তাঁহারাই বাবু। যাঁহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষাবিরোধী, তাঁহারাই বাবু। মহারাজ! এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন বাবু জন্মিবেন যে, তাঁহারা মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ হইবেন। যাঁহাদিগের দশেন্দ্রিয় প্রকৃতিস্থ, অতএব অপরিশুদ্ধ, যাঁহাদিগের কেবল রসনেন্দ্রিয় পরজাতিনিষ্ঠীবনে পবিত্র, তাঁহারাই বাবু। যাঁহাদিগের চরণ মাংসাস্থিবিহীন শুষ্ক কাষ্ঠের ন্যায় হইলেও পলায়নে সক্ষম;-হস্ত দুর্ব্বল হইলেও লেখনীধারণে এবং বেতনগ্রহণে সুপটু;-চর্ম্ম কোমল হইলেও সাগরপারনির্ম্মিত দ্রব্যবিশেষের প্রহারসহিষ্ণু; যাঁহাদিগের ইন্দ্রিয়মাত্রেরই ঐরূপ প্রশংসা করা যাইতে পারে, তাঁহারাই বাবু। যাঁহারা বিনা উদ্দেশ্যে সঞ্চয় করিবেন, সঞ্চয়ের জন্য উপার্জ্জন করিবেন, উপার্জ্জনের জন্য বিদ্যাধ্যয়ন করিবেন, বিদ্যাধ্যয়নের জন্য প্রশ্ন চুরি করিবেন, তাঁহারাই বাবু।
মহারাজ! বাবু শব্দ নানার্থ হইবে। যাঁহারা কলিযুগে ভারতবর্ষে রাজ্যাভিষিক্ত হইয়া, ইংরাজ নামে খ্যাত হইবেন, তাঁহাদিগের নিকট “বাবু” অর্থে কেরাণী বা বাজারসরকার বুঝাইবে। নির্ধনদিগের নিকটে “বাবু” শব্দে অপেক্ষাকৃত ধনী বুঝাইবে। ভৃত্যের নিকট “বাবু” অর্থে প্রভু বুঝাইবে। এ সকল হইতে পৃথক্, কেবল বাবুজন্মনির্ব্বাহাভিলাষী কতকগুলিন মনুষ্য জন্মিবেন। আমি কেবল তাঁহাদিগেরই গুণকীর্ত্তন করিতেছি। যিনি বিপরীতার্থ করিবেন, তাঁহার এই মহাভারত শ্রবণ নিষ্ফল হইবে। তিনি গোজন্ম গ্রহণ করিয়া বাবুদিগের ভক্ষ্য হইবেন।
হে নরাধিপ! বাবুগণ দ্বিতীয় অগস্ত্যের ন্যায় সমুদ্ররূপী বরুণকে শোষণ করিবেন, স্ফাটিক পাত্র ইঁহাদিগের গণ্ডূষ। অগ্নি ইঁহাদিগের আজ্ঞাবহ হইবেন-“তামাকু” এবং “চুরুট” নামক দুইটি অভিনব খাণ্ডবকে আশ্রয় করিয়া রাত্রি দিন ইঁহাদিগের মুখে লাগিয়া থাকিবেন। ইঁহাদিগের যেমন মুখে অগ্নি, তেমন জঠরেও অগ্নি জ্বলিবেন। এবং রাত্রি তৃতীয় প্রহর পর্য্যন্ত ইঁহাদিগের রথস্থ যুগল প্রদীপে জ্বলিবেন। আলোচিত সঙ্গীতে এবং কাব্যেও অগ্নিদেব থাকিবেন। তথায় তিনি “মদন আগুন” এবং “মনাগুন” রূপে পরিণত হইবেন। বারবিলাসিনীদিগের মতে ইঁহাদিগের কপালেও অগ্নিদেব বিরাজ করিবেন। বায়ুকেই ইঁহারা ভক্ষণ করিবেন-ভদ্রতা করিয়া সেই দুর্দ্দর্ষ কার্য্যর নাম রাখিবেন, “বায়ুসেবন”। চন্দ্র ইঁহাদের গৃহে এবং গৃহের বাহিরে নিত্য বিরাজমান থাকিবেন-কদাপি অবগুণ্ঠনাবৃত। কেহ প্রথম রাত্রে কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্র, শেষ রাত্রে শুক্লপক্ষের চন্দ্র দেখিবেন, কেহ তদ্বিপরীত করিবেন। সূর্য্য ইঁহাদিগকে দেখিতে পাইবেন না। যম ইঁহাদিগকে ভুলিয়া থাকিবেন। কেবল অশ্বিনীকুমারদিগকে ইঁহারা পূজা করিবেন। অশ্বিনীকুমারদিগের মন্দিরের নাম হইবে “আস্তাবল”।
হে নরশ্রেষ্ঠ! যিনি কাব্যরসাদিতে বঞ্চিত, সঙ্গীতে দগ্ধ কোকিলাহারী, যাঁহার পাণ্ডিত্য শৈশবাভ্যস্ত গ্রন্থগত, যিনি আপনাকে অনন্তজ্ঞানী বিবেচনা করিবেন, তিনিই বাবু। যিনি কাব্যের কিছুই বুঝিবেন না, অথচ কাব্যপাঠে এবং সমালোচনায় প্রবৃত্ত, যিনি বারযোষিতের চীৎকার মাত্রকেই সঙ্গীত বিবেচনা করিবেন, যিনি আপনাকে অভ্রান্ত বলিয়া জানিবেন, তিনিই বাবু। যিনি রূপে কার্ত্তিকেয়ের কনিষ্ঠ, গুণে নির্গুণ পদার্থ, কর্ম্মে জড় ভরত, এবং বাক্যে সরস্বতী, তিনিই বাবু। যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতীপূজা করিবেন, এবং পাঁটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু। যাঁহার গমন বিচিত্র রথে, শয়ন সাধারণ গৃহে, পান দ্রাক্ষারস, এবং আহার কদলী দগ্ধ, তিনিই বাবু। যিনি মহাদেবের তুল্য মাদকপ্রিয়, ব্রহ্মার তুল্য প্রজাসিসৃক্ষু, এবং বিষ্ণুর তুল্য লীলা-পটু, তিনিই বাবু। হে কুরুকুলভূষণ! বিষ্ণুর সহিত এই বাবুদিগের বিশেষ সাদৃশ্য হইবে। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহাদের লক্ষ্মী এবং সরস্বতী উভয়ই থাকিবেন। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারাও অনন্তশয্যাশায়ী হইবেন। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহাদিগেরও দশ অবতার-যথা, কেরাণী, মাষ্টার, ব্রাহ্ম, মুৎসুদ্দী, ডাক্তার, উকিল, হাকিম, জমিদার, সম্বাদপত্রসম্পাদক এবং নিষ্কর্ম্মা। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারা সকল অবতারেই অমিতবলপরাক্রম অসুরগণকে বধ করিবেন। কেরাণী অবতারে বধ্য অসুর দপ্তরী; মাষ্টার অবতারে বধ্য ছাত্র, ষ্টেশ্যন মাষ্টার অবতারে বধ্য টিকেটহীন পথিক; ব্রাহ্মাবতারে বধ্য চালকলাপ্রত্যাশী পুরোহিত; মুৎসুদ্দী অবতারে বধ্য বণিক্ ইংরাজ; ডাক্তার অবতারে বধ্য রোগী; উকিল অবতারে বধ্য মোয়াক্কল; হাকিম অবতারে বধ্য বিচারার্থী; জমিদার অবতারে বধ্য প্রজা; সম্পাদক অবতারে বধ্য ভদ্রলোক এবং নিষ্কর্ম্মাবতারে বধ্য পুষ্করিণীর মৎস্য।
মহারাজ! পুনশ্চ শ্রবণ করুন। যাঁহার বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং কলহে সহস্র তিনিই বাবু। যাঁহার বল হস্তে একগুণ, মুখে দশগুণ, পৃষ্ঠে শতগুণ এবং কার্য্যকালে অদৃশ্য, তিনিই বাবু। যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্দ্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই বাবু। যাঁহার ইষ্টদেবতা ইংরাজ, গুরু ব্রাহ্মধর্ম্মবেত্তা, বেদ দেশী সম্বাদপত্র এবং তীর্থ “ন্যাশনাল থিয়েটার,” তিনিই বাবু। যিনি মিসনরির নিকট খ্রীষ্টিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু, এবং ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক, তিনিই বাবু। যিনি নিজগৃহে জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান, এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু। যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু। যাঁহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল গৃহিণী বা উপগৃহিণীতে, এবং রাগ কেবল সদ্গ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহে তিনিই বাবু।
হে নরনাথ! আমি যাঁহাদিগের কথা বলিলাম, তাঁহাদিগের মনে মনে বিশ্বাস জন্মিবে যে, আমরা তাম্বূল চর্ব্বণ করিয়া উপাধান অবলম্বন করিয়া দ্বৈভাষিকী কথা কহিয়া, এবং তামাকু সেবন করিয়া ভারতবর্ষের পুনরুদ্ধার করিব।
জনমেজয় কহিলেন, হে মুনিপুঙ্গব! বাবুদিগের জয় হউক, আপনি অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন।
০৪. গর্দ্দভ
হে গর্দ্দভ! আমার প্রদত্ত, এই নবীন সকল ভোজন করুন।১ |
আমি বহুযত্নে, গোবৎসাদির অগম্য প্রান্তর সকল হইতে, নবজলকণানিষেকসুরভি তৃণাগ্রভাগ সকল আহরণ করিয়া আনিয়াছি, আপনি সুন্দর বদনমণ্ডলে গ্রহণ করিয়া, মুক্তানিন্দিত দন্তে ছেদনপূর্ব্বক আমার প্রতি কৃপাবান্ হউন।
হে মহাভাগ! আপনার পূজা করিব ইচ্ছা হইয়াছে; কেন না, আপনাকেই সর্ব্বত্র দেখিতে পাই। অতএব হে বিশ্বব্যাপিন্! আমার পূজা গ্রহণ করুন।
আমি পূজ্য ব্যক্তির অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া, নানা দেশে নানাস্থানে পরিভ্রমণ করিয়া দেখিলাম, আপনি সর্ব্বত্রই বসিয়া আছেন, সকলেই আপনার পূজা করিতেছে। অতএব হে দীর্ঘকর্ণ! আমারও পূজা গ্রহণ করুন।
হে গর্দ্দভ! কে বলে তোমার পদগুলি ক্ষুদ্র। যেখানে সেখানে তোমারই বড় পদ দেখিয়া থাকি। তুমি উচ্চাসনে বসিয়া, স্তাবকগণে পরিবৃত হইয়া, মোটা মোটা ঘাসের আঁটি খাইয়া থাক। লোকে তোমার শ্রবণেন্দ্রিয়ের প্রশংসা করে।
তুমিই বিচারাসনে উপবেশন করিয়া, মহাকর্ণদ্বয় ইতস্ততঃ সঞ্চালন করিতেছ। তাহার অগাধ গহ্বর দেখিতে পাইয়া, উকীল নামক কবিগণ নানাবিধ কাব্যরস তন্মধ্যে ঢালিয়া দিতেছে। তখন তুমি শ্রবণতৃপ্তিসুখে অভিভূত হইয়া নিদ্রা গিয়া থাক।
হে বৃহন্মুণ্ড! তখন সেই কাব্যরসে আর্দ্রীভূত হইয়া, তুমি দয়াময় হইয়া, অসীম দয়ার প্রভাবে রামের সর্ব্বস্ব শ্যামকে দাও, শ্যামের সর্ব্বস্ব কানাইকে দাও; তোমার দয়ার পার নাই।
হে রজকগৃহভূষণ! কখনও দেখিয়াছি, তুমি লাঙ্গুল সঙ্গোপনপূর্ব্বক কাষ্ঠাসনে উপবেশন করিয়া, সরস্বতীমণ্ডপমধ্যে বঙ্গীয় বালকগণকে গর্দ্দভলোক প্রাপ্তির উপায় বলিয়া দিতেছ। বালকেরা গর্দ্দভলোকে প্রবেশ করিলে, “প্রবেশিকায় উত্তীর্ণ হইল” বলিয়া, মহা গর্জ্জন করিয়া থাক। শুনিয়া আমরা ভয় পাই।
হে প্রকাণ্ডোদর! তুমিই চতুষ্পাঠীমধ্যে কুশাসনে উপবেশন করিয়া, তৈলনিষিক্ত ললাটপ্রান্তরে চন্দনে নদী অঙ্কিত করিয়া, তুলটহস্তে শোভা পাও। তোমার কৃত শাস্ত্রের ব্যাখ্যা শুনিয়া আমরা ধন্য ধন্য করিতেছি। অতএব হে মহাপশো! আমার প্রদত্ত কোমল তৃণাঙ্কুর ভোজন কর।
তোমারই প্রতি লক্ষ্মীর কৃপা-তুমি নহিলে আর কাহারও প্রতি কমলার দয়া হয় না। তিনি তোমাকে কখনও ত্যাগ করেন না, কিন্তু তুমি তাঁহাকে বুদ্ধির গুণে সর্ব্বদাই ত্যাগ করিয়া থাক। এই জন্যই লক্ষ্মীর চাঞ্চল্য কলঙ্ক। অতএব হে সুপুচ্ছ! তৃণ ভোজন কর।
তুমিই গায়ক। ষড়্জ, ঋষভ, গান্ধার প্রভৃতি সপ্ত সুরই তোমার কণ্ঠে। অন্যে বহুকাল তোমার অনুকরণ করিয়া, দীর্ঘ শ্মশ্রু রাখিয়া, অনেক প্রকার কাশি অভ্যাস করিয়া, তোমার মত স্বর পাইয়া থাকে। হে ভৈরবকণ্ঠ! ঘাস খাও।
তুমি বহুকাল হইতে পৃথিবীতলে বিচরণ করিতেছ। তুমিই রামায়ণে রাজা দশরথ, নহিলে রাম বনে যাইবে কেন? তুমি মহাভারতে পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির, নহিলে পাণ্ডব পাশায় স্ত্রী হারিবে কেন? তুমি কলিযুগে বঙ্গদেশে বৃদ্ধ সেনরাজা ছিলে,-নহিলে বঙ্গদেশে মুসলমান কেন?
তুমি নানা রূপে, নানা দেশ আলো করিয়া যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছ। এক্ষণে তপস্যাবলে, ব্রহ্মার বরে তুমি বঙ্গদেশে সমালোচক হইয়া অবতীর্ণ হইয়াছ। হে লোমশাবতার! আমার সমাহৃত কোমল নবীন তৃণাঙ্কুর সকল ভক্ষণ কর, আমি আহ্লাদিত হইব।
হে মহাপৃষ্ঠ! তুমি কখন রাজ্যের ভার বহ, কখন পুস্তকের ভার বহ, কখন ধোবার গাঁটরি বহ। হে লোমশ! কোন্টি গুরুভার, আমায় বলিয়া দাও।
তুমি কখন ঘাস খাও, তখন ঠেঙ্গা খাও; কখন গ্রন্থকারের মাথা খাও; হে লোমশ! কোন্টি সুভক্ষ্য, অর্ব্বার্চ্চীনকে বলিয়া দাও।
হে সুন্দর! তোমার রূপ দেখিয়া আমি মোহিত হইয়াছি। তুমি যখন গাছতলায় দাঁড়াইয়া, নববর্ষাসারসিক্ত হইতে থাক, দুই মহাকর্ণ ঊর্দ্ধোত্থিত করিয়া মুখচন্দ্র বিনত করিয়া চক্ষু দুটি ক্ষণে মুদিত, ক্ষণে উন্মেষিত করিতে করিতে ভিজিতে থাক,-তোমার পৃষ্ঠে, মুণ্ডে এবং স্কন্ধে বসুধারা বহিতে থাকে-তখন তোমাকে আমি বড় সুন্দর দেখি। হে লোকমনোমোহন! কিছু ঘাস খাও।
বিধাতা তোমায় তেজ দেন নাই, এজন্য তুমি শান্ত, বেগ দেন নাই, এজন্য সুধীর, বুদ্ধি দেন নাই, এজন্য তুমি বিদ্বান্; এবং মোট না বহিলে খাইতে পাও না, এজন্য তুমি পরোপকারী। আমি তোমার যশোগান করিতেছি; ঘাস খাইয়া সুখী কর।
০৫. দাম্পত্য দণ্ডবিধির আইন
আমরা স্ত্রীজাতি, নিরীহ ভালমানুষ বলিয়া আজি কালি আমাদিগের উপর বড় অত্যাচার হইতেছে। পুরুষের এক্ষণে বড় স্পর্দ্ধা হইয়াছে, ভর্ত্তৃগণ স্ত্রীকে আর মানে না, স্ত্রীলোকদিগের পুরাতন স্বত্ব লুপ্ত হইতেছে, কেহই আর স্ত্রীর আজ্ঞার বশবর্ত্তী নহে। এই সকল বিষয়ের সুনিয়ম করিবার জন্য আমরা স্ত্রীস্বত্বরক্ষিণী সভা সংস্থাপিত করিয়াছি। সে সভার পরিচয় যদি সাধারণে সবিশেষ অবগত না থাকেন, তবে তাহার বিজ্ঞাপনী পশ্চাৎ প্রকাশ করিব। এক্ষণে বক্তব্য এই যে, আমাদিগের স্বত্বরক্ষার্থ সভা হইতে একটি বিশেষ সদুপায় হইয়াছে। আমরা এ বিষয়ে ভারতবর্ষীয় গবর্ণমেন্টে আবেদনপত্র প্রেরণ করিয়াছি। এবং তৎসমভিব্যাহারে ভর্ত্তৃশাসনার্থ একটি দাম্পত্য দণ্ডবিধির আইনের পাণ্ডুলিপি প্রেরণ করিয়াছি।
সকলের স্বত্ব রক্ষার্থ যেখানে প্রত্যহ আইনের সৃষ্টি হইতেছে, সেখানে আমাদিগের চিরন্তন স্বত্ব রক্ষার্থ কোন আইন হয় না কেন? অতএব এই আইন সত্বরে পাস হইবে, এই কামনায় স্বামিগণকে অবগত করিবার জন্য আমি তাহা বঙ্গদর্শনে প্রচার করিলাম। অনেক বাবুলোক বাঙ্গালাতে আইন ভাল বুঝিতে পারেন না, বিশেষতঃ আইনের বাঙ্গালা অনুবাদ সচরাচর ভাল হয় না, এবং আইন আদৌ ইংরাজিতেই প্রণীত হইয়াছিল, এবং ইহার বাঙ্গালা অনুবাদটি ভাল হয় নাই, স্থানে স্থানে ইংরাজির সঙ্গে ইহার প্রভেদ আছে, অতএব আমরা ইংরাজি বাঙ্গালা দুই পাঠালাম। ভরসা করি, বঙ্গদর্শনকারক একবার আমাদিগের অনুরোধে ইংরাজির প্রতি বিরাগ ত্যাগ করিয়া ইংরাজিসমেত এই আইন প্রচার করিবেন। সকলেই দেখিবেন যে, এই আইনটিতে নূতন কিছু নাই; সাবেক Lex non scripta কেবল লিপিবদ্ধ হইয়াছে মাত্র।