গৃহে প্রবেশ করেই এক অপূর্ব দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে। আমরা দেখতে পাই যে, বিদেশী বস্তু আমাদের গৃহ আক্রমণ করেছে, এবং তার অন্তরতম প্রদেশ পর্যন্ত অধিকার করে বসে আছে। সাহেবিয়ানার খাতিরে আমাদের গৃহসজ্জা অসম্ভবরকম জটিল হয়ে পড়েছে। আসবাবের ভিড় ঠেলে ঘরে ঢোকাই মুশকিল, চলে-ফিরে বেড়াবার স্বাধীনতা তো একেবারেই নেই। এই জটিলতার মধ্যে সকলকেই কুটিল গতি অবলম্বন করতে হয়। প্রথমেই মনে হয় যে, এ ঘর বাসের জন্য নয়, ব্যবহারের জন্য নয়—সাজাবার জন্য, দেখাবার জন্য, গহস্বামীর ধন এবং শিক্ষার পরিচয় দেবার একটা প্রদর্শনী মাত্র, লক্ষ্মী-সরস্বতীর মিলনের অপ্রশস্ত ক্ষেত্র। আমাদের নূতন ধরনের গৃহসজ্জার বর্ণনা করবার কোনো দরকার নেই, কারণ তা সকলেরই নিকট সুপরিচিত। চেয়ার টেবিল কোচ টিপয় পিয়ানো আয়না, ছিটের পরদা, ব্রাসেলসের কারপেট, চীনের পুতুল, ওলিয়োগ্রাফের ছবি-এই আমাদের নূতন সভ্যতার উপকরণ এবং নিদর্শন। গৃহস্থের অবস্থা অনুসারে এই-সকল উপকরণ হয় লাজারস এবং অসল্যর, নয় বৌবাজারের বিক্রিওয়ালার দোকান হতে সংগ্রহ করা হয়। যিনি ধনী, তাঁর গৃহ হঠাৎ দেখতে দোকান বলে ভুল হয়। আর যিনি লক্ষ্মীর কৃপায় বঞ্চিত, তাঁর গৃহ হঠাৎ দেখতে যুদ্ধক্ষেত্রের হাঁসপাতাল বলে ভ্রম হয়; আসবাবপত্র সব যেন লড়াই থেকে ফিরে এসে, হয় মেরামত, নয় দেহত্যাগের জন্য অপেক্ষা করছে। কোনো চৌকির হাত নেই, কোনো টিপয়ের পা নেই, কোনো টেবিলের পক্ষাঘাত হয়েছে; পরদার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে গেছে, কৌচের নাড়িভুড়ি নিগত হয়ে পড়েছে, চীনের পুতুলের ধড় আছে কিন্তু মণ্ড নেই, পারিস পালেস্তারার ভিনাসের নাসিকা লণ্ড, ওলিয়োগ্রাফ-সুন্দরীর মুখে মেচেতা পড়েছে, আয়নার গা দিয়ে পারা ফটে বেরিয়েছে, পিয়ানো দন্তহীন এবং হারমোনিয়ম বাসরোগগ্রস্ত। এ অবস্থাতেও আমরা এই-সকল অব্যবহার্য দর্য আবর্জনা দূর করে তার পরিবর্তে ফরাশ বিছিয়ে বসি না কেন?–কারণ ইংরেজের কাছে আমরা শিখেছি যে দৈন্য পাপ নয়, কিন্তু স্বদেশীয়তা অসভ্যতা।
আমাদের এই নবসভ্যতার আজবঘরে স্বর্গীয় পিতামহগুণ যদি দৈবাৎ এসে উপস্থিত হন, তা হলে নিঃসন্দেহ সব দেখেশুনে তাঁদের চক্ষুশির হয়ে যাবে। অবাক হয়ে তারা ঊর্ধ্বনেত্রে চেয়ে থাকবেন, নির্বাক হয়ে আমরাও অধোবদনে বসে থাকব। উভয় পক্ষে কোনো বোঝা-পড়া হওয়া অসম্ভব। অপরিচিত অশন-বসন আসন-ভূষণের ভিতরে কিরূপে জাতি রক্ষা হয়, তা তারা বুঝতে পারবেন না; কৈফিয়ত চাইলে আমাদের মধ্যে যাঁর কিছু বলবার আছে তিনি সম্ভবত এই উত্তর দেবেন যে, ‘জাতি শব্দের অর্থ আপনাদের নিকট সংকীর্ণ ছিল, আমাদের নিকট তা প্রশস্ততর হয়েছে; রক্ষা অর্থে আপনারা বুঝতেন শুধু স্থিতি, আমরা বুঝি উন্নতি; আপনাদের গর, ছিল মন, আমাদের গর, হার্বাট স্পেনসার; আমাদের নূতন চাল আপনাদের হিসাবে জাতিরক্ষার প্রতিকল, কিন্তু আমাদের হিসাবে অনুকূল।’ এ কথা যদি সত্য, যদি বিজ্ঞানসম্মত হয়, তা হলে আমার আপত্তির কোনো কারণ নেই; কেননা যে প্রথা অবলম্বন করলে ব্রাহ্মণ-শদ্রের, এমন-কি, হিন্দুমসলমানের মধ্যে আচার-ব্যবহারের চিরবিরোধ থেকে যাবে, আমার পক্ষে সে প্রথার পক্ষপাতী হওয়া অসম্ভব। যে সামাজিক শাসন জাতীয় জীবনের প্রসারতা লাভের বিরোধী, আমি তার সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু আমাদের সমাজকে যে ইউরোপের পশ্চাধাবন করতেই হবে তার কোনো প্রমাণ নেই। গতিমাত্রেরই একটি স্বতন্ত্র প্রধানভূমি আছে, একটি দিক নির্দিষ্ট আছে, যা তার পূর্বাবস্থার দ্বারা নিয়মিত। উন্নতির অর্থ আকাশে ওড়া নয়। কোন দেশে জন্মগ্রহণ করি সেটা যেমন আমাদের ইচ্ছাধীন নয়, তেমনি কোন সমাজে জন্মগ্রহণ করি সেও আমাদের ইচ্ছাধীন নয়। পরিবর্তন যেমন কালসাপেক্ষ, পরিবর্ধন তেমনি দেশ ও পাত্র -সাপেক্ষ। আমাদের প্রত্যেকেরই দেহ ও মনের মূলে পূর্বপুরুষরা বিরাজ করছেন, এবং আমাদের জাতীয় সভ্যতা অর্থাৎ সামাজিকতার মূলে পূর্বে পরিষদের সমাজ বিরাজ করছে। বংশপরম্পরা হেরিডিটি হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো উন্নতি অসম্ভব। যে গহে পূর্বপুরুষদের স্থান হয় না, সে গহে ভোগবিলাসের চরিতার্থতা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু মানব জীবনের সার্থকতা লাভ হয় না। স্মৃতি যেমন প্রতি মানবের অহংজ্ঞানের মূলপূর্বাপরের যোগসূত্র-বরূপ স্মৃতির অস্তিত্ব না থাকলে, আত্মোন্নতি দূরে থাকুক, কেহই আত্মার সন্ধানও পেতেন না—তেমনি অতীতের স্মৃতি জাতীয় অহংজ্ঞানেরও মূল। অতীতের জ্ঞানশূন্য হয়ে কোনো জাতি জাতীয় আত্মার সন্ধান পায় না, জাতীয় আত্মোন্নতি দূরে থাকুক। সামাজিক জীবের পক্ষে অতীতের প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয় হচ্ছে পিতা-পিতামহ ইত্যাদি, এবং ক্ষেত্র হচ্ছে বাস্তু। সেই বাস্তুজ্ঞানরহিত হলে আমাদের বস্তুজ্ঞানশূন্য হওয়া সহজ হয়ে পড়ে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তর্ক তুলে ইশবগ-নামক খেটে-খাওয়াদূলের লোককে বিরক্ত করবার কোনো সার্থকতা নেই। এরা বিজ্ঞানের দোহাই দেন আলোচনা বন্ধ করবার জন্য, আরম্ভ করবার জন্য নয়। হার্বাট স্পেনসার এদের গর, কিন্তু শিক্ষাগর, নন, দীক্ষাগুর। ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিকদের কাছে এরা কিছুই শিক্ষালাভ করেন নি, শুধু দুটি-একটি বীজমল গ্রহণ করেছেন, যথা সভ্যতা উন্নতি ইত্যাদি। অন্যান্য তান্ত্রিকদের মতো এই তান্ত্রিকদেরও নিকটে বীজমন্ত্র যত দুবোধ, সম্ভবত যত অপশন্য, তত তার মাহাত্ম। ইউরোপীয় সভ্যতা এরা জ্ঞানের দ্বারা পেতে চান না, ভক্তির দ্বারা পেতে চান। দাস্যভাব-সখ্যভাবের চর্চাই এরা মুক্তির একমাত্র উপায় স্থির করেছেন। আমরা এদের যে অবস্থাটাকে দুর্দশা বলে মনে করি, সেটি শুধু ইউরোপভক্তির দশা মাত্র।