সাহেবিয়ানার প্রচণ্ড নেশায় বঙ্গসন্তানকে যে কতদূর বে-এক্তিয়ার করে ফেলতে পারে, তার প্রমাণ ধর্মতলার রঙ্গমন্দিরে ধর্মমন্দিরের প্রতিষ্ঠাথে করণ যাচাল বিদেশীয় পণ্ঠপোষকতায় ব্লো Tablcaux হ্বিভা Vivants অভিধেয় বিচিত্র চিত্র-অভিনয়। নেশা ধরা পড়ে দুই জিনিসে অবিক্ষেপে এবং বাক্যবিপর্যয়ে। এ ব্যাপারে দুই লক্ষণেরই সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। ঐ দশ-কাব্যের পিছনে একটি দর্শন আছে, একটি কবিত্ব আছে; সেই কবিত্বপর্ণ দর্শন কিংবা দার্শনিক কবিত্বের প্রকাশ নিউ ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে। উক্ত ব্যাপারের সপক্ষে নিউ ইন্ডিয়ার মতামত, ইন্ডিয়া না হোক নিউ বটে। জস্টিস অনকল মোজির জীবনীর ভাষা যেমন নতুন, এর ভাবও তেমনি নতুন; এবং উভয় রচনাই এক উপায়ে সিদ্ধ হয়েছে। ইংরেজি ফরাসি লাটিন গ্রীক এবং ইটালিয়ান নানা ছোটো-বড়ো বাছা-বাছা বাক্য ও পদের অসংগত সমাবেশে মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের জীবনীলেখকের রচনা ভাষার রাজ্যে যেমন এক অপূর্ব কীর্তি, জীবতত্ত্ব সমাজতত্ত্ব ইতিহাস পরাণ ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি সকল শাস্যের ছোটো-বড়ো নানা বাছা-বাছা শব্দ এবং বাক্যের অসংগত সমাবেশে সম্পাদক মহাশয়ের রচনা চিতার রাজ্যে তেমনি এক অপরকীর্তি। লেখক কিছুই বাদ দেন নি-চিত্রকলাও নয়, নত্যকলাও নয়। কলাবিদ্যার কতকটা জ্ঞান অনেকটা চার উপর নির্ভর করে, কিন্তু অসমসাহসী লেখকের পক্ষে ঠিক তার উলটো। দাম্ভিকতার বলে অজ্ঞতা বিজ্ঞতার সিংহাসনে অধিরোহণ করতে পারে। কলাবিদ্যার শুধু শেষাংশ দেখাবার চেষ্টা করে অনেকে, তাঁরা যে শুধু তার প্রথমাংশ জানেন, এই প্রমাণ করেন। এ বিশ্ব ভগবানের লীলাখেলা হতে পারে, কিন্তু সমাজের সৃষ্টি স্থিতি এবং উন্নতি মানুষের লীলাখেলার ফল নয়। এই প্রবধে উক্ত ব্যাপারের অবতারণা করবার একটু বিশেষ সার্থকতা আছে। আমাদের নকল সভ্যতা এর উধে আর উঠতে পারে না। আমাদের দোলের ঐ শেষসীমা, পেণ্ডুলমকে ঐখান হতেই ফিরতে হবে, এবং কার্যত ফিরতে আরম্ভ করেছে। ঘরে বিদেশী অনাচারের ঠেলা এবং বাইরে বিদেশী অত্যাচারের চাপ, এই দুয়ের ভিতর পড়ে যাঁরা কিঞ্চিৎ বেদনা অনুভব করছিলেন, তাঁদের অনেকেরই আজ চৈতন্য হয়েছে। ঐ ঘটনায় আমাদের মধ্যে অনেক অন্যমনস্ক লোকেরও মনে পড়ে গেছে যে, আমাদের একটা সমাজ ব’লে কোনো জিনিস নেই। আমরা ঝরাপাতার দল, হাওয়ায় আমাদের কখনো-বা একত্র জড় করে, কখনো-বা ছড়িয়ে দেয়। গাছের অসংখ্য পাতা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র হলেও তাদের সকলের ভিতর নাড়ির এবং রক্তের বন্ধন আছে; তাদের একের প্রাণের মূলও যেখানে, অপরের প্রাণের মূলও সেখানে দেশের মাটিতে। কিন্তু আজ আমাদের অনেকেরই চোখ ফটেছে। আমরা নিজের নিজের সংকীর্ণ সমাজ ত্যাগ করলেও হিন্দুসমাজ আমাদের ত্যাগ করে নি। আমরা নিজেরা শুধু সেই বহৎ সমাজের মধ্যে আর-একটি সংকীর্ণ সমাজ গড়তে চেষ্টা করেছিলুম, সৌভাগ্যক্রমে তাতে কৃতকার্য হই নি। আজকাল ভারতবাসীর দেহে নতুন প্রাণ এসেছে; হিন্দুসমাজ একটি সবহৎ স্বদেশী সমাজে পরিণত হচ্ছে, জাতের ভাব দূর হয়ে জাতীয় ভাব উপস্থিত হয়েছে, আমরা পরস্পরের পার্থক্য ভুলে গিয়ে স্বদেশীর সঙ্গে বিদেশীর পার্থক্য অনুভব করতে আরম্ভ করেছি। এ অবস্থায় আমাদের স্বদেশীয়তায় ফেরার অর্থ আমরা যে বরাবর স্বদেশ ও জাতির অন্তর্ভুত হয়েই আছি, সেই বিষয়ে পণ্টজ্ঞান জন্মাননা। আমরা যে-সমাজে ফিরছি, সে-সমাজ পূর্বে ছিল না, আজও পর্ণাবয়বপ্রাপ্ত হয় নি, ভবিষ্যতে তার রূপ যে কি হবে, তাও আমরা আজ ঠিক ধরতে পারি নে। তার স্বরূপ জানবারও কোনো আবশ্যক নেই; শুধু এই জানি যে, আমাদের জাতির মূলশতি উদবোধিত হয়েছে। সেই শক্তি আমাদের সকলেরই প্রাণে জাগরুক হয়ে উঠেছে, যে শক্তির কার্য হচ্ছে আমাদের সমগ্র জাতির অপরূপ শ্ৰী এবং উন্নতি সাধন করা। জড়পদার্থ নিয়ে একটা কিছু গড়তে হলে আগে হতেই একটা প্ল্যান এবং এসটিমেট করতে হয়; কিন্তু প্রাণ নিজের আকৃতি নিজে গড়ে নেয়, বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপও ক্রমে পষ্ট হয়ে আসে। প্রকৃতি যে ফুল ফোঁটাবে, মানুষ তার সাহায্য করতে পারে কিংবা বাধা দিতে পারে, কিন্তু তাতে স্বকপোলকপিত বর্ণ গন্ধ আকার এনে দিতে পারে না। কাগজের ফুল রচনায় আমাদের যে স্বাধীনতা আছে, গাছের ফল ভালো করে ফোঁটানোতে সে স্বাধীনতা নেই। আমাদের স্বদেশী সমাজের অক্ষয়-বটে নতুন পাতা দেখা দিয়েছে, আমাদের কর্তব্য এখন তার গোঁড়ায় প্রচুর সার এবং জল জোগাননা, আর চার পাশের জঞ্জাল ও জঙ্গল দূর করা। আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক-সকল স্বদেশী সমাজ অবলম্বন করেও আমাদের স্বাতন্য রক্ষা করব, কিন্তু সে তার শাখাপ্রশাখা হয়ে, পরগাছা হয়ে নয়। সুতরাং আমরা স্বদেশে যাতে বিদেশী না হই, সে বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। আমাদের তন মন ধন দেশের পায়ে বিকতে হবে, বিদেশের পায়ে নয়। আমাদের এই ধারণাটকু জন্মানো উচিত যে, আমাদের কেউ নিজের শক্তি বিক্ষিপ্ত করে ফেলবার অধিকারী নন; সকলের শক্তি একত্র করে, সংহত করে, স্বদেশের জাতির উন্নতির কার্যে প্রয়োগ করতে হবে। অল্প হোক, বিস্তর হোক, আমাদের প্রত্যেকের আত্মশক্তি যাতে ব্যর্থ না হয়, যাতে তা সামাজিক গতির সহায়ভূত হয়, তার জন্য প্রথমত দিকনির্ণয় করা দরকার। তার পর, কোথায় কি উপায়ে নিজশক্তি প্রয়োগ করতে পারি, তার হিসাব জানতে হবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার বক্তব্য দেখতে পাচ্ছি ক্ৰমে ফলাও এবং গুরতর হয়ে আসছে। এই স্থানেই সুতরাং আমাকে মনের রাশ টেনে ধরতে হবে। এ প্রবন্ধে আমার কতকগুলো সাদাসিধে ছোটোখাটো দৈনিক আচার-ব্যবহারের আলোচনা করবার অভিপ্রায় আছে। কিন্তু হঠাৎ দেখছি ধান ভানতে শিবের গীত শর করে দিয়েছি। এখন ভূমিকা ছেড়ে জমিতে নামাই আমার পক্ষে কর্তব্য। আয়একটি কথা বলেই আমি প্রকৃত প্রস্তাব আরম্ভ করব। সে কথাটি হচ্ছে এই, ভারতবর্ষের লন্ত সভ্যতা উদ্ধার করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়; আজকের দিনে নিজের দেশে আপনার ভিতর যে নতুন সভ্যতার বীজের সন্ধান পেয়েছি, তাকেই পত্র-পল্পফল-মণ্ডিত মহাবকে পরিণত করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। স্বদেশের জ্ঞান লাভ করতে গিয়ে ঘ-কালের জ্ঞান যেন না হারাই। আমাদের নূতন সভ্যতা যে পেই ধারণ করুক-না কেন, মাটির গুণে তাকে স্বদেশী হতেই হবে। জীবনীশক্তির ক্ষতি পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই হয়। বীজ থেকে বক্ষ একটা ধারাবাহিক পরিবর্তনের সমষ্টি মাত্র। আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজ, ভূত সমাজও হবে না, অদ্ভুত সমাজও হবে না। ইংরেজিয়ানার মোহে আমরা অতত্বের চর্চা করছিলুম, কিন্তু ভূতে না পেলে যে অদ্ভুতত্ব বর্জন করা যায় না, এমন নয়। আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের জাতির ভিতর প্রাণ আছে। বর্তমান অশান্তি শুধু নতুন জীবনের চাঞ্চল্য, মত্যর অব্যবহিতপব বিকারের ছটফটানি নয়। যে সমাজে প্রাণ আছে, সে সমাজে প্রাণের যে প্রধান লক্ষণ-বাইরের অবস্থার উপযোগী আত্মপরিবর্তন সে লক্ষণ প্রচুর পরিমাণে দেখা যাবে। এ জগৎ গম, ধাতু হতে উৎপন্ন, এমন গুণী আমরা কেউ নই যে জগতের ধাত বদলে দিতে পারি। স্বদেশীভাবের মূল হতে অনেক আশার ফল ফটবে, কিন্তু ফল ধরবে না। দেশের মাটি ভালোবাসি বলে যে, মাটি নিতে হবে, মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে, শেষটা মাটি হতে হবে, এ ভুল যেন কেউ না করেন। আমরা আজ যখন জীবনের পথে অগ্রসর হতে চলেছি, তখন এইটে মনে রাখতে হবে যে, দেশের মাটি আমাদের পদক্ষেপের পক্ষে ভগবান দত্ত অটল নির্ভর। অতীতের যে আগুন নিবেছে, যার এখন ভস্মমাত্র অবশিষ্ট আছে তাতে অতি ভক্তিভরে বাতাস দিলেও শুধু ছাই উড়িয়ে সমাজের চোখে ফেলব। কিন্তু আমাদের জাতির প্রাণে যেখানে আজও আগুন আছে, সেখানেই ফ; দিতে হবে, পাখা করতে হবে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, কোথায় শুধু ছাই আর কোথায় ছাই-ঢাকা আগন আছে কি করে জানব? তার উত্তর, যদি পশু করে আগন না চিনতে পারতো পাঁজি-পথির সাহায্যে তা পারবে না। অতঃপর ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, আমাদের এগোতে হবে। বড়োগোছের একটা লাফ মারবার পরে মান কিঞ্চিৎ পিছ, হটে পাল্লা নেয়; আমাদের সমাজ এখন পাল্লা নিচ্ছে। সরীসপের মতো সমাজও ক্রমাগত দেহকে আকুঞ্চন-প্রসারণ করে অগ্রসর হয়। কি উপায়ে কতদূর পর্যন্ত আমাদের সামাজিক দেহের আজ আকুঞ্চন করা কর্তব্য, সেই সম্বন্ধে গোটাকতক কথা বলতে উদ্যত হয়েছি।