পাণ্ডু কবে মারা গেলেন তারও কোনো নির্দিষ্ট সময় জানা যায় না। হিমালয় শৃঙ্গ থেকে কয়েকজন মুনি কুন্তীদের পৌঁছে দিতে এসেছিলেন, তারা কোনো আতিথেয়তা গ্রহণ না করেই সংক্ষেপে দু’চারটা কথা বলে চলে গেলেন। তারা পাণ্ডু ও মাদ্রীর সতেরো দিনের মৃতদেহ বহন করে এনেছিলেন। সেখানে তারা জলও স্পর্শ করলেন না।
কুন্তী বললেন, জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির ধর্মের পুত্র, মধ্যম ভীম পবনপুত্র, কনিষ্ঠ অৰ্জুন ইন্দ্ৰপুত্র আর নকুল সহদেব অশ্বিনীকুমারের যমজ সন্তান। স্বামী ব্যতীত আরো তিনটি প্রার্থিত পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়ে কুন্তী এই তিনটির জন্ম দিয়েছেন এবং সূর্যের অঙ্কশায়িনী হয়ে কুমারী অবস্থায় জন্ম দিয়েছিলেন কর্ণকে। এই রহস্যজনক পাঁচটি জটবন্ধলধারী কিশোরকে নিয়ে কুন্তী যখন হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছলেন, এবং নানাজনে নানা কথা বলতে শুরু করলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেলো সেই সমালোচনার উপর যবনিকা নেমে এসেছে। সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে, সব নিন্দা অগ্রাহ্য করে, ঐ পাঁচটি বালককে রাজবাটী থেকেই পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজপুত্র ঘোষণা করে, রাজবাড়ির শিক্ষাদীক্ষা বিষয়ে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা যে গুরুর কাছে যে পাঠ নিচ্ছে এই পাঁচটি বালককেও যেন সেই শিক্ষাদীক্ষার পাঠ সেই গুরুর কাছেই দেওয়া হয়, এ হুকুমটি জারি করা হলো। এর পরে এই পঞ্চভ্রাতা কুরুবংশেরই বংশধর হিশেবে গণ্য হয়ে রাজবাড়ির শিক্ষাদীক্ষা সহবতের অন্তর্গত হলো। হস্তিনাপুরবাসীরা জানলো পাণ্ডুর এই ক্ষেত্ৰজ পুত্ররা তাদেরই পুত্র মিত্র শিষ্য সুহৃদ ও ভ্রাতা স্বরূপ। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রও জানলেন তাদের যেন তিনি পুত্রজ্ঞানেই গ্রহণ করেন।
এখন কথা হচ্ছে এতো অল্প সময়ের মধ্যে এই সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত এমন সহজে নেওয়া কার দ্বারা সম্ভব হলো? কাজটা যিনিই করুন, যিনিই বলুন, সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে সকলের মুখ বন্ধ করার মুখ্য ব্যক্তিটি কে? রচয়িতা সে নামটি ঘোষণা করেননি। না করলেও এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না, যার ইচ্ছেতে দ্বিধাহীনভাবে দ্বৈপায়ন এসে এই প্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন, তার হুকুমই তামিল করলেন ভীষ্ম। সত্যবতী তখন রানীপদবাচ্য না থাকলেও, সমস্ত আদেশ নির্দেশ তিনিই দিয়ে থাকেন। কর্মচারীরা সেটা পালন করে। তার মধ্যে প্রধান ব্যক্তি ভীষ্ম। দ্বৈপায়ন সত্যবতীর নাম উল্লেখ না করলেও, হুকুমটা ঐ বড় তরফ থেকেই যে এসেছে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। যুধিষ্ঠির যে বিদুরের পুত্র সে খবরটা নিশ্চয়ই তিনি জেনেছিলেন। তিনি প্রচ্ছন্নই রইলেন, সকলে এটা ভীমের আদেশ বলেই মেনে নিলো। ভীষ্ম যা বলেন সেটাই সকলে নিদ্বিধায় মেনে নিতে অভ্যস্ত। এ কথাও তারা জানেন, সত্যবতীর অমত থাকলে, এবং তিনি গ্রহণযোগ্য মনে না করলে, ভীষ্মও সেটা বলবেন না। সুতরাং সেই বাক্যকেই ধ্রুব বাক্য হিশেবে গ্রহণ করে মুহুর্তে নিঃশব্দ হয়ে গেলো সন্দেহের ফিশফিশানি।
কিন্তু সকলের মন থেকেই যে সেটা মুছে গেলো সেটা ঠিক নয়। বিশেষভাবে কুন্তী যখন বললেন, দুর্যোধনের বয়স পনেরো, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের বয়স ষোলো। সুতরাং এই কুলে পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ হিশেবে যুধিষ্ঠিরই জ্যেষ্ঠ। তখন কিন্তু অনেকেই এই আকস্মিক ঘটনাকে সন্দেহের উৰ্দ্ধে ঠাঁই দিতে পারলেন না। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, বিদুরের বুদ্ধিকেই সর্বাধিক বলে গণ্য করেন, সুতরাং এ ব্যাপারে বিদুরের মতামতই তার মতামত। তদুপরি সত্যবতী এবং ভীষ্ম যা মেনে নিয়েছেন তার উপরে আর কারো কোনো মতামতের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু স্বাধীনচিত্ত দুৰ্যোধন, মাতৃস্নেহ বঞ্চিত দুর্যোধন, ভীমের আদর্শে গঠিত যুবরাজ দুৰ্যোধন, অবশ্যই এই স্বীকৃতিকে সুনজরে দেখলেন না। এই পাঁচটি পুত্রের ব্যবহারে তাদের মধ্যে কুরুকুলোচিত এক বিন্দু সংস্কৃতি আছে বলে মনে হয়নি তাঁর। কুন্তীকে তিনি এই প্রথম দেখলেন। বিদুরের ব্যাপারটাই সব চাইতে বেশি আশ্চর্য করলো তাঁকে। তিনি কুন্তীকে নিয়ে যেমন ব্যস্ত, পুত্রদের নিয়ে ততোধিক। দুর্যোধনকে বিদুর কোনোদিনই সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু এই ছেলেদের বেলায় তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। দুর্যোধন ভেবে পেলেন না, এতো স্নেহ এই মনুষ্যটির হৃদয়ে এতোদিন কোথায় লুক্কায়িত ছিলো! একজন মানুষের কী করে এরকম দুই চেহারা হতে পারে। তিনি কুন্তীকে যে ভাবে সদাসুখী রাখতে ব্যস্ত, সেই ব্যস্ততা যাকে নিয়ত দেখেন সেই ভ্রাতৃবধূ গান্ধারীর প্রতি কখনো দেখা যায়নি, এমনকি এতো ঘনিষ্ঠতা নিজ স্ত্রীর সঙ্গেও দেখা যায় না।
কুন্তী বলেছেন, যুধিষ্ঠিরের বয়স ষোলো। তার প্রমাণ কী? তদ্ব্যতীত, এই ছেলেদের পাণ্ডুর মৃত্যুর পরে কেন কুরুকুলের পুত্র মিত্র ভ্রাতা বলে প্রকাশ করা হলো? এতোগুলো বছর কাটলো, তখন কেন জানা গেলো না পাণ্ডু একজন দুজন নয়, পাঁচ পাঁচটি ক্ষেত্ৰজ পুত্রের পিতা হয়েছেন! তবে কি পাণ্ডুর মৃত্যু না হলে ক্ষেত্ৰজ বলা সম্ভব ছিলো না?
এতোগুলো সম্ভাব্য অসম্ভাব্য চিন্তাকে বিন্দুবৎ গ্রাহ্য না করে, এবং পরিবারের নিয়মকে উপেক্ষা করে, কিছুই না জেনে, না শুনে সত্যবতীর এই আপাত তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত বিস্ময়কর। এর মধ্য দিয়ে তার চরিত্রের কঠিন কত্রীত্ব আবারও উদঘাটিত সত্যবতী এখন যে শুধু রানী নন তা-ই নয়, রাজমাতাও নন। বলা যায়, সাধারণ নিয়ম অনুসারে কেউ নন। স্বামীর মৃত্যুর পরে তখনকার মহিলাদের বানপ্রস্থ নেওয়াই ধর্ম ছিলো। তা তিনি নেননি। এই না-নেওয়ার মধ্যেও তার লক্ষ্যপূরণের ইঙ্গিত আছে। আসলে কিছুই তিনি পরোয়া করেন না। তার মনের পর্দা এই সব ক্ষুদ্র নিন্দাপ্রশংসার অনেক উপরে বাধা। তার ইচ্ছে তার, তার ধর্ম তার, তার সিদ্ধান্তও তারই। স্বকীয়তায় তিনি অনন্যা। কোনো কোনো মানুষ এই ধরনের ব্যক্তিত্ব নিয়ে জন্মায়। তাছাড়া, সত্যবতী তথাকথিত বড়ো বংশের কন্যা নন, সেটাই তার আশীৰ্বাদ। লজ্জা, সংকোচ, কুষ্ঠার বিলাস এই সুন্দরী, কৃষ্ণকায়া, খেটে-খাওয়া নিষাদকন্যার থাকাটাই অস্বাভাবিক।