শিশুর ক্রন্দন কর্কশ অথবা কোমল এই নালিশ কিন্তু পরিবারের আর কারো কাছে শোনা গেলো না, কেবলমাত্র বিদুরই শিশুকে তৎক্ষণাৎ নিহত করবার জন্য অতিরিক্ত অস্থির বোধ করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, কিন্তু বধির নন। তিনি শুনেছেন বলে মনে হলো না। না হােক, বিদুর তো শুনেছেন, সেটাই সত্য। যারা শুনেছেন এমন দু’চারজন লোকও তিনি বাইরে থেকে সংগ্ৰহ করে নিয়ে এলেন। কিন্ত খুব বেশি পেলেন না। সত্যবতীর নিকট থেকেও খবরটা আনতে পারলেন না। অথচ এমন মনে হতে লাগলো বিদুর কোনো দৈববাণী শুনেছেন যে এই শিশুকে ধ্বংস না করলে এই মুহুর্তে সারা জগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। ধৃতরাষ্ট্র সম্ভবত তখনো ততোটা সম্মোহিত হননি যে বিদুরের এই নির্দেশ স্বেচ্ছায় মান্য করবেন। অথবা, হাজার হোক শিশুটি তার প্রথম পুত্র, এবং অতি কামনার ধন, সুতরাং এই একটি স্থানে তিনি তাঁর পিতৃত্বকে কলঙ্কিত করতে পারলেন না। এবং বিদুরের এমন নৃশংস হয়ে ওঠার কারণটা ঠিক কী আমরাও বুঝে উঠতে পারলাম না। বোঝা গেল তার অনেক পরে।
সেই সময়ে কুন্তীও গর্ভবতী ছিলেন। সেই পুত্রের নামই যুধিষ্ঠির যুধিষ্ঠিরের জন্ম তখনো হয়নি বলেই বিদুর দুৰ্যোধনকে হত্যা করবার জন্য এত অস্থির ছিলেন। মহাভারতে এ কথা স্পষ্ট করে বলা না হলেও একের পর এক ঘটনা আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে এই পুত্র বিদুরের ঔরসেই কুন্তীর গর্ভজাত পুত্র। সেই পুত্র যদি এখনো না জন্মে থাকে, তাহলে জ্যেষ্ঠ হিশেবে তার সিংহাসন প্রাপ্তির আশা দুরাশা মাত্র। তদ্ব্যতীত, সেই পুত্র কেবলমাত্র জ্যেষ্ঠ হলেই তো হবে না, তাঁকে পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ হিশাবে প্রমাণ করার দায়ও আছে। যে কারণে দ্বৈপায়নের পুত্র হয়েও তিনি রাজা হতে পারেননি, সেই একই কারণ তো তার পুত্রের উপরও বর্ষিত হবে। ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু যেহেতু বিচিত্রবীর্যের পত্নীদের গর্ভজাত, সেজন্য তাঁরা প্রতিবন্ধী হয়েও রাজা হলেন, আর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ পুত্র হয়েও কোনো দাবিদাওয়ার অধিকারী হলেন না। অথচ অজ্ঞান বয়স থেকে তাঁকে রাজপুত্রদের সঙ্গে একইভাবে ভীষ্ম মানুষ করে তুলেছেন। সবাই এক পিতার সন্তান হলেও বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্ৰজ নন বলেই দাসীপুত্রের পরিচয় তার মিটলো না। ঈর্ষার দংশন তাঁকে দগ্ধ করলো। দ্বৈপায়নের উৎপাদিত বিষবৃক্ষের অঙ্কুরটি তখন বৃক্ষ হয়ে উঠতে আর বেশি দেরি করলো না।
ধৃতরাষ্ট্র শত পুত্রের পিতা হলেন, কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয়টিই ছিলো কুরুকুলের প্রধান চরিত্র। এখানেও একটা লক্ষ করবার বিষয় আছে। প্রথম পুত্রটির নাম হলো দুর্যোধন, দ্বিতীয়টির দুঃশাসন। কেউ কারো সন্তানের নাম কি দুর্যোধন বা দুঃশাসন রাখতে পারে? বিশেষত যারা আকাঙ্ক্ষার সন্তান এবং যুবরাজ? পরবর্তী জীবনে হয়তো কেউ দুর্জন হতে পারে, কিন্তু জন্মানো মাত্রই তো সেটা প্রকট হওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব অসম্ভবের প্রশ্নই থাকে না এ ব্যাপারে। যা থাকে তার নাম ইচ্ছে। সেজন্য নামকরণে সর্বদাই দু’র পরিবর্তে ‘সু’ থাকে। এবার দুর্যোধনকে যদি আমরা সূৰ্যধন ভাবি, আর দুঃশাসনকে সুশাসন, সেটাই স্বাভাবিক মনে হয় না? ‘সু’টাকে ‘দু’ বলে প্রচার বিদুরের দ্বারাই সাধিত হয়েছে। তবে ‘সু’ ই হোক বা ‘দু’ ই হোক, বিদুরকে হতাশ করে দুৰ্যোধন শশিকলার ন্যায় বৃদ্ধি পেতে লাগলেন, দেশেরও কোনো ক্ষতি হলো না। তার শ্যামল দেহে চন্দ্রবংশীয় রক্ত না থাকলেও পিতামহী অম্বিকার কারণে কিছুটা অন্তত ক্ষত্রিয় রক্ত প্রবাহমান ছিলো। তদুপরি, আবাল্য গঙ্গাপুত্র দেবব্রতর শিক্ষায় থেকে রাজোচিত নিয়ম কানুনের সঙ্গে তাঁর সম্যক পরিচয় ঘটেছিল। বিদ্যায় বুদ্ধিতে অস্ত্রচালনায় যথার্থই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। সাহস স্বাস্থ্য বিচার বিবেচনা ব্যবহার সমস্ত দিক থেকে তিনি ভবিষ্যৎ রাজার প্রতীক হিশেবে অতি উপযুক্ত ছিলেন। তাঁকে সেই হিশেবেই গণ্য করে সমগ্র দেশবাসী অতি উল্লসিত হয়েছিলো। সর্বসম্মতিক্রমে দুর্যোধনের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হবার প্রস্তুতিপর্ব যখন সমাপ্তির পথে, এই সময়েই হঠাৎ কুন্তী এতোকাল বাদে পাঁচটি জটবন্ধলধারী পুত্র সমভিব্যাহারে হস্তিনাপুরে এসে উপস্থিত হলেন। জানা গেলো, জটবন্ধলধারী ওই কিশোররা পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ পুত্ৰ! তিনটি কুন্তীর গর্ভজাত, দুটি মাদ্রীর গর্ভজাত। জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের বয়স ষোলো, মধ্যম ভীমের বয়স পনেরো, কনিষ্ঠ অৰ্জুন চোদ্দো। এই তিনজন তাঁর, মানে কুন্তীর, অন্য দুজন, নকুল সহদেবের বয়স তেরো, ওরা মাদ্রীর যমজ পুত্র।
পাণ্ডুর সঙ্গে কুন্তীর কুলপ্রথা অনুযায়ী বিবাহ হয়নি। কুরুবংশের নিয়ম অনুসারে মাল্যদানের পরে কন্যাকে স্বগৃহে নিয়ে এসে অনুষ্ঠান করতে হয়। কুন্তী নিজেই স্বয়ংবর সভায় পাণ্ডুর গলায় মাল্যদান করেছিলেন। পরে শান্তনুনন্দন ভীষ্ম প্রথামতো মদ্রকন্যা মাদ্রীকে নিয়ে এসে পাণ্ডুকে দ্বিতীয়বার বিবাহ দেন। সন্তান জন্ম দেবার ক্ষমতা ছিলো না পাণ্ডুর। সেই দুঃখে কবে তিনি চলে গেছেন ধৃতরাষ্ট্রের হস্তে সমস্ত সম্পত্তি সমর্পণ করে তার ঠিক নেই। এতো কাল বাদে পাঁচটি কিশোরকে দেখে এবং পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ শুনে যেমন নগরবাসীরা বিস্মিত হলো, তেমনি পরিবারের আর সকলেও কম বিস্মিত হলো না। প্রথমে ভাবলো, এঁরা কারা? তারপর পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ পুত্র শুনে ভাবলো এতো বড় বড় সব ছেলে, কিন্তু এদের কথা এতো দিনের মধ্যেও তারা ঘুণাক্ষরেও জানলো না কেন? জানতে হলো তার মৃত্যুর পরে? নগরবাসীরা বলতে লাগলো, পাণ্ডু তো অনেকদিন পূর্বেই মারা গেছেন, তার কোনো পুত্র আছে বলে তো শুনিনি। তবে এঁরা কী করে কুরুবংশের হবে? সাক্ষী কে? পাণ্ডুও মৃত, মাদ্রীও মৃত।