ধৃষ্টদ্যুমের গৃহ থেকে বহির্গত হতেই শিবিরের প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা জাগরিত হয়ে অশ্বথামাকে পরিবেষ্টন করলেন। দ্রোণপুত্র তাদের রুদ্রাস্ত্র দিয়ে নিপাতিত করে অনতিদূরে নিদ্রিত উত্তমৌজাকে দেখে তাঁকেও পদদ্বয়ের শক্তিতে কণ্ঠ ও বক্ষঃস্থল আক্রমণ করে শমনসদনে পাঠালেন। মোটকথা, অশ্বথামা শিবিরে নিদ্রামগ্ন মহা মহা যোদ্ধৃগণকে নিধন করে, রুধিরাক্ত দেহে কালান্তকের চেহারা নিয়ে, সাক্ষাৎ যমের মতো দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ও শিখৰ্ত্তীসহ আরো অনেক মহারথকে নিধন করে, পাণ্ডবশিবির প্রায় শূন্য করে অপসৃত হলেন। দ্রোণপুত্রের রক্তমাখা ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে কেউ ভাবলে ভূত, কেউ ভাবলো রাক্ষস। কেউ যুদ্ধ করতে চেষ্টা করে বিফল হলো, কেউ পালিয়ে গেলো। কিন্তু কেউ তাঁকে চিনতে পারলো না। কিছু করতেও পারলো না। কৃতবৰ্মা ও কৃপাচার্যও দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে থেকে বহু পলায়ন-তৎপর রক্ষীকে নিধন করলেন। তারপর তারাই শিবিরের তিন স্থানে অগ্নিপ্রদান করলেন। অগ্নি প্রজ্বলিত হওয়াতে শিবির আলোকময় হয়ে উঠলো। সেই আলোতে অশ্বত্থামা তরবারি হাতে নিয়ে বিচরণ করতে লাগলেন এবং যারা তাঁর দিকে আসছিলো আর যারা ভয়ে পলায়ন করছিলো সকলকেই বিনাশ করলেন।
দ্রোণপুত্র এইভাবে অর্ধরাত্রির মধ্যেই পাণ্ডবদিগের সমুদয় সৈন্য শমনসদনে প্রেরণ করলেন। কুরুক্ষেত্রের মতো সেখানেও মৃতদেহের স্তৃপ জমে উঠলো। শিবিরের সব ঘুমন্ত মানুষ পুনরায় চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হলেন। অশ্ব গজ প্রভৃতি সেইসঙ্গে মৃত্যুর স্তুপে পরিণত হয়ে একটা ভীষণ আকৃতি নিলো। অতঃপর কৃতবৰ্মা, কৃপাচার্য ও অশ্বথামা তিনজন আনন্দে করতালি প্রদানপূর্বক হর্ষধ্বনি করতে আরম্ভ করলেন। আনন্দের আতিশয্যে তিনজনেই তিনজনকে আলিঙ্গন করে অতি দ্রুত কুরুরাজ দুর্যোধনের নিকটে এলেন।
এসে দেখলেন তখনো তিনি জীবিত আছেন, কিন্তু দেহের দুর্জয় যন্ত্রণায় প্রায় সংজ্ঞাহীন। এই অবস্থা দেখে তিনজনেই অতি শোকাকুল হয়ে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করে তাঁকে স্পর্শ করলেন। দুর্যোধন অতি কষ্টে চক্ষু উল্মীলিত করে তাকালেন তাদের দিকে। কুরুরাজকে তাকাতে দেখে তারা দুর্বিষহ দুঃখে অশ্রুসম্বরণ করতে পারলেন না। নিজেদের হস্তদ্বারা দুৰ্যোধনের মুখ থেকে রক্তধারা মুছিয়ে দিলেন। অশ্বথামা কুরুরাজকে সম্বোধন করে বিলাপ ও পরিতাপ করে বললেন, “হে মহারাজ! তোমাকে সবাই ধনুর্ধরাগ্রগণ্য বলে নির্দেশ করতো। বলরাম তোমার গুরু ও যুদ্ধে সর্বগ্রগণ্য। দুরাত্মা ভীম কীভাবে তোমার এমন দশা ঘটালো? সেই পাপাত্মা ছলপূর্বক তোমাকে ধরাশায়ী করেছে। ধর্মযুদ্ধে আহবান করে যারা এই ধরনের কটযুদ্ধে পরাস্ত করে তাদের নরকে ঠাঁই হয়। তদুপরি, সে তোমার মস্তকে পা রেখেছে, আর যুধিষ্ঠির বসে বসে তা দেখেছেন। যুধিষ্ঠিরকে ধিক্কার দেবার ভাষা নেই। হে মহারাজ! তুমি কখনো অন্যায় যুদ্ধ করেনি, তুমি সর্বদা সৎ থেকেছো, মহর্ষিগণ ক্ষত্রিয়দের যা প্রশস্ত গতি বলে কীর্তন করেছেন, তুমি সেই গতিই লাভ করবে। কৃষ্ণ ও অর্জুনকে ধিক। এঁরা আবার নিজেদের ধাৰ্মিক বলে প্রচার করে। দ্রোণপুত্র এইসব বলে পরিতাপ করতে লাগলেন। তারা তাদের এমন প্রিয় রাজাকে নিজেদের শক্তি দিয়ে রক্ষা করতে পারলেন না বিধেয় রোদন করতে লাগলেন। অবশেষে বললেন, ‘হে রাজন! আপনার শ্রুতিসুখকর কিছু সংবাদ জ্ঞাপন করি। দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, ধৃষ্টদ্যুমের পুত্রসহ ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং অবশিষ্ট সকলকেই আমরা পশুর ন্যায়
সংহার ও পাণ্ডবগণের সমুদয় বাহন, সৈন্য ও পুত্রগণকে বিনাশ করে এর প্রতিশোধ নিয়েছি।‘
দুৰ্যোধন দ্রোণপুত্রের এই সমাচার শুনে প্রীত হয়ে বললেন, ‘পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ এবং কর্ণ যা পারেননি, তোমরা তা পেরেছো। দুই বাহু বাড়িয়ে দিলেন তিনজনের দিকে, গভীরভাবে আলিঙ্গন করলেন। বললেন, ‘তোমাদের মঙ্গল হোক। পুনরায় স্বর্গে দেখা হবে।’ এই বলে প্রাণত্যাগ করলেন।
দুৰ্যোধনের মৃত্যুতে নায়িকা সত্যবতীর সমস্ত সংকল্প পূর্ণ হলো। আর এক ফোটা রক্তও রইলো না যা তাঁর নিজের রক্ত নয়। যারা রইলেন তাদের একজন সত্যবতীর অবৈধ পুত্র অনার্য কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, কৃষ্ণদ্বৈপায়নের অবৈধ পুত্র বিদুর, আর বিদুরের অবৈধ পুত্র যুধিষ্ঠির যে যুধিষ্ঠিরকে শান্তনুর সিংহাসন অধিকার করাবার বাসনায় তাঁর পিতা বিদুর এবং পিতামহ দ্বৈপায়নের এতো কাণ্ড, সেই যুধিষ্ঠির ঠিকই সেখানে অধিরূঢ় হলেন। কিন্তু কাকে শাসন করবেন, প্রজা কোথায়?
কর্ণকে যখন কৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘তুমি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সেবা করেছো, ধর্মশাস্ত্রের সূক্ষ্ম তত্ত্ব সকল শিখেছো, তুমি ধর্মানুসারে পাণ্ডুরই পুত্র। অতএব তুমি রাজা হও তোমার পিতৃপক্ষীয় পাণ্ডবগণ এবং মাতৃপক্ষীয় বৃষ্ণিগণ, দুই পক্ষকেই তোমার সহায় বলে জেনো। তুমি আজ আমার সঙ্গে চলো, পাণ্ডবরা জানুক যে তুমি যুধিষ্ঠিরের অগ্রজ। তোমার পাঁচ ভ্রাতা, এবং দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, এবং অভিমুন্য, তোমার চরণ ধারণ করবেন। দ্রৌপদীও ষষ্ঠকালে তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন। আমরা তোমাকে পৃথিবীর রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করবো। কুন্তীপুত্র, তুমি ভ্রাতৃগণে বেষ্টিত হয়ে রাজ্যশাসন করো। পাণ্ডব ভ্রাতাদের সঙ্গে তোমার সৌহার্দ্য হোক। কর্ণ জবাব দিয়েছিলেন, গোবিন্দ! সমস্ত পৃথিবী এবং রাশি রাশি সুবর্ণ পেলেও আমি আমার পুরোনো সম্বন্ধ কক্ষনো অস্বীকার করতে পারি না। তারপর আরো অন্যান্য কথার শেষে বলেছিলেন, ‘আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি, তুমি যেন এক রক্তাক্ত পৃথিবীকে হাতে ধরে নিক্ষেপ করছে আর সেই অগ্নিস্তুপের উপর উঠে দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠির সুবর্ণপাত্রে ঘৃত পায়স ভক্ষণ করছেন।‘