এই অন্যায় যুদ্ধ দেখে বলরাম অত্যন্ত ক্রোধাবিষ্ট হলেন। হাত তুলে ভীষণ আর্তনাদ পরিত্যাগ ও ভীমসেনকে বারংবার ধিক্কার দিয়ে বললেন, ‘ধর্মযুদ্ধে নাভির অধঃস্থলে গদাঘাত করা নিতান্ত অন্যায় হয়েছে। গদাযুদ্ধে ভীম যেরকম কুকার্যের অনুষ্ঠান করলো, এরকম আর কখনো দৃষ্টিগোচর হয়নি। নাভির নিচে কদাচ গদাঘাত করবে না, এটা শাস্ত্রের নিয়ম ও স্থির সিদ্ধান্ত। কিন্তু মহামূর্খ বৃকোদর শাস্ত্রসম্মত ব্যবহার অতিক্রম করে স্বেচ্ছাচারে প্রবৃত্ত হয়েছে। বলতে বলতে ক্রোধে একান্ত অধীর হয়ে লাঙল উদ্যত করে মহাবেগে ভীমের দিকে ধাবমান হলেন। অনেক কষ্টে বাসুদেব তাঁকে শান্ত করলেন।
হলধর বললেন, সাধু লোকেরাই ধর্মের অনুষ্ঠান করে থাকেন, কিন্তু সেই ধর্ম, অর্থ ও কাম দ্বারা নষ্ট হয়। অতএব, যে ব্যক্তি ধর্ম অর্থ ও কামের প্রতি সমদৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে কালযাপন করতে পারে, সে-ই যথার্থ সুখভোগে সমর্থ হয়। হে হৃষিকেশ! এখন তুমি যতো চেষ্টাই করো না কেন, ভীম যে অধৰ্মাচরণ করেছে, তা আমার মন থেকে কখনোই দূর করতে সমর্থ হবে না। ভীম ধর্মপরায়ণ দুর্যোধনকে অধৰ্মানুসারে বিনষ্ট করেছে, এই কুট যোদ্ধাকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না। আর ন্যায়যুদ্ধ করার জন্য দুৰ্যোধন শাশ্বত স্বৰ্গ লাভ করবেন।’ এই বলে নিতান্ত অসন্তুষ্ট চিত্তে তিনি চলে গেলেন সেখান থেকে।
অতঃপর কৃষ্ণ যখন দুর্যোধনের বিরুদ্ধে অনেক কটুবাক্য প্রয়োগ করছিলেন, তখন দুৰ্যোধন কৃষ্ণের মুখে ঐ ধরনের বাক্য শুনে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলেন। বললেন, ‘হে কংসদাসতনয়! অর্জুন তোমারই নির্দেশে ভীমকে আমার উরুভঙ্গ করতে ইঙ্গিত করেছিলো। হে নির্লজ্জ! প্রতিদিন তোমার কূট উপায় দ্বারাই যুদ্ধে প্রবৃত্ত সহস্ৰ সহস্ৰ নৃপতি নিহত হয়েছেন। তুমি শিখণ্ডীকে অগ্রসর করে পিতামহকে নিপাতিত করেছো। যুধিষ্ঠির তোমারই প্ররোচনায় মিথ্যা বলে আচার্যকে অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করিয়েছিলো আর সেই অবসরে দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন তোমারই সমক্ষে আচার্যকে নিহত করেছে। কর্ণ অৰ্জুনের বিনাশার্থ বহুদিন অতি যত্ন করে যে শক্তি রেখেছিলেন, তুমি তোমার কৌটিল্যের দ্বারা সেই শক্তি ঘটােৎকচের উপর নিক্ষেপ করিয়ে ব্যর্থ করেছো। সাত্যকি তোমারই প্ররোচনায় ছিন্নহস্ত প্রায়োপবিষ্ট ভূরিশ্রবাকে নিহত করেছে। মহাবীর কর্ণ অৰ্জুন বধে সমুদ্যত হলে তুমি নিজে তাঁর সর্পবাণ ব্যর্থ করেছো। কিন্তু তোমার প্রতিজ্ঞা ছিলো তুমি যুদ্ধ করবে না। তদ্ব্যতীত, একজনের সঙ্গে দুজনের যুদ্ধও অধর্ম। তারপর কী-ভাবে তাঁকে মারলে রথ থেকে নেমে সে মাটিতে বসে যাওয়া রথের চাকাটা যখন তুলছিলো এবং বলেছিলো আমি এখুনি চাকাটা তুলে রথে উঠছি, তোমরা যেন আমাকে সেই নিরস্ত্র অবস্থায় মেরে অধৰ্ম করো না, সেটা ধর্মের বা যুদ্ধের রীতি নয়, তুমি তক্ষুনি অর্জুনকে বললে, ওকে রথে ওঠার সময় দিয়ো না, এই অবস্থাতেই নিহত করো। তোমার কি লজ্জাও হয় না। অনার্য। আজ তুমি আমাকে কীভাবে ভীমকে দিয়ে অন্যায় আঘাতে নিপাতিত করালে।’
এসব শুনতে শুনতে পাণ্ডবগণ ও অন্যরা নিজেদের অধৰ্মাচরণ স্মরণ করে বিষন্ন হলেন। কৃষ্ণ বললেন, হে পাণ্ডবগণ রাজা দুৰ্যোধন অসাধারণ সমরবিশারদ এবং ক্ষিপ্ৰহস্ত। তোমরা কোনোভাবেই তাঁকে ধর্মযুদ্ধে পরাজিত করতে সমর্থ হতে না। তোমাদের হিতের জন্যই আমি এই উপায় উদ্ভাবন করেছি। আর যে সব মহারথীকে কৌশলে নিহত করা হয়েছে, ধর্মযুদ্ধ করলে কি তোমরা কখনো তাদের জয় করতে পারতে? সেজন্যই ছলের প্রয়োজনে ছিলো।’
অতঃপর আস্তে আস্তে সকলেই সেখান থেকে চলে গেলেন।
তারা চলে গেলে সঞ্জয় এলেন। তাঁকে দেখে দুর্যোধন বললেন, ‘হে সঞ্জয়! আমার পিতামাতা যুদ্ধধর্ম বিলক্ষণ অবগত আছেন। তুমি তাদের বলো, আমি বিবিধ যাগযজ্ঞানুষ্ঠান, ভৃত্য প্রতিপালন, ধর্মানুসারে সসাগরাবসুন্ধরা শাসন, যাচকদিগকে অর্থদান, অধ্যয়ন ও মিত্ৰগণের প্রিয়কার্য সাধন করেছি। সৌভাগ্যবশত, স্বধর্মনিরত ক্ষত্রিয়গণ যেরূপ মৃত্যু অভিলাষ করে, আমি সেভাবেই মৃত্যুর সাক্ষাৎ পেয়েছি। হে সঞ্জয়! তুমি আমার বাক্যানুসারে অশ্বথামা, কৃতবৰ্মা ও কৃপাচার্যকে বলবে, “পাণ্ডবেরা নিয়ম ব্যতিক্রম ও সতত অধৰ্মানুষ্ঠান করে থাকে, অতএব তোমরা যেন তাদের বিশ্বাস করো না’।”
এদিকে হতাবশিষ্ট অশ্বথামা, কৃপাচার্য ও কৃতবৰ্মা দূতদিগের কাছে জানতে পারলেন দুৰ্যোধনের উরুভঙ্গ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অতি দ্রুতগামী রথে চলে এলেন সেখানে। দুর্যোধনের অবস্থা দেখে বাষ্পাকুল নয়নে বাকশূন্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাঁদের অতি প্রিয় রাজা আজ রুধিরাক্ত কলেবরে সহসা নিপতিত সূর্যমণ্ডলের ন্যায়, পরিশুষ্ক সাগরের ন্যায়, পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় ভূতলে শায়িত। শোকে দুঃখে তাঁরা অভিভূত হলেন।
দ্রোণপুত্র অশ্বথামা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ক্ৰন্দনরত কষ্ঠে বললেন, ‘হয়, তুমি পৃথিবী শাসন করতে, আজ তুমি এই নির্জন অরণ্যে এভাবে অবস্থান করছো? কৃতান্তের গতি দুজ্ঞেয় হে মহারাজ! তোমার এ অবস্থা আমি সহ্য করতে পারছি না। তুমি সর্বলোকের মাননীয়, সকলের প্রিয় ইন্দ্র তুল্য বিভবশালী হয়েও এই অবস্থা প্রাপ্ত হলে।’
অশ্বথামার কথা শুনে দুর্যোধন দুই হাতে চোখের জল মুছে বললেন, ‘হে বীরগণ! তোমরা তো জানো, কালক্রমে সর্বভূতেরই বিনাশ হয়। ভাগ্যক্রমে, আমি কোনো বিপদেই সমরে পরাজুখ হইনি; পাপাত্মারা ছলপূর্বক আমার এই অবস্থা ঘটিয়েছে। এই ভালো হলো, এখন আমি সমরক্ষেত্রে জ্ঞাতি ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নিহত হলাম। আর আজ যে তোমাদের এই ভীষণ জনক্ষয়ের মধ্য থেকে বিমুক্ত দেখছি সেটা আমার পরম সৌভাগ্য!” দুর্যোধনের চোখের জলে কথা থেমে গেল।