কৃষ্ণের কথা শুনে ভীম বললেন, ‘যদুনন্দন! তুমি বিষন্ন হয়ে না। আমি নিশ্চয়ই দুর্যোধনকে বিনাশ করবো।‘
একথা শুনে কৃষ্ণ আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘হে বীর যুধিষ্ঠির তোমার বাহুবলেই আজ অরতিবিহীন হয়ে রাজলক্ষ্মী লাভ করতে চলেছেন। এখন তুমি দুর্যোধনকেও নিপাতিত করে, বিষ্ণু যেমন দেবরাজকে স্বৰ্গরাজ্য প্রদান করেছিলেন তুমিও ধর্মরাজকে সেইরূপ পৃথিবী প্রদান করে।’
ভীমসেনকে তারপর সবাই খুব প্রশংসা করতে লাগলেন।
ভীমসেন বললেন, ‘ঐ পুরুষাধম কখনোই আমাকে পরাজিত করতে পারবে না। আজ গদার আঘাতে ঐ পাপাত্মার প্রাণসংহার পূর্বক দুর্যোধনের প্রতি হৃদয়নিহিত ক্রোধানল নিক্ষেপ করবো। এই বলে ভীম গদা উত্তোলন করে দাঁড়ালেন।
দুৰ্যোধনও উত্তম মাতঙ্গ যেমন মত্ত মাতঙ্গ প্রতি ধাবমান হয়, সেভাবে ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হলেন। নির্ভয়শরীরে অসংকোচিতচিত্তে সমরক্ষেত্র অবলোকন করতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘বাগাড়ম্বর করবার প্রয়োজন নেই। অবিলম্বে আমার সঙ্গে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। আমি সিক্ত দেহ তাতেই শুষ্ক করে নেবো। শোনো, ন্যায়ানুসারে গদাযুদ্ধে সুররাজ পুরন্দরও আমাকে পরাজিত করতে সক্ষম নন। কিন্তু বাসুদেবের পরামর্শে অন্যায়যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে না। সেটা ব্রাত্যের ধর্ম হতে পারে, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম নয়।’
বীরদ্বয়ের ভীষণ গদাযুদ্ধ আরম্ভ হলে পাণ্ডবগণ সকলেই উপবেশন করলেন। ঐ সময়ে বলরামও শিষ্যদ্বয়ের সংগ্রাম বৃত্তান্ত অবগত হয়ে সেখানে এলেন। তাঁকে দেখে সকলেই খুব প্রীত হলেন। তিনি তাঁর শিষ্যদ্বয়ের যুদ্ধ দেখতে বসলেন। বলরাম কৃষ্ণকে বলেছিলেন, ‘তুমি কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করো, কিন্তু কৃষ্ণ সেকথা না শুনে পাণ্ডবপক্ষে গেলেন। তখন বলরাম রোষপরবশ হয়ে, কারো পক্ষ অবলম্বন না করে, তীর্থযাত্রায় নির্গত হয়েছিলেন। প্রত্যাবর্তনের পথে শিষ্যদ্বয়ের গদাযুদ্ধের সংবাদ পেয়ে এখানে এসেছেন। সকলেই তাঁকে যার যার সম্পর্ক অনুযায়ী আলিঙ্গন অভিবাদন নমস্কার পূর্বক স্বাগত ও কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। রাজা দুৰ্যোধন আর ভীমও এসে অতিপ্রীতমনে নমস্কার পূর্বক স্বাগত ও কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। অনন্তর, তিনিও অতি প্রীতমনে গদাযুদ্ধ নিরীক্ষণ করবার জন্য উপবেশিত হলেন।
ভীম চিৎকার করে দুৰ্যোধনকে নানা বাক্যশল্যে বিদ্ধ করছিলেন। দুৰ্যোধন বললেন, কেন বৃথা বাগজাল বিস্তার করছো, অদ্য অবশ্যই তোমার যুদ্ধ করার ঔৎসুক্য অপনোদন করবো। দুৰ্যোধন সামান্য ব্যক্তির মতো তৎসদৃশ লোকের কথায় ভীত হবার পাত্র নয়। আমার বহুদিনের বাসনা তোমার সঙ্গে গদাযুদ্ধ করবো। আজ দৈব অনুকূল। এখন বৃথা বাক্য ব্যয় না করে অচিরাৎ কার্যে সেটা পরিণত করো।” বলেই মহাবেগে ভীমের দিকে ধাবমান হলেন।
অনন্তর পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণপূর্বক জিগীষাপরবশ হয়ে তুমুল যুদ্ধে ব্যাপৃত হয়ে রণস্থলে ঘোরতর শব্দ সমুখিত করলেন। গদা নিষ্পেষণে হুতাশনস্ফুলিঙ্গ বিদ্যুতের মতো চমকাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে দুজনে শ্রমকাতর হয়ে মুহুর্তকাল বিশ্রাম করে, পুনরায় যুদ্ধ শুরু করলেন। সেই বীরদ্বয়ের যুদ্ধ দেখে সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হলেন এবং কার যে জয়লাভ হবে স্থির করতে পারলেন না। দুই যোদ্ধাই দুজনকে বিবিধ কৌশল দেখিয়ে সময় সুযোগমতো আঘাত করতে লাগলেন।
একসময়ে অর্জুন দুই যোদ্ধার এই ঘোরতর যুদ্ধ দেখতে দেখতে কৌতুহলবশত কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এঁরা সমানেই যুদ্ধ করছেন। তোমার মতে এদের মধ্যে কে অপেক্ষাকৃত যুদ্ধকুশল এবং কারই বা কোন গুণ অধিক বলো তো।‘
কৃষ্ণ বললেন, ‘এঁরা দুজনেই সমান উপদেশ পেয়েছেন। তবে ভীমসেন বলবান বটে কিন্তু দুৰ্যোধন ভীমসেন অপেক্ষা অনেক বেশি শিক্ষিত এবং যুদ্ধনৈপুণ্যে অনেক বেশি পটুত্ব অর্জন করেছেন। ভীমসেন ন্যায়যুদ্ধে কখনোই দুর্যোধনকে পরাজিত করতে পারবেন না। অন্যায় যুদ্ধ করেই দুর্যোধনকে বিনষ্ট করতে হবে। যদি ভীমসেন দুৰ্যোধনের সঙ্গে ন্যায়যুদ্ধ করেন, তবে রাজা যুধিষ্ঠির মহাসংকটে নিপতিত হবেন। পুনরায় ধর্মরাজের অপরাধেই আমাদের মহৎ ভয় উপস্থিত হয়েছে। ভীষ্ম প্রভৃতি মহাবীরগণ নিহত হওয়াতেই আমরা জয়লাভ করেছিলাম। এখন আবার ধর্মরাজের জন্যই ঘোর বিপদ উপস্থিত। তবু ভালো দুর্যোধন তাঁকেই যুদ্ধে আহবান করেননি। বীরগণ অবশ্য তা কখনো করেনও না। তদ্ব্যতীত, দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের মতো শুয়ে বসে অন্যদের বিক্রমে যুদ্ধ করেননি। তাঁর রাজত্বও তিনি তাঁর একার যোগ্যতাতেই অতি সুশৃঙ্খলভাবে চালিয়েছেন।
কৃষ্ণের কথা শুনে অৰ্জুন ভয় পেলেন। বললেন, তা হলে কী হবে?
কৃষ্ণ বললেন, ‘অন্যায় যুদ্ধেই জয়ী হতে হবে।’
অর্থাৎ এই পর্যন্ত যা করে এসেছেন, যে পরামর্শ দিয়ে এসেছেন, পুনরায় সে কার্যই করলেন তিনি। যুদ্ধের চরম মুহুর্তে অৰ্জুন ইঙ্গিতে তখন ভীমকে নিজের উরুদেশটা দেখিয়ে দিলেন।
অর্থাৎ মনে করিয়ে দিলেন তিনি দুর্যোধনের উরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
বৃকোদর তদর্শনে তাঁর অভিপ্রায় অবগত হয়ে গদাহন্তে বিবিধ গতি প্রদর্শন পূর্বক পরিভ্রমণ করে দুৰ্যোধনকে চমৎকৃত করতে লাগলেন। আরো কিছুক্ষণ অবিরাম যুদ্ধ করে সংগ্রামে উভয়েই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, দুজনেই পুনরায় ক্রুদ্ধচিত্তে গদা গ্রহণ পূর্বক সংগ্রাম শুরু করলেন। পরস্পর পরস্পরের আঘাতে শোণিতাক্ত কলেবর হয়ে আরো দুর্জয় হয়ে উঠলেন। একসময়ে ভীম মিথ্যা দৌর্বল্য দেখিয়ে, দুর্যোধনকে ঈষৎ গর্বিত করে, তাঁর প্রতি ধাবমান হতে প্রলোভিত করলেন। দুৰ্যোধন যেইমাত্র তাঁর সম্মুখীন হলেন তৎক্ষণাৎ ভীম অতি বেগে গদা নিক্ষেপ করলেন। দুর্যোধনও তৎক্ষণাৎ সেই স্থল হতে বহুদূরে অপসৃত হলেন। সুতরাং ভীমের এই সুযোগটা ব্যর্থ হলো। দুর্যোধন তখন স্বীয় গাদঘাতে ভীমকে এতো জোরে আঘাত করলেন যে বৃকোদর প্রায় মূৰ্ছাগত হলেন। এ অবস্থায় ভীমকে অবস্থিত দেখে দুৰ্যোধন আর তাঁকে প্রহার করতে পারলেন না। মানবিক ধর্ম প্রযুক্ত হয়ে ভীমকে সুস্থ হবার অবকাশ দিলেন। তিনি কুরুকুলের রাজা দুর্যোধন বীর্যপ্রয়োগেও তারা নিয়ম কানুনের অধীন। কৃষ্ণের মিথ্যাচারে সমাচ্ছন্ন পাণ্ডবদের প্রবঞ্চনা তিনি জানেন না। যেই মুহুর্তে দুর্যোধন একটু স্থির হলেন, তৎক্ষণাৎ ভীম দুর্যোধনের প্রতি মহাবেগে ধাবিত হলেন। ভীমকে রোষান্বিত চিত্তে আগমন করতে দেখে, তাঁর গদাঘাতের প্রহর ব্যর্থ করবার জন্য দুৰ্যোধন উর্ধ্বে উঠবার চেষ্টা করলেন, এবং লম্ফ দিয়ে যেই মাটি ছাড়লেন, তৎক্ষণাৎ বৃকোদর তাদের চিরাচরিত মিথ্যা কৌশলে, যুদ্ধের নিয়ম ভেঙে, তাঁর বজ্ৰতুল্য ভীষণ গদা দুর্যোধনের দিকে মহাবেগে নিক্ষেপ করে তাঁর জানুদ্বয় ভঙ্গ করে ভূতলে নিপাতিত করলেন। তারপর তাঁর মস্তক পা দিয়ে মাড়িয়ে দিলেন।