বিচিত্রবীর্য রাজ্যপালনে অক্ষম হয়েও রাজা, স্বয়ংবরসভায় না গিয়েও বিজয়ী। অন্যের শৌর্যে বিজিত কন্যাদের সঙ্গে বিবাহিত হয়ে মহানন্দে সাত বৎসর নিরন্তর বিহার করে যৌবনকালেই যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে নিয়তিক্রমে তাঁকে শমনসদনে যেতে হলো। তারপরে কিছুকাল পর্যন্ত কোনো রাজা উপবিষ্ট ছিলেন না সিংহাসনে। সেই শূন্য সিংহাসন শূন্য রেখেই ভীষ্ম রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
শূন্য সিংহাসন পূর্ণ হতে বড়ো কম সময় লাগলো না। শিশুরা জন্ম নিলো, বড়ো হলো, তবে তো হস্তিনাপুরের রাজা হলো? কিন্তু সেখানেও বাধা। বড়ো পুত্রটি অন্ধ, ছোটো পুত্রটি পাণ্ডুর। সুতরাং আর একটি সুস্থ শিশু না জন্মালে চলে না। অতএব পুনরায় ব্যাসদেবের আবির্ভাব এবং সুস্ত শিশুর জন্ম দেবার আমন্ত্রণ এবং বিদুরের জন্ম। রাজকন্যাদের চালাকির ফলে বিদুর জন্ম নিলো রাজবাটীরই একটি সুন্দরী দাসীর গর্ভে। সে অবশ্য সুস্থ সন্তান এবং তার পিতা বিচিত্রবীর্য নন, একান্তভাবেই স্বয়ং ব্যাসদেব। কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার মতো হলেও দ্বৈপায়ন বিদুরের পিতৃত্বকে অস্বীকার করলেন না। বিচিত্রবীর্যের পুত্ররা তার দ্বারা জন্মগ্রহণ করলেও তারা ক্ষেত্ৰজ বিচিত্ৰবীৰ্যই তাদের পিতা। প্রকৃতপক্ষে যে স্নেহ মমতা সন্তানের প্রতি প্রাকৃতিক ভাবেই পিতার বক্ষে জন্ম নেয়, সেটা এই ক্ষেত্রজদের প্রতি দ্বৈপায়নের ছিলো না। ক্ষেত্ৰজরাও নিজেদের বিচিত্রবীর্যের সন্তান হিশেবেই অজ্ঞান বয়স থেকে জানায় কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে পিতা ভাবার কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু রাজকাৰ্য তো থেমে থাকে না। থাকেওনি।
হস্তিনাপুরের অধিবাসীরা ভীষ্মকে যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত। সুতরাং তাদের নিকট ভীমের কোনো কার্যই প্রতিবাদযোগ্য নয়। ভীষ্ম যা করেন তাই যে তাদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য এ নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র সংশয়ী নন। এদিকে সত্যবতীও জানেন তিনি যা করবেন তা-ই মেনে নেবেন ভীষ্ম। তিনি সশব্দেই বলুন, নিঃশব্দেই বলুন, সত্যবতীর কোনো ইচ্ছেকেই ভীষ্ম প্রতিরোধ করতে অক্ষম। নচেৎ কুমার কালের সন্তানটিকে রাজপুরীতে আহবান করে নিয়ে আসার সাহস তিনি পেতেন না। প্রত্যয় হয়, এই ধীবরকন্যাটিকে রাজবাটীতে আনয়ন করে পিতার হস্তে সমর্পণ করার পরে তিনিও সমৰ্পিত হয়ে গিয়েছিলেন। মহারাজা শান্তনুর একমাত্র কুলতিলক দেবব্রতকে আমরা যতোদিন দেবব্রতরূপে প্রত্যক্ষ করেছি, সমস্ত দিক বিবেচনা করলে তার তুল্য এমন সর্বগুণসম্পন্ন মহৎ চরিত্র মহাভারতে আর নেই। যে মুহুর্তে তিনি ভীষ্ম হলেন সেই মুহুর্ত থেকেই তার দুর্বার ব্যক্তিত্ব স্তিমিত হলো। কেন হলো? সত্যবতীই কি তা সমূলে উৎপাটিত করে সেই অনন্য ব্যক্তিটিকে একেবারে নিজের কুক্ষিগত করে ফেললেন? নচেৎ, আমন বিচিত্র বিশাল মহাদেশে তো একটাই সিংহাসন পাতা ছিলো না দেবব্রতর জন্য? যাকে সমরোদ্যত নিরীক্ষণ করলে শত্রুপক্ষ ‘সিংহভীত গো-পালের ন্যায় ভয়ে উদ্বেগে কম্পমান’ হয়, যিনি ক্রুদ্ধ হলে যে কুলোদ্ভবই হোক না কেন অচিরকালের মধ্যেই পঞ্চতৃপ্রাপ্ত হয়, যার শৌর্যবীর্য পরশুরাম অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, নীতি ও মেধায় যিনি অপ্রমেয়, কী করে তিনি অমন নিশ্চেষ্টভাবে বছরের পর বছর নিক্রিয় হয়ে বসে রইলেন? কখনো কোনো যুদ্ধ জয়ে যাননি, শিকারে যাননি, ভ্রমণে যাননি, কিছুই করেননি। না হয় পূর্ববৎ মাতামহ জহুমুনির আশ্রমেই প্রত্যাবৃত হতেন। জীবনের উৎকৃষ্ট সময়টা তো তিনি সেখানেই কাটিয়েছিলেন। পিতার কাছে যতোদিন কাটিয়েছেন, মাতার কাছে তার বহুগুণ বেশি সময় কাটিয়েছেন। আশ্রম জীবন তো তার কাছে অচিন্ত্যনীয় নয়। অন্তত অন্যের বশবর্তী হয়ে থাকা অপেক্ষা অবশ্যই সম্মানজনক। সত্যবতীর বংশধরদের জন্য সিংহাসন অটুট রাখার দায়িত্ব তো তার নয়। মনে হয় সত্যবতী কখন কী করাবেন, কী বলবেন, সেই অপেক্ষাতেই তিনি যেন সদাসচকিত। বলা যায় সত্যবতীর অঙ্গুলি হেলনেই তিনি উঠতেন বসতেন। তার নিজের কি কোনো আশা আকাজক্ষা বাঞ্ছা বাসনা কিছুই আলাদাভাবে ছিলো না? যে রমণী তাঁকে জাগতিক সর্বসুখে বঞ্চিত করেছেন, তার জন্য এমন আত্মবিসর্জন কী করে সম্ভব? কুরুকুলের এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিটিই যাঁর আয়ত্তে তার তবে কাকে ভয়? কাকে লজ্জা? তার ইচ্ছেই চরম ইচ্ছে। সেজন্যই নিদ্বিধায় সত্যবতী নিজের কলঙ্কটিকে আহবান করে নিয়ে এলেন এই রাজপুরীতে। তিলতম লজ্জাও তাঁকে বিড়ম্বিত করলো না। যদি তা না আনতেন তা হলে কি বিদুরের মতো একটি ধূর্ত, অবৈধ, পরগাছার প্রবেশ ঘটতো এই সংসারে?
সর্বাপেক্ষা বিস্ময়ের বিষয় এটাই, সত্যবতীর প্রতি মুগ্ধতাবশত ভীমের আনুগত্য যতটা সীমাহীন, ততোটাই কার্যকারণের অনধীন। কেবলমাত্র এই কারণেই তিনি যে স্বীয় সর্বনাশ ডেকে এনে সমগ্র কুরুকুলকেই নিশ্চিহ্ন করেছেন তা-ই নয়, সমগ্র দেশটাকেই প্রায় মনুষ্যহীন করে ভাসিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য পুস্তকটি অনেক স্থলেই অসঙ্গতি দোষে দুষ্ট। নিষাদ বালক একলব্যকে নিষাদ বলেই দ্রোণ শিষ্য হিশেবে গ্রহণ করতে পারলেন না, অথচ রাজ্যের যিনি প্রভু তিনি বিবাহ করলেন একজন ধীবরকন্যাকে ধীবররা যেখানে সকলেই নিষাদ। সঙ্গে সঙ্গে এই তথ্যটাও জানতে কৌতুহল হয়, দ্বৈপায়নের পিতা পরাশরমুনি যখন সত্যবতীর পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন, সত্যবতী তাঁকে কী কারণে প্রত্যাখ্যান করলেন? পরাশর অযোগ্য নন। তাঁকে গ্রহণ করলে অবৈধ পুত্রকে আর অবৈধ কলঙ্কে কলঙ্কিত থাকতে হতো না। সত্যবতীর চরিত্রেও কোনো কালো দাগ থাকতো না।
মহাভারতের মহারণ্যে – ১.৩
বিশেষভাবে লক্ষ করলে আরো একটা বিষয় বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মহাভারতে যে সব ঘটনার সমাবেশে সে সব ব্যক্তিকে পাপিষ্ঠ বা মহাত্মা আখ্যা দেওয়া হয়েছে, এবং সহস্র বৎসর যাবৎ প্রচারের দ্বারা আমাদের মনে যে বিশ্বাসটিকে হৃদয়ের নিগূঢ় নিবাসে প্রোথিত করা হয়েছে, এবং যে যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বলা হয়েছে, তা বড়ই বিভ্রান্তিকর। চার দশকেরও অধিককাল ধরে নিবিষ্টচিত্তে কালীপ্রসন্ন সিংহের সম্পূর্ণ মহাভারত পাঠ করে সাহিত্য হিশাবে তা যতোই মনোমুগ্ধকর বলে মনে করেছি, ততোটাই উদ্রান্ত বোধ করেছি ধর্মাধর্মের অবিচার দেখে। যুদ্ধ যে ভাবে আগত হলো, তখন যে সব ঘটনা ঘটেছে, সেই সব ঘটনা যদি স্তরে স্তরে সাজিয়ে ক্রমান্বয়ে বর্ণনা সমেত পাঠকদের নিকট তুলে ধরি, বিচক্ষণ এবং সংস্কারহীন বিবেচনার দ্বারা বিশ্লেষণ করলে তারা আমার বিচারকে অগ্রাহ্য করবেন এমন মনে হয় না।