দুৰ্যোধন জলের মধ্যে থেকেই বললেন, ‘প্রাণীমাত্রেরই অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু আমি প্রাণভয়ে পলায়ন করিনি। সংগ্রামে আমার রথ ও তৃণীর দুই-ই বিনষ্ট হয়েছে। সৈন্য সামন্ত পৃষ্ঠপোষক নিহত হয়েছে। আমি অতিরিক্ত পরিশ্রান্ত হয়েই সলিলমধ্যে প্রবেশ করে বিশ্রামের চেষ্টা করছি। প্রাণভয়ে বা বিষাদযুক্ত হয়ে এখানে লুকোতে আসিনি। অনুচরগণের সঙ্গে তুমিও কিয়ৎকাল বিশ্রাম নাও। আমি অবিলম্বেই সলিল থেকে সমুখিত হয়ে সংগ্রাম করবো।‘
যুধিষ্ঠির বললেন, “আমাদের কোনো বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। তুমি অবিলম্বে হ্রদের মধ্য থেকে উত্থিত হয়ে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও আমাদের হাতে নিহত হয়ে বীরলোক প্রাপ্ত হও।‘
দুৰ্যোধন বললেন, “আমি যাদের জন্য রাজ্যলাভের অভিলাষ করেছিলাম, আমার সেই সমস্ত ভ্রাতা পরলোক গমন করেছে। পৃথিবীও রত্নহীন, ক্ষত্রিয় বলেও আর কিছু নেই। এই অবনীকে ভোগ করতে আর আমার কোনো স্পৃহা নেই। হে যুধিষ্ঠির আমি এখনো পাণ্ডবগণকে ভগ্নোৎসাহ করে তোমাকে পরাজিত করতে পারি। কিন্তু পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কর্ণকে হারিয়ে আমার মনে আর যুদ্ধের কোনো স্পৃহ নেই। তুমিই এখন সকলকে নিয়ে এই পৃথিবী ভোগ করো। আমার জীবনধারণেরও কোনো ইচ্ছা নেই। আমি মৃগচর্ম পরিধান করে বনে গমন করবো। ভোগে আর বিন্দুমাত্র স্পৃহা অনুভব করছি না।’
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আর পরিতাপ করে কী হবে? তোমার আর্তপ্রলাপে আমার মনে অণুমাত্র দয়ার সঞ্চার হচ্ছে না। তুমি পৃথিবী দান করলে আমি নেবো কেন? আর এখন তুমি পৃথিবী দান করবার কে? এখন তোমার এই রাজ্য বলপূর্বক গ্রহণ বা দান করবার ক্ষমতাই কি আছে? দুৰ্যোধন, তুমি রাজ্য দানে অভিলাষী হলেও, আমি তোমার প্রাণ রক্ষা করবো না। এখন তোমার জীবন আমার অধীন। আমি ইচ্ছে করলে তোমার প্রাণ রক্ষা করতে পারি, কিন্তু তুমি আত্মপরিত্রাণে কখনোই সমর্থ হবে না। এখন তুমি জল থেকে উত্থিত হয়ে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও।‘
এবার জল আলোড়িত করে উঠে এলেন দুৰ্যোধন। যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হয়ে বললেন, ‘তোমাদের রথ ও বাহন, বন্ধুবান্ধব সবই আছে। কিন্তু আমি একা এবং বিরথ, অত্যন্ত পরিশ্রান্ত। এখন তোমরা অনেকে রথারূঢ় হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে আছো, সুতরাং আমি কী করে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবো? অতএব, তোমরা একে একে আমার সঙ্গে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও তোমাদের কারোকে দেখেই আমার মনে কোনো ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে না। আমি একা তোমাদের সকলকে নিবারণ করবো। হে যুধিষ্ঠির! আমি তোমাকে তোমার ভ্রাতৃগণের সঙ্গে নিপাতিত করে বাহুলীক ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্ৰথ, শল্য, ভূরিশ্রবা শকুনি এবং আমার ভ্রাতাগণ পুত্ৰগণ ও বন্ধুবান্ধব সকলের ঋণ পরিশোধ করবো।’
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘তোমার অভীষ্ট আয়ুধ গ্রহণ করে আমাদের মধ্যে যে কোনো বীরের সঙ্গে সমাগত হয়ে যুদ্ধ করো। আমরা সকলে রণস্থলে অবস্থানপূর্বক যুদ্ধব্যাপার নিরীক্ষণ করবো। এখন আমি বলছি, তুমি আমাদের মধ্যে একজনকে বিনাশ করতে পারলে, সমুদয় রাজ্য তোমার হবে।’
দুৰ্যোধন বললেন, “যদি আমাকে একজনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, তা হলে আমি তোমাদের মধ্যে যে সর্বাপেক্ষা বলশালী তাঁর সঙ্গেই যুদ্ধ করবো। তুমি আমাকে যে কোনো আয়ুধ গ্রহণ করতে বলেছো, আমি এই গদা মনোনীত করলাম। এখন তোমাদের মধ্যে যিনি আমার বলবীৰ্য সহ্য করতে সমর্থ, তিনিই আসুন।‘
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘তুমি যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে গদাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও।
দুৰ্যোধন তাঁর সুদৃঢ় ভীষণ লৌহময় গদা কাধে নিয়ে প্রচণ্ড মার্তণ্ডের ন্যায় সমাগত হলেন। বললেন, ‘হে পাণ্ডবগণ! আমি অচিরাৎ তোমাদের যমালয়ে প্রেরণ করবো।’
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘এখন তুমি কবচ পরিধান, কেশকলাপ বন্ধন ও যে কোনো দ্রব্যের অভাব থাকে, সে সব গ্রহণ করো। আমি এখনো বলছি, তুমি পাণ্ডবদিগের যার সঙ্গে অভিরুচি হয়, যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। হয় তাঁকে বিনাশ করে রাজ্যপদ লাভ করো, না হয় তাঁর হস্তে নিহত হয়ে স্বৰ্গসুখ অনুভব করো।’
দুৰ্যোধন সুবর্ণময় বর্ম ও কনকমণ্ডিত বিচিত্র শিরস্ত্রণ গ্রহণ করে গদা সমুদ্যত করে পাণ্ডবদের বললেন, “হে বীরগণ, এখন তোমরা কে আসবে এসো। আমি ক্রমে ক্রমে সকলকেই বিনাশ করে বৈরানল নির্বাণ করবো।’
যখন দুৰ্যোধন এভাবে তর্জনগর্জন করছিলেন, কৃষ্ণ পরম ক্রোধান্বিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আপনি কোন সাহসে বলছেন যে আমাদের মধ্যে যাকে খুশি তাঁকে বেছে নাও? আপনি দুৰ্যোধনের সঙ্গে পারবেন লড়তে? সে যদি এখন আপনাকে চায়? আপনি কেন, অর্জুন নকুল সহদেব কেউ কি পারবে? তখন? তখন আপনার কী হবে ভেবে দেখেছেন? গদাযুদ্ধে দুৰ্যোধন অতিশয় পারদর্শী, ভীমসেনও পারবেন কিনা সন্দেহ। পূর্বে দূতক্রীড়া করে যে সর্বনাশ করেছিলেন, আবার তাই হবে। দুর্যোধন গদাযুদ্ধে কৃতী, যদি তিনি ভীমসেনকে চান, তবু রক্ষা। ভীমসেন পরাক্রমশালী, ভাগ্যবলে ভীমসেনকে নির্বাচন করলে তবু কিছু আশা করা যায়। নচেৎ, সেই পাশাক্রীড়াই পুনরায় শুরু হবে বলে ধরে নিন। যেখানে ভীমসেন পারবে কিনা সন্দেহ, আপনি এই প্রতিজ্ঞা করে বসলেন, আমাদের মধ্যে যার সঙ্গে খুশি তাঁর সঙ্গেই এই গদাযুদ্ধে অবতীর্ণ হও।‘