কুরুরাজ দুর্যোধনের একথা শুনে অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণ সাধু সাধু বলে প্রশংসা করতে লাগলেন। তখন পরাজিত হয়েছেন বলে কারো মনের মধ্যে কোনো কষ্ট রইলো না। বিক্রম প্রকাশে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। যুদ্ধার্থে নরপতিগণও স্ব স্ব মত প্রকাশ করলেন। আচার্যপুত্র অশ্বথামা প্রাণত্যাগে উদ্যত নগরপালদের ইঙ্গিত অবগত হয়ে রাজা দুৰ্যোধনের নবেদিত সূর্যতুল্য সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুনুন, পণ্ডিতেরা স্বামীভক্তি, দেশকালাদি সম্পত্তি, রণপটুতা ও নীতি এই কয়েকটিকে যুদ্ধের সাধন বলে নির্দেশ করেছেন। আমাদের যে সব দেবতুল্য লোকপ্রবীর মহারথগণ নীতিজ্ঞ, রণদক্ষ, প্রভুপরায়ণ, ও নিয়ত যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলেন, তারা কেউ যুদ্ধের দ্বারা পরাজিত হননি। পাণ্ডবরা তাদের পিছন থেকে লুকিয়ে হত্যা করেছেন। তা বলে জয়ের আশা ত্যাগ করা উচিত নয়। সুনীতি প্রয়োগ করলে দৈবকেও অনুকুল করা যায়। এখন আপনি বিশ্রাম করুন। আপনি শান্ত হোন।‘
অতি প্রত্যুষে পুনরায় আবার সকলে একত্রিত হলেন। দুর্যোধনকে সম্ভাষণ করে বললেন, ‘হে মহারাজ! আপনি একজন সেনাপতি নিযুক্ত করুন, আমরা সেই সেনাপতির নিকট রক্ষিত হয়ে সম্মুখ সমরে সমুদয় শক্রকে পরাজিত করবো।‘ তখন রাজা দুর্যোধন নিজের রথে বসেই অশ্বথামার কাছে গেলেন।
অশ্বথামার রূপের কোনো তুলনা ছিলো না। তিনি বায়ুর মতো বলবেগশালী এবং তেজে দিবাকর ও বুদ্ধিতে শুক্রাচার্য। দুর্যোধন সেই দ্রোণপুত্রের নিকট গিয়ে বললেন, ‘হে গুরুপুত্র! আজ আপনিই অগতির গতি। আপনিই বলুন কাকে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করবো।’ অশ্বথামা দুর্যোধনের বাক্য শুনে তখনি বললেন, ‘হে মহারাজ! মদ্রাধিপতি শল্য বলবীর্যে শ্রী ও যশ প্রভৃতি অশেষ গুণসম্পন্ন এবং সৎকুলসস্তুত। ঐ মহাবীরকেই আপনি আমাদের সেনাপতির পদে অভিষিক্ত করুন। ঐ মহাত্মা নিজের ভাগিনেয়দের ছেড়ে আমাদের নিকট উপস্থিত হয়েছেন, তাঁর মিত্রতার তুলনা নেই।‘
তখন দুর্যোধন রথ থেকে নেমে ভীষ্মসদৃশ মহাবীর মদ্রাধিপতিকে বললেন, ‘হে মিত্রবৎসল, আপনি আমাদের বন্ধু। অসময়েই মানুষ জানতে পারেন কে বন্ধু আর কে নয়। অতএব আপনি আমাদের সেনাপতি পদে অভিষিক্ত হোন।‘
শল্য বললেন, ‘হে কুরুরাজ, তুমি আমাকে যা বলবে, আমি তাই করবো। আমার রাজ্য মনপ্রাণ যা কিছু আছে সবই তোমার।’
দুৰ্যোধন বললেন, ‘হে মাতুল! আমি আপনাকে সেনাপতিপদে বরণ করছি। আপনি আমাদের রক্ষায় প্রবৃত্ত হোন।‘
শল্যরাজ বললেন, ‘হে মহারাজ। আমি যা বলছি তুমি তা অবিহিত হয়ে শোনো। ধনঞ্জয় আর বাসুদেবকে শ্রেষ্ঠ মনে করো না। সমস্ত পৃথিবী উদ্যত হলেও, আমি ক্রোধাবিষ্ট হলে অনায়াসেই তাদের জয় করতে পারি। এখন আমি তোমার সেনাপতি হয়ে বিপক্ষগণের নিতান্ত দুর্ভেদ্য ব্যূহ রচনা এবং সমস্ত পাণ্ডবদের পরাজিত করবো সন্দেহ নেই।‘
বস্তুতই মদ্রাধিপতি শল্য একজন প্রকৃত যোদ্ধা। অবশ্য কুরুকুলে কুরুরাজ দুৰ্যোধন তো আছেনই, তাঁর জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তারা কেউ এমন যোদ্ধা ছিলেন না, যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাণ্ডবপক্ষের কেউ জয়ী হতে পারেন। পারেনওনি। কৃষ্ণের মিথ্যাচারেই অর্জুনের মতো যোদ্ধা একবারের জন্যও রণক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতাঁর প্রমাণ রাখার অবকাশ পেলেন না। ভীষ্ম দ্ৰোণ জয়দ্ৰথ ভূরিশ্রব কর্ণ কারো সঙ্গে তাঁকে যুদ্ধ করতে দেননি বাসুদেব। প্রত্যেককে যুদ্ধ ছাড়াই পিছন থেকে অতর্কিতে অথবা অসৎপন্থায় নিহত করিয়েছেন। যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর এই অন্যায় কর্ম অব্যাহত ছিলো।
কৰ্ণ অর্থিগণের কল্পবৃক্ষ স্বরূপ ছিলেন। যাচকদের কখনোই প্রত্যাখ্যান করতেন না। সাধু ব্যক্তিরা তাঁকে সৎপুরুষ বলে অতীব শ্রদ্ধা করতেন। কর্ণ কৃষ্ণেরও বন্ধু ছিলেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও কৃষ্ণ তাঁকে ধর্মচ্যুত করতে পারেননি। দুৰ্যোধনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি। এই সততা কুরুপক্ষের সকলের মধ্যেই বর্তমান ছিলো। দুৰ্যোধন নিজে একজন বিশেষ মানুষই ছিলেন। তাঁর পক্ষের রাজাগণ এবং সৈন্যগণ তাঁর প্রতি সেজন্যই এতো একনিষ্ঠ ছিলো। তিনি যুধিষ্ঠিরের মতো যুদ্ধের মধ্যে আরামশয্যায় শুয়ে বসে দিন কাটাননি। অবিশ্রান্ত যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকেছেন। পিতৃবৎসল, মিত্রবৎসল, প্রজাবৎসল—এসব গুণ তাঁর মধ্যে প্রভূত পরিমাণে ছিলো। একটি মিথ্যাবাক্যও তিনি উচ্চারণ করেছেন এমন ঘোষণা বিদুরও করতে পারেননি।
যেদিন কর্ণ অন্যায়যুদ্ধে অসহায় অবস্থায় নিহত হলেন, সেই সময়ে যুধিষ্ঠির তাঁর সুবর্ণময় উত্তম শয্যায় শুয়ে আলস্য যাপন করছিলেন। সহৰ্ষে অর্জুন ও কৃষ্ণ প্রবেশ করলেন। তাদের মুখ দেখেই যুধিষ্ঠির বুঝতে পারলেন কর্ণকে তারা নিহত করতে পেরেছেন। তাঁর মুখে উত্তেজনার ভাব ফুটে উঠলো। তিনি গাত্ৰোখান করলেন। শুভসংবাদ অবগত হলেন। কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে তিনি কর্ণের মৃতদেহ দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে সমরক্ষেত্রে এসে দাঁড়ালেন। আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে বললেন, ‘এর কথা ভেবে আমি ভয়ে তেরো বৎসর ভালো করে ঘুমোতে পারিনি। আজ সুখে নিদ্রা যাবো।’
কর্ণের মৃত্যুর পরে পাণ্ডবরা নিজেদের নিরাপদ বোধ করছিলেন। তাঁর পরেও শল্য যে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে একেবারে উথালপাথাল করে তুলবেন সেটা ভাবেননি। পাঞ্চাল আর সোমক আর পাণ্ডবেরা সেই সৈন্যনিপাতনে কৃতান্ততুল্য মদ্ররাজের পরাক্রম দেখে অধীর হয়ে উঠলো। সাত্যকি ভীম নকুল সহদেব অসাধারণ বলসম্পন্ন মদ্রাধিপতিকে সহসা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধে উদ্যত দেখে আতি তৎপরতাঁর সঙ্গে তাঁকে পরিবেষ্টন করে মহাবেগসম্পন্ন শর দ্বারা মদ্রাধিপতি শল্যকে নিপীড়িত করতে লাগলেন। শল্য সে সব অগ্রাহ্য করে যুধিষ্ঠিরের দিকেই ধাবিত হলেন। সমরাঙ্গন মৃতের স্তুপে পরিণত হলো। এই যুদ্ধে কৃষ্ণ উপস্থিত ছিলেন না, তাই যুদ্ধটা যুদ্ধের মতোই হলো। যুধিষ্ঠির-পরিবেষ্টিত যোদ্ধাদের বাণে বিদ্ধ হতে হতে এক সময়ে যুধিষ্ঠিরের একটি বাণে তিনি বিনষ্ট হলেন। শল্য যুধিষ্ঠিরের দিকেই তাঁর একান্ত মনোযোগ নিবিষ্ট করেছিলেন। দেখতে পেয়েই অর্জুন ভীম নকুল সহদেব সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র পাঞ্চাল ও সোমকদল তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিলেন। তাদের সকলের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠির তাঁর জীবনের প্রথম কীর্তি স্থাপন করতে পারলেন। মহাভারত নামের গ্রন্থটিতে যুধিষ্ঠিরের এই একমাত্র বীরত্বের কাহিনী মোটা দাগে অঙ্কিত হলো। মহারাজা শল্য যে তাঁর দ্বারাই বিনষ্ট হয়েছেন, তা যেন অন্য কোনো পরিবেষ্টনকারীর নামে না যায় সেটাই বারে বারে উল্লিখিত হলো।