অৰ্জুনের মতো যোদ্ধা বিরল। দুঃখ হয়, কৃষ্ণ তাঁকে যুদ্ধ করতেই দিলেন না। কেবল কতোগুলো মানুষকে অন্যায় যুদ্ধে অথবা পিছন থেকে লুকিয়ে খুন করালেন। কর্ণ যখন নিরস্ত্র, যখন রথ থেকে নেমে নিচে বসে যাওয়া চাকাটা তুলছিলেন, অনুরোধ করছিলেন, ‘একটুখানি সময় আমাকে ক্ষমা করো, যেন যুদ্ধের নিয়ম ভেঙে আমাকে নিরস্ত্র অবস্থায় রথে না ওঠা পর্যন্ত নিহত করো না’, কৃষ্ণ বুঝলেন, এই একমাত্র সুযোগ, বললেন, ‘এক্ষুনি মারো ওকে, কোনোরকমেই যেন রথে উঠে না বসে।‘ আর মহাবীর অর্জুন তাই করলেন। এতোদিন ধরে এতো সব বড় বড় যোদ্ধার কাছে কতো যত্নে কতো ধরনের যুদ্ধ শিখলেন, মহাদেবের বরপ্রাপ্ত হলেন, সবই বিফলে গেলো। কর্ণ এবং অর্জুনের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার মতোই একটা দৃশ্য ছিলো। অনেকেই এই দুটি বড় মাপের যোদ্ধার যুদ্ধ দেখতে কৌতুহলী ছিলেন। কৃষ্ণ সেখানেও হস্তক্ষেপ করলেন। কিন্তু অর্জুন? মহাভারতের তিনটি সর্বোৎকৃষ্ট যোদ্ধা এবং সর্বাঙ্গসুন্দর পুরষ ভীষ্ম, কর্ণ, অৰ্জুন। সেই অৰ্জুন নিজেকে কেন এমনভাবে মুছে দিলেন? তাঁর তো কোনো রাজ্যলোভ ছিলো না। জ্যেষ্ঠের আদেশে কাজ করার নিয়ম, তাই করে যাচ্ছেন। প্রকৃতিগতভাবে তিনি শুভবুদ্ধিধারী ছিলেন বলেই মনে হয়। কিন্তু কৃষ্ণের নীতিহীনতাঁর কাছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নতিস্বীকার করে গেলেন তিনি।
মহাভারতের মহারণ্যে – ২.১১
দুৰ্যোধনের হৃদয় আর প্রবোধ মানলো না। কর্ণ তো কেবলমাত্র বন্ধু ছিলেন না। ছিলেন আশ্রয়, অবলম্বন, পিতামাতাম্রাতাবন্ধুস্বজন, সব। সব কিছুর উৎস। সব কিছুর সমন্বয়। তাঁর দুই গাল জলে ভেসে গেলো। তারপরেই সমস্ত দুঃখ এবং ক্রোধ উত্তাল হয়ে উঠলো। সারথিকে বললেন, ‘হে সূত! আমি আজ অর্জুনকে সংহার করবো। অর্জুন আজ আমাকে কিছুতেই অতিক্রম করতে সমর্থ হবে না।’
দুৰ্যোধন সমাগত শক্রগণের প্রতি বেগে ধাবমান হলেন যে কৰ্ণ পৃথিবীর ঈশ্বর হতেও রাজি হননি দুর্যোধনের হিতাভিলাষে, সেই কর্ণকে ওরা এভাবে নিধন করলো? এর নাম যুদ্ধ যুদ্ধ করলে অর্জুন কি কর্ণের কাছে জয়ী হতে পারতেন? পিছন থেকে ছুরি মেরে খুন করতে তাদের বিবেকে কি এক ফোটাও দ্বিধা উদ্রিত হলো না? লজ্জা কুষ্ঠা ধর্ম কিছুই কি নেই তাদের মধ্যে? তারা কি মানুষ? মনুষ্য পদবাচ্য কোনো জীবই কি এটা করতে পারে? দুর্যোধন হা কৰ্ণ বলে রোদন করতে করতে উন্মাদের মতো প্রচণ্ড বেগে যাকে কাছে পেলেন তাঁকেই শরনিকরে বিদ্ধ করতে করতে আহবান করতে লাগলেন যোদ্ধাদের।
মদ্রাধিপতি শল্য শেষে কোনোরকমে নিবৃত্ত করলেন তাঁকে। বললেন, ‘হে রাজন! তোমার অদ্ভুত পৌরুষ দেখে আমি অভিভূত। তুমি একা একা এই অসংখ্য শত্রু সৈন্যকে কী ভাবে নিপাতিত করছো। কিন্তু আমাদের সৈন্যরা এখন চতুর্দিকে পলায়মান কর্ণের মৃত্যুতে তারা সকলেই ভীত, ব্যথিত। ক্ষত্রিয়ধর্ম যারা পালন করে না, যুদ্ধক্ষেত্রে যারা অন্যায় হত্যা করে, তাদের সঙ্গে একজন ক্ষত্রিয় যোদ্ধা ধর্মযুদ্ধ কী ভাবে পালন করবে? তুমি শান্ত হও। সূতপুত্রের নিধনে সকল সৈন্যই বিষাদগ্ৰস্ত, বিপন্ন এবং পরিশ্রান্ত। আজকের মতো সকলকে ছুটি দাও। তুমিও শিবিরে চলো।‘ শোকাকুলচিত্ত মদ্রাধিপতি এই সব বলে চুপ করলেন। তখন দুর্যোধন বাষ্পাকুল নয়নে যুদ্ধ শেষ করে সৈন্যদের ছুটি দিয়ে শিবিরে গেলেন।
সকলেই কর্ণের কথা বলতে বলতে গভীর রাত্রি পর্যন্ত জেগে কাটিয়ে দিয়ে অবশেষে নিদ্রিত হলেন। কিন্তু দুর্যোধনের নিদ্রা এলো না। গভীর যামিনী গত হয়ে কখন আকাশ রক্তবর্ণ হলো, তবু তাঁর দুই গাল জলেই ভরে রইলো। হৃদয় কেবলই হাহাকার করতে লাগলো একমাত্র বন্ধু কর্ণের জন্য।
কৃপাচার্য বলেছিলেন, হে রাজন! তুমি এবার ওদের সঙ্গে সন্ধি করো। আমার মনে হয় কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের বাক্য লঙ্ঘন করতে সমর্থ হবেন না। হে মহারাজ। আমি দীনতা বা প্রাণরক্ষার নিমিত্ত একথা বলছি না। একথা তোমার হিতকর বলেই বলছি।‘
দুৰ্যোধন বললেন, ‘হে আচার্য। আপনি পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে যুদ্ধ করেছেন, এখনো বন্ধুজনোচিত বাক্যই বলছেন, কিন্তু আমি কীরূপে এ কাজ করতে পারি! আমি আপনার বাক্য শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়েও বলছি, পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করা উচিত নয়, যুদ্ধ করাই শ্রেয়। দেখুন, আমি বহুবিধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান, ব্রাহ্মণগণকে প্রভূত দক্ষিণাদান, বেদাধ্যয়ন ও বিপক্ষগণের শীর্ষস্থানীয়রূপে অবস্থান করেছি। আমি যা চেয়েছি সবই পেয়েছি। আমার ভৃত্যগণ অতি সুখে প্রতিপালিত হয়েছে। আমি দুঃখীদের দুঃখ দূর করেছি, স্বরাজ্য প্রতিপালন, ভোগ্যদ্রব্য উপভোগ এবং ধর্মঅর্থকামের সেবা করেছি। ক্ষত্রিয়ধর্ম ও পিতৃঋণ থেকেও আমার মুক্তিলাভ হয়েছে। এই পৃথিবীতে কিছুতেই সুখ নেই। কেবল কীর্তিলাভ করাই লোকের কর্তব্য। আমি ক্ষত্রিয় ক্ষত্রিয়গণ গৃহমধ্যে রোগভোগ করে মরতে চায় না। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুই আমার কাম্য। তদ্ব্যতীত, আমার জন্য নিহত পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, মহাবীর জয়দ্ৰথ এবং কর্ণ, যে আমার কথা ভেবে পৃথিবীর ঐশ্বর্য ও কৃষ্ণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাদের কথা আমি কী করে ভুলতে পারি? কতো অবনীপাল আমার জন্য যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, তাদের নিকটও আমি বহুরূপে ঋণী। সেই কৃতজ্ঞতাঁর শোধ কি আমি নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে তাদের দিতে পারি? যুদ্ধক্ষেত্রে আমার প্রাণ দিয়েই আমি ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করে তাদের সঙ্গে মিলিত হতে চাই।’