অৰ্জুন স্পর্ধা করেই বললেন, ‘হয় আমি আজ আমার বাণে কর্ণকে নিহত করবো নচেৎ কর্ণের বাণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিহত হবো। তুমি তাড়াতাড়ি অশ্বচালনা করো।‘
সেই সময়টাতে কর্ণ পুত্রের মৃত্যুসংবাদে সন্তপ্ত হয়ে অশ্রুবারি পরিত্যাগ করছিলেন। ইত্যবসরে অৰ্জুনকে সমাগত দেখে শোক ভুলে রোষাবিষ্ট হয়ে তাঁকে যুদ্ধ করতে আহবান করলেন।
অন্যান্য যোদ্ধারা এই দুই বীরকে মুখোমুখি দেখে সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। কৌরবগণ কর্ণকে উত্তেজিত করার জন্য বাদিত্রধ্বনি ও শঙ্খ বাজাতে লাগলেন, পাণ্ডবরা তুর্য ও শঙ্খের শব্দে অর্জুনকে উত্তেজিত করতে লাগলেন।
যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে লাভ নেই। কে কতো অস্ত্রের দ্বারা কতোবার কাকে বিদ্ধ করেছিলেন সেই বর্ণনায় গিয়েও কাজ নেই। তবে সেই বর্ণনায় এটা স্পষ্ট ছিলো যে কৰ্ণ হেরে যাবেন না, জয়ী হয়ে কৌরবদের রক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু নিয়তিক্রমে তাঁর রথের একটা চাকা সহসা মাটিতে বসে গলো। কর্ণ বললেন, ‘হে পাৰ্থ! তুমি মুহুর্তকাল যুদ্ধে নিবৃত্ত হও, আমি চাকাটা উদ্ধার করছি। দৈবক্রমে আমার দক্ষিণচক্ৰ পৃথিবীতে প্রোথিত হয়েছে। এ সময়ে তুমি কাপুরুষোচিত দুরভিসন্ধি পরিত্যাগ করো। তুমি রণপণ্ডিত বলে বিখ্যাত, এখন অসাধু কার্য করা তোমার উচিত নয়। আমি এখন ভূতলগত, অসহায়, আর তুমি রথের উপর বসে আছো। যে পর্যন্ত চাকাটা উদ্ধার করতে না পারি, তাবৎ আমাকে বিনাশ করা তোমার উচিত নয়। তুমি মুহুর্তকাল আমাকে ক্ষমা করো। অন্তত সেই পৌরুষটুকু তোমার আছে বলেই বিশ্বাস করি।
এখানে ছোট্টো একটি উপকথা বলা হয়েছে। সেটির উল্লেখ এখানে অবান্তর হবে না। যদিও উপকথা, তথাপি তাঁর দ্বারাই একটা মানুষের চরিত্রগত ছবি ফুটে ওঠে। ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি কর্ণ ভীমকে ও যুধিষ্ঠিরকে পরাস্ত করেও প্রাণে মারলেন না শুধু তাঁর কামুক গর্ভধারিণী, যিনি নিজের সুনাম রক্ষার্থে কুমারীকালের এই সন্তানকে প্রসব করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, যিনি কখনো কোনো দুঃখ বেদনা অপমান অসম্মান থেকে কোনোদিনই এই সন্তানকে চিনতে পেরেও উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেননি, অথচ লজ্জাহীনভাবে এসেছিলেন স্বীয় স্বার্থ রক্ষা করতে, সেই মহিলার নিকট দেওয়া কথা লঙ্ঘন করতে পারেননি বলেই যুদ্ধে যোগ দিয়েই মহাবীর কর্ণ, মহানুভব কর্ণ, কোনো প্রলোভনের অনধীন কর্ণ, অগ্নিগোলকের মতো সমরাঙ্গনে ছিটকে পড়েই শক্রমর্দনে সকলকে ত্ৰাসিত করেছিলেন। সেই ত্ৰাসে ত্ৰাসিত হয়ে অতি শঠ কৃষ্ণ অজুনকে সমরাঙ্গন থেকে সরিয়ে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর যেদিন মুখোমুখি হলেন দুজনে, অতি প্রিয়দর্শন দুটি ভ্রাতা, যখন যুদ্ধ প্রায় তুঙ্গে, এই সময়ে বেগে পাতালতল থেকে উত্তীর্ণ হয়ে, অন্তরীক্ষ থেকে কর্ণ এবং অর্জুনের সংগ্রাম সন্দর্শন করে, বৈরনির্যাতনের এটাই সর্বাপেক্ষা যোগ্য সময় বিবেচনায় সর্প অশ্বসেন কর্ণের এক তৃণীরশায়ী শরমধ্যে প্রবেশ করলো।
কর্ণ কিছুই জানতে পারলেন না। কিন্তু কৃষ্ণ জানতে পেরে তাঁর রথ চার আঙুল নিচে নামিয়ে দিলেন। এটি কর্ণের অব্যর্থ শর। সাপ না ঢুকলে অনায়াসে অর্জুনের মস্তকচ্ছেদ করতে পারতেন। কিন্তু তা হলো না। শল্য বলেছিলেন, ‘তুমি এই শরটি নিক্ষেপ করো না। এটা কিন্তু অৰ্জুনের গ্রীবাচ্ছেদনে সমর্থ হবে না। অতএব, যদ্বারা অর্জুনের মস্তকচ্ছেদন করা যায়, সে রকম একটি শর সন্ধান করো।’
ক্ষত্রিয়জনোচিত অহংকারে কর্ণ শল্যের কথা শুনলেন না। বললেন, ‘হে মহাবাহো! এক শর হাতে নিলে আর সেটা আমি পরিত্যাগ করি না। আমার সদৃশ ব্যক্তিরা কখনো কূটযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় না।‘
সুতরাং অব্যর্থ শরটি বিফল হলো। সেই ভীষণ শর হুতাশন ও সূর্যের মতো অন্তরীক্ষে উত্তীর্ণ হয়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটালো। কিন্তু অর্জুনের মস্তক ছেদনে সমর্থ হলো না। তাঁর সুবর্ণখচিত মণিহীরক সমলস্কৃত নাগাস্ত্র কেবল অর্জুনের দিব্য কিরীট মহাবেগে চূর্ণ করলো। পূর্বে পুরন্দর অসুরসংহার কালে ঐ কিরীট দিয়েছিলেন। বিপক্ষেরা সেটা দেখলে ভয় পেতো। সাপ সূতপুত্রের শরে প্রবিষ্ট হয়ে সেই কিরীট চূর্ণ করলো।
কর্ণ এতোক্ষণে সেই অশ্বসেন নামের সাপকে দেখলেন। সে বললো, ‘অৰ্জুন আমার মাতাকে বধ করেছিলেন, আমি আজ তাঁর প্রতিশোধ নেবো। তখন তুমি না জেনে প্রয়োগ করেছিলে, সেজন্যই অৰ্জুনের মস্তক ছেদন করতে পারেনি। এখন তো আমাকে দেখলে, এবার প্রয়োগ করো, তাহলে আমি অবশ্যই তাঁকে সংহার করবো। যদি স্বয়ং দেবরাজও ওর রক্ষক হন, তথাপি আমি ওকে যমরাজার রাজধানীতে প্রেরণ করবো।’
তখন কর্ণ বললেন, ‘হে নাগ! কর্ণ কখনো অন্যের বলবীর্য অবলম্বন করে সমরবিজয়ী হয় না, এবং একশত অৰ্জুনকে বধ করতে হলেও এক শর দুবার সন্ধান করে না।’
এরই নাম ক্ষত্রিয়। এরই নাম যোদ্ধা। এই সমরে অর্জুন ভীম বা যুধিষ্ঠির যে সব অসৎ উপায়ে বড় বড় যোদ্ধাদের বধ করেছেন সবই কৃষ্ণের দুর্বদ্ধিতে। নচেৎ অর্জুনের মতো একজন যোদ্ধা একবারের জন্যও কোনো ছলনা ব্যতীত যুদ্ধ জয় করতে পারলেন না কেন? যেমন বিদুরের দুষ্ট প্ররোচনায় যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলিঙ্গা যুধিষ্ঠিরকে নষ্ট করেছে, এখন কৃষ্ণের দুষ্ট প্ররোচনায় অর্জুন তাঁর ব্যক্তিত্বের বিনাশ ঘটিয়েছেন। এবং সেই দুষ্টবুদ্ধির পরবশ হয়েই কৰ্ণ যে সময়ে নিচু হয়ে তাঁর রথের চাকাটা মাটি থেকে তুলতে চেষ্টা করছিলেন, এবং অস্ত্রহীন অবস্থায় ছিলেন, সেই সময়ে কৃষ্ণ যেই বললেন, ‘হে পার্থ কর্ণ রথে আরোহণ না করতেই তুমি অতি দ্রুত ওর মস্তক ছেদন করো, অর্জুন অতীব কাপুরুষের মতো তা-ই করলেন। এখানেও অর্জুন সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন না।