পরের দিন রজনী প্রভাত হলে কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, “আমি ধনঞ্জয় অপেক্ষা যে যে অংশে হীন সেগুলো তোমাকে জানানো কর্তব্য। অর্জুনের সারথি বাসুদেব, কাঞ্চনভূষণ রথ অগ্নিদত্ত ও অচ্ছেদ্য। অশ্বসকল অতি বেগশালী এবং ধ্বজা বিস্ময়কর। হে কুরুরাজ! তুমি দুঃসহবীর্য মদ্ররাজকে আমার সারথি হতে দাও। তোমার নিশ্চয়ই জয়লাভ হবে। শকট সমুদয় আমার যুদ্ধাস্ত্র বহন করুক এবং উৎকৃষ্ট অশ্ব-সংযোজিত রথসকল আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎগমন করুক। এ রকম হলে আমি অর্জুন অপেক্ষা সমধিক হবো। শল্য অপেক্ষা ভুজবীর্যসম্পন্ন আর কেউ নেই। আর আমার তুল্য অস্ত্রযুদ্ধে পারঙ্গমও আর কেউ নেই। অতএব শল্য সারথি হলে আমার রথ অৰ্জুনের রথ থেকেও উৎকৃষ্ট হবে। আমি নিঃসন্দেহে অৰ্জুনকে পরাজিত করবো।’
দুৰ্যোধন বললেন, ‘হেরাধেয়! তুমি যা বললে আমি সেই অনুষ্ঠানই করবো।’
তা অবশ্য করলেন। যদিও শল্য প্রথমে খুবই আপত্তি করেছিলেন। ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার মতো একজন অদ্বিতীয় যোদ্ধা শেষে সূতপুত্রের সারথি হবে?’ দুর্যোধন বিনীত বচনে তাঁকে তুষ্ট করে বললেন, ‘হে মহারাজা! আমি কর্ণকে সূতকূলোৎপন্ন বলে মনে করি না। আমার মতে উনি ক্ষত্রিয়কুলপ্রসূত দেবকুমার এবং মহদগোত্র সম্পন্ন। উনি কখনোই সূতকুলসম্ভব নন। তদ্ব্যতীত, আপনি তো জানেন, ভগবান ব্ৰহ্মাও রুদ্রদেবের সারথ্য স্বীকার করেছিলেন। ফলত, রথী অপেক্ষা সমধিক বলশালী ব্যক্তিকে সারথি করা কর্তব্য। হে মাতুল! আপনি অস্ত্রবিদগণের অগ্রগণ্য, সর্বশাস্ত্রবিশারদ কর্ণকে অবজ্ঞা করবেন না। যার ভীষণ জ্যা নিৰ্ঘোষ শব্দ পাণ্ডব সৈন্যের শ্রবণে প্রবিষ্ট হলে তারা দশদিকে পলায়ন করে, মায়াবী রাক্ষস ঘটোৎকচ আপনারই চোখের সম্মুখে রাত্রিকালে যার মায়াপ্রভাবে নিহত হয়েছে, মহাবীর অর্জুন নিতান্ত ভীত হয়ে এতোদিন যার সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রবৃত্ত হননি, যে মহারথ মহাবল পরাক্রান্ত বৃকোদরকে কামুক দ্বারা সঞ্চালিত করে বার বার মূঢ় ঔদরিক বলে ভর্ৎসনা করেছেন, যিনি নকুল সহদেব যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করে কী জানি কী গূঢ় কারণবশত বিনাশ করেননি, পাণ্ডবরা কী করে সেই মহাবীর কর্ণকে পরাজয় করতে সমর্থ হবেন? আর আপনি সারথি হিশাবে বাসুদেব অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট।’
এইসব নানা বাক্যে দুর্যোধন শল্যকে সন্তুষ্ট করে কর্ণের সারথি করলেন। যুদ্ধে নেমেই কর্ণ পাণ্ডবদের ভীতি উৎপাদন করেছিলেন। এখন আরো দুর্জয় হলেন। পাণ্ডবপক্ষের বহু শত্রুবিনাশ করে, শরাসন হাতে যেন নৃত্য করেই পরিভ্রমণ করতে লাগলেন সমরাঙ্গনে।
শল্যরাজ বললেন, ‘কৰ্ণ, তুমি প্রকৃতই একজন অস্ত্রবিশারদ, যুদ্ধদুর্মদ ও অন্তকের ন্যায় অসহ্য। তুমি অনায়াসে সমরাঙ্গনে শক্রগণকে পরাজিত করতে সমর্থ হবে। শল্যরাজ-মুখনিঃসৃত এই সব বাক্য শ্রবণ করে কর্ণ আনন্দিত হলেন, তাঁর মনে হলো, ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্যের পরে তিনিই পাণ্ডবগণকে পরাজিত করবেন। তাঁর মনে আশা সঞ্জাত হলো।
দুৰ্যোধন বললেন, “আমি তোমার বাক্যানুসারে পিতামহ ও দ্রোণাচার্যকে অতিশয় বীর বলে গণ্য করতাম। কিন্তু ভীষ্ম পিতামহ বলেই দশদিন পাণ্ডুতনয়দের রক্ষা করেছিলেন। দ্রোণাচার্যও শিষ্য বলেই তাদের মারতে পারেননি। হে কর্ণ। এখন তোমার মতো পরাক্রান্ত যোদ্ধা আর কারোকেও নয়নগোচর হয় না। আমি তোমার বলবীর্য ও আমার সোঁহাদ্যের বিষয় সম্যক অবগত আছি। তুমিই পূর্বাপর আমার হিতসাধন করেছো। কৌরবদের সেনাপতি হয়ে, সৈন্যগণকে রক্ষা করে, দৈত্যনিসূদন মহেন্দ্রের মতো শক্রনিপাতনে নিযুক্ত হও।‘
কৰ্ণ বললেন। ‘হে কুরুরাজ! আমি বরাবর তোমাকে বলেছি, পাণ্ডবগণকে তাদের পুত্ৰগণ ও জনার্দনের সঙ্গে পরাজিত করবো। তুমি প্রশান্তচিত্ত হয়ে পাণ্ডবগণকে পরাজিত বলে স্থির করো।’
কর্ণের কথা শুনে দুৰ্যোধন পরম পরিতুষ্ট হলেন। তাঁর মনে পুনরায় জয়ের আশা সঞ্জাত হলো। অনন্তর যুদ্ধ যেভাবে তুমুলরপ ধারণ করলো, কে যে কাকে মারছে তা-ও প্রায় অননুধাবনীয় হয়ে উঠলো।
অবশেষে কর্ণ ও অর্জুন মুখোমুখি হলেন। কর্ণকে অতি উদ্বেল সমুদ্রের মতো গর্জন করে আসতে দেখে কৃষ্ণ বললেন, ‘বন্ধু, আজ যার সঙ্গে তোমার যুদ্ধ করতে হবে, ঐ দ্যাখে তিনি আসছেন। তুমি স্থির হও। সূতনন্দন দুৰ্যোধনের হিতচিকীর্ষীয় শরজাল বর্ষণ করে সমাগত হচ্ছেন। মদ্ররাজ তাঁর রথে অবস্থিত থেকে অশ্বসঞ্চালন করছেন। কর্ণের ধনুকের শব্দে যুদ্ধের অন্য সব শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। সূতপুত্রকে নিরীক্ষণ করে দ্যাখো পাঞ্চালরা কীভাবে পলায়ন করছে। তুমি ভিন্ন আর কেউ কর্ণের বাণ সহ্য করতে সমর্থ নয়।’
অৰ্জুন বললেন, ‘হে সখে! তুমি রথ সঞ্চালন করো। অর্জন কর্ণকে সমরে নিপাতিত না করে কখনো প্রতিনিবৃত্ত হবে না।‘ একথা শুনে অর্জুনের মতো এমন একজন যোদ্ধার প্রতি পুনরায় পাঠকদের বিশ্বাস ফিরে আসে। মনে হয় এবার অর্জুন যা করবেন নিজে করবেন। দুজন প্রায় সমযোদ্ধা মুখোমুখি হচ্ছেন, এবারই বোঝা যাবে কার কতো পারদর্শিতা। এতোক্ষণ তো পাণ্ডবপক্ষীয় এই মহাযোদ্ধাটিকে আমরা যুদ্ধ করতেই দেখলাম না। যে সব মহারথীরা লোকান্তরিত হলেন, তাদের সঙ্গে তো পাণ্ডবগণ যুদ্ধ করেননি, গুপ্ত ঘাতক হয়ে অতি অসৎভাবে হত্যা করেছেন। অন্তত একবারের জন্যও তারা এমন কিছু করুন, যা থেকে মনে করা যায় তারাও যুদ্ধ করতে জানেন। অন্তত অৰ্জুন।