রোষবশে অৰ্জুনের মনের কথা এতোদিনে উচ্চারিত হলো। এই মানুষটির জন্যই তাঁর প্রথম প্রণয় বিনষ্ট হয়েছে। বারো বছর বনবাস করতে হয়েছে। দ্রৌপদীকে তিনি কখন পেলেন? দুঃখ কি ছিলো না সেজন্য? ছিলো। তখনকার দিনে জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে কনিষ্ঠভ্রাতাদের অন্ধভক্তি করারই নিয়ম ছিলো। কিন্তু এই মুহুর্তে সমস্ত বেদনাই বেরিয়ে এসেছে মন থেকে। অর্জুন কিছুতেই তাঁর ক্রোধ সামলাতে পারছিলেন না।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য কৃষ্ণের মধ্যস্থতায় সবই আবার ঠিকঠাক হয়ে গেলো এবং পুনরায় সংগ্রামস্থলে উপস্থিত হলেন অর্জুন, এবং কর্ণ-বিনাশে কৃতসংকল্প হলেন। কৃষ্ণ বললেন, হে অৰ্জুন! তুমি কিন্তু কর্ণকে অবজ্ঞা করো না। মহারথ সূতপুত্র মহাবল পরাক্রান্ত। সুশিক্ষিত কার্যকুশল বিচিত্র যোদ্ধা, এবং কীরূপ স্থানে, কী রকম কালে, যুদ্ধ কর্তব্য সে বিষয়ে অভিজ্ঞ। আমি সংক্ষেপে তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি, তুমি মন দিয়ে শোনো। ঐ বীর আমার মতে, হয়তো বা তোমাপেক্ষা সমধিক বলশালী হবে। অতএব খুব সতর্কভাবে তাঁকে সংহার করা কর্তব্য। কর্ণ তেজে হুতাশসঙ্কাশ, বেগে বায়ুসদৃশ, ক্রোধে অন্তকতুল্য। ঐ বিশালবাহুশালী বীরবরের দৈঘ্যও যেমন, সে রকম বক্ষঃস্থলও অতি বিস্তৃত। এবং সে নিতান্ত দুর্জয়, অভিমানী, প্রিয়দর্শন, যোদ্ধৃগণে সমলঙ্কৃত, মিত্রগণের অভয়প্রদ, পাণ্ডবগণের বিদ্বেষী ও ধার্তরাষ্ট্রদিগের হিতানুষ্ঠানে নিরত। তাঁকে বিনাশ করা অতি কঠিন। অদ্য যুদ্ধের সপ্তদশ দিন। যাবতীয় পাণ্ডব ও সমাগত অন্যান্য নৃপতিরা তোমাকে আশ্রয় করেই অবস্থান করছেন। কৌরব পক্ষে এখনো অশ্বথামা, কৃতবৰ্মা, কর্ণ, মদ্ররাজ আর কৃপাচার্য এবং পাঁচজন মহারথী উপস্থিত আছেন।‘
অৰ্জুন বললেন, ‘তুমি যখন আমার সহায় তখন আমার জয়লাভ হবেই। এখন আমি সূতপুত্রে আশঙ্কিতচিত্তে সমরাঙ্গনে সঞ্চারণ করতে নিরীক্ষণ করছি।‘
এদিকে শল্য কর্ণকে বললেন, ‘হে রাধেয়! তুমি যার অনুসন্ধান করছে, ঐ দাখো, সে রোষারক্ত নয়নে মহাবেগে আমাদের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। কৌরবগণ এই মহাসাগরে দ্বীপের মতো তোমার আশ্রয় গ্রহণ করেই অবস্থান করছেন। তুমি যে রকম ধৈর্যসহকারে বৈদেহ কাম্বোজ নগ্নজিৎ ও গান্ধারগণকে পরাজিত করেছো, সেই রকম ধৈর্য অবলম্বন করেই স্বীয় পুরুষকার প্রকাশ করে অর্জুন ও বাসুদেবের দিকে গমন করো।‘
কর্ণ বললেন, ‘হে মদ্ররাজ! তুমি এতোদিন আমাকে তোমার বাক্যশল্যেই বিদ্ধ করেছো। কিন্তু আজ তোমার ব্যবহারে আমার মন শান্ত হয়েছে। তুমি চিন্তা করো না। ধনঞ্জয় থেকে তোমার কিছু মাত্র ভয় নেই। আজ আমি কৃষ্ণ ও অর্জুনকে বধ না করে রণাঙ্গন ছাড়বো না। আমি জানি অৰ্জুনের মতো যোদ্ধা আর কেউ নয়। অর্জুন শরযুদ্ধে আর কৃষ্ণ চক্রযুদ্ধে অতিশয় নিপুণ। এখন আমি ব্যতিরেকে আর কে ওদের নিকট যুদ্ধার্থে অগ্রসর হবে?
ইতিমধ্যে অর্জুন আরো অনেক কৌরব নিষ্পিষ্ট করলেন, কর্ণও অনেক পাণ্ডবসৈন্যকে নিহত করলেন। ভীমের সঙ্গে দুঃশাসনের যুদ্ধ হচ্ছিলো। এই ভীমকে পরাজিত করেও কর্ণ প্ৰাণে মারেননি। যদি মারতেন, যুদ্ধ প্রায় সেখানেই সমাপ্ত হতো। সেই ভীম দুঃশাসনকে পরাজিত করে মেরে ফেললেন। তারপর তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে ঈষদুষ্ণ রক্তপান করতে করতে বললেন, ‘মাতৃদুগ্ধ ঘৃত মধু সুরা, সুবাসিত উৎকৃষ্ট জল, দধি দুগ্ধ এবং উত্তম ঘোল, প্রভৃতি সকল অমৃততুল্য সুস্বাদু যতো পানীয় আছে, আজ এই রক্ত আমার সর্বাপেক্ষা সুস্বাদু বোধ হচ্ছে ঐ সময়ে যে সকল বীর সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারা ভয়ে আর্তনাদ করে বলতে লাগলেন, ‘এ ব্যক্তি মনুষ্য নয়, নিশ্চয়ই রাক্ষস।‘
কৰ্ণ হয়তো তখন মনে মনে ভেবেছিলেন কুন্তীর মতো গর্ভধারিণীর গর্ভে জন্মধারণ করে তাঁর সমস্তটা জীবন শুধু অপমানে অসম্মানে ওলোটপালোটই হয়েছে। তবে কুন্তী নামের সেই মহিলার কাছে তিনি কেন এই কথা দিলেন, “আপনার পঞ্চপুত্র পঞ্চপুত্রই থাকবে? আর আমরা ভাবি, কথা দিলেও রক্ষা করবার কী প্রয়োজন ছিলো? যাদের সঙ্গে তিনি আজ যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ, তারা তো একের পর এক মহারথীকে কেবলমাত্র শঠতাঁর দ্বারাই হত্যা করেছেন। যুধিষ্ঠিরকে বা কেন তিনি মারলেন না? তাঁর মিথ্যাবাক্যই তো তাদের পিতৃতুল্য গুরু দ্রোণাচার্যকে পুত্ৰশোকে বিচেতন করলো, আর সেই বিচেতন অবস্থাতেই যুদ্ধের কোনো নিয়ম পালন না করে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর মুগুচ্ছেদন করলো। আর তা নিয়ে বীভৎস উল্লাস! যুদ্ধ শেষ হবার পরে অসতর্ক জয়দ্রথের মস্তক ছিন্ন করা হলো। এদের সঙ্গে তিনি কোন মঞ্চে দাঁড়িয়ে ন্যায়যুদ্ধ করবেন? এখানে যুদ্ধ কোথায়? এটা তো যুদ্ধ নয়। কেন ধর্মযুদ্ধের নামে এতোগুলো প্রাণ বিনষ্ট হলো? তাঁর চেয়ে যে ভাবে জরাসন্ধকে নিহত করেছে, সে ভাবে ছদ্মবেশে লুকিয়ে যে কোনোদিন যে কোনো মহারথীকে পিঠে ছুরি মেরেই তো পালিয়ে আসতে পারতো পাণ্ডবরা। যে মহিলাকে তিনি শ্রদ্ধা করেন না, তাঁর সঙ্গে বাক্য-বিনিময় না করলেই ভালো হতো। সত্যি বলতে, কুন্তীর কাছে দেওয়া এই অর্থহীন প্রতিশ্রুতির কাছে কৰ্ণ দায়বদ্ধ না থাকলে পাণ্ডবদের পক্ষে কখনোই যুদ্ধ জয় সম্ভব হতো না। যুধিষ্ঠিরের মৃত্যু অবধারিত ছিলো।
যুধিষ্ঠির কি রাজা হবার যোগ্য? যিনি রাজা তিনিই যদি যুদ্ধস্থল থেকে পালিয়ে যান, তবে তাঁকে কী ভাবে রাজা বলা যায়? অন্যদিকে দুর্যোধন সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত, অর্থাৎ যতোক্ষণ যুদ্ধ চলে, একবারের জন্য বিশ্রাম নেন না, শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নেন না। নিজ দলের একটি মানুষকেও তিনি ছেড়ে চলে আসেন না। কে জানে আজ কর্ণের ভাগ্যে কী আছে। তাঁকেও যে আর সব মহারথীদের মতো অর্জুনকে দিয়ে কৃষ্ণ সুযোগমতো খুন করাবেন না, তা-ও কি কেউ বলতে পারে?