রণক্ষেত্র থেকে মহাত্মা যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ পালিয়ে বাঁচলেন।
অৰ্জুন কৃষ্ণকে বললেন, ‘ঐ দাখো, সূতনন্দন কালান্তক যমের মতো ক্রুদ্ধ হয়ে রণস্থলে নিদারুণ কার্য সম্পাদন করে বারংবার আমার প্রতি কটাক্ষ নিক্ষেপ করছে। এখন কর্ণকে পরিত্যাগ করে পলায়ন করা আমার নিতান্ত অকর্তব্য।’
কৃষ্ণ রণস্থল থেকে অর্জুনকে সরিয়ে নিতে নিতে বললেন, হে পার্থ রাজা যুধিষ্ঠির কর্ণবাণে নিতান্ত নিপীড়িত হয়েছেন। তুমি সর্বাগ্রে তাঁকে দর্শন ও আশ্বাস প্রদান করে পরে কর্ণকে নিপীড়িত করবে।’
এর মধ্যে অর্জুন ভীমকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে মহাত্মন! এখন ধর্মরাজ কোথায়?
ভীম বললেন, ভ্রাতঃ ধৰ্মনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির সূতপুত্রের শরনিকরে সন্তপ্ত হয়ে এখান থেকে চলে গেছেন। তিনি জীবিত আছেন কিনা সন্দেহ।’
তখন অর্জুন ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে তিনি সূতপুত্রের শরনিকরে গাঢ়তর বিদ্ধ হয়ে শিবিরমধ্যে প্রবেশ করেছেন। পুর্বে তিনি দ্রোণাচার্যের নিশিত শরে বিদ্ধ হয়েও বিজয়লাভ প্রত্যাশায় সংগ্রামস্থল ছেড়ে যাননি। আজ যখন তাঁকে সংগ্রামস্থলে দেখছি না, তখন কর্ণের সঙ্গে সংগ্রামে নিশ্চয়ই তাঁর প্রাণসংশয় উপস্থিত হয়েছে। অতএব চলো, অবিলম্বে তাঁর কাছে যাই।‘
অন্য কোনো কারণে নয়, যে কুন্তীকে তিনি আদৌ শ্রদ্ধা করেন না, তাঁর কাছে দেওয়া বাক্য রক্ষার্থেই অবধারিত জয়কে উপেক্ষা করে, ভীম ও যুধিষ্ঠিরকে ছেড়ে দিয়েছিলেন কর্ণ। তাঁর মহত্ত্বের কোনো তুলনা নেই। বাক পৃথিবীর আদি সত্য। সেই সত্যরক্ষাই কর্ণের চরিত্রের মহত্তম বস্তু, তাঁর ধর্ম। এই প্রসঙ্গে দুর্যোধনকেও কৃতিত্ব দেওয়া আবশ্যক। কারণ যুদ্ধটা রাজার আদেশে এবং আদর্শেই চলে। কৌরবপক্ষে অসৎ রণনীতি অনুসরণের দৃষ্টান্ত বিরল। দুৰ্যোধনসহ প্রতিটি অবধ্য বীরকে কৃষ্ণের প্ররোচনায় পাণ্ডবেরা অন্যায় যুদ্ধে হত্যা করেছে।
কৃষ্ণ ভীমকে সংশপ্তকগণকে সংহার করতে বলে বেগগামী অশ্বগণকে সঞ্চালন করে অতি দ্রুত অৰ্জুনকে নিয়ে রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন। দেখলেন তিনি একাকী শায়িত। এবং ভালোই আছেন। তাদের দেখে যুধিষ্ঠির আহ্লাদিত হয়ে অভিনন্দন করলেন। বললেন, ‘হে কৃষ্ণ! হে ধনঞ্জয়! তোমাদের দেখে অতিশয় প্রীতিলাভ হচ্ছে। তোমরা অক্ষত শরীরে কর্ণকে নিহত করেছো। মহাবীর সূতপুত্র সমরাঙ্গনে আশীবিষ সদৃশ ও সমস্ত শস্ত্রপারদর্শী কৌরবগণের বর্ম। ঐ বীর পরশুরামের নিকট দুর্জয় অস্ত্রপ্রাপ্ত হয়েছে। কর্ণ সতত কৌরবগণের রক্ষক হয়ে শক্রদের মর্দন করছে এবং সর্বদাই দুর্যোধনের হিতসাধনে তৎপর। তোমরা ভাগ্যক্রমে সেই অনলের মতো তেজস্বী, বাতাসের মতো বেগশালী, আমার মিত্ৰগণের অন্তকস্বরূপ মহাবীরকে বিনষ্ট করে আমার কাছে এসেছে। সে সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন নকুল সহদেব শিখণ্ডী ও পাঞ্চালগণকে পরাজিত করে, তাদের সমক্ষেই আমার রথধ্বজ ছিন্ন করে, অশ্বগণকে নিহত করে, আমাকে পরাজিত করে, সমরাঙ্গনে আমাকে অনুসরণ করে অনেক পরুষবাক্য প্রয়োগ করেছে। কর্ণকৃত অপমান আমার নিতান্ত অসহ্য বোধ হচ্ছে। আমি এই লোকটির ভয়ে তেরো বৎসর নিদ্রিত হতে পারিনি, সুখী হতে পারিনি। আজ অবশ্য সে আমাকে মারেনি, কিন্তু পরাজিত করে উপহাস করেছে। কী ভাবে তোমরা তাঁকে মারলে সে কথা আমাকে অবগত করাও। কী ভাবে সূতনন্দনের মস্তকচ্ছেদ করলে?’
যখন শুনলেন কর্ণকে নিপাত না করে অর্জুন তাঁকে দেখতে এসেছেন, তখন তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। বললেন, “আমি রাজ্যলাভে একান্ত লোলুপ। হে ধনঞ্জয়! বীজ যেমন মেঘের উপর নির্ভর করে, তদ্রুপ আমরা কেবল রাজ্যলাভের আশায় তোমার উপরই নির্ভর করেছিলাম। দুৰ্যোধনের উন্নতি বিষয়ে আমি অণুমাত্র প্রত্যাশা করিনি, এবং তুমি যে সূতপুত্রকে দেখে ভীত হবে আমার মনে কখনও এরকম বিশ্বাস হয়নি। বিশেষ বাসুদেব তোমার সারথি হয়েছেন, তথাচ তুমি সূতপুত্রের ভয়ে ভীত হয়ে রণস্থল থেকে প্রত্যাগমন করলে। এখন তুমি বাসুদেবকে গান্ধব শরাসন প্রদান করো। তুমি সমর পরিত্যাগপূর্বক পলায়ন করা অপেক্ষা পঞ্চম মাসে গর্ভস্রাবে বিনষ্ট হলে না কেন? হে দুরাত্মা! এখন তোমার গান্তবে ধিক বাহুবীর্যে ও অসংখ্য শরনিকরেও ধিক!’
এভাবে অন্যায় তিরস্কারে অর্জুন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে অসিগ্রহণ করলেন। কৃষ্ণ অতি সত্বর বাধা দিলেন। অর্জুন যুধিষ্ঠিরের প্রতি দৃষ্টিপাত করে ক্রুদ্ধ সৰ্পের মতো নিশ্বাস ত্যাগ করে বললেন।“তুমি অন্যকে গাওঁব সমর্পণ করো” এই কথা যিনি আমাকে বলবেন, আমি তাঁর মস্তকছেদন করবো, এই আমার গুপ্ত প্রতিজ্ঞা। হে রাজা! তুমি রণস্থল থেকে একক্রোশ অন্তরে অবস্থান করছো, আর তিরস্কার করছো আমাকে। তোমার তো সে অধিকার নেই-ই, বললে বলতে পারেন ভীম। ঐ মহাবল একাকী দুর্যোধনের চতুরঙ্গ বল প্রমথিত করে অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ নিষাদ মাগধ এবং অন্যান্য শক্রগণের প্রাণসংহার করেছেন। শিখণ্ডী ভীমের সঙ্গে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হলে আমিই তাঁকে রক্ষা করেছিলোম, নচেৎ দ্রুপদতনয় কদাচ তাঁকে সংহার করতে পারতো না। আমি স্ত্রী পুত্র শরীর ও জীবন পর্যন্ত পণ করে তোমার হিতার্থে যত্নবান থাকি, তথাপি তুমি আমাকে বাক্যবাণে নিপীড়িত করছো। আমি তোমার জন্য মহারথগণকে নিহত করেছি, আর তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে দ্রৌপদীর শয্যায় শয়ন করে আমার অবমাননায় প্রবৃত্ত হয়েছো। তুমি নিতান্ত নিষ্ঠুর তোমার নিকট কখনো কোনোদিন সুখী হতে পারিনি। তুমি অক্ষত্ৰীড়ায় আসক্ত হয়ে, স্বয়ং ঘোরতর অধৰ্মানুষ্ঠান করে, এখন আমাদের প্রভাবে শক্রদের পরাজিত করতে অভিলাষ করছো। আমি তোমার রাজ্যলোভে বিন্দুমাত্র সন্তুষ্ট নই। তোমার অক্ষত্রীড়া বিষয়ে সহদেব অনেক দোষ কীর্তন করেছিলো, বুঝিয়েছিলো। তুমি কি সে কথা শুনেছো? আজ আমরা কার পাপে এই দুঃখের সাগরে নিপতিত? তোমার অপরাধেই আজ এই যুদ্ধ, এতো মনুষ্যের ছিন্নগাত্র ভূমিতলে পতিত কৌরব বংশ আজ কার জন্য নির্মুল হতে চলেছে? তোমার জন্য। তোমার দোষেই প্রাচ্য-প্রতীচ্য-উদীচ্য-দাক্ষিণাত্যগণ নিহত হে রাজন! তুমি দূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হয়েছিলে, তোমার জন্যই আমাদের রাজ্যনাশ ও অসহ্য দুঃখ উপস্থিত হয়েছে।‘