কৃষ্ণের কুটিল পরামর্শে হীনকর্ম এখানেই শেষ নয়, আরো আছে, যা আরো বীভৎস। পাঠকদের মনে থাকতে পারে চতুর্দশ দিনের যুদ্ধে অর্জুনের প্রতিজ্ঞা ছিলো সূর্যাস্তের পূর্বেই তিনি জয়দ্রথকে বধ করবেন। তা তিনি পেরে ওঠেননি। যখন সূর্য অস্ত গেলো এবং জয়দ্রথ যখন যুদ্ধ শেষ জেনে উর্ধ্বমুখী হয়ে আকাশের দিকে তাকালেন, এই সময় কৃষ্ণ বললেন, ছিলনা ভিন্ন জয়দ্রথকে বধ করা যাবে না, এই সুযোগ, জয়দ্রথকে তুমি বধ করো। অর্জুন জয়দ্রথের প্রতি ধাবিত হলেন এবং কৃষ্ণের পরামর্শে তাঁর শিরচ্ছেদ করলেন। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণ বললেন, ‘এইবার এই কাটা মুণ্ড জয়দ্রথের বৃদ্ধ পিতা বুদ্ধক্ষত্রের ক্রোড়ে ফ্যালো।‘ অর্জুন তাই করলেন। বুদ্ধক্ষত্র তখন সন্ধ্যাবন্দনা করছিলেন, সহসা কৃষ্ণকেশ ও কুণ্ডলে শোভিত জয়দ্রথের ছিন্নমুণ্ড তাঁর ক্রোড়ে পতিত হতেই তিনি সচমকে অতি দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন, পুত্রের ছিন্নমস্তক দর্শনে তাঁরও মৃত্যু ঘটলো।
আরো আছে। কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন পিছন থেকে সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধরত ভূরিশ্রবার দক্ষিণ হস্ত কেটে ফেললেন। কেননা সাত্যকি ভূরিশ্রবার কাছে হেরে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধের মধ্যে নিয়ম বহির্ভূত এই অপকর্ম দেখে ভূরিশ্রবা অত্যধিক ক্ষুব্ধ হলেন। বললেন, ‘অৰ্জুন, তুমি অত্যন্ত গৰ্হিত ও নৃশংস কর্ম করলে। আমি অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে রত ছিলাম, সেই সময়ে তুমি এই কাজ করলে? যুদ্ধের এই শিক্ষা তোমাকে কে দিয়েছে? অন্ধক বংশের লোকজন সবাই ব্রাত্য, নিন্দার্হ কর্ম করাই তাদের স্বভাব। আমি জানি সেই বংশজাত কৃষ্ণের আদেশেই তুমি এই অন্যায় কর্মে প্রভাবিত হয়েছো। তাঁর কথা তুমি শুনলে কেন? তোমার নিজের ধর্মবোধ কি তোমাকে বিরত করতে পারলো না? এই বলে তিনি প্রায়োপবেশনে বসলেন এবং যোগস্থ হলেন মৃত্যুর জন্য।
দ্রোণের মৃত্যুর পর দুর্যোধন কর্ণকেই আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাপতিত্বে বরণ করেছিলেন। কিন্তু ভীমের যুদ্ধবিরতির পর থেকেই কর্ণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছিলেন। কৃষ্ণের প্রথম থেকেই এই লোকটিকে ভয়। তিনি বুঝেছিলেন কর্ণ আর অর্জুনের সম্মুখ যুদ্ধ হলে অর্জুন কখনোই জিততে পারবেন না। পাঠকরা জানেন, সে জন্য নানা কৌশলে কর্ণকে নিজেদের দলে এনে ফেলার অনেক চেষ্টাই তিনি করেছিলেন। কিন্তু সেই মনোরথ তাঁর পূর্ণ হয়নি। তারপরে কর্ণের স্বার্থপর মাতা কুন্তীও গিয়েছিলেন সেই অভিপ্রায় নিয়ে তা-ও তাঁকে টলানো যায়নি। শুধু বলেছিলেন, ‘অৰ্জুন ব্যতীত আর কারোকে আমি প্রাণে মারবো না। আমি অর্জুনের সঙ্গেই যুদ্ধ করতে চাই। তাঁর ফলে হয়তো আমার মৃত্যু ঘটবে অথবা তাঁর। আপনার পঞ্চপুত্র পঞ্চপুত্রই থাকবে।
ভীমের সঙ্গে যখন তাঁর যুদ্ধ হচ্ছিলো, তখন কর্ণ ভীমকে নিদারুণ ব্যাকুল ও বারবার অভিভূত করতে লাগলেন। কিন্তু সহসা কুন্তীর বাক্য স্মরণ করে ভীমসেনের প্রাণসংহার করতে পারলেন না। বললেন, “ওহে তুবরক! তুমি মূঢ় রণস্থল তোমার উপযুক্ত স্থান নয়। যে স্থানে বহুবিধ ভক্ষ্য, ভোজ্য ও পানীয় আছে, তুমি সেই স্থানেরই যোগ্য। এই ধরনের সব উপহাস করে ভীম তরুণ বয়সে যে সকল অপ্রিয় কার্যের অনুষ্ঠান করেছিলেন, সে কথাও তাঁর কর্ণগোচর করতে লাগলেন। তারপর ধনুষ্কোটি দ্বারা স্পর্শ করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার সদৃশ ব্যক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে এইরূপ বা সেইরূপ অবস্থাও ঘটে। অতএব যেখানে কৃষ্ণ ও অর্জুন বিদ্যমান আছেন, তুমি সেখানেই যাও। তারা তোমাকে রক্ষা করবেন।‘
কৰ্ণ কেবলমাত্র ভীমকেই যে প্রাণে মারলেন না তাই নয়। যুধিষ্ঠিরও একবার এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর অপটু বীরত্ব নিয়ে। তাঁকেও কর্ণ প্রাণে মারলেন না। কোনো লোভই যেমন তাঁকে বন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করাতে সমর্থ হলো না, তেমনি কুন্তীর নিকট কথা দিয়েছিলেন বলে ভীমকে পরাজিত করেও প্রাণে মারলেন না, যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করেও প্রাণে মারলেন না। কুবুদ্ধিতে কৃষ্ণ যতো পটু, সৎবুদ্ধিতে কর্ণ ততোই মহান। অবশ্য কুরুপক্ষে এমন কেউ নেই, যিনি যুদ্ধ করতে এসে যুদ্ধ না করে, যুদ্ধের নিয়ম ভেঙে, মিথ্যাচারের সাহায্যে শত্রু বধ করে, নিজেকে নীচাশয়ের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ভীষ্ম দ্রোণ জয়দ্রথের মতো সব মহারথীকে কৃষ্ণ যেভাবে হত্যা করিয়েছেন অর্জুনকে দিয়ে, তাঁর চাইতে অধিক কাপুরুষোচিত নীচকর্মসিদ্ধির কলঙ্ক আর কারো নামেই নেই।
কর্ণ যুদ্ধে নেমেই পাণ্ডবদের একেবারে উথালপাথাল করে তুলেছিলেন। পাণ্ডব সৈন্যরা ভয়ার্ত হয়ে পালাতে লাগলো। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, ‘কর্ণের ভার্গবাস্ত্রের শক্তি দ্যাখো, আমি কোনো রকমেই এই অস্ত্র নিবারণ করতে পারবো না। কিন্তু কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ না করে পালাতেও পারবো না।‘
কৃষ্ণ বললেন, ‘রাজা যুধিষ্ঠির কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। প্রথমে তাঁর কাছেই তোমার যাওয়া উচিত। এখন সেখানে চলো তো, তারপর ফিরে এসে যা হয় হবে।’
আসলে একথা বললেন অর্জুনকে বাঁচাবার জন্যই। আপাতত কর্ণকে যুদ্ধে নিযুক্ত রেখে ক্লান্ত করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো। সেজন্যই এই অজুহাতে অৰ্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিনি সরিয়ে নিলেন।
কর্ণের দ্বারা প্রকৃতই যুধিষ্ঠির কিঞ্চিৎ ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন। কর্ণ তাঁকে মারেননি, কিন্তু উপহাস করতেও ছাড়েননি। কর্ণ উপহাস করে তাঁর পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘হে পাণ্ডুনন্দন! তুমি ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করেও ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন না করে প্রাণভয়ে সমর পরিত্যাগ করে পলায়ন করছে কেন? আমার মনে হয় তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম অবগত নও। যুদ্ধ করা তোমার কর্ম নয়। এখন সংগ্রাম ইচ্ছা পরিত্যাগ করো, বীরপুরুষদের কাছে আর যেও না, কোনো অপ্রিয় কথাও বোলো না।‘