পাঠকদের অবশ্যই মনে আছে যুধিষ্ঠির দ্রোণের মৃত্যুর গুহ্য তথ্যও সংগ্রহ করে এনেছিলেন। সেই পথেই কৌশল করে পা ফেলতে কৃষ্ণ উপদেশ দিলেন। কৃষ্ণের অন্তরে কোনো বিবেকবোধ ছিলো না, ষড়যন্ত্র ব্যতীত তিনি জরাসন্ধকেও জয় করতে পারেননি, শিশুপালকেও নিধন করতে পারেননি। এই যুদ্ধেও তিনি অর্জুনকে দিয়ে সেভাবেই জয়ের পথ পরিষ্কার করতে চাইলেন। বললেন, ‘শোনো, যা বোধ হচ্ছে, দ্রোণ আজ সকলকেই বিনাশ করবেন। তুমি বলো তাঁর পুত্র সংগ্রামে নিহত হয়েছে।’
কৃষ্ণ অমৃতবাক্য উচ্চারণেও যেমন বিমুখ নন, তেমনি যে কোনো হীনকর্ম করতেও দ্বিধাহীন। কৃষ্ণের যাদুবলে মোহচ্ছন্ন অৰ্জুন কিন্তু এই মিথ্যা উক্তিতে কোনো রকমেই সম্মত হলেন না। দ্রোণ বলেছিলেন, হাতে ধনুর্বাণ থাকলে তিনি দেবগণেরও অজেয়। কিন্তু যদি অস্ত্র ত্যাগ করেন, তবে মানুষও তাঁকে বধ করতে পারে। দ্রোণ অতিশয় পুত্রবৎসল, তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনলে শোকে বিহবল হয়ে অবশ্যই তিনি অস্ত্রত্যাগ করবেন, আর তখনি তাঁকে নিহত করা যাবে।
অৰ্জুনকে সম্মত করা গেলো না, কিন্তু সত্যবাদী’ যুধিষ্ঠির সম্মত হলেন। মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বথামা নামে একটি হাতি ছিলো। ভীম তাঁকে গদাঘাতে সংহার করে দ্রোণের কাছে গিয়ে বললেন, “অশ্বথামা হত হয়েছেন। ভীমসেনের কাছে অশ্বথামা হাত হয়েছেন শুনে তিনি বিমনা হলেন, কিন্তু বিশ্বাস হলো না। তখন তিনি একান্ত ব্যথিত হৃদয়ে যুধিষ্ঠিরকে স্বীয় পুত্র নিহত হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। প্রচারের দক্ষতায় তিনি চিরদিন শুনে এসেছেন যুধিষ্ঠির সত্যবাদী। তাঁর মনে হলো যুধিষ্ঠির ত্রিলোকের ঐশ্বৰ্যলাভ হলেও কদাচ মিথ্যাবাক্য উচ্চারণ করবেন না। সেজন্যই আর কারোকে জিজ্ঞাসা না করে যুধিষ্ঠিরকেই জিজ্ঞাসা করলেন। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘দ্রোনাচার্য রোষবশ হয়ে আর দেড়দিন যুদ্ধ করলেই আপনার সমস্ত সৈন্য বিনষ্ট হবে। শান্তনুর সিংহাসনে কোনোদিন আর বসবার সুযোগ হবে না। আপনি মিথ্যা বলে ত্ৰাণ করুন।‘
প্রথমে ভীম বলেছিলেন, ‘হে ব্ৰাহ্মণ অশ্বথামা বিনষ্ট হয়েছেন। তবে আর কেন আপনি যুদ্ধ করছেন? যুধিষ্ঠির রাজ্যের লোভে মিথ্যে কথাটাই বললেন। ‘অশ্বথামা হত’ এই বাক্য দুটি খুব জোরে বললেন। তারপর অস্ফুটে বললেন, ‘ইতি কুঞ্জর।‘ সেটা শোনা গেলো না।
দ্ৰোণ যখন যুধিষ্ঠিরের কথা বিশ্বাস করে পুত্ৰশোকে অত্যধিক কাতর হয়ে অশ্বথামার নাম উচ্চারণ পুর্বক উচ্চৈঃস্বরে ক্ৰন্দন করে উঠলেন, এবং রথোপরি সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র সন্নিবেশিত করে অস্ত্রত্যাগী হয়ে বিচেতন হলেন, যুধিষ্ঠির বলতে লাগলেন, ‘শীঘ্ৰ তোমরা দ্ৰোণাভিমুখে ধাবমান হও, এই সুযোগ।’
যুধিষ্ঠিরের আদেশে ধৃষ্টদ্যুম্ন তখন ঐ রকম বিচেতন অবস্থাতেই তাঁকে রথ থেকে নিপাতিত করলেন, কেশাকর্ষণ করে অসিদণ্ড দিয়ে মস্তক ছেদন করলেন। তারপর গুরুর প্রকাণ্ড মস্তক নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠে তরবারি বিঘুর্ণিত করে সিংহনাদ করলেন। যুধিষ্ঠির এবং ভীম আনন্দে আত্মহারা হলেন। অচেতন অবস্থায় গুরুহত্যার এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে অর্জুন ক্ষুব্ধ হলেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে তিরস্কার করে বলে উঠলেন, “হে মহারাজ! দ্রোণাচার্য সৌহার্দ্যবশত ও ধর্মানুসারে আমাদের পিতার তুল্য ছিলেন। তিনি আপনাকে শিষ্য ও সত্যপরায়ণ বলে জানতেন। বিশ্বাস করতেন আপনি তাঁকে কখনো মিথ্যা বলবেন না। গুরু কেবল আপনার বাক্য শ্রবণেই ন্যস্তশস্ত্র হয়ে ভগ্ননৌকার ন্যায় আপনার সম্মুখেই বিহবলতাবশত গতচেতন হলেন, আর আপনি রাজ্যলালসায় শিষ্য হয়েও সেই পুত্ৰশোকসন্তপ্ত গুরুকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করে হৃষ্টচিত্ত হচ্ছেন? আমি বারবার আপনাকে মিথ্যাকথা বলতে নিষেধ করেছিলোম, তুচ্ছ রাজ্যলোভে তথাপি আপনি লঘুচিত্ত ও অনার্যের মতো স্বধৰ্ম পরিত্যাগ করে নিতোপকারী যোগারূঢ় বৃদ্ধ আচার্যের প্রাণ সংহার করলেন? ধিক জীবনে আর প্রয়োজন কী? মরণই শ্রেয়। এই বয়সে কতোদিন আর রাজত্ব ভোগ করবেন?’
লক্ষণীয়, অৰ্জুন যতোবার যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করছেন, ততোবার তাঁকে রাজ্যলোলুপ বলছেন। প্রকৃতপক্ষে দ্রোণাচার্যকে যেভাবে বধ করা হয়েছে, এবং তাঁর কাটা মুণ্ডু নিয়ে যে রকম বীভৎস উল্লাসে যুধিষ্ঠির ভীম নৃত্য করেছেন, সেই দৃশ্য দেখা যে-কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষেই অসহ্য। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর প্রমাণও পাওয়া গেছে। প্রত্যেকেই এই অপকর্মের নিন্দা করেছে, ধিক্কার দিয়েছে। কৈশোরকাল থেকে দ্রোণাচার্য এদের গুরু। এদের তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন এবং অর্জুনের প্রতি পক্ষপাত তাঁর অনিরুদ্ধ ছিলো। যুধিষ্ঠির যদি ক্ষত্রিয়ের মতো ন্যায়যুদ্ধে জয়ী হতেন, বীরের মতো সংহার করতেন, তা হলে উল্লসিত হবার কারণ ঘটতে পারতো। তা তিনি করেননি। মিথ্যে কথা বলে একটা অচৈতন্য মানুষের গলা কেটেছেন, আর তা নিয়ে লজ্জা নেই, দুঃখ নেই, আনন্দে নৃত্য করছেন। কয়েকদিন পূর্বে ভীষ্মকেও ঠিক একইভাবে শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে পিছন থেকে অনবরত বাণবিদ্ধ করেছেন অৰ্জুন। সম্মুখে দাঁড়িয়ে শিখণ্ডীও সমানে বাণ বর্ষণ করে গেছেন এবং জেনেছেন তিনি তাঁকে যতো বাণেই বিদ্ধ করুন না কেন, ভীষ্ম তাঁকে মারবেন না। অর্জুনকে মারবেন না। স্বধর্মে নিরত থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তারা জেতেননি। স্বধর্মে নিরত ছিলেন বলে দুর্যোধন হেরেছেন। মহাভারতে ধর্মের কোণ জয় নেই। ন্যায়ের কোনো স্থান নেই, সত্যের কোনো দাম নেই, বিবেকের কোনো দংশন নেই।