ভীমের পতন কুরুপাণ্ডব সকলের নিকটই অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা। এঁরা সবাই তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, দ্রোণাচার্যকে তিনিই তাঁদের অস্ত্রশিক্ষায় শিক্ষিত করবার জন্য সসম্মানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন। তারা যাতে সেই শিক্ষায় বড়ো হয়ে ওঠেন, বীরত্বে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হন, তাদের প্রশংসা যেন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে, এটাই ছিলো তাঁর ঐকান্তিক প্রার্থনা। সকলের চক্ষুই সজল হয়ে উঠলো। সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে অর্জুনের শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভীষ্ম পূর্বদিকে মাথা রেখে রথ থেকে পতিত হলেন। হায় হায় করে উঠেছিলো সবাই ভীষ্ম বললেন, ভূতলে পতিত থেকেই আমি উত্তরায়ণের প্রতীক্ষায় প্রাণ ধারণ করবো।’
বলাই বাহুল্য, কৌরবগণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেন। কৃপ দুৰ্যোধন প্রভৃতি রোদন করতে লাগলেন, যুদ্ধে আর তাদের মন গেলো না। ওদিকে, এইরকম দুর্জয় অন্যায়ভাবে কাপুরুষের মতো প্রতিযোদ্ধাহীন যুদ্ধ করে লজ্জিত না হয়ে পাণ্ডবগণ সিংহনাদ করতে লাগলেন। দুঃশাসনের মুখে ভীমের পতনসংবাদ শুনে দ্রোণ মূৰ্ছিত হলেন। সংজ্ঞালাভ করে সৈন্যদের যুদ্ধ থেকে বিরত করলেন।
মহাভারতের মহারণ্যে – ২.১০
রাজার ধর্ম ত্যাগ করে কর্ণ ভীষ্মের কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাণ্ডব সৈন্যগণ মধ্যে তখন সহস্র তুর্য বাজতে লাগলো, ভীম মহা আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন। যখন রাত একটু গভীর হলো, সকলে নিজ নিজ শিবিরে ফিরে গেলেন, তখন কর্ণ কিঞ্চিৎ ভীতভাবে ভীমের কাছে এলেন এবং তাঁর চরণে মাথা রেখে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘কুরুশ্ৰেষ্ঠ, আমি রাধেয় কর্ণ। কোনো অপরাধ না করেও আমি আপনার বিরাগভাজন।
চক্ষু উন্মলিত করতে কষ্ট হচ্ছিলো ভীমের সবলে উন্মলিত করে দেখলেন কেউ নেই। রক্ষীদেরও তিনি সরিয়ে দিলেন। তারপর এক হস্তে কর্ণকে পিতার ন্যায় আলিঙ্গন করে সস্নেহে বললেন, ‘আমি জানি তুমি কুন্তীপুত্র, সূর্য তোমার পিতা। সত্য বলছি, তোমার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। তুমি না এলেই আমি দুঃখ পেতাম। আমি তোমার দুর্জয় বীরত্ব, বেদনিষ্ঠা ও দানের বিষয়েও জ্ঞাত আছি।‘ আরো কিছু কথার পরে কর্ণ ভীষ্মকে অভিবাদন করে, সরোদনে রথে উঠে দুর্যোধনের কাছে চলে গেলেন।
ভীষ্ম কর্ণকে কোনো কটুক্তি করাতে কর্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ভীমের পতন না হলে তিনি যুদ্ধ করবেন না। দুর্যোধনের কাছে গিয়ে সকলকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, ‘মহাত্মা ভীষ্ম তোমাদের যেমন রক্ষা করতেন, আমিও তোমাদের সেভাবেই রক্ষা করবো। আমি পাণ্ডবদের যমালয়ে পাঠিয়ে পরম যশস্বী হবো। অথবা শক্রহস্তে নিহত হয়ে ভূতলে শয়ন করবো।’
পরদিন রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে পুনরায় কর্ণ রথারোহণে ভীমের কাছে এলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, আমি কর্ণ। আপনি আমাকে শুভবাক্য বলুন। কুরুবীরদের বিপদসাগরে ফেলে আপনি পিতৃলোকে যাচ্ছেন, ক্রুদ্ধ ব্র্যাঘ্র যেমন মৃগনিধন করে, পাণ্ডবগণ সেইরূপ এখন কৌরবগণকে বিনাশ করবে। আপনি অনুমতি দিলে আমি প্রচণ্ড বিক্রমশালী অৰ্জুনকে অস্ত্রের বলে বধ করতে পারবো।’
ভীষ্ম বললেন, ‘কৰ্ণ! সমুদ্র যেমন নদীগণের, ভাস্কর যেমন সকল তেজের, সাধুগণ যেমন সত্যের, উর্বরা ভূমি যেমন বীজের, মেঘ যেমন জীবগণের, তুমিও তেমন বান্ধবগণের আশ্রয় হও। আমি প্রসন্নচিত্তে বলছি, তুমি শক্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, কৌরবগণকে উপদেশ দাও, দুৰ্যোধনের জয়বিধান করো। দুর্যোধনের ন্যায় তুমিও আমার পৌত্রতুল্য। তুমি তাদের রক্ষা করো।’
ভীষ্মকে প্রণাম করে কর্ণ রণস্থলের দিকে চলে গেলেন। তারপর, কুরুরা কর্ণের পরামর্শে সর্বসম্মতিক্রমে দ্রোণাচার্যকে সেনাপতি করলেন। দ্রোণ সকল যোদ্ধার শিক্ষক, মাননীয় এবং শ্ৰেষ্ঠ অস্ত্রধর। তাঁর তুল্য আর কে আছে? ভীষ্ম যুদ্ধ থেকে বিরত না হওয়া পর্যন্ত যে কৰ্ণ যুদ্ধ করবেন না সেটা কৃষ্ণ জানতেন। যখন যুধিষ্ঠির ভীষ্ম, দ্রোণ কৃপাচার্য ইত্যাদি অবধ্য যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে ভক্তি গদ গদ ভাবে চরণবন্দনা করে কথা প্রসঙ্গে তাদের মৃত্যুর গুহ্য খবর সংগ্ৰহ করে এবং শল্যকেও সম্মান দেখিয়ে, প্রদক্ষিণ করে বলে এলেন তিনি যেন তাঁর পূর্বেকার বর ভুলে না গিয়ে যুদ্ধকালে সূতপুত্রের তেজ নষ্ট করেন, ততোক্ষণে কৃষ্ণ কর্ণের নিকট গেলেন। বললেন, ‘হে কর্ণ। যতোদিন ভীষ্ম যুদ্ধ করবেন, সেই সময়টা তুমি আমাদের পক্ষে থাকো।’ কৰ্ণ বললেন, কেশব! আমি দুর্যোধনের অপ্রিয় কার্য করবো না। জেনে রাখো আমি তাঁর হিতৈষী, তাঁর জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়েছি। কর্ণের সততা এবং কৃষ্ণের সততার অভাব, একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত।
কর্ণকে পাণ্ডব দলে নিয়ে আসার জন্য কৃষ্ণ যে কতো ধরনের অন্যায় চেষ্টা করেছেন তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অতি ক্রর উপায়ে ভীষ্মকে যে ভাবে অৰ্জুন কৃষ্ণের পরামর্শে অতিশয় কাপুরুষের মতো পাতিত করলেন সেটাও যুদ্ধের দশম দিনে প্রত্যক্ষ করলাম। এই যুদ্ধে পাণ্ডবদের দিকে থেকে কোনো ধর্ম ছিলো না, বীরত্ব ছিলো না, যোদ্ধাধার গৌরবও ছিলো না। নিয়ম কানুনের বালাই তো ছিলোই না। যা ছিলো তাঁর নাম শঠতা আর তুলনারহিত চক্রান্ত ও হৃদয়হীনতা এবং এই হৃদয়হীনতা যে কতো দূর যেতে পারে তাঁর চরম উদাহরণ দ্রোণের মৃত্যু। রণস্থলে প্রবেশ করে যুদ্ধ না করা, অন্তরালে থেকে যুদ্ধ করা, আর সমর পরিত্যাগপূর্বক পলায়ন করা এটাই যাদববংশের তথা কৃষ্ণের ধর্ম অৰ্জুন প্রকৃতই একজন মহাবীরের সম্মানে ভূষিত হবার মতো যোগ্যতা রাখেন। যুধিষ্ঠিরের মতো রাজ্যলোভী নন, ভীমের মতো ধৈর্যহীন নন, স্বীয় স্বার্থে অনৃতভাষণেও তিনি সম্মত নন। কিন্তু কৃষ্ণের চক্রান্তে যা যা তিনি করেছেন তাতে তিনি নিশ্চিতভাবেই কলঙ্কিত এবং নিন্দার্হ। তাঁর বীরত্বের সম্মান তিনি অধাৰ্মিক কর্মে নিম্নগামী করেছেন। সেনাপতি হয়ে দ্রোণ অবিশ্রান্তভাবে কেবলমাত্র পাণ্ডবসৈন্যই নয়, বড় বড় যোদ্ধা, রাজা মহারাজাকে বিনষ্ট করতে লাগলেন এবং কুন্তীপুত্রগণকে নিপীড়িত ও ভয়ার্ত করতে লাগলেন; তাতে একথা স্পষ্টই অনুমিত হলো পাণ্ডবদের জয়াশা একা তিনিই সমূলে উচ্ছিন্ন করবেন। তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণ অৰ্জুনকে পরামর্শ দিলেন, ‘ধর্ম পরিত্যাগ করো। নচেৎ দ্রোণ কারোকে আজ প্রাণ নিয়ে ফিরতে দেবেন না।’