কৃষ্ণ অৰ্জুনকে উশকে দিয়ে বললেন, ‘তুমি না বিরাটনগরে সঞ্জয়কে বলেছিলে, ভীষ্ম দ্রোণ প্রমুখ কুরুসৈন্য সংহার করবে? ক্ষত্রধর্ম মনে রেখে এখন সেই বাক্য স্মরণ করো। অর্জুন বিষন্ন স্বরে বললেন, ‘যারা অবধ্য তাদের বধ করে নরকের পথ-স্বরূপ রাজ্যলাভের চেয়ে বনবাসের কষ্টভোগও অনেক ভালো। ঠিক আছে, তোমার কথাই রাখবো, ভীমের নিকট রথ নিয়ে চলো। কুরুপিতামহকে নিপাতিত করবো। তারপর দুপক্ষেই প্রবল যুদ্ধ হতে লাগলো, এপক্ষের ওপক্ষের বহু সৈন্য নিহত হলো। শেষে সূর্যাস্ত হলে যুদ্ধও শেষ হলো।
কিন্তু দশম দিনে ভীষ্ম নিপাতিত হলেন। নবম দিনের যুদ্ধের পরে পাণ্ডবরা কৃষ্ণসহ ভীমের কাছে পুনরায় গিয়ে কী ভাবে তাঁকে বধ করবেন সেটা জেনে এলেন। প্রকৃত পক্ষে, পাণ্ডবদের জয়ার্থে ভীষ্ম স্বেচ্ছামৃত্যুই বরণ করেছিলেন। ভীষ্ম বলেছিলেন, ‘আমি জীবিত থাকতে তোমাদের জয় হবে না। আমি সুরাসুরেরও অবধ্য। কিন্তু আমি যদি অস্ত্র ত্যাগ করি তবে তোমরা আমাকে বধ করতে পারবে। কখনো শরণাপন্ন স্ত্রী, স্ত্রনামধারী, বিকলেন্দ্রিয়, একপুত্রের পিতা, নিরস্ত্র, ভূপতিত, বর্ম ও ধ্বজবিহীন, ইত্যাদির সঙ্গে যুদ্ধ করতে আমার অবশ্য প্রবৃত্তি হয় না। তোমার সৈন্যদলে শিখণ্ডী আছেন। তিনি পূর্বে স্ত্রী ছিলেন তা তোমরা জানো। তাঁকে সম্মুখে রেখে অর্জুন আমাকে বধ করুক। ভীমের নিকট থেকে এই গুহ্য তথ্য জেনে দশমদিনে সেই শিখণ্ডীকেই সম্মুখে রেখে কৃষ্ণ অৰ্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করলেন। ভীষ্ম শিখণ্ডীর রথসেনাকে দগ্ধ করতে লাগলেন, কিন্তু তাঁর প্রতি শরনিক্ষেপ করলেন না। আর এদিকে ভীম নকুল সহদেব সাত্যকি এদেরও সব ধ্বংস করতে লাগলেন। যতোক্ষণ ভীষ্ম তাদের বিনষ্ট করলেন, শিখণ্ডীকে সম্মুখবর্তী করে, ভীষ্মকে পরাজিত করতে অক্ষম অৰ্জুনকে কৃষ্ণ পুনঃপুন অন্যায়ভাবে শরনিক্ষেপ করতে অনুপ্রাণিত করতে লাগলেন। যুদ্ধের কোনো রীতি না মেনে শিখৰ্ত্তীর পিছনে প্রচ্ছন্ন থেকে অর্জুনও কৃষ্ণের পরামর্শে অনবরত শরনিক্ষেপ করতে লাগলেন। শিখণ্ডী শরদ্বারা ভীমের বক্ষঃস্থলে আঘাত করলে ভীষ্ম বললেন, ‘হে শিখণ্ডী! তুমি আমার প্রতি শরনিক্ষেপ করো বা না করো, আমি তোমার সঙ্গে কখনোই যুদ্ধ করবো না। বিধাতা তোমাকে শিখণ্ডিনীরূপে সৃষ্টি করেছিলেন, তুমি সেই শিখণ্ডিনীই আছো।’
ভীষ্মের কথা শুনে শিখণ্ডী বললেন, ‘হে ভীষ্ম! তোমাকে আমি বিলক্ষণ জানি। তোমার দিব্যপ্রভা আমার অবিদিত নেই। তথাপি আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করবো। তুমি আমার প্রতি শরনিক্ষেপ করো বা না করো, তথাপি আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করবো। তুমি জীবিত থাকতে আমার কাছে ত্রাণ পাবে না।’
অৰ্জুন পিছন থেকে উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘আমি তোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবো, তুমি ভীষ্মকে অনবরত আক্রমণ করো, সংহার করো, আমি তোমার পশ্চাতেই আছি। আমি রক্ষা করবো তোমাকে। তুমি যথাসম্ভব শীঘ্র ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হও। তাঁকে বধ করো। যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণের মধ্যে এমন কেউ নেই যে ভীমের সঙ্গে প্রতিযুদ্ধ করতে সমর্থ। ভীষ্মের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তুমি শরনিক্ষেপ করো।‘
অর্জুনের বাক্য শ্রবণান্তর শিখণ্ডী নানাবিধ শরে তাঁকে আকীর্ণ করতে লাগলো, কিন্তু প্রতিবার ভীষ্ম তা উপেক্ষা করে প্রজ্বলিত দাবানলের মতো শুরগণকে দগ্ধ করতে লাগলেন। অজুর্নও শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে ভুরি ভুরি শরে তাঁকে আচ্ছাদিত করতে লাগলেন। ভুরি ভুরি শরে আকীর্ণ হয়েও তা অগ্রাহ্য করে, পাণ্ডবদের সৈন্যগণকে নিপাতিত করে, ভীষ্মরূপ অনল রথরুপ অগ্নিগৃহে অবস্থিত হয়ে চারুরূপ শিখায় শোভিত হলেন। এক অপূর্ব শোভা প্রত্যক্ষ করলেন সকলে। কৃষ্ণের পরামর্শে তখন সমুদয় পাণ্ডব ও সঞ্জয়রা ভীষ্মকে পরিবেষ্টন করে ফেললেন ও পিছন থেকে মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে তাঁকে বধ করতে চেষ্টা করলেন। কিছুকাল মধ্যে সেই অজস্র নিক্ষিপ্ত শর ভীমের শরীরে প্রবিষ্ট হলো, তত্ৰাচ তিনি পাণ্ডবদের সহস্র সৈন্য ধ্বংস করতে লাগলেন। শিখণ্ডীও যেমন শত সহস্র শরনিক্ষেপে তাঁকে বিচলিত করতে সক্ষম হলো না, তেমনি লুকিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে অর্জনও কোনোরকমেই তাঁকে ব্যাহত করতে পারলো না। ভীষ্ম স্থির করেছিলেন শিখণ্ডীর সঙ্গে কখনোই যুদ্ধ করবেন না, অৰ্জুনকেও প্রাণে মারবেন না।
যুধিষ্ঠির অস্থির হয়ে গেলেন। মৃত্যুর উপায় জেনে এসেও কি তবে শেষরক্ষা হলো না? শেষ পর্যন্ত অবশ্য শিখণ্ডীর পিছনে লুকিয়ে অনবরত বাণবিদ্ধ করতে করতে অৰ্জুন একসময় ভীষ্মকে ধরাতলে নিপাতিত করলেন। প্রতিযোদ্ধার সম্মান পেলেন না, শুধু অন্যায়ের উপর দাঁড়িয়ে শেষ করলেন তাঁর কর্ম। যুধিষ্ঠির আশ্বস্ত হলেন। অর্জুন এতো শর নিক্ষেপ করেছিলেন ভীমের শরীরে যে দুই আঙুল পরিমাণ স্থানও অবশিষ্ট ছিলো না। অর্জুনকে কিন্তু তিনি একটি প্রতিশরও নিক্ষেপ করেননি। না করে রথ থেকে পড়ে গেলেন। কাপুরুষের মতো অন্যায় যুদ্ধের আশ্রয় না নিলে পাণ্ডবরা যে জিততে পারতেন না, তাঁর প্রথম নজির ভীমের পতন। অবশ্য মহাভারতে কৃষ্ণ-অর্জুন-শিখণ্ডী কেউ-ই ভীষ্মকে মারবার জন্য দায়ী নয়, কারণ ‘ইচ্ছা-মৃত্যু’ ব্যতীত তাঁকে পাতন করা অসম্ভব ছিলো। তবু, যুদ্ধের একটা নিয়মবন্ধন ছিলো। সেই নিয়মকেও কৃষ্ণের পরামর্শে অতিক্রম করা হলো। আর নিষ্ঠুরতাঁর তো কোনো তুলনাই নেই।