কৃষ্ণ বললেন, ‘আমি লোকক্ষয়কারী কাল। এখানে যারা সমবেত হয়েছে, তুমি না মারলেও তারা মরবে। সব্যসাচী! তুমি নিমিত্তমাত্র। ওঠো, যশোলাভ করো। শত্রুজয় করে সমৃদ্ধ রাজ্য ভোগ করো।’
অর্জুনের অন্তর যখন স্বজনদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে ব্যথিত, অবসন্ন, এঁদের সঙ্গে যুদ্ধ জয় করার চেয়ে ভিক্ষান্ন ভোজনও অনেক ভালো মনে করছেন, এবং কৃষ্ণ যখন তাঁকে উত্তপ্ত করার জন্য বিশ্বরূপ দর্শন করালেন, সেই সময়ে যুধিষ্ঠির তাঁর বর্ম খুলে, অস্ত্রত্যাগ করে, দ্রুত রথ থেকে নামলেন এবং শক্রসেনার ভিতর দিয়ে পদব্রজে যুক্তকর হয়ে ভীমের অভিমুখে চললেন। তাঁকে এভাবে যেতে দেখে সকলেই উৎকণ্ঠিত বোধ করলেন। ভ্রাতারা অগ্রসর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একি। শত্রুসৈন্যর মধ্য দিয়ে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনার অভিপ্রায় কী? ক্ষণকালের জন্য মনে হয়েছিলো যুধিষ্ঠির এইজন্যই বুঝি মহাত্মা যুধিষ্ঠির এখন আর তিনি যুদ্ধ চান না, এভাবেই সব থামিয়ে দিতে চলেছেন। তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। যেমন যাচ্ছিলেন তেমনই যেতে লাগলেন। কৃষ্ণ সহস্যে বললেন, ‘ইনি ভীমদ্রোণাদি গুরুজনদের সম্মান দেখিয়ে তারপর যুদ্ধে নিয়োজিত হবেন। শাস্ত্রে আছে, গুরুজনদের সম্মানিত করে কোনো কর্মে প্রবিষ্ট হলে সে কাজ সম্পন্ন হয়।‘
অত বুদ্ধিমান হয়েও কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে চিনতে পারেননি, কিংবা পেরেও অর্জুনকে প্রবোধ দিচ্ছেন। হাজার হোক, যুধিষ্ঠির তো বিদুরের পুত্র! স্বার্থসিদ্ধির বুদ্ধিতে তিনি সকলের উর্ধ্বে। অন্তত এই কর্মে তিনি তা স্পষ্টতই প্রমাণ করলেন। অর্জুনের মতো তাঁর হৃদয়ে কোনো দুর্বলতাঁর প্রশ্ন নেই। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য যুদ্ধে জয়ী হয়ে রাজ্য গ্রহণ। যে উদ্দেশ্যে অজ্ঞাতবাসে থেকে দ্রুপদের জামাত হয়েছিলেন, উদ্দেশ্য তাঁর সেই গন্তব্যের স্থিরীকৃত। তিনি জানতেন ভীষ্মকে জয় করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কী উপায়ে তাঁকে বধ করা যায় সেই কথাটা জানবার জন্যই তাঁর এই গুরুপ্রণামের ছলনা।
ভীমের কাছে এসে তাঁর পদবন্দনা করে বিগলিত করলেন। বললেন, ‘পিতামহ, আশীৰ্বাদ করুন। যুদ্ধে অনুমতি দিন।‘
ভীষ্ম বললেন, ‘যদি তুমি এভাবে আমার কাছে না আসতে, আমি তোমাকে পরাজয়ের জন্য অভিশাপ দিতাম। তোমার ব্যবহারে আমি প্রকৃতই প্রীতিলাভ করেছি।‘
ভীষ্ম বললেন, ‘আমি তোমার শত্রুপক্ষে যুদ্ধ করছি, তুমি আমার কাছে কী সাহায্য চাও?’
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘পিতামহ, আপনি অপরাজেয়। যদি আমাদের শুভকামনা করেন, তবে বলুন, আপনাকে কোন উপায়ে জয় করবো?’
ভীষ্ম হেসে বললেন, ‘আমি সকলেরই অবধ্য। আমাকে তোমরা জয় করতে পারবে না। তুমি পরে আমার কাছে এসো।’
ভীষ্মের কাছে তাঁর মৃত্যুর উপায় পরে জানবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে দ্রোণাচার্যের কাছে গেলেন। সেখানে গিয়েও এই ভক্তি গদগদ ভাব দেখিয়ে নানা ছলে তাঁর মৃত্যুর উপায় জেনে নিলেন। তারপর গেলেন কৃপাচার্যের কাছে। কিন্তু কৃপাচার্য কিছু বললেন না। তিনি যুধিষ্ঠিরের মনোভাব বুঝতে পেরেছিলেন। যুধিষ্ঠির শল্যের কাছেও গেলেন। গিয়ে তাঁকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করে বললেন, ‘আপনি পূর্বে বর দিয়েছিলেন যে যুদ্ধকালে সূতপুত্রের তেজ নষ্ট করবেন, আমি সেটাই আবার কামনা করছি। শল্য বললেন, তাই হবে।‘ অতঃপর কার্যসিদ্ধ করে যুধিষ্ঠির ফিরে এলেন।
কৃষ্ণ অৰ্জুনকে যেভাবে চালিত করতে চেয়েছেন সেভাবেই তিনি চলেছেন। যুধিষ্ঠির কিন্তু নামতই ধাৰ্মিক। এটাও শ্রবণ থেকে শ্রবণান্তরে ব্যাপ্ত প্রচার ব্যতীত অন্য কিছু নয়। এবং সেটা তাঁর প্রতি পদক্ষেপেই প্রকট। অর্জুনের হৃদয়বৃত্তি তদপেক্ষা অনেক বড়, অনেক মহৎ সর্বাপেক্ষা বিস্ময়ের বিষয় ভীমের শান্তিবাদ। শেষ পর্যন্ত ভীমও যুদ্ধ করতে চাইলেন না। বললেন, “হে মধুসূদন যুদ্ধের কথা বলো না। তুমি আমাদের পিতামহ ভীষ্ম ও অন্যান্য সভাসদকে বলো, যা করলে আমাদের পরস্পর সৌভ্রাত্র জন্মে ও দুর্যোধন প্রশান্ত হয়, সেই উপায়ই তুমি নির্ধারণ করবে।’
কৃষ্ণ যদি সে বিষয়ে উদ্যোগী হতেন হয়তো বা সেটা সম্ভব হতো। দুর্যোধন জন্মাবধি শুনে এসেছেন তাঁকে মেরে ফেলা হলো না কেন, সে নিষ্ঠুর, পাপপরায়ণ, ঐশ্বর্যমদমত্ত। পরিজনদের নিকট বিদুর তাঁকে একটি নরকের কীট বানিয়ে রেখেছেন। কখনো কারো কাছে ভালো ব্যবহার পাননি, কারো মুখে কটু বিশেষণ ব্যতীত কোনো স্বাভাবিক কথা শোনেননি, জন্ম থেকে শুধু জেনেছেন জন্মানো মাত্র তাঁকে মেরে না ফেলাটাই ঘোর অন্যায় হয়েছে। তথাপি যে দুর্যোধন তাঁর স্বাভাবিক চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠেছেন, তাঁর চেয়ে বড়ো ঘটনা আর কী হতে পারে? একমাত্র কর্ণ ব্যতীত কোথাও যার কোনো শান্তি নেই, সান্ত্বনা নেই, আশ্রয় নেই, ভালোবাসা নেই, স্নেহমমতাপ্রতি কিছুই নেই, তাঁকে তুষ্ট করতে কৃষ্ণর একটা নিমেষের অধিক ক্ষয় হতো না। কিন্তু তিনি তা করলেন না। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো।
সর্বমোট আঠারো দিনের যুদ্ধের নবম দিনে ভীষ্ম সর্বতোভদ্র নামে এক মহাব্যুহ রচনা করলেন। কৃপ, দ্রোণ, ভূরিশ্রবা, শল্য, ভগদত্ত, দুর্যোধন, ইত্যাদি এ ব্যূহের বিভিন্ন স্থানে রইলেন। সেদিন ভীমের প্রচণ্ড বাণবর্ষণে পাণ্ডবসেনা বিধ্বস্ত হলো, সকলে পলায়ন করতে লাগলো। হস্তী ও অশ্বের মৃতদেহে ভগ্ন রথ ও ধ্বজে রণস্থল ব্যাপ্ত হলো, সৈন্যরা হাহাকার করতে লাগলো।