এদিকে হস্তিনাপুর থেকে সকলের বিদায় নিয়ে প্রত্যাবর্তিত হবার জন্য কৃষ্ণ যখন তাঁর রথে আরোহণ করলেন, তখন কর্ণকেও সঙ্গে নিলেন। আসল উদ্দেশ্য কৃষ্ণের এটাই ছিলো, যুদ্ধে কর্ণকে পাণ্ডবদের সঙ্গী হতে বলা। সন্ধির প্রস্তাবটা একটা ছলনামাত্র। এরকম যোদ্ধাকে সঙ্গে পেলে পাণ্ডবদের শক্তি দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
রথে তুলে বললেন, ‘কুমারী কন্যার গর্ভে পুত্র হলে তাঁকে কানীনপুত্র বলে। কর্ণ, তুমি কানীনপুত্র। রাধেয়, তুমি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সেবা করেছো, ধর্মশাস্ত্রের সূক্ষ্ম তত্ত্বসকল শিখেছো। তুমি ধর্মানুসারে পাণ্ডুরই পুত্র। অতএব তুমি রাজা হও তোমার পিতৃপক্ষীয় পাণ্ডবগণ এবং মাতৃপক্ষীয় বৃষ্ণিগণ, দুই পক্ষকেই তোমার সহায় বলে জেনো। তুমি আজ আমার সঙ্গে চলো, পাণ্ডবরা জানুন যে তুমি যুধিষ্ঠিরের অগ্রজ। তোমার পাঁচত্রাতা এবং দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র এবং অভিমনু তোমার চরণধারণ করবেন, দ্রৌপদীও ষষ্ঠকালে তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন। আমরা তোমাকে পৃথিবীর রাজপদে অভিষিক্ত করবো। কুন্তীপুত্র, তুমি ভ্রাতৃগণে বেষ্টিত হয়ে রাজ্যশাসন করো, পাণ্ডবভ্রাতাদের সঙ্গে তোমার সৌহার্দ্য হোক।’
মৃদু হেসে কর্ণ বললেন, ‘ধর্মশাস্ত্র অনুসারে আমি পাণ্ডুরই পুত্র, সে কথা আমি জানি। কুন্তী আমাকে গর্ভে ধারণ করেন এবং হিত চিন্তা না করে ত্যাগ করেন। অধিরথ আমাকে তাঁর গৃহে আনেন, তাঁর পত্নী রাধার স্নেহবশে স্তনদুগ্ধ ক্ষরিত হয়েছিলো। আমি কী করে তাঁর পিণ্ডলোপ করতে পারি? পত্নীদের সঙ্গে আমার প্রেমের বন্ধন আছে। গোবিন্দ! সমস্ত পৃথিবী এবং রাশি রাশি সুবর্ণ পেলেও আমি সেই সম্বন্ধ কখনো অস্বীকার করতে পারি না। তদ্ব্যতীত, আমি ত্রয়োদশ বৎসর দুর্যোধনের আশ্রয়ে নিষ্কণ্টক রাজ্যভোগ করেছি, সূতগণের সঙ্গে আমি বহু যজ্ঞ করেছি, তাদের সঙ্গে সম্বন্ধও আমার গভীর। আর সর্বোপরি, দুৰ্যোধন আমার ভরসাতেই যুদ্ধের উদযোগ করেছেন। দ্বৈরথ যুদ্ধে অর্জুনের প্রতিযোদ্ধারূপেই আমাকে বরণ করেছেন। কোনো কিছুর বিনিময়েই আমি তাঁর সঙ্গে মিথ্যাচার করতে পারি না। কেশব সারা বিশ্বে পুণ্যতম স্থান কুরুক্ষেত্রে ক্ষত্রিয়মণ্ডল যেন অস্ত্রযুদ্ধে নিহত হন। সমস্ত ক্ষত্ৰিয়ই যেন স্বৰ্গলাভ করেন।‘
কৃষ্ণ একটু হাসলেন, ‘তাহলে তুমি পৃথিবীর রাজ্য চাও না?’
কর্ণও মৃদুহাস্যে বললেন, ‘সব জেনেও আমাকে কেন ভোলাচ্ছো। পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন, আমরা তাঁর নিমিত্তমাত্র। আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি, তুমি এক রক্তাক্ত পৃথিবীকে হাতে ধরে নিক্ষেপ করছে আর অগ্নিস্তুপের উপর উঠে দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠির স্বর্ণপাত্রে ঘৃতপায়েস ভক্ষণ করছেন, আর তোমার পৃথিবী তা গ্রহণ করছে।‘
কৃষ্ণ বললেন, ‘তা হলে তুমি এই পৃথিবীর বিনাশই চাও?’
কৰ্ণ কৃষ্ণকে গাঢ় আলিঙ্গন করে বললেন, ‘হয়তো স্বর্গেই পুনরায় আমাদের মিলন হবে।’ এই বলে নেমে গেলেন রথ থেকে।
কৃষ্ণ বিফল হয়ে ফিরে গেলে কুন্তী ভাবলেন, কর্ণ তো আমারই পুত্র। আমি কিছু বললে কি সে শুনবে না? সকলের মতো আমিও জানি আমার পুত্র দয়ালু, সত্যনিষ্ঠ। এই রকম ভেবে কুন্তীও কর্ণর নিকটে গেলেন। কর্ণ কুন্তীকে দেখতে পেয়ে সবিস্ময়ে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, “আমি অধিরথ ও রাধার পুত্র কর্ণ। আজ্ঞা করুন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি।’
কর্ণর বাক্য শুনে কুন্তী বললেন, ‘কৰ্ণ, তুমি কৌন্তেয়। রাধার গর্ভে তোমার জন্ম হয়নি, অধিরথও তোমার পিতা নন, তপনদেব তোমার জন্মদাতা। তুমি সর্বগুণসম্পন্ন, আমার পুত্রদের সর্বজ্যেষ্ঠ—‘
কৰ্ণ বললেন, ‘ক্ষত্রিয়জননী, আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা নেই। আপনার অনুরোধও আমি ধর্মসংগত মনে করি না। আপনি আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। তাতে আমার যশ ও কীর্তি নষ্ট করেছেন। জন্মে ক্ষত্রিয় হলেও আপনার জন্য আমি ক্ষত্রিয়োচিত সম্মান পাইনি। এরচেয়ে অধিক অপরাধ কোনো শত্রুও করতে পারে না। যথাকালে আমার প্রতি আপনার কিঞ্চিৎমাত্র দয়াও ছিলো না। এখন এসেছেন কেবল আপনার নিজের হিতের জন্য। আমার জন্য নয়। কিন্তু আপনার আগমন আমি ব্যর্থ করবো না, আমি অর্জুনকে নিহত করে অভীষ্ট ফল লাভ করবো, অথবা তাঁর হাতে নিহত হয়ে যশোলাভ করবো। যেই মরুক, অর্জুন অথবা আমাকে নিয়ে আপনার পাঁচপুত্ৰই জীবিত থাকবে।‘
স্বার্থপর কুন্তী বললেন, ‘এই কথা কিন্তু মনে রেখো।’ বলতে বলতে পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে সহসা স্নেহে আপ্লুত হয়ে আলিঙ্গন করলেন পুত্রকে, আশীৰ্বাদ করলেন। কর্ণ তাঁকে অভিবাদন করলেন।
মহাভারতের মহারণ্যে – ২.০৯
অতঃপর যা অবশ্যম্ভাবী তাই হলো। শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধের প্রস্তুতি। কুরু পিতামহ ভীষ্ম সিংহনাদ করে শঙ্খ বাজালেন। তখন ভেরী পণব আনক প্রভৃতি রণবাদ্য তুমুল শব্দে বেজে উঠলো। কৃষ্ণও তাঁর পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজালেন। যুধিষ্ঠির প্রভৃতিও নিজ নিজ শঙ্খ বাজালেন। সেই শব্দ যেন আকাশ ও পৃথিবী অনুনাদিত করে দুর্যোধনাদির হৃদয় বিদীর্ণ করে দিলো। কৃষ্ণ কুরু-পাণ্ডব সেনার মধ্যে রথ নিয়ে গেলেন। অর্জুনও ঐ পক্ষের স্বজনদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বেদনায় কম্পিত হলেন। তাঁর হৃদয়ও দুর্যোধনের হৃদয়ের মতো বিদীর্ণ হলো। ব্যাকুল হয়ে বললেন, “আমি বিজয় চাই না। যাদের সঙ্গে বিজেতা হতে যাচ্ছি, তারা কারা? কাঁদের দেখছি আমি? কাঁদের নিরীক্ষণ করে আমার বক্ষঃস্থল আমাকে বিরত হতে বলছে? দুই পক্ষেই পিতা-পিতামহস্থানীয় গুরুজন, আচার্য মাতুল শ্বশুর ভ্রাতা পুত্র ও সুহৃদগণ। যুদ্ধ তবে আমি কার সঙ্গে করবো? কৃষ্ণ তাঁকে ব্যথিত ও অবসন্ন দেখে বললেন, ‘এই সংকটকালে তুমি মোহগ্ৰস্ত হলে চলবে কেন? ক্লীব হয়ে না।’ তথাপি অজুনকে যুদ্ধবিমুখ দেখে, শোকাচ্ছন্ন দেখে এবং অনেক বোঝালেও বুঝছেন না দেখে কৃষ্ণ তাঁকে বিশ্বরূপ দেখালেন। অর্জুন দেখলেন, দংষ্ট্রাকরাল কালানলসন্নিভ মুখসকলের মধ্যে পতঙ্গ যেমন প্রদীপ্ত অনলে প্রবেশ করে সেই রকম দ্রুতবেগে জীবসমূহ সেই মুখসকলের মধ্যে প্রবেশ করছে। জ্বলন্ত বদনে সর্বদিক থেকে সমগ্রলোক গ্রাস করতে করতে লেহেন করছে। সমস্ত জগৎ সেই তেজে পূরিত হয়ে সন্তপ্ত হচ্ছে অর্জুন অভিভূত হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণত হলেন। ভয়ার্ত আবেগে বললেন, ‘কে তুমি? তোমাকে নমস্কার। হে দেবেশ, প্রসন্ন হও।‘