সঞ্জয়ের বিনীত নিবেদনের উত্তরে এই জবাব নিতান্তই নির্লজ্জ জবাব। রাজা হতে চাইলেও রাজার আচরণ তিনি জানেন না। তদ্ব্যতীত, ধৃতরাষ্ট্রকে যদি নিজের পিতৃব্য বলে বিবেচনা করতেন, তা হলে এভাবে তাঁর বিষয়ে কথা বলতেন না। জন্মাবধি তিনি যদি পাণ্ডুর নিকটই বড়ো হয়ে উঠতেন, তা হলেও এই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত হতেন না। কথা বলতে জানাটাও যে একটা শিক্ষা, কথাবাতাঁর মধ্যেও যে মানুষ তাঁর সংস্কৃতির ও আভিজাত্যের প্রমাণ দেয়, তাহলে সেটুকু রাজকীয় জ্ঞান অন্তত জানা থাকতো তাঁর। যে ব্যক্তি জুয়ার নেশায় পত্নীকে পর্যন্ত বিক্রয় করেন, আমরা তেমন ব্যক্তিকে কোনোভাবেই সম্মানিত ব্যক্তি বলে গ্রহণ করতে পারি না। যুধিষ্ঠিরের সামান্য অপরাধবোধ থাকলেও তিনি এভাবে কথা বলতেন না। বিদুরের পুত্র বিদুরই হয়েছেন, রাজবাড়ির প্রলেপ পড়েনি সেখানে। তিনি জানেন, শান্তনুর সিংহাসনের অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত, কুরুদের অধীনস্থ না করা পর্যন্ত, শক্ৰতা স্তব্ধ হবে না। আর অন্য কিছুতেই তাঁর তুষ্টি নেই। ভীষ্মের রাজপুত্র বানাবার শিক্ষাও এখানে একান্তভাবেই ব্যর্থ হয়েছে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে যাঁর কিছুই স্বোপার্জিত নয়—সিংহাসন তো নয়ই, এমন কি পত্নীটিও নয়—ভোগের লালসা তাঁর মধ্যে সর্বাধিক। অর্ধরাজ্য পেয়ে তিনি তুষ্ট ছিলেন না, সমস্ত রাজ্যের আকাঙ্খা নিয়েই শকুনির সঙ্গে খেলেছিলেন। সমস্ত রাজ্যের অধিকার পাবার জন্যই বিদুর তাঁকে হাতে ধরে যে রাস্তায় পা ফেলতে বলেছেন সে রাস্তাতেই তিনি পা ফেলেছেন। তারপর পিতামহর হাত ধরে গিয়েছেন দ্রুপদরাজার কন্যার স্বয়ংবর সভায়। কনিষ্ঠ ভ্রাতার উপার্জিত পত্নীটিকে পর্যন্ত দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্র কী করেননি তাঁর জন্য? সাদরে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছেন, সন্তুষ্ট চিত্তেই রাজত্বের অর্ধাংশ দিয়েছেন সুখে থাকার জন্য।
সঞ্জয় বললেন, ‘আপনি উদ্বেগহীন হয়ে নিজে সরে যান। স্বর্গের পথ থেকে ভ্ৰষ্ট হবেন না।’
কৃষ্ণ বললেন, দস্যু বধ করলে পুণ্য হয়। অধৰ্মজ্ঞ কৌরবগণ দসু্যবৃত্তিই অবলম্বন করেছে।’
কৃষ্ণ হঠাৎ এই নতুন চেনা পাঁচটি ভ্রাতার সঙ্গে বন্ধুতা করে কেন এই বিবাদটা আরো পাকিয়ে তুলছেন তাঁর কোনো কারণ এই মহাগ্রন্থে লেখা নেই। দস্যুবৃত্তি কৌরবরা করেননি, যা করেছেন পাণ্ডবরাই করেছেন। গ্রন্থটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অবিশ্রান্ত দুর্ব্যবহার করাটাই ছিলো দুৰ্যোধনের সঙ্গে তাদের একমাত্র সম্পর্ক। কোনো না কোনো ছলে তাঁকে অপদস্থ করা আর হারিয়ে দেওয়া। দুর্যোধন মধ্যস্থ না থাকলে অন্ধ রাজটিকে রাজ্যচ্যুত করে কর্মচারী বানানোর কোনো অসুবিধে ছিলো না, এটাই কি তবে এই শক্রতাঁর মূল কারণ? কিন্তু কৃষ্ণ কেন তাঁর মধ্যে ঢুকে পড়লেন, বাস্তববুদ্ধিতে তাঁর ব্যাখ্যা মেলে না।
প্রথম দিকে অনেক তেজ দেখিয়ে যুধিষ্ঠির তাঁর রাজত্ব ফিরে চাইছিলেন, শেষের দিকে ভ্রাতাদের নিশ্চুপ দেখে কিছুটা ভীত হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, রাজ্যের একটি প্রদেশ আমাদের দিক, নতুন আমাদের পাঁচটি ভ্রাতাকে পাঁচটি গ্রাম দিক।‘
সঞ্জয় ফিরে এসে যা বললেন তা শুনে ভীষ্ম বললেন, ‘বৎস দুর্যোধন! ধর্ম ও অর্থ থেকে তোমার বুদ্ধি চ্যুত হয়েছে। তুমি যদি আমার কথা অগ্রাহ্য করো, তাহলে বহু লোকের মৃত্যু হবে।’
দ্রোণও তাই বললেন, কিন্তু দুর্যোধন চুপ করে রইলেন। সবাই যখন ধৃতরাষ্ট্রকে পাণ্ডবদের শক্তির কথা বলে ভয় দেখাতে লাগলেন, তখন ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করে দুর্যোধন বললেন, ‘মহারাজা ভয় পাবেন না। পাণ্ডবরা বনে গেলে কৃষ্ণ, কেকয়গণ, ধৃষ্টকেতু, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও বহু রাজা সসৈন্যে ইন্দ্রপ্রস্থের নিকটে এসে আমাদের নিন্দা করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, পাণ্ডবদের উচিত কৌরবদের উচ্ছেদ করে পুনরায় রাজ্য উদ্ধার করা। গুপ্তচরদের মুখে এই সংবাদ পেয়ে আমার ধারণা হয়েছিলো পাণ্ডবরা তাদের বনবাসের প্রতিজ্ঞা পালন করবেন না। যুদ্ধে আমাদের পরাস্ত করবেন। সেই সময়ে পূর্বাপর না জেনে আমাদের মিত্র ও প্রজারা সকলেই ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের ধিক্কার দিচ্ছিলো। তখন আমি ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ ও অশ্বথামাকে বললাম, “পিতা আমার জন্য দুঃখবোধ করছেন।” অতএব সন্ধি করাই ভালো। তাতে ভীষ্ম দ্রোণাদি আমাকে আশ্বাস দিলেন, “ভয় পেয়ো না, যুদ্ধে কেউ আমাদের জয় করতে পারবে না।” মহারাজ অসীমতেজ ভীষ্মদ্রোণাদির তখন এই ধারণা দৃঢ় ছিলো। এখন পাণ্ডবগণ পূর্বাপেক্ষা বলহীন হয়েছে। সমস্ত পৃথিবী আমাদের বশে এসেছে। যে রাজারা আমাদের পক্ষে যোগ দিয়েছেন, তারা শোকদুঃখে আমাদেরই অংশভাগী হবেন। অতএব আপনি ভয় দূর করুন। আমাদের সৈন্য সমাবেশে যুধিষ্ঠির ভীত হয়েছেন। তাই তিনি কেবল পাঁচটি গ্রাম চেয়েছেন। তাঁর রাজধানী চাননি। যুদ্ধজয়ের বল সম্বন্ধে যা মনে করেন তা মিথ্যা। আমি যখন বলরামের কাছে অস্ত্র শিক্ষা করতাম, তখন সকলে বলতো, সম্মুখ যুদ্ধে আমার সমান পৃথিবীতে কেউ নেই। আমি এক আঘাতেই ভীমকে যমালয়ে পাঠাবো। ভীষ্ম দ্রোণ অশ্বথামা কৃপ কৰ্ণ ভূরিশ্রবা শল্য ভগদত্ত ও জয়দ্ৰথ এদের যে কেউ পাণ্ডবদের বধ করতে পারেন। এঁরা সম্মিলিত হলে ক্ষণমাত্রেই তাদের যমালয়ে পাঠাবেন। কর্ণ ইন্দ্রর কাছ থেকে অমোঘ শক্তি অস্ত্র পেয়েছেন। সেই অস্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধে অৰ্জুন কী করে বাঁচবেন? মহারাজ! বিপক্ষের বল আমাদের তুলনায় সবরকমেই হীন। আমি জীবন, রাজ্য ও সমস্ত ধন ত্যাগ করবো, কিন্তু কোনো কিছুর বিনিময়েই পাণ্ডবদের সঙ্গে বাস করবো না।‘