আজও পর্যন্ত সেই মিথ্যেই অকাট্য সত্য হিশাবে প্রচলিত। পাশাখেলায় সৌবল প্রকৃতই যে একজন অদ্বিতীয় ব্যক্তি, এবং যুধিষ্ঠির যে তাঁর মতো একজন খেলোয়াড়ের নিকট একটা ফুৎকারও নয়, এ কথা যুধিষ্ঠিরের তো প্রথম খেলাতেই বুঝতে পারা উচিত ছিলো। তখুনি তিনি শেষ করে দিতে পারতেন খেলা। অন্য কারো সঙ্গে খেলতে পারতেন। তাঁর সমকক্ষ খেলোয়াড়ের অভাব ছিলো না সেখানে। কিন্তু সর্ব বিষয়ে অক্ষম ব্যক্তিদের মধ্যে একটা মাত্রহীন জেদ থাকে, কিছুতেই হার স্বীকার করতে পারে না। আত্মসম্মান রক্ষার্থে সেই জেদই চালিত করেছিলো যুধিষ্ঠিরকে। সর্বত্র হেরে যেতে কার বাসনা থাকে? তদ্ব্যতীত, রাজসূয় যজ্ঞ করে এতো অঢেল ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন যে মনে করেছিলেন তাঁর সঙ্গে এঁরা পাল্লা দিতে পারবেন না, এবং তিনি খেলতে খেলতে একবার জয়ী হতেই পারবেন। তখন এঁরা তাঁর অর্থের প্রাচুর্য দেখে নিজেদের অনেক দীন বলে ভাববে আর যথেষ্ট অপমানিত হবে। সে ইচ্ছে তিনি শেষ পর্যন্তও ছাড়তে পারেননি। এই অসৎ ইচ্ছাই তাঁকে সেই নরকে নিয়ে গেছে, যেখান নিঃস্ব হয়েছেন।
যুদ্ধের আলোচনা সবই একপক্ষে চলছিলো। অভিমনু্য-উত্তরার বিবাহে সব মহানুভব ব্যক্তিরা অতিথি হিশাবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। সুতরাং ঐ পক্ষ কী করছে সেটা না জেনেই এই আলোচনা চলছিলো। কৃষ্ণ অন্যান্য আমন্ত্রিত রাজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, পরাজিত হলে হৃতরাজ্য ও বনবাসের জন্য সেবল শঠতাপূর্বক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। এখন কৌরব ও পাণ্ডবগণের পক্ষে যা মঙ্গল তাই আপনারা চিন্তা করুন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অধৰ্মগতভাবে সুরসাম্রাজ্যও কামনা করেন না। যদিও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা বলবীর্যে এদের পরাজিত করতে অসমর্থ হয়েই শঠতাপূর্বক পৈতৃকরাজ্য অপহরণ করে এদের এতোদিন দুঃখে দগ্ধ করেছে। কৃষ্ণ সব কিছু জেনেই এই অসত্য কথাগুলো বললেন।
স্বভাব দোষে অনর্থক অসূয়া বিভিন্ন পিতার পাঁচটি সন্তানের পক্ষে সম্ভব হতে পারে। শৈশব তাদের কোথায় কীভাবে কেটেছে তা আমরা কেউ জানি না। কী তাদের বোঝানো হয়েছে তাও অজানা। কিন্তু কৃষ্ণ কেন দুৰ্যোধনের বৈবাহিক হয়েও তাঁর ঘোর শক্র সেটা বোঝা দুরূহ।
মহাভারত নামের বৃহৎ পুস্তকখানিতে আমরা কৃষ্ণকে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভাতেই প্রথম দেখতে পেলাম। দুৰ্যোধনের সঙ্গে তাঁর কোনো শক্রতাঁর সংবাদও আগোচর ছিলো। দুর্যোধন তাঁর বৈবাহিক। তাঁর পুত্র দুর্যোধনের কন্যাকে বিবাহ করেছে। সুতরাং একজন বিশেষ আতীয় তাঁকে এই ধরনের অপমান করার মধ্যে যে অশিষ্টতা এবং অভদ্রতা লক্ষ করা যায় তা উন্নতমনস্ক সজ্জনের শোভা পায় না।
কৃষ্ণ তখন প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছেন, দুর্যোধনের বয়সও কিছু থেমে নেই, একজন বিশিষ্ট রাজাও বটে। তাঁর সঙ্গে কৃষ্ণের যদি বা কোনো কারণে কোনো শক্রতাও থাকে, তথাপি এই ব্যবহার তাঁকে মানায় না। তবে কি যাদববংশের এই নেতা কৌলিন্যের অভাবেই বোঝেন না যে ব্যক্তিবিশেষ বলে একটা শব্দ আছে অভিধানে! একথাটা অবশ্যই জানা উচিত, একজন আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি কখনো অপমান ভুলবেন না, ভুলতে পারবেন না। ব্যাসদেব এমনভাবে ঘটনাটা সাজালেন যেন দুৰ্যোধন ঈৰ্ষাপরায়ণ হয়েই এই কৌশলে নিতান্ত অকারণে সরল সাধু যুধিষ্ঠিরকে এই অন্ধকারে ঠেলে দিলেন। যেমন একবার ভীমকে বিষ খাইয়ে জলে ফেলে দিয়েছিলেন বলে রটানো হয়েছিলো, এই ঘটনাটাও তাঁরই আর এক চেহারা। পিছনে কোনো কারণ নেই, যা আছে তা যুধিষ্ঠিরের দুৰ্যোধনের প্রতি নির্ভেজাল এক নারকীয় ঈর্ষা।
বলরামের বাক্য কারো কর্ণেই সুধাবর্ষণ করলো না, শুধু তিক্ততা ছড়ালো। অতএব সত্যটা কখন মুছে গিয়ে মিথ্যাটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
কৃষ্ণ উপস্থিত রাজনবর্গকে বললেন, “যদি কৌরবগণ এঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, তবে এঁরা আহত হওয়ামাত্রই ওদের নিহত করবেন।’ আরো বললেন, “যদি আপনারা মনে করেন পাণ্ডবগণ সংখ্যায় অল্প বলে ওদের পরাজিত করতে অক্ষম হবেন, তা হলে সকল সুহৃদ একসঙ্গে হয়ে তাদের সংহার করতে যত্নশীল হবেন। এই পরামর্শে এটা অতি স্বচ্ছ যে কৃষ্ণ যুদ্ধটাই চাইছেন। কৌরব বংশ ধ্বংস করতে কৃষ্ণ এবং বিদুর একই রকম উগ্র ইচ্ছার অধীন। যুধিষ্ঠির তো বটেই।
এদিকে পাণ্ডবগণ সৈন্য সংগ্রহ করেছেন জেনে দুর্যোধনও সৈন্য সংগ্রহে একাগ্র হলেন। দুৰ্যোধনের আহবানে প্রচুর সৈন্য সংগৃহীত হলো। নানাবিধ ধ্বজা পতাকাশালী সৈন্যগণের সমাবেশে হস্তিনানগর পরিপূর্ণ হয়েও ছাপিয়ে গেলো। তাদের সব বিভিন্ন স্থানে সংস্থাপিত করলেন দুর্যোধন। পাঞ্চালপতি প্রেরিত সেই পুরোহিত সৈন্যর প্রাচুর্য দেখে স্তম্ভিত হলেন।
পুরোহিত কৌরবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং দ্রুপদরাজার শিক্ষামতো যা যা বক্তব্য সবই ব্যক্ত করলেন। ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ইত্যাদি তাঁকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণও করলেন এবং তাদের দিক থেকেও সঞ্জয়কে সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে পাঠালেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘দুর্যোধন আমাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে যদি ইন্দ্রপ্রস্থ প্রদান করেন, তা হলে আমি শান্তিপক্ষ অবলম্বন করবো। প্রদীপ্ত অগ্নি যেমন ঘৃত পেয়ে তৃপ্ত হয় না, সে রকম বিপুলভোগ্যে বিষয় পেয়েও ধৃতরাষ্ট্র তৃপ্ত হননি। এখন সংকটে পড়ে পরের উপর নির্ভর করছেন। এতে তাঁর মঙ্গল হবে না। এখন তিনি তাঁর দুৰ্বদ্ধি ক্রুর স্বভাব কুমন্ত্রীবেষ্টিত পুত্রের জন্য বিলাপ করছেন কেন? বিদুরের উপদেশ অগ্রাহ্য করে অধর্মের পথে চলেছিলেন কেন?