তদ্ব্যতীত, দ্রৌপদী এখন কুরুকুলবধূ বলে নিজেকে জাহির করলেও, যজ্ঞের দিন যে চাপল্য প্রকাশ করেছিলেন সেই ব্যবহারটা বিন্দুমাত্র সুষ্ঠু ছিলো না। অন্যকে অসম্মান অপমান করলে, পরিবর্তে অসম্মানিত অপমানিত হবার বাঁঠুকি থাকে বৈকি। স্বয়ংবর সভায় জাত তুলে অতি অন্যায়ভাবে কর্ণকে অপমান করেছিলেন দ্রৌপদী, তাঁর মধ্যে কোনো শালীনতা ছিলো না। অতঃপর একজনের গলায় বরমাল্য দিয়ে বিবাহের পরেও তিনি তাঁর বরণীয় পতির জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ সকল ভ্রাতার সঙ্গেই বা কী করে বিবাহিত হলেন? কৰ্ণকে প্রত্যাখ্যান করবার সময়ে তাঁর কণ্ঠে যে জোর ছিলো, বিবাহের সময়ে কেন তেজস্বিনী দ্রৌপদীর কণ্ঠ নিঃশব্দ রইলো?
যুধিষ্ঠিরের মান সম্মান ঐশ্বর্য কিছুই তাঁর স্কোপার্জিত নয়। পত্নীটিও নয়। অনুপার্জিত সমস্ত কিছুই তিনি তাঁর জুয়ার নেশায় সমর্পণ করে ভ্রাতাগণসহ দ্রৌপদীকে নিয়ে কুরুদের দাস হলেন।
দুরোদর রাজাদের বিবিধ ব্যসনের মধ্যে একটা খেলার জন্য সকল রাজাই সকলকে ডাকতে পারেন—সেটাই নিয়ম। সেটা একটা সম্মানের ব্যাপার। এই খেলার আয়োজন যে কোনো রাজা যে কোনোদিন করতে পারেন, খেলতেও পারেন। যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ডাকলেও একা তাঁকেই ডাকা হয়নি; অন্যান্য কীর্তিমান রাজারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যুধিষ্ঠির নিজেই শকুনির সঙ্গে খেলতে অভিলাষী হলেন। কেন অভিলাষী হলেন তাঁর মধ্যে যে একটা গৃঢ় অভিসন্ধি ছিলো সেটা কেউ ধরতে পারেননি। তিনি নিজেই প্রকাশ করেছিলেন সে কথা। সরবে সদরে নয়, দ্রৌপদীর বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে তাঁকে বলেছিলেন যে তাঁর মনে হয়েছিলো খেলতে খেলতে একবার না একবার তিনি জিতবেনই, এবং তখন দুর্যোধনের সমস্ত ঐশ্বর্য তাঁর ক্ষমতার অধীন হবে। একথা যে তিনি শুধু স্ত্রীকেই বলেছিলেন তা-ই নয়, ক্রুদ্ধ ভ্রাতা ভীমকেও বলেছিলেন। নচেৎ, এ খেলাটা যদি তিনি অন্য কারো সঙ্গে খেলতেন, হয়তো জিতেও যেতে পারতেন। কিন্তু দুর্যোধনকে না হারাতে পারলে সুখ কোথায়? এই খেলা যে সবাই পণ নিয়ে খেলেন তা নয়। দুর্যোধনও পণের কথা বলেননি, বলেছিলেন যুধিষ্ঠির নিজেই। তিনি জানতেন তাঁর যতো ঐশ্বর্য আছে, তাঁর সঙ্গে এঁরা কোনোরকমেই পাল্লা দিয়ে উঠতে পারবে না, অতএব এক সময় ধরা দিতেই হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বাসনা তাঁর মিটলো না। বিদুরের মতো তাঁরও শান্তনুর সিংহাসনটি শেষ লক্ষ্য।
হিতৈষীরা তাঁকে শকুনির সঙ্গে খেলতে বারণ করেছিলেন, তিনি শোনেননি। কুরুরা একটা অভিসন্ধি নিয়ে খেলার আয়োজন করলেও, ফলাফল বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন না। কেননা যুধিষ্ঠির যে সৌবলের সঙ্গেই খেলবেন এমন তো কোনো কথা নেই। যুধিষ্ঠিরের মনে অথচ সেই নিশ্চয়তা ছিলো। ধনদৌলতের আধিক্যে তিনি যে এদের অপেক্ষা অনেক বেশি ঐশ্বর্যবান, সে বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহে ছিলেন। সেজন্যই গৌরব করে বলেছিলেন, ‘পণ-পূর্বক খেলো, দেখি তোমাদের কী আছে। কিন্তু মজাটা এই যে সারা রাজ্যেই রটে গেলো দুর্যোধনের ঈর্ষাতেই যুধিষ্ঠিরের এতো বড় একটা ক্ষতি হলো। যুধিষ্ঠির খেললেন, যুধিষ্ঠির হারলেন, অতি নিন্দিত জুয়াড়িদের চাইতেও অধিক নিন্দিত জুয়াড়ি হয়ে স্বীয় পত্নীকেও পণ রাখলেন; তথাপি যুধিষ্ঠির সৎ, যুধিষ্ঠির নির্দোষ, যুধিষ্ঠির সরল, আর তাঁর সব মন্দকর্মের দায় নিতে হলো দুর্যোধনকে। অবশ্য কর্ণ সোবল্য বাদ গেলেন না।
এরমধ্যে যেটা উল্লেখযোগ্য তা ভীষ্ম এবং দ্রোণের চুপ করে থাকা। তাঁর অর্থ সম্ভবত এটাই যে তাঁরা সেখানে দুর্যোধনের দোষ দেখতে পাননি। সহসা বিদুর তাঁর পক্ষে যতোটা সম্ভব ভদ্রভাষায় বললেন, ‘হে ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ, তোমরা অন্যায় দূতক্রীড়া করেছো। যেহেতু সভামধ্যে স্ত্রী নিয়ে বিবাদ করছো, তোমাদের রাজ্যের কল্যাণ বলে আর কিছুই রইলো না। তোমরা সকলেই কুমন্ত্রণা-পরতন্ত্র হয়েছো। সভামধ্যে অধৰ্মানুষ্ঠান হলে সমুদয় দূষিত হয়। এখন আমার ধর্মবাক্য শ্রবণ করো। দ্যাখো, যদ্যপি যুধিষ্ঠির আত্মপরাজয়ের পূর্বে দ্রৌপদীকে পণ রেখে ক্রীড়া করতেন, তা হলে উনি যথার্থ ঈশ্বর হতেন। কিন্তু অনীশ্বরের নিকট বিজিত ধন, আমার মতে স্বপ্নার্জিত ধনের ন্যায়। অতএব হে কৌরবগণ! তোমরা গান্ধাররাজের বাক্য শ্রবণে বিমূঢ় হয়ে ধর্মচ্যুত হয়ে না।’
দুৰ্যোধন দ্রৌপদীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে যজ্ঞসেনী! ভীম অর্জুন নকুল সহদেবের মতই আমার মত। যদি তারা যুধিষ্ঠিরকে অধীশ্বর বলেন, তাহলে তোমার দাসীত্ব মোচন হবে।’
হঠাৎ ধৃতরাষ্ট্র দুৰ্যোধনকে বলতে লাগলেন, ‘আরে দুবিনীত দুৰ্যোধন। তুই একেবারে উৎসন্ন হলি। যেহেতু কুরুকুলকামিনী, বিশেষত পাণ্ডবগণের ধর্মপত্নী দ্রৌপদীকে সভামধ্যে সম্বোধন করলি।‘
বিদুর বলেছেন, অতএব ধৃতরাষ্ট্রকে ছেলের বিরুদ্ধে কিছু তো বলতেই হবে। এই প্রৌঢ় রাজাটির অবিবেচনা যতো গভীর, দুর্যোধনের দুর্ভাগ্য ততোধিক। দুর্যোধন তাঁর বয়স্ক পুত্র; স্বাবলম্বী, প্রজাবৎসল বলে খ্যাত একজন রাজা। সভার মধ্যে সকলের সম্মুখে পিতাই যদি তাঁর নিন্দায় মুখর হন, এভাবে অসম্মান করেন, তাহলে অন্যেরা বলবে না কেন? পরিজনদের মধ্যে এমনিতেই বিদুর তাঁকে যে চিত্রে চিত্রিত করে রেখেছেন, সেই চিত্র তবে আর কেমন করে মুছে যাবে? প্রচারের সাহায্যে বিদুর তাঁকে যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, তাতে উত্ত্যক্ত হয়ে দুর্যোধন আজ যদি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে মাত্রাজ্ঞান হারান, খুব কি দোষের সেটা?