দুঃশাসনও ‘দাসী’ ‘দাসী’ বলে উচ্চৈঃস্বরে হাসছিলেন। এমনই হাসির রোল যেদিন দুর্যোধনকে ব্যথিত করেছিলো, নিজেকে সেদিন নিশ্চয়ই অতি অসহায় এবং দীন বলে মনে হয়েছিলো তাঁর। আজ দ্রৌপদীকে এই হাসির রোল নিশ্চয়ই তেমনি ব্যথিত ও দীনভাবাপন্ন করে তুলছিলো। কৌরবদের আজকের নির্দয় অভদ্র ব্যবহারের পেছনে মূল কথাটা প্রতিশোধস্পৃহা৷
তবু দ্রৌপদী স্ত্রীলোক, তারা পুরুষ। তদ্ব্যতীত, দুঃশাসন যেভাবে তাঁকে সভার মধ্যে নিয়ে এসেছে বা যেভাবে তাঁর বস্ত্র ধরে টানাটানি করছিলো, সেটা অতীব অভব্য ব্যবহার খুব আশ্চর্য, কেউ তা নিয়ে একটা কথাও বলছিলেন না। দ্রৌপদী ক্ৰন্দন করতে করতে বললেন, ‘হায়, ভরতবংশীয়গণের ধর্মে ধিক। ক্ষাত্রধর্মজ্ঞগণের চরিত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সভাস্থ সমস্ত কুরুগণ স্বচক্ষে কুরুকর্মের ব্যতিক্রম নিরীক্ষণ করছেন, কিন্তু কেউ এদের নিন্দা করছেন না। বোধহয় এদেরও এই কর্মে অনুমোদন আছে। দ্রোণ ভীষ্ম বিদুর, এদের কিছুমাত্র সত্ত্ব নাই। প্রধান প্রধান কুরুবংশীয় বৃদ্ধগণও দুৰ্যোধনের এই অধর্মানুষ্ঠান অনায়াসে উপেক্ষা করছেন।‘
ভীষ্ম বললেন, ‘হে সুভগে! একদিকে পরবশ ব্যক্তি পরের ধন পণ রাখতে পারেন না, অন্যদিকে স্ত্রী স্বামীর অধীন, এই উভয়পক্ষই তুল্যবল বোধ হওয়াতে তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর বিবেচনায় আমরা অসমর্থ। বিশেষত যুধিষ্ঠির আপনার মুখে স্বীকার করছেন, “আমি পরাজিত হয়েছি”। শকুনি দূতক্রিয়ায় অদ্বিতীয়। যুধিষ্ঠির স্বয়ং তাঁর সঙ্গে ক্রীড়া করতে অভিলাষী। তিনি স্বয়ং তোমার এই অবমাননা উপেক্ষা করছেন। আমরা কী করে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি?’
এই জবাবটা ভীষ্মের উপযুক্ত হলো না। এটা কোনো জবাবই নয়। গৃহবধূকে এভাবে টেনে সভার মধ্যে অপমান করা যে অন্যায়, সে কথাটাই তাঁর বলা উচিত ছিলো। যুধিষ্ঠির তাঁকে পণ্য করে যতো অসম্মানই করে থাকুন, সেটা আলাদা। কিন্তু বিনিময়ে যেভাবে এঁরা আক্রোশ মেটাচ্ছেন, তাঁর প্রতিবাদ করা গুরুজনদের কেবলমাত্র উচিতই নয়, কর্তব্য। কিন্তু তা কেউ করেননি। কেন করেননি? তাঁর মানে কি এটাই ধরে নেবো যে দ্রৌপদী স্ত্রী কিংবা পুরুষ এটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিলো না। স্ত্রীলোকের প্রতি আলাদা কোনো সম্মানের প্রশ্ন নেই। যদি তা থাকতো তাহলে দ্রৌপদীকে সভায় এনে সকলের সম্মুখে, বিশেষত যেখানে ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি গুরুজনেরা সকলেই উপস্থিত, সেখানে এই অশালীন আচরণ করার সাহস তাদের কখনোই হতো না। সেকালের সমাজে মাননীয় অতিথি এলে অন্যান্য দ্রব্যের সঙ্গে একজন স্ত্রীলোককেও উপঢৌকন দেওয়া হতো। সেই মনোভাব থেকেই কি দ্রৌপদীকে এভাবে সভার মধ্যে টেনে আনায় তাঁরা কোনো অন্যায় দেখতে পাননি?
আরো একটা কথা ভীষ্ম বললেন, ‘পরবশ ব্যক্তি পরের ধন পণ রাখতে পারেন না, অন্যদিকে স্ত্রী স্বামীর অধীন। এই উভয় পক্ষই তুল্যবল বোধ হওয়াতে তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর বিবেচনায় আমরা অসমর্থ।‘ তাই যদি হয়, তা হলে যুধিষ্ঠিরই তো দ্রৌপদীর একমাত্র স্বামী নন, আরো তো চারজন স্বামী আছেন, তারা কেন কোনো প্রতিবাদ করলেন না? অন্যের স্ত্রীকে পণ রাখার অধিকার যুধিষ্ঠির কোথায় পেলেন? পুরাকালের নিয়ম অনুসারে কনিষ্ঠ ভ্রাতা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অধীন, কিন্তু তাদের স্ত্রীরা নিশ্চয় তাদের স্বামীর অধীন। তাহলে সেই স্বামীরা নিঃশব্দ রইলেন কেন? তারা তো দ্রৌপদীকে পণ রাখেননি। তারা কেন কোনো প্রতিবাদ করলেন না? শেষ পর্যন্ত এটাই মনে হয়, প্রতিবাদ যখন কেউ করলেন না, গুরুজনেরাও নন, সভাস্থ অন্যান্য জনেরাও নন, স্বামীরাও নন, তবে হয়তো দ্রৌপদীর কারো কাছেই মহিলা বলে আলাদা সম্মান পাবার কোনো প্রশ্ন ছিলো না। অথবা জুয়াখেলার নিয়ম অনুসারে, অনুক্ষণ অপমানিত দুর্যোধন আর কর্ণ যা করছিলেন, সেটা কিছু অন্যায় নয়। দুৰ্যোধনের কোনো এক ভ্রাতাই একমাত্র ব্যক্তি যার মুখে একটি প্রতিবাদ উচ্চারিত হলো। বিকর্ণ বললেন, ‘যুধিষ্ঠির ব্যসনাসক্ত হয়ে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন, অধিকন্তু পণ রাখবার পূর্বে তিনি স্বয়ং পরাজিত হয়েছেন, তাতে তিনি স্বত্ববর্জিত হয়েছেন। এসব বিবেচনা করে আমি দ্রৌপদীকে জয়লব্ধ বলে স্বীকার করতে পারি না।’
বিকর্ণর একথা শুনে কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘দেবতারা স্ত্রীলোকদের এক ভর্তাই বিধান করেছেন। দ্রৌপদী সেই বিধি লঙ্ঘন করে যখন অনেক ভতাঁর বশবর্তিনী হয়েছেন, তখন ইনি বারস্ত্রী। সুতরাং সভামধ্যে আনয়ন, বা বিবসনা করা, মোটেই আশ্চর্যের বিষয় নয়।’
দুৰ্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘হে নৃপতে। ভীম অর্জুন নকুল সহদেব তোমার বশীভূত, দ্রৌপদী পরাজিত কিনা তুমিই বলো না।‘ হাসতে হাসতে বসন সরিয়ে উরুতে চাপড় দিলেন। বলাই বাহুল্য, ব্যবহারটা অশালীন।
কিন্তু আশৈশব তিনি বিদুরের বাক্যদংশনে যে জ্বালায় জ্বলেছেন, বিদুরের পরামর্শে পাণ্ডব নামধারী পঞ্চভ্রাতার সঙ্গে যে বৈরীভাব সৃষ্টি হয়েছে, নিঃশব্দে যে গ্লানি, অপমান, অসম্মান, সতত সহ্য করেছেন, এতোদিনে সেই সব অপমানের প্রতিশোধ নিতে পেরে দুর্যোধনের মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলা আশ্চর্য নয়। বিশেষত, মহিলারা যে সমাজে ভোগের সামগ্রী ব্যতীত আর কিছু নয়। বিশেষত, যে স্ত্রী পঞ্চপতিগামিনী।