ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের পরামর্শ নিয়ে বললেন, ‘বিদুর যখন অক্ষবেদনে অনুমোদন করছেন না, তা হলে এসবে প্রয়োজন নেই। তোমার কী অভাব? তুমি রাজপদে প্রতিষ্ঠিত, পৈতৃক রাজ্য বর্ধিত করেছো, প্রতিনিয়ত আজ্ঞাপ্রচার করে দেবেশ্বরের ন্যায় দীপ্তি পাচ্ছো, তবে তোমার দুঃখের বিষয় কী বলো?’
দুঃখের বিষয়টা যে কী সেটা কি দুর্যোধন বলেননি? পুত্রের সেই অসম্মানে পিতা হয়ে তাঁর হৃদয়ে কি কোনো প্রতিক্রিয়া হয়েছে? বেদনার সঞ্চার? অপমানবোধ? কী ভাবে সবাই মিলে তাঁকে উপহাস করলো! দ্ৰৌপদী পর্যন্ত তাঁর প্রতিও দুৰ্যোধনের কি কিছু কম প্রতিশোধস্পৃহা জন্মেছে? প্রতিশোধস্পৃহা কর্ণেরও কিছু আছে বৈকি! কী ভাবে স্বয়ংবর সভায় জাত তুলে কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন দ্রৌপদী, তা কি ভোলা সম্ভব? আর তারপরে কী হলো? যে কন্যা উদ্ধত প্রতিবাদে কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করে অজুর্নকে বরমাল্য দিলেন, তাঁকে বিয়ে করতে হলো পাঁচজনকে। পাঁচজনকে বিয়ে করা মেয়ের পক্ষেই বুঝি নববধূ হয়েও ওরকম নির্লজ্জ হাসি শোভা পায়। যে নারী পাঁচজনের সঙ্গে বিবাহে সম্মতি দেয়, তোকে সমাজ এবং অন্যান্য পুরুষ সন্ত্রমের চোখে দেখে না। সুযোগ পেলে দুর্যোধন তাঁকে ছেড়ে দেবেন না। পিতাকে বোঝানো অসম্ভব, কে শক্র কে মিত্র এটা কারো শরীরে লেখা থাকে না। সেরকম কোনো সাংকেতিক শব্দও নেই। যে যাকে সন্তাপিত করে শুধু সে-ই জানে কে কার শত্রু।
এর পরে আর পিতার সঙ্গে কোনো বিতর্কে গেলেন না দুর্যোধন, কিন্তু নিজের সংকল্প থেকেও চু্যত হলেন না। জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করলেন দুষ্ট লোকের মিথ্যা প্রচারে স্বীয় সম্মানকে পদাহত হতে দেওয়াও একধরনের কাপুরুষতা। ক্ষতি যা করবার বিদুর সেটা ষোলো আনার স্থলে আঠারো আনাতেই পৌঁছে দিয়েছেন। এইবার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এমন কোন দুর্নাম আর তাঁর বাকি আছে যা মুখে মুখে বিদুর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে রটিয়ে বেড়াননি? ধৃতরাষ্ট্র না জানুন, দুৰ্যোধন জানেন বিদুর যতোটাই পাণ্ডবগণের হিতৈষী, ততোটাই ধার্তরাষ্ট্রদের অহিতাকাঙ্খী। স্থির করলেন, হয় অক্ষবেদনে যুধিষ্ঠিরকে আমন্ত্রণ জানাবেন, নচেৎ যুদ্ধে নিহত হবেন। তিনি জানেন, পৌরুষশালী ব্যক্তি পরমার্থের সাপেক্ষ হয়ে স্বকার্য সাধনে প্রবৃত্ত হয় না। কর্তব্যানুষ্ঠান বিষয়ে দুইজনের মত সমান হওয়া নিতান্ত দুর্ঘট। কী ব্যাধি কী মৃত্যু কেউ শ্রেয় প্রাপ্তির জন্য প্রতীক্ষা করে না। অতএব ভবিষ্যৎ কালের অপেক্ষা না করে শ্রেয়স্কর কর্মের অনুষ্ঠান করাই কর্তব্য। দুর্যোধন দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘হয় পাণ্ডবলক্ষ্মী লাভ করবো, নতুবা আমার প্রাণধারণের আবশ্যকতা নেই।‘ পুত্রের এই দৃঢ় কণ্ঠ শ্রবণে ধৃতরাষ্ট্র ভৃত্যগণকে আদেশ করলেন, ‘তোমরা সহস্রস্তম্ভশোভিত হেমবৈদুৰ্যখচিত শতদ্বারবিশিষ্ট ক্রোশায়ত তোরণস্ফটিক নামে এক মহতী সভা শীঘ্ৰ নিৰ্মাণ করো।’
তাই হলো। সুনিপুণ শিল্পীগণ শীঘ্ৰ সভা নির্মাণ করে সমুচিত দ্রব্যসামগ্রীতে সুশোভিত করে স্বল্পকাল মধ্যেই বহুরত্নে খচিত ও বিচিত্র হেমাসনে শোভিত করলেন। সভা সুসম্পন্ন হলো। তারপরেই ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বললেন, ‘তুমি ইন্দ্রপ্রস্থ গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে এসো।
সঙ্গে সঙ্গে বিদুর বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনার এই ইচ্ছে আমি কোনোরকমেই সমর্থন করতে পারছি না। আপনি আমাকে এই অনুমতি দেবেন না। এতে সুহৃদভেদ হয়।’
কথাটা অযৌক্তিক নয়। কিন্তু সুহৃদভেদ হয়েছে বলেই যে এই আয়োজন তা-ও বিদুর জানেন। রাজত্ব পেয়েও তাদের মন থেকে যে দুর্যোধনের প্রতি এক কণা বিদ্বেষও প্রতিহত হয়নি, সেটা অকাট্য সত্য। অতি প্রতাপশালী একজন রাজা, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী, সৈন্যস্থাপনে সুযোগ্য, তাঁর পক্ষে ভীষ্ম আছেন, দ্রোণাচার্য আছেন, অশ্বথামা আছেন, আছেন কর্ণ। সুস্থির হয়ে বসে তবে তো পাণ্ডবরা এদিকে মন দেবেন? সুতরাং দুৰ্যোধনকে তো তারা প্রতিদ্বন্দ্বীর দৃষ্টিতেই দেখবেন। এ অবস্থায় যুধিষ্ঠির যদি জুয়াখেলায় মত্ত হয়ে উঠে হেরে যান, তবে তো সব গেলো। এই ভীতিতেই বিদুর কিছুতেই মত দিতে পারেন না।
কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বললেন, দৈব প্রতিকূল না হলে কলহ আমাদের পরিতাপিত করতে পারবে না। তুমি কুন্তীপুত্রকে গিয়ে নিয়ে এসো।
মহাভারতের মহারণ্যে – ২.০৭
অগত্যা যেতেই হলো বিদুরকে। ইন্দ্রপ্রস্থে পৌঁছে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘ধূতরাষ্ট্র পাশাক্রীড়াচারীদের সম্মেলন ডেকেছেন। তুমি সেই ধূর্ত পাশাক্রীড়াচারীদের দেখবে। আমি ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞাবাহী হয়েই এসেছি। নিবৃত্ত করতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। তত্ৰাচ আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। এখন তুমি যা শ্রেয়স্কর মনে করো, তাই করো।
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘দুর্যোধন ব্যতীত আর কোন কোন অক্ষবিদ সেখানে আছেন বলুন। আমি তাদের শতবার পরাজিত করবো।‘
বিদুর বললেন, ‘অক্ষনিপুণ পাকাহাত শকুনি, বিবিংশতি, চিত্ৰসেন, রাজা সত্যব্রত, জয়, এঁরা সব সেখানে উপস্থিত হয়েছেন।‘
বিদুরের অনিচ্ছা বুঝেও যুধিষ্ঠির যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। দ্রৌপদী প্রভৃতি স্ত্রীগণসহ ভ্রাতাগণসহ অনুচরসহচরবর্গভিব্যাহারে বেশ জাকজমক করেই হস্তিনাপুরে এলেন। সেই রাত্রি সুখে যাপন করে পরের দিন সভামণ্ডপে প্রবেশ করলে শকুনি বললেন, ‘এই সভামধ্যে সকলেই তোমার প্রতীক্ষা করছেন। দূতক্রীড়া আরম্ভ করা যাক।‘