অনুশাসক। ধৃতরাষ্ট্রের জানা উচিত, জন্মের পর থেকে ক্রমশ যেমন শরীরের বৃদ্ধি হয়, সেই রকম যে রাজা সম্পদের ক্রমিক বৃদ্ধি আকাঙ্ক্ষা করেন, তিনিই জ্ঞাতিগণের মধ্যে সমৃদ্ধ হন। পরাক্রমই তৎকালীন উন্নতির উপায়স্বরূপ। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, পাণ্ডবেরা নানা দেশের নৃপতির সঙ্গে বন্ধুতা করে, কৃষ্ণের সহায়তা লাভ করে, জরাসন্ধ আর শিশুপালকে নিধন করে, অতিশয় বলশালী হয়েছেন। উদ্বেগহীনও হয়েছেন। এখন শুধু একটু গুছিয়ে বসা। তাঁর পরের কর্মই হবে ধৃতরাষ্ট্রকে উচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণ অধিকারের জন্য এই রাজ্যের উপর ঝাপিয়ে পড়া। তারপর অখণ্ড রাজ্যের রাজ্যেশ্বর হয়ে সিংহাসনে উপবেশন। পাণ্ডব এবং কুরু এই দুটি নাম কার রচনা সেটা না জানলেও সম্পর্কের মধ্যে এই যে একটা শুষ্ক মরুভূমি তৈরি হয়েছে এটা বিদুরেরই অবদান। সম্পর্কের কথা বাদ দিয়েও, দুর্যোধনের মতো একজন দেশবরেণ্য রাজা যদি এই অপমান সহ্য করে, চোরের মতো ফিরে এসে চুপিচুপি বসে থাকেন, তদপেক্ষা বেশি পরাজয় আর কী হতে পারে? সেই পরাজয় আর মৃত্যু দুই-ই সমান। এর যদি কোনো প্রতিবাদ না করেন তবে তো ওরা তাঁকে সময় সুযোগ মতো সর্বদাই এভাবে তাচ্ছিল্য করবে। অপমান করবে। সুযোগ পেলে চক্রান্ত করে নিধনও করতে পারে। এঁরা তো কৃষ্ণের পরামর্শে সম্মুখ যুদ্ধের অপেক্ষা অন্যায় হত্যার রাজনীতিই অনুসরণ করছে। যদি সুযোগ না থাকে, সুযোগ তৈরি করে নিতে কতোক্ষণ? এই অসম্মানের জবাব তাঁকে দিতেই হবে, সেটা যে উপায়েই হোক।
মহাভারতের মহারণ্যে – ২.০৬
ফিরে এসে ধৃতরাষ্ট্রকে দুর্যোধন জানালেন সেকথা। ধৃতরাষ্ট্রের তাতে কোনো চৈতন্য উদয় হয়েছে বলে মনে হলো না। তাঁর ধারণায় উৎকৃষ্ট অন্নভোজন আর উৎকৃষ্ট বস্ত্রপরিধানই সব। তিনি জানেন না, কাপুরুষেরাই অশনে বসনে পরিতৃপ্ত হয়ে থাকে, অধৰ্মপুরুষেরাই অমৰ্যশূন্য হয়। দুর্যোধন যাদের এতো বড় শক্র, তারাই বা দুর্যোধনের কাছে মিত্র হবেন কেমন করে? তাদের তিনি বিনষ্ট করতে কেন বদ্ধপরিকর হবেন না? যুধিষ্ঠিরের দীপ্যমান রাজলক্ষ্মী, যার গর্বে গর্বিত হয়ে সবাই মিলে তাঁকে এতোখানি যন্ত্রণায়, লজ্জায়, অপমানে দগ্ধ করেছে, সেই রাজলক্ষ্মীকেই বা কেন তিনি কেড়ে নেবেন না? ওরা তাঁর বীরত্ব দেখুক একবার। দুৰ্যোধন লুকিয়ে হত্যা করতে অক্ষম, সেটা তাঁর ক্ষত্রিয় ধর্মের বিপরীত পন্থা। কিন্তু যোদ্ধা হিশেবে বুক ফুলিয়ে দাড়াতে জানেন তিনি। সভাচতুরে জলভ্রমে পরিচ্ছদ উৎক্ষিপ্ত করলে, ওরা তাঁকে শক্রসম্পত্তি দর্শনে বিভ্রান্ত ও রত্নানভিজ্ঞ মনে করে উপহাস করেছিলো। সেই উপহাসের শাস্তি তাদের দিতেই হবে। এজন্যই, অভু্যদয় কালেই শক্ৰদের উপেক্ষা না করে, পরিবর্ধিত ব্যাধির ন্যায় মূলোচ্ছেদ করা উচিত। সামান্য কণ্টকও কালক্রমে ব্রণকারণ হয়ে ওঠে।
মাতুল পূর্বেই বলেছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধে কিছুতেই রাজি হবেন না, বিদুরই দেবেন না সেটা, কেননা এখনো ওরা প্রস্তুত হতে পারেনি।
ঠিকই বলেছিলেন। সব শুনে পিতা বললেন, ‘হে পুত্র! যুদ্ধ করা আমার অভিপ্রেত নয়।’
এরপরে ধৃতরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে আরো নানা বিষয় পর্যালোচনার পরে সেবল নির্জনে বললেন, ‘একটা উপায় আছে যা তোমাকে তোমার মনোমতো স্থানে হয়তো পৌঁছে দিতে পারে। সেটা কোনো গোপন ষড়যন্ত্র নয়, ছদ্মবেশে কারো অন্তঃপুরে প্রবিষ্ট হয়ে কারোকে নিধন করাও নয়, কোনো কাপুরুষের নীতিও নয়। রাজাদের একটা ব্যসন মাত্র। আমি অক্ষবিদ্যায় অভিজ্ঞ, মৰ্মজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ। যুধিষ্ঠির দৃতিপ্রিয়, কিন্তু তদ্বিষয়ে তাঁর নিপুণতা নেই। ক্ষত্রিয় রীতি অনুসারে দূতের নিমিত্ত আহবান করলে তিনি আসবেন, এবং আমি অতি সহজেই তাঁকে পরাস্ত করবো।’
কথাটা দুর্যোধন খুব পছন্দ না করলেও মন্দের ভালো এটাই ভেবে নিলেন। তাঁর ইচ্ছা করছিলো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই অসম্মানের ভালো জবাব দেন। শিশুপাল কৃষ্ণের শত্রু আর দুৰ্যোধন পাণ্ডবদের শত্রু। শিশুপালকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে যেভাবে যথেষ্ট পরিমাণে অপমান করা হয়েছিলো এবং বধ করা হয়েছিলো, সেটা মেনে নেওয়া সহজ নয়। আর নিধন না করলেও চূড়ান্ত অপমান তাঁকেও করা হয়েছে। দুর্যোধন এবং পাণ্ডবগণ একই কুরুবংশের সন্তান হিশাবে গণ্য, পরন্তু যার যার পিতার অংশ তারা তারাই সঠিকভাবে ভোগ করছে। উপরন্তু, এই মুহুর্তে রাজসূয় যজ্ঞ করে পাণ্ডবরা যেখানে পৌঁছেছেন, তাদের ব্যবহার সেই মর্যাদার উপযুক্ত শালীনতাঁর গণ্ডিতে পড়ে না, সদ্বংশের গণ্ডিতে পড়ে না। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে কে বোঝাবে সে কথা?
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, বিদুর আমাদের মন্ত্রী, বিদুর আমাকে যে মন্ত্রণা দেবেন, আমি তাই শুনবো। বিদুর দূরদর্শিতা প্রভাবে উভয় পক্ষের মঙ্গল ও ধর্মানুসারে মন্ত্রণা দেবেন।’ বলাই বাহুল্য, বিদুর সব শুনে দুর্যোধনের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করলেন।
বোঝায়, পুত্রস্নেহে অন্ধ বলতে বোঝায় ধৃতরাষ্ট্রকে। এই সব কটি প্রবাদই নিতান্ত অসত্য। বিদুরের মতো অধাৰ্মিক যেমন সচরাচর দেখা যায় না, দু’একটা অমৃতভাষণ এই পুস্তকে যার মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছে তাঁর নামই যেমন যুধিষ্ঠির, স্বীয় পুত্রকে মরার বাড়া গাল দিয়েও যার হৃদয়ে বিন্দুমাত্র কষ্টের সঞ্চার হয় না, তিনিই হচ্ছেন ধৃতরাষ্ট্র।