শিশুপাল বললেন, ‘হে ভীষ্ম! বৃদ্ধ হয়ে কি তুমি কুলের কলঙ্ক হয়েছো? তোমার কি মতিভ্রম হয়েছে? স্থবিরাবস্থা উপস্থিত হয়েছে? তুমি কি বিচেতন হয়ে দুরাত্মা কেশবের স্তুতিবাদ করছো? যাকে বালকেরাও ঘৃণা করে, তুমি জ্ঞানবৃদ্ধ হয়ে তাঁকে কী ভেবে প্রশংসা করছো? তুমি কি জানো, এই দুরাত্মা কংসের অন্নে প্রতিপালিত হয়ে তাঁকেই সংহার করেছে? অন্নদাতাঁর প্রতি শস্ত্রপাত কি মহাত্মার লক্ষণ? না কি গোপনে হত্যা করা কোনো তেজের লক্ষণ? তাঁকে কি ধর্ম বলে? তুমি কৌরবের প্রধান হয়েছো। ধর্মসঙ্গত বাক্য প্রয়োগ করাই তোমার কর্তব্য। স্তাবকতা নয়।‘
ভীষ্ম বললেন, ‘কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করা থেকে যে সব অলৌকিক কর্মের পরিচয় দিয়েছেন, আমি পুনঃ পুনঃ তাঁর ভূয়সী প্রশংসা শুনেছি এবং আশ্চর্য হয়েছি। অতএব অশেষ গুণবাহুল্যযুক্ত বৃদ্ধ ব্যক্তিদিগকে অতিক্রম করেও কৃষ্ণের অর্চনা করা বিধেয়। কৃষ্ণ যা করেছেন তা কোনো সামান্য ব্যক্তির দ্বারা সম্ভব নয়। হে চেদিরাজ! তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আর যেন কখনো বুদ্ধির এরকম ব্যতিক্রম না হয়। যেন কখনো এরকম গর্ব প্রকাশ না করো।’
হাস্যসহকারে শিশুপাল বললেন, ‘তুমি কি বাসুদেবকে অপার্থিবজ্ঞানে পার্থিবগণকে বিভীষিকা দেখাচ্ছে, না কি পুতনাঘাত প্রভৃতি ক্রিয়াকলাপ কীর্তন করে আমাদের কাছে পরিহাসের পাত্ররূপে প্রদর্শন করছো? ক্রীড়নকের মতো ব্যবহার করছো কেন? বাল্যকালে পক্ষীর ন্যায় আকাশে উড্ডীন তৃণাবর্ত এবং যুদ্ধানভিজ্ঞ অশ্ব ও বৃষভ বিনষ্ট করেছিলো, প্রাণহীন এক কাষ্ঠময় শকট পাদদ্বারা পতিত করেছিলো, অথবা রাশিকৃত অন্নভোজন করেছিলো, বাসুদেবের এই কর্মের মহিমাতেই, হে ভীষ্ম! তুমি সেই গোপ বালকদের মতো বিস্ময়াবিষ্ট হলে? তুমি এখন কৌরবশ্রেষ্ঠ না কৌরবাধম!’
ভীম দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করে মূর্তিমান কালান্তকের মতো অগ্রসর হয়ে এলেন শিশুপালের দিকে।
ভীমের ক্ৰোধ দেখে কুপিত সিংহ যেমন মৃগের প্রতি উপেক্ষা করে থাকে, সেই রকম উপেক্ষা সহকারে হাসতে হাসতে শিশুপাল বললেন, ‘হে ভীষ্ম, একে পরিত্যাগ করো, এই ভীম পতঙ্গকে আমি এখুনি দগ্ধ করছি, উপস্থিত নরপতিরা দেখুন। আর, তোমার মন যদি কেবল পরের স্তুতিবাদ করেই সন্তুষ্ট থাকে, তবে অন্য ভূপালদের স্তুতিবাদ করো। মহাবীর কর্ণের প্রশংসা করো, যিনি অঙ্গ ও বঙ্গদেশের অধ্যক্ষ এবং সহস্রাক্ষসদৃশ বলশালী, যার মহাবাহুর চাপবিকর্ষ অতি ভয়ানক, কুণ্ডলদ্বয় সহজাত, যিনি সত্যি সত্যি বীর, যিনি সম্মুখযুদ্ধে জরাসন্ধকে পরাজিত করেছিলেন। আরো কতো সব অনন্যসাধারণ বীরগণ উপস্থিত আছেন, তাদের প্রশংসা করো না। তাছাড়া সাগর স্বনা পৃথিবীতে যিনি অদ্বিতীয়, সেই রাজেন্দ্র দুৰ্যোধনই তো এখানে উপস্থিত, তাঁকে স্তুতি করতে ইচ্ছা হয় না তোমার? তুমি মোহবশত এদের উপেক্ষা করে ঐ অস্তবনীয় বাসুদেবকে স্তব করছো কেন? তোমার বুদ্ধি প্রকৃতির অনুগত নয়।’
ভীষ্ম বললেন, ‘আমরা গোবিন্দকে পূজা করেছি, তিনিও সম্মুখে বিদ্যমান। বেশ তো, যার নিতান্তই মরণসাধ হয়েছে সে বাসুদেবকে যুদ্ধে আহবান করুক না।’
ভীমের বাক্য শ্রবণমাত্রই শিশুপাল বাসুদেবকে সংগ্রামে আহবান করে বললেন, ‘কই হে, এসো, আমি তোমাকে আহ্বান করছি। সাহস থাকে তো আমার সঙ্গে সংগ্রাম করো। আজ তোমাকে পাণ্ডবগণ সমভিব্যাহারে যমালয়ে প্রেরণ করি। তুমি রাজা নও, তুমি দাস, দুর্মতি, ও পূজার অযোগ্যপাত্র। এই পাণ্ডবরা সেই তোমাকেই অন্য সব মাননীয়কে অবজ্ঞা করে পূজনীয় হিশাবে পূজা দিয়েছে। তাদের বধ করেও এই অপমানের প্রতিশোধ নেবো।’
কৃষ্ণ অতি সত্বর গা ঢাকা দিলেন। পাণ্ডবরাও তাঁকে অনুসরণ করলেন। কৃষ্ণ পাণ্ডবদের নিয়ে অন্যান্য ক্রুদ্ধ ভূপতিদের আড়ালে বসে খুব নিচুস্বরে অতি বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনারা দয়া করে শুনুন, এই সাত্যকিনন্দনের কর্মই হলো যে তাঁর উপকার করে তাঁর অপকার করা। এটাই ওর স্বভাব। এই পাপিষ্ঠ আমাকে অনর্থক পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে। আমার সহচরদের বিনষ্ট করেছে। স্বীয় মাতুল বিশালাপতির কন্যা ভদ্রাকে অপহরণ করেছে। (এখানে পুনরায় উল্লেখ করছি, কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুনও তাঁর মাতুল কন্যা সুভদ্রাকে অপহরণ করেছিলেন। অর্জুনের মাতা কুন্তী বাসুদেবের পিতা বসুদেবের ভগ্নি। সুতরাং সুভদ্রাও তাঁর মাতুলকন্যা।) এই পাপাত্মার কুকর্মের সীমা নেই, দুষ্কর্মের শেষ নেই। তথাপি আমি একে কেন এতোদিন সহ্য করেছি জানেন? এর মাতা আমার নিজের পিতৃস্বসা। তাঁর কাছে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ওর সহস্র অপরাধ ক্ষমা করবো। এখন আপনাদের অবগতির জন্য জানাই আজই ওর সেই সহস্র অপরাধ পূর্ণ হলো। আর আমি ওকে ক্ষমা করবো না।’
নিন্দিতকৰ্মা যাদুকর কৃষ্ণ তাঁর বাকচাতুর্যে যতক্ষণ এইসব ক্রুদ্ধ নৃপতিদের বিভ্রান্ত করে, ব্যস্ত করে, অমনোযোগী করে রাখলেন, সেই সুযোগে শিশুপালবধ সাঙ্গ হলো।
এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, যা পূর্বেই কী ভাবে কী করতে হবে স্থিরীকৃত ছিলো, তাঁর সমস্ত প্রক্রিয়াটাই যুধিষ্ঠিরের অনুমোদনে কৃষ্ণের বুদ্ধিতে যে সংগঠিত হয়েছিলো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যজ্ঞবাড়ির কোলাহল তখন তুঙ্গে। সহস্ৰ সহস্র ব্রাহ্মণ, জ্ঞাতিকুল, সহকারীগণ, নানা দেশ থেকে আগত প্রধান প্রধান সব ক্ষত্রিয়রা ও অমাত্যবর্গ, লোকে লোকারণ্য। সেইসব হট্টগোলে আর দীয়তাং ভূজ্যতাং শব্দে আকাশ পরিব্যাপ্ত। তাঁর মধ্যে কাকে কোথায় কী উদ্দেশ্যে নিয়োগ করে রাখা হয়েছিলো কে লক্ষ করেছে? মন্ত্রণাপ্রদানে সুচতুর বাসুদেব প্রকৃতই অতি দক্ষ। অনবধান ব্যক্তিকে পিছন থেকে লুকিয়ে সংহার করানোই তাঁর ধর্ম। এই হত্যাকাণ্ড অতি নিপুণতাঁর সঙ্গে সাঙ্গ হলো। শব্দসমুদ্রের মধ্যে একটু উচু থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখে খুব কাছে থেকেই কেউ আঘাত করেছিলো শিশুপালকে আঘাতের প্রচণ্ডতা এতো অধিক ছিলো যে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মস্তক বিদীর্ণ হয়ে গেলো। যে গুরভার লৌহচক্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো, কোনো মানুষের পক্ষে সে আঘাত সহ্য করা সম্ভব নয়। চক্রের ফলা অতি সুতীক্ষ ছিলো। মহাভারতে অবশ্য মধুসূদনের চক্র নামক অলৌকিক বস্তুকে নিয়ে আসা হয়েছে কৃষ্ণের গরিমা প্রকট করতে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে শিশুপালের মতো বীরকে বধ করার জন্য নিশ্চয় সেই রকমই এক বলিষ্ঠ গুপ্তঘাতক সংগ্রহ করা হয়েছিলো, যার হাতের জোরও প্রচণ্ড। চোখের পলকে কী ভাবে যে নৃপতিদের অমনোযোগের সুযোগে (যে সুযোগটা কৃষ্ণ দিচ্ছিলেন নিজের ক্ষমতার গল্প শুনিয়ে) ঘটনাটা ঘটে গেলো বোঝাও গেলো না।