এরপর ভীমের সঙ্গে জরাসন্ধের প্রবল যুদ্ধ শুরু হলো। চতুর্দশ দিবসে ধূর্ত কৃষ্ণ ক্লান্ত মগধরাজকে কীভাবে হত করা যাবে জানাতে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে ভীমের দিকে তাকালেন, বললেন, ‘হে ভীম! তোমার যে দৈববল ও বাহুবল আছে, আশু সেটা জরাসন্ধকে প্রদর্শন করাও।‘ বলামাত্র ভীম অব্যবস্থিত, ক্লান্ত, উপবাসী, অসতর্ক, জরাসন্ধকে তাঁর দানবীয় শক্তি দিয়ে উৎক্ষিপ্ত করে ঘূর্ণিত করতে লাগলেন। তারপর হাঁটু দিয়ে চেপে বসে তাঁর পৃষ্ঠদেশ ভগ্ন ও নিষ্পেষণ করে তাঁর পদদ্বয় দুহাতে ধরে দ্বিধা-বিভক্ত করলেন। কৃষ্ণ এবং অর্জুন বসে বসে সেই নারকীয় দৃশ্য উপভোগ করলেন।
অবশ্য আমি যতো সহজে যুদ্ধের শেষ দৃশ্যে এনে ফেলেছি এতো সহজে ভীম এখানে এসে পৌঁছতে পারেননি। কিন্তু সেই বর্ণনায় গিয়ে লাভ নেই। প্রকৃত পক্ষে, কৃষ্ণের লুকিয়ে পালিয়ে থাকা জীবন থেকে এতোদিন মুক্তি ঘটলো। এই কারণেই, এতোকাল পরে, নব পরিচিত এই যুবকদের সঙ্গে তাঁর বাড়াবাড়ি বন্ধুতার কার্যকারণটাও বুঝতে অসুবিধে হলো না। জরাসন্ধকে হত্যা করে এসে তিনি হাঁপ ছাড়লেন। এবং দেশে দেশে রটে গেলো পুরষোত্তম কৃষ্ণ, মহাবল ভীম, অজেয় যোদ্ধা অর্জুন, জরাসন্ধকে নিহত করেছেন।
পাণ্ডবরা যা করেছেন সবই ক্ষাত্রধর্ম বিরুদ্ধ। এভাবে গোপনে কারো অন্তঃপুরে প্রবেশ করে অসতর্ক গৃহস্থকে হত্যা করা, কেবলমাত্র ক্ষত্ৰিয়ই নয়, যে কোনো মনুষ্যের পক্ষেই অতিশয় গৃঢ় অপরাধ বলে গণ্য। প্রথম দিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত পাণ্ডবরা এই কর্মই করে গেছেন। কিন্তু তাতে তাদের কোনো নিন্দা নেই মহাভারতে। আইনত ফাঁসির যোগ্য অপরাধও বীরত্ব বলে ঘোষিত হয়েছে। আমরা পাঠকরা সেটা মেনে নিতে পারি না। যা অন্যায় তা অন্যায়ই, সেটা যিনিই করুন।
মহাভারতের মহারণ্যে – ২.০৪
কৃষ্ণের দুজন শক্রর একজন এই জরাসন্ধ, অন্যজন শিশুপাল। জরাসন্ধ শিশুপাল অপেক্ষা কৃষ্ণের অন্তরে অনেক বেশী ভীতিজনক ব্যক্তি ছিলেন। জরাসন্ধের ভয়েই তিনি লুকিয়ে দ্বারকাবতীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাঞ্চালীর স্বয়ংবর সভাতে গিয়েই তিনি বুঝেছিলেন অৰ্জুন এবং ভীম একত্র হলে তিনি অনেক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটাতে পারেন। দেরি না করে তিনি তাঁদের প্রিয় সখা হয়ে উঠলেন। অনুমান ব্যর্থ হলো না।
এবার যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের পরামর্শে নিৰ্ভয়ে যজ্ঞে নিয়োজিত হলেন। অতঃপর চতুর্দিকে সমস্ত ব্রাহ্মণ এবং রাজগণকে আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ করতে দূত পাঠালেন। সকলেই সে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে চলে এলেন সভাতে। কৃষ্ণের আর একজন শত্রু শিশুপালও এলেন। তিনি যে আসবেন কৃষ্ণ জানতেন। মনে মনে প্রস্তুত হয়ে রইলেন এই ব্যক্তিটিকেও নিধন করার জন্য।
সেটা অবশ্য লিখিত নেই, তবে বুঝতে দেরি হয় না। এবং ঘটনাটা অচিরেই ঘটে গেলো। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, যে পাণ্ডবরা বিদুর ব্যতীত কুরুকুলের আর কারো প্রতিই কোনো আতীয়তা অনুভব করতেন না, হঠাৎ দেখা গেলো কুরুপিতামহ ভীষ্মকে তারা এই বৃহৎ যজ্ঞের একজন বিশিষ্ট গণ্যমান্য কর্তব্যক্তি হিশাবে স্থান দিয়েছেন। অথচ এতোকাল তাঁকে উপেক্ষাই করে এসেছেন তারা। যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অভিষেক, জতুগৃহদাহ, পাণ্ডবদের দগ্ধ হবার সংবাদ, পাঞ্চালরাজের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক, একজন কন্যাকে পাঁচজন ভ্রাতার বিবাহ এতোগুলো ঘটনার মধ্যে কখনোই কুরুকুলপতি পিতামহকে কেউ স্মরণ করেননি। আর কোথাও না হোক, বিবাহ বাসরে তাঁর উপস্থিতি স্বাভাবিক ছিলো। সতেরো দিনের মৃত গলিত পাণ্ডু ও পাণ্ডুপত্নী মাদ্রীকে নিয়ে যখন কুন্তী বহু বৎসর পরে পাঁচটি বড়ো বড়ো পুত্রসহ এলেন, ভীষ্মই তখন তাদের সমাদরে গ্রহণ করে পুরবাসীদের মনকে সংশয়হীন করেছিলেন। পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ বলে গ্রহণ করে কুন্তীর সম্মানও যেমন রক্ষা করলেন, পাঁচটি অজানিত পুত্রদেরও কুরুকুলে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তিনিই তাদের শিক্ষা দিয়েছেন। ক্ষত্রিয়জনোচিত বীর তৈরী করতে দ্রোণাচার্যকে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে গুরু নিয়োগ করেছেন। স্নেহ মমতা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন। কিন্তু কার্যকালে দেখা গেলো বিদুর এবং ব্যাসদেবই পাণ্ডবদের সব।
প্রকৃতপক্ষে ভীষ্ম ছিলেন সত্যবতীর প্রয়োজনের হাতিয়ার। কিন্তু এখন আর কীসের প্রয়োজন? বরং যে উদ্দেশ্যে বিদুর তাদের অজ্ঞাতবাসে রেখে ব্যাসদেবের সাহায্যে মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রকে গদিচ্যুত করবার বাসনায় অন্য কোনো বলশালী রাজার সঙ্গে যুক্ত, সেখানে ভীষ্ম অবশ্যই অপাঙক্তেয়। তদ্ব্যতীত, যে পদ্ধতিতে একজন কন্যা পঞ্চস্বামীর হস্তে সমৰ্পিত হলো, সেই পদ্ধতি আর্যকুলে বা ক্ষত্রিয়কুলে সম্ভবই নয়। আর্য নিয়ম বা ক্ষত্রিয় নিয়ম না মেনে অনার্য অবৈধ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন যেভাবে তাঁর পৌত্র যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের রাজত্বে সর্বময় কর্তৃত্বের আসনে বসাবার রাস্তা সাব্যস্ত করলেন, সেখানে ভীষ্মকে স্মরণ করাও একটা মস্ত বড় বাধা। পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ হলে এই প্রথা অনুসারে বিবাহ করা বা বিবাহ দেওয়া তিনি কি মেনে নিতেন? কিন্তু নিয়েছিলেন। কেন নিয়েছিলেন? তাঁর কারণও কি সত্যবতী? মৃত সত্যবতীকে স্মরণ করে?
অকস্মাৎ দেখা গেল সত্যবতীর দয়ায় অপাঙক্তেয় বৃদ্ধ প্রায়বিস্মৃত ভীষ্মকে পাণ্ডবরা অতিশয় সম্মান দেখিয়ে সেই যজ্ঞে আহবান করে একজন প্রধান ব্যক্তি হিশেবে নিয়ে এসেছেন। সম্ভবত কৃষ্ণের পরামর্শেই সেটা করেছিলেন তারা, এবং নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য ছিলো। নচেৎ এতোকাল পরে এ বৃদ্ধকে তাদের কী দরকার? কিন্তু যতোই নিস্তাপ হয়ে যান না কেন, তিনি খাঁটি ক্ষত্রিয় তো বটে। এই আগুন কখনো নির্বাপিত হয় না। একটু খুঁচিয়ে বাতাস দিলেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। এই সত্য কৃষ্ণের বুদ্ধির অন্তর্গত হওয়াই স্বাভাবিক। এতোবড়ো যজ্ঞসভায় এই রকম ক্ষত্রিয় বীরকে সহায় পাওয়া প্রয়োজন। তাঁকে হাতে রাখার জন্য কৃষ্ণ অবশ্যই অনেক মধুর ব্যবহার এবং অনেক মধুর বাক্য বিনিময়ে সম্মোহিত করে ফেলেছিলেন ভীষ্মকে। এসব কথা লিখিত না থাকলেও অলিখিত সত্য বলে ধরে নেওয়া যায়। যজ্ঞের শুরুতে প্রধান পদের মর্যাদায় স্থিত ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ঋত্বিক, সম্বন্ধী, স্নাতক এবং প্রিয় ব্যক্তি এঁরাই অৰ্ঘাৰ্হ। এদের সকলের জন্যই এক একটি অর্ঘ্য নিয়ে এসো।’