পিতাকে বিষন্ন দেখে এবং তার কারণ জেনে পুত্র দেবব্রত, পিতার প্রিয়চিকীয়ঁ পুত্র দেবব্রত, সব শর্ত পালনে সম্মত হয়ে সত্যবতীকে নিয়ে এলেন পিতার কাছে। সত্যবতীর দূরদর্শিতা প্রথম থেকেই সীমাহীন। সেজন্যই, কেবলমাত্র তার গর্ভজাত পুত্রই যে সিংহাসনে বসবে সেই শর্তেই থেমে না থেকে, দেবব্রতর সন্তানও যাতে সিংহাসনের দাবিদার না হতে পারে তেমন প্রতিজ্ঞাই করিয়ে নিলেন দেবব্রতকে দিয়ে। দেবব্রত সেই শর্ত মেনে নিয়ে ঘোষণা করলেন, তিনি কখনো বিবাহ করবেন না।
সেই থেকেই তার ‘ভীষ্ম’ আখ্যা লাভ। কিন্তু এর মানে কি এই নয় যে শান্তনুর মৃত্যুর পরে সত্যবতী স্বীয় বংশ ভিন্ন অন্য কোনো রক্তের চিহ্ন রাখবেন না?
তাই হলো। আঁটঘাঁট বেঁধেই তিনি এসেছিলেন এই প্রাসাদের সর্বময়ী কত্রী হয়ে রূপেগুণে ঈর্ষাযোগ্য মহাভারতের শ্রেষ্ঠ আর্য যুবকটিকে সেই কারণেই তার স্বার্থসিদ্ধির বলি হতে হলো। মহাভারতের অজস্র ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে এটা এমন একটি ঘটনা যার গুরুত্ব দ্বৈপায়ন তেমনভাবে না দিলেও, তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী, এবং তাৎপর্য গভীর।
আমরা দেখতে পেলাম, যে সত্যবতী দেবব্রতর জীবনকে সমস্ত দিক থেকে পঙ্গু করে সমগ্র সুখের সুবর্ণ ফটকটি বন্ধ করে দিলেন, পরবর্তীকালে দেবব্রত সেই সত্যবতীরই একান্ত অনুগত একজন আজ্ঞাপালনের বাহকমাত্র। এসব অকল্পনীয় ঘটনা পড়তে পড়তে মনে হয় ভাগ্য আর পুরষকারের মধ্যে ভাগ্যই প্রধান ভাগ্যচক্রের ঘূর্ণায়মান চক্রটিকেই বড়ো আসন দিতে হয়। বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, এই কাহিনীর নায়িকা সত্যবতীর ইচ্ছা নামের তরণীটিকে যিনি অবিরাম অনুকূল বায়ুপ্রবাহে বাহিত হবার সুযোগ দিয়েছেন তার নাম ‘ভীষ্ম’ আখ্যাধারী দেবব্রত। তিনি তার ত্যাগ ও ঔদার্যের বিনিময়ে এই নিষাদ রমণীটিকে কুরুকুলের মহারানীর সিংহাসনে বসিয়ে পিতাকে সন্তষ্ট করেই ক্ষান্ত হননি, তার সুখের জন্য নিজেকেও উৎসর্গ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, সত্যবতী দেবব্রতকে অগ্রবর্তী করেই সমগ্র কার্য, যা যা তিনি সম্পন্ন করতে সংকল্প করেছিলেন, সবই নির্বিবাদে সমাধা করতে সক্ষম হয়েছেন।
মহারাজা শান্তনুর সঙ্গে সত্যবতীর বিবাহের পরে অবশ্য অনতিদীর্ঘকালের মধ্যেই দেখা গেলো দেবব্রত যেন মুছে গেছেন সব কিছু থেকে। সেটা তার স্বীয় সুখের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন দেখেই নিজেকে নিজে সরিয়ে নিয়েছিলেন, অথবা দ্বৈপায়ন আর তাঁকে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই বোধেই পরিত্যাগ করেছিলেন, জানি না। কিন্তু শান্তনুর ইহলীলা সংবরণের অচিরকালের মধ্যেই দেখা গেলো আবার তিনি রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ। এবং তার কারণও সত্যবতীই।
শান্তনুর ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে যে দুটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিলো তার একজন তখনো বালক, অন্যজন অযোগ্য। এই অবস্থাতেই ছেলেদের রেখে শান্তনু লোকান্তরিত হন। সত্যবতী তার বড়ো পুত্রটিকে রাজপদে বসান। চিত্রাঙ্গদ অতিশয় বলবান ছিলেন, অত্যন্ত দাম্ভিকও ছিলেন। সকলকেই নগণ্য জ্ঞান করতেন। একদিন গন্ধৰ্বরাজ বললেন, ‘সবাইকেই নিকৃষ্ট ভাবো, আমার নাম আর তোমার নাম এক। তুমিও চিত্রাঙ্গদ, আমিও চিত্রাঙ্গদ। আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো, দেখি কে জয়ী হয়।’ আস্ফালন করে গন্ধর্বরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর অহংকারই তাঁকে নিহত করলো। নিজের পুত্রকে চিনতে সত্যবতীর দেরি হয়নি, এবং সেই কারণেই তিনি বুঝেছিলেন, এই পুত্রকে যদি কোনো দক্ষ শাসক পরিচালনা না করেন তবে রাজত্ব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। স্বভাবতই, দেবব্রত ব্যতীত সুচারুরূপে এই রাজ্য শাসন আর কারো দ্বারা সম্ভব নয়। অতএব সত্যবতী বাধ্য হয়েই পিছন থেকে রাজ্য চালনার গুরুভার তার হস্তে ন্যস্ত করলেন। চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পর অপ্রাপ্তবয়স্ক বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে পুনর্বার সেই পুতুল নিয়েই সত্যবতীর অনুজ্ঞাক্রমে রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন ভীষ্ম।
সত্যবতী স্বীয় স্বার্থের প্রয়োজনে দেবব্রতকে ডেকে আনলেও দেবব্রতর বাধ্য হবার কোনো দায় ছিলো না। রাজত্ব যেন কোনোক্রমেই গঙ্গাপুত্র দেবব্রতর, অথবা তার বংশধরদের হস্তগত না হয়, সেজন্য সত্যবতী দেবব্রতকে দিয়ে যা যা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন, তারপরে দেবব্রত কেন নতমস্তকে সত্যবতীর নির্দেশ শিরোধার্য করে নিলেন তার কোনো কারণ দেখতে পাই না। তবে কি যে মোহিনী মায়ায় মহারাজা শান্তনু আবদ্ধ হয়েছিলেন, সেই মোহিনী মায়ায় সত্যবতী। তার পুত্র দেবব্রতকেও বন্দী করেছিলেন? সত্যবতী তাঁকে যে-ভাবে ব্যবহার করেছেন, এবং ওইরকম একটি কনককান্তি দ্বিতীয়রহিত বীর যুবক যে-রকম মন্ত্রমুগ্ধের মতো ব্যবহৃত হয়েছেন, দুয়ের চেহারা একে অন্যের পরিপূরক। জানতে ইচ্ছে হয় সত্যবতী বিষয়ে দেবব্রতর অন্তরে কী চেতনা কাজ করতো। কেন তিনি তার জীবন যৌবন ক্ষমতা এই হস্তিনাপুরের অভ্যন্তরে নিঃশেষ করলেন? তদ্ব্যতীত, পিতার মৃত্যু পর্যন্তই বা কেন এমন নিঃশব্দে আত্মগোপন করে রইলেন?
কুরুকুলের ভাগ্যদোষে শেষ পর্যন্ত সত্যবতীর সব আকাজক্ষা পূরণের প্রধান সহায় হলেন দেবব্রত। সত্যবতী যদি যন্ত্রী হন, দেবব্রত তাহলে যন্ত্র। আর এই যন্ত্রের যন্ত্রী হয়ে সত্যবতী। অতঃপর যে সুর বাজাতে সক্ষম হয়েছেন সেই সুরেই রচিত হয়েছে এ কাহিনী। এই পুস্তক। যে পুস্তকের নাম মহাভারত যে পুস্তককে বলা হয় পঞ্চম বেদ। তপোবনে সনাতন বেদশাস্ত্রের সারোদ্ধার করে এ পবিত্র গ্রন্থের জন্ম। যে গ্রন্থের যুদ্ধকে বলা হয় ধর্মযুদ্ধ। এবং যার তুল্য মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না।