যুধিষ্ঠিরের ভীতি দেখে কৃষ্ণ যে বিষয়ে অতি দক্ষ, নিভৃতে সেই পরামর্শটি দিলেন। বললেন, ‘একটা উপায় আছে, যদি আজ্ঞা করেন তো বলি।‘
যুধিষ্ঠির উৎসুক হলেন। কৃষ্ণ বললেন, ‘দেখুন, আমি নীতিজ্ঞ, ভীমসেন বলবান, এবং অর্জুন আমাদের রক্ষক। অতএব, তিন অগ্নি একত্র হয়ে যেমন যজ্ঞ সম্পন্ন করে, তেমনই আমরা তিনজন একত্র হয়ে জরাসন্ধের বধসাধন করবো। আমরা তিনজন নির্জনে আক্রমণ করলে জরাসন্ধ নিশ্চয়ই একজনের সঙ্গে সংগ্রাম করবে। সে অবমাননা, লোভ ও বাহুবীর্যে উত্তেজিত হয়ে ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করবে সন্দেহ নেই। তখনি ভীমসেন তাঁকে সংহার করতে পারবে।’
কী অন্যায়! এর নাম কি বীরত্ব? কিন্তু এঁরাই মহাভারতের শ্রেষ্ঠ বীর বলে বর্ণিত। কোনো রাজা বা রাজপুত্র কখনো এভাবে শক্রসংহার করে না, তাতে তাদের অপমান হয়। এবং কৃষ্ণও জানেন জরাসন্ধও করবেন না। ধর্মত দুর্যোধনও এই ধরনের কর্ম কখনও ভাবতে পারবেন না। কিন্তু যিনি মহাত্মা ধর্মাতা যুধিষ্ঠির, তিনি এই প্রস্তাবে ভীষণ খুশি হলেন। লুকিয়ে কোনো অন্তঃপুরে ঢুকে, তাঁর আতিথ্যে সামাদৃত হয়ে, সহসা সেই মানুষকে তাঁর অসতর্ক মুহূর্তে খুন করার মধ্যে যে যথেষ্ঠ পরাজয় আছে, অন্যায় আছে, অধর্ম আছে, একবারও সে কথা তাঁর মনে হলো না। যে কোনো বীরের পক্ষে সেই অপমান মৃত্যুর অধিক। মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের মন কিন্তু এই প্রস্তাব অসততার চূড়ান্ত বলে বর্জন করলো না।
আর এদিকে অর্জুনের মতো একজন মহাবীরের কাছেও সেই প্রস্তাব কাপুরুষতার নামান্তর হিশেবে গণ্য হলো না। ইতিহাস যাঁকে ধর্মের ধ্বজা বলে চিহ্নিত করেছে এবং যাঁকে বীরত্বের শেষ সীমা বলে প্রচার করেছে, তাদের দুজনের একজনও এই বুদ্ধিকে কুবুদ্ধি বলে বর্জন করলেন না। বীরশ্ৰেষ্ঠ অৰ্জুন ও মহাবীর ভীম চুপ করে রইলেন, শ্রেষ্ঠ ধাৰ্মিক যুধিষ্ঠির বললেন, ‘তুমি প্রজ্ঞা নীতি বল ক্রিয়া ও উপায় সম্পন্ন। অতএব ভীম ও অর্জুন কার্যসিদ্ধির জন্য তোমাকেই অনুসরণ করুন।’
যিনি প্রকৃত বীর তিনি যে কখনোই বীরত্বকে অবমাননা করেন না, কৃষ্ণ সেটা জানেন। সেটা তাঁদের পক্ষে অপমান, আমর্যাদা, এবং অধৰ্ম। নচেৎ, কীরূপে জ্ঞাত হলেন যে নিরুপায় লোকটিকে তিনজনে আক্রমণ করলেও তিনি সর্বাপেক্ষা যিনি বলবান তাঁর সঙ্গেই যুদ্ধ করবেন? একজন বীরশ্রেষ্ঠর পক্ষে সেটাই তাঁর যোগ্যতাঁর সম্মান এবং প্রমাণ। সারা মহাভারত ভর্তি কোটি কোটি অক্ষরের প্রকাশ্যে যাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হিশেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেই অর্জুন কিন্তু যুদ্ধের সময় প্রকৃতপক্ষে কোনো বড়ো যোদ্ধার সঙ্গেই শঠতা ব্যতীত বীরত্বের প্রমাণ দেননি। আর যিনি ধর্মাত মহাত্মা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, তিনি নিজে অক্ষম হয়েও, অপরের পারঙ্গমতাঁর সাহায্যে তাঁর নিজের লোভ চরিতার্থের জন্য যে কোনো পাপকর্মে অন্যদের লিপ্ত হতে দিতে মুহুর্তমাত্র দ্বিধা করেননি। যে কৰ্ম করতে কর্ণ এবং দুর্যোধন ঘৃণা বোধ করতেন, লজ্জা বোধ করতেন, এঁরা সেটা অনায়াসে করেন।
মহাভারতের মহারণ্যে – ২.০৩
পরামর্শের পরে কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে মগধপুরে গমন করলেন। পথে যেতে যেতে নানাবিধ অন্যায় কর্মে নিরত করলেন নিজেদের। সারি সারি সব দোকান শূন্য করে ফেলে দিলেন, কাউকে কুবাক্য বললেন, তারপর দ্বারদেশে এসে নগরচৈত্যের সম্মুখে উপস্থিত হলেন।
জরাসন্ধ বৃষরূপধারী দৈত্যকে সংহার করে তাঁর চর্ম দিয়ে তিনটি ভেরী প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। সেই ভেরীতে একবার আঘাত করলে একমাসব্যাপী গম্ভীর ধ্বনি অনুরণিত হতো। মহারাজা নিজপুরীতে সেই ভেরী তিনটি রেখেছিলেন। ভেরীগুলো এঁরা ভেঙে ফেললেন। তারপর নিজেদের অস্ত্র-শস্ত্র পরিত্যাগ করে জরাসন্ধের সঙ্গে বাহুযুদ্ধ করবার জন্য পুরপ্রবেশ করে জরাসন্ধের নিকট সমুপস্থিত হলেন।
মহারাজা জরাসন্ধ তাদের দেখে ব্রাহ্মণ ভেবে সত্বর গাত্ৰোত্থান করে, মধুপর্ক ইত্যাদি দ্বারা পাদ্য পূজা করে, স্বাগত প্রশ্ন করলেন। ভীম আর অর্জুন চুপ করে রইলেন। কৃষ্ণ বললেন, ‘হে রাজেন্দ্র। এঁরা নিয়মস্থ। এঁরা এখন কথা বলবেন না। এঁরা পূর্বরাত্রি অতীত হলে আপনার সঙ্গে আলাপ করবেন।‘ ভেবে দেখুন কী সহজে মিথ্যে কথা বলতে পারেন কৃষ্ণ!
সেদিন কোনো পূজা নিবন্ধন মহারাজা জরাসন্ধ উপবাসী ছিলেন। একথা শুনে তাঁদের যজ্ঞাগারে রেখে স্বীয় গৃহাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হলেন। কিন্তু কোনো স্নাতকব্রাহ্মণ অর্ধরাত্র সময়ে উপস্থিত হলে তিনি তৎক্ষণাৎ গমন করলেও প্রত্যুদগমন করতেন। অর্ধরাত্রে এসে পুনরায় তিনি তিনজনের সমীপে উপস্থিত হয়েই পূজা করলেন। একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘হে বিপ্রগণ! আমি জানি স্নাতকব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণগণ সভাগমন ব্যতীত কখনো মাল্য বা চন্দন ধারণ করেন না। আপনারা কে?”
কৃষ্ণ বললেন, ‘হে বৃহদ্রথনন্দন! ধীর ব্যক্তিগণ শক্ৰগৃহে অপ্রকাশ্যভাবেই প্রবেশ করে। আমরা স্বকার্য সাধনাৰ্থে শত্রুগৃহে প্রবেশ করেছি।‘
জরাসন্ধ বললেন, ‘হে বিপ্রগণ! আমি কখন আপনাদের শক্রতা করেছি? কী নিমিত্ত আমাকে শত্রু বলে স্থির করলেন? আমি সতত স্বধর্ম সাধনে নিয়ত থাকি। প্রজাদের ব্যথিত করি না। নিশ্চয়ই আপনাদের কোনো প্রমাদ ঘটেছে।‘
গভীর রাত্রির নির্জন মুহূর্তে দুটি বলবান যোদ্ধার আশ্রয়ে সাহসী হয়ে উঠে কৃষ্ণ স্বমূর্তি ধারণ করে বললেন, ‘তোমাকে কপট সংহার করতেই আমরা এখানে এসেছি। আমরা ব্রাহ্মণ নই। আমি বসুদেবনন্দন কৃষ্ণ, এঁরা দুজন পাণ্ডুতনয়।’