বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের আদেশানুক্রমে বিবিধ রত্ন ধনসম্পত্তি নিয়ে দ্রুপদ ও পাণ্ডবদিগের সন্নিধানে উপনীত হলেন। দ্রুপদও বিদুরকে সাদর সম্ভাষণপূর্বক আদর অর্ভ্যর্থনা করলেন। বিদুর পাণ্ডবদের স্নেহভরে আলিঙ্গন করলেন। অতঃপর তিনি তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য জানালেন।
দ্রুপদরাজ খুশি হয়েই কন্যাকে তাঁর শ্বশুরালয়ে পাঠাতে রাজি হলেন। বললেন, ‘কৌরবগণের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ হওয়াতে আমার যথেষ্ট পরিতোষ জন্মেছে। পাণ্ডবগণের স্বদেশগমন করাই আমার মতে উচিত। কিন্তু আমি স্বয়ং এদের এ স্থান থেকে বিদায় করতে পারি না। এদের পরম প্রিয়কারী বাসুদেব যদি সম্মত থাকেন তা হলে এঁরা স্বরাজ্যে গমন করুন। আমার কোনো আপত্তি নেই।‘
এইসব কথাবার্তার পরে কৃষ্ণা-কুন্তীকে নিয়ে পাণ্ডবগণ হস্তিনাপুরে এলেন। গুরুজনদের পাদবন্দনার পরে ধৃতরাষ্ট্র সস্নেহে তাঁদের বিশ্রাম করতে বললেন। কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামের পরে ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্ম তাদের আহবান করলেন। ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘বৎস! তুমি ভ্রাতৃগণের সঙ্গে আমার বাক্য শ্রবণ করো। তোমরা রাজ্যের অর্ধাংশ গ্রহণ করে খাণ্ডবপ্রস্থে গিয়ে বাস করো। তাহলে দুর্যোধনাদির সঙ্গে তোমাদের পুনরায় বিবাদ হবার আর সম্ভাবনা থাকে না।’
পিতৃব্যের আজ্ঞানুসারে পাণ্ডবগণ তাই করলেন। সঙ্গে কৃষ্ণও ছিলেন। খাণ্ডবপ্রস্থে এসে নগরের সৌন্দর্যে তাঁরা মোহিত হয়ে গেলেন। নগরটি অতি সুরক্ষিত। সমুদ্রসদৃশ পরিখা দ্বারা অলংকৃত। গগনস্পশী প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। অস্ত্রশস্ত্রে সুরক্ষিত ও সুশোভিত। এই পরম রমণীয় প্রদেশে কুবের গৃহতুল্য ধনসম্পন্ন কৌরবগৃহ বিরাজিত।
পাণ্ডবগণ এই অপূর্ব নগরীটি দেখে অতিমাত্রায় পুলকিত হলেন, এবং অত্যন্ত সুখে বাস করতে লাগলেন। কৃষ্ণ কিছুদিন তাদের সঙ্গে বাস করে স্বগৃহে ফিরে গেলেন। যুধিষ্ঠির অনায়াসে ভ্রাতাদের বীরত্বে সমস্তই, এমন কি দ্রৌপদীর মতো পত্নীটিকে পর্যন্ত পেয়ে, মহা আনন্দে রাজা হয়ে সিংহাসনে অধিরূঢ় হলেন। দিন সুখেই কাটতে লাগলো।
মহাভারতের মহারণ্যে – ২.০২
খাণ্ডবদাহন পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণ এবং অর্জুন শিল্পকর্ম বিশারদ ময়দানবের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। একদিন ময়দানব এসে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানাতে যুধিষ্ঠিরের জন্য একটি উৎকৃষ্ট সভা নির্মাণ করে দেবার অভিলাষ জানালো। এ কথায় দুজনেই প্রীত হয়ে সম্মতি জানালে, ময়দানব বহু পরিশ্রম করে এমন একটি সভাস্থল নির্মাণ করলো যে-সভা ভূমণ্ডলে আর কারো নেই। নিজের কোনো যোগ্যতা না থাকলেও, ঈশ্বর যাকে সমস্ত রকম সুখ সম্মান আহ্লাদ দিতে ইচ্ছে করেন, সে অবশ্যই ভাগ্যবান। তাঁর আর কোনো পুরস্কারের প্রয়োজন হয় না। অবিশ্রান্ত ভাগ্যই তাঁকে সমস্তরকম সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে ঘিরে রাখে। যুধিষ্ঠির সেই অলৌকিক অসাধারণ ভাগ্য নিয়েই জন্মেছিলেন। ভ্রাতাদের প্রসাদেই তিনি সব কিছুর অধিকর্তা। অতএব ময়দানবের তৈরি তুলনাহীন সভাটিতেও তিনিই বসবার অধিকারী হলেন। বিদুরের বুদ্ধিতে পা ফেলে ফেলে চলে, ব্যাসদেবের সহায়তায়, অৰ্জুনের বীরত্বে, ভীমের বলে, আজ তিনি অদ্বিতীয়া রূপবতী পত্নীর পতি হয়ে যেন যাদুবলে এমন একটি রাজ্যের এমন এক আশ্চর্য সভার সর্বাধিপতি। অথচ এতো কিছু পাবার জন্য একটি আঙুলও তাঁকে নাঁড়তে হয়নি।
অনুপার্জিত ক্ষমতায় পার্থিব সুখসমৃদ্ধির তুঙ্গে উঠে যুধিষ্ঠিরের লোভ আরো উর্ধ্বগামী হলো। মনে মনে তাঁর সম্রাট হবার বাসনা উদিত হলো। ক্রমে ক্রমে সেই ইচ্ছা তাঁকে অস্থির করে তুললো। রাজসূয় যজ্ঞ করবার বাসনায় তিনি যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। মন্ত্রিগণ ও অনুজদের আহবান করে বললেন সেকথা। পরামর্শ করবার জন্য কৃষ্ণকেও দূত পাঠিয়ে আনয়ন করলেন। কৃষ্ণ যথাসম্ভব শীঘ্র এসে উপস্থিত হলেন। যখন শুনলেন যুধিষ্ঠির রাজসূর যজ্ঞ করবার জন্য লালায়িত হয়েছেন, ভিতরে ভিতরে সম্ভবত তাঁর মন আনন্দে কম্পমান হলো। বোধহয় তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে হলো যা তিনি চেয়েছেন এঁদের সঙ্গে বন্ধুতার বিনিময়ে, সেই সুযোগ সমুপস্থিত। বললেন, ‘একটা কথা, যজ্ঞ যদি নির্বিঘ্নে সমাপন করতে চান, তা হলে আপনার প্রথম কর্তব্য হবে জরাসন্ধকে নিধন করা।’
যুধিষ্ঠির অনুজদের দিকে তাকালেন। সাধ-আকাঙ্ক্ষা যুধিষ্ঠিরের, যাঁরা মেটাবেন তাঁরা ভ্রাতারাই। তিনি যে অযোগ্য তা তিনি জানেন। এ পর্যন্ত যা হয়েছে বা যা হতে পেরেছে সব কিছুর জন্য তো ভ্রাতাদের অনুকম্পাই তাঁর সম্বল। ভ্রাতারা কৃষ্ণের দিকে তাকালেন। কৃষ্ণ বললেন, ‘মহীপতি জরাসন্ধ স্বীয় বাহুবলে সমস্ত ভূপতিগণকে পরাজিত করে, তাদের দ্বারা পূজিত হয়ে, অখণ্ড ভূমন্ডলে একাধিপত্য স্থাপন করেছে। তাঁকে পরাজিত করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।”
তৎক্ষণাৎ যুধিষ্ঠির ভয় পেলেন। বললেন, ‘হায় হায়! আমি তো তোমারই বাহুবল আশ্রয় করে আছি। যখন তুমিই জরাসন্ধকে ভয় করো, তখন আমি নিজেকে কী করে বলবান মনে করবো?’ এই পঞ্চভ্রাতা এতোদিন বিদুরের চাতুর্যে ও ব্যাসদেবের সহায়তায় এইখানে এসে পৌঁছেছেন। এর মধ্যে জতুগৃহে অগ্নি প্রজ্বলিত করে কতোগুলো ঘুমন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা ব্যতীত তাদের নিজেদের অন্য কোনো কৃতিত্ব মাহাত্ম্য বা বীরত্বের কোনো প্রমাণ ছিলো না। একমাত্র অর্জুনের লক্ষ্যভেদটাই উল্লেখযোগ্য। সেখানেও তিনি অদ্বিতীয় নন। অর্জুনের পূর্বে সেটা কর্ণই করেছিলেন।